ডিসেম্বর মাস। শীতের সকাল। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এ বছর যেন শীতটা একটু বেশি। সংবাদমাধ্যমগুলোও সেই শীতের শুরু থেকে তা-ই বলছে। হেমন্তের মাঝামাঝিতেই শীত পড়তে শুরু করেছে। আর গ্রাম হলে তো কথাই নেই। যদিও উপজেলা শহর। তবু তো গ্রামের মতোই। এখানে বৃদ্ধদের জন্য শীত অনেক যন্ত্রণার। গরিবের জন্য তো শাঁখের করাত।
কনকনে শীতের মধ্যে একটু রোদ পোহানোর জন্য সবাই বসে আছে ঘরের সামনে। কেউ আগুন ধরায় কাগজে, কেউ পুরনো কাপড় বের করে আগুন জ্বালায়। রোদের দেখা নেই। মুক্তিযোদ্ধা ভাসাই বেপারী জবুথবু হয়ে বসে আছেন। গায়ে একটা পাতলা ফিনফিনে পাঞ্জাবি, যেটা গত বছর বিজয় দিবসে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। তার চাদর বা শীতবস্ত্র বলতে কিছু নেই। পাঞ্জাবির চেয়ে একটা চাদর খুব বেশি জরুরি ছিল তার জন্য। কিন্তু না, সরকার খুশি হয়ে যা দেয়, তা-ই নিতে হয়।
ভাসাই বেপারী একা একা স্মৃতি রোমন্থন করছেন। প্রতি বছর বিজয় দিবস এলে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়া হয়। একসপ্তাহ আগে থেকে চলতে থাকে প্রস্তুতি। প্রতিরাতে কাজ-কর্ম শেষে খিচুড়ি খায় নেতাকর্মীরা। দফায় দফায় মিছিল। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’—স্লোগানটা শুনলেই শরীরের ভেতরে এক অজানা শিহরণ জাগে। অক্ষম শরীরেও রক্ত টগবগ করে। তারপর অপেক্ষা সংবর্ধনার, পুরস্কারের, ভুনাখিচুড়ির। এই তো হয়ে আসছে দীর্ঘকাল পর থেকে।
বিজয় দিবসের সকালের কর্মসূচির শেষে দুপুরে কলেজ মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়া। উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত থাকেন। তারপর অমুক নেতা, তমুক নেতা, অমুক অফিসার, তমুক অফিসারের বক্তৃতা শেষ হতে হতে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরালেও আলোচনা শেষ হয় না। আর তাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শেষ না হলে সম্মাননা বা দুপুরের খাবার কোনোটাই দেওয়া হবে না।
রাগে-ক্ষোভে দুই/একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ইয়ের ভ্যাড়-ভ্যাড় (বকবক) শুরু করছে। ও যুদ্ধের কী জানে? এমন ভাব দ্যাহায়, মনে অয়, অয়ই যুদ্ধ করছে। নেতা অইছে। ইয়ের নেতা। ব্যাটা ভ্যাড়-ভ্যাড় শ্যাষ কর। মাইক পাইলে আর ছাড়ে না।
বক্তব্য শেষ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নড়েচড়ে বসেন। তাদের কাঙ্ক্ষিত সময় চলে আসে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মহিলারা শাড়ি, পুরুষরা লুঙ্গি বা পাঞ্জাবি নেন। তখনই ভাসাই বেপারী দায়িত্বরত নেতাকে বলেছিলেন, বাজান এহোন বেজায় শীত, পাঞ্জাবি না দিয়া একটা চাদর দিলে ভালো অইতো।
নেতা খেঁকিয়ে ওঠেন, যান যান। ভিড় কমান। আগামী বছর পাইবেন। প্রত্যেক বছর পাইতাছেন, এই তো বেশি। যত পায় তত চায়। লোভ তো আর কমে না।
রোদ উঠতে দেরি হবে মনে হয়। কুয়াশার চাদর এখনো কেটে যায়নি। ঠাণ্ডায় ঠকঠক করতে করতে ডাকেন ছেলেকে—অই বশার-নুরা, কই গেলি তোরা? একটা পাতলা কাঁথা লইয়া আয় রে বাপ। জম্মের শীত লাগে। মইরা যামু রে। বশার ছোট ছেলে। কখন কোথায় যায়, কেউ জানে না। এই এখানে আছে, আবার নেই। নুরা বড় ছেলে। সংসারের ভারটা এখন তার কাঁধেই। নুরা ঘর থেকে একটা কাঁথা এনে জড়িয়ে দেয় ভাসাই বেপারীর গায়ে।
নুরা, ষোলই ডিসেম্বর কবে রে—ভাসাই বেপারী জানতে চান।
বাজান খাড়াও, ক্যালেন্ডারডা দেইক্যা আহি—বলে নুরা ভেতরে চলে যায়।
নুরার গমন দেখতে দেখতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাসাই বেপারী রোদের অস্তিত্ব খোঁজেন। অফিস-আদালতের লোকজন আসতে শুরু করেছে। রাস্তা থেকে ঘরের সামনে চলে যায়। ঘর বলতে একচালা একটা ছাউনি। সরকারি জায়গায় ছাউনিটা করেছে। সরকার চাইলে যেকোনো সময় উচ্ছেদ করে দিতে পারে। কয়েকবার করতেও চেয়েছিল। ভাসাই বেপারী বলেন, না। তুলব না। আমি মুক্তিযোদ্ধা। দ্যাশের লেইগ্যা যুদ্ধ করছি না?
দুঃখ তার একটাই। ছেলে দুটো মানুষ হয়নি। লেখাপড়াও করেনি। করলে আজ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি পেতো। আফসোস করেন ভাসাই বেপারী। বশার স্থানীয় প্রেসক্লাবের অফিস সহকারী। সাংবাদিকদের ফরমায়েশ খাটে। সাংবাদিকরা মাসে পাঁচশ’ টাকা দেয়। এ ছাড়া আশপাশের সবার কাজে সাহায্য করে। তারা খুশি হয়ে যে যা দেয়, তাতেই খুশি। বশারের নেশা শুধু পান। একগাল পান পেলে সে সারা দিন তার পেছন পেছন ছুটতে পারে। হয়তো পানের আশায় কার পেছনে ছুটছে এখন, কে জানে? তাই ডেকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘরের সঙ্গেই ভাসাই বেপারীর হোটেল। শুধু ভাত-তরকারি বিক্রি করে। নুরা চালায় সেটা। নুরার মা রান্নাবান্না করে। নুরার বউও কাজে সাহায্য করে। তবে লোকজন তেমন হয় না। আর টাকার অভাবে বাজারও তেমন করা হয় না। ভাসাই বেপারীর ঘর আর হোটেল ওই একটাই। পাশের দুই/তিনটা হোটেল ভালো চললেও এটা তেমন কারও নজর কাড়ে না।
নুরা ভেতর থেকে এসে জানায়, এহনো বারো দিন বাকি আছে।
ও তাইলে আর কয় দিন কষ্ট করি। দেহিস এবার আমাগো চাদর দিব—মুচকি হেসে বলেন ভাসাই বেপারী।
নুরা খেপে যায়—হ, চাদর দিব, কইছে তোমারে? তত দিনে শীতে মরবা। মরার পর ওই চাদর দিয়া তোমার কবর ঢাইক্যা দিমু, যেন কবরে বইয়া শীত না করে।
নুরার কথা শুনে ভাসাই বেপারীর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। নুরাও চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। ভাসাই বেপারী একটা চাদরের আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন।