জয়নালের বউটা সুন্দর।
জয়নাল রিকশা চালায় বগুড়া শহরে। সাত ভোরে একপেট পান্তা গিলে ভাড়ার গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শহর অভিমুখে। ওর বাড়ি থেকে শহরের রাস্তা এগালো কিলো। সাত কিলো ওকে খালি রিকশাই বেয়ে আসতে হয়। ঝোপগাড়ী থেকে ভিএম স্কুলের এক ছাত্রীকে নিয়ে সে শহরে আসে নিয়মিত। তারপর আর বিশ্রাম নেই।
মাটিডালি, উপশহর, সাতমাথা, রহমান নগর, সূত্রাপুর, সেউজগাড়ীসহ সারাশহর চষে বেড়ায় রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত। মাঝে দুপুর বেলা কোনো এক রাস্তার পাশে সস্তা হোটেল খেয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়। রিকশার চাকায় তালা মেরে পৌর উদ্যানের সবুজ ঘাসের ওপর গামছা বিছিয়ে ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে নেয়। শরীরটা একটু ঠাণ্ডা হলে আবার রিকশায় পেডেল মারে জয়নাল। একটানা রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত ভাড়া খেটে সোজা বাড়ির পথ ধরে। ফেরার সময় বাজার থেকে আধসের বাসি মাছ অথবা মাংস নিয়ে যায় গামছা পেঁচিয়ে। বউয়ের জন্য কোনোদিন তেঁতুলের আচার, কোনোদিন দুটো রসগোল্লা কিনে নিয়ে যায়।
জয়নালের ফেরার প্রতীক্ষায় হেরিকেন জ্বলিয়ে রাত জেগে চৌকির ওপর বসে থাকে ওর বউ পরী বানু। জয়নাল মাছটা, লাউটা, কচুটা নিয়ে এলে কুপির আধো আলোয় সেগুলো কেটে কুটে চুলোয় ভাত চড়ায়। ততক্ষণে জয়নাল কলতলায় গিয়ে সারা গায়ে গন্ধওয়ালা সাবান মাখে। সারাদিনের ক্লান্তি অতিরিক্ত জল ঢেলে ধুয়ে ফেলে। ভাত হলে মাঝরাতে রাক্ষুসে পেটে তিন থালা গরম ভাত গপাশ গপাশ করে চালান করে দেয় জয়নাল। ভাত খেয়ে একটা বিড়িতে টান দিতে দিতেই শরীরটা আবার ভারী হয়ে ওঠে।
ব্যথাযুক্ত শরীর নিয়ে ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় জয়নাল। সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রাদেবীর রাজ্যে বিচরণ করতে থাকে সে। এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে মাঝরাতে আর বউয়ের সঙ্গে খুশুর খুশুর করে গল্প করতে ইচ্ছে করে না ওর। বিয়ের প্রথম প্রথম ওসব করতো। এখন আর তেমন ইচ্ছে করে না। কাল আবার সকালে উঠতে হবে। শহরে যেতে হবে। বউ পরীবানু কোনো রাতে একা একা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেঁদে কেটে বুকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শুয়ে পড়ে জয়নালের পাশে। কোনো রাতে জেগেও থাকে ভোর পর্যন্ত।
কোনোদিন দরজা খুলে বারান্দায় এসে গাছ আর প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে। আকাশ আর বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। এখন এভাবেই দিন কাটে জয়নাল আর পরীবানুর। মাস যায়। বছর যায়।
