আমার এই চিলেকোঠার ঘরের পাশেই একখণ্ড ছাদ। তার রেলিং ধরে উঁকি দিলে প্রতিদিন ঠিক তিনটা কুড়ি মিনিটে একটা মধ্য বয়সী ছেলেকে দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে। ছেলেটা একমনে যেন গাড়ির আসা-যাওয়া দেখে। আমি ওর চোখ খেয়াল করেছি, মনে হয় ছেলেটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করে। ইচ্ছে হয়, একদিন ছাদ থেকে হাঁক দেই—এই ছেলে তুমি কার জন্য অপেক্ষা করো? কেউ কি আসার আছে তোমার? কিন্তু আমিও অন্যদের মতো চাইলেই সবকিছু করতে পারি না। কেবল এই ছাদে বাগানে বসে থাকা ছাড়া। ডালিয়া, গোলাপ আরও নানা ফুলগাছের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে এক-একদিন আমার মাথা ঝিম ধরে যায়। মনে হয় আমি নেশাগ্রস্ত। আবার কখনো নিজেকে মনে হয় কোনো পতঙ্গের মতো। যেন আমি গাছের ফাঁকে বসে থাকি চুপটি করে, রঙবদলের আশায়। কিন্তু দিন যায়, যায় মাস, দণ্ড, পল থেকে অণুপল, তবু আমার রঙ বদলায় না। আমি গাছের সবুজের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করি, গাছ হবো বলে। মনে মনে বলি, এই চলৎশক্তিহীন পা দুটো শিকড় হয়ে ওঠো। এগিয়ে যাওয়ার বদলে না হয় মাটি কামড়ে ধরি। কিন্তু পা দুটো শিকড় হয় না বরং বারবার চলতে চায়, অথচ পারে না।
আমার এই ছাদবাগানের এখন নিত্য অতিথি সূচনা। স্বাধীনচেতা মেয়েটা আসে, হাসে, গল্প করে আবার রাগও। সে যেনতেন রাগ নয়, একেবারে দিবাকর মধ্যমা। যেন আমি ওর জন্মের চেনা, রাগ করা আমার ওপর সাজে। অথচ মেয়েটার সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র কয়েক মাসের, নার্সারিতে গাছের চারা আনতে গিয়ে। এর মধ্যেই ও আমাকে যেন আপন করে নিয়েছে। সূচনা বলে, আমার সঙ্গ নাকি ওর ভালো লাগে। আমি নাকি একটা পঙ্গু পতঙ্গ। ছাদ বাগানের এই গাছের পাতার ফাঁকে পা হারিয়ে বসে আছি চুপচাপ। ও আমাকে খুঁজে বের করেছে। আর দীর্ঘদিন ঢাকা থেকে মাথার ওপরের পাতার আস্তরণ সরাতেই আমি বিস্ময়ে চমকে উঠেছি। তারপরেই সূচনা আমাকে নিয়ে গান ধরে—‘আলোকে মোর চক্ষু দুটি, মুগ্ধ হয়ে উঠলো ফুটি।’ মেয়েটার এসব পাগলামিতে এখন আমি অভ্যস্ত। একটা নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে সরোবরে ও যেন আলোড়ন তুলেছে। ওকে দেখলে এখন আমি টের পাই, দশ বছর আগে সেই যে দুর্ঘটনায় আমার বাঁচার আনন্দ ফুরিয়েছিল, তার ছিটেফোঁটা যেন আজও রয়ে গেছে। সূচনা সেই আনন্দের ক্ষীণ ধারাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। আমি এখন নিয়মিত মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করি। একদিন ও না এলে আমি ছাদের সবুজ থেকে ফিরে যাই আমার ক্ষমাহীন কুঠুরিতে। সেখানে বসে আমি পাতার পর পাতা লিখে চলি মৃত্যু নামের জটিল অঙ্কের সহজ সূত্রগুলো। একদিন সূচনাকে দেখিয়েছিলাম আমার এই সূত্রের খাতাটা। ও হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। সূচনা বলে, মৃত্যু ওর কাছে দুঃসহ বরং জীবন স্পন্দন এক মহান অনুভব। আমি এত যত্ন নিয়ে মৃত্যু সাজাই বলে ওর কী অভিমান! আমি মেয়েটার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলি—শোন, এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে মৃত্যুকে আমি ডাকি স্বাভাবিক নিয়মেই। শুধু তার ধরন কেমন হবে, তা নিয়েই আমার কৌতূহল। মরে যাওয়ার আগে আমি বুঝতে চাই, মৃত্যু কাকে বলে? মৃত্যু কী ও কেন? মানুষ নিজেকে হত্যা ছাড়াও তো মৃত্যু উপহার দিতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে নিশ্চিন্ত ও সুখে মৃত্যুর উপায় কী? সূচনা গাল ফোলায়, বলে, না গো পঙ্গু পতঙ্গ তোমাকে এত দ্রুত মরতে দিচ্ছি না। আসছে বসন্তে ফুল ফোটাবে না? আমি তোমার ছাদ বাগানে বসরাই গোলাপের চারা বুনবো। ইতিউতি লাগিয়ে দেব মিরিন্ডা, সানসিল্ক আর পিয়ারি। মন খারাপ হলে যেন তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারো কিংস র্যানসনের পাপড়িও। দেখবে গোলাপ সৌকর্যে তোমার ছাদ কেমন ঝলমল করে। ওদের এক-একটির ওপর শিশিরের ফোঁটা মৃদুমন্দ বাতাসে কেমন জীবন নিয়ে কাঁপে। আমি ওকে বলি—তোর গোলাপ এত ভালো লাগে! সূচনা একরাশ ঝলমলে উচ্ছাস নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, লাগবে না মানে, গোলাপের মতো আর কোনো ফুল হয় নাকি? ও তো লালের লহমা, কী অসহ্য সুন্দর রক্তিম।
সূচনার কথায় আমারও গোলাপ হতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এসব মৃত্যুকাব্য ছুড়ে ফেলে জীবন গোলাপ আঁকি। সেদিন আমি ওকে বলেছিলাম, হ্যাঁরে আমাকে একটা বীজ মনে করে মাটিতে পুঁতে দিতে পারবি? আমি স্বর্ণলতা হয়ে তোর মতো একটা দস্যি গোলাপ গাছ আঁকড়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠবো। সূচনা আমার গলা জড়িয়ে বলে—স্বর্ণলতা কেন, তুমি না হয় আরেকটা গোলাপ হও। সর্বাঙ্গে রক্তলাল নিয়ে বাতাসে আমরা দোল খাব। আর একজন রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেখে বলবেন—‘সুন্দর’।
সুন্দর হলো সে । আমি অবাক হই, সূচনার তীব্র উচ্ছল মায়াময় মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কখনো মনে হয় ও ঠিক মানুষ নয়, একটা আস্ত গোলাপ। মাঝে মাঝে সূচনাকে দেখি একথোকা গোলাপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কী এমন দুঃখ তোর, কেনও কাঁদিসরে তুই? সূচনা ছলছলে চোখ লুকায় না, বরং আরও সজল হয়ে উঠে একমনে আওড়ায়—‘এখনো বহু রাত আমি গোলাপের স্বপ্নে ঘুমাতে পারি না/দৃঢ়বন্ধে জপটে ধরি গোলাপ, গোলাপ ভেবে ঘুম ও মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা/গোলাপ বস্তুত এই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন; জেগে উঠেই গোলাপ দেখি রক্তমাখা, গোলাপ দেখি কলুষকালো/গোলাপ দেখি গভীর গোপন অসুস্থতায়, অবসন্ন মর্মে ভীষণ বিষের ফণা।’
না না কবির কবিতা দিয়ে আমার মন ভরে না। কবি কিন্তু এও লিখেছেন—আমি গোলাপকে গোলাপ বলি না, বলি স্বপ্ন, বলি মৃত্যু, বলি মর্মান্তিক। তারচেয়ে বরং তুই কথা বল। গোলাপ তোর কথাতেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। সূচনা চোখ মুছে বলে, তোমাকে বসরাইয়ের চারা এনে দেবো। দেখবে কত্তবড় টকটকে ফুল ফোটে এই ছাদ বাগানে। তুমি আকাশের সাদাটে নীল আর ওই গোলাপের রঙ দিয়ে ক্যানভাসে ছবি আঁকতে পারবে। পঙ্গু পতঙ্গ, আমি চাই তখন তুমি মৃত্যুর খাতাটা ফেলে দেবে। আমি কী বলবো বুঝি না। সূচনা আমাকে গোলাপ স্বপ্ন দেখায় ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুর গোপন ভৃত্যটা যে আমার অকেজো পাগুলোর আশপাশেই ঘুরঘুর করে। সূচনা চলে গেলে সে আমাকে অন্ধকারে ফুসলায়—বেঁচে কী হবে? কার জন্য বাঁচবে তুমি, কে আছে তোমার? চলৎশক্তিহীন এমন জড়ের মতো পড়ে না থেকে মৃত্যু নিয়েই অলৌকিক জীবন্ত হও। দেখবে, সে জীবনে বেঁচে থাকার এত গ্লানি নেই। তারপরেই আমি ওই খাতা নিয়ে বসে যাই। মরতে তো পারি না, কিন্তু লিখতে তো পারি। লেখার মধ্য দিয়েই আমি মৃত্যুকে আহ্বান করি। আমার কলম দ্রুত চলে, ডাইরির সাদা পাতাটায় লিখি।
মৃত্যু অমোঘ, অজেয়, অনিবার্য। আমিও ধীরে ধীরে এই চিরকালীন নির্ধারিত ভাগ্যের দিকে এগিয়ে যাব হয়তো। এ ছাড়া আর কীই-বা করার আছে আমার? কিচ্ছু নেই। মা চলে গেলেন জন্মের সময়ই। বাবা কর্মের আগে। একজন প্রেয়সী ছিল, সেও চলে গেল নিজের বুঝে। তাই এই একা নিঃসঙ্গ গ্লানি বয়ে আমিও অপেক্ষায় আছি চলে যাওয়ার। জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য সাদা ও কালোর মধ্যকার পার্থক্যের মতো নাকি সরল নয়। কিন্তু আমি সরল মৃত্যু চাই। যেন খুব আরামে চোখটা বন্ধ করা যায়। আবেশে যেন ভারি হয়ে আসে নিঃশ্বাস। শুধু মাথার কাছে থাকবে একটা স্নেহময় হাত। আমার চলে যাওয়ার কষ্টে তার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়বে এই কপালে। পৃথিবীতে আমার প্রাপ্য শেষ বায়ুটুকু ফুসফুসে নিয়ে আমি সক্রেটিসের মতো সেই স্নেহময়কে বলে যেতে চাই—ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াস আমাদের কাছে একটি মোরগ পান, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভোলো না।
আচ্ছা সক্রেটিসের কাছে তো অ্যাসক্লেপিয়াস আরোগ্যের দেবতা, আমার সেই স্নেহময় হাতটি কে? আমি কাকে এই শেষ কথা বলে যেতে চাই? সে কি সূচনা! মাত্র কয়েক মাসের পরিচয়ে কেন মেয়েটিকে আমি আমার মৃত্যু শয্যায় বসাতে চাইছি! এসব আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে আমার দিন ফুরিয়ে যায়। গোধূলির আলোটাও মিইয়ে গিয়ে ছাদ বাগানে রাত নামে সন্তর্পণে। আমি সত্যিই একটা আহত পতঙ্গের মতো গাছগুলোকে পাশে নিয়ে দূরে জ্বলতে থাকা বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কখনো কখনো খানিকটা মদ্যপান করি, তামাকের ধুয়া উড়াই। অবশ্য সবসময় যে এই একক সাম্রাজ্যে আমিই একমাত্র থাকি, তা না। কাজের ছেলেটা শুধু ডাক দিলে আসে। তবে কারও অনুমতি না নিয়েই নিঃসংকোচে চলে আসে সূচনা। সেদিন যেমন দুই হাতে দুটি গোলাপের চারা নিয়ে এসে বললো—এই দেখো, বসরাই। কত কষ্ট করে দাম দিয়ে জোগাড় করলাম একজোড়া। এর একটা তুমি, অন্যটা আমি। দেখবে দুটো গাছেই কী মস্ত বড় ফুল ফোটে। সেই যে বলেছিলাম, আমরা দুলবো মৃদু হাওয়ায়। সূচনার উচ্ছাস দেখতে আমার ভালো লাগে। ইচ্ছে করে আরও দেখি, ওকে ছুঁয়ে একটু বসে থাকি। কিন্তু উচ্ছল মেয়েটা ছাদ বাগানের এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়। টব জোগাড় করে মাটি ছেনে নেয়। বসরাই চারা দুটো ও আজই বুনে দিতে চায়। আমি বলি, সূচনা আজ তোকেও টুকটুকে একটা আদুরে গোলাপের মতোই লাগছে। হাতে এক গাদা মাটি নিয়ে ও হাসে, বলে—গোলাপ এত লাল হলো কেনও জানো তো? বুকের রক্তে। রূপে মুগ্ধ একটা বুলবুলি আলিঙ্গন করতে গিয়েছিল শ্বেত গোলাপকে। কিন্তু তার কাঁটা ছিল ষড়যন্ত্রের মতো। কখন যে চোখা একটা কাঁটা ঢুকে গেল বুলবুলির বুকে পাখিটা তা টেরও পায়নি। ব্যাস, ছোট্ট পাখিটার তাজা রক্ত পেয়ে নিজেও একই রূপ ধারণ করলো শ্বেত গোলাপ। সেই থেকে গোলাপ হলো লাল আর রূপে মুগ্ধতা হলো আত্মহত্যার বিষ।
মাঝে মাঝে সূচনা যে এসব কী বলে আমি একদম বুঝি না। একটা বুলবুলি পাখি আলিঙ্গন করবে কেনও গোলাপকে! ও কি কখনো হয় নাকি। কিন্তু সূচনা বলে হয়। যা কিছু হয় না তার সবকিছুই নাকি মাঝে মাঝে হতে হয়। হয়তো এই বিশ্বাসটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়াবে। সবকিছু যে সবসময় হতে নেই, এটা ওকে বোঝাতে পারি না। কয়েকদিন আগে বায়না ধরলো, জার্মানি যাবে। সেখানে হিলদেশিম ক্যাথিড্রালে সবচেয়ে পুরনো গোলাপ ঝাড় আছে। অনেকটা দেখতে একজন ধ্যানী বৃদ্ধের উস্কখুস্ক চুলের মতো। তাতে নাকি এখনো ফুল ফোটে। কিন্তু সূচনাকে কিভাবে বোঝাই, পা থাকলে হয়তো কদম ফেলার সাহস হতো, কিন্তু এই হুইলচেয়ার নিয়ে পৃথিবী ঘুরে শান্তি পাবো না। তারচেয়ে বরং যতদিন বাঁচি এই বাড়িটাতেই কেটে যাক জীবন। হয়তো একদিন এসে দেখবি, তোর লাগানো বসরাইটাতে সত্যিই গোলাপ ফুটেছে, আর আমি ঘরে মরে পড়ে আছি। সূচনা আনমনা হয়, উদাস হয়। বলে, তোমাকে এত তাড়াতাড়ি মরতে দেবো না পঙ্গু পতঙ্গ। অন্তত যতদিন না পর্যন্ত আমি থাকি। আমি তোমায় বুকের মাঝে আগলে রাখবো। সূচনার এই কথাটা শুনে সত্যিই আমি সেদিন চমকে গেছিলাম। মনের মধ্যে কোথায় একটা জট পাকানো বাতাসের কুণ্ডলী পাক খাচ্ছে বলে মনে হয়। তবে কী!
আমার আশঙ্কাই অবশেষে সত্যে রূপ নিলো। কিন্তু এই রূপটা যে এত কদর্যভাবে আমার সামনে উপস্থিত হবে তা আমি কল্পনাও করিনি। সত্যি সূচনা তাহলে ওর বিশ্বাসটাকেই আঁকড়ে ধরলো। যা কিছু হয় না তার সবকিছুকে হওয়ানোর মধ্যে যে অপ্রতিরোধ্য তৃপ্তি আছে, সূচনার বয়স তার রস আস্বাদন করতে চায়। কিন্তু আমি এটা কিভাবে দেখবো! আর কেউ না জানুক আমি তো জানি, সূচনাকে আমি সে চোখে দেখি না। ওর কোমলতা, চঞ্চল আবেগের মধ্যে আমি সন্তানসম কাউকে দেখি। ওর মাথায় হাত বোলাতে আমার ভালো লাগে। ওর সঙ্গ আমার কাঙ্ক্ষিত। তার এক-একটি কথা, সম্মোধন যেন আমার মধ্যে অদৃশ্য পিতৃহৃদয়কে উদ্বেল করে তোলে। ইচ্ছে হয় বুকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুই ছিলি, সত্যিই তুই আমারই অংশ ছিলি। তাই তো আমি ওর চোখে চোখ রাখতে ভয় পাইনি। গভীর দৃষ্টিতে বলেছি, ছি, তুই যা চাইছিস, তা আমার জন্য এক গভীর লজ্জা।
আমার কথা শুনে সূচনা যেন অবাক হয়, কিছুক্ষণ নীরবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখটা জলে ভরে এলে গভীর দুঃখ নিয়ে বলে, পঙ্গু পতঙ্গ কেন এমন গভীর অসুখে পড়লাম বলো তো? অবসন্ন মর্মে কেন এমন ভীষণ বিষের ফণা? হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য প্রকট। তবু আমি এই ক’দিন তোমাকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার এই নিশ্চল জীবনটাকে সচল করতে গোলাপ স্বপ্ন দেখিছি। আমি চেয়েছি তোমার ঝিমিয়ে পড়া প্রতিটি শিরায় আবার প্রবাহিত হোক গোলাপের মতো জীবন্ত রক্তাভ। অথচ হায়, উল্টো আমিই আজ আরোগ্যহীন।
সূচনা ওর লাগানো বসরাইয়ের গাছগুলোর পাশে মুখ ঢেকে বসে ছিল, আর আমি বাগানের এক কোণে। কী এক গভীর লজ্জায় আর অপরাধবোধে আমরা দু’জনই যেন তখন ধূলার সঙ্গে মিশে যাচ্ছি। তবু আমি নিজেকে সামলে নেই, এমন ভান করলাম যেন কিছুই হয়নি। সবকিছু সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝি। হুইলচেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে এসে আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম। কিন্তু সূচনা আঁতকে উঠলো। বিহ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললো, ছুঁয়ো না আমাকে, আমি অসুস্থ। যে পচন আমাকে ধরেছে, তা বিষাক্ত। ওর কথার আমি কী উত্তর দেব, বুঝে পাই না। তবু বলি, সূচনা তোর সঙ্গে কি আমি কখনো এমন কোনো আচরণ করেছি বা এমন কোনো ইঙ্গিত আমি দিয়েছি, যাতে তোর আমাকে প্রেমিক বলে মনে হয়েছে? আমার স্পর্শ, আদরে কি তুই একবারও বাবার স্নেহ দেখিসনি? এই যে আমরা এত গোলাপ লাগিয়েছি, এ তো পিতা-কন্যার পৃথিবী। আর তার মাঝে এই বসরাই দুটো তুই আর আমি।
না পঙ্গু পতঙ্গ, আমি তোমাকে বাবার আসনে বসাইনি। বরং গোলাপের মতো সুন্দর হয়ে আমি তোমাকে আকাঙ্ক্ষা করেছি। এটা কি পাপ বলো? যদি তাই হয় তবে সেটাই করেছি। এই বসরাই দুটো সত্যিই তুমি আর আমি। তবে না, ওরা পিতা-কন্যা কখনোই নয়।
কেন নয়, সূচনা? যে আমি মৃত্যু নিয়ে পড়ে থাকি নিশ্চল, তাকে তুই সন্তান আদরে গোলাপের মতো সতেজ হয়ে বেঁচে থাকার কথা বলেছিস। বলেছিস, পৃথিবীর সব ফুল ফুরিয়ে যাবে, গোলাপ ফুরাবে না। আমি যেন মৃত্যুর কথা লেখা ডাইরিটাতে তাই গোলাপের পাপড়ি গুঁজে রাখি।
সূচনা চোখ মুছে নিয়ে আমার সামনে উঠে দাঁড়ায়। দূরের চরাচরে আনমনে তাকিয়ে বলে, গোলাপের জন্ম কিভাবে জানো? সে জন্মের ইতিহাস বড় করুণ। আফ্রোদিতি তার প্রেমাস্পদ অ্যাডোনিসের কামনায় আমার মতোই অধীর হয়ে ছুটছিলেন এক কণ্টকারণ্যের বন্ধুর পথে। আমার মতোই আজগুবি সব স্বপ্ন দেখতে দেখতে আনমনে হাঁটার সময় ঝোপের কাঁটার ঘায়ে তার পা থেকে রক্ত ঝরে। আর সে রক্তই রূপ নেয় রক্তগোলাপে। আমি চলে যাচ্ছি পঙ্গু পতঙ্গ, আর কোনোদিন আসবো না। আমার প্রতি পদে পদে রক্ত ঝড়ছে। তুমি তা টের পাবে না। সব গোলাপ তোমার কাছে রইলো। থাকলো বসরাই দুটোও। দেখবে আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ওই বসরাইকে আরও লাল করে তুলবে।
আমার মনের মধ্যে যে হাহাকার জাগে। তুই যদি চলেই যাবি তাহলে এসেছিলি কেন? কেন আমাকে এমন গোলাপ ঘেরাও কারাগারে ফেলে যাচ্ছিস। সূচনা কথা শোনে না। ও চলেই যাচ্ছে। শুধু ছাদবাগানের চৌকাঠটা পার হওয়ার আগে এক ঝলক মুখ ঘোরায়, বলে—এটা কারাগার নয় পতঙ্গ, গোলাপগুলোকে রেখে গেলাম। ওরা তোমাকে আমার হয়ে পাহারা দেবে।
বাঁচার আনন্দকে অর্থবহ করতে মানুষ যূথবদ্ধ হয়। আবার কখনো কখনো সবাই চলে গেলেও মানুষ বাঁচে। এই যেমন আমি বেঁচে আছি। এটা শুধুই এক বেঁচে থাকা, আর কিছু না। সূচনা চলে গেছে অনেকদিন। ছাদবাগানে এখন গোলাপের সমারোহ। প্রতিদিন বিকাল থেকে গভীর রাত অবধি আমি ছাদে হুইল চেয়ার টেনে টেনে ঘুরে বেড়াই। কখনো কখনো মদের ঘোরে ঝিমুতে থাকি। কিন্তু ঘুমাতে পারি না। কাজের ছেলেটা এসে ডাক দেয়, কিন্তু আমি পড়েই থাকি। গোলাপগুলো সত্যি আমাকে পাহারা দিচ্ছে। যে বসরাই গাছ দুটো ছাদের মাঝখানে লাগানো আছে, তাতে সম্প্রতি কলি এসেছে। খুব শিগগিরই হয়তো ফুলও ফুটবে। কিন্তু আমি সেই ফুল নিয়ে আতঙ্কে থাকি। রক্তলাল বসরাই দেখার আতঙ্কে আমি ঘুমাতে পারি না। অপরাধবোধ শত সহস্র সৈন্য হয়ে আমাকে ঘিরে ধরে। যন্ত্রণায় কাঁতড়াতে কাঁতড়াতে আমি নিজের চুল খামচে ধরি। তবু বসরাই দুটোর যেন তাতে কিছুই যায় আসে না। মৃদুমন্দ বাতাস এলে ওরা যেন আমাকে অবজ্ঞা করতে করতে দুলতে থাকে। যেন হাসতে হাসতে বলে, অপেক্ষা করো দেখবে কত মস্তবড় রক্তগোলাপ ফোটে।
এভাবে কতদিন চলে গেছে আমি জানি না। শুধু জানি প্রতিদিন নিয়ম করে সূর্য ওঠে, অস্ত যায়, রাত হয়, আবার একই রুটিন। কেবল আমিই ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই কিসের এক আতঙ্ক আমার গলা টিপে ধরে। আমি শ্বাস নিতে ছটফট করি। তারপর হঠাৎ একসময় সব চলে যায়। আমি ক্লান্ত ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস টানি আর ছাড়ি। এমন করেই চলছিল। কিন্তু তারপর একদিন সত্যিই ছাদবাগানে এলো সেই মুহূর্ত। খুব ভোরে, যখন নরম আলো তার চোখের পাতা কেবল পিটপিট করছে, তখন ছাদে আমি গোলাপটার তীব্র ঘ্রাণ পেলাম। ঝিমুতে থাকা আমি ঘোলা দৃষ্টি মেলেই দেখলাম, সত্যিই একটা গাছে কী মস্ত বড় বসরাই ফুটেছে। আধো আলো-আঁধারির মধ্যেও ওর লালের জেল্লা ফুটে বের হচ্ছে। ফুলটাকে ছুঁয়ে দেখি ওর পাপড়িতে জমেছে হালকা শিশির। অথচ পাশেই আরেকটা গাছে ফুল নেই। সেটা যেন বিলাপ করে বলছে, আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন। সারাটা সকাল আমি কাটিয়েছি ওই গোলাপটাকে ঘিরে। অতপর সূর্য যখন ঠিক মধ্য আকাশে তখনই আমি সিদ্ধান্তটা নিতে পারলাম। অসহ্য রোদে পুড়তে পুড়তে আমি বারবার চিন্তা করলাম নিজেকে নিয়ে। মনে হলো না, যা ভেবেছি সেটাই হয়তো আমাকে শান্তি দিতে পারে। বসরাই গোলাপটাকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখি। ঠিক তিনটা কুড়ি মিনিটে রেলিংয়ের পাশ দিয়ে তাকাতেই সেই মধ্য বয়সী ছেলেটাকে দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম সে আমার দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, মৃদু অভয় মেশানো হাসি হাসে। আমি হুইল চেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে ঘরে চলে আসি। সেখানে দুপুরের ভ্যাপসা গরম। এর মধ্যেই আমি মৃত্যুর কথা লেখার ডাইরিটা খুলে বসি। তার একটি পাতার ভেতর শুকনো গোলাপ পাপড়ির সঙ্গে যত্নে রাখা চকচকে একটা ব্লেড। তার বিচ্ছুরণে আমার হাতের শিরাটা দপদপ করে। আমি ডাইরির একটা খালি পাতায় কলম চালাই।
চারদিকটা এত উষ্ণ কেন! আমি একটু শীতলতা চাই। মৃত্যু কি শীতল? যদি তাই হয় আমি সেই শীতলতা আকণ্ঠ পান করবো। আমি জানি সূচনা একদিন না একদিন ফিরে আসবে। যে ভালোবাসা স্নেহ আমি ওকে দিয়েছি, সেটাই ওর মুখ ঘোরাবে এ পথে। সময় ওকে বুঝিয়ে দেবে কোনটা প্রেম আর কোনটা ভালোবাসা। কিন্তু যে অপরাধে আমি অপরাধী, তা একান্তই আমার। তাই সূচনা নয় বরং আমার রক্তের রঙ যেন এত গাঢ় হয়, যা অনায়াসে রঞ্জিত করতে পারে পৃথিবীর তাবৎ গোলাপ। যদি তা নাও হয়, তবু জেনো এই রক্ত গোলাপসম।