অন্ধকার। নির্মল বুঝতে পারে না—সে তাকিয়ে আছে না চোখ বুঁজে আছে। না, তাকিয়েই তো আছে। এত অন্ধকার কেন চারিদিকে? হাত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কে যেন বললো—মশায় উঠে বসুন, উঠে বসুন। দেখবেন, আলো আছে না কবরে! ‘কবর’ শব্দটি কানে যেতেই ঝট করে উঠে বসে নির্মল।
নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দেখার পরে একশ পাওয়ারের বাল্বের ঘোলাটে আলো চোখে পড়তেই নির্মল চোখ বন্ধ করলো কিন্তু তা দুই সেকেন্ডের জন্য মাত্র। নির্মল কিছুই বুঝতেই পারছে না। অন্ধকার! কবর! কারণ কী, মানে কী এসবের? তাকাতেই দেখে, ঢিলেঢালা সাদা শার্ট-প্যান্ট পরা একজন সহজ সরল ভদ্রলোক মুখের দুই পাটি দাঁত কেলিয়ে নিঃশব্দে হাসছে আর ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
সহজ, সরল? হবে না? যে বত্রিশ দন্ত প্রদর্শন করে এভাবে হাসে, তার ভেতরে জটিলতার লেশমাত্র নেই—বোঝা-ই যায়। আর ভদ্রলোক? তা সহজ-সরল লোকদের ভদ্রলোক না হয়ে অন্যকিছু হবার জো নেই!
ভদ্রলোক আবার বিনীত স্বরে বলে, মশায় কবরে তো অন্ধকার হবেই। বোকা লোকেরা তো আর কবরে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা করে না। নির্মল হতভম্বের মতো লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে দেখে, লোকটি আবারও বলে, মশায়, ব্যাপার কী বলুন তো, আপনি যে মারা গেছেন, তা কি এখনো মনে করতে পারছেন না?
নির্মলের চট করে সব মনে পড়ে। আজ দুপুরে সে মারা গেছে। বয়স ষাটের বেশি হবে না। তবে প্রথম যৌবনে গঙ্গা, যমুনা ভোগ করতে বাকি রাখেনি বলে বার্ধক্য যৌবন শেষ হওয়ার আগেই চলে এসেছিল। স্বাস্থ্যও খুব ভালো ছিল না। তাই আঠারো হাজার নয়শ’ দিনের মধ্যেই পৃথিবীর গাঁট বাঁধতে হলো। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে ভীষণভাবে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তার মানে এখন থেকে শাস্তির পালা শুরু। ওহ্ ঈশ্বর!
যদিও জীবন যৌবন যখন পড়ে এসেছে, ভোগ বিলাসে মন মজতো না, তখন ফিরে এসেছিল ধর্মের পথে। তবে মনে মনে ঠিকই জানতো, ঈশ্বরের চোখে এ ফাঁকি এড়াবে না। নির্মল ভীত চোখে তাকালো লোকটির দিকে। তার মানে মৃত্যুর পরে এ-ই বিপথগামীদের প্রথম শাস্তি দেওয়ার জন্য নিয়োজিত দাস! নির্মল প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলে, মহান ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে শাস্তি দেবেন না, আমাকে কোনো শাস্তি দেবেন না।
দাস বড় অবাক হয়ে বলে, আমি আপনাকে শাস্তি দেব কেন? হেঃ হেঃ। আমাকে দেখে কি তাই মনে হয়? হেঃ হেঃ। আমি এসেছি আপনাকে নিয়ে যেতে। আমি তো আর পরপারের পথঘাট চেনেন না, এছাড়া অনেকে ভুলে যায়, সে মারা গিয়েছে। ফলে বাড়িতে গিয়ে ওঠে। আর লোকজন তাকে ভূত ভেবে ভয় পায়। আমি তাই পথঘাট দেখিয়ে নিয়ে যাই। কেউ মারা যাওয়ার কথা ভুলে গেলে মনে করিয়ে দেই। অনেকে তখন কাঁদে। আমার যে কী কষ্ট লাগে তখন, আপনাকে বোঝাতে পারবো না। কেউ কেউ তো আবার আমাকেই ভূত ভেবে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আচ্ছা, অনেক কথা বলে ফেললাম। এবার কবর থেকে উঠে আসুন তো। আমি আপনাকে শাস্তি দিতে আসিনি, এসেছি সাথে করে নিয়ে যেতে ভাই।
