অফিস থেকে বের হয়ে আরেফিন নিচে নেমে আসে। মন ফুরফুরে। ড্রাইভার গাড়িতেই বসা ছিল। আরেফিনকে দেখে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে যখন পেছনের দরজা খুলে দিচ্ছিল, তখন আরেফিন বলল, তুমি চলে যাও। আমি ড্রাইভ করব। গফুর মাথা নিচু করে বলল, জি স্যার।
গফুর আরেফিনের হাতে চাবি তুলে দিলে ড্রাইভিং সিটে বসে দরজা বন্ধ করে আরেফিন ফোন দিল, হ্যালো কাশফিয়া।
কাশফিয়া দীর্ঘলয়ে উত্তর দেয়, হ্যাঁ। কী খবর? অনেক দিন পর সাহেবের খবর হলো।
অনেক দিক কোথায়? গত সপ্তাহে না দেখা হলো। বলো, তুমি কোথায়?
আমি আমার ফ্ল্যাটেই।
চলো বাইরে ঘুরে আসি। তারপর ডিনার করব একসঙ্গে।
দূরে কোথাও?
না, আশুলিয়ার দিকে যাব।
চলে এসো। আমি তৈরি হয়ে নেই।
আরেফিন হিন্দি গানের সিডি বাজিয়ে আস্তে আস্তে গাড়িটি নিয়ে এগিয়ে যায়। ট্র্যাফিক জ্যামের জন্য উত্তরায় যেতে দুই ঘণ্টা লেগে গেল। দুই ঘণ্টা সময় কাটাতে কাশফিয়া অস্থির লাগছিল।
একবার জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে গাড়িটি গেটের পাশে থামে। সে নিচে নেমে আসে।
গাড়িতে ওঠে কাশফিয়া। এত দেরি করলে যে?
আর বলো না। ভীষণ ট্র্যাফিক। বড় অসহ্য।
এখন কোথায় যাবে? আশুলিয়া থেকে একটু ঘুরে আসি। তারপর সোনার গাঁওয়ে ডিনার করব।
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। পথবাতি ঝলমল করছে। আশুলিয়া জলাশয়ের বুক চিরে যে রাস্তাটি গেছে সেখানে গাড়ি পার্ক করে ওরা দাঁড়ায়। দুপাশের প্রসারিত জলাশয় ধোয়া ঝিরঝিরে বাতাস শরীর জুরিয়ে দেয়। হিম শীতল আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝুলে আছে। জলাশয়ের জলের ছোট ছোট তরঙ্গের ঠোঁটে চাঁদের আলো চিকচিক করছে। এই সুবিস্তৃত জলাশয়ের এই রাস্তাটিতে এসে দাঁড়ালে মন বড় হয়ে যায়। ঢাকায় একটু ফাঁকা জায়গা আর কোথায় পাওয়া যায়? কাশফিয়ার পরনের হালকা নীল রঙের জর্জেট শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। সারা পিঠে ছড়ানো রেশমের মতো কোমল চুলগুলোও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। জলাশয়ে পূর্ণিমার চাঁদের প্রতিবিম্বটির দিকে তাকিয়ে থেকে আরেফিন বলল, তুমি তো পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর। চাঁদ দেখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়?
কাশফিয়া হাসে। যদিও জানে এসব কথা আরেফিনের মনের কথা নয়, সে কেবল সাময়িক আনন্দের জন্যই কাশফিয়াকে চায়। কাশফিয়া এও জানে যে,আরেফিনের এমন রক্ষিতা আরও কয়েকজন আছে। আর এটুকু বুঝে বলেই নিজের পাওনা হাড়ে হাড়ে আদায় করে ছাড়ে। না-হয়, উত্তরার মতো জায়গায় একটা ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া কি আর সোজা কথা। কাশফিয়া এমন কথা অনেক শুনেছে তাই তার স্তুতিবাক্যের কোনো উত্তর না দিয়ে বলল, আজ তোমার মন এত ফুরফরে কেন?
আরেফিন মৃদু হাসে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, আজ একটা দাঁও মেরেছি। বেশ বড় দান। কথাটি শেষ করে আরেফিন রহস্যময় হাসি হাসে।
দান যে বড় হবে সেটা কাশফিয়া ধারণা করতে পেরেছে। কাশফিয়া রহস্যময় হাসিটির রহস্য উদ্ঘাটন করতেই জিজ্ঞেস করল, হাসছো কেন?
হাসছি মানুষের বোকামি দেখে। ওই যে,আমাদের অফিসের নজরুলকে চিনো না?
হ্যাঁ। নজরুল। সাদাসিদে মানুষ। সরল।
সরল তো বটেই। ছাগলও বটে।
কেন? এমন সরল একটা মানুষকে ছাগল বলে গালি দিচ্ছ কেন?
শুনো, যে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না সেই ছাগল। যদি তাল মেলাতে পারত তাহলে তার এই অবস্থা? আমরা যারা তাল মেলাতে পারলাম আজ কোটি টাকার মালিক। আর সে তো সে-ই। এখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাড়া শেখের নাম উচ্চারণ করে না।
কাশফিয়া হাসে। লোকটা আসলেই বোকা। মুজিব মাটির নিচে। বঙ্গবন্ধু বলে কি আর তাকে বাঁচানো যাবে? তবে লোকটার জন্য বেশ মায়া হয়। এত অভাবী!
বোকারা এমন অভাবীই হয়। আজকে দিলাম একটা ধমক। তাও মিটিংয়ে। দেখি শালার মুখটা চুন হয়ে গেছে। কেন কী করেছিল?
স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠান করার প্রস্তুতি-মিটিং চলছিল। আর ও প্রথমেই বলে, আজকে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি অবিসংবাদিত নেতা এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা মনে পড়ে।
তুমি কী বললে?
আমি বললাম, আপনি কী শেখ মুজিবের কথা বলছেন? উনি তো ইতিহাসের পাতা থেকেই বিলীন হয়ে গেছেন। তাকে স্মরণ করে কী লাভ? আশা করি বঙ্গবন্ধু শব্দটি বাদ দিয়ে পরবর্তী সময় কথা বলবেন।
কাশফিয়া হাসে, হি হি হি। তারপর বলল, নজরুল কী বলল?
কিছু বলেনি। মুখ কালো করে পেছনে একটা চেয়ারে চোরের মতো বসে রইল।
কাশফিয়া আবার হাসে। তুমি যা বলো না। চোরের মতো, হি হি হি।
কাশফিয়ার হাসি ধবল চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। আরেফিন কাশফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতায় অভিভূত হয়ে তার হাত টেনে নেয় নিজের হাতের মুঠোয়। তারপর আরও ঘনিষ্ট হয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে আরেফিন বলল, চলো এখন।
আরেফিন গাড়ি চালায়। হিন্দি গান বাজে। গানের তালে তালে দুজনের শরীরও দোলায়িত হয়।
সোনার গাঁও হোটেলের বারে গিয়ে ওরা বসে। আরেফিন ড্রাইজিন নেয় আর কাশফিয়া নেয় রেড ওয়াইন। ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে। রাতের আহারও সারে বুফেতে। তারপর আরেফিন বলল, আজ আর বাসায় যাব না। চলো একটা রুম বুকিং দেই।
কাশফিয়ার না বলার উপায় নেই। আর না বলবেই বা কেন? আরেফিনের ইচ্ছের কাছে কাশফিয়া সবটুকুই সমর্পণ করেছে। আর বিনিময়ে একটি ফ্ল্যাট পেয়েছে। তারপরও যখন যা লাগে তাই পায়।
পরদিন দুপুরের আগে ওদের ঘুম ভাঙে। বারোটায় চেক আউট হয়ে কাশফিয়াকে উত্তরায় দিয়ে এসে বাসায় ফিরে আরেফিন।
নাহিদা আরেফিনের স্ত্রী। শান্ত সৌম্য। আরেফিন যা বলে তাই বিশ্বাস করে। সাধারণ একজন কৃষকের মেয়ে নাহিদা। আর আরেফিনের কবছর আগে কী-ই-বা ছিল। সাধারণ একটা ব্যবসা করে কোনো মতে দিন পার করত। দিন বদলের সুযোগে সে দাঁও মেরে হঠাৎ আঙুল ফুলে বটগাছ।
কলবেলের শব্দ পেয়ে বাসার দরজা খুলতে খুলতে নাহিদা বলল, একটা ফোন করতে পারলে না। সারা রাত কত চিন্তায় ছিলাম।
কেন চিন্তা করো তুমি? লক্ষ্মী বউ আমার! একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন করারও সময় পাইনি।
তোমার পোলাপান কোথায়?
স্কুলে। তাড়াতাড়ি গোসল করে আসো, আমি ভাত দিচ্ছি।
আমি আসছি।
নাহিদা তার স্বামীর কিছুই বুঝতে পারে না। আদর যত্ন করে খাওয়ায় আরেফিনকে। রাতে ড্রাই জিনের ডোজটা বেশি হয়ে গিয়েছিল। সেই ভাবটা এখনও আছে। খেয়ে দেয়ে আবার ঘুমুতে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালার বাইরে তাকায় আরেফিন। জানালা লাগোয়া বকুল গাছের ডালে বসে আছে গিরগিটি। আরেফিনের চোখ পড়ে ওর দিকে। গিরগিটির রং বদলাচ্ছে মাঝে মাঝে। কখনো সবুজ। কখনো লাল। কখনো লালচে কালো। আরেফিন গিরগিটিটির দিকে হাসে। আর ভাবে, আমিও একটা গিরগিটি। কত রং বদলিয়ে আজে আমি কোটি কোটি টাকার মালিক। ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা, তন্দ্রা থেকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়।
0২.
একদিন রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়। সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই বিটিভি আর বাংলাদেশ বেতারে ভেসে ওঠে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। প্রতিটি সেট থেকে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ এই বজ্রকণ্ঠ বাংলার আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে আর অনুরণিত হতে থাকে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের শোণিতের ধারায়, হৃৎপিণ্ডের প্রাচীরে।
আরেফিনও বসেছিল টিভি সেটের সামনে। তার বুকের ভেতরে যদিও অতীতের কাজকর্মের তোলপাড় ছিল তবে মুখে ছিল অন্যকথা। নাহিদা মূর্তির মতো তার সামনে বসেছিল। নাহিদা বলল, বাবারে, গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে।
আরেফিন বলল, বঙ্গবন্ধু বড় নেতা ছিলেন। তুমি বুঝতে পারছ না, তার ডাকে সারা দেশের এক হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মাত্র নয় মাসে একটা দেশ স্বাধীন হয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্যই। কি তেজ দেখো।
নাহিদা স্মিত হেসে বলল, তুমি না আগে শেখের নামই শুনতেই পারতে না। হঠাৎ আবার এই গান গাওয়া শুরু করলে কেন?
যা সত্য তাই বললাম। ওনার মতো… বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা সারা পৃথিবীতে ক’জন আছে? এদেশে আর এমন নেতা কখনোই হবে না।
নাহিদা আবার হাসে। তবে এ হাসির রহস্য শুধু নাহিদাই বুঝতে পারে। সে প্রকাশ করতে চায় না। সে জানে আরেফিন নিজেকে বদলাতে বেশি সময় নেয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সে গোপনে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাথে যোগাযোগ রাখত। মুরগি সাপ্লাই দিত। তারপর স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ঘুরতো। তারপর বিএনপি করে জাতীয় পার্টিও করছে। যেখানে স্বার্থ আছে সেখানে মুহূর্তেই রং বদলিয়ে ফেলে। আজব গিরগিটি।
নাহিদা আরেফিনকে ডেকে নিয়ে রাতের খাবার দেয়।
রাতে শুয়ে শুয়ে আরেফিন ভাবে, কর্মচারী কল্যাণ সমিতির নামে কত কিছুই করলাম। এখনকি পালাতে হবে? না, পালাব কেন? বুদ্ধি করে শুধু তুরুপের তাসটা সময় মতো ফেলতে হবে। যত সহজে সিদ্ধান্তটি সে নিয়ে নেয় তত সহজ হবে কিনা তা ভেবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়, বিভ্রান্ত হয়। কী করবে ভাবতে থাকে। আলোছায়ার মিশেল যন্ত্রণায় আরেফিন রাতে ঘুমোতে পারে না। বড় কর্তাদের ভাঙিয়ে সে এত সম্পদের মালিক হয়েছি তা অফিসে চাউর হয়েছে। মানুষ কি এত সহজে ছেড়ে দেবে? নজরুল, আহা গোবেচারাকে কী ধমক দিয়েই না সেদিন মিটিংয়ে অপমান করেছিলাম! সে-ই কি ছেড়ে দেবে? এমন বিরুদ্ধ প্রতিকূল স্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে রাত শেষ হয়। ভোরের কাকগুলো বৈদ্যুতিক তারে বসে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন আরেফিন এতদিন এগারোটার আগে অফিসে না গেলেও আজকে নয়টার আগেই অফিসে গিয়ে হাজির। নজরুলই একমাত্র লোক যে কিনা বঙ্গবন্ধুকে হৃৎপিণ্ডের ভাঁজে ভাঁজে সম্মানের সঙ্গে ঠাঁই দিয়ে রেখেছে। ওর সঙ্গে খাতিরটা রাখতে হবে। আহারে গোবেচারা! বঙ্গবন্ধুকে এত ভালোবাসে, দেখি এবার সে কী পায়? একটা মোচড় ঠিকমতো দিতে পারলে নজরুলও হাওয়া হয়ে যাবে।
বুদ্ধি তো আরেফিনের আছে। একটি মুজিব কোট দরকার। একটি মুজিব কোটই যথেষ্ট।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম। আরেফিন কয়েকদিন পর অফিসে যাচ্ছে। গায়ে মুজিক কোট। লোকটাকে একটা ক্লাউনের মতো দেখা যাচ্ছে। গফুর মুখ টিপে হাসে। একবার বলল, স্যার এই গরমের দিন কোট গায়ে দিলেন? গফুর যদিও জানে এই কোট কেবল আওয়ামী লীগের মানুষেই পরে। আরেফিন বলল, গরম কই? ঠাণ্ডাই তো দেখছি। এই হালকা গরমে কোট পরা যায়।
গাড়িটি সরাসরি অফিসের গেটে না থেমে কেন্টিনের সামনে থামে। আরেফিন কেন্টিনে ঢুকে মানুষের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করে। নজরুলসহ আরও কয়েকজন কেন্টিনের পেছনের সারিতে একটি চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী দুজন আছে। তারাও এখন নতুন পানির স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে। আরেফিন এসে এই টেবিলেই বসে। আরেফিনকে দেখে সবাই হেসে ওঠে। আরে ভাই, কোটটা খুব মানিয়েছে, ওদের একজন বলল। আরেফিন কথা না বলে নজরুলের ভাব বোঝার জন্য অপেক্ষা করে।
নজরুলের চোখে আক্রোশের আগুন লক লক করলেও কিছু বলেনি। সে শান্ত চোখে আরেফিনকে দেখে চায়ে চুমুক দেয়।
আরে নজরুল ভাই, কেমন আছেন?
আছি, ভালো আছি। আপনার অসুখ নাকি?
না, অসুখ না। কেন, হঠাৎ এমন মনে হলো কেন?
এমন মনে না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। গরমে আমাদের নাভিশ্বাস অবস্থা আর আপনার গায়ে কোট। তাই ভাবলাম জ্বরটর হয়েছে কিনা।
ও আচ্ছা। এই বয়, এখানে নাশতা দে। চা দে।
অন্যরা বলল, চা-নাশতা খাওয়া আমাদের শেষ। আপনি খান। দুজন সিগারেট জ্বালায়।
নজরুল চা খায়। তবে আড্ডাটা জমেনি। একে একে কাজের কথা বলে ওঠে যায়। এক সময় আরেফিনও। নজরুল থ মেরে বসে থেকে ভাবে, এই লোকটা বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতে পারত না। মনে হতো ওর গায়ে আগুন জ্বলে যায়, আজ মুজিব কোট পরেছে, এদেশে আর কী দেখতে হবে কে জানে?
নজরুলের সঙ্গে আরেফিন আর সুবিধে করতে পারেনি। তাই এক সময় উঠে চলে যায়। আরেফিন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্টিনের ম্যানেজার এসে জিজ্ঞেস করে, নজরুল ভাই, ঘটনা কী? আরেফিনের খোলস বদলায়েছে দেখা যায়। আপনার দল ক্ষমতায় এসেছে আর আপনার গায়ে মুজিব কোট দেখি নাই।
নজরুল হাসতে হাসতে বুকের ওপর হাত রেখে বলল, আমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বুকের ভেতরে। এই যে, এখানে। বুঝেছো কিছু?
জি ভাই। লোকটা বড় সুবিধাবাদী। দেখবেন আপনাকে টপকায়ে কী করে?
শুন রশিদ, আমি বঙ্গবন্ধুকে ভাঙিয়ে কোনো কিছু করতে চাই না। সে নীতিহীন, যা পারে করবে। আমি আমার দেশ, বঙ্গবন্ধুকে এক করে দেখি। কোনো সুবিধা পাওয়ার চিন্তা কখনোই করি না। দেশ আমার, বঙ্গবন্ধু আমার আদর্শ, তিনি আমার আদর্শের নেতা।
রশিদ জানে নজরুল কতটা সহজ, কতটা সাধারণ! আবার নীতির প্রশ্নে কতটা কঠিন। টানাপড়েনের সংসারে অবৈধ উপার্জনের কথা কখনো ভাবতেও পারে না লোকটা। আর আরেফিনের মতো মানুষ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। নজরুলকে দশ বছর ধরে দেখে আসছে রশিদ। জীর্ণশীর্ণ জামাকাপড়। দুটি শার্ট, দুটি প্যান্ট পরে বছর পার। নিরহঙ্কার এই মানুষটার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় রশিদের বুক ভরে যায়। তার চোখ দুটি ছলছল করে।
মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে অফিসে সাজ সাজ রব। কর্মচারী কল্যাণ সমিতিও বসে নেই। মন্ত্রীর গলায় মালা দেবে। ভাষণ দেবে। কে দেবে? আরেফিনের নামই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়। তবে এ কারখানার এ সমিতিটি দেশের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন না হলেও রাজনীতির কৌশলগত কারণে এখানে নেতাদের মাঝে মাঝে আসতে হয়। এ কারণেই একজন মন্ত্রী আসছেন সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করতে। এই কারখানাটি পরিদর্শন করা হলো, স্বচক্ষে দেখাও হলো দীর্ঘদিন ধরে জংধরা কারখানাটির অবস্থা।
মঞ্চে উপবিষ্ট হলেন মন্ত্রী। তার পাশে কারখানার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। এক পাশে আরেফিন। তার গায়ে আজকেও মুজিব কোট। গরমে মানুষের ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা হলেও আরেফিন নির্বিকার।
যে মানুষটি এতকাল শেখ মুজিবের নাম শুনলেই আক্রোশে ফেটে পড়ত সে আজ বক্তৃতায় বলল, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে এই কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আর আমরা তাঁর আদর্শ বুকে ধারণ করে এই কারখানাটি টিকিয়ে রেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে সোনার বাংলা উপহার দিতে আমরা আজকে জীবন বাজি রেখে আজকে কাজ করে যাচ্ছি। আজকে আমাদের সামনে নতুন দিনে এসেছে। আজকে আমাদের নতুন প্রতিজ্ঞা নিয়ে আজকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে…।’
আরেফিনের বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সবাই হাসে। এই কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ষাটের দশকে। অথচ একটা ডাহা মিথ্যে বলে চালিয়ে দিল। মিটিং শেষ হলে মঞ্চ থেকে নেমে এক কোণে গিয়ে আরেফিন কাশফিয়াকে ফোন দেয়। হ্যালো, কাশফিয়া, হ্যাঁ, হ্যাঁ… আরে বলো না শুধু হাততালি, আর হাততালি। একেবারে ফাটিয়ে দিলাম। এখন রাখি। সন্ধ্যায় দেখা হবে।
মন্ত্রী বের হয়ে যাওয়ার সময় আরেফিনকে ডেকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যান। গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে নজরুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কালো রংয়ের গাড়িটির দিকে।