মেম্বারের লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা করছে আইডি কার্ড দেখে। আবদুল লতিফ। পিতা-মৃত নুর মোহাম্মদ সরকার। মাতা-মৃত বিলকিস আকতার। জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯। ঠিকানা: দুলু সওদাগর বাড়ী, ৭ নং ওয়ার্ড, দৌলদিয়া ইউনিয়ন। লোকজন বলাবলি করছে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ইউনিয়ন থেকে ত্রাণ দেওয়া হবে, তাই এই তালিকা। তালিকায় নাম তুলে মেম্বারের লোক চলে গেলে মাজেদা বেগম এক কাপ লাল চা আর প্লাস্টিকের বাটিতে একমুঠো মুড়ি দিয়ে যায় আবদুল লতিফকে। ঘরের দাওয়ায় বসে মুড়ি চিবোতে চিবোতে চায়ে চুমুক দিয়ে আবদুল লতিফ ভাবে—আইডি কার্ড বানানোর সময় তার নামের আগে কবিয়াল কেন লেখা হয়নি! চা আর মুড়ি খাওয়া শেষ হয় কিন্তু ভাবনার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না কবিয়াল আবদুল লতিফ। জামগাছের ডালে বসে ডেকে যায় বুলবুলি। জৈষ্ঠ্যের গরম বড় অসহ্য। লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে পুকুরের দিকে হাঁটতে থাকে কবিয়াল।
দৌলদিয়া গ্রামে ঢোকার পথে দক্ষিণ পাড়া হাটে আবদুল লতিফের ছোট মুদি দোকান। দোকানটায় ভাগ্যদেবীর সুদৃষ্টি পড়েনি। পড়বেই বা কী করে! আবদুল লতিফের নেশা কবিগান। গেলো তিনমাস কবিগানের কোনো বায়না নেই। হাটেও দোকান খুলতে পারেনি করোনার তাণ্ডবে। পুলিশ এসে সব বন্ধ করে দিয়েছে। হাতে পাতে যা জমানো টাকা ছিল, এ ক’মাসে তাও শেষ। মনের অস্থিরতা কমাতে ইদানীং বিকেলে হাটের দিকে যায় কবিয়াল। হাটে চৌকিদারের সঙ্গে দেখা হলে সে একগাল হেসে জানায়, কৃষি অফিসার তাকে দেখা করতে বলেছে।
কবিয়ালকে বলে, আমি আর রোকসানা একজন অন্যজনরে পছন্দ করি। আমগো মধ্যে ভালোবাসা হইছে, আমরা বিয়া করতে চাই।
পরের দিনই সাতসকালে পান্তার সঙ্গে আগের দিনের কলমি শাক ভাজি খেয়ে উপজেলার দিকে রওনা হয় কবিয়াল। মাজেদা বেগম খুচরো নোট আর কয়েন মিলিয়ে চল্লিশ টাকা দেয় কবিয়ালের হাতে। কৃষি অফিসে পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় তাকে। হাই ওঠে আলস্যে। অফিসার তখনো আসেনি। দূরে দেখা যায় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব শহীদ মিনার। গত বছর ডিসেম্বরেও এখানে কবিগান করেছে কবিয়াল। আজ সব ফাঁকা। শূন্য পড়ে আছে চত্বরটা। কবিয়ালের মনের মতোই হাহাকার উড়ছে হাওয়ায়।
সৃষ্টিকর্তা, প্রভু স্মরি, স্বদেশের বন্দনা করি,
দেশ আমার স্বাধীন বাংলাদেশ।
ফুলে ফলে সুশোভিত পাখির কণ্ঠে মুখরিত,
অতস্থানে পরিবেশিত, কবিগানের কত সুন্দর পরিবেশ।
স্মরণ করি বিশ্বের চির অমর মানুষ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ তাহাদের বন্দনা আমি গাই।
ভবে যারা মানব প্রেমিক, গবেষক সাধক বৈজ্ঞানিক,
সকলের উদ্দেশে আমি সালাম ও নমস্কার জানাই।
