ইদানীং লিখতে বসলে আমার গল্পের ভাষা চটির মতো হয়ে যায়! অনেক চেষ্টা করেও এই ভাষা থেকে বের হতে পারি না। তবে একদমই যে পারছি না, ঠিক তাও নয়। মাঝে মাঝে হুট করে বেরিয়েও যাচ্ছি! উড়ছি! হাঁটছি! আবার খেলছিও! তবে, গন্তব্যে পৌঁছতে পারছি না। সে সভ্য চিন্তাগুলো হয়তো আংশিক গল্প হয়ে উঠছে অথবা কিছুই হয়ে উঠছে না। তবে সেগুলোই কিন্তু দেশের সব দৈনিকে ছাপা হচ্ছে। ঢাউস ঈদ সংখ্যাগুলোতে ছাপা হচ্ছে। কিছু করার উপায় নেই। ঈদ আসার পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকেই সিরিয়াল ঠিক হয়ে যায় কাকে কখন গল্প দিতে হবে। তখন এইসব সিরিয়ালের লেখা লিখতে লিখতে নিজেকে একটা মেশিন মনে হয়। গল্পের মেশিন!
একটা ঈদ উপলক্ষে ক’টা গল্প লেখা সম্ভব! বড়জোর দুই-তিনটা। কিন্তু আমাকে তো দশ বারোটা পত্রিকায় লিখতে হয়। এমন ভাবেই লিখে আসছি দেড় যুগ ধরে। কিছু কিছু পত্রিকা ভালো সম্মানী দেয়। আবার কিছু পত্রিকা লেখা চাওয়ার সময় ভালো ভালো কথা বলে। বাসায় বসে থেকে লেখা আদায় করে নিয়ে যায়। কিন্তু ঈদ চলে যাওয়ার পর—না সম্মানী, না একটা সৌজন্য সংখ্যা—কিছুই দেয় না। এরকম করেই চলছে। তাও লিখছি। টাকা পয়সার জন্য তো আর আমি লিখছি না। একটা কিছু করার জন্য লিখছি। পঁয়ত্রিশ বছর যাবত এই কিছু একটা লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এক্কেবারে শৈশবেই যাদের প্রতিভা বিকাশিত হয়ে উথলে পড়ার উপক্রম হয় আমি তেমন প্রতিভাবান কেউ না। দশ-বারো ক্লাস পাস করার পরও আমার মধ্যে লেখার কোনো ভাব উদয় হয়নি। এমনকী অনার্স শেষবর্ষে যখন ইয়ারমেট দিপার প্রেমে পড়লাম, তখন পর্যন্তও না। না কবিতা; না গল্প। কিছুই ডানা ঝাপটায়নি আমার মন কিংবা মাথার মধ্যে। বাংলার ছাত্র হওয়ার কারণে মনের মধ্যে যে কিছু ভাব থাকার কথা সেটাও আমার মধ্যে কখনো ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সহপাঠীদের সঙ্গে পাঠচক্র কিংবা আবৃত্তি অনুষ্ঠানেও আমার অংশ গ্রহণ ছিল না। চাকরি জীবনের প্রায় তিন বছর অতিক্রম করার পর একদিন আমার লেখা শুরু হয়ে যায়। একদম হঠাৎ করেই আমি লিখতে শুরু করি। একা একা। কাউকে বলি না। সারাদিন সরকারের কাজ করি। বনে জঙ্গলে ঘুরি আর রাতে এসে খাতায় লেখার চেষ্টা করি। এক বছর ধরে শুধুই লিখেছি কিন্তু কোনো লেখাই শেষ করতে পারিনি। পারবো কী করে! পাঠ্যসূচির বাইরে যেমন আমার পাঠ-বিস্তার ছিল না—তেমন মানুষের ভাষাও কিছুই জানা ছিল না। আর কৌশল তো মোটেই না।
এই যে আমাকে ছাড়া আমি চলতে পারছি। হাঁটছি। দৌড়াচ্ছি। ভিজেও যাচ্ছি অনেক। এসব কিন্তু কোনো গল্পেই লেখা হচ্ছে না। লিখতে পারছি না। অথচ এসব লেখার জন্যই হয়তো আমি লেখা শুরু করেছিলাম। অথবা নিজেকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচানোর জন্য! এসব নিয়ে শুধু শায়লার সঙ্গেই কথা হয়। শায়লা জানতো আমি কী পছন্দ-অপছন্দ করি। মনে মনে সেসবের একটা ফর্দ তৈরি করে রেখেছিল সে। কখনো আমার সম্পর্কিত কোনো কিছু সে ভুলে যেতো না। কিন্তু এই যে আমি কিছুদিন যাবত মনে মনে চটি লিখছি! অনিচ্ছায় বিড়বিড় করে সেসব পাঠ করছি। করেই যাচ্ছি। সেটা ভেবে আমি শায়লার কাছে লজ্জিত হই। শায়লার কথা ভাবতেই পারি না কিংবা ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় প্রেমে পড়া সেই ম্যাডামের কাছে লজ্জিত হই। লজ্জা ক্রমশ বাড়তে থাকে। একটা সময় ধরেই নিই আমি আর কিছু লিখতে পারবো না। লজ্জায় ডুবতে ডুবতেই আমি মরে যাবো। আর এই লিখতে না পারার দুঃখে হয়তো সুইসাইড করবো। মনে মনে ঠিকও করি কিভাবে সুইসাইড করবো। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি এই বয়সী একজন মানুষের আসলে সুইসাইড করার কী আছে! মানুষ হাসবে। আর গলির মোড়ে মোড়ে আমার নামের সঙ্গে পরিচিত লোকেরা বলবে, হালায় এই বয়সে না জানি কী আকাম ঘাডাইছে যেই কারণে সুইসাইড খাইছে!
আরও কত্তো কী বানিয়ে বানিয়ে বলবে তার ঠিক নেই। মানুষ খুব সহজেই গল্প বানাতে পারে। তীব্র গতিতে সেই গল্প টেনে টেনে বড় বানাতে পারে।
আমি এসব ভাবছি আর চোখের সামনে সেসব পাড়া-মহল্লার মুখগুলো দেখতে পাচ্ছি। মনে মনে তখনো বিড়বিড় করে যাচ্ছি সদ্য কেটে ফেলা চটিগুলোর অংশ। কিংবা গত তিনদিন ধরে যেসব ছিঁড়ে ফেলেছি সেসবও। নিজের মধ্য থেকে সিরিয়াস রাইটার ভাব করে থাকা মানুষটাকে পাশে ফেলে দেই। ঘৃণা ভরে তার দিকে তাকাই। আমার চোখে কিছুটা করুণাও থাকে। জানতে চাই, আচ্ছা আসলে কি আমি এত দিনের লেখক জীবনে সিরিয়াস কিছু লিখেছি? না সিরিয়াস কিছু পড়েছি?
আমার হাদারাম মার্কা চেহারা থেকে কোনো উত্তর আসে না। আমিও জানি সে কোনো জবাব দিতে পারবে না। তার মধ্যে থেকে সিরিয়াস অভিনয় করা খেলসাটা বের হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শালা মিটমিট করে হাসছে। হাদারামের মুখের দশা দেখে তার আনন্দ হচ্ছে। আমি কিছুটা লজ্জিত হই। কিছুটা হাসিও পায়। পরক্ষণেই আবার এইসব আঁকিবুকি মুছে ফেলি।
যাত্রাদলে নাচ শুরু হলে যেমন প্যান্ডেল কাঁপতে থাকে ঠিক তেমন করে কাঁপতে থাকে আমার কলিজা। সাহসও উধাও হয়ে যায় কিছু। শায়লার কাছ থেকে আমি পরিত্রান পেতে চাই। মনে মনে ঠিক করি সামনের যে কোনো স্বপ্নে শায়লাকে ডেকে ক্ষমা চেয়ে নেবো। সারাজীবনে যত মিথ্যা বলেছি তার জন্য যখন ক্ষমা চাইবো। তার সঙ্গে চটি লেখার জন্যও ক্ষমা চাইবো।
মাথার মধ্যে হুট করে একটা আইডিয়া আসে। চোখের মধ্যেও জ্বলজ্বল করে আইডিয়ার চরিত্ররা। এতক্ষণ আঁকিবুকি করতে থাকা কাগজটাকে দলামোচা করে ওয়েস্টবক্সে ফেলে দেই। নতুন কাগজ নেই।
মনে মনে ঠিক করি যেকোনো মূল্যে এবার একটা গল্প আমাকে লিখতেই হবে। গত একুশ দিন ধরে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেটাও ভুলতে চেষ্টা করি। ভাবি এই তো এখন নতুন গল্প লিখতে বসেছি। এক্বেবারে লেখা শুরু করার গোড়ার দিকের মতোন। যখন লিখতে বসলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে যেতো। শেষই হতে চাইতো না।
পেটে চিনচিন করছে। একটা স্যাকলো খাই। ডকডক করে এক মগ পানি খাই। পেটের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নিজের প্রতি নিজের বিরক্তি শুরু হয়। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই। হাঁটতে থাকি। আবার চেয়ারে বসি। কলম হাতে নেই। শেষ অব্দি বাথরুমেই যেতে হয়।
কমোডে বসে মল ত্যাগ করে নিজেকে ফুরফুরে করার চেষ্টা করি। গন্ধ ছড়ানো বায়ু ছাড়া কিছুই হয় না। মাথার মধ্যে নতুন আইডিয়ার চরিত্ররা খেলতে থাকে। কোত্থেকে এসে হাজির হয় একদল কালো মানুষ। আমি বাথরুমের যেখানে তাকাই সেখানেই অনেক কালো মানুষ দেখি। অনেক নিগ্রো মুখ। সব মুখই শায়লার মুখের মতো। শায়লা তো কালো ছিল না। আমি জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখি। মল ত্যাগের জন্য চাপ দেই। কোনো কাজ হয় না। কতক্ষণ বসে থেকে বিরক্ত হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসি। বিরক্ত মুখে, জ্যামলেগে থাকা মাথা নিয়ে চেয়ারে বসি। কিন্তু কিছুতেই আর সেই আইডিয়াটা মনে আসে না। মাথাটা নিগ্রোদের চোখ দিয়ে ভর্তি। আমি নিজেকে সহজ করার জন্য ব্যালকনিতে যাই। এত রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। বাইরে সম্ভবত একটু আগে হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বাতাসের গতি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গাছের দিকে। বাগানের দিকে।
যথারীতি আজ সকাল থেকেই লেখার চেষ্টা করছি। কাগজ কলমের সঙ্গে একটা যুদ্ধ লেগেই আছে।
দরজায় টোকা পরে। আমি চেয়ার থেকে না উঠেই জিজ্ঞেস করি, কে? কে এসেছ?
এ সময়ে বাসায় কেউ থাকে না। আমার রুমটা সামনের দিকে আলাদা। বাড়ি করার সময় এরকম করেই করেছি। যেন আমি রাত জেগে থাকলেও কারও অসুবিধা না হয়। দরজায় আবার টোকা পরে। আমি বিরক্ত হই। গত কয়েক বছর যাবত অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যাই। একটু বয়স হলে মনে হয় মানুষ এমন অল্পতেই মানুষ বিরক্ত হয়ে যায়। ধৈর্য ধরে রাখতে পারি না। যে কারণে ছেলে-মেয়েরাও মাঝে মাঝে বলে, বাবা তোমার রাগটা মনে হয় দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।
আমি রাগ করি না। সতেরা বছর আগে গত হওয়া শায়লার কথা ভাবি। শায়লা শুধু স্ত্রী নয় বন্ধুও ছিল আমার। যে অকপটে সব সহ্য করে গেছে। কখনো আমার কোনো কিছুর প্রতিবাদ করেনি। তার মুখটা আমাকে বলে, ছেলেরা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। ওদের কথায় তুমি রাগ করো না।
আমি মনে মনে মাথা নেড়ে সায় দেই। রাগ করি না। মোলায়েম কণ্ঠে বলি, দেখ্ বাবা বয়স হলে এরকম হয়। কী আর করবি। আমি তো তোদের বাপ! আর কিছু দিন একটু সহ্য কর! কদিনই বা বাঁচবো!
ছোট ছেলেটা হাসতে গিয়েও থেমে যায়। তার চোখে আনমনা ভাব। মনে হচ্ছে আমার ভেতরটা পড়ছে সে।
আমি চুপ করেই থাকি।
দরজা খুলতে উঠে লুঙ্গিটা শক্ত করে বাঁধি। গ্যাসের কারণে পেটটাও ফুলে ঢোলের মতো হয়ে আছে। দাঁত দিয়ে ওপরের ঠোঁটে মৃতপ্রায় চামড়াটা কামড়ে ধরি। টেবিলের দেরাজ টেনে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজি। যদিও দেড় বছর ধরে ডাক্তারের নির্দেশে আমার সিগারেট খাওয়া নিষেধ। তারপরও আগে যেমন দিনে এক প্যাকেট খেতাম এখন তিন চার-পাঁচটা খাই। ডাক্তারকে বলেছি—এটা আমাকে খেতেই হবে তাতে যত দিন বাঁচি। সত্যি বলতে আমি লিখতে বসলে সিগারেট খেতে হয়। আমি সিগারেট না খেলে লিখতে পারি না। লিখবো আর সিগারেট খাবো। শায়লা থাকতে আমার লেখার টেবিলে ফ্লাক্স ভরে চা আর মগ রেখে যেতো। এখন ছেলে বউরা এত যত্ন করার সময় পায় না। আর করবেই বা কিভাবে তাদের ছেলে মেয়েদের যত্ন নেওয়ার সময়ই তাদের হয় না। তারা তো সবাই নিজেদের চাকরি আর ফ্যাশন নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
দরজা খুলে আমি অবাক হই না। যদিও আমি মনে মনে যার প্রত্যাশা করেছিলাম সে আসেনি। সে অনেক দিন ধরেই আসে না। সে এলে প্রথম দিকে চুপ করে বসে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে তার জগতের দরজা খুলে দেয়। সেখান থেকে রঙ বেরঙের বাসাত প্রবাহিত হতে থাকে। ইদানীং অনেক গল্প শোনায়। আমি হাসি আর লাবনীর গল্প শুনি। লাবনীও হাসে। আহা কী নিষ্পাপ হাসি! ঢেউহীন বয়ে যাওয়া দীর্ঘ নদী অথচ তার মধ্যেই কত লুকানো ঢেউ। সেটা লাবনীর জীবনের গল্প না শুনলে বোঝা যাবে না। ভাবছি এসব নিয়ে একটা কিছু লিখবো। কোনো লেখাই তো মানুষের জীবনের বাইরে নয়।
আমার মনে হচ্ছে পারমিতা ছটফট করছে। পারমিতার সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়ে দুটো ছটফট করছে। পারমিতার প্যারালাইজড জামাই ছটফট করছে
দরজা খুলে যাকে পেলাম সেও আমার অতিপরিচিত মানুষ। পারমিতা। প্রায়ই আসে। গল্প করে। বয়সে আমার থেকে বিশ বছরের ছোট। একটা কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ায়। আমি যে বয়সে শুরু করেছিলাম সে তার থেকেও দেরি করে শুরু করেছে লেখা। কিন্তু তার গতি আমার থেকে তিনগুণ অথবা তার থেকেও বেশি। গত তিন বছর ধরে পারমিতা লিখছে। এরই মধ্যে চারটি বই বেরিয়েছে তার। শুনলাম বেশ বিক্রিও হচ্ছে। অথচ আমার প্রকাশকরা বলে, স্যার এখন লেখার ধাঁচ পাল্টে গেছে। মানুষ আর আপনাদের সময়ের মতো লেখা পড়তে চায় না।
পারমিতার লেখার প্রতি আমার আগ্রহ নেই। পরমিতার প্রতিও না। তবে এটাইবা কম কিসে যে এই বুড়ো বয়সে একজন সুন্দরী রমণী আমার খোঁজ নিচ্ছে। নিয়ম করে গল্প করতে আসছে।
আমি কিছু বলি না। চুপ করে থাকি। পারমিতা ঘোষের চারটি বইই আমার বুকসেলফে সাজানো আছে। সে নিজে এসে আমাকে লিখে দিয়ে গেছে। আমি প্রথম বইটি অনেক কষ্টে তিন-চার পাতা পড়েছিলাম। যদিও আমি কখনো কবিতা লিখিনি। তার চারটা বইই কবিতার বই। আমি হেসে হেসে বলি, দেখো পারমিতা আমি কথাসাহিত্যের মানুষ। কখনো কবিতা লিখিনি। লিখতেও আর চাই না। আমি আসলে এসব কম বুঝি। আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের পর আর কারও কবিতা লেখার দরকার নেই। তারপরও যা দরকার ছিলো সে পথ অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছে আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসানরা। সে জন্য আর আমি এরকম সাহস করিনি। যাক তুমি কবিতা লিখেছ, এটা বেশ খুশির ব্যাপার।
পারমিতা পরিচিত হাসি হাসে। এ হাসি আমার গত নয় বছরের চেনা। প্রথম দিন যখন পারমিতা আমার কাছে এসেছিল সেদিনই আমি লক্ষ্য করেছিলাম এই হাসির স্রোত। হাসির সঙ্গে যেন মৃগনাভি ভেঙে ভেঙে ঘরময় ছড়িয়ে যায়।
ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি!
আমি তার চোখ মাপার চেষ্টা করি। ছেষট্টি বছর বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখার চেষ্টা করি তার তৃপ্তির পরিধি। সে বলে, তা ঠিক বলেছেন স্যার। কবিতা তো সবাই বলে খুব কঠিন জিনিস। আমি প্রথমে তাই ভাবতাম। কিন্তু এখন আসলে কবিতা খুব সহজ হয়ে গেছে।
আমি উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাই। সে বলতে থাকে, এই যে এখন যারা লিখতে এদের লেখা পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন। কবিতা এখন কোনো ব্যাকরণে থেমে নেই। যার যেমন খুশি লিখছে! কথা শেষ করে পারমিতা হাসে। বড় করেই হাসে। আমি বলি, তাই নাকি?
জ্বি স্যার। আপনি তো এখনকার তরুণদের লেখাজোখা সেরকম পড়ার সময় পান না। পড়লে দেখতে পেতেন।
আমি পড়ার সুযোগ পাই না সেটা মোটেই মিথ্যা নয়। বয়স আর পত্রিকাওয়ালাদের চাপে আমি নতুন কিছু পড়তেই পারছি না। পাঠাভ্যাসটাও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। চোখটাও বাঁকা হয়ে বসেছে এখন।
পারমিতা আমার লেখার টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসে।
টেবিলে রাখা আমার কাটাকুটি করা লেখাজোগার দিকে তাকায়। আমি মনে মনে লজ্জিত হই।
পারমিতা জানতে চায় কি লিখছি।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকি।
স্যার আমি কি অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম?
না। ঠিক তা নয়।
আপনার শরীর খারাপ?
আমি হাসি।
শরীর আর কী খারাপ হবে বলো। বয়স তো কম হলো না। এখন যেকোনো সময় টুপ করে হলুদ পাতার মতোন ঝরে যাবো।
আমি আবার হাসি।
পারমিতা হাসে না।
সে কিছু একটা বলতে গিয়েও আবার থেমে যায়। বলে না। অনেকটা আদরের দৃষ্টি নিয়ে ফের চোখ তুলে তাকায়।
চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া পারমিতার চোখ টলমল করে।
আমি তার চোখে আমার ফপুজানকে দেখি। যে আমাকে পেলেপুষে বড় করেছে। মায়ের শূন্যতায় আমাকে মানুষ করার চেষ্টা করেছে। পারমিতার চোখে আমি দরদ দেখি।
স্যার আপনার কাছে আরও প্রত্যাশা করি।
আমি আসলে অনেকদিন ধরে কিছুই লিখতে পারছি না পারমিতা।
পারমিতা চোখ মোছে। কেন মোছে! এরকম করে তো কখনো আমার সামনে কাঁদেনি সে। পারমিতার চোখে একজোড়া পায়রা উড়ছে। শাদা রঙের পায়রা অথবা হলুদ রঙের। কিংবা কালো। তারা ডানা ঝাপটাচ্ছে।
আমার মনে হচ্ছে পারমিতা ছটফট করছে। পারমিতার সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়ে দুটো ছটফট করছে। পারমিতার প্যারালাইজড জামাই ছটফট করছে।
আমার ভেতরে অসংখ্য ধ্বংস হচ্ছে। কিংবা তৈরি হচ্ছে গুচ্ছ গুচ্ছ ট্রয়!
ইচ্ছে করছে পারমিতার হাত ধরি।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। সিঁথির লাল আল ধরে দৌড়ে যাই। দুজন মিলে অন্তত একবার অন্ধকার হই।
আমি টের পাই আমার মাথার মধ্যে গল্প খেলছে। মনের মধ্যে গুনগুন করছে সমুদ্র থেকে দৌড়ে আসা তীব্র ঢেউ। আমি কাগজ নিয়ে বসে যাই। কলম নিয়ে লিখতে শুরু করি। পারমিতা তার ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট বেনসন দেয় আমার হাতে।
আমার কলম চলছে। আমি লিখছি আর লিখছি। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে। অথবা অসংখ্য মৃগনাভি ফেটে আমাদের পাশাপাশি অথবা জগত সমান দূরে থাকা দুজনার শরীরে লেগে যাচ্ছে।
ভুলে যাই আমার পাশে একজন পারমিতা। একগুচ্ছ পারমিতা। একদল নিগ্রো শায়লা। আমার পাশে একটা পাহাড় ক্রমশ নুইয়ে যেতে যেতে নদী গয়ে যাচ্ছে! আমি লিখছি। লিখেই যাচ্ছি।
অথবা আমরা দুজন নত হচ্ছি একটি গল্পের মধ্যে।