জয়নালের পরিবার ভালোো। তিন ভাই দুই বোনের সবাই শিক্ষিত। জয়নাল চতুর্থ। সবাই বিয়ে শাদী করে যে যার সুখের সংসার পেতেছে। জয়নালের খোঁজ খবর কেউ নেয় না তারা। যে যার মতো। পোড়া কপাল জয়নালের। বুদ্ধি কম বলে ভাই-বোনদের মধ্যে সে একাই অশিক্ষিত থেকে গেছে। কিশোর বেলায় পড়ালেখা না করে এ গেরাম সে গেরাম আবড়ে দাবড়ে বেড়িয়েছে জয়নাল। সুন্দরী মেয়েদের গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে দিন পার করেছে। একবার এক বিড়িওয়ালীকে জমির আইলের সঙ্গে ধরেছিল ঠেসে। সেবার গেরাম শুদ্ধ হৈ চৈ পড়ে গেলো। পাড়ার লোকজন জয়নালের বাপকে এসে বলে, অ সলিমদ্দি, তর এ পোলাডা এমুন অইল ক্যা? অহনও সময় আছে। ভালোা দেইখ্যা একখান মাইয়া দ্যাখ। বউ পাইলে পোলাডার মাথা ঠিক অইব।
পাড়ার লোকজনের কথা কাজে লাগে। চার ক্রোশ দূরে গরিব ঘরের এক ‘চান্দের লাহান মাইয়ার’ সঙ্গে একদিন ঠাস করে বিয়ে হয় জয়নালের। সুন্দরী বউ পেয়ে জয়নালের আউলা মাথা ঠাণ্ডা হয়। গেরামের লোকজন জয়নালের বউ দেখে টাসকি লেগে যায়। বয়স্করা আক্ষেপ করে বলে, মাইয়াডার যেমুন সৌন্দর্য তেমুন ব্যবহার। আহা, এই মায়াডা পাগলা পাইল কই? কী রে জয়নাল, আর অন্য মাইয়ার গাও শুঁকতে যাবি?
জয়নাল আর কোনো মেয়ের গা শুঁকতে যায় না। সুন্দরী বউ পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পায়। দিনরাত বউয়ের শাড়ির আঁচল ধরে বসে থাকে। মাস তিনেক বউয়ের সঙ্গে লটরপটর করতেই কেটে যায় ওর। এরপর বিপাকে পড়ে জয়নাল। ভোলাভালোা অশিক্ষিত জয়নালের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ওর শিক্ষিত ভাই-বোনেরা। হাবিজাবি বুঝিয়ে নিরক্ষর বাপের কাছ থেকে সব জমি জিরাত কৌশলে লিখিয়ে নেয় তারা। রাস্তার ওপারে দুই ঘরের একটা মাটির বাড়ি ছাড়া করে খাওয়ার মতো আর কিছু পায় না জয়নাল। সেই শোকে জয়নালের মা-ও মরে চোত মাসে। দিশেহারা জয়নাল বউয়ের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত ভাড়ার রিকশা ধরে। নিরক্ষর বাপ জয়নালকে সান্ত্বনা দেয়, দুঃখু করিসনে বাজান। তারা কেউ তরে দেখলো না। তরে আল্লায় দেখবো। আমি দোয়া করতেছি।
বাপের দোয়া নাকি কাজে লাগে। জয়নালের বাপের দোয়াও বিফলে যায় না। নির্মম বাস্তবতার মধ্যে পড়ে জয়নালের ঢিলা মাথা ঠিক হয়। মনের মধ্যে বুঝ আসে। দুঃখকে শক্তিতে পরিণত করে দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকে জয়নাল।
রিকশা ঠেলে ঠেলে দু’হাতে কামাতেও থাকে তেমন। বৃদ্ধ বাপ, বউ আর জয়নাল। তিন মানুষের কয়টাকা খরচ? জয়নাল যা কামাই করে তাতে খরচ ছাড়াও দিনান্তে শ’খানেকের বেশি টাকা পকেটে থাকে। বছর দেড়েকের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় জয়নাল। নিজের দৈন্যদশা থেকে উঠে আসে। বাড়ির চেহারা পাল্টে ফেলে। চৌকি বেচে খাট বানায়। ঘরগুলো আস্তর করে। আঙিনার পুব পাশে পেয়ারা গাছের নিচে চাপকল বসায়। দুই নম্বর ইট দিয়ে পায়খানা দেয়। পাড়ার লোকজন জয়নালের বাড়িতে এসে হা করে তাকিয়ে থাকে। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে এসব কী করে ফেলেছে জয়নাল! কেবল সরকার বাড়ি ছাড়া গোটা গেরামে আর কারও বাড়িতে চাপকল নেই। জয়নাল চাপকল দিয়েছে। পায়খানা দিয়েছে। বাড়িটারে রাজবাড়ি করে ফেলেইছে। সবাই এরকম প্রশংসা করে, বউটাই জয়নালের সব। সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। সে না হলে আজ এ অবস্থা করতে পারতো না। কথা শুনে জয়নালের বুক গর্বে দুই ইঞ্চি ফুলে ওঠে। স্বস্তির হাসি দেয়। জয়নাল নিজেও স্বীকার করে বউটাই ওর শক্তি, ওর প্রেরণা। আল্লায় তারে কিছু দেয় নাই। কিন্তু মনের মতন একখান বউ দিয়েছে। আহা, কী বিজলী চমকাইন্যা রূপ! একবার দেখলেই মনডা জুড়াইয়া যায়।
বউকে জানের চেয়েও বেশি ভালোোবাসে জয়নাল। বাসবে না কেন? সে না এলে তো ওর মরুময় জীবনটা এমন সুন্দর হতো না। বিরান হয় যেতো। তাই বউয়ের সুখের জন্য দিনরাত রিকশা চালায় জয়নাল। দু’হাতে টাকা কামাই করে। বউয়ের কথা মনে হলে কোনো কষ্ট গায়ে লাগে না ওর। উল্টো পায়ে যেন আরও বল পায়। জোরে প্যাডেল মারে।
বিকেল থেকে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি একটানা চলে রাত প্রায় দশটা নাগাদ। জয়নালের খুব মন খারাপ হয়। আজ সকাল থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে পঞ্চাশ টাকার বেশি ভাড়া খাটা যায়নি। শুক্রবার রিকশার ভাড়া দিতে হয় না মহাজনকে। পারমানেন্ট যারা রিকশা ভাড়া নেয় তাদের জন্য এই সুবিধে। শুক্রবার যত টাকা ভাড়া খাটা হবে সব চালকের পকেটে উঠবে। আজ জয়লনের দিন খারাপ যায়। পকেট ভরে না। না ভরুক। আল্লাহর সব দিন ভালো যায় না। কোন দিন কটকটা রোদ, কোন দিন ঝুম বৃষ্টি।
খালি রিকশা নিয়ে মাঝরাতে বাড়ির পথ ধরে জয়নাল। বৃষ্টি আবারও শুরু হয়েছে। মিটমিটে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি সবচেয়ে খারাপ। মানুষ না পারে ঘরে থাকতে, না পারে বাইরে বেরুতে। রাস্তাঘাট কাদায় পিচপিচে হয়। লালমাটিতে পা পিছলে চিৎপটাং খায় অনেকে। বিষন্ন বদনে ভিজতে ভিজতে অন্ধকার রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে চলতে থাকে জয়নাল। তার মনে হাজারও চিন্তা। সবচেয়ে বড় চিন্তা বউকে নিয়ে। দু’দিন হল বাপ নেই বাড়িতে। বউ একা। তাকে দেখে রাখার কেউ নেই।
সব ডাক্তারের একই উত্তর, জয়নালের শুক্রাণু মৃত। মৃত শুক্রাণুতে জাইগোট গঠনের ক্ষমতা থাকে না। সন্তান জন্ম হয় না।
