ঠাস করে চড়টা পড়ে নিজের পাচা বরাবর। বেশরম মশার উৎপাতে অগত্যা চড় ছাড়া উপায় নেই। কানের কাছে বিশ্রী শব্দ তুলে এই ছোট্ট অথচ ভয়ানক জানোয়ারটির সাহসের হিস্যা বেশুমার। চড়ে-চড়ে নিজের শরীর ব্যথা হতে পারে, মাঝে ঠিকই ফাঁক গলে অন্য পাশে উৎপাত শুরু করে দেয় তারা। কয়েল জ্বালিয়ে দিন, তার ওপরেই খেলা দেখাবে সে। রাগ করে গেরস্থী কেউ বলে, কয়েল না ছাঁই! একবার মেজমামার কাণ্ড দেখে হেসেছিলাম ঢের। মামা মশা মারতে উস্তাদ। কেউ আবার ভাববেন না, তিনি মশা মারতে কামান দাগান! মামা একটা মশা মারেন চট করে, সেটা আবার যত্ন করে রেখে দেন সমুখে রাখা বাটিতে। পুরো প্রক্রিয়াটায় মামার জ্ঞানের সীমা বোঝা যায় তার হাতের দ্রুত চলন ও কৃৎকৌশলে। বাটির তলায় মরা মশার ঢেরা! কেন বাপু এমন করেন? তার এককথা, নিজ জাতির এমন মরণদশা দেখে কে আসবে বলো রক্ত খেতে? এটা হলো গিয়ে মাইন্ড গেম, বুঝলে? কোনো শালাই এবার এদিকে আসবে না, দেখে নিও, এই বলে দিলাম। মামার হাতে তখনো লেগে থাকে মশার শরীর থেকে পাওয়া নিজেরই রক্ত। তিনি লহুতে লাল হাত পরিষ্কার করেন মিশন শেষ করে। আমিও ভাবি মশার এমন উৎপাতে মামার থিউরিটা ব্যবহার করবো কি না।
মশার সঙ্গে পুরো রুম অন্ধকারে জমে আছে। নিচ তলার বাসায় মশা-মাছি হয় জানি, এত অন্ধকার থাকে আজ জানা হলো। জগতে কতকিছু অজানা রয়ে গেলো এখনো ভাবতেও নিজেকে আমাম-আনপড় মনে হয়! চারপাশে গলাগলি করে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের পাশঘেঁষে কোনো আলো ঢোকার জো নেই ঘরে। আলো না আসুক, পচা-বিশ্রী গন্ধ ঠিকই আসে। দামি জায়গা, কেউ ছাড়তে রাজি নয় এক ইঞ্চিও। এই না-ত্যাগ মানসিকতা দামি জায়গার নিচের অংশকে করেছে করপোরেশনের ভাগাড়। অবস্থা এমন, ওপর থেকে ব্যালকনি হয়ে নিচে পড়ে যাবতীয় ময়লার ঠোঙ্গা। আরে শরমের কী, মহিলাদের ব্যবহৃত প্যাডে ভরপুর একেকটা বিল্ডিংর নিচের অংশ। কোনো দরকারে চোর কি ভাড়াটিয়া কারও সাধ্য নেই চিপা পথে যাওয়ার। ভাড়াটিয়ারা জিন্দা-লাশ, মাসশেষে ভাড়া গুনবে, নীরব থাকতে হয় জমিদারসুলভ যে-কোনো আচরণে। ডান কাত হয়ে শোয়া আমার পুরনো অভ্যেস। মূল গল্পে যাওয়ার আগে, এখানে মানে এই মশা-মাছির রাজত্বে আমি কী করে এলাম, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন বলে ভ্রম হতে পারে আপনাদের। আসছি ভালো কথা, তাই বলে একেবারে বিছানায়! মানুষ এমনই, বসতে দিলে শুতে চায় প্রবাদটা এখানে কিছুটা বেখাপ্পা। আমার বাসা ফেনী শহরের প্রাণকেন্দ্রে। চাকরির কল্যাণে বিখ্যাত ফেনী শহরে থাকি। এক সময় ময়মুরব্বির মুখে ঠাট্টাচ্ছলে ‘হেনি কলেজের টাকা লই চুদুরবুদুর চইলতো ন’ ডায়লগটা শুনে কৈশোরে বুঝি ভাবতাম ফেনী শহরের লোকজন খুব হিসাবী! চাকরির সাড়ে চার বছরের আয়ু খেয়ে চলেছি কিন্তু ওরকম কিছু চোখে পড়েনি আমাদের। শুরুতে ভাবতাম, ব্যাংকের চাকরি মানুষ করে কিভাবে! এত চাপ, এত প্যারা। ক্যাশ কাউন্টারের ভেতর কবরের আজাবের কিছুটা টের পেতাম। দীর্ঘ লাইন কাস্টমারের, তাদের নানা কথা, নানা আবদার, টিটকারিও। কেউ তো জাল নোট দিয়ে ধন্ধে ফেলে দেয়। মাস তিনেক পর কাউন্টার থেকে মুক্তি পেয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে বসি। এখানে আরেক বেদিশা অবস্থা। প্রকৃতির ডাক আসুক আর কোনো অসুবিধা, সমান মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে। কাস্টমার বলে যাবে নানান কথা, বোবা হয়ে, হাসি-হাসি মুখ করে সবই সহ্য করতে হবে। ছাড়ি ছাড়ি করে আর চাকরি ছাড়ার নাম মুখে আনি না। কষ্ট আছে সত্য, এই কষ্টের টাকাতেই তো মায়ের মেডিসিন কেনা, বাবার পকেট খরচ, বাজার খরচ আর অন্যান্য খরচের আঞ্জাম হয়। শেষে রাগটা এসে পড়ে নিজের উপর। শালা, আরেকটু প্রস্তুতি নিলে আমলা-টামলা কিছু হতে পারতি না! রোবট-রোবট ভাব থাকলেও বিকাল নাগাদ মাথাটা ধরে আসে, চোখে ঝাপসা দেখি।
আসলে ব্যাচেলর লাইফটাই এমন, সাথে যদি থাকে সমমনা রুমমেট। প্রচন্ড গরমেও কোলবালিশটা কাছে নেই আমি, ওপরে জিরান দিয়ে চলছে সিলিং ফ্যান।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে কিছুটা সান্ত্বনা পাই নিজের কাছে, চারদিকে কত কষ্টে আছে মানুষ। আমার কী এমন বিশেষ যোগ্যতা আছে যে, এত টাকা বেতন দেয়! আমাকে অনাহারী থাকতে হয় না, অর্ধাহারী থাকতে হচ্ছে না। অবশ্য মাস শেষে একাউন্টে সঞ্চয় থাকে না মোটেও, যা খোদ বিশ্বাস করতে পারে না পরিবারের লোকেরাও। গৃহপালিত প্রাণির মতো আড্ডা দেই বাসায়, তারপর রুমমেটেরা একসাথে খেয়ে যার যার মতো শরীর এলিয়ে দেই বিছানায়। বিছানা আর অফিসের এই মেলাবন্ধনে ফেনী শহরটা খুব বেশি দেখার সুযোগ হয়নি। সপ্তাহে দুদিন ছুটির কারবারটা বরং বাড়ি টু ফেনী বাস আর ছোটাছুটিতে খতম। কত প্রাণহানী এই সড়কে, কত দুর্ঘটনা দেখলাম! প্রাণটা হাতে নিয়ে আল্লাহ-খোদার নামে একেকজন যাত্রী যেন বসেন বাসের সিটে। যাত্রাপথে বারকয়েক ফোন দেন মমতাময়ী মা। তার উদ্বেগে ভরা প্রশ্ন, কদ্দুর আইলি বাপধন? যেতে যেতে রাতদুপুর হোক, তবুও এ্যাজমার রোগী মা অপেক্ষায় থাকেন তার মেঝ ছেলের জন্য। আর শিখিয়ে দেন, বাপ, দোয়া ইউনুস পড়িস, দেখেশুনে আসিছ। বাসের কথা আসলে আমার মনে বিরাট এক ধাক্কা দেয় ভাড়া-বিড়ম্বনা। এই এক-দেড় বছরে অন্তত তিন-চারবার বাড়লো ভাড়া। দামের কী মা-বাপ নাই? একবার এক সুতো বাড়লো জ্বালানীর দাম, আমাদের পকেটে এসে পড়ে তার দুই হাত ঘা। ভাগ্যগুণে দাম কমলে আগের ভাড়ায় যাবে সে নিয়মে বুড়া কেনো কনিষ্ট আঙুলও দেখায় না বাসয়লারা। কখন দাম বাড়ে, কেনো বাড়ে তার হিসেব নেবে কে? বাড়ার বেলায় সব ঠিক, কমার ইয়েতেও কেউ মুতে না! মাসে মাসে বেতন থেকে কর্তন হচ্ছে ট্যাক্স, তার হিসেব কোথাই থাকে খোদা মালুম। কিন্তু এবারের ঘটনা একটু আলাদা। ধৈর্য ধরুন মশাই, বলেছি বিস্তারে। গত কদিন আগে আমাদের হেড অফিস থেকে সার্কুলার আসে প্রমোশন ডিওদের তালিকা এবং ভাইভার দিন-তারিখ। মনে তখন হাওয়া মে ওড়তা ভাব, নিজেকে ভাবতে শুরু করি আরেক রেঙ্ক উপরের কর্মকর্তা হিসেবে। এমনিতে এসিস্ট্যান্ট অফিসারের পর জুনিয়র অফিসার পদে পদোন্নতী হলে বেয়াক্কেল বন্ধু আর আত্মীয়-কুটুমদের হাসাহাসির তালে পড়ে কেমন বেইজ্জত অবস্থায় পড়েছিলাম তা বিগত দুইটা বছর বয়ে বেড়ানোর ক্ষত এখনো দগদগে। তাদের কথা কী বলবো, খোদ কাস্টমারেরাও অফিসিয়াল সিলে জুনিয়র অফিসার পদবী দেখে সমীহের ভাবটা কতখানি কমিয়ে দেয় তাও বারকয়েক খেয়ালে পড়েছে আমার। এবার সেই পদবী ঘুছে যাবে, তার স্থলে ঝকঝক করবে অফিসার, মানে পূর্ণাঙ্গ অফিসার। সেই অবসরে সিভিটা সমৃদ্ধ করে বিয়ের বাজারে নামার হাওস আমাকে পেয়ে বসে। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের নজর তো কতদিকে দিতে হয়!
একজনের সিভি ভারি করার নয় শুধু তাদের দেখতে হয় হাজারে-হাজার কর্মীর সুখ ও সমৃদ্ধির খতিয়ান, মালিক পক্ষের তেল-ঝোলের বিষয়াদি। ফলে কুরবানির আগের যে ব্যস্ততা ব্যাংকে যায় তার নাম করে পিছিয়ে দেয় আমাদের ভাইভার পূর্ব নির্ধারিত তারিখ। ঘটনা সেখানে শেষ হলে গল্পটা লেখার কোন চান্সই থাকতো না আর পাঠককে গিলতে হতো না এই নিমতিতা বড়ি। আবারো ভাইভার তারিখ পাই আমরা মেইল মারফত। কিন্তু আমার বন্ধু কি কলিগ আরিফের মতামতকে কোন যুক্তিকে অগ্রাহ্য করবো আমি? আমার কাছে তখন ফেনী থেকে নোয়াখালী সদরের দূরত্ব পুলসিরাতের রং নিয়ে হাজির হয় যেনবা। একে তো ভাইভার ভয় ও উত্তেজনা, তার উপর সময়টা ঠিক দুপুর দুটো। ছোটখাটো বিষয়েও আমার মারাত্মক টেনশন হয় এটা সুবিদিত পরিচিত মহলে। ফলে আরিফের প্রস্তাবকে বাপ-ভাইয়ের উপকার জ্ঞানে কবুল করে নেই আমি।
সে আরেক লম্বা ঘটনা। সেদিকে যাবার বিশেষ খায়েস নেই আমার। ভাইভা দিয়ে আসার পর আবারো আমি আরিফদের বাসায় নামি। ওখানে রাখা আছে ব্যাগ, ব্যাগের ভেতর টি-শার্ট, জিন্স। ভদ্রস্থ হয়ে, বলতে গেলে একেবারে পরিপাটি হয়েই ভাইভা বোর্ডে যেতে হয়। ইস্ত্রী করা শার্টের ভাঁজ যাত্রাপথে ভেঙে যাবে এই ভয়ে আরিফদের বাসায় এসেই গায়ে চড়াই নতুন জামা। সাথে মানানসই প্যান্ট-টাই। অবশ্য চকচক করা সুটাও ফেনী থেকে পরে আসিনি। কারণ সবার জানা, যমুনা কি সুগন্ধা কিং বাসে যাত্রীদের হুশ থাকে কম, কারে ঠেলে কে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সেই প্রতিযোগীতায় বেখেয়ালে জুতোয় পড়ে যেতে পারে সহযাত্রীর পায়ের ছাপ। সতর্ক অবস্থানের এত আয়োজনের পরে বলা যেতে পারে ভাইভা ভালো হয়েছে। শুধু নামের অর্থটা পারিনি। আপনাদের বলতে লজ্জ্বা নেই, এখন আমার অনুভূতি, ‘এত লজ্জ্বা রাখি কোথায়’? আচমকা ‘আপনার নামের অর্থ বলুন’ প্রশ্নে বেদিশা হয়ে ওঠি আমি। মা-বাবা শখ করে ছেলের নাম রেখেছে তোজাম্মেল হক। মোজাম্মেল খুব দেখা যায় কিন্তু তোজাম্মেল? এমন আনকমন নাম রেখেছেন মা-বাবা, কোনদিন মনে উদয় হয়নি, এ-নামের অর্থটা কী? গুগল-টুগলও করা হয়নি কস্মিনকালে। আজ সেটাই কিছুটা নার্ভাস ও বিপন্ন বোধে তাড়িত করলো আমাকে। নিজের কানেই শুনতে পাই নিজের ধিক্কার, ব্যাটা আহাম্মক, নামের অর্থটাও জানোস না; যে নাম বড় করতে এত সাধ, তাকে জানতে হয়! এসি রুমের ঠাণ্ডা হাওয়াতেও যেন আমি ঘেমে ওঠি। বাকি প্রশ্ন কমন পরার খুশিতে ছুটির দিনের বিকেলটা আমাকে দিয়ে যায় দিবাঘুমের আন্তরিক আমন্ত্রণ। পরিচিত মহলে অনেকেই জানে, ছুটির দিনের বিকেলটা বড্ড ভালোবাসি শুধু ঘুমের জন্য। ওদিকে আরিফের ভাইভা বিকেল চারটায়, তার বাসায় আসা কমচে কম আরো দু ঘন্টার মামলা। সময়টা কাজে যথাযথভাবে লাগাতে আরিফের বিছানায় এলিয়ে দেই নিজেকে। আরিফের কোলবালিশটা জড়ায়ে নেই বন্ধুর মতো করে। আশ্চর্য, বালিশের গায়ে জ্যান্ত হয়ে আছে যেন আরিফের ব্যবহৃত পারফিউমের সুঘ্রাণ! শুনেছিলাম ফোনে, নতুন বাসায় ওঠার সময় দুই কলিগ দুটো কোলবালিশ নিয়েছিল। দুই ব্যাচেলরকে সেই বালিশ প্রদান অনুষ্ঠান ছিল রীতিমতো দেখার মতো। মোমবাতি প্রজ্বলন করে কেক কাটা হয়েছিল মহাসমারোহে। রাতে বাসায় হয়েছিল চমৎকার বিরিয়ানি, সাথে কোক। তারপর আরিফেরা কোলবালিশকে বউ এর মতো জেনে হাসিমুখে ছবি তুলেছিল! আসলে ব্যাচেলর লাইফটাই এমন, সাথে যদি থাকে সমমনা রুমমেট। প্রচন্ড গরমেও কোলবালিশটা কাছে নেই আমি, ওপরে জিরান দিয়ে চলছে সিলিং ফ্যান।
যেখানে ঘূর্ণির মতোন জন্ম নিচ্ছে মশার পোনা। মানুষেরা দিশাহীন, মশার উৎপাতে তাদের মন-মগজ ছিঁড়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে বিবেকের বাঁধন।
চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল সম্ভবত কিছুটা। পাশের লোকের নাক ডাকার বিকট চিৎকারে ঘুম উবে গেল মুহূর্তেই। স্থির হতে একটু সময় নিলেও নিজেকে সামলে নেই। এটা আমার বাসা নয় মনা, কুল, বি কুল। ফেনী শহরের বাসায় অবশ্য নাক ডাকার লোক নেই। এখানে যিনি নাক ডাকছেন ঘুমের সুখে তার নাম সাদেক শাহ, ব্যাংকের অফিসার। তাকে ডাকতে গিয়েও দমে যাই আমি। কমপরিচিত লোক, তারউপর বন্ধুর বাসার ক্ষণিকের অতিথি আমি। কি দরকার বাপু কথায় যাবার, নিজেকে প্রবোধ দেই। অবশ্য অনেকে বলে, আমি সিরিয়াস অনেক বিষয়ই নাকি গায়ে মাখি না, হেসে উড়িয়ে দেই। নাক ডাকার শব্দ বেশ উঠানামা করছে। আলো-আঁধারির এই সময়ে নাকডাকাটাও একটা ভিন্ন ব্যঞ্জনা তৈরি করতে পারে তার সাক্ষী হলাম যেনো চৌমুহনীর এই বাসায় শুয়ে! মশার উৎপাত বাড়ছে, বাড়ুক। আমি লোকটার চেহারার দিকে তাকাই। খুব স্পষ্ট না, যেটুক দেখি তাতেই চমকে ওঠি। বুকে এক দলা থুথু দেই বিস্ময় থামাতে। এ কী, সাদেক ভাই-ই তো শুয়ে আছে, কিন্তু ওটা কার চেহারা! কিছুটা মানুষ, কিছুটা কুত্তা, কিছুটা ঘোড়ার চেহারা নিয়ে আশ্চর্যরকম একটা খোমা বানিয়ে নিয়েছে সাদেক ভাই! আর বের হচ্ছে নাক ডাকার বিশ্রী সংগীত। বেহেশতে কী এমন সংগীত গিলতে হয় বিদ্যুৎহীন ভাঁপসা বিকেলে? নাক-মুখের এমন সমবেত সংগীত নিরালায় একা উপভোগ করার মতো বক্কিল নই আমি। কিন্তু ভয় ভর করে আমার ওপর। আশ্চর্য, বিছানা যেন লেপ্টে ধরে আছে আমাকে। আরিফকে ফোন দেবো সে অবস্থাও নেই, এখন সে থাকবে ভাইভা রুমে। সাদেকের চেহারা দেখে আমার মনে পড়ে নানা পদের মসনদে থাকা বিশিষ্ট লোকদের চেহারা। যারা জনমনের ভাষা বোঝে না, হৃদয় চেনে না। কেবল উপরিভাষায় কথা বলে। সেসব কথা শুনে হাসাহাসি করে লোকেরা, আফসোস সেটা বোঝার নূন্যতম বোধই নেই তাদের। নিজেদের কখনো তারা প্রান্তিক লেভেলে ভাবতে পারে না, উল্টো উপহাস করে এসব নিয়ে। ক্রমাগত বলে যায় মিথ্যে, মিথ্যে বলতে বলতে তাদের চেহারায় ছাপ পড়েছে কুত্তা-ঘোড়ার! তাদের নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে, চোখ দিয়ে, এমনকি অন্তর দিয়েও ক্রমাগত বেরুচ্ছে নাকডাকার বিকট শব্দ।
ভাইভার রেজাল্ট বেরিয়েছে আজ তিন মাস। আরিফ বা আমি কারো প্রমোশন হয়নি। আশায় পানি ঢেলে দিয়েছে নিয়তি। অথচ কত প্রস্তুতি, কত উত্তেজনা এই প্রমোশন নিয়ে। কেউবা বলে খালি যোগ্যতায় প্রমোশন হয় না, তৈলও লাগে। আজকাল প্রমোশন দেয় না, আনতে হয় নানা কায়দায়। দুঃখবোধে তেমন কথা হয় না কারো সাথে। ক্যারিয়ার নিয়ে তো নয়ই। এর ফাঁকে আরিফকে একবার ফোনে জিগাই, দোস্ত, তোদের রুমের সাদেক লোকটা কেমন? কিছুটা অপ্রস্তুত আরিফ আমার আতঁকা প্রশ্নে বেকুব বনে যায় যেনবা। খানিক বাদে, ক্ষীণ স্বরে ওপ্রান্ত থেকে সে বলে, লোকটা খুব ভালো, আচার-ব্যবহার একেবারে অমায়িক। মেসে খাবার সময় দেখে দেখে ভালোটা খায়, বাজারের সময় তার থাকে ব্যস্ততা। নিজেরটা ভালো বোঝে, পরের বেলায় টো টো। জবাব পেয়ে ফোন রেখে দেই আমি।
ঘুমভাঙা বিকেলে আমার চোখে ভাসে কেবল কিছু লোকের ছবি, যাদের মুখে লেগে আছে কুত্তা-ঘোড়ার ছায়া, আর তারা নাক ডেকে চলছে সমানে। যেখানে ঘূর্ণির মতোন জন্ম নিচ্ছে মশার পোনা। মানুষেরা দিশাহীন, মশার উৎপাতে তাদের মন-মগজ ছিঁড়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে বিবেকের বাঁধন।
অথচ দাবি করেন, আমাদের এখন বেহেশতে রাখা হয়েছে। বেহেশত কেমনরে মনা?