এক.
পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির শ্যাওলা জমা দেয়াল থেকে খসে পড়ছে জীর্ণ ইট। প্রাচীরের গায়ে জন্ম নিয়েছে গুল্মলতা। মানুষসমান আগাছা আর ঝোঁপঝাড় বলে দেয়, বহুদিন ধরে এখানে কোনো জনবসতি নেই। বাড়ির ভেতরে খুপরি ও ছোট-বড় গর্তে বিভিন্ন জাতের সাপের আড্ডা। রাতের বেলা শিয়াল যেন পাল্লা দিয়ে ডাকে। কে কবে এখানে নিশুতিরাতে শুভ্র কাফন জড়ানো অশরীরী কোন প্রেতাত্মার সন্ধান পেয়েছিল, সেই গল্প এখনো চলে সবার মুখে মুখে।
বাড়ির দক্ষিণে শানবাঁধানো পুকুরঘাট। শ্যাওলা জমে পুকুরের জলের রঙ ঈষৎ সবুজাভ হয়ে আছে। দুই-চারটে পদ্ম ফুটে আছে পুকুরের মাঝ বরাবর। পুকুরের চারপাশে ঝোপঝাড় তারপর বিস্তৃত ফসলের মাঠ। জায়গাটা নির্জন। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে এদিকের পথ কেউ মাড়ায় না। তবে একজন আসে, রোজ আসে। একজন বললে ভুল হয়, দুজন আসে।
ননাই জেলের বউ সোনালি ক্ষেতের আইল ধরে আঁকাবাঁকা পা ফেলে ভরদুপুরে মাথার ওপর সূর্য নিয়ে রোজ আসে জমিদার বাড়ির শানবাঁধানো পুকুরঘাটে। ঘাটে বসে আলতা রঙা পা ডুবিয়ে দেয় শ্যাওলা জমা জলে। তারপর একে একে খুলতে থাকে গায়ের বসন। ঘটি ভরা হিম জল ঢালে মাথায়, সর্বাঙ্গ ভিজে যায় সোনালির। শাড়ির আচলে সাবানের ফেনা তুলে সোনালি। তারপর ঘঁষতে থাকে চোখমুখ, গলা।
ঝোপঝাড় থেকে একজোড়া চোখের তীক্ষ্ণ নজর পড়ে সোনালির ওপর। সোনালি চোখ বুজেও অনুভব করতে পারে সে দৃষ্টি। নিজে থেকেই ফেলে দেয় বুকের আঁচল, ব্লাউজসমেত বক্ষ পাহাড়ি উপত্যকার মতো মনে হয় গৌতমের চোখে। গৌতম এদিক-ওদিক তাকায়। না, কেউ নেই আশেপাশে। বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে চুপচাপ বেরিয়ে আসে গৌতম। সোনালির এক দেড়গজ তফাতে বসে জিজ্ঞেস করে, কাইল আইলি না যে?
চোখেমুখে সাবান মাখতে মাখতেই সোনালি জবাব দেয়, আইছিলাম তো বিকালের সময়। কাম সারতে সারতে দেরি অইয়া গেলো।
অভিযোগের সুরে গৌতম বলে, আমি যে ঘাটে আইয়া বইয়া রইলাম এক দুপুর?
অকস্মাৎ রেগে গিয়ে জবাব দেয়, সোনালি, তোরে থাকবার কইছে কেরায়?