জয়নালের ছোট সংসার। সে দিনরাত রিকশা চালিয়ে দু’হাতে পয়সা কামাই করে। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে আরাম করে দুইথালা গরম ভাত খেয়ে ঘুম দেয়। সংসারে তেমন অভাব নেই ওর। রিকশা চালালেও পাড়ার দু’চার জমিওয়ালার চেয়ে সে ভালোই খায়। ভালোই পরে। বউকে সময় মতো শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ কিনে দেয়। আলতা স্নো কিনে দেয়। মেয়ে মানুষের আরও যা সব লাগে কিনে দেয়। বউয়ের কোন আব্দার আজ পর্যন্ত অপূর্ণ রাখেনি জয়নাল। বউটাও সাক্ষাত লক্ষ্মী। সংসারে তার চাহিদা খুবই কম। বছর ঘুরলে তিনখানা শাড়ি আর তেল, স্নো, পাউডার ঠিক মতো পেলেই খুশি সে। মাঝরাতে, শেষ রাতে যন্ত্রণা করে না। স্বামীর কাছ থেকে জোর করে কিছু আদায় করে না। আব্দার করে না তেমন। করবে কীভাবে, স্বামী তো তারে কম খাওয়ায় না, কম পরায় না। বাঙ্গালী ঘরের একজন অজপাড়া গাঁয়ের গ্রাম্য বধূ সে। যার স্বামী সামান্য রিকশা চালক। যে দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এসে মাঝরাতে ভাত খেয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। তার কাছ থেকে পরীবানু আর কিছু প্রত্যাশা করে না। স্বামীর ক্ষমতা তার জানা।
পরীবানুর শখ আলাদা। সে দিনভর সেজে গুঁজে থাকে। মুখে গায়ে স্নো পাউডার মাখে। চুলে তেল দিয়ে কাউকে দিয়ে বেনী করিয়ে নেয়। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে তার সঙ্গেহেসে হেসে হাত নেড়ে কথা বলে। আদর আপ্যায়ন করে। এতে অন্যায়ের কিছু দেখে না জয়নাল। তার বউ দেখতে সুন্দর। এই মেয়ে সেজে গুঁজে না থাকলে চলবে? সুন্দর বউ ছেঁড়া ময়লা কাপড় চোপড় পরে সারাক্ষণ মানুষের চোখের সামনে ঘুরলে ভালো দেখাবে? উল্টো পাড়ার লোকজনই তাকে বকবে, কীরে জয়নাল, আনলি পরীর বাচ্চা। দুইদিন পর অইল পেত্তুনী। এমুন জংলী বউ নিয়া ক্যামনে শুইয়া থাকিস?
গরীবের কপালে সুখ নাকি বেশি দিন সয় না। জয়নালও এ বৃত্তের মধ্যে গুমরে মরে। বছর দুয়েক সুখে শান্তিতেই চলে ওদের সংসার। তারপর হুট করে বাতাস যেন প্রতিকূলে বইতে শুরু করে। একদিন প্রতিবেশী সম্পর্কে এক দাদি এসে জয়নালকে বলে, অ জয়নাল, তুই কেমুন মরদ ক দিনি? বিয়া করলি দুই বছর পার অইল। অহনও নাত বউয়ের কোন পোলাপাইন অইল না। বাড়িডা কেমুন খাঁ খাঁ করে। পাড়ার মাইনষের মুখতো বন্দ করা যায় না।
জয়নাল অবাক হয়ে বলে, কী কয় পাড়ার মাইনষে? ‘তর বউ নাহি বাঁজা। না অইলে তো এতোদিনে দুইখান পোলাপাইন অওনের কতা। পাড়ার মাইনষের কতা তর শুইনা কাম নাই। তুই হামার একখান কতা শোন। পোলাপাইন ল। না অইলে মাইনষের মুক বন্দ হইব না।’
জয়নাল হাসে, তুমি কইলেই তো অইব না দাদি। তোমার নাতবউ-এর অহন ইচ্ছা নাই। বলছে আরও বছর দুই যাক। অহন সাধ আল্লাদ করব। পোলাপাইন অইলে তো সাধ আল্লাদ করবার পারব না।
বৃদ্ধার কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে, কছ কী হারামজাদা! তর পরীবানুর ওপর হ¹লের নজর। পাড়ার ছেলেপেলে আউচা অইছে। আল্লায় গোসসা অইব। বউরে বুঝা। পোলাপাইন মানুষ করতে অইব না? বউরে সিকায় তুইল্যা রাইখা লাভ কী? মাইয়া মানুষ সময় মতো না বিয়াইলে চলব? মাইনষে খারাপ কইব না?
