আরও একটি রাত পেরোলো। দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, বিষণ্ন একটি রাত। রাতশেষে দিনের আয়নায় মুখ দেখতে সূর্যটা পৃথিবীর দিকে খানিক পাশ ফিরতেই রঞ্জুর মনে হলো, এই রাতটা না পেরোলেই বেশ হতো। বেশ হতো রাত্তিরের অন্ধকারেই সে চিরদিনের জন্য নিশ্চিন্তির বেশ একটি ঘুম জড়িয়ে শুয়ে পড়তে পারলে। কিন্তু আদতে তেমনটি হয় না। ছেনাল রাত শুধু আসে আর যায়, রঞ্জুর চোখে ঘুম আসে না তবু। দিনগুলোও রাত্তিরের মতোই বিষণ্ন কাটে ইদানীং। বিষণ্ণ আর একা।
অতীতের বাহুডোরে ফেরা যায় না বলে, ভবিষ্যতের পুরু পর্দা সরানো যায় না বলে, হতাশা ক্রমশই পেয়ে বসে তাকে, বিষণ্নতা আঁকড়ে ধরে আষ্টেপৃষ্টে। আর সদ্য মাথাচাড়া দেওয়া নতুন অসুখটাও সেই ফাঁকে আস্কারা পেয়ে তাকে জাপটে ধরে রীতিমতো। মেঘা তাকে ছেড়ে গেছে ঢের আগে। সে-ও প্রায় বছর ঘুরে এলো। তা যাক। উড়ে যাওয়া পাখির জন্য মায়া সে পোষে না মনে আর। যে চলে যাবার, সে যাবেই। তার জন্য মনের মধ্যে কান্না পুষে নিজের যন্ত্রণা বাড়ানোর ক্লেশ সে নিতে চায় না আর অকারণে।
প্রথম দিকে মেঘার মধ্যে বেশ একটু ইতস্তত ভাব দেখেছিল রঞ্জু। নিজের ভেতরে প্রশ্ন জমা হয়েছিল তখনই। মনের ভেতর মাথাচাড়া দিচ্ছিল চাপা উদ্বেগ। তবু পাত্তা দেয়নি রঞ্জু। পাত্তা দেয়নি মানে মন থেকে সে প্রায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিল সে-সব অহেতুক চিন্তা। কারণ সে জানতো, মেঘা তাকে ভালোবাসে, সে জানতো, পৃথিবীর সব প্রেম তার জন্যে জমা হয়ে আছে মেঘার মনে। সেখানে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই কোনো। হয়তো মেঘার কোনো সমস্যা হয়েছে, নিশ্চয়ই বড় কোনো অসুবিধায় পড়েছে সে, নইলে রঞ্জুর কাছে এসে এমন যাই যাই সে করে না কখনো। রঞ্জু না চাইলেও মেঘা রঞ্জুকে একা পাওয়ার জন্য হেন কোনো পাগলামি নাই যা করে না, করেনি। বরাবরই রঞ্জুর চেয়ে মেঘাই উতলা ছিল বেশি, প্রেমে সে রঞ্জুকে সবসময়ই হারিয়ে দিয়েছে অনায়াসে। সেই মেঘা।
মন থেকে সন্দেহের মেঘ যতই সময়ের ঘূর্ণি হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চেয়েছে রঞ্জু, সময় ততই লু হাওয়ার মতো সন্দেহগুলোকে আরও পাকাপোক্ত করে এনে ফেলেছে তার মনের ওপর, তীব্র কষ্টের আগুনে তাকে পুড়িয়ে দিয়েছে দাউদাউ। শেষের দিকে মেঘার আসা কমে গিয়েছিল একদম। মাসে-দুমাসে একবার আসতো, এসে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকত অসুস্থ, বিধ্বস্ত রঞ্জুর পাশে। কথা খুঁজে পেত না বলার মতো। ততদিনে রঞ্জুর মনেও জমে উঠেছে পাহাড়সমান অভিমান। সে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে ইচ্ছে করেই চুপ থাকত আরও। পাশের ঘরে মা হয়তো কাজে ব্যস্ত তখন, মাকে সাহায্য করার নামে, মায়ের সঙ্গে কথা বলার নামে উঠে যেত শেষে মেঘা, আর ফিরত না। মায়ের কাছ থেকেই বিদায় নিয়ে চলে যেত সোজা। হিশেব মিলত না রঞ্জুর। এই মেঘাকে সেই মেঘার সঙ্গে মেলাতে পারত না সে কিছুতেই। কোথাও একটা কিছু গড়বড় হয়েছে খুব, কোথায় যেন কেটে গেছে চিরচেনা সুরটির তাল, তার আর মেঘার সম্পর্কের সুতোটা কোথায় যেন আলগা হয়ে আসছে ক্রমশ। ভীষণ বেসুরে বাজতে শুরু করেছে তাদের দুজনের হৃদয়ের তানপুরা। টের পেত রঞ্জু। অবশেষে মেঘাই পর্দা সরালো সব রহস্যের। রঞ্জুর পাশে বসে নখ খুঁটতে খুঁটতে খানিকটা জড়ানো গলায় সে কথাগুলো বলল অবশেষে রঞ্জুকে। রঞ্জু ততদিনে নিজেকে প্রস্তুত করেই নিয়েছিল এমন কিছুর জন্য। সে বুঝে গেছিল ততদিনে, পরিস্থিতি বদলে গেছে। তার জন্য পৃথিবীর হাতেই যখন আর তিলমাত্র সময় নাই, তখন মেঘা তো অতি অল্পই বলল। মৃদু, স্খলিত গলায় বলা মেঘার কথাটাই অবশেষে মেঘাকে ফিরিয়ে দিল রঞ্জু, ‘আমি আর অপেক্ষা করতে পারব না। আমাকে আমার পথ খুঁজে নিতে হচ্ছে। বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যায় না।’
মেঘার যে প্রেমকে সত্যি ভেবে হাওয়ায় উড়েছিল সে একদিন, সেই মেঘা তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে পৃথিবীতে সকলই আপেক্ষিক, সবই রূপ পাল্টায় সময়বিশেষে।
চমকে রঞ্জুর মুখে নিজের বলা কথারই পুনরাবৃত্তি শুনে, রঞ্জুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থেকে, থমথমে মুখে উঠে সেই যে চলে গেছিল মেঘা, আর আসেনি কোনোদিন। আসবে না, জানত রঞ্জুও। কথা তো গোপন থাকে না কিছুতেই। নদীর মতোই সে বয়ে যায়, গোপনে, অতি সঙ্গোপনে। রঞ্জুর অসুখটার কথাও গোপন থাকেনি শেষমেষ। রঞ্জুর মা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন প্রাণপণে। অন্তত রঞ্জুর কানে যেন না আসে খবরটা, সেটুকু নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন কই! নিজেকে নির্ভার করতে মেঘা শেষদিন রঞ্জুর কাছে সব রহস্যের পর্দা উন্মোচন করে দিয়ে গেছিল। বলে গেছিল, রঞ্জুর এ অসুখ সারবার নয়। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন তাকে। আর বড়জোর ছ মাস। তারপর আর রঞ্জু বলে কেউ থাকবে না পৃথিবী নামক গ্রহটার পিঠে। মেঘা মন্দ করেনি কিছু। জীবন ছোট। অপেক্ষা নামক মোহঘোরে তাকে ফুরিয়ে ফেলাটা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা। মেঘা নির্বোধ নয়। সে নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। দীর্ঘ বারো বছরের প্রেমকে রঞ্জুর ছ মাসের অসুস্থতার কাছে বলি দিয়ে মালা পরিয়েছে অন্য কারো গলে। তা পরাক। সে সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক। তার প্রতি কোনো অভিযোগ, কোনো অভিমান পোষে না আর রঞ্জু। পোষ না মানা পাখির প্রতি ভালোবাসা যদি-বা থাকে, অভিমান বা অভিযোগ রাথা অর্থহীন, জানে রঞ্জু। সময় বড় আশ্চর্য দাওয়াই। সব সইয়ে দেয়। তারও সয়ে গেছে। চোখও খুলে দিয়ে গেছে বৈকি! মেঘার যে প্রেমকে সত্যি ভেবে হাওয়ায় উড়েছিল সে একদিন, সেই মেঘা তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে পৃথিবীতে সকলই আপেক্ষিক, সবই রূপ পাল্টায় সময়বিশেষে।
