-আংকেল, একটু আসতে পারবেন?
-এখনই?
-হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে আমার একটু গুরুত্বপূর্ণ আলাপ ছিল। কয়েকদিন ধরে ভাবছি বলবো। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। গতরাতে ঠিক করলাম, আমার না বলা কথাগুলো আপনাকে বলা দরকার। আসবেন? প্লিজ! অুননয় সিলভিয়ার কণ্ঠে।
-কোথায় আসবো? বাসায়? আনিসুর রহমানের গলায় উল্লাস তাস খেলতে শুরু করেছে। শালা, এতদিনে মেয়েটি লাইনে এসেছে! সুন্দরী মেয়ে হলে লাইনে আসতে একটু সময় লাগে বটে কিন্তু আনিসুর রহমান ধৈর্য ধরতে জানেন। জানেন, ধৈর্যের পরইও খুলে যায় কামনা-বাসনার সব সুরভিত সুরঙ্গের দরজা।
-না আংকেল। আমি ধানমন্ডির ধানসিঁড়ি রেস্তোরায়। আসতে পারবেন না?
-নিশ্চয়ই। তুমি আধাঘণ্টা অপেক্ষা করো, আমি আসছি। সেলফোন রেখে সামনে তাকান আনিসুর রহমান। তিনি বসে আছেন ঘূর্ণায়মান চেয়ারে। সামনে বিশাল টেবিল। টেবিলের ওপর শক্ত মোটা বেলজিয়াম কাচ। কাচের ওপর অত্যাধুনিক কম্পিউটার। টেবিলের ওপাশে অফিসের কয়েকজন স্টাফ। সিঙ্গাপুরে একটা শিপমেন্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেই সময়ে টুপ করে মোবাইলে প্রবেশ করে সিলভিয়া নাজনীন। মোবাইলে কথা শেষ করে তাকান স্টাফ অফিসার এলাহীর দিকে, তোমাদের সঙ্গে আমার কাজ শেষ?
-ফাইলের কাজ, শিপমেন্টের কাগজ এখনো রেডি হয়নি। ওদের সঙ্গে কী কী বিষয়ে চুক্তি করবো, আলোচনা করা দরকার।
দাঁড়ান আনিসুর রহমান, তোমরা সব প্রস্তুত করো। আমি বিকেলে এসে সব দেখবো, কেমন? জরুরি ফোন এসেছে, এখনই যেতে হবে। টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন রূপালী গ্রুপের এমডি আনিসুর রহমান।
আনিসুর রহমানের বয়স কত? বোঝা মুশকিল। নাকের নিচে হালকা কালো গোঁফ। মাথার চুল ব্রাকব্যাশ করা। চওড়া কপাল। শরীরের রঙ টকটকে লাল সাদা। হালকা পাতলা পেটানো শরীর। বোঝা যায় নিয়মিত জিমে যান। সব সময়ে পরেন উজ্জ্বল টি-শার্ট, জিনসের প্যান্ট, কালো বুট। দারুণ মানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলেন আনিসুর রহমান। কয়েক বছর চাকরি করতে করতে বুঝে গেছেন চাকরির চেয়ে ব্যাংকের টাকায় ব্যবসা করলে, সুখে থেকে বিবিধ সখ মেটানো সহজ হয়। তিনি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নামলেন। পুরানা পল্টনে অফিস নিলেন। শুরু করলেন ইনডেটিং ব্যবসা। জাপান থেকে ফটোকপিয়ার মেশিনের টোনার আনতে শুরু করলেন এবং শুরুতেই বাজিমাত। ব্যবসার কাজে ব্রিটেন যাওয়ার সময়ে বিমানে দেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু জুনায়েদ রব্বানীর সঙ্গে, দুজনে পাশাপাশি সিটে, বিজনেস ক্লাসে।
তাহলে বন্ধু দেখা হলো বিমানে বিশ-বাইশ বছর পর? হাসেন আনিসুর রহমান।
পা ছড়িয়ে দেয় আয়েশ করে জুনায়েদ, আমি মাঝে মাঝে তোকে ভাবতাম। কই যে হারালি, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, তোর সঙ্গে কেন হয় না! বছর পাঁচেক আগে দেখা হয়েছিল হিমাংশুর সঙ্গে। ও বলেছিল তুই ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নেমেছিস। সত্যি নাকি, ব্যবসা করছিস?
