শীত সহ্য করতে পারে না মুনা। প্রচণ্ড রোদ বাইরে, তবু শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে মেয়েটি। সাধারণত এই সময়ে সে গরম কাপড় পরে বসে থাকে। মুনা বোরকা পরে শুধু শীতের জন্য। পর্দা করার কোনো আগ্রহ নেই মুনার। সে সব সময় আঁটসাটো জামাকাপড় পরে। তবে রঙের কম্বিনেশন থাকতেই হবে। স্যান্ডেলের সঙ্গে হিজাবের রঙের একটা মিল থাকতেই হবে। জামার রঙের সঙ্গে মিল রেখে সে ঘড়িও পরে। মুনা একটা বড় বক্স কিনেছে শুধু ঘড়ি রাখার জন্য।
স্কুল-কলেজে তার পড়াশুনার রেজাল্ট সবাই অনুমান করতে পারতো। মুনাকে কখনোই বলতে হতো না তার রেজাল্ট কী হয়েছে মেট্রিক পরীক্ষা অথবা এইচএসসিতে। আর তাই তার পরীক্ষার ফল নিয়ে কোনো বিস্ময় অথবা অতিরিক্ত হৈহুল্লোড় হতো না বাসায়। সবাই জানতো সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট মুনা করবেই। এই জন্যই মুনার অর্জন করা সব ভালো রেজাল্টের কোনো বিশেষ সেলিব্রেশন ছিল না। তবে পরীবারের সবার প্রশংসার তালিকায় থাকে মুনার নাম। অবশ্য এখানে পরিবার শব্দটা নিয়ে কিছুটা ঝামেলা রয়েছে। মুনা তার মার সঙ্গে মামাদের ফ্যামিলিতে থাকতো। বোধোদয় হওয়ার পর থেকেই মুনা এই পরিবারের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। মুনার বাবা কখনোই মুনার জামা অথবা জুতার সাইজ জানতো না। মুনাও কখনো কল্পনা করার চেষ্টা করেনি বাবা কেমন হয়। তার মামারা কখনোই বুঝতে দেয়নি বাবার অভাব। পাশাপাশি বাবার পক্ষে কোনো ভালো তথ্য মুনার কাছে এখনো নেই। মেয়েরা সাধারণত বাবাদের ভালো গুণগুলো নিয়ে চিন্তা করে। আসলে মুনাকে জানানো হয়নি তার বাবার বিষয়ে। পুরুষদের নিয়ে মুনার মধ্যে এক ধরনের নোংরা চিন্তা ঢুকানো হতো। কিন্তু মুনা কখনো কানে নেয়নি সেই সব কানপড়া। অবশ্য মুনা কখনোই চিন্তা করেনি, নিশ্চয়ই একটা মানুষের সবগুলো ব্যাপারে একযোগে খারাপ হতে পারে না। তার বাবার হয়তো অনেক ভালো গুণ ছিলো, থাকতে পারে । মুনা খুব সাদাসিধে মানুষ। তার চিন্তা-ভাবনার গণ্ডিও সীমিত। ঘড়ির কাঁটার মতো কলেজ-বাসা-পার্লার-দুচারটে ক্যাফে-শপিংমল-কোচিং সেন্টার এরকম একটা সার্কেল করেই তার জীবন ঘুরপাক খেতেছিলো। এই সময়ের ছোট্ট ছোট্ট বিশেষ অংশে একটা ছেলেকে তার ভালোবাসতে ইচ্ছে হতো অথবা হতো না। একটা দ্বিধাময় অমীমাংসিত বিষয় ছিল ওই ছেলেটি। কিন্তু এক ধরনের অনুভূতি জন্ম নিত তার জন্য। মুনা যে কখনো কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা করেনি তা কিন্তু একদম নয়। সে বয়সের প্রত্যেকটা বাঁকে বাঁকে প্রেমে পড়েছে। ছ্যাঁকা খেয়েছে, ছ্যাঁকা দিয়েছে। কিন্তু একটা ছেলের সঙ্গে সে প্রেমও করেনি আবার ছ্যাঁকাও দেয়নি।