প্রচণ্ড আত্মভিমানে চুপ করে থাকে গৌতম।
সোনালি তার ছেলেবেলার খেলার সাথী, বয়সে পিঠাপিঠি। যমুনার কোল ঘেঁষে জেলেপল্লীতে সকাল সন্ধ্যা কত রকম খেলার উপকরণ জোগাড় করতে করতে বড় হয়েছে ওরা, কতদিনের কত খেলা পণ্ড হয়ে গেছে বালুচরে একে অন্যের চুল ছেঁড়াছিঁড়ি করে। তখনো এত অভিমান হয়নি গৌতমের। আজকাল সোনালির এক আধটা বাঁকা কথাই গৌতমের বুকে তীরের মতো বিঁধে।
এই নিভৃত নির্জন পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির পুকুরঘাটে লোকচক্ষুর আড়ালে ঝোপের মধ্যে কেন যে এক দুপুরের ছটফটানি অপেক্ষা, সোনালির কাছে তা অজানা নয়। জেলেপল্লীর পশ্চিমে নদী, ননাই বাড়িতে একটা অগভীর নলকূপও বসিয়েছে তবু ভর দুপুরে সোনালি এই নির্জন পুকুরঘাটেই গোসল করতে কেন আসে সেই প্রশ্নের যুতসই জবাব নেই সদ্য এই যৌবনবতী কাছে।
গৌতমের অভিমানী মুখের ওপর সোনালির বড্ডো মায়া। সোনালি বলে, হা রে গতু। আমার এহন বিয়া হইছে না? স্বামী সংসার আছে। মানুষ জানতি পারলে খারাপ কবো না? ক দেহি?
—তোরে যে একবার দেখবার মন চায়।
সোনালি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর পা কচলাতে কচলাতে বলে, এত দেখবার চাইলে ঘরে তুলতি। তার বেলায় তো মুরাদ নাই। ব্যাটা ছাওয়ালের বুক ভরা মায়া থাকলিই চলে না রে, পেটে দুইডা ভাত দেবারও ক্ষেমতা থাকা চাই।
গৌতম বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। নীরবে চেয়ে থাকে সোনালির দিকে। সোনালির কিছুই অজানা নয়। দুজনেরই তখন বাড়ন্ত বয়স। গতুর বাবা গতুকে নৌকায় নিয়ে গেলো। মাঝির ছেলে।গায়ে গতরে বেড়ে গেলে বসে বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করার সুযোগ নেই। ওদিকে সোনালির শরীরও লতার মতো বেড়ে ওঠে, বয়সন্ধি পেরিয়ে স্পষ্ট হয় যৌবনের চিহ্ন। সোনালির মা নিরঞ্জনা কর্তা বংশীকে বললো, ম্যায়া ডাঙ্গর হইছে। বিয়া দেওন দরকার। বংশী অনেক ভেবে দেখলো, জেলেপল্লীতে আনবি তো পোলা, তয় রোজগার ভালো একজনই আছে, ননাই।
নিরঞ্জনা ক্ষেপে গিয়ে বললো, আমার ম্যায়া কাইটা যমুনায় ভাসাইয়া দিমু ,তাও ননাইয়ের কাছে দিমু না।
বংশী বিরক্ত হয়ে বললো, ক্যান রে মাগী? ননাইয়ে দোষ কী?
—দোষ কী! মনে অয় জানে না কিছু? পাড়ার হগল মানুষ জানে ননাইয়ের বাপে মইরা যাওয়ার পর, ননাইরে দুই বছরের থুইয়া ওর মায় এক ভদ্দরলোকের লগে বাইর হওয়া গেছিল। খুব শখ হইছিল ভদ্দরলোকের ঘর করবো! তারবাদে মাগীরে নিয়া বেইচা দিছে বেশ্যা পাড়ায়। ব্যাটায় উচিত কাম করছে!
বংশী রাগতস্বরে বৌকে বলে, চুপ থাক হারামজাদি! এর মইধ্যে ননাইয়ের দোষ কী? ননাইয়ের জন্মে তো আর দোষ নাই।
নিরঞ্জনা আবার কথা বলতে যায় কিন্তু বংশীর রক্তচোখের দিকে তাকিয়ে আর বেশিকিছু বলার সাহস পায় না। মিনমিন করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নিরঞ্জনা।
বংশী জানে, জাইল্যাগো আয়রুজি ভালো না এখন। জালে আগের মতো মাছ পড়ে না। মাছগুলা যেন কোন ভিনদেশে চলে গেছে। দুই চারটা যাও আছে, সেগুলোও বড় সেয়ানা। জালে আটকাতে চায় না। সুবিস্তীর্ণ যমুনার জলরাশির দিকে তাকালে বংশীর বুকে ব্যথা অনুভূত হয়, কোথাও যেন বাঁচবার মতো জীবনের রসদ অবশিষ্ট নেই। এই পল্লীতে এতগুলো ঘর, বালবাচ্চা নিয়া শ পাঁচেকের কম না। এরা কই যাবে? কী খাবে?