হাসেন আনিস, ঠিকই শুনেছিস। আমি গরিবের ছেলে। আবার গ্রামের। কিন্তু আমি লড়াই করতে জানি। ব্যাংকের চাকরি করতে করতে দেখতে পাচ্ছিলাম, লোকজন তো ব্যাংকের টাকায় খেয়ে দেয়ে মোটা তাজা হচ্ছে। আমার দোষ কোথায়? একটু সাহস আর রিস্ক লাগে, নিলাম।
তুই যেভাবে রিস্ক নিয়েছিলি জুলেখাকে নিয়ে!
আনিস টঙ্গি থেকে ফেরার পথে উত্তরার সাত নম্বর সেকটরের তিন নম্বর রোডের আঠারো নম্বর বাড়ির তিন তলায় এসে কলিংবেল টেপে, এক বিকেলে। দরজা খুলে দেয় রাখি, আপনি?
দুই বন্ধু অনেক দিন পর বিমানের মধ্যে হাসিতে ফেটে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনে। পাশের যাত্রীরা ভ্রূ বাঁকা করে তাকাচ্ছে।
কিচ্ছু করার ছিল না রে জুনায়েদ, ওইভাবে জোর করে জুলেখাকে বিয়ে না করলে পেতাম না ওকে।
তা ঠিক, যদিও আমরা ভয় পেয়েছিলাম। জুলেখার বাবা সরকারের হোমরাচোমরা। ভেবেছিলাম, পুলিশে ধরিয়ে তোকে ফাসিয়ে দেবে।
সেই জন্য তোরা দূরে সরে গেলি?
এতদিন পরে মিথ্যা বলবো না, স্বীকার করে জুনায়েদ রব্বানী, তুই ঠিকই বলেছিস। আমরা তোর পক্ষে দাঁড়ানোর মতো সাহস তখন আমাদের ছিল না।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে অবিশ্বাস্য রকমের। বিয়ের পর জুলেখার বাবা হাসিব আহমেদ খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছিলেন আমাকে। কিন্তু…
– মেনে নিলে আবার কিন্তু কেনো?
-আমার শ্বশুর বলেছিলেন খাবার টেবিলে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমার দ্বারা কোনো সুবিধা পাবে না। ও লোক তো জানতো না, আমি ইতোমধ্যে মাস্টার্স ফাইনাল দিয়ে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার পদে ইন্টারভিউ দিয়েছি। বিয়ের দেড় মাসের মাথায় আমার চাকরি হয়ে যায়। আমি জুলেখার মাথা হেড করিনি ওর বাবার কাছে।
-কী রকম?
-আমি এখন পর্যন্ত শ্বশুরের কোনো ফেবার গ্রহণ করিনি।
-গুড। ছেলে-মেয়ে কজন?
-তিন ছেলে-মেয়ে। বড় দুইটা ছেলে। আর ছোটটা মেয়ে। তোর?
-তোর মতোই, তিন জন। বড়টা মেয়ে, শেষের দুটো ছেলে।
বিমানে দেখার পর দুই বন্ধুর মধ্যে কার্ড বদল হয় ও মোবাইল নম্বরও। খুব দ্রুত দুই পরিবারের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আনিসের স্ত্রী জুলেখা আর জুনায়েদের স্ত্রী রাখির মধ্যেও এক ধরনের যোগাযোগ তৈরি হয়। জুনায়েদের মেয়ে সিলভিয়া নাজনীন ইন্টারমিডিয়েড পাস করে ডাক্তারি পড়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছে। রাখি খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে। মধ্য বয়সেও দেখতে দারুণ সুন্দরী। স্লিম ফিগার। মাথায় দীঘল চুল। চোখ দুটো সাদা। অন্যরকম একটা সৌন্দর্য রাখির চোখে-মুখে-শরীরে। মায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিলভিয়াও এগিয়ে যাচ্ছে। জুনায়েদের বাসা উত্তরা। আনিসের বাসা বনশ্রী।
দুই বন্ধুর মধ্যে বছর খানেক যোগাযোগ থাকলেও ব্যস্ততার কারণে কমে যায়। আনিস টঙ্গি থেকে ফেরার পথে উত্তরার সাত নম্বর সেকটরের তিন নম্বর রোডের আঠারো নম্বর বাড়ির তিন তলায় এসে কলিংবেল টেপে, এক বিকেলে। দরজা খুলে দেয় রাখি, আপনি?
-একটা কাজে টঙ্গী গিয়েছিলাম। ফেরার পথে….
-আসুন, ভেতরে আসুন।
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করে আনিস, জুনায়েদ বাসায় নেই?
-না।
-কোথায় গেছে ও?
-আগে তো বসুন। আপনার বন্ধু বাসায় নেই কিন্তু আমি তো আছি। আমার ছেলে-মেয়েরা আছে। আপনি লাঞ্চ করেছেন তো?
সোফায় বসতে বসতে জবাব দেয় আনিসুর রহমান, হ্যাঁ ভাবী। আপনি বরং আপনার হাতের বিখ্যাত আদা মিশ্রিত এক কাপ চা দিন। চা খেয়েই কেটে পড়ি। অফিসে প্রচুর কাজ।
এই বাসায় এলে রাখির আদামিশ্রিত চা খেয়ে অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায়। রাখি চা বানাতে চলে গেলে সিলভিয়া এসে পাশের সোফায় বসে, কেমন আছেন আংকেল?
-এই তো মা ভালো আছি। তুমি?
-ভালো আছি। বাবা আমেরিকা গেছে, আপনি জানেন না?
-নাহ, অনেক দিন হয়েছে জুনায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বেড়াতে না ব্যবসার কাজে গেছে?
-আপনার বন্ধু আমাদের কাছে কোনো কিছু বলে যায়? কাজের মহিলা ট্রলি ঠেলে নিয়ে রুমের ভেতরে ঢোকে। সামনে রাখি। যতবার এসেছে এই বাসায় আনিস, দেখছে রাখি এত বিত্তের মধ্যে থেকেও আটপৌরে এক নারী। নিরাভরণ। নিজের হাতে সব কাজ করার চেষ্টা করে। লাল রঙের শরীরে পরেছে কালো রঙের তাতের শাড়ি। মাথার চুল খোঁপা করা। খোঁপায় একট কাঁটা গাঁথা। ব্লাউজটা সাদা কাপড়ের। ব্রা কালো রঙের। দোহারা গড়নের শরীরের সঙ্গে সবকিছু সাধারণ কিন্তু অন্যচোখে দেখলে, অসাধারণ। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রী হলেও আনিস ভিন্ন মনের চোখে না তাকিয়ে পারে না। ভেতরের কেউ একজন বাজনা বাজাচ্ছে। দ্রিম দ্রিম দ্রিম।
-চায়ের আগে একটু নাস্তা নিন।
আনিস গোপন অভিসারী দৃষ্টি থেকে ফিরে আসে সামনে, ট্রলিতে প্রচুর খাবার, এত খাবার?
-এত আর কই? হাতের কাছে যা ছিল তাই।
নাস্তার প্লেট হাতে নেয় আনিস, আমি একা খাবো? সিলভিয়া, তুমি আমার সঙ্গে অংশ নাও।
-আংকেল স্যরি, আমি ডায়েটে আছি। আপনি খান, আমি যাই, মা আপনাকে সঙ্গ দেবে। সিলভিয়া চলে গেলে ওর জায়গায় আনিসের মুখোমুখি বসে রাখি। আনিস তাকায় রাখির দিকে। রাখি চোখ ফিরিয়ে নেয়, দেখছিল আনিসকে গভীর আয়াত দৃষ্টিতে।
নাস্তা সেরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে আনিস, আপনার কণ্ঠে জুনায়েদ সর্ম্পকে অভিমানের সুর শুনতে পেলাম ভাবী।
মৃদু কিন্তু বিষণ্ন হাসি রাখির মুখে, আমার অভিমানে আপনার বন্ধুর কিছু যায়-আসে?
-মানে কী? আমি তো জানি আপনারা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। আর জুনায়েদ আপনাকে দারুন পছন্দ করে।
-এক সময়ে করতো, এখন সময় পার হয়ে গেছে। তখন আপনার বন্ধুর অল্প বয়স। অভিজ্ঞতা ছিল কম। ব্যবসা শুরু করেনি, বিয়ের আট নয় বছর পর আমার কোলে এলো সিলভিয়া, আপনার বন্ধু শুরু করলো ব্যবসা। টাকা আসতে লাগলো দেদার। আপনার বন্ধুর ভাণ্ডারে সঞ্চিত হতে লাগলো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, দেশে ও বিদেশে। আমি হয়ে পড়লাম আমারই সাজানো সংসারে পরিত্যক্ত এক টুকরো ন্যাপকিন, রাখি অল্প কয়েকটা বাক্যে জুনায়েদ ও নিজের সংসারের মাত্রচিত্র এঁকে দেয়।
রাখির শারীরিক মুগ্ধতা ছাড়িয়ে আনিস আবারও মুগ্ধ হলো রাখির প্রজ্ঞারও, আপনি লেখালেখি করেন নাকি ভাবী?
-কেন মনে হলো আপনার, আমি লিখি?
-আপনার কণ্ঠ উৎসারিত শব্দের গাঁথুনিতে মনে হলো, আপনি লেখেন।
-রমিজের মা? ও রমিজের মা? কাজের মহিলা সামনে এলে ইশারায় ট্রলি নিয়ে যেতে বলে রাখি তাকায় আনিসের দিকে, আমি আসছি। আপনি অপেক্ষা করুন দুই-তিন মিনিট।
-ঠিকাছে ভাবী, আপনি এলেই আমি উঠবো। জরুরি কাজ আছে অফিসে।
-সে দেখা যাবে, আপনি অপেক্ষা করুন, রাখি চলে যায়। আনিস নিজের মতো করে ভাবছে, মানুষ মূলত বাতাস ভরা বেলুন। বেলুনটা ছিদ্র করে দিলে যেভাবে দুমড়ে মুচড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, মানুষও তেমন। জুনায়েদ ও রাখী ভাবীর মধ্যে বিরাট শূন্যতা ঝুলছে বাতাস ভরা বেলুনের মতো। যতবার এই বাসায় বা ভিন্ন কোনো জায়গায় দেখা হয়েছে জুনায়েদ ও রাখির সঙ্গে, দেখেছে জুনায়েদ এক ধরনের নির্লিপ্ত ব্যবহার করছে। নিজেকে ডমিনেট করছে প্রকাশ্যেই রাখির ওপর। জুনায়েদ কি প্রায়ই বিদেশে যায়? ব্যবসার কাজে? না কি অন্য কিছু? ভাবনার মধ্যে রাখি ঢোকে রুমে। বসে আগের জায়গায়। হাতে একটা ডায়েরি। তাকায় রাখির দিকে, যদি কিছু মনে না করেন একটা বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাই।
-করুন, হাতের ডায়েরি নাড়াচাড়া করে রাখি।
-জুনায়েদের সঙ্গে আপনার কোনো সমস্যা…
ওরাও বাসার ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখতে চাইবে। মানুষ মুখে যা বলে মনে রেখো, সেটা মনের কথা নয়। মনের কথা, ভাষা, তৃষ্ণা অন্যরকম। সেটা তুমি বুঝবে না। লেখাপড়া করোনি, মাত্র মেট্রিক পাশ!
তীর্যক চোখে তাকায়, আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা বা দূরত্ব যাই বলুন, সবটুকুই আপনার বন্ধুর। ওই যে বললাম, অঢেল টাকা হাতে এলে পুরুষের পৌরষত্ব বেড়ে যায়, রুচির নগ্ন পরিবর্তন আসে, এখানে ওখানে নাক দিয়ে গন্ধ নিয়ে হামলে পড়ে কুমিরের মতো, আপনার বন্ধু এখন কুমির। আমাকে প্রয়োজন নেই। যেহেতু, সংসার গড়েছি, বাচ্চাদের মা হয়েছি, এই বয়সে কোথাও যাবার জায়গা নেই, বাধ্য হয়ে আছি।
-আমি দুঃখিত ভাবী, সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে আয়েস করে আনিসুর রহমান। ধোয়ার কুণ্ডুলী ছড়িয়ে পড়ে রাখির সুসজ্জিত ড্রযিংরুমে। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধটা ভালোলাগে রাখির। আনিসের গোটা শরীর কাঠামোর মধ্যে এক ধরনের দুত্যি ছড়িয়ে পড়ছে। মাথার লম্বা চুল কপালের ওপর কয়েক গাছি ছড়িয়ে গেছে। আনিসের পুরো শরীরের অবাকাঠামো জুড়ে অদ্ভুত একটা ব্যাক্তিত্বময় সৌন্দর্য দেখে রাখি। নিষ্পলক দেখতে ইচ্ছে করছে সামনের এই সুপুরুষকে।
হাসে আনিসুর রহমান, আপনি বললেন বয়স প্রসঙ্গে কিন্তু আমার ধারণা আপনাকে দেখে অধিকাংশ পুরুষ ভুল করবে।
-ভুল করবে? কী রকম? উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় আনিসের দিকে রাখি।
-মনে করবে, আপনি এখনো অনেক সুরভিত একজন নারী। আর ফিগারটা ধরে রেখেছেন দারুন যত্নে। মেঘের সোনা রঙ ওপর স্বর্ণলতা।
অদ্ভুত তৃষ্ণিত চোখে তাকিয়ে থাকে রাখি, অন্য পুরুষ কি বললো তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি কী বলেন?