জয়নাল মাথা নিচু করে লজ্জিত কণ্ঠে বলে, বিষয়ডা আমি দেখতাছি দাদি।
অনেক রাত পর্যন্ত বউয়ের সঙ্গেপরামর্শ হয় জয়নালের। পরীবানু প্রখমে গররাজী হলেও পরে জয়নালের যুক্তির কাছে হার মানে। সিদ্ধান্ত হয় দু’বছর অনেক আনন্দ উৎসব হয়েছে। আর না। এবার তালা খোলা হবে। দু’বছরের ব্যবধানে দুটো বাচ্চা নেয়া হবে। ফের তালা দেয়া হবে। জম তালা।
শুরু হয় জয়নাল পরীবানু জুটির নতুন করে পথচলা। ফেমিকন, প্যানথার সাময়িক নিষিদ্ধ হয়। মাস তিনেক পর একবার খোঁজ নেয় জয়নাল, কেমুন বুঝতাছ বউ?
পরীবানু লাজুক কণ্ঠে উত্তর দেয়, কিছু তো বুঝতাছি না।
জয়নালের কপালে ঘাম জমে, কও কী, তিন মাসেও কিছু অইল না?
পরী বানু হাসে, অইব অইব। আপনে এত অধৈর্য অইবেন না তো।
আরও মাস তিনেক পরে বউয়ের কাছে থেকে একই ধরনের উত্তর আসে। জয়নাল চিন্তিত হয়ে পড়ে। জয়নালের বাপ সলিমদ্দিও ইশারা ইঙ্গিতে বার বার তাড়া দেয়। পাড়ার দু’একজন বন্ধু ব্যঙ্গ করে, কীরে জয়নাল, তর পরী বানুরে হারা জীবন বিয়াইবি না? তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর। না অইলে দেখবি তর পোলা হাঁটন না হিকতেই তর ফুট্টুস। হিঃ হিঃ হিঃ।
আর যাই হোক পাড়ার লোকজনের ব্যঙ্গ সহ্য হয় না জয়নালের। রাগে গা খান জ্বলে যায়। তার বউয়ের পোলাপাইন লইয়া মাইনষের এতো কী?
একদিন পরী বানু হতাশ গলায় বলে, অনেক তো সবুর করলাম। কিছুতেই কিছু অইল না। আমাগো বোধহয় ডাক্তারের কাছে যাওন দরকার।
বউ-এর কথাটা কানে ধরে জয়নালের। প্রথমে তারা যায় গঞ্জের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানে কোন সুফল পাওয়া যায় না। তাদের পাঠানো হয় থানার বড় হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে। সেখানে আলাদা করে জয়নাল আর পরী বানুর কয়েক রকম টেস্ট ফেস্ট চলে। প্রায় হাজার টাকা বেরিয়ে যায় জয়নালের পকেট থেকে। তাতেও আপত্তি নেই জয়নালের। তবু একটা যদি কিছু ব্যবস্থা হয়।
সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় টেস্টগুলোর রিপোর্ট পেতে। ডাক্তার জয়নালকে একাকি তাঁর চেম্বারে ডেকে নিয়ে যান। রিপোর্টগুলো নিরীক্ষা করে হতাশ গলায় বলেন, তোমার কপাল খারাপ জয়নাল। তুমি কোন দিন বাবা হতে পারবে না।
ডাক্তারের কথায় জয়নাল চোখে অন্ধকার দেখে। ঢোক গিলে বলে, ক্যান ডাক্তার সাব?