মুনা এইচএসসি পরীক্ষার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন নেওয়ার যুদ্ধে হারতে শুরু করল। তখনই তার মা-মামারা তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগে। তখনই কিছুটা সময়ের জন্য বুঝতে পেরেছিল মুনা এই পরিবারের একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অবশ্য ওই বছরটা কোনো না কোনো কারণে খুব দ্রুত চলে যায়। মুনাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়নি কোনো এক প্রাকৃতিক কারণে। পরের বছরেই দেশের সবচেয়ে ভালো ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়ে যায় মুনা। কিছুদিনের জন্য বিয়ে বিষয়ক আলোচনা থমকে থাকে। মুনা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তার জীবনে আরও নতুন নতুন গল্প জমতে থাকতে। সেই গল্পগুলো কল্পনা করতেও মুনার ভালো লাগে। মুনার ব্রেইনে ভালো সময়ের সংখ্যা অনেক কম।
মুনা এখন সন্ধ্যায় বাসার বাইরে যেতে পারে। ক্যাম্পাসের বিশাল এরিয়া জুড়ে হেঁটে বেড়াতে পারে। পহেলা বৈশাখে শাড়ি পরে সেজে-গুজে বের হতে পারে। আড্ডা দিতে দিতে পুরো দিনটা মাটি করে দিতে পারে। রাস্তায় কাদায় হোঁচট খেয়ে ময়লা জামাকাপড় পরেই সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে পারে অথবা ক্যান্টিনে দুটা সিঙ্গাড়া আর তিনটা ভেলপুরি খেয়ে পার করে দিতে পারে পুরাটা দিন।
কখনো দেয়াল ফেটে অথবা জানালার পর্দা পুড়ে ভস্ম করা চাঁদের আলো আসলে অথবা কৃষ্ণচূড়া দেখলে অথবা বৃষ্টি থেকে ছুটে আসা হালকা বাতাস তার গালে লাগলেই সেই ছেলেটির কথা মনে পড়তো। যার সঙ্গে মুনার প্রেম হয়নি অথবা অন্যকিছু। ওই ছেলেটিকে মুনার তেমন একটা ভালোও লাগে না। মুনা ছেলেটিকে দেখে কখনোই মুগ্ধ হয়নি। ছেলেটির নাম মহসীন। পড়াশুনায় ভালো। তার গুণের শেষ নেই। সব কাজ তাকেই করতে হয়। দেশের হাল ধরার জন্য এই ছেলের সংখ্যা বাড়াতে হবে সরকারের। শুধু সমাজের জন্য না, সে নিজের জন্যও নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আবার সুন্দর করে কথাও বলে। তাও মুনা অতটা মুগ্ধ হয় না। যতটা মুগ্ধ হয়েছে তার প্রাক্তন প্রেমিকদের দেখে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও সে প্রেমে পড়েছে। কিন্তু বেশিদিন ঘোরের মধ্যে থাকতে পারেনি। ঘোর ভেঙে আবার সে আলোয় মুখ ধুয়েছে। তার বেড়ে ওঠা খুব সোজা-সাপ্টা। একটা সোজা রাস্তা ধরে সে হেঁটে চলেছে অবিরাম। সেখানে অনেক ছেলে আসছে আবার চলেও গেছে কিন্তু কখনোই তার পথ চলা থেমে থাকেনি। জীবন তার কাছে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নাম। জীবন তার কাছে সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত-ঘুম-খাওয়া-পড়াশুনা। এইভাবে সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একদিন হঠাৎ সন্ধ্যায় তার বিয়ে।