-একই উচ্চারণ করবো আপনার সর্ম্পকে। নিঝুম সময়ের নিখাদ স্বর্ণলতা আপনি।
রাখির শরীরের ভেতরটা গলে মোম হয়ে যায়, জলন্ত জল হয়ে গলে গলে পড়ছে কিন্তু আনিসুর রহমান বুঝতে পারে না। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। আনিসের দিকে তাকাতে পারে না, চোখের ভেতরে জ্বালার জলে আগুন জ্বলছে। তাকায় দেয়ালের দিকে। মুখোমুখি দেয়ালে পোড়ামাটির বিচিত্র ভাস্কর্য। এগুলো থাইল্যান্ড থেকে এনেছে জুনায়েদ বছর সাতেক আগে। নারী পুরষের শারীরিক সংবর্তের জীবন্ত আগুন মিশে আছে টেরাকোটাগুলোয়। বন্য, কামনা মাখা, আদিম। ড্রয়িংরুমে না রেখে বেডরুমের দেয়ালে লাগাতে বলেছিল রাখি।
-কেন? ড্রয়িংরুমে লাগালে সমস্যা কী? প্রশ্ন করে জুনায়েদ।
বাইরের কত মানুষ এসে এখানে বসে। ওরা কী ভাববে?
-কী ভাববে? আমি বিকৃত? নোংরা? ব্যাভিচারী? পর নারীর প্রতি আমার ঘ্রাণ কুকুরের চেয়েও বেশি। যা তুমি আমাকে সব সময়ে বলো?
-আমি তোমাকে যাই বলি, বাইরের মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার দরকার কী? তাছাড়া ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে!
-শোনো, ড্রয়িংরুমে যারা আসবে, তারা দেখে নাক সিটকাবে, উল্টোপাল্টা বলবে, আমার রুচির প্রশ্ন তুলবে কিন্তু বাসার বাইরে গিয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করবে, আমি এইসব টেরাকোটা কোথায় পেয়েছি, হাসে জুনায়েদ।
-কেন জিজ্ঞেস করবে?
ওরাও বাসার ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখতে চাইবে। মানুষ মুখে যা বলে মনে রেখো, সেটা মনের কথা নয়। মনের কথা, ভাষা, তৃষ্ণা অন্যরকম। সেটা তুমি বুঝবে না। লেখাপড়া করোনি, মাত্র মেট্রিক পাশ!
রাখি রুম থেকে চলে যায়। ইচ্ছে হয় লোকটাকে চাবুকপেটা করতে। বিয়ের পর কতভাবে বলেছে, আমি কলেজে ভর্তি হই।
-জুনায়েদ বলেছে, তুমিই আমার ইউনিভার্সিটি। কলেজের দরকার কী?
-ভাবী, হাতে কী? ডায়েরি আপনার?
-লেখা না, হাবিজাবি। আপনি লেখার বিষয়ে বললেন, তাই নিয়ে এলাম। দেখবেন?
-দিন, উল্টো দিকের সোফা থেকে উঠে এসেপাশে বসে আনিস। হাতে নেয় ডায়েরি, পাতা উল্টাতে উল্টাতে থেমে যায় এক পৃষ্ঠায়। গোটা গোটা হাতের লেখায়, আমি কে? আমি শূন্য এক। কেউ নেই আমার। কিন্তু চারপাশের মানুষ আত্মীয় স্বজনেরা জানে, আমি পরম সুখী এক রমনী। প্রচুর অর্থ সম্পদের মধ্যে বসবাস। আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে, আমি কিছুই পারি না। আমার পায়ে হাত কোনো শিকল নেই কিন্তু আমার অস্তিত্বের সবটুকুজুড়ে শিকলের কাঁটা। যে আমার সকল শক্তি প্রেমের আধার, সেই আমাকে সকল সুখের শিকল থেকে মুক্তি দিