আকাশ দেখা হয় না কতদিন! কতদিন হয় না মেঘেদের ভেলায় মন ভাসিয়ে পাখির মতো শূন্যে ওড়া! জীবন তবু বয়ে চলে। বয়ে চলে নদী। নদী আর নারীর বহমানতায় মুগ্ধ, বিমোহিত হওয়ার ফুরসত আজকাল আর মেলে না কাননের। জীবনের ক্রীতদাস হয়ে সকাল-সন্ধে সে বিক্রি হয়ে যায় প্রাত্যহিকতার কাছে। সাত-সকালে ছুটতে হয় অফিসে। ফিরতে ফিরতে রাত। অফিসের কাঁচঘেরা জানালা দিয়ে যদি বা ফিকে আকাশ দেখা যায়, তাকানোর অবসর মেলে না, ইচ্ছেও মরে গেছে। এখন তাই আকাশের দিকে তাকালে বরং অচেনা লাগে খুব। মাথা ঘুরে ওঠে। হঠাৎ দেখা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার অস্বস্তি ভর করে।
আজ তবু কী মনে করে তাকায় কানন। কিংবা হঠাৎ ফুরসত মিলে যায় অনেকদিন পর। অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ে সে। সন্ধেটা অনেকদিন পর ফাঁকা পেয়ে কেমন বোকা বোকা লাগে নিজেরই। কী করবে, ভেবেই নষ্ট করে ফেলে অনেকটা সময়। কৃপণ যেমন আগলে রাখে ধন, তারপর হুট করে মৃত্যু এসে কাছে দাঁড়াতেই নিদারুণ আফসোসে হা-হুতাশ করে, ভোগ না করে মিথ্যে আগলে রাখার বোকামিতে কষ্ট পায়, তেমনি নষ্ট সময়টা ভেবে কাননেরও ভারী আফসোস হয়। একটু কষ্টও। অস্থিরতা ঘিরে ধরে। এমন কোনো বন্ধু নাই, যেখানে যাওয়া যায়, কাটানো যায় এই সন্ধেটা। কিন্তু এতদিন পর এই একটা সন্ধে তার নিজের করে পেয়ে, কিছুতেই সে মাটি করতে চায় না। ঘড়ি দেখে কানন। অস্থিরতা বাড়ে আরও। সাড়ে সাতটা। সাড়ে এগারোটায় তাকে ফিরতে হয় বাসায়। সাড়ে এগারোটায় বাসার মেইন গেটে তালা পড়ে যায়। এরপর বাসায় ঢোকা মানে আপা-দুলাভাইয়ের তোপের মুখে পড়া। আবাস গুটিয়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার তাগাদা। হাতে আছে ঘণ্টাচারেক সময়। এই সময়টা সে আজ উপভোগ করতে চায়। একটা রিকশা খালি পেয়ে হাত ইশারায় ডাকে।
কই যাইবেন? প্রশ্ন করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে রিকশাঅলা। কথা বলে না কানন। লাফ দিয়ে উঠে বসে। পায়ের ওপর পা তুলে জুত করে বসে প্রায় আদেশের সুরে বলে, যাও! কথা না বাড়িয়ে রিকশায় টান দেয় রিকশাঅলা। কানন দুহাতে বাতাস আড়াল করে কায়দা করে সিগারেট ধরায়। বেনসন অ্যান্ড হেজেস। সে নিজে খায় গোল্ডলিফ। আজ দিন ভালো ছিল। দাঁও বুঝে বসের রুম থেকে ঝেড়ে দিয়েছে এক প্যাকেট। দারুণ সুখে সে ধোঁয়ার রিং তৈরির চেষ্টা করে। ধোঁয়া বেশ পাক খেতে খেতে শূন্যে উড়াল দেয়। চোখ সরু করে দেখে কানন। ঠোঁটে গুঁজে রাখা সিগারেটে টান দেয় আবার। তার পরনে ধোপদুরস্ত জিন্স। গায়ে বাহারি টি-শার্ট। পায়ে কেডস। তাকে দেখে কেউ বুঝবে না, সে যে কলেজের গণ্ডিটাও পেরোয়নি।
ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়ই ঘটে গেলো ঘটনাটা। সেই থেকে সে গাঁ-ছাড়া। লাপাত্তা। পুলিশের ভাষায় পলাতক। পড়াশোনা আর এগোয়নি। এমনিতেও অবশ্য খুব জ্ঞানপিপাসু সে ছিল না কোনোকালেই। হঠাৎ-ই আকাশের দিকে তাকায় কানন। তাকিয়েই বুকের মধ্যে কেমন ধাক্কা লাগে। আজ কি পূর্ণিমা? ধুশ্-শালা! জোরেই বলে ওঠে সে। রিকশাঅলা পেছন ফিরে, কী কন? যাইবেন কই? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ততক্ষণাৎ।
যেই খানে মন চায় যামু। তুমি যাইতে থাকো!
ধমকের সুরে বলে রিকশাঅলা ছেলেটাকে ভালো করে লক্ষ করে কানন। তারই বয়সী। পঁচিশ-ছাব্বিশ। লুঙ্গি পরা, ছেঁড়া গেঞ্জি, পায়ে চটি। মাথায় একটা গামছা ফেট্টি করে বাঁধা। চোখ ফিরিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকায় কানন। চাঁদটা নির্লজ্জের মতন হাসে। তার চারপাশে গোল আগুনের চাকতি। কিংবা রঙধনু। চাঁদের থেকে কিছুটা দূরত্বে বৃত্ত তৈরি করেছে। চাঁদের ওপর দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া সাদা মেঘ ভেসে দূরে সরে যায়, আবার কাছে আসে। চাঁদটাকে কেন্দ্র করেই মেঘগুলোর পরিক্রমণ চলে যেন আজ। মাকে মনে পড়ে হঠাৎ। মনে পড়ে, এমনি চাঁদনি রাতে মা তাদের নিয়ে উঠোনে খেজুরপাতার পাটি বিছিয়ে বসতেন। গল্প শোনাতেন। তালপাখার বাতাস করতে করতে হঠাৎ-ই বলে উঠতেন, দেখ! দেখ! চান্দে সভা বসচে আজ!
শুনে কাননেরা ক’ ভাইবোন হৈ হৈ করে উঠতো। আকাশের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো তারা। চাঁদের আলোয় চকচক করত তাদের মুখগুলো। তখন চাঁদের দিকে তাকাতেই গায়ে কাঁটা দিতো কাননের। মায়ের আরও কাছটিতে ঘেঁষে সে প্রায় ফিসফিস করে বলতো, চান্দে কেমনে সভা বসে, মা?
কাননের অনুভূতি বুঝে তাকে কাছে টেনে মা বিজ্ঞের মতো বলতেন, চান্দের কাছে আজ বেবাক তারারা চইলা আসচে, তারা বেবাকে মিল্যা চান্দের লগে সভা করবো, দেহস না, চান্দের আজ কত রূপ ফুটচে? বেবাকের আলো আজ চান্দের ওপরে পড়চে, তাই আজ তার এত জৌলুস। মায়ের জ্ঞানগম্যিতে অবাক কানন ফ্যালফ্যাল করে একবার মা আরেকবার চাঁদের দিকে তাকাতো। গা শিউরানো ছমছমে এক অনুভূতি জাপটে ধরতো তাকে।
কাননের মতিগতি সুবিধার ঠেকে না রিকশাঅলার। বেশ রাত নেমেছে এখন। ঘরে তার পোয়াতি বউ। বেশি রাত রিকশা চালায় না সে আজকাল। সে তাই নিশ্চিত হতে চায়, ঠিক কোথায় যাবে আরোহী ব্যক্তিটি, কত রাত হতে পারে তার ফিরতে। অধৈর্য হয়ে তাই সে আবার জানতে চায়, ভাই, আপনে যাইবেন কই কন! আমি বেশিদূর যাইতাম না। আমারে বাসায় ফিরতে অইবো জলদি।
রাতের এইসব মাথা আউলা আরোহীদের সে বেশ ভয় পায়। এরা বিপজ্জনক হয়, সে জানে। কানন, কেন কে জানে, ভারী উদার হয়ে ওঠে হঠাৎ। উদাস উদাস গলায় বলে, বাসায় ফিরতে অইবো তোর? আহা রে! এক কাম কর, আমারে সামনে যে বেড়িবাঁধটা আছে অইহানে নামাইয়া দে। তারপর তোর যেইহানে মন চায়, যাগা, যা!
বেড়িবাঁধের নির্জন বাঁধানো ঘাটে থম ধরে বসে থাকে কানন। মরা নদীটায় চাঁদের আলো পড়ে কী অদ্ভুত দেখায়! আবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে আজ তার মায়ের ভাষায় ‘চান্দের সভা বসচে’। আগুনরঙা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে কেমন একটু চাপ অনুভব করে কানন। দমবন্ধ একটা অনুভূতি টের পায়। তারাগুলো আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলে। মায়ের নাকের নাকফুলটি হয়ে অজস্র ফুটে থাকে আকাশের গায়ে। কাননের চোখ জ্বলে। মা! তার বোকাসোকা, ভালোমানুষ মা! আকাশের কোন তারাটি হয়ে আছেন এখন কে জানে!
ভারী, ঠাণ্ডা বাতাস বয়। শহুরে ব্যস্ততা তেমন নেই এই রাস্তাটায়। বেড়িবাঁধের এই রাস্তাটা বাইপাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভিড় বেশ কম। সন্ধ্যার পর বেশ নির্জন। শুকনো, মরা নদীর দিকে তাকিয়ে নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে কাননের, মনে পড়ে গ্রামের পাশ দিয়ে ঝিরঝির বয়ে যাওয়া নদী। আহা! কতদিন যাওয়া হয়নি! কতদিন বসা হয়নি তার প্রাণজুড়োনো তীরে! হঠাৎই মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। মনে পড়ে যায় বিপ্লব ভাইয়ের মুখ। হাত মুঠিবদ্ধ হয়ে ওঠে নিজের অজান্তেই। দাঁতে দাঁত পেষে। বিড়বিড় করে, শালা! শুয়োরের বাচ্চা!
আত্মগ্লানিও হয় বৈ কি! নিজেরও ভুল ছিল তার। ছিল লোভ। কিন্তু সেটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না তার জন্য। আঠারো বছর বয়সে অমন লোভ হতেই পারে। সালটা ছিল দু হাজার নয়। ফেব্রুয়ারি, না কি মার্চ? মার্চই হবে, সম্ভবত। ঠিক মনে নেই। গ্রামে দিন, মাস, তারিখের খবর অত রাখে না কেউ। একদিন অনেক রাতে দরজায় কড়া নড়ে উঠেছিল তাদের। কানন বা তার ভাই-বোন, টের পায়নি কেউই । বাবা খুলে দিয়েছিলেন দরজা। সকালে ঘুম ভেঙে তারা দেখেছিল বিল্পব ভাইয়ের ফর্সা, ফোলা মুখ। বহুদিন বিপ্লব ভাই আসেনি তাদের তল্লাটে । অন্তত বুদ্ধি হওয়ার পর দেখেনি কানন । বিপ্লবকে দেখে তাই ভীষণ অবাক হয়েছিল তারা। বিপ্লব ভাই তেমন পড়াশোনা করেনি । ক্লাস এইট অব্দি পড়েই যোগ দিয়েছিল বিডিআর বাহিনীতে। তাদের গ্রামও কাননদের গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে। সে কারণে তাদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। চাকরির পর আরও দূরত্ব বেড়েছিল। মাঝে মাঝে, ছুটি-ছাটায় যদি বা নিজ গ্রামে যেত বিপ্লব, কাননদের বাড়িতে যাওয়া আর হয়ে উঠতো না তার। মা আফসোস করে বিপ্লবের মাকে বলতেন, তোমার পোলা তো আর তার খালারে চিনেই না বুজি! চাকরি পাইয়া পর কইরা দিলো তারে!
বিপ্লবের মা পান মুখে পুরে হাসতেন। সুখের হাসি, তৃপ্তির হাসি। হাসতে হাসতে বলতেন, কি যে কইস ছোট! বিপ্লব তোরে কত্ত বালাবাসে! আইলেই তোগো কতা জিগায়। সুময় করতে পারে না, তাই যাইতে পারে না রে পাগলি! সরকারি চাকরি, কত কাম তার বুজিসনে!
শেষের কথাগুলো বলার সময় বড় খালার মুখটা কেমন উজ্জ্বল, অহংকারী হয়ে উঠতো! ভারী অবাক হয়ে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো কানন। একজন মানুষ কি পরিবেশ, পরিস্থিতি, সময় আর স্থান অনুযায়ী বদলে যায়? বদলে যায় তার কথা বলার ঢং, মুখের অভিব্যক্তি আর চেহারার আদল? বড় খালাকে দেখত আর নিজের মনে কথাগুলো নিয়ে বেশ উল্টেপাল্টে ভাবতো সে। ঘুম ভেঙে সেই বিপ্লব ভাইকে দেখে তারা তিন ভাই-বোন তাই অবাক হয়েছিল খুব। খুশিও। সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন মা। এতদিন পর বেড়াতে আসা বোনপোকে তিনি কোথায় বসাবেন, কী খাওয়াবেন, ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন সে চিন্তায়।
কিন্তু বিপ্লব ভাইয়ের আচরণ যেন কেমন ধারা। আনমনা হয়ে থাকে। সামান্যতেই কেমন চমকে চমকে ওঠে। বাড়ির বাইরে তেমন একটা বের হয়। কানন তখন খুব ছোট তো নয়। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার। উড়ুউড়ু মন তার। সিনেমা, নাটক, দেখার নেশা। সে বিপ্লব ভাইয়ের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে দ্রুত। তার সঙ্গে আলোচনা করে নিজের জ্ঞানগম্যি ঝালাই করতে চায়। চায় রুবির বিষয়টা নিয়েও একটু শলা পরামর্শ করতে। হাজার হোক, সরকারি চাকরি করা শহুরে ভাইটি তার। সেই ভাইয়ের মতামতের একটা দাম তো থাকেই! রুবির সঙ্গে বেশ জমে গেছে তার ততদিনে। আড়ালে পেয়ে বেশ কবার চুমুও খেয়েছে রুবিকে। বেশ মেয়ে রুবি। এইটে পড়ে! কিন্তু বিপ্লব বড় একটা পাত্তা দেয় না কাননকে। পড়ে পড়ে ঘুমোয়। সামান্য শব্দ হলেই চমকে ওঠে, লাফ দিয়ে উঠে বসে লাল চোখে ভয়ে ভয়ে জানতে চায় কী হয়েছে, শব্দ কিসের! কেমন খটকা লাগে কাননের। এ কেমন ধারা মানুষ! দিনে ঘর থেকে বেরোয় না, কারও সঙ্গে কথাও বলে না তেমন, কতদিন পর এবার এলো, এলো যদি তো যাওয়ারও নামটি নেই আর! অথচ মায়ের কত অনুরোধ, উপরোধেও বিপ্লব কখনো এমুখো হয়নি! এখন কি তার চাকরি নেই? এমন অনেকগুলো প্রশ্ন কাননের মাথায় ঘুরতে থাকে। তাদের বাড়িতে টিভি নেই। সে টিভি দেখে গাঁয়ের মাতবর চাচার বাড়ি গিয়ে। শুধু বিশেষ কোনো নাটক, সিনেমা যখন চলে তখনই সে যায় শুধু। সেদিন কী মনে করে একটু আগেই হাজির হয় কানন। খবর চলছিল। তেমন মনোযোগ দেয় না তাতে কানন । হঠাৎ বিডিআর শব্দটি কানে আসতেই চমকে মনোযোগী হয় সে। ঢাকার পিলখানা দরবার হলের ভেতরে বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছে। অনেক আর্মি অফিসারকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে বিডিআর জওয়ানেরা। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে শক্তহাতে। অনেক বিডিআর সদস্য পলাতক আছে। পুলিশ হন্যে হয় জড়িতদের খুঁজছে। কাননের বুকের ভেতর থেকে উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ডটা বের হয়ে আসতে চায়। প্রচণ্ড ঘামতে থাকে সে। একছুটে বাড়িতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মাকে জিগ্যেস করে, বাজান কই, মা?
কাননের উত্তেজিত, ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মা ভীষণ অবাক হয়ে তাকান। সাঁঝের টিমটিমে পিদিমের আলোয় ভারি অদ্ভুত দেখায় কাননের কচি, নিষ্পাপ মুখ। তিনি উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করেন, কী অইচে বাজান?
কিছু না! বাজান কই, কও শিগগির, বাজানের লগে কতা আচে!
তোর বাজান গঞ্জের থনে আহে নাও অহনতরি। কি অইচে আমারে ক!
কইলাম তো কিচু না। বাজান আইলে শুইনো।
বলতে বলতেই বাইরে গলা খাঁকারির শব্দ শোনা যায়। বাবা আসেন। কানন বাবাকে বুঝিয়ে বলে সবটা। নিশ্চয়ই এই ঘটনার সাথে বিপ্লব ভাই জড়িত, নইলে কেন সে পালিয়ে বেড়ায়, কেন সে গা ঢাকা দিয়ে থাকে তাদের ঘরের কোণে! নিজের অভিমত ব্যক্ত করে কানন। সব শুনে বাবা ভয় পেয়ে যান খুব। খবরে যা দেখেছে কানন, তাতে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, এদের যারা আশ্রয় দেবে তাদেরও বিপদে পড়ারই আশঙ্কা প্রবল। ভয়ে, উত্তেজনায় শরীর কাঁপতে থাকে তার।
মা সব শোনেন। কেঁদে ফেলেন ভয়ে। বাবা বলেন, অরে চইলা যাইতে কও, অক্ষণ!
আহা! আগে তো পোলাডারে জিগাই কী অইচে, হ্যায় হাচাই অই কামে জড়িত আচিল কি না জাইন্যা লই। অহন তারে কেমনে আমি চইলা যাইতে কমু! আমার বোইনের পোলারে আমি কেমনে কমু, বাজান, তুই চইলা যা, তুই থাকলে আমগোর বিপদ অইব! মার কণ্ঠ বুজে আসে। চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
খাড়াও, তোমারে কিচু কইতে অইব না, আমিই কইতাচি! বলে হনহন করে ঘরের দিকে হাঁটা দেন বাবা। পেছনে, কানন আর তার মা। বিপ্লব শুয়ে ছিল উপুড় হয়ে। ঝিমুচ্ছিল। বাবা গম্ভীর কণ্ঠে ডাকেন, বিপ্লব!
জি, খালুজান! ধড়মড় উঠে বসে বিপ্লব । চোখ লাল, চোখের নিচে অনিদ্রার ছাপ স্পষ্ট ।
তুমি অক্ষণ এইহান থন চইলা যাও! অক্ষণ যাও!
বিপ্লব ভয়ে ভয়ে বোঝার চেষ্টা করে পরিস্থিতি । বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে নেয় অবস্থা । তারপর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বলে, ক্যান খালুজান, কী অইচে?
তুমরা কী করচো ডাহায়? তুমরা বলে মেলা আর্মি মাইরা ফেলচো? মেলা কিচু লুটপাট করচো? খবরে যে কইতাচে? পুলিশ তুমাগোরে খুঁজতাচে? তুমি বাবা অক্ষণ চইলা যাও, নাইলে আমরা বিপদে পইড়া যামু!
এবার ফ্যাকাসে একটু হাসে বিপ্লব । তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে সে এসবের সঙ্গে জড়িত নয়, এসবের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই । তাহলে কেন সে পালিয়ে আছে, প্রশ্নের উত্তরে সে জবাব দেয়, আর্মির ওপর অ্যাটাক হওয়ায় ভয়ঙ্কর ক্ষেপে আছে তারা, বিডিআরের যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরছে, তাই সে সাময়িক ছুটি নিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আবার সে চাকরিতে ফিরে যাবে। বাবা সন্তুষ্ট হন না তার উত্তরে, কাননেরও মনের মধ্যে কী একটা কাঁটা ফুটতে থাকে খচখচ। কিন্তু মা বিপ্লবের পক্ষ নেন। বাবার নিষেধ অমান্য করেই বিপ্লবকে আশ্রয় দেন তিনি। বিপ্লব থেকে যায়। কানন বড় একটা বিপ্লবের কাছ ঘেঁষে না আর। দূরে দূরে থাকে। মায়ের সিদ্ধান্ত ভালো লাগে না তার। কিন্তু মার কান্নার কাছে বাবা পরাজিত হন শেষতক। অগত্যা তারাও। সাতদিনের দিন সকালের দিকে তাদের বাড়িতে হাজির হয় পুলিশ। ঘিরে ফেলে সারা বাড়ি। হাতকড়া পড়ে বিপ্লব আর তার বাবার হাতে। বিপ্লবকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে বাবাকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় তারা অবশেষে ।
বেড়িবাঁধের নির্জনতায় বসে বাবার হাতকড়া পরা চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করে কানন। মনে করার চেষ্টা করে মায়ের সেই জলে ভেজা মুখ, বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার নিষ্ফল অনুরোধ, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারির দৃশ্য। আশ্চর্য! এখন আর মায়ের মুখটা তেমন স্পষ্ট ভাসে না মনে। তেমন কোনো কষ্টও জমে না বুকে। সে স্থির, শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে নদীর নোংরা, কালো হয়ে আসা জলের দিকে, জলে ভাসতে থাকা থির, শীতল চাঁদের দিকে। চাঁদটা কী বেহায়া, নির্লজ্জের মতন হাসে! কারও দুঃখ, যন্ত্রনা, বেদনায় কোনো বিকার নাই তার, নাই সামান্যও সহানুভূতি। আশেপাশে বেশ ক বার নিশিকন্যার উপস্থিতি টের পায় সে। যে উদ্দেশ্যে তার এই নির্জনতায় আসা তা বিফলে যায়। বেশ ক জন পাশে এসে তাকে শিকারের চেষ্টা করে ফিরে যায়। অশ্লীল উক্তিও করে কেউ কেউ। সেদিকে কান দেয় না কানন। চেষ্টা করে জলে ডোবা চাঁদের দিকে মনোযোগ অক্ষুণ্ন রাখতে। যেন চাঁদের গোলগাল ওই ছায়ার মধ্যেই তার ভূত-ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে আছে।
বাবাকে আটকে রাখে না প্রথমে। দু দিন পরই ছেড়ে দেয়। গুমোট মেঘ কেটে যায়। আর তখনই ভুলটা করে বসে কানন। নিয়তি টেনে নেয় তাকে। বিপ্লব ভাইয়ের ব্যাগটা অযত্নে পড়েছিল ঘরের এককোণে। কৌতূহলবশে ব্যাগটা খোলে সে। খুলেই চমকে ওঠে। ব্যাগের মধ্যে অনেক গহনা, সোনার। সেই সঙ্গে খুব দামি একটা মোবাইলফোন সেট। দেখেই বোঝা যায়। অফ করা সেটটা দেখে কৌতূহল হয় কাননের। বুকের মধ্যে খামচি দিয়ে জেগে ওঠে লোভ। খুব ইচ্ছে হয় সেটটা অন করে দেখে, সেটের ফাংশনগুলো জানার ইচ্ছেটা তীব্রভাবে খোঁচায় তাকে। সেট অন করে কানন। অনেক ছবি, গান, ভিডিও আছে সেটটিতে। দেখে। অফ করে রাখে আবার।
সকালে সেট অন করেছিল কানন। বিকেলেই পুলিশ ঘিরে ফেলে তাদের বাড়ি, পুনরায়। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে সেটের অবস্থান বের করে ফেলেছে তারা।
এবার বাবা নয় কাননের হাতে হাতকড়া পড়ে। লুট করা গহনা আর মোবাইল আত্মসাৎ করার গুরুতর অপরাধ তার বিরুদ্ধে। বাবা পুলিশ কর্মকর্তার পা জড়িয়ে ধরেন। অনুরোধ করেন কাননের পরিবর্তে তাকে গ্রেপ্তার করা হোক। নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন তিনি। অগত্যা বাবাকে আবার ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। বিচারে জেল হয়ে যায় বাবার। সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেন দ্রুতবিচার আদালত। বাবার শোকে অল্প ক দিন পরেই মারা যান দাদি। বাবা দেখতে পান না নিজের মৃত মায়ের মুখটাও। ছোট ভাইটি আর কানন আগলে রাখে তাদের মাকে। একমাত্র বড় বোনটার বিয়ে হয়ে ঢাকায় চলে যায় বরের সঙ্গে।
দূরে, নদীতে ছৈ-হীন নৌকা ভাসে । চাঁদের আলোয় দূর থেকে ঝাপসা চোখে পড়ে তাতে ঘনিষ্ঠ যুগল অবয়ব। কানন ইচ্ছে করলেই পারে অমন কোনো নৌকায় কোনো এক নিশিকন্যাকে নিয়ে ঘনিষ্ঠ হতে। ইচ্ছে করে না। রুবির মুখটা ছলাৎ করে ওঠে বুকের ভেতর। রুবি! শেষ পর্যন্ত কি-না রুবিকে খুনের অপবাদ মাথায় নিয়ে লাপাত্তা হতে হলো তাকে! শুধু কি খুন! সঙ্গে ধর্ষণ! এই অন্ধ সমাজকে সে কী করে বোঝাবে রুবিকে মোটেই ধর্ষণের প্রয়োজন পড়ে না তার! রুবি তো তারই ছিল, শরীরে, মনে! তবে কেন সে ধর্ষণ করবে তাকে, কিংবা খুন! দুর্বলের কথা কেউ শোনে না কোনোদিন, তার কথাও শোনেনি কেউ ।
এমনি মাতাল করা জোছনা ছিল সেদিন। রুবি লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে। বাড়ির পাশের খোলা মাঠটিতে বেড়ে ওঠা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে অনেক রাত অব্দি গল্প করেছিল তারা, বিস্ময়মুগ্ধ চোখে দেখেছিল জোছনায় ডুবে যাওয়া পুরো গ্রাম, মাঠ আর নদীর সোনালী শরীর। রুবিকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরেছিল কানন। ঘুম ভেঙেছিল শোরগোল, চিৎকারে। রুবি খুন হয়েছে। খোলা মাঠের মধ্যে উদোম পড়ে আছে তার নিষ্প্রাণ শরীর। সারা শরীরে রক্ত, জখম। সবুজ ফসলি জমিনের মাঝখানে পড়ে আছে রুবির রক্তভেজা শরীর । যেন এক টুকরো বাংলাদেশ, একটি পতাকা ।
বুকের মধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলে। তবু থির বসে থাকে কানন। কেন তাকে সন্দেহ করা হলো, কেন এক নম্বর আসাসির তালিকায় নাম উঠে গেলো তার, সে আর জানা হলো না তার কোনোদিন। বাড়ি ফিরে যাওয়া রুবি কী করে চলে এলো মাঠের খোলা বুকে, কেনই বা এলো, জানা হলো না তা-ও। বাবা জেলে। তার হয়ে লড়াই করার ছিল না কেউ। মা তাকে লুকিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকায় বোনের কাছে। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন তার পরপরই। কেমন দেখতে হয়েছিল মায়ের মৃত মুখটা কে জানে! এ বরং ভালোই হয়েছে, তার কল্পনায় মা এখনো জীবিত। মায়ের মৃত মুখ তাকে দেখতে হয়নি, এ নিয়ে তেমন আফসোস তার ছিল না কখনো, এখনো নাই। বাবাকে নাকি পুলিশি পাহারায় মায়ের জানাজায় অংশ নিতে দেওয়া হয়েছিল। ছোট ভাইটি এখন কেমন আছে কে জানে । সাজা ভোগ শেষে বাবা ফিরে গিয়েছেন গাঁয়ে । বিয়ে করে বেশ নাকি সংসার সাজিয়ে নিয়েছেন। ভালো। জীবন কি আর থেমে থাকে! সেও কি থেমে আছে! রুবির জন্য কিছুই কি আটকে আছে তার! রুবির খুনি, ধর্ষক হিসেবে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে একটি জীবন! এই যা আফসোস!
ঘড়ি দেখে কানন। সাড়ে দশটা। একবার ভাবে ফিরে যাবে। শুধু শুধু বোন-দুলাভাইয়ের মুখঝামটা ভালো লাগে না। গেটেও দারোয়ান ঝামেলা করে খুব। কিন্তু চাঁদটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না কানন। নদীর কালো জলে সোনালি চাঁদটা ঝিকমিকিয়ে ওঠে। জোছনার ছটায় অবশ করে তোলে কাননের সমস্ত শরীর, মন। মোহগ্রস্থ হয়ে সে ঘাট বেয়ে নেমে যায়। একটা খালি নৌকা ইশারায় ডাকে। নৌকা এগিয়ে এলে উঠে বসে তাতে। মাঝি অবাক হয়ে ইতিউতি তাকায়। কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে, আপনে একা যাইবাইন?
হ্যাঁ, তুমি বাইতে থাক।
কথা বাড়ায় না মাঝি আর । ছপাৎ ছপাৎ দাঁড় টানার শব্দ ভাসে হাওয়ায়। নৌকার পাটাতনে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে কানন। মাথার ওপর খোলা আকাশ, ভরা যৌবনা চাঁদ আর লক্ষ কোটি তারার দিকে তাকিয়ে বুকটা ভীষণ মুচড়ে ওঠে তার, কী যেন নাম না জানা বোধ বুকের মধ্যে অনবরত ঘাই মেরে যায়। একসময় ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুমিয়ে পড়ে সে। চাঁদের রাশি রাশি জোছনা জল হয়ে ঝরে তার ঘুমন্ত শরীরে। তারাগুলো অবিরাম নেভে আর জ্বলে। ঝিরঝিরে বাতাস বয়। নৌকা ভেসে চলে মরে যাওয়া নদীর বুকে। মাঝি টের পায় যুবকটি ঘুমিয়েছে। তাকে ডাকে না মাঝি। মাঝে মাঝে এমন উদ্ভ্রান্ত দু চার জন জুটে যায় তার নৌকায়। নিরুদ্বেগে সে তাই বৈঠা বায়। ঘুমের মধ্যে কাননের মনে হয়, নদী নয়, কোনো এক নারীর বুকে ভেসে আছে সে। নারীটি আর কেউ নয়, রুবি, যাকে খুন এবং ধর্ষণের অপরাধে পলাতক আছে কানন। কিন্তু নষ্ট এ সমাজ জানে না, রুবিকে ধর্ষণ করতে হয় না তার। রুবিকে ভালোবাসলে সে স্বেচ্ছায় কাননের হয়ে যায়। কাননের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি লেগে থাকে। বিদ্রূপের, অগ্রাহ্যের, অস্বীকারের। চাঁদটা চারপাশে আগুনের চাকতি নিয়ে তখনো জেগে থাকে, একা।