ডাক্তার চোখ থেকে চশমা খুলে বলেন, তোমার বউয়ের কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা আসলে তোমার নিজের। তোমার বীর্য মৃত। মৃত বীর্য থেকে কখনও সন্তান হয় না।
জয়নাল কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলে, এর কী কোন ব্যবস্থা নাই ডাক্তার সাব? আমার বাবা অওনের কোন উপায় নাই?
ডাক্তার তাকে আবারও নিরাশ করেন, না জয়নাল। এটা সৃষ্টিকর্তার শাস্তি। সৃষ্টিকর্তার শাস্তিকে মাথা পেতে নিতেই হবে তোমাকে। কোন উপায় নেই।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বিষণ্ন বদনে বেরিয়ে আসে জয়নাল। বউ উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করে, ডাক্তার কী কইলো? আপনের মুখ এমুন শুকনা ক্যান?
অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত কোন কথা বলে না জয়নাল। পরাজিত সৈনিকের মতো স্থবির হয়ে থাকে। শেষে বউয়ের পিড়াপিড়িতে অনেক ভেবে চিন্তে মুখ খোলে। নিজের অক্ষমতা বউয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে মিথ্যে কথাটা বলেই ফেলে, তোমার প্যাটে সমস্যা আছে বউ। এ কথায় পরী বানুর মুখ শুকিয়ে যায়, কী অইছে আমার প্যাটে?
জয়নাল অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, নাড়িভুঁড়ি সব প্যাঁচ লাইগা আছে। তোমার প্যাট মরা। মরা প্যাটে সন্তান অইব না। অপারেশন করলেও লাভ নাই।
পরী বানু মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, আপনে আমারে একী কতা শুনাইলেন! আমার কোন সন্তান অইব না? আমাগো দেখব কে?
বউকে সান্ত্বনা দেয় জয়নাল, দুঃখু কইরো না বউ। আল্লা আল্লা কর। তিনার ওপর ভরসা রাখ।
বছর খানেক কেটে যায় এভাবে। এর মধ্যে জয়নাল তলে তলে আরও কয়েকজন বড় ডাক্তারকে দিয়ে নিজেকে পরীক্ষার করায়। বিভিন্ন রকম টেস্টে আরও হাজার দুয়েক টাকা ব্যয় করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যোগের খাতায় শুন্যই পড়ে। সব ডাক্তারের একই উত্তর, জয়নালের শুক্রাণু মৃত। মৃত শুক্রাণুতে জাইগোট গঠনের ক্ষমতা থাকে না। সন্তান জন্ম হয় না।
এটা পৃথিবীর আর কারো পক্ষে অনুধাবণ করা সম্ভব নয়। জয়নাল পরাজিত ভঙ্গিতে বউয়ের সামনে মাথা নিচু করে থাকে। পক্ষান্তরে বউয়ের চোখ মুখে তখন বিজয়ের আনন্দ।
এরপরও থেমে থাকে না জয়নাল। যার তার কথা মতো বিভিন্ন পীর ফকিরের তাবিজ কবজ, তেলপড়া, গুড়পড়া, গাছ গাছালীর শিকড় বাকড় সব শেষ করে। কিছুতেই সুফল আসে না। চেষ্টার চূড়ান্ত করে শেষে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় জয়নাল। বউয়ের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ভবিষ্যতকে অদৃষ্টের হাতে শঁপে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে।
একদিন হুট করে সরকার মশাইয়ের ছোট ছেলে মজনু আসে মালেশিয়া থেকে। মজনু জয়নালের ছোট বেলার বন্ধু। লেখাপড়া না করায় বছর পাঁচেক আগে মজনুকে মালেশিয়া পাঠানো হয়েছিল। কোম্পানীর সঙ্গেচুক্তি শেষ করে অনেক মালপানি কামিয়ে দেশে ফিরেছে। মজনুর দেশে ফেরা কপাল ফেরায় জয়নালেরও। আচমকা মজনু একদিন জয়নালের বাড়ি এসে বলে, দোস্ত, তর এতো সুন্দর বউডারে সাগরের মইধ্যে ফালাইয়া রাখছস ক্যান? সাগরের পাড় বাইন্ধ্যা দে। না অইলে বউডা একদিন ভাইসা যাইব।
জয়নাল মজনুর কথার ধাঁচ আঁচ করতে পারে না। সরু চোখে তাকিয়ে বলে, আমি তর কতার মাথা মুন্ডু কিছু বুঝতাছি না দোস্ত।
বাড়ির চারপাশ খোলা দেখে মজনু হেসে বলে, বাড়ির আঙ্গিনায় প্রাচীর দিয়া দে। এক মাইল দূর থাইকা সব্বাই তর পরী বানুরে দ্যাখে। হেইডা কী ভালোা?
জয়নাল লজ্জিত কণ্ঠে বলে, অনেক ট্যাকার ব্যাপার। এতো ট্যাকা পামু কই? মজনু হেসে বলে, ট্যাকার কথা চিন্তা করবি না। যত ট্যাকা লাগে আমি দিমু। আমি থাকতে তর বউয়ের ওপর মাইনষের নজর পড়ব তা কী হয়? আমি তর দোস্ত না?
মজুন পরী বানুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আপনেই কন দিনি ভাবি, আমি কী মন্দ কিছু কইছি?
পরী বানু মজনুর কোন কথার উত্তর করে না। মুখ টিপে হাসে।
এরপর মজনুর কাছ থেকে বিনা শর্তে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে এক মাসের মধ্যে বাড়ির চারপাশে উঁচু করে প্রাচীর দেওয়া হয়। গোটা বাড়ি চুন রঙ করা হয়। ঘরের মাঝে, বারান্দা পাকা করা হয়। খড়ের চালা ফেলে দিয়ে টিন দেয়া হয়। জয়নালের সঙ্গেমজনুর বন্ধুত্ব আরও পাকাপোক্ত হয়। এখন প্রতি রাতে একবার করে হলেও জয়নালের খোঁজ নিতে আসে মজনু। জয়নালের সঙ্গে খোশ গল্প করে। জয়নাল বাড়িতে না থাকলে পরী বানুর সঙ্গে গল্পসল্প করে। হাসাহাসি করে। কোন রাতে জয়নালের সঙ্গে বসে ভাতও খেয়ে যায়। পরী বানুর রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করে।
মজনুর আচার ব্যবহার খুব ভালো লাগে জয়নালের। এমুন ভালো ছেলে দু’চার গ্রামে নেই। জয়নাল ভাবে, মজনু এত ভালো ছিল না। খচ্চর টাইপের ছিল। দু’বন্ধু মিলে অনেক আকাম বদকাম করেছে। ওর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মজনুকে মালেশিয়া পাঠান ওর বাবা। মালেশিয়া থেকে সাধু ছেলে হয়ে দেশে ফিরে এসেছে মজনু। বন্ধুর উপকারে দু’হাত পেতে দিয়েছে। খারাপ মানুষ ভালো হতে ক’দিন লাগে?
ক’দিন আগে পরী বানুর জন্য হাজার টাকা দামের দুটো শাড়ি কিনে আনল মজনু। জয়নালের জন্য লুঙ্গি পাঞ্জাবী কিনে আনল। নতুন দামি কাপড় চোপড় পেয়ে জয়নাল যত খুশি হল তার দশ গুণ খুশি হল পরী বানু। আনন্দে উল্লাসে পরী বানু লাফ ঝাপ শুরু করল। স্বামীর কাছে যখন তখন মজনুর প্রশংসার গীত গাইতে লাগল। মজনু জয়নালকে বলল, আগামী মাসে তাকে একটা নতুন রিকশা কিনে দেবে। বন্ধুকে আর ভাড়ার রিকশা বইতে দেবে না সে। মজনুর এ কথায় জয়নালেরও মনে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করল। জোয়ারে ভাসতে থাকল জয়নাল। এই না হলে দোস্ত!