কিন্তু এইসব রাতগুলো বড় দীর্ঘ লাগে তার আজকাল। দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর। ক্লা্ন্তিকর আর বিষণ্ণ। মেঘার কথা সে ভাবে না আজকাল। নিজেকে নিয়েও না। মানুষ নিয়ে ভাবে সে আজকাল। জীবন নিয়ে ভাবে। যে অসুখটা তাকে এতদিন পুরোপুরি মেরে ফেলেছিল প্রায়, যে অসুখের কথা জেনে এসেছিল সে এতদিন সেটা ভুল ছিল, ডাক্তারের মারাত্বক ভুলের বলী হয়েছিল সে। অন্যজনের রিপোর্ট তার বলে ভুল করে তার আয়ু বড়জোর ছ মাস নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ডাক্তার। আর তাতেই সব উল্টেপাল্টে গেল। সামনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনে মনে মনে প্রায় মরেই গেল সে। আর তখনই তার মনে চুপিসারে জন্ম নিল এক নতুন অসুখ। কেউ জানল না, কেউ বুঝল না, শুধু সে একা লড়াই করে চলল নিজের মনে সেই একান্ত গোপন অসুখটার সঙ্গে। যুদ্ধ করে চলল নিরন্তর। এখনো চলছে তার সেই গোপন যুদ্ধ। ডাক্তার যতই তাকে আশ্বস্ত করে এখন তার কোনো অসুখ নাই বলে, ভেতরের অসুখটা ততই তাকে জাপটে ধরে ভীষণ জোরে। ততই সে অতীতে ফিরতে চায়, ভবিষ্যতে উঁকি দিতে চায়। আর কী অদ্ভুত। অতীতে ফেরার ইচ্ছে হলেই শৈশব এসে ভিড় করে তার মনে। শৈশবের দিনগুলিতে ফিরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে তাকে অস্থির করে তোলে। তার আজকাল মনে হয়, মানুষের চেয়ে অসহায়, পরাধীন প্রাণী আর হয় না পৃথিবীতে। কিংবা আর কোনো প্রাণীর সে বোধটুকু নেই বলেই এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। মানুষেরই যত হ্যাপা। এই যে, তার প্রবল ইচ্ছে হয় শৈশবে ফিরে যেতে, ইচ্ছে হয় শৈশবের সেই দারুণ সময়টাকে ছুঁয়ে দেখতে, কিন্তু পারে না, এরচেয়ে যন্ত্রণার, এরচেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে পৃথিবীতে? কিংবা তার যখন তীব্র ইচ্ছে জাগে আগামীকাল কী হবে তা জানার কিন্তু পারে না সে, আগামীকাল তো দূরের কথা, এক সেকেন্ড পরের ভবিতব্যটুকুও সে ঠাওর করতে পারে না কিছুতেই, তখন নিজেকে তার মনে হয় ভীষণ অসহায় আর পরাধীন এক সত্তা। অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝখানে যাকে কেউ আটকে রেখেছে দারুণ পরাক্রমে।
অতীত আর ভবিষ্যতের দেয়ালের চাপে তখন নিজেকে চিড়েচ্যাপ্টা মনে হতে থাকে তার, তাতে তার দমবন্ধ লাগে, লাগে দারুণ অস্থির আর উচাটন। তার সময়গুলো এভাবেই কাটে আজকাল। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে অতীতের স্বর্ণসময়গুলিতে ঘুরে আসতে, সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে ভবিষ্যতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে তা জানতে, কিন্তু কিছুই সে পারে না আদতে। সে বর্তমানের ঘেরাটোপেই খাবি খেতে থাকে শুধু, করে যেতে থাকে অস্থির যাপন। তার কেবলই মনে হয়, এই খাবি খাওয়াই তার ভবিতব্য, এই-ই তার জীবন। আর সবই অর্থহীন আর অবান্তর। তার দিন-রাত সব গুলিয়ে যেতে থাকে এইসব নিদারুণ চিন্তায়, তার জীবন বিষ হয়ে ওঠে এইসব গূঢ় রহস্যভাবনায়। তবু তার ধোঁয়াশা কাটে না, কাটে না ধন্দ। তার ভেতরের অসুখটা তার এইসব ভাবনাগুলিকে দেখে জাঁকিয়ে বসতে চায় আরও, জগতে ভাবনার চেয়ে কঠিন কোনো অসুখ নেই, সে কথা তাকে তারস্বরে ব্যক্ত করতে উদগ্রীব হয়, শেষে সেটা ডালপালা মেলে দিয়ে বাড়তে থাকে আরও রঞ্জুর ভেতরেই, রঞ্জুর ভাবনাগুলোকে আরও আরও উস্কে দিয়ে।
রঞ্জুর স্কুল জীবনটা এসে চোখে ভাসে। সেই প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলো তার! আহা! কী যে সুখের দিন ছিল সব! আর সেই শৈশবের বিকেলগুলো! শীতের সেই উদার উদাস ফসলের মাঠ! কোথায় গেল তারা! রঞ্জুর ইচ্ছে করে সে একছুটে চলে যায় সেইসব দিনে। শিখাকে মনে পড়ে। সেই ছোট্ট, পরির মতো মিষ্টি মেয়ে শিখা। দারুণ শান্ত আর লক্ষ্মী ছিল মেয়েটা। মনে পড়ে রঞ্জুর। তখন তারা ক্লাস ফাইভে পড়ত। গোল্লাছুট খেলছিল মেয়েরা। রঞ্জুর ওপর ভার পড়ল দলের সদস্য নির্বাচন করে দেওয়ার। অপেক্ষাকৃত ভালো দলটিতে শিখাকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য বাছাইয়ের সময় খানিক নয়ছয় করল রঞ্জু, কেউ ধরতে পারল না ব্যাপারটা। কিন্তু বোকা আর ভালোমেয়ে শিখা বুঝে ফেলল সহজেই। সে সেটা সবাইকে বলে দিল গিয়ে। এত রাগ হলো রঞ্জুর! যার জন্য চুরি করল সেই কি-না তাকে চোর বলে দুষল! রেগেমেগে সে দৌড়ে গিয়ে শিখার পিঠের ওপর দুম করে এক কিল বসিয়ে দিল সজোরে। বেচারা শিখা তার বড় বড় ছলছল চোখ রঞ্জুর চোখে রেখে অবাক তাকিয়ে থাকল অতঃপর। ইদানীং কী যে হয়েছে রঞ্জুর! শিখার সেই চোখ দুটো চোখে ভাসে! ইচ্ছে করে অতীতে ফিরে যায়, শিখার সেই ছলছলে চোখ তাকে অস্থির করে তোলে, তার ইচ্ছে করে শিখার কাছে গিয়ে ক্ষমা চায়, বলে, মাফ করে দে, শিখা! আমাকে মাফ করে, দে, প্লিজ!
তার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যায়, সময়গুলো হয়ে ওঠে দীর্ঘতর, বিষণ্ণ আর ক্লান্তিকর। মেঘার বলা শেষ কথাটা মনে পড়ে যায় তখন, ‘বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যায় না।’
কিন্তু বর্তমানের ঘেরাটোপে বন্দি রঞ্জু কিছুতেই সেই অতীতে ফিরতে পারে না, শিখার কাছে ক্ষমা চাওয়াও হয়ে ওঠে না তার। ফলে সে শিখার সেই ছলছল চোখের ব্যথাভরা দৃষ্টির সামনে ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে থাকে, গভীর গোপন অপরাধবোধে ডুবে যেতে থাকে তার মন আর সে পুড়তে থাকে নিজের ভেতরই নিরন্তর। শিখা হিন্দু ছিল, সেই ঘটনার অল্প কদিন পরেই তারা আবাস গুটিয়ে চলে গেছিল ওপার বাংলায়, ফলে আর তার সঙ্গে যোগাযোগেরও কোনো উপায় ছিল না রঞ্জুর। আর তাই সেই ছোট্ট পরির মতো মেয়েটার ব্যথাভরা অবাক দৃষ্টিটি তার স্মৃতিতে গেঁথে গেছিল দারুণভাবে, নাড়া দিত তাকে প্রতিদিন। কিন্তু ইদানীং, এই অসুখটার পর থেকে অতীতের কাছে ফেরার বাসনা তাকে অস্থির করে তোলে ক্রমশ। শৈশবের শিখার কাছে ফিরে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছেটা নিরন্তর খুঁচিয়ে মারে তাকে। একইভাবে শৈশবের বিকেলগুলোও