নিজের অজান্তেই গুনগুন করে কবিয়াল। তার ভাবনার সঙ্গে সকালও পাল্লা দিয়ে গড়িয়ে যায়। অবশেষে কৃষি অফিসার আসেন। তিনি জানান উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় শিল্পীদের তালিকা তৈরি করা হবে। কৃষি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সমন্বয় করার। আবদুল লতিফ যেন খোঁজ খবর রাখে। এরই মধ্যে কৃষি অফিসে লোকের ভিড় বাড়তে থাকে। কৃষি অফিস থেকে গরিব কৃষকদের জন্য কিছু সার, বীজ ইত্যাদির বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত গরিব কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। কবিয়ালের কোনো কৃষিজমি নেই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ভিড় এড়িয়ে কৃষি অফিস থেকে বের হয়ে আবদুল লতিফ ভাবে—সওদাগর মার্কেটের দিকে যাবে। সূর্যটা ততক্ষণে মাথার ওপর। পথটা আজ বড় দীর্ঘ মনে হয়। এ মার্কেটের একটি দোকানে সেলসম্যানের চাকরি করে হারুন। হারুন একসময় ঢোল বাজাতো কবিয়াল দলে। বিয়ের পর কবিগানের দলে যাওয়া আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয় ছেলেটা। কবিয়াল দলে ঢোল বাজানোর সময়ে হারুন প্রায়ই যেতো কবিয়ালের বাড়ি। বাড়িতে আনাগোনায় হারুনের সঙ্গে ভাব জমে রোকসানার। একদিন সকালে কোনো কারণ ছাড়াই হারুন কবিয়ালের বাড়িতে আসে। কবিয়ালকে বলে, আমি আর রোকসানা একজন অন্যজনরে পছন্দ করি। আমগো মধ্যে ভালোবাসা হইছে, আমরা বিয়া করতে চাই।
হারুনের কথায় নিরুত্তর থাকে কবিয়াল। ভাবে। হারুনকে বলে না কিছুই। হারুন চলে গেলে রোকসানাকে ডেকে বলে, এইগুলান কী কথা রে মা? পোলাডায় যা কইল তা কি সইত্য?
লজ্জায় লাল হয়ে রোকসানা ঘাড় নেড়ে জানান দেয়, হারুনকে সে পছন্দ করে। কবিয়াল এই প্রথম আবিষ্কার করে, মেয়ে বড় হয়ে গেছে তার, মেয়ের মনের ভেতর প্রেমের বাঁশি বাজতে শুরু করেছে, বাবা হয়ে একবারের জন্যও টের পায়নি সে। মাজেদা বেগম নিশ্চয়ই টের পেয়েছে, অথচ কবিয়ালকে সে জানায়নি কিছুই।।
কিন্তু মাজেদা বেগম সায় দেয় না ওটা বিক্রিতে। বলে, দ্যাখেন, কয়েকদিনের মধ্যেই পালার ডাক পড়বো। সবুর যখন করছেন তখন আর কয়টা দিন দ্যাখলে হয় না?
প্রায় দেড়মাস পর গত সপ্তায় হারুনের দোকান খুলেছে। কবিয়ালকে দোকানে দেখে হারুন বিস্মিত হয় খুব। কেমন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখায়। হারুন তাড়াতাড়ি চেয়ার এগিয়ে দেয়। মাথার ওপর ফ্যান ছেড়ে দেয় জোরে। মুখের দুপাশ দিয়ে নিচে নেমে আসা ঘাম মুছতে ভুলে যায় কবিয়াল। ঘাম শুকিয়ে কালচে রেখা গড়িয়ে পড়ে তার কানের পাশ দিয়ে। হাঁসফাঁস লাগে তার। ততক্ষণে হারুন বাইরে গিয়ে একটা ডাব নিয়ে আসে। ডাবে চুমুক দিতে দিতে কবিয়াল জিজ্ঞেস করে হারুনকে, তোমার শইলডা এহন কেমুন?
ভালাই, জ্বর আর আহে নাই। ধান কাটোনের সময় বিষ্টিতে ভিইজ্জা ঠাণ্ডা লাগছিল। হেই কারণে জ্বর আইছিল, ভয়ের কিছু নাই।
হ, তোমার শাশুড়িও বড়ই চিন্তায় আছিল তোমারে লইয়া। খালি নামায পড়ছে। মোবাইলে তো সব সময় ট্যাকা থাহে না যে ফোন কইরা খবরাখবর লাগামু। তুমি একটু সাবধানে থাইকো বাপ।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় কবিয়াল। বলে, যাইগা অহন। রোকসানা আর নানাভাইরে লইয়া বেড়াইতে আইসো দিনকাল ভালা হইলে।
হারুণ পাঁচশ টাকার একটা নোট কবিয়ালের হাতের মুঠোয় এক প্রকার জোর করে গুঁজে দেয়। কবিয়ালের বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। কতদিন আগে শেষবার মেয়েকে দেখেছে সে!
বাড়ি ফেরার পথে দৌলদিয়া স্কুল মাঠের কাছে এসে হঠাৎ কেমন এক নির্জনতা পেয়ে বসে কবিয়ালের। বেতের ঝোঁপ থেকে ডাহুকের ডাক ভেসে আসে। স্কুলের পুকুরে একদল সাদা হাঁসের সাঁতার ছাড়া আর কোনো কিছুই দৃষ্টিতে পড়ে না। মৃদু পায়ে হেঁটে মাঠের কোনে অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে কবিয়াল। ভাবে। এই তো সেদিনের কথা। কবিয়াল পিতা নুর মোহাম্মদের হাত ধরে এ স্কুলের মাঠেই কবিগানের হাতে খড়ি আবদুল লতিফের। তারপর কতো কবিগান যে গাওয়া হলো এ স্কুলের মাঠে তার কোন হিসেব রাখেনি কখনো। চোখের সামনে ভাসে অগণিত দর্শক। তাল-মাত্রা-সুর-ছন্দের সাথে এগিয়ে চলা যুক্তির লড়াই। ভাবতে ভাবতে পড়ন্ত দুপুরের সূর্যের রুপালি আলো গাছের ছায়া ভেদ করে এসে পড়ে কবিয়ালের মুখে। ধ্যান ভাঙে তার। আজ কেন যেন বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না আর। মনের ভেতরের বন্দনা রূপ নেয় নিজের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার রঙে। গানের পরিমণ্ডলে সেগুলো মুহুর্মুহু কোরাসের সুরে বাজে,
শুনেন দেশবাসীগণ,
যুদ্ধকালে স্থির থাকব,
এ করেছি পণ…
বাড়ি ফিরে পাঁচশ টাকার নোটটা মাজেদা বেগমকে দিয়ে বলে, ধর,তোমার জন্য মাইয়া পাঠাইছে।
আমগো নাতি বশির ভালা আছেনি? আর রোকসানা, হারুন, ভালানি তারা সবে?
হ, ভালা আছে, হারুন কইছে আর কটা দিন যাক, রোকসানা আর বশিররে কয়দিনের জন্য পাঠাইবো।
দেশে কি এক আইছে, কোরোনা কোরোনা! হের লাইগ্যা কারও মুখ দেখাদেখিও নাই। আপনি এত দেরি করছেন ক্যান?—বলতে বলতে মাটিতে মাদুর পাতে মাজেদা বেগম। অনেক বেলা হইছে, হাত মুখ ভালা কইরা ধুইয়া আসেন। খাইতে দিছি।
হাটে দোকানপাট খোলা শুরু হয়। ত্রাণও বিলি হয়ে যায়, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ত্রাণ পায় না কবিয়াল। মুদি দোকানটা খুলতেই হয়। আবার কবে কবিগানের বায়না শুরু হবে তা ভেবে কোনো কূলকিনারা পায় না সে। এমন অভাব শেষ কবে দেখেছে মনে করতে পারে না মাজেদা বেগম। এ কয়দিনে কবিয়াল যেন আরও বুড়ো হয়ে গেছে। বয়স যেন আরও বেশি কামড় বসিয়েছে তার পোড় খাওয়া মুখে। কবিয়াল ভাবে, এখন শেষ ভরসা উনিশ শ নব্বই সালে কবিগান গেয়ে পাওয়া স্বর্ণ পদকটা। কিন্তু মাজেদা বেগম সায় দেয় না ওটা বিক্রিতে। বলে, দ্যাখেন, কয়েকদিনের মধ্যেই পালার ডাক পড়বো। সবুর যখন করছেন তখন আর কয়টা দিন দ্যাখলে হয় না?