সারাদিনের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ভেজা শরীরটা নিয়ে প্রচন্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে মাঝরাতে বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায় জয়নাল। বারান্দায় জ্বালিয়ে রাখা হ্যাজাকের তীব্র আলো এসে লাগে ওর চোখ দুটোয়।
জয়নাল দেখতে পায়, বারান্দায় কাঁথা বিছিয়ে পরী বানু শুয়ে আছে লেপমুড়ি দিয়ে। পরী বানুর মাথার কাছে পিড়েয় বসে হাই তুলছে ফজু ডাক্তার। তাকে ঘিরে বসে আছে পাড়ার কয়েকজন মধ্যবয়সী মেয়ে মানুষ। আমেনার মা, জহুরার দাদি, আক্কাস ভাই এর বউ এরকম আরও কয়েকজন। মিনমিনে গলায় গুটুর গুটুর করে খোশগল্পে মত্ত সবাই। ঘটনার কিছু আঁচ করতে পানে না জয়নাল। হ্যাজাক, মেয়ে মানুষের জটলা, ফহু ডাক্তার এসবের গুঢ় রহস্য উদঘাটন করতে পারে না। উঠোন থেকে পরী বানুর কাছে একরকম ছুটে যায় জয়নাল। প্রায় চিৎকার করে বলে, আমার পরী বানুর কী অইছে?
জয়নালের চিৎকারে চোখ মেলে পরী বানু। প্রশ্নকর্তার দিকে সবাই ফিরে তাকায় এক সাথে। মেয়ে মানুষদের গল্প গুজব বন্ধ হয়ে যায়। জয়নালের আগমনে যেন স্বস্তি ফিরে আসে সবার মধ্যে। খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠে তাদের। ফজু ডাক্তার আনন্দিত কণ্ঠে ঘোষণা করে, বড়ই আচানক ঘটনা আছে জয়নাল। তোমার বউ পোয়াতী অইছে। তুমি বাবা হবা। তাড়াতাড়ি বাজারে যাও। গনি মিয়ার মিষ্টির দোকান বোধ হয় অহনও খোলা। মিষ্টি লইয়া আস।
ফজু ডাক্তারের কথা শুনে কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে থাকে জয়নাল। ওর মাথার মধ্যে লক্ষ অমানিশার ঘোর কাল ছায়া। পাঁচ পাঁচ জন বড় ডাক্তারের দেয়া একই রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হওয়ার পেছনে কোন যুক্তি খেলে না ওর মাথার মধ্যে। সে হলেও বছর দুই আগেই সন্তান সম্ভবা হত পরী বানু। অথচ কাকতালীয় ভাবে চার চারটি বছর পর পোয়াতি হল জয়নালের বউ! এ বাস্তবতা মানা যায় না। এটা মানবেও না জয়নাল। এসবের মধ্যে তৃতীয় শক্তির অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করে সে। পায় কী পায় না বোঝা যায় না। লজ্জা আর অপমানে অকস্মাৎ মুখ থেকে রক্ত সরে যায় জয়নালের। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত একজন পরাজিত সৈনিকের মতো নিজেকে অসহায় বোধ করে সে। ফেরেস্তার মতো বউটার প্রতি তীব্র ঘৃণা আর অবিশ্বাস বাড়ে। এই মেয়ে তাকে ঠকিয়েছে। এটা পৃথিবীর আর কারো পক্ষে অনুধাবণ করা সম্ভব নয়। জয়নাল পরাজিত ভঙ্গিতে বউয়ের সামনে মাথা নিচু করে থাকে। পক্ষান্তরে বউয়ের চোখ মুখে তখন বিজয়ের আনন্দ। এ বিজয় যেন জয়নালের শব দেহের ওপর সুখের পতাকা ওড়ায়। মিথ্যে বন্ধ্যাত্বের বারতা ঘোষণা করে।