তাকে পাগল করে তোলে আজকাল। তার ইচ্ছে হয় একছুটে ফিরে যায় সেইসব দিনে, সেইসব বন্ধুদের সঙ্গে আবার দারুণ হুল্লোড়ে মাতে, অর্থহীন সেইসব ছেলেমানুষিতে ভরিয়ে তোলে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ। কিংবা শীতের শীর্ণ মাঠের খোলা জমিনে সে বন্ধুদের নিয়ে ডাংগুলি খেলায় মাতে আবার, শুকনো ছোলার ঝোপে আগুন দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে গোল হয়ে বসে ছোলাপোড়া খায় আর আগুন পোহায় ভীষণ আহ্লাদে।
বাবার মুখটাও মনে পড়ে। শৈশবে বাবাই ছিলেন তার একমাত্র আশ্রয়। দিনরাত স্কুলশিক্ষক বাবার সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে থাকত রঞ্জু। বাবাকে সে ভালোবাসত ভীষণ। বাবার সঙ্গে কাটানো সেই মধুর ক্ষণগুলো উতলা করে তোলে তাকে। বাবার হাত ধরে প্রতি সকালে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্যটা চোখে ভাসে, প্রতি বিকেলে বাবার পিছু নিয়ে বাজারে গিয়ে বাবাকে চমকে দেওয়ার দৃশ্যটা ফিরে ফিরে মনে আসে, বাবার বাজারের ব্যাগ থেকে উঁকি দেওয়া রূপালী ইলিশ তাকে হাতছানি দিয়ে প্রতিনিয়ত ডাকতে থাকে সেই দারুণ দূরন্ত শৈশবে। রঞ্জুও তাই উতলা হয়ে অতীতে ফেরার রাস্তাটা খুঁজে ফেরে নিরন্তর। শৈশবে হারিয়ে যাওয়া বাবার মুখটা আরেকবার দেখার নেশা তাকে পাগল করে তোলে। কিংবা ভবিষ্যতে সে আর মা কীভাবে থাকবে, কী করবে, কেমন হবে তাদের সামনের দিনগুলো, সেসব জানার আগ্রহ তাকে করে তোলে ভীষণ অস্থির আর উদগ্রীব। সে তাই ভবিষ্যতে উঁকি দিয়ে দেখার মওকা খুঁজে ফেরে অনবরত। কিন্তু বাস্তবে সেসব হয় না কিছুই। অতীতে ফেরা হয় না তার, ভবিষ্যতে পৌঁছতে পারে না সে, এই বর্তমানের ঘেরাটোপেই শুধু খাবি খেতে হয় তাকে দিনের পর দিন। আর এভাবেই তার বর্তমানের সময়গুলিও দুম করে হারিয়ে যেতে থাকে অতীতের অতল অন্ধকারে, কিছুতেই ধরে রাখা যায় না তাকে, যেমন যতই সে ঢুকতে চায় ভবিষ্যতের কোটরে কিছুতেই তার থৈ পায় না খুঁজে, কোনো অনিবার্য আকর্ষণেই ভবিষ্যত এসে ধরা দেয় না তার নাগালের মধ্যে। যতই সে বর্তমানের খোলস ছিঁড়ে বের হতে চায়, বর্তমান ততই তাকে আঁকড়ে ধরে, তারপর হারিয়ে যায় অতীতের গহ্বরে আর ভবিষ্যত তার সামনে এসে হাজির হয় বর্তমানের রূপ নিয়ে। সে পড়ে থাকে কেবল বর্তমানেরই অর্থহীন, বিষণ্ণ পিঠে। আর তখনই তার মেঘাকেও মনে পড়ে। নিদারুণ একাকিত্ব তখন তাকে ছুঁয়ে যায়। তার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যায়, সময়গুলো হয়ে ওঠে দীর্ঘতর, বিষণ্ণ আর ক্লান্তিকর। মেঘার বলা শেষ কথাটা মনে পড়ে যায় তখন, ‘বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যায় না।’
