ভাঙা দরমার চৌখুপি গলে চাঁদের মোলায়েম জোছনা এসে পড়ছে কাঠের চৌকিতে। বাঁশের ঝাপতাড়া ভেতর থেকে ভেজানো। নড়বড়ে চৌকির ওপর শোয়া রেশমার কপালে-গালে চাঁদের আলোর আঁকিবুঁকি খেলে যায়। রহস্যময় সে আলো অদ্ভুত এক নরম মাদকতা ছড়িয়ে ঘরময় হেঁটে বেড়ায়। ছুঁয়ে যায় রেশমার প্রশস্ত কপালে, নগ্ন পায়ের পাতা পর্যন্ত।
কাত হয়ে শোয়া রেশমার ভরাট বুকের ওপর থেকে কাপড় সরে গেছে অনেকটা। নরম হাওয়ার কারসাজিতে এমনটা হয়েছে বলে মনে হয়। জোছনার তীব্র আলোয় তার মুখের খানিকটা আরও ঝলমল করে ওঠে। শুধু মুখ নয়; উঁচু কপাল, নিটোল থুতনি, গলার নিচসহ বুকের মাঝখান পর্যন্ত। নরম জোছনা মোমের মতো গলে গলা বেয়ে ঢুকে পড়ছে বুকের খাঁজে, সেখান থেকে আরও গভীরে, আরও গহীনে কোথাও।
হালকা তন্দ্রার ঘোরে নিশ্চেতন হয়ে আলসেমি নিয়ে পড়ে ছিল রেশমা। বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যারাতের একগুঁয়ে নিস্তব্ধতার মধ্যে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদু আওয়াজ শোনা যায়। সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে এক শান্ত ছন্দের তালে তার স্ফীত বুক ওঠানামা করে। ব্লাউজের গোলাপি আবদ্ধ ঠেলে উঁকি দেওয়া পদ্মফুলের মতো তার ভরাট স্তন দুটো বুকের ওঠানামার সঙ্গে হালকা দুলে দুলে ওঠে। আগে একসময় রেশমার এ রোশনাই করা রূপ বস্তির অনেক পুরুষের মধ্যেই কামভাব জাগিয়ে দিতো অনায়াসে। অবশ্য এখন তা একজনেরই দখলে।
সলতে নামানো হারিকেনের আলো ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। ভেতরে দম ফুরিয়ে এলে যেমন হয়—নিভু নিভু প্রাণের বিড়বিড়ানি আলাপন। তারপর একসময় দপ করে নিভে যায় সেটা। মিটমিট করে জ্বলা আগুন নিভে যাওয়ায় তেলে-বাতাসে একটা উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারী শুরু করে। তবে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢোকা সাদা জোছনা ঘরময় যে মোহময় আলোর ফাঁদ তৈরি করে দিয়েছে, তাতে রেশমার ভালোই লাগে। তাই আলসেমিটাকে আরও উসকে দিয়ে আগের মতোই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে সে।
নূরা এখনও কারখানা থেকে ফিরেনি। ঝালাই কারখানার সব কাজ গুছিয়ে মালিককে অর্ডারের মাল বুঝিয়ে দিতে ঠিক সন্ধ্যা লেগে যায়। তারপর মাইলখানেক রাস্তা পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন নূরা যখন বস্তির গলির মুখে ঢুকতো, ঘড়ির কাঁটা নয়টা পার হয়ে যেতো কখনো কখনো। কিন্তু, আজ সে সময়ও পেরিয়েছে অনেকক্ষণ আগে।
রেশমা তাই না খেয়ে চৌকির ওপর এপাশ ওপাশ করে অপেক্ষা করতে থাকে নূরার জন্য। হালকা হাওয়ার ধাক্কায় কেরোসিনের উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধটা নাকে এলে রেশমার ভালোই লাগে। কেরোসিন হাওয়া থেকে জোরে নিশ্বাস নিতে গিয়ে বুকভরে একটু ধবধবে সাদা জোছনাও ভেতরে ভরে নেয় সে। ভালো লাগার আবেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বাইরে ছপছপ আওয়াজ শুনতে পায়।
রাশু, দরজা খোলো।
নিচু গলায় পুরুষ কণ্ঠের ডাক। নরম সে ডাকে মায়া মিশে থাকে। না কি হালকা মিনতি? তবে সে ডাক ঝমঝম করে রেশমার একাকী নিস্তব্ধতা কেড়ে নেয়। নূরার ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরোয়নি তখনো। কিন্তু, এরই মধ্যে কারখানা থেকে বের হয়ে ঘণ্টাখানিক পথ হেঁটে গলদঘর্ম নূরার হাঁপ ধরে গেছে। পথের বিড়ম্বনাকে পায়ে ঠেলে রুদ্ধশ্বাসে যেন কত যোজন যোজন দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এসেছে সে রেশমার কাছে।
রেশমাকে আজকাল সন্দেহ হয় তার। ঠিক সন্দেহ নয়; বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। তাই কাজ শেষ হওয়ার আগেই মনটাকে ঠেলে বাড়ি পাঠিয়ে দিতো সে। নূরা জানে, ঝুপড়ি থেকে কারখানার দূরত্ব প্রায় দেড় ঘণ্টার। এই দূরত্ব আসতে তার প্রায়শই রাত হয়ে যেতো। নানান ছুতায় রেশমাও মাঝে মাঝে তাকে রাত অবধি ব্যস্ত করে রাখতো। কিন্তু, আজ সে সোজা হনহন করে ঝুপড়ির দিকে ছোটে। পথে কোথাও দাঁড়ায় না সে। এমনকি খোকনের চায়ের দোকানেও। দেড় ঘণ্টার দূরত্ব আসতে যতটুকু সময় লাগে, ব্যস ততটুকুই; এর একটুও বেশি নয়।
রেশমা কাজ ছাড়িয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। নতুন একটা জায়গায় কাজ নিয়েছে সে। মাইনে বেশি, সুবিধাও আছে নাকি অনেক। আর এই নতুন কাজ নিয়েই নূরার যত আপত্তি, জমে থাকা সন্দেহের পাহাড় রেশমাকে ঘিরে। গ্রাম থেকে শহরে এসে এই ঝুপড়িতে মাথা গুঁজে নিয়েছিল দুজনে। দুই বছরের নির্ঝঞ্ঝাট পুতুলের মতো সংসারে ভালোই তো ছিল দুজন। তবে নতুন করে…থাক। আর ভাবতে চায় না সে। এমন ভাবতে ভাবতেই ভেতর থেকে প্রায় নিঃশব্দে ঝাঁপ ঠেলে বাইরে আসে রেশমা।
আইজও তোমার দেরি হইলেঅ। না খাইয়া অপেক্ষা করতে করতে আমার কেমুন ঝিমানি চইলা আসছে।
রেশমার গলার স্বরটা ভারী মনে হয় নূরার। তবে তার দুই চোখ থির হয়ে আটকে থাকে আলোর ফিনকিতে ভেসে ওঠা রেশমার ভরাট বুকের খাঁজের ওপর। ততক্ষণে বুকের ওপর শাড়ি টেনে এনে দুই হাতে অগোছালো চুল পরিপাটি করে নেয় সে। নিজেকে সামলানোর মুহূর্তে রেশমার চোখের দিকে শরবিদ্ধ দৃষ্টি মেলে দেয় নূরা। ক্লান্ত সেই চোখ কী যেন লুকাতে চায় নূরার কাছে।
রেশমার শরীর থেকে প্রসাধনের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ঠেকে। চুলের গন্ধরাজ তেলের সুবাসমাখানো বাতাসে মাথা ঝিম হয়ে আসে। দরজার সামনের থিকথিকে কাদায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তীব্র ওই গন্ধমাখা বাতাস অবিশ্বাসের একটা পাতলা পর্দা তুলে দেয় দুজনের মাঝে। সংশয়ভরা মনকে প্রশ্রয় না দিয়ে তারপরও দিনশেষে অবসন্ন শরীরটাকে নিয়ে আশ্রয় খুঁজে নিতে চায় বস্তির এই গলিঘুঁজির চার দেয়ালের ভেতরে।
ঘর আন্ধার কইরা ছিলি ক্যান?
এমনেই। দেখো না, কেমুন জোছনা চাইরদিকে।
হারিকেন কই?
হারিকেনে ত্যাল নাই মনে হয়। দপ কইরা নিভ্যা গেল।
তাইলে কুপি জ্বাল তাড়াতাড়ি। আন্ধার কেমুন জানি লাগে।
নূরার সন্দেহভরা চোখ কুপির আলোয় খুঁজে নিতে চায় রেশমার সঙ্গে অন্যকোনো পুরুষের সম্ভাব্য সহবাসের চিহ্ন।
কী হইছে? ঝিম ধইরা আছো ক্যান? চাপকল থিকা পানি নিয়া আসছি। চোখেমুখে ছিটাইয়া লও। আমি ভাত বাড়তাছি।
রেশমাকে আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি মায়াবী মনে হয়। অবসন্ন নূরা চৌকির এককোণে বসে খুব সতর্কভাবে তার চলাফেরা লক্ষ করে। উৎসুক চোখে শরীরের অসংলগ্ন ভাষা পড়ে নিয়ে নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করে যায়।
কাজ শেষে বের হয়ে আসার পর এমনিতেই তার মেজাজটা আজ খিঁচ ধরে ছিল। কারখানার সামনের বড় রাস্তার মোড়ে লোকাল বাসের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। তারপর ঝুপ করে এক ঝটকা বৃষ্টিও নেমে গেলো তখন। ব্যস যা হওয়ার, ঠিক তাই হলো। কাকভেজা শরীরে ভিড় ঠেলে কোনো রকমে বাসে উঠলেও কিছুদূর গিয়েই আবার বিকল হয়ে পড়ল বাসটা। তারপর রাস্তায় নেমে কাদা-জল ডিঙিয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ফিরতে হয় বস্তিতে।
ঝিলপাড়া বস্তির কাছাকাছি আসতেই ভেজা শরীরেও নূরার মনটা চনমন করে ওঠে। এদিকটায় বৃষ্টি মনে হয় আগেই হয়ে গেছে, বৃষ্টির লেশমাত্র নেই এখানে। রাস্তার খানাখন্দে জমে থাকা পানি দেখে এমনই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় নূরা। বৃষ্টিধোয়া চাঁদের জোছনা তাই আরও ঝকঝকে লাগে তার কাছে। নূরার কেবলই মনে হয় বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের এ জোছনা ঢেউ তুলে আজ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাকে।
বৃষ্টিতে জবুথবু হলেও অনেকখানি পথ হেঁটে আসায় ভেজা জামা গায়েই শুকিয়ে গেছে তার। তাই আলসেমিতে আরও আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে সে। অথচ খুব বেশি আগের কথা নয়, কারখানা থেকে ফিরে আসলে রেশমা নিজেই ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে গোসল করিয়ে দিতো তাকে। কারখানার কালিঝুলি একেবারে সাবান ডলে ভালোমতো ধুইয়ে দিত সব। যেন পরম যত্নে নাবালক শিশুপুত্রকে শাসন করে চলছে। নূরার দিকে চাইত সে চোখেই। আজ কেন জানি এসব কথা মনে পড়ছে তার। নূরাকে একইভাবে বসে থাকতে দেখে রেশমা গামছাটা এগিয়ে দেয়।
—লও, আগে মাথা মোছ। ভেজা চুল নিয়া আর কতক্ষণ বইসা থাকবা?
নিশ্চুপ নূরা হাত বাড়িয়ে গামছাটা নেয়। তারপর শরীর থেকে ভেজা জামা খুলে নিয়ে আলনার এক কোণে ঝুলিয়ে রাখে।
—তোমারে এমুন চিন্তিত লাগে যে! কী হইছে? যাও, তাড়াতাড়ি গিয়া হাতমুখ ধোও। আমি সব গরম কইরা আনতাছি।
উঠতে গিয়েও অবশ শরীরটা বিছানায় লেপটে থাকে, ক্লান্ত পা দু’টো অনিচ্ছায় দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে চৌকির সঙ্গে। অলস অনিচ্ছু ভঙ্গিতে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে রেশমার রাত্রিকালীন ভোজের আয়োজন দেখে।
হারিকেনে তেল ভরে কুপি নিভিয়ে দেয় রেশমা। আগুনের সলতে উঠিয়ে দিয়ে আলোর পরিধি বাড়িয়ে দেয়। হারিকেনের খাঁচা থেকে হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে। কাপড় ছেড়ে নূরা ততক্ষণে নির্লিপ্ত শরীরে মাদুরে শান্ত হয়ে বসে। তবে তার অশান্ত মন আগের মতোই রেশমাকে নিয়ে গভীর ভাবনার মায়াজাল বুনে যায়।
দুই.
নূরার কেবলই মনে হয় আয়নাল এসেছিল ঘরে। ঘরময় অন্য পুরুষের উপস্থিতি সে টের পায় অবচেতনে, তার অদৃশ্য কল্পনায়। বাইরে ঝাপতাড়ার সামনে আজও সিগারেটের আধখাওয়া অংশ পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহের মাত্রা তরতর করে বেড়ে যায় তার। নূরা পান-বিড়ি-সিগারেট কিছুই খায় না। তাই তার সন্দেহের বীজ শেকড় গেড়ে বসে। আর কিছুদিন ধরে এমনিতেই তা ডালপালা গজিয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে।
রেশমাদের ঝুপড়ির নতুন ঘরটা জুটিয়ে দিয়েছিল ওই আয়নালই। যে পথে তাদের দুজনের আগে আসা-যাওয়া ছিল সেই গলির মুখেই আয়নালের ফোন-ফ্যাক্স, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীসহ ক্যাবল টিভির চালু দোকান। রোজ ওই গলিপথ দিয়েই তারা কাজে বের হয়ে যেতো। বিক্রি-বাট্টা বাদেও অনেক রাত পর্যন্ত লোকের আনাগোনা চলতো সেই দোকানে। এদিকে রোজ আসা-যাওয়ার সূত্র ধরেই তাদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
আজ সকালে কারখানায় যাওয়ার পথে কী কারণে যেন দোকানটি বন্ধই দেখেছিল নূরা। তার ওপর আয়নাল যেদিনই এই বস্তির দিকে কোনো কাজে আসতো সেদিনই বন্ধ করে রাখতো তার বেচা-কেনা। দোকান চালানোর পাশাপাশি ঝুপড়ি থেকে ঘরপ্রতি নির্দিষ্ট চাঁদাও তোলে আয়নাল। পার্টির ফান্ডে কিছু জমা দিয়ে বাদবাকি নিজেই সরিয়ে রাখে এমনটাই শুনেছে তারা।
রেশমা যে নতুন কাজে যোগ দিয়েছে, তাও সেই আয়নালেরই কল্যাণে। আগ বাড়িয়ে এত খাতির, মাখামাখি প্রথম থেকেই অস্বাভাবিক ঠেকেছিল নূরার। কিন্তু, প্রথম দিকে এ বস্তিতে ঠিকানা গেড়ে তারা ছিল সত্যিই নিরুপায়। আস্তে আস্তে রেশমার রূপের কাছে ধরাশায়ী হয়ে আয়নালও কাছ ঘেঁষেছে তার। মধুলোভী মৌমাছির মতো সম্মোহিত হয়ে ঘুপচি বস্তির এই অন্ধকার দুয়ারে হানা দিয়েছে সময়ে-অসময়ে। বিনা কারণে সময় কাটিয়েছে নোংরা বদ্ধ চৌখুপির ভেতরে।
—আইজ একটু ভালো-মন্দ রানছিলাম। মন চাইল। তোমার পছন্দের টেংরা মাছের ঝোলও আছে।
নূরা তাকিয়ে দেখে মুগের ডালের সঙ্গে সজনে ডাটার চচ্চড়ি, করলার ভাজি, কলার মোচার ভর্তা আর পুঁই-চিংড়ির তরকারি বাটিতে সাজানো। সঙ্গে টেংরা মাছের ঘন ঝোল। কয়েক লোকমা ভাত খেয়ে নিলেও মুখটা কেমন তেতো হয়ে থাকে তার। অথচ, করলার ভাজি সে পাতেই তোলেনি। কবে এনেছিল টেংরা মাছ তাও তার ঠিক মনে পড়ে না।
পাতে ভাতের দলা মাখাতে মাখাতে সে রেশমাকে কেবল মনের হাত দিয়েই ছুঁয়ে যায়। রেশমার সমগ্র সত্তাকে উপলব্ধি করতে চায়, আবিষ্কার করতে চায় নতুন করে। রেশমাকে দেখে আগে যেমন করে ভালোবাসা উথলে উঠতো, এখনো কি এমন হচ্ছে তার? এ প্রশ্নের কোনো সাড়া আসে না নূরার ভেতর থেকে।
চাঁদের নরম আলো জোয়ার এনেছে ঘরের ভেতর। আলো-আঁধারির অদ্ভুত ফাঁদ এঁকে চলেছে সারা ঘরময়। সেখান থেকে চৌকিতে শোয়া রেশমার মুখে, বুকে। নূরা কি সেই ফাঁদেই আটকা পড়ে আছে? আলেয়ার মতো বিছানো সেই মায়াজাল তাকে কি গ্রাস করে নিচ্ছে মিথ্যা কোনো মরীচিকার দিকে? রাত এলে সেই ভাবনাই আরও চেপে বসে নূরার মনে।
নূরার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকা রেশমাকে ছুঁয়ে দেখতে মন চায় একবার। নিঃসাড় রেশমার ওপাশ থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের চাপা আওয়াজ ছাড়া তেমন সাড়া আসে না। ছুঁতে গেলেই রাতের নৈঃশব্দ্যে চেঁচিয়ে ওঠে সে।
—আহ, কী করো? ছাড়ো তো। আইজ বড্ড কাহিল তুমি। ঘুমাও এখন।
কথাগুলো নূরার কানে ঝমঝম করে বাজে। অসীম বিরক্তি নিয়ে রেশমা হাত ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দেয় তার। অক্ষমতার তীর ছুড়ে দেয় উলটা নূরার দিকেই। তার ভেতরকার পৌরুষ তখনো ঝিমিয়ে থাকে। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা কামার্ত পুরুষের হিংস্রতাকে এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে একটু একটু করে জাগানোর যে চেষ্টা করছিল, তাও আর জাগতে চায় না। রেশমা এবার পাশ ফিরে শোয়। কাছ ঘেঁষে নূরার।
নৈমিত্তিক অভ্যাসের মতো স্বামিত্ব ফলানোর চেষ্টা করে যায় আবার। মনের লুকানো ইচ্ছাটা চাগাড় দেয় কামুক পশুর মতো, আদিম উদ্দামতায় হারিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু, শরীর আর মনের বিস্তর ফারাকের মধ্যে আবারও ছন্দপতন ঘটে। শরীর যে তার মনের একান্ত বাধ্যগত নয়, এটা সে টের পায়। তাই মনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে শরীরটা হাঁপিয়ে ওঠে শুধু। শরীর ও মনের এই সন্ধিহীন আচরণের কারণে উদগ্র কামভাব মুহূর্তেই দমে যায় নূরার ভেতরে। নির্লিপ্ত দুজন মানুষ সমান্তরালভাবে শুয়ে থাকে দুই ভুবনের বাসিন্দার মতো।
কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের একচিলতে উঠান দেখা যায়। কিছু এলোমেলো মেঘের অবিরাম লুকোচুরি খেলা করে সেখানে। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে ঘরের মধ্যে চোখ নামিয়ে আনে নূরা। ভাসমান মেঘের মতো প্রবল এক শূন্য অনুভূতি নিয়ে ভেসে যেতে ইচ্ছা করে তার। ব্যর্থতার অন্তরালে মুখ ঢেকে রেশমার মায়াবী মুখের দিকে তাকায়। কী নিবিড় ঘুমের অতলে ডুবে আছে রেশমা। বুকের শান্ত ওঠানামার সঙ্গে নিশ্বাস ভারী হয়ে আছড়ে পড়ছে তারই বুকের কাছে। রেশমার এই নিশ্বাসের ধ্বনি তার সংশয়ভরা চৈতন্যে নাড়া দিয়ে যায় বারবার।
সত্যিই তো! সবকিছুই তো নূরার কল্পনা। এমন তো কিছু ঘটেনি বা নিজের চোখে দেখেনি কিছু সে। আকাশের চাঁদটা যেমন অদৃশ্য কালি নিয়েও অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে যায় সবাইকে, রেশমার মায়াবী মুখছবিও তেমনি পূর্ণ শশীর মগ্নতা নিয়ে ধরা দেয় নূরার কাছে। এ যেন অনাবিল কোনো সুখ। যাপিত সময়ের সমষ্টি যদি জীবন হয়ে থাকে তবে সে সময়ের একটুখানি কালিমালিপ্ত হলোই বা! তাতে কীই বা এমন ক্ষতি?
মনের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে নিমগ্ন সুখের বানে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চায় নূরা। দেহ ও মনের এ অনিবার্য সংঘাতকে সামাল দিয়ে শেষমেশ নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। তারপর কখন যে ঘুমের তেপান্তরে হারিয়ে যায় তা নিজেই জানে না।
তিন.
ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙে নূরার। শেষ রাতের দিকে আকাশ ফর্সা হওয়ার আগে যেন আরও ঘোর অন্ধকারের পর্দা নেমে আসে আকাশের বুকে। সকাল না সন্ধ্যা বোঝার জো নেই মোটে। মুষলধারে বৃষ্টি হলেও চারদিকে কেমন স্যাঁতসেঁতে দমবন্ধ করা গুমোট পরিবেশ। দুই দিন ধরে বিজলী বাতি নেই ঘরের মধ্যে; অথবা সরকারি লোকেরা অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইন ভেবে কেটে দিয়ে গেছে হয়তো। এই নিয়ে ভাবনা নেই নূরার। আলো-অন্ধকার সবই এখন সমান তার কাছে।
ঝিলপাড়া বস্তিটাই তো গড়ে উঠেছে সরকারি খাস জমি দখল করে। ভূমি দখল করে যারা ফায়দা লুটছে এবং তাদের মতো শ্রমজীবী মানুষ থেকে মাসোহারা আদায় করছে তারা নাকি অনেক ওপর থেকেও আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। সেই চিন্তা নূরাদের নাগালের বাইরে। তাই তাদের দৈনন্দিন চাহিদা, অপ্রাপ্তি-অভিযোগগুলো জানানোর কোনো জায়গা নেই, সেটাও নূরা জানে। অপ্রাপ্তিগুলো অপদখলের ধাক্কায় হুঁশ হারিয়ে ফেলে প্রতিনিয়ত।
আকাশ অন্ধকার করে আছে মেঘ। গতকাল সন্ধ্যার জমাটবাঁধা মেঘগুলো কোত্থেকে যে উড়ে এসে আবার ছায়া ফেলেছে এখানে কে জানে? অথচ গতকাল রাতেও রেশমা-নূরার ছোট্ট ছাপরাজুড়ে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে পড়ছিল। ঘিঞ্জি বস্তির আনাচ-কানাচ পর্যন্ত এমন সুন্দর ফিনিক ফোটা জোছনার ঢল নেমেছিল যে এটা ভাবতেই বেশ অবাক লাগে নূরার।
ভোর হতে এখনো কিছুটা সময় বাকি। মাটির মেঝে বৃষ্টির ছাঁটে কেমন এঁদো কাদাময় হয়ে উঠেছে। আর এদিকে নূরার দেহেও রক্তের অদম্য বান ডেকে যায়। পায়ের কাছে রাখা পাতলা কাঁথাটি বুকের কাছে টেনে নিয়ে রেশমার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। গায়ে লেগে থাকা বাসি প্রসাধনের মৃদু সুবাস বুকে ভরে নিয়ে দেহমনের তিয়াস মেটাতে মরিয়া হয় সে। উষ্ণ শিহরণে পিষ্ট করতে চায় রেশমার অনাবৃত দেহকে। রেশমার শরীরের কোমল গন্ধ নেওয়ার পাশাপাশি কেমন একটা অচেনা পুরুষালি গন্ধও নিছক অনুমান করে সে। যে ঘ্রাণটা একদম অন্যরকম, লেগে আছে রেশমার মুখে-বুকে-চিবুকে।
নূরার শরীরের প্রতিটি রোমে বাঁধ ভাঙা যে কোলাহল জেগে উঠেছিল হঠাৎ তা থেমে যায়। তার শরীরের ভাষা বোবা হয়ে হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে। ভোগবতী রেশমাকে পূর্ণ করার আগেই শূন্য শিহরণে থমকে যায় সবকিছু। নিজেকে সামলে নিয়ে চৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অপ্রস্তুত নূরা। হালকা হাওয়ার শীতল অনুভব নিয়ে রেশমার অপূর্ণ নগ্ন শরীরটা পড়ে থাকে বিছানায়।
সকাল থেকেই আষাঢ়ের মতো ঢল নামে বস্তির সরু গলিপথে। রেশমা কাজে না গিয়ে শুয়ে থাকে ঘরে। জলকাদা মাড়িয়ে এমন বৃষ্টিতে কাজে যেতে কারই বা ইচ্ছা করে? রেশমারও ঠিক তাই হয়। তার শুধু অলস শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে নূরা নয় যেন অন্য কারও আদিম গন্ধ গায়ে মেখে। ওদিকে নিজের অক্ষমতাকে আড়াল করে নূরা ভেজা চুপসে হয়ে বেরিয়ে যায় কাজে। রাতে প্রায়শই এমন হয় তার। আকণ্ঠ তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যায়। কিন্তু, সেই জল আর পান করা হয় না কিংবা অথৈ জলে ডুব দিয়ে অবগাহন করাও হয় না। একটা অপ্রাপ্তি ও অক্ষমতাকে বহন করে নিয়ে চলছে দিনের পর দিন।
শরীর খারাপের অজুহাতে সেদিন তাড়াতাড়ি বস্তিতে ফিরে আসে নূরা। গলিমুখে ঢোকার আগেই দূর থেকে দেখতে পায়, দরজার ঝাঁপ ঠেলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আয়নাল, সঙ্গে রেশমা। হাঁটুর ওপর লুঙ্গির কাছা তুলে সন্তর্পণে জল ডিঙিয়ে বড় রাস্তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মুখে দিগ্বিজয়ী বীরের হাসি। রেশমার কাজে না যাওয়ার বাহানা সহজেই আঁচ করতে পারে সে। সীমাহীন আনন্দের পৌনঃপুনিক ঝিলিক উছলে উছলে উঠছে রেশমার শরীরে-মনে। মেঘলা দিনশেষে যেমন শেষ বিকেলের বৃষ্টিধোয়া রোদের আভা দিগন্তে ছড়িয়ে যায়, ঠিক তেমনি তার চোখের চাহনি ও মুখের মধ্যে খুশির বান উপচে ওঠে। কোনো ধরনের ক্লান্তিবোধ নেই, অপরাধবোধের চিহ্নমাত্র নেই। শুধুই এক ভোগবতী নারীর স্বার্থপর কামনা চাহিদার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলন স্পষ্ট হয় সে চেহারায়।
নূরা আর গলিমুখো হয় না। একছুটে পালিয়ে আসে সেখান থেকে। খোকনের চা-এর টঙের বেঞ্চিতে গোঁজ মেরে বসে থাকে। অনভ্যাসবশত একটা সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে গুঁজে দেয়। ভুসভুস করে ধোঁয়া বুকে টেনে না নিয়ে কেবল বাইরে আছড়ে ফেলে। কেমন একটা গ্লানি আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। গলিপথ থেকে বের হওয়া আয়নালের চোখাচুখি হতেই নিজেকে আড়াল করে নেয় সে। একটা সীমাহীন চোরাবালির ভেতর জীবনটা আটকে পড়ে যেন।
দোকানের সামনে দাঁড়ানো বস্তির রহিমা খালা নূরাকে দেখে একটু দাঁড়ায়। পিচ করে পানের পিক ফেলে আরেক খিলি পান মুখের ভেতর পুরে দিয়ে বরাবরের মতোই ঠেসারা করে তার দিকে।
—কীরে নূরা। কী শুনছিরে এইসব?
—কিসের কথা কও খালা?
—ওমা, এ তো দেখি ঘরের কথা কিছুই জানে না গো। তুই কি সংসারের খোঁজটাও ভালোমতো রাখিস নারে নূরা? বস্তির মাগিগুলা মুখে নানান কথা নিয়ে চরে বেড়ায়। রেশমার দিকে একটু ভালো করে নজর রাখিস গো।
তর্জনির ডগায় লাগানো চুনটা মুখে চালান দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায় রহিমা খালা। ইঙ্গিতে ঠিক কী বলে গেলো একটু ভালো করে বুঝে নিতে চায় নূরা।
—নূরা ভাই, মিষ্টি খাওয়াও। খোকনের কথার খোঁচায় তার সম্বিৎ ফিরে আসে।
—কী কস খোকন? কিসের মিষ্টি?
—ক্যান, তুমি কিছু জানো না? শুনলাম, রেশমা বু মা হইতে যাইতাছে। তুমি বাবা হইবা। আমাগো সবতেরে মিষ্টি খাওয়াও।
আয়নালের চোখে-মুখে ঝলকে ওঠা অর্থপূর্ণ সে হাসির ভাষা নূরা উপলব্ধি করতে পারে এখন। তার মাথায় খুন চেপে যায়। একদণ্ড অপেক্ষা না করে সে সরু গলি ধরে দৌড়াতে থাকে। আয়নালের চোখের সামনে দিয়েই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে পালিয়ে গলির শেষ প্রান্তরেখায় পৌঁছে যায়। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপা শরীরে কিছু একটা অঘটন কাণ্ড করেই ফেলবে বুঝি। নূরার এ আকস্মিক উন্মত্ত আচরণে দোকানের লোকগুলোও হতভম্ব হয়ে যায়।
ঝুপড়ি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল এক করে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তারপর এক ঝটকায় ঝাঁপ ঠেলে ভেতরে ঢুকে রেশমাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে।
—কী রে বউ। এই খুশির খবর আমারে আগে দিলি না যে?
—কাইল রাতেই কইতে চাইছিলাম।
—ঘটনা কি আসলেই সত্য?
লজ্জাজড়ানো কণ্ঠে রেশমা শুধু বলে, হ। তুমি বাবা হইবা।
সারাদিনের বৃষ্টিধকল সয়ে মেঘলা স্যাঁতসেঁতে দিনটা গোধূলির শেষ বেলাতে রোদের হালকা উত্তাপ মেখে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা নামার আগে আগে অক্ষম নূরার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটা বাবা হওয়ার আনন্দে গর্বে ফুলে ওঠে।