কবিয়ালের শ্বাসকষ্ট বাড়ে, সুনসান নীরবতায় ঝড় তোলে এক ভয়াল দানো। হারিকেনের আলো মিলিয়ে যায়, ঘন অন্ধকারে ডুবে যায় কবিয়ালের ঘর। মাজেদা বেগম ঘুমোয়। ঘুম ভাঙে না তার।
কবিয়াল ভাবে। সে দিন কি আর ফিরে আসবে? শত দর্শকের সামনে দেশপ্রেম আর মানবপ্রেমের বন্দনা করে ভালো-মন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণে প্রবল আলোড়ন তোলা সেইসব ক্ষণ! হয়তো আর আসবে না। সন্ধ্যার পর স্বর্ণকার মতিলাল ধরের বাড়ি যায় কবিয়াল। সঙ্গে করে পদকটাও নিয়ে যায়। স্বর্ণকার পদকটা হাতে নিয়ে খুব ভালো করে দেখে। সাফ জানিয়ে দেয়, এ সময়ে পদক বিক্রি করা যাবে না, তাছাড়া এখন সোনার দামও একদম কমতির দিকে। কবিয়ালের অনেক মিনতির পর স্বর্ণকার পদকটা তার কাছে রাখে, বলে, দ্যাখো কবিয়াল, তোমার অবস্থা দেইখ্যা এইটা আমার কাছে রাখলাম। তয় কতদূর কী করতে পারুম জানি না!
জৈষ্ঠ্যের শেষের দিকে প্রায় দিনই বৃষ্টি। দুইমাস পর হাটের দোকানটা খুলে পরিষ্কার করে কবিয়াল। কিছু মালপত্র যে দোকানে তুলবে তারও সুযোগ নেই। হাট থেকে ফিরতে পথে বৃষ্টিতে ভিজে যায় কবিয়াল। জ্বর আসে রাতে। সঙ্গে কাশি। ঠাণ্ডা লেগেছে ভেবে পাত্তা দেয় না অত। মাজেদা বেগম বলে, মাইয়ার দেওয়া ট্যাকাডি এহনও কয়ডা আছে। অই ট্যাকা থেইক্যা অল্প ওষুধ কিইন্না আনেন নির্মল ডাক্তারের কাছ থেইক্যা। আর স্বর্ণকারে যহন পদকটা নিছে, সে নিশ্চয় ট্যাকার একটা ব্যবস্থা কইরা দিবো।
কবিয়াল যে এর মধ্যে স্বর্ণকারের কাছে অনেকবার ধর্ণা দিয়েছে সে কথা মাজেদা বেগমকে জানায় না আর। স্বর্ণকারের হাবভাব কবিয়ালের ভালো ঠেকে না মোটেই। ভালো ঠেকে না কবিয়ালের শরীরও। জ্বর দিনে দিনে বাড়তে থাকে আরও। এর মধ্যেই শ্বাসকষ্টও শুরু হয়। এতটাই দুর্বল লাগে যে, বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয় তার। ফোনে রোকসানা বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে কাঁদে। মোবাইলে মেয়ের কান্নার শব্দ শুনে আর মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে চোখের কোনে জল জমে কবিয়ালের। সেদিন সন্ধ্যায় শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। বিদ্যুৎ নেই। হারিকেন জ্বালার তেল যতটুকু ছিল তা দিয়ে হারিকেন জ্বেলে দেয় মাজেদা বেগম। ঘণ্টা দুই হয়তো জ্বলবে। কবিয়াল খাটে শুয়ে। ঘুমিয়ে নাকি অচেতন, বোঝা যায় না। গায়ের ওপর মোটা কাঁথা। পাশে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমের ঘোরে ঝিমোয় মাজেদা বেগম। টিনের চালের ওপর তুমুল বৃষ্টির শব্দ কবিয়ালের কান পর্যন্ত পৌঁছয় না। নিঝুম নির্জনতায় কবিয়াল দেখতে পায় একটি উজ্জ্বল আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তার পিতা নুর মোহাম্মদ। আবদুল লতিফকে বলে, পালা যে শুরু হইয়া যায়। হাজার লোকের সমাগম হইছে। শোয়া থেইক্যা তাড়াতাড়ি উইঠা পড়।
—বলতে বলতে বাবার মুখটা ঝাপসা হয়ে আলোটা হারিয়ে যায় দূরে। কবিয়ালের শ্বাসকষ্ট বাড়ে, সুনসান নীরবতায় ঝড় তোলে এক ভয়াল দানো। হারিকেনের আলো মিলিয়ে যায়, ঘন অন্ধকারে ডুবে যায় কবিয়ালের ঘর। মাজেদা বেগম ঘুমোয়। ঘুম ভাঙে না তার।