বস্তুত বাস্তবতাকে অস্বীকার করার শক্তিটা সবার থাকেও না। রঞ্জু প্রাণপণ চেষ্টা করে তবু বাস্তবতাকে উপেক্ষার, অস্বীকারের। কিন্তু পারে কই! এইসব দীর্ঘতর রাত্রিগুলি তাকে বাস্তবতাকে আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয়। কঠিনতম দিনগুলি তাকে বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধে ক্লান্ত থেকে ক্লান্ত করে তোলে। তার ইচ্ছে যত প্রবল হয় অতীতে ফিরে যাওয়ার, কিংবা ভবিষ্যতে গিয়ে আগামীর দিনগুলি, আগামীদিনের নিজেকে, আগামীদিনের পৃথিবীকে দেখে আসার, ততই হতাশা বাড়ে তার, ততই বাড়ে তার বিষণ্ণতা। অতীত বা ভবিষ্যৎ কোনোটাতেই যাওয়ার কোনো পথ যখন সে খুঁজে পায় না কিছুতেই, তখনই সে আরও বেশি হতাশ আরও বেশি হতোদ্যম হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ডাক্তারদের ওপর আস্থা না পেয়ে যে মা তাকে ভারতে নিয়ে বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন সেই একমাত্র আপনজন মাকে মনে পড়ে, ভারতের সেই সৌম্যশান্ত ডাক্তারটিকে মনে পড়ে। রঞ্জুর বাংলাদেশে করা সব টেস্টের রিপোর্ট যিনি একফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘কে বলেছে আপনার ক্যান্সার, আর ছয়মাস বাঁচবেন? ভুল রিপোর্ট এসেছে। আপনার কিচ্ছু হয়নি। আপনি দিব্যি সুস্থ! যান, নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।’
ডাক্তার তো আর জানতেন না, মৃত্যু ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে জানার পর থেকেই নতুন এক অসুখ বাসা বেঁধেছে তার মনে! অতীতে ফিরতে চাওয়ার অসুখ, ভবিষ্যতে ভ্রমণাকাঙ্ক্ষার অসুখ, বর্তমানকে বন্দি খাঁচা ভেবে নিরন্তর খাবি খাওয়ার অসুখ! এ অসুখ সারবার নয়, জানে রঞ্জু। যেমন মেঘা একদিন জেনেছিল, রঞ্জুর ক্যান্সার, সে বাঁচবে না আর। আর তাই বারো বছরের প্রেমকে অস্বীকার করে দিব্যি অন্যকে বিয়ে করে জমিয়ে সংসার শুরু করেছিল মেঘা। ভেবেই ভীষণ হাসি পায় এখন রঞ্জুর। ইচ্ছে করে অতীতে ফিরে গিয়ে মেঘাকে বলে আসে, সব ভুল, তার কিচ্ছু হয়নি। ইচ্ছে করে ভবিষ্যতে উড়াল দিয়ে দেখে আসে মেঘার বিব্রত, ব্যথিত মুখ। কিন্তু পারে না রঞ্জু। বর্তমানের খোলসে সে খাবি খায় অহর্নিশ। বর্তমানের ঘেরাটোপ তার দমবন্ধ করে দিতে চায়, বিবশ করে তোলে। তার সময়গুলো হয়ে ওঠে দীর্ঘতর, বিষণ্ণ আর ক্লান্তিকর। ভেতরে গজিয়ে ওঠা নতুন অসুখটা তখন খলবল করে ওঠে আরও, ক্রমশ গিলে ফেলতে চায় তাকে।
রঞ্জু ক্লান্ত হয়ে ওঠে। বর্তমানের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে সে হাঁসফাস করে, মুক্তির বাসনায় হয়ে ওঠে তৃষ্ণার্ত চাতক।
হঠাৎ হঠাৎ বাঁধনও বুকের ভেতর সরব হয়ে ওঠে ভীষণ। বাঁধনের মুখটা চোখে ভাসে। আশ্চর্য! আশৈশব পরিচিত সেই একহারা গড়ন, দারুণ টানাটানা দুটো চোখের মায়াকাড়া দৃষ্টি, একমাথা কোঁকড়া চুলের কবি কবি চেহারার সেই মিষ্টি ছেলেটাকে মনে পড়ে না রঞ্জুর! বরং তার চোখে ভাসে রক্তে ভিজে যাওয়া বাঁধনের নেতিয়ে পড়া শরীর, খা খা রোদ্দুরে তেতে ওঠা রাজপথে বাইক দুর্ঘটনায় অসহায়, মৃত্যুপথযাত্রী বাঁধনের ক্লিষ্ট, পাণ্ডুর মুখ। কানে বাজে বাঁধনের বলা ফিসফিসে, শোনা যায় না প্রায় এমন স্বর, আমাকে বাঁচা রঞ্জু! আমি ছাড়া মার আর কেউ নাই রে! মা খুব কাঁদবে জানিস তো! মা! ও মা! মা!