নির্মল কিছুটা প্রকৃতস্থ হয়ে ভাবে, তাই তো লোকটার আচরণ তো শাস্তিদানকারী দাসদের সঙ্গে মিলছে না।
আসলে নিজের অপকর্মের কথা মনে হতেই ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। মুখে একটু হাসি উঁকি দিতে গিয়েও মিলিয়ে গেলো, শাস্তি তো পেতেই হবে। এ তো মামা বাড়ির আব্দার নয়, শাস্তি ভোগ করলে করলাম, না করলে নাই। হয়তো লোকটি যেখানে নিয়ে যেতে চাইছে, সেখানে শুরু হবে খেলা, আসল মজা। যা পাপ জীবনে করেছে সে, অনন্ত শাস্তি থেকে তাকে কে বাঁচাবে? এসব ভাবতেই হাসি শুকিয়ে যাওয়া মুখটি আরও চিমসে মেরে গেলো।
নির্মল নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো, তার শরীরের নিম্নাংশ মাটির ভেতরে, যেন সে পানির মধ্যে বসে আছে। লোকটি হাত বাড়াতেই নির্মল তার হাত ধরে উঠে এলো। কিন্তু কবরের মাটি যেমন ছিল তেমন-ই। উঁচু ঢিবি করা। ওটার ভেতর থেকে কিছু বেরিয়ে আসার চিহ্ন নেই। তারমানে সে এখন শুধুই আত্মা। তার ব্যবহৃত শরীরটা মাটিচাপা দেওয়া এই কবরেই। মনে মনে বলে—হে আমার নশ্বর শরীর, ক্ষণিকের পোশাক, থাকো তুমি ওই কবরের ভেতরে, থাকো, চললাম, প্রিয়তম শরীর বিদায়।
লোকটি হাত ধরে টান দিতেই নির্মল সম্বিৎ ফিরে পেলো। লোকটি বললো, চলুন, তাড়াতাড়ি পা চালান আমার সাথে। পথ-প্রদর্শক লোকটি নির্মলের হাত ধরে হাওয়ার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলো।
নির্মল যা ভেবেছিল, তা নয়। ভেবেছিল, হয়তো ওকে শাস্তি দেওয়ার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই কক্ষ দেখে মনে হচ্ছে, এটা অন্য কোনো কক্ষ। তাহলে কি তাকে বিচার করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে? কিন্তু বিচার তো করা হবে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পর, সবারই একসঙ্গে। এরই মধ্যে কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে? তাহলে আর মানুষজন কোথায়? আগুনের তৈরি জিনদেরও তো বিচার করার কথা। না কি তাকে এখানে আনার উদ্দেশ্য অন্যকিছু। সামনের চেয়ারে যে বসে আছে, সে-ই কি ঈশ্বর?
মৃত মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে কি না, জানি না, থাকলে বলা যেতো নির্মলের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। চেয়ারে বসা লোকটিকে ঈশ্বর মনে করে সে দু’পা এগিয়ে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে। মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত বুকের কাছে এনে বলে, হে মহান ঈশ্বর, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার আত্মা পাপে কলুষিত। হে মহান, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন। চেয়ারে বসা লোকটি বলে, স্বপ্নের পৃথিবী, ঘুমের বাস্তবতা, হায় কে কার ঈশ্বর!
নির্মল প্রথম জীবনে বলতে গেলে নাস্তিকই ছিল। তার প্রথম দিককার কবিতায় এই নাস্তিক্যবাদ খুব ভালোভাবেই উঠে এসেছে। ভাবলো, ঈশ্বর হয়তো সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। আর ‘হায়’ শব্দটি তো প্রাণহীন আত্মা থেকে আরেকবার প্রাণ উড়িয়ে নিলো। এখনই বুঝি আদেশ হবে কোনো কঠিনতম শাস্তির।
নির্মল কাঁদতে কাঁদতে বলে, প্রভু আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি আপনার শাস্তি চাই না, দয়া চাই, দয়া, শুধু একটু দয়া। প্রভু বলে, তা ব্যস্ত হওয়ার কী হলো, অ্যাঁ, ব্যস্ত হওয়ার কী হলো।
নির্মল যার সঙ্গে এসেছে, সেই লোকটির উদ্দেশে বলে,‘ওরে ওনাকে একটু আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর, এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু হা করে মুখের কথা শুনলে হবে? যা না বাবা একটু তাড়াতাড়ি কর।
লোকটি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরে এলো। হাতে ট্রে ভর্তি নানা রঙের পানীয়। নির্মল দেখেই বুঝতে পারলো, এগুলো আসলে কী? ডানপাশের গ্লাসে তো একেবারে খাঁটি বাংলামদ। মনে পড়লো, মারা যাওয়ার দিনতিনেক আগে পঞ্চবিংশ বই প্রকাশের সময় প্রথমবারের মতো প্রকাশকের কাছ থেকে টাকা পেয়েছিল রয়ালেটি বাবদ। সেই আনন্দে প্রকাশকের কাছ থেকে পাওয়া সব কটা টাকা দিয়েই মদ গিলেছিল টানা দুদিন। তার জের টানতে গিয়েই তৃতীয় দিনের মাথায় হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মারা যায় সে।
নির্মল এবার আরও জোরে কেঁদে ওঠে—প্রভু, আমার অপরাধ জানি ক্ষমার অযোগ্য। তবু হে মহান প্রভু, আমি শুধু আপনার দয়া চাই, করুণা চাই, আর কিছু নয়, আর কিছু নয়।
আচ্ছা, আপনার প্রথম কবিতার বই ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর সবকটি কবিতা হিট হয়নি বলে কি আপনি পরবর্তী সময়ে আপনার বইকে ফাঁসিতে চড়িয়ে ছিলেন?’
প্রভুর কথায় নির্মল প্রথমে হতভম্ব হলেও, তার মনে একটু লাগলো। তবে সেটুকু সামলে নিয়ে খুব বিনীতভাবে বললো, প্রভু, আমার প্রকৃত নাম নির্মলেন্দু গুণ, তার কারণ আমার বাবা কবি নির্মলেন্দু গুণের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তারচেয়ে বড় কথা তিনি কবি গুণের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। তাই তিনি বড় শখ করে আমার নামও রেখেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। কিন্তু মহান প্রভু, আমি আপনার নামের শপথ করে বলছি, নির্মলেন্দু গুণ নামে আমার কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়নি। আমার আমার নাম বদলে নির্মল বেদনা রেখেছিলাম। সবাই আমাকে নির্মল বেদনা নামেই চেনে।
প্রভু যেন বড় ভুল করে ফেলেছেন, এমন ভঙ্গিমা করে বললেন, থুড়ি, থুড়ি, আমার বৃহত্তর ভুল হয়ে গেছে। বৃহত্তর ভুল শব্দটি শুনে নির্মল কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রভু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলতে লাগলো, যাই হোক কিন্তু কথা হলো আপনি তো পাপ, পুণ্য, স্বপ্ন, বাস্তব কিছুই বোঝেন না!
—মানে?
—মানে, মানে, আচ্ছা কেউ যদি স্বপ্নে কোনো পাপ করতে দেখে তাহলে কি তাকে পাপী বলা হয়, বলুন?
—না, কারণ সে তো নিজের ইচ্ছায় কিছুই করেনি।
প্রভু এবার খুব হাসতে লাগলো, তার হাসি দেখে ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিরও হাসতে হাসতে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। নির্মল কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। খুব একচোট হেসে প্রভু বললো, আপনারা পৃথিবীর মানুষেরা কোনটি ঘুম আর কোনটি জাগরণ তাই জানেন না। আপনারা যেটাকে ঘুম বলে মনে করেন, আসলে সেটাই হলো জাগরণ। ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখতেন, সেটাই ছিল বাস্তবতা। হা হা হা আপনাদের বাস্তব অবস্থা ছিল প্রকৃত পক্ষে ঘুমের ভেতর দেখা স্বপ্ন। আপনারা স্বপ্নে সব পাপ, পুণ্য অর্জন করতেন। একেবারে ঘুম থেকে উঠাকে আপনারা বলেন, মৃত্যু।
নির্মল যেন বধির হয়ে গেছে, কী শুনছে সে! এ কি সত্যি, না কি এও কোনো স্বপ্ন, যা অত্যন্ত বাস্তব মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই যা ভেঙে যাবে।
প্রভু হাসতে হাসতে বললো, আর শুনুন, আমি কোনো প্রভু বা ঈশ্বর নই, সত্যিকারের প্রভু যিনি, আপনাদের পাপ, পুণ্য নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কথাটুকু বলেই ট্রে থেকে মদের গ্লাস নিয়ে পান করতে লাগলো।