কিন্তু ননাইয়ের কথা আলাদা। ননাইকে ভগবান অন্য ধাতুতে গড়েছেন। মাঝিরা নৌকা নিয়ে যমুনায় যায়, কারও নায়ে মাছ পড়ে না। ননাই ফিরে নৌকা বোঝাই মাছ নিয়ে। ননাই যেন জাদু জানে। রূপকথার গল্পের মতো মৎস্যকন্যার আশীর্বাদে ঝাঁক বেঁধে মাছ ধরা পড়ে ননাইর জালে।
ননাইও মাঝির ছেলে, কৃষ্ণকায় বর্ণ, লম্বা গড়ন। হাতে যেন অসুরের শক্তি। দুই টাকার সরিষার তেল গায়ে মেখে ননাই সমস্ত শীতের রাত জাল বাইতে পারে, এতটুকু টলে না। ননাইয়ের চরিত্রেও দোষ নেই। গতর গরম করার জন্যেও মদ গিলে না, জুয়া খেলে সময় কাটায় না। মাঝিবাড়ির ছেলে অথচ কারও সঙ্গে দেই পয়সা নিয়ে হাঙ্গামা বাধায় না। নষ্টা মেয়েছেলের পেছনেও ঘুর ঘুর করে না। বাপের চরিত্র পেয়েছে ননাই, বড় ভালো ছেলে।
দুই.
ভাটচান্দা বিল থেকে মাছ ধরে হাটে নিয়ে বেচার কথা ছিল ননাইয়ের। কিন্তু ননাই হাটে যায়নি আজ। বিল থেকে মাছ নিয়ে হাটে যাওয়ার পথেই বিক্রি হয়ে গেছে সব। ননাই বাড়ি ফিরেছে তাড়াতাড়ি। বাড়ি ফিরে বৌকে দেখতে না পেয়ে নলকূপের জলে স্নান সেরে গায়ে সরিষার তেল মাখছিল, এমন সময় সোনালি ভেজা কাপড়ে বাড়িতে ঢুকে ননাইকে দেখে অবাক হলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না।
সোনালি কাপড় বদলে ননাইকে খাওয়ার জন্য ডাকলো। হাঁড়িতে কিছু পান্তা অবশিষ্ট থাকলেও দুই জনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। সোনালির দোষ এতে কিছু নেই। যেদিন ননাই হাটে যায়, সেদিন দুপুরে খায় না। কাজেই সোনালি আজ একজনের ভাতই রেখেছিল। ননাই একনজর তাকিয়ে দেখলো সানকিতে পান্তা, সঙ্গে দুইটা লঙ্কা। সাতপাঁচ কী যেন ভেবে ননাই বললো, খামু না এহন। ক্ষিধা নাই।
ননাই একটা শার্ট কাঁধে চেপে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সোনালি জিজ্ঞেস করলো, কই যান এহন?
ননাই জবাব দিলো আড়তদারের কাছে। কিছু টেহা পাওনা আছে।
ননাই বড় হয়েছে বড় অনাদরে। জাইল্যাদের নৌকায় সারারাত মাছ খুঁটে, তামাক সাজিয়ে, মাঘ মাসের শীতের রাতে সাঁতার দিয়ে জালের ওপর থেকে পানা সরিয়ে কোনো কোনো দিন সে এক-দুই টাকা পেতো। তা দিয়ে পেট পুরে খাওয়া চলে না। জেলেপল্লীতে মোট পঁচাত্তর ঘর পরিবারের মধ্যে এমন কোনো ঘর নেই, যেখানে ননাই উচ্ছ্বিষ্টাংশ খায়নি। গরিব জেলেপল্লীতে উচ্ছ্বিষ্টাংশও বড় দুর্লভ। অভাবের তাড়নায় ভাতের ফেনাও গিলে নেয় বুবুক্ষুর দল। ননাই এক সানকি পান্তাভাতে কব্জি ডোবানো জলের মধ্যে এক দুই দানা ভাত খুঁজে পেতো।
ননাই বড় হলে ধীরে ধীরে তার অবস্থা ফিরেছে। দুচালা টিনের ঘরে দুবেলা চুলা জ্বলে এখন। কিন্তু শৈশব কৈশোরের অনটন এবং বাল্যকালে মাতৃস্নেহের অভাব ননাইয়ের চরিত্রে রুক্ষ্ণতা এনে দিয়েছে। সোনালি এখনো ননাইকে বুঝে উঠতে পারেনি। কাঠখোট্টা টাইপের এই মানুষটার হাসি কম, কান্না কম, আবেগ বা ভালোবাসাও কম।
সোনালি হাট থেকে এক শিশি তেল নিয়ে আসতে বললে ননাই নিয়ে আসে ঠিকই কিন্তু নিজে থেকে কোনোদিনই দুই টাকার চুলে বাঁধার ফিতা কিনে আনে না। জবজবে তেলে মাথা ভিজিয়ে লাল ফিতায় চুল বাঁধলেও ননাই ফিরে দেখে না। সোনালি যদি বলে বাইদা আইছে একডজন রেশমি চুড়ি কিনমু, ননাই উদাসভাবে দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয়।
জেলেপল্লীতে বৌ-ঝিরা রাতের বেলায় পুরুষদের খুব বেশি ঘরে পায় না। সারারাত মাঝিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নদী-নালা, হাওর-বাওরে মাছ ধরে, ভোর হতেই সেই মাছ নিয়ে ছোটে বাজারে। মাছ বেশি ধরা পড়লে তা নিয়ে যায় এলেঙ্গা। পাইকারি হারে দিয়ে আসে আড়তদারের কাছে। কেউ কেউ বেশি লাভের আশায় খুচরো বিক্রি করতে চাইলে আড়তদার না করে না সত্য, তবে দেখা যায় দুপুর নাগাদও কিছু মাছ বিক্রি হয়নি। সে মাছ পরে পচে গলে যায়।
বিয়ের পর সোনালিও খুব বেশি সময় কাছে পায়নি ননাইকে। কোনো কোনো রাতে সোনালি ননাইয়ের গা ঘেঁষে এলে ননাই সাড়া দিয়েছে, সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর হয়তো কোনো কোনো রাতে ননাইও বুকে জড়িয়ে নিয়েছে সোনালিকে। কিন্তু এটুকুতেই মন ভরে না সোনালির। বুকের কোথায় যেন একটা দুঃখবোধ, অপ্রাপ্তির বেদনা জেগে ওঠে। সারারাত ধরে সে ব্যথা কুরে কুরে খায় সোনালিকে, কোনো কোনো মাঝরাতে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। আঁচলে চোখ মুছে পাশ ফিরে শোয়। ননাই এসবের খবর রাখে না।
জেলেপল্লীতে এসব হৃদয়ঘটিত ব্যাপার সব মেয়েলোকের মধ্যে দেখা যায় না। সকালে উনুনে হাঁড়ি দেওয়ার পর আবার রাতে উনুন জ্বলবে কি না, এই দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়েই পুরো দিন কেটে যায়। জীবনে কী পেলো, কী পেলো না, এই সব ভাবনার চেয়ে সন্তানাদি নিয়ে একবেলা পেট পুরে খাওয়ার ভাবনাটা তাদের কাছে মুখ্য। দুই বেলা ভাতের জোগাড় যেখানে নেই, সেখানে জগতের অন্য সব বিষয়, হৃদয়ের দাবি দাওয়া নিতান্তই তুচ্ছ, অসার। সোনালির খাওয়া-পরার ভাবনা নেই। এই দরিদ্র পল্লীতে এটুকু পাওয়াই যে সাত রাজার ধন পাওয়ার সমতুল্য, এটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। সবচেয়ে বেশি স্বীকার করে নিরঞ্জনা, ম্যায়াডা আমার ভগবানের দয়ায় বহুত ভালা আছে।
তিন.
দুপুরের পর থেকে মন ভালো নেই গৌতমের। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে সারা বিকেল এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে জুয়ার আড্ডায় বসেছে, তাতেও মনের ভার কমেনি এতটুকু। গণশা জিজ্ঞেস করে, গতু তোরে আইজ কাহিল দেহাইতেছে। অসুখ করছেনি? গৌতমের অসুখ একটা আছে বটে কিন্তু দুনিয়ার কোথাও এ রোগের ওষুধ নেই।
গৌতম বিরসমুখে জবাব দেয়, শরীলডা ভালো ঠ্যাকতাছে না রে গণশা। মনের সঙ্গে দেহেরও একটা সম্বন্ধ আছে বটে কিন্তু দেহের ক্ষত যেভাবে সবাইকে দেখানো যায়, মনের ক্ষত কাউকেই সেভাবে বোঝানো যায় না।
গণশা নিচুস্বরে গৌতমকে বলে, রাইতের বেলা ওপার পৌলি যাত্রা আছে। হুনছি বাইজি নাচাবো। যাবিনি রে গতু? গৌতম হতাশ স্বরে বলে, না রে গণশা। আইজ উঠি।
পথ চলতে আনন্দ নেই গৌতমের, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোথায় এ পথের শেষ তাও অজানা। লতা যেভাবে সরু বৃক্ষকে জড়িয়ে তরতর করে বেড়ে ওঠে, তেমনি সোনালি ও গৌতম একে অন্যকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোথা থেকে এক ঝড় এসে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেলো ওদের বন্ধন। এলোমেলো হয়ে গেলো সব। সোনালির জন্য বড় বেশি মন পুড়ে গৌতমের, সোনালির বুকে নাকমুখ গুঁজে ঘ্রাণ নেওয়ার মাদকতাও টানে খুব!
বিয়ের পরপর সোনালি তবু একেবারে এড়িয়ে চলেনি গৌতমকে। ইশারায়, আকার ইঙ্গিতে এবেলা-ওবেলা দেখা করার কথা বলেছে। আবেগী গৌতম সুযোগ বুঝে জড়িয়ে ধরেছে সোনালিকে। নরম দেহের মোহমায়ায় গৌতমের এক আধটা দিন কেটে যেতো সোনালির আবেশে, পরম সুখে। আজকাল সোনালিকে বড় দুর্বোধ্য ঠ্যাকে গৌতমের। মনে হয়, এ সোনালি তার সেই সোনালি নয়, এ যেন অন্য সোনালি। যে সোনালিকে বুঝে ওঠার মতো যতেষ্ট পুরুষত্ব তার মধ্যে নেই। এই সোনালি ফাঁকি দেয়, এড়িয়ে চলে, অবজ্ঞা দেখায়, কারণে অকারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ভাবতে ভাবতেই গৌতমের বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা মোচড় দিয়ে ওঠে। গৌতম আর ভাবতে পারে না কিছু। হন্তদন্ত পা ফেলে ননাইয়ের বাড়ির পথে!
ঘনবসতিপূর্ণ জেলেপল্লীতে এক ঘরের বেড়া অন্য ঘরের সঙ্গে লাগোয়া। উঠোন বলতে আলাদা কোনো আঙিনা চিহ্নিত করা যায় না। ছোটছোট বাচ্চার চিৎকার চেঁচামেচিতে আর বৌঝিদের কলহে জেলেপল্লীতে সন্ধ্যা নামে বড় অভদ্রভাবে।
কোনো কোনো ঘরে কেরোসিনের অভাবে প্রদীপ জ্বলে না। মা তার মেয়েকে বলে, যা লো প্রভাতী তোর কমলা মাসীর থিইক্যা এট্টু তেল কর্জ কইরা নিয়া আয়।
সোনালি ঘরে এখনো প্রদীপ জ্বালায়নি।
ঘরের সামনে উনুনে ভাত বসিয়ে আনমনে বসে আছে। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে ফর্সা আকাশ ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। এক ছায়ামূর্তি সেই সন্ধ্যার আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে সোনালির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ছায়ামূর্তির ওপর আচানক চোখ পড়ায় চমকে ওঠে সোনালি। দাঁতে দাঁত চেপে সোনালি জিজ্ঞেস করে, তুই এহানে আইছস ক্যান?
গৌতমের মনের মধ্যে অস্থিরতা ছিল সোনালির সঙ্গে বিচ্ছেদের শঙ্কায়। সারাক্ষণ গৌতমের কেবল এই ভয় কাজ করে, সোনালি তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূরে-বহুদূরে। দিনদিন অচেনা মানুষ হয়ে উঠছে সোনালি। এ মুহূর্তে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না গৌতম। সোনালিকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমি তোরে ছাড়া বাঁচুম না রে সোনালি। সোনালি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে, ছাড়ো আমারে! ছাড়ো কইতাছি। কেউ দেইখা ফেলবো। গৌতমের একরোখা জেদ আর শক্তির কাছে সোনালি পরাস্ত হয়। কোনোভাবেই ছাড়িয়ে নিতে পারে না নিজেকে। শেষমেশ সোনালির হাতে থাকা ভাঁজাকাটা দিয়ে আঘাত করে গৌতমের কপালে। ছিলছিলে রক্তে ভেসে যায় গৌতমের চোখমুখ।
চার.
রাতে বাড়ি ফিরে ননাই দেখতে পায়, অন্ধকার ঘরে বিছানার ওপর বালিশে মুখ গুঁজে সোনালি পড়ে আছে। ননাই দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে নিজেই প্রদীপ ধরায়। নলকূপ থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে সোনালিকে বলে, খাওন দে। পেটে ভোগ লাগছে। সোনালি আজ অন্যমনস্ক। ননাই নিজেই পিড়ি পেতে বসে। খেতে দিয়ে ননাইয়ের পাতে পাট শাক তুলে দেয় সোনালি। ননাই একগ্রাসে খেয়ে নেয় শাকটুকু। ননাইয়ের ক্ষিধে বড় বেশি।
ননাই লক্ষ করে সোনালি তরকারি না বেড়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে প্রদীপের আলোয়। ননাই বিচলিত হয়ে বলে, কী অইছে তোর? শরীল খারাপনি? চমকে ওঠে সোনালি, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু।
রাতে ঘুমুতে গিয়ে ননাইয়ের শীত লাগে। তেল চিটচিটে কাঁথা জড়িয়ে নেয় গায়। নিজেই নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখে, গরম। জ্বর আসছে ননাইর। অসুখ খুব একটা করে না তার। ছোটখাটো অসুখে গা করলেও গরিবের চলে না। কিন্তু আজ ননাইর শীত বেশি। ননাই শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, এমন অবস্থায় যমুনার জলে জাল ফেলে মাছ ধরলে কেমন ভয়াবহ ব্যাপার হবে? চারপাশ থেকে হু হু করে আসা শীতল বাতাস আর যমুনার ঠাণ্ডা জল স্পর্শ করে যাবে ননাইয়ের লোমকূপ। ননাই এর বেশি ভাবতে পারে না। কাঁপতে থাকে জ্বরে।
ননাইয়ের পাশেই পাশ ফিরে শুয়ে আছে সোনালি। ঘুম নেই সোনালির চোখে। ননাইয়ের কাঁপুনিতে সোনালি ঠিক বুঝতে পারে, পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার আজ উষ্ণতা প্রয়োজন, অন্তত কপালের উত্তাপে কোমল হাতের স্পর্শ। কিন্তু সোনালি আজ নির্জীব, অসার। বড্ড অভিমান পুষে আছে বুকে।
চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরলেও যে মানুষটা বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নেয় না পরম মমতায়, হৃদয় পানে চোখ মেলে তাকায় না, তার সঙ্গে সংসার করা আর জড়বস্তুকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনো তফাত নেই। সোনালির মন আজ বিক্ষিপ্ত। বাল্যপ্রেম জলাঞ্জলি দিয়ে বহুবার মনের দিক থেকে কঠোর হতে চেয়েছে সে। গতুকে ভুলে গিয়ে সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলে হতে চেয়েছে খাটি ঘরকন্যা। কিন্তু গতুকে ভুলতে গিয়ে হৃদয়ের মধ্যে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সে শূন্যতা কখনোই পূরণ হয়নি ননাইকে দিয়ে। উপরন্তু গতু নিজেই এসে সে শূন্য মন্দিরে ঘণ্টা বাজিয়ে গেছে বারবার। আজ ননাইয়ের প্রতি বড্ড ক্ষোভ জন্মেছে সোনালির মনে। বোধকরি সন্ধ্যা রাতে গতুর প্রতি যে নিষ্ঠুরতা সে দেখিয়েছে, তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ছে ননাইয়ের ওপর। ননাই যদি জ্বরে পুড়ে যায় যাক! তার কী?
ননাইয়ের ঘুম ভাঙে বেলা করে। আলস্যে বিছানায় পড়ে থাকে আরও কিছুক্ষণ। এতটুকু বয়স থেকে জীবন পথে বিরামহীন ছুটে চলায় কখনো শ্রান্তি অনুভব করেনি ননাই। আজ বড় ক্লান্ত লাগছে তার। ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। পূব আকাশে সূর্য উঠে রোদের আস্ফালন চোখে এসে পড়ছে। জেলেপল্লীতে মাঝিরা এখন আর কেউ ঘরে নেই। যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে।
ননাই সোনালিকে দেখতে পায় না আশেপাশে কোথাও। চুলা থেকে পোড়ামাটির এক টুকরো নিয়ে দাঁত মাজন করতে করতে কলপাড়ে আসে। হাতমুখ ধুয়ে দেখতে পায় ঘরের সামনে পড়ে রয়েছে নতুন বোনা একখানা জাল। জালে গাব দেওয়া দরকার। গায়ে জ্বর থাকলেও অলসভাবে সারাদিন পার করে দেওয়ার লোক নয় ননাই। জমিদার বাড়ির পেছনে একটা গাব গাছ চোখে পড়েছিলো ননাইয়ে। ঘর থেকে একটা ধামা বের করে নিয়ে ক্ষেতের আইল ধরে ননাই হাঁটতে থাকে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির দিকে। শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে এসে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ননাই। সোনালি গতুর বুকে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। গতুর কপালে ব্যান্ডেজ। ননাইকে আচমকা এখানে দেখতে পেয়ে ধড়ফড় করে উঠে গৌতম ও সোনালি। কয়েক মুহূর্ত কেটে যায় ননাইয়ের স্বাভাবিক চৈতন্য ফিরে পেতে।
পাঁচ.
পল্লীকে পেছনে ফেলে ননাই হাঁটতে থাকে সোজা পশ্চিমে। ফসলের মাঠ পেরিয়ে আরও মিনিট দুই গেলে যমুনার বিস্তৃত চর। চরের প্রান্তে অশ্বত্থ গাছের নিচেই ঘাট। ননাইয়ের নৌকা বাঁধা আছে ঘাটে। নৌকা ছেড়ে দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে ননাই আকাশের দিকে তাকায়। রোদের তেজ বাড়ছে। যমুনার স্বচ্ছ জলে সে রোদ পড়ে ঝিকিমিকি করছে। জেলেপল্লীর দুরন্ত শিশুরা যেমন শৈশব না পেরুতেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে সুবিস্তীর্ণ যমুনার বুকে শক্ত হাতে নৌকার হাল ধরে, এ রোদের তেজও তেমনি ভোরের কোমলতা কাটিয়ে ক্রমশ প্রখর হয়ে উঠছে।
মাঝেমাঝে জীবনকে ননাইয়ের বড় বিচিত্র ঠ্যাকে। মাঝ দরিয়ায় নাও নিয়ে এসে পাটাতনের ওপর শুয়ে সুবিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের মর্মার্থ কিছুটা হলেও বুঝতে পারে ননাই। সমগ্র বিশ্ব চরাচরের যেন আর কোনো জনমানব নেই, আর কোনো বন্ধন নেই। সকলই মিছে মায়া, এখানে কেউ কারও নয়।
মা-বাবার মুখ মনে নেই ননাইয়ের, থাকার কথাও না। বান্ধবহীন নিষ্ঠুর নির্মম পৃথিবীতে মানুষের কূটিল রূপ দেখে বড় হয়েছে সে। দুনিয়াটা একটুকুন বুঝতে শেখার পরই ননাই দেখেছে, মা কে নিয়ে কুৎসা রটিয়ে দোষ কীর্তন করা মানুষের অভাব নেই বটে কিন্তু অনাহারে দুইদিন না খেয়ে থাকলেও দুই মুঠো ভাতের জোগান দেবে, এমন একজনও নেই। আদতে মায়ের প্রতি ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই নেই ননাইয়ের মনে। তবু সে ঘেন্নাটাও গেঁথে আছে তারই শরীরে। কেউ যদি শখে আহ্লাদে এক বেলা এক সানকি ভাত দিতো ননাইকে, ননাই ভাত গেলার সঙ্গে সঙ্গে গিলেছে মায়ের কু-কীর্তির ইতিহাসও। জেলেপল্লীর যে নির্মলা মাসি গোপনে শরীর বেচে খায়, সেও তো দরদ দেখিয়ে কতবার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে গেছে ননাইয়ের বেশ্যা মাকে।
সেসব মানুষের ভিড় ঠেলে ননাই এসে আশ্রয় নিয়েছে যমুনায়। জেলেপল্লীর সব শিশু যখন মায়ের বুকের উমে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, ননাই তখন যমুনার বুকে ভাসতে ভাসতে রাতের আকাশের তারা গুনেছে। বুকের ছাতি ফাটা তৃষ্ণায় যমুনার বুক থেকে দু আঁজলা জল নিয়ে সে পিপাসা মিটিয়েছে। না, এ জননী কখনো ফিরিয়ে দেয়নি ননাইকে!
সারাদিনের ক্ষুৎপিপাসা আর প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে রাতে ঘরে ফিরেছে ননাই। কোলাহল থেমে গিয়ে জেলেপল্লী নিস্তব্দ তখন। সারাদিন সোনালি প্রাণের ছটফটানি নিয়ে উন্মুখ হয়ে বসে ছিল ননাইয়ের পথ চেয়ে। কাউকে কিছু বলারও সাহস পায়নি সে। নিজেও কিছু মুখে দেয়নি।
ননাই অবসাদে বিছানায় শুয়ে পড়লে সোনালি ধীরে এসে বসে ননাইয়ের পাশে। ভয়ে ভয়ে মাথায় হাত রাখে ননাইয়ের কপালে। বীতশ্রদ্ধ ননাইয়ের কাছে সোনালির এই আচরণ আদিখ্যেতা মনে হয়। সহ্য করতে পারে না আর। এক ধাক্কায় সোনালিকে ফেলে দেয় চৌকি থেকে। গর্জে ওঠে ননাই, নষ্টা মাগি ছুঁবি না আমারে। উৎকণ্ঠা আর বিক্ষিপ্ত মনে সোনালিরও ভেতরও দহন কম হয়নি সারাদিন। এই অপমান আর শারীরিক লাঞ্ছনায় সোনালিও মেজাজ হারায়। বলে ওঠে, নষ্টা মাগি আমি না তোর মা।
তারপর মিনিট পাঁচেক দুজনেই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। ননাই বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে গায়ের শার্ট কাঁধে তুলে নেয়। ননাই ঘর ছেড়ে চলে যাবে বুঝতে পেরে সোনালি এসে জড়িয়ে ধরে ননাইয়ের পা। ননাই এক ঝাটায় সোনালিকে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
পরদিন সকালে উসকোখুসকো চুলে হতবিহ্বল ননাইকে দেখা গেলো শান্তিকুঞ্জের বেশ্যালয়ে। টকটকে লাল চোখে তাকিয়ে আছে সে, অগুনতি কাননবালার মাঝে—এখানে কে তার জননী?