বুকের মধ্যে শক্ত করে বাঁধনকে জড়িয়ে ধরে পথচারিদের সহায়তায় হাসপাতালে ছোটে রঞ্জু, বাঁধনকে বাঁচাতে এ ওয়ার্ড সে ওয়ার্ড দৌড়ায়, ডাক্তারদের অনুরোধ করে বাঁধনকে যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে দিতে। রঞ্জুর সব চেষ্টায় জল ঢেলে তার হাতের ওপর মাথা রেখেই তবু ঘুমিয়ে যায় বাঁধন, পৃথিবীর সঙ্গে সব মায়ার বাঁধন আলগা করে সে সমর্পিত হয় অনন্ত ঘুমে। বাঁধনকে কিছুতেই চেনা যায় না আর। তার সারা মুখ রক্তে লাল, মাথা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে উষ্ণ-লাল রক্তের ধারা। সে-ও আজ কত বছর হল! বছর পাঁচেক তো হবেই! কিন্তু রঞ্জুর মনে হয় এখনো সে বুকের মধ্যে জড়িয়ে আছে বাঁধনের রক্তাক্ত শরীর, এখনো সে শুনতে পাচ্ছে বাঁধনের সেই তীব্র আকুতিভরা ফিসফিসে, করুণ কণ্ঠস্বর! তার ইচ্ছে করে একছুটে সে বাঁধনকে নিয়ে যায় হাসপাতালে, ডাক্তারদের সহায়তায় বাঁচিয়ে তোলে তাকে, ফিরিয়ে আনে বর্তমানের এই বিভ্রান্তিময় সময়ে, বাঁধনকে বুঝিয়ে বলে তার অসুখটার আদ্যোপান্ত। কিন্তু পরক্ষণেই ভ্রম ভাঙে। আবার সে ডুবে যায় হতাশার চোরাবালিতে। তার মনে পড়ে, বাঁধন নিজেই হারিয়ে গেছে অতীতে, পৃষ্টা উল্টে সে সরে গেছে দূরে। শুধু সে একা লটকে আছে বর্তমানের খোলা এক পৃষ্টা হয়ে।
সময় বইটি তার অতীতের সব পৃষ্টা সরিয়ে নিয়েছে রঞ্জুর সামনে থেকে, আবছা ঝুলিয়ে রেখেছে স্মৃতির ছায়া, যার মোহঘরে সে আকুল হয়ে উঠছে ক্রমশ, যার সুবাস তাকে করে তুলছে মোহান্ধ। আর কুহকি সময় তার ভবিষ্যতের পৃষ্টাটি সরিয়ে রেখেছে রঞ্জুর নাগালের বাইরে, অদৃশ্য অবস্থায়। রঞ্জু ভাবে, অতীতকে তবু ক্ষনে ক্ষনে অনুভব করা যায়, পাওয়া যায় তার স্মৃতির সুবাস, কিন্তু ভবিষ্যত শুধুই এক অলীক স্বপ্ন, তাকে শুধু অনুমান করা যায় অন্ধের মতো, বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্বই নেই! রঞ্জুর প্রবল ইচ্ছে করে সময় নামক বইটি হাতের মুঠোয় নিয়ে উল্টে দেখে তার অতীতের পাতা, পাল্টে দেয় তার ভবিষ্যতের লেখা। ভাবে, আর অক্ষম অপারগতায় সে ছটফট করে। সে অনুভব করে সময় নামক বইটি তাকে বর্তমানের ক্লান্তিকর পাতায় আটকে রেখেছে, বন্দি করে রেখেছে প্রবল প্রতাপে। রঞ্জু ক্লান্ত হয়ে ওঠে। বর্তমানের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে সে হাঁসফাস করে, মুক্তির বাসনায় হয়ে ওঠে তৃষ্ণার্ত চাতক।