ছেলেটির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে হাতের আঙুলগুলো থেকেও কম দিন। ছেলেটির নাম আতিক। সে ব্যাংকে চাকরি করে। আতিকও গরম সহ্য করতে পারে না। এবং তার কাছে গরম বিষাক্ত সাপের থেকেও ভয়ঙ্কর মনে হয়। ব্যাংকে সব সময় এসির মধ্যে থাকবে বলে সে এই চাকরি নিয়েছে। আতিকের জীবনটা অনেক সংগ্রামের । সুখ খোঁজার সংগ্রাম । তার কাছে সুখ মানে এসির বাতাস। সমস্ত ধরনের মাংস। বিশেষ করে চিকেন। আর সপ্তাহে একটা দিন টানা ঘুম। আতিক বড় হয়েছে বন্ধুদের প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে। কখনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে তার টিউশন স্টুডেন্টের মায়ের সঙ্গে আবার কখনো কোনো বন্ধু তার টিউশন ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করে। এই গল্পগুলো দিনের বেলায় আতিককে অনেক আনন্দ দিতো কিন্তু আতিক ঘুমাতে গেলে একদম ঘুমাতে পারতো না। এটা কেন করল আমার বন্ধু । তার মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা তৈরি হতো ওই বন্ধুর ওপরে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারত না এই সব অপ-প্রেম। কিন্তু আবার যখন ঘুম থেকে উঠতো ওই বন্ধুকেই সাবাশ বলতো। একই গল্প আতিককে দুই ধরনের অনুভূতি দিতো।
খুব ভালোভাবে পড়াশুনা শেষ করে আতিক তার লক্ষ্য অনুযায়ী ব্যাংকে চাকরি নিল। এখন দরকার একটা বিয়ে এবং সংসার। আতিকের জীবনেও প্রেম এসেছে অনেকবার কিন্তু স্থায়ীত্বকাল খুব-ই কম। ঠিকমতো ব্যাটে বলে হয়নি। কখনো আতিক চায়নি আবার কখনো অন্য পাশের মেয়েটি চায়নি। এই করে করে আতিক তার জীবনের গাণিতিক হিসাবে ৩৩ বছর কাটিয়েছে।
মুনা কাটিয়েছে তার ব্যক্তিগত ২২ বছর। দুজনের বয়সের যোগফল ৫৫ বছর। বিয়ের ৫৫তম দিনেই মুনা প্রেগনেন্ট। গল্পে আরেকটা চরিত্রের জন্ম নিলো। কিন্তু মুনা আর আতিকের এখনো এক সঙ্গে বসে চিকেন খাওয়া হয়নি। তারপরও হুটহাট করে দিনগুলো চলে যাচ্ছিল। কখনো কোনো দিনকে অনেক লম্বা মনে হয়নি আতিকের অথবা মুনার। মুনার চোখে কৃষ্ণচূড়া অথবা বৃষ্টি থেকে নিঃসৃত নরম বাতাস অথবা রাতকে দিন করা চাঁদের আলো চোখে পড়েনি। আজকাল মুনা ঘড়ির কাটা দেখতেও ভুলে যাচ্ছে ।
মুনার পুরনো একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। ফ্রেন্ডলিস্টে অল্প কয়েকজন মানুষের সঙ্গে সেই ছেলেটিও আছে যার সঙ্গে মুনা কখনো প্রেম করেনি অথবা বিচ্ছেদও হয়নি। মুনা মাঝে মাঝে তার সঙ্গে হায় হ্যালো করতো এবং এখনো করে। তাদের যোগাযোগের ভাষাটা ছিলো খুব-ই ভদ্র এবং স্বাভাবিক। আতিক প্রতিদিন-ই রাতে ঘুমানোর সময়ে মুনার ফোন ঘাঁটতো। সবকিছু পড়তো। আতিক ছোটখাটো কোনো হাই-হ্যালোও সহ্য করতে পারতো না। তার শরীরের মধ্যে এক ধরনের অস্থির অনুভূতি তৈরি হতো। ঘুম নষ্ট হয়ে যেত। অফিসের এসির ঠাণ্ডা বাতাস তাকে স্থির করতে পারত না।
আতিকের কাছে ছোট ঘটনাই অস্বাভাবিক লাগত। সুখ হারিয়ে ফেলার একটা উদ্ভুত চাপে থাকত। ভীষণ রকমের চাপ। সেই চাপ নিয়ে সে হাঁটতে পারত না, ঘুমাতে পারত না। তাকে সব কিছুতেই বাধা দিত গরম। অসহ্য রকমের গরম তাকে ঝাপটে ধরত। সে শুধু ঘামতে থাকত।
বাসায় ফিরে আবার চেক করে মুনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। সেখানে ছোটখাটো বাক্যালাপেও আতিকের শরীরে তাপ বাড়াতে থাকে । কিন্তু সরাসরি মুনাকে আতিক কিছু বলে না। একদিন হুট করে খারাপ ভাষায় ছেলেটিকে মুনার অ্যাকাউন্ট থেকে ম্যাসেজ পাঠায় এবং থ্রেট দেয়। ওইদিন রাতে মুনা ওই ম্যাসেজ দেখে প্রচণ্ড রেগে যায় কিন্তু কিছু বলে না আতিককে। মুনা স্যরি লিখে ম্যাসেজ পাঠায় মহসীনকে । ওই ম্যাসেজ দেখে আবার আতিক রেগে আগুন হয়ে যায় কিন্তু কিছু বলে না মুনাকে। আবার সে বাজে-বাজে কথা লিখতে থাকে ওই ছেলেকে।
মুনা আতিকের সঙ্গে মুখোমুখি কোনো আলোচনা নেই। মুনা মহসীনের কাছে স্যরি হয় আর আতিক মহসীনকে গালি দিয়ে-ই যাচ্ছে। তাদের সমস্ত ঝগড়া ইনবক্সকেন্দ্রিক। তারা দুজনে আগের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করে যাচ্ছে। মুনা টেবিলে খাবার তুলে দেয় আতিক রাতে খায়। দুজনে বিছানায় ঘুমোতে যায়। আতিক নিয়ম করে রাতে তার শারীরিক আনন্দ তুলে নেয় মুনার কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায়। মুনা কখনো তেমন বাধা দেয় না। অথবা মুনার তেমন কোনো ইচ্ছা বা কোনো অনুরণনও সৃষ্টি হয় না আতিকের ছোঁয়ায়। এক ধরনের নিয়ম বাস্তবায়নের মতো চলতে থাকে তাদের দিনগুলো। রাতের বিশেষ মুহূর্তে মুনার মনে হয় সে দায়িত্ব পালন করছে আর আতিকের মনে হয় অধিকার আদায় করছে।
কিন্তু হুট করে মুনা বিল্পবী হয়ে ওঠে। তার এই দায়িত্ব আর পালন করতে ইচ্ছে করছে না। প্রতিরাতে একটা বালিশ শক্ত করে মুনা চেপে ধরে তার বুকের মধ্যে কিছুতেই মুনা ওই বালিশ ছাড়ে না। আতিকের কোনো চেষ্টাই তাকে আর গলাতে পারে না। আতিক আরও জ্বলতে থাকে এবং প্রচণ্ড গরমে সে ভিজিয়ে দেয় বিছানার চাদর । কিন্তু দিনের বেলায় তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু হয় আগের মতোই। রাতের বেলায় ওই শক্ত বালিশটি মুনা ঝাপটে ধরে ঘুমায়। মুনার একমাত্র সঙ্গী এবং রক্ষাকবচ হলো একটা কোল বালিশ। অন্ধকারে এই কোলবালিশটাই তাকে প্রতিরাতে রক্ষা করে যাচ্ছে।
আতিক একদিন হুট করে মুনার বালিশটি লুকিয়ে রাখে কিন্তু মুনা ঠিকই খুঁজে বার করে ওই বালিশটি এবং ওই বালিশটি শক্ত করে বুকের ভেতরে চেপে ঘুমিয়ে পড়ে মুনা। আতিক আবার নিরুপায় হয়ে মুনার পাশে কাচুমাচু হয়ে গরমে ধাপাতে থাকে সারাটারাত জুড়ে।
আতিক অফিসে নিজের জন্য একটা আলাদা এয়ারকুলার কিনে নেয়। তারপরেও তার ঘাম ঝড়তে থাকে অবিরত । প্রতিদিন অফিসে সবার সঙ্গে তার ঝগড়া হয় এসি কমানো বাড়ানো নিয়ে। আতিক এখন আর অফিসে ব্লেজার পরে আসে না। শার্ট পরে আসে যেন একটু গরম কম অনুভূত হয়। কিন্তু এই গরম তার সঙ্গ ছাড়ে না একদম।
আতিকের সব শার্ট মোটা কাপড়ের, একটা পাতলা কাপড়ের শার্ট প্রতিদিন পরে আসে সে। একদিন অফিস শেষে আতিক শার্ট কিনতে যায়। পাতলা কাপড়ের শার্ট। আগের মোটা কাপড়ের শার্টগুলো তার সহ্য হয় না। বাসায় এসে তার একই অবস্থা। মুনার বাচ্চাটার নাম নুজাইবা । মুনার ঠাণ্ডা লেগে গেছে । ওই ছোট বাচ্চাটার নিমুনিয়া হয়ে গেছে। তাও আতিক এসি একদম কমাবে না। কারণ এসি বন্ধ করলে আতিকের দম বন্ধ হয়ে যায়। সুখপ্রিয় আতিক দিনে দিনে সব নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করতে থাকে।
মুনা ঘুমাতে যায় একটা বালিশ নিয়ে এবং আতিক ঘুমাতে যায় এসির রিমোট নিয়ে আর নুজাইবা সারারাত চিৎকার করে কাঁদে। আতিকের জীবন সব সময়েই অভাবের। কখনোই সে কোনো কিছু তার চাওয়ার মধ্যে পায়নি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। সবকিছুর মধ্যে ভাগ বসানোর জন্য অন্য ভাইবোনারা এসে হাজির হতো। আর তখনই আতিকের আর পাওয়া হতো না।
ঢাকাতে আতিক একা থাকতো। মফস্বলে বাবা-মা ভাইবোন। তাদের আতিক খুব অল্প টাকা পাঠাতো। সে নিজের আরাম আয়েশের পেছনে টাকা পয়সা খরচ করতো বেশি। প্রচণ্ড সুখপ্রিয় মানুষ আতিক। সে নানা চেষ্টা করছে সুখে থাকার জন্য। কিন্তু পারছে না একদম। তার পিছু ছাড়ছে না গরম। সারাদিন তাকে গরম তাড়া করছে। আর সে দৌড়াচ্ছে এদিক-সেদিক।
অফিস থেকে ফেরার পথে আতিক সিদ্ধান্ত নিল আজ মুনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিবে। এটাই আতিকের কাছে সবচেয়ে বড় সমাধান। সে প্রতিদিন খবরের কাগজে হত্যার গল্প পড়ে। এমন কোনোদিন নেই যেদিন ডজনখানেক হত্যা হয় না। আতিক যখন সিনেমা দেখে তখন মানুষের মুণ্ডুটাকে তার বোঁটার ফুল মনে হয়। ইচ্ছে করলেই যেন ছিঁড়ে নেওয়া যায়। আতিকের কাছে মৃত্যু খুব স্বাভাবিক। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও মানুষ মরছে। আর মুনা মরলেই বা কী হবে। আজ না হয় কাল তো মুনাকে মরতেই হবে। আমার সুখের জন্য না হয় একটু আগেই মরল। কত মানুষ একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য অতিরিক্তি যাত্রী হয়ে লঞ্চে উঠে লঞ্চঢুবিতে মারা যায়। তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে গিয়ে তাড়াতাড়ি আল্লাহর কাছে চলে যায়। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো পৃথিবীতে এত পাপ এখানে যতবেশি দিন থাকবে তত পাপ বাড়বে। তার চেয়ে যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াই উত্তম।
কিন্তু আতিক কাউকে খুন করতে পারবে না। কারণ আতিক মুরগী জবাই দিতেও ভয় পায়। আর মানুষ তো অসম্ভব। কিন্তু হত্যা তাকে করতেই হবে। আবার ভাবে সে আমি যদি মুনাকে খুন করি তাহলে ধরা পড়ে যাব আমার সারাজীবন জেলে থাকতে হবে।
ওইখানে তো আরও বেশি গরম হবে। না সে নিজের হাতে মুনাকে খুন করবে না। সে এমন কাউকে দিয়ে খুন করাবে যেন কোনো প্রমাণ না থাকে। কিন্তু কিভাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ আতিকের মাথায় বুদ্ধি আসলো, ভাড়াটে খুনির কথা। এমন কোনো একটা টিম ভাড়া করবে, যারা প্রমাণহীনভাবে মুনাকে খুন করে চলে যাবে। তারও কিছু হবে না মুনাও তার জীবন থেকে সরে যাবে।
ভাড়াটে খুনির সন্ধানে বের হলো আতিক। দক্ষ খুনি লাগবে তার। দক্ষ খুনি খুঁজতে খুঁজতে একজনের সন্ধানও পেয়ে গেল আতিক। শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে সে খুন করে আর কখনোই জানতে দেয় না খুনের হুকুমের আসামির কথা। দরকার হলে সে নিজে জেল খাটে। এই তথ্য পেয়ে আতিক খুব খুশি। কিন্তু তার জন্য খরচ করতে হবে অনেক টাকা। বাজারে এখন রিয়েল জিনিস পাওয়া খুবই কঠিন। চারপাশে সব ভেজালে ভরা। তার ওপরে খুন। এটা তো আরও জটিল বিষয়। ভালো সত্যিকারের দায়িত্ববান খুনি পেতে হলে তো অবশ্যই অনেক খরচ করতে হবে আতিকের।
কিন্তু এত টাকা আতিক কোথায় পাবে। বাসার গয়না বিক্রি করলেও তো এত টাকা হবে না। আতিক লোনের জন্য আবেদন করে। তার অস্বাভাবিক আচরণের জন্য অফিস থেকে তাকে লোনও দিতে রাজি হয় না অফিস। প্রচণ্ড বিপাকে পড়ে আছে আতিক।
তাকে এই হত্যা করতে হবে। এই হত্যাই একমাত্র তার অসুখের ওষুধ। যখন হত্যার পরিকল্পনা মাথার মধ্যে চলতে থাকে তখন আর আতিকের গরম লাগে না। সে শান্তি পেতে থাকে। সে ভালো করে বুঝতে পারে তাকে একমাত্র শান্তিতে থাকতে বাধা দিচ্ছে মুনা। ওরে সরিয়ে দিতে পারলে সব সমস্যা সমাধান। কিন্তু এত টাকা সে কোথায় পাবে। কোনো বন্ধুর কাছেও সে টাকা চেয়ে লোন পায় না। প্রতিদিন সে ৩ ঘণ্টা ব্যয় করে টাকা খোঁজার পেছনে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। একবার বাড়িতেও ফোন করে জমি বিক্রি করে টাকা চাওয়ার জন্য। কিন্তু বাড়ির লোক তাকে টাকা দিতে চায় না। দিনে দিনে সে অসহায় অনুভব করা শুরু করে।
টাকার সন্ধান করতে করতে হঠাৎ একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই লোক তাকে বুদ্ধি দেয় আপনি চাইলে আপনার একটা কিডনি বিক্রি করে দিতে পারেন। একটা কিডনিতেও তো আপনি বাঁচবেন। আপনার জীবনে টাকার সমস্যাও সমাধান হলো আবার আপনি বেঁচে থেকে তা উপভোগ করেও যেতে পারলেন। দুটো আস্ত কিডনি নিয়ে মরার মধ্যে কোনো সফলতা নেই। শান্তি নেই।
আতিক ভালো ভাবে চিন্তা করে। আমার তো সুখে থাকতে হবে। আমি আর গরম সহ্য করতে পারছি না। একটা কিডনি চলে গেলেও আমি শান্তিতে থাকতে পারব। সত্যিই তো আমি যদি একটা কিডনিতে বেঁচে থাকতে পারি তাহলে শুধু শুধু আরেকটা অতিরিক্তি কিডনির ভার সারা জীবন বহন করার কোনো মানে নেই। সে ওই দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তার কাছে আতিক একটা কিডনি বিক্রি করে দেয়। সেই টাকা দিয়ে ভাড়াটে খুনি ভাড়া করে।
তারপরে একদিন অন্ধকার রাতে। প্রচণ্ড বৃষ্টি ভেতরে ভাড়াটে খুনি দিয়ে মুনাকে খুন করায় আতিক । কোনো প্রমাণ থাকে না সেই খুনের। কেউ জানতে পারে না কিছুই। খুনের রাতে শোঁ-শোঁ করে বাতাস আসতে থাকে জানালা দিয়ে। আতিক বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে লাল হয়ে আছে গাছটা। হঠাৎ আতিক ভাবে এইগুলো কি মুনার রক্ত। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে না ওইটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। বৃষ্টির পানিতে লাল ফুলগুলো রক্তের মতো লাল হয়ে আছে।
সারারাত ঝুপঝাপ বৃষ্টি হয়। সবকিছু ধুয়ে নিয়ে যায় বৃষ্টির পানি। কোনো নোংরা ময়লা থাকে না রাস্তায়। কোনো মৃত্যুর চিহ্নও থাকে না কোথাও।
অনেকগুলো রাত যেতে থাকে। স্বজনরা মুনার দুঃখ ভুলতে থাকে। ভুলতে থাকে মুনার স্মৃতি। ভাগ-ভাটোয়ারা হয়ে যায় মুনার নিজস্ব জামাকাপড় গয়না। ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে দেওয়া হয় বাড়ির বুয়াকে। দৃশ্যপট থেকে মুনা খুব দ্রুত সরে যেতে থাকে।
ভাড়াটে খুনিরা রান্নাঘরে কোনো একটা প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে মুনাকে সরিয়ে দেয় পৃথিবী থেকে। পৃথিবী জানে মুনার মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনার কবলে।
একটা একটা করে মুনার জিনিস আতিকের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। আতিক নিজের বাসাটা আবার নিজের জন্য সাজাতে থাকে।
তারপর একদিন রাতে আতিক চমৎকার একটা ঘুম দেয়। লম্বা একটা ঘুম। পৃথিবীটা তার কাছে বাসযোগ্য অথবা ঘুমযোগ্য মনে হতে শুরু করে।
ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সেদিন দুপুর হয়ে যায় । সেইদিন সে অফিসে দেরি করে যায়। বসের বকাও তার মিষ্টি লাগতে থাকে। আজকে আর এয়ার কুলার টা অন করতে হয় না। এসি কমানো বাড়ানো নিয়ে তার কোনো ঝগড়া মাখাব্যথা নেই।
এভাবে হাতের যতগুলো আছে ততগুলো দিন আতিক আরাম করে। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাতে অজানা কারণে আতিকের খুব গরম লাগতে শুরু করে। আতিক হাঁপাতে থাকে। শরীর দিয়ে ঘাম বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে।
আতিক টের পায় আজকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু তাও তার গরম লাগছে খুব। বিছানা থেকে উঠে সে তার রুম থেকে নুজাইবার রুমের দিকে যায় ওইখানে বুয়ার সঙ্গে নুজাইবা ঘুমায়। আজকে রাতে নুজাইবা কিছুতেই ঘুমাতে চাচ্ছে না। সে শুধু চিৎকার করছে। সেই চিৎকার কিছুতেই থামছে না।
নুজাইবা যত চিৎকার দিচ্ছে আতিকের তত গরম লাগছে। আতিকের সেন্টু গেঞ্জি ঘামে ভিজে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
আতিক বাথটাবে ফ্রিজের সব বরফ এবং ঠাণ্ডা পানি ঢেলে শুয়ে পড়ে। ওইখানে প্রচণ্ড ঘুম আসতে থাকে আতিকের। বাঁধভাঙা ঘুম। সেই ঘুম এখনো ভাঙেনি। আতিক ঘুমাচ্ছে। ক্যালেন্ডার পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। সরকার বদলাচ্ছে। দেশের সংবিধান সংস্করণ হচ্ছে কিন্তু আতিকের ঘুম ভাঙছে না কিছুতেই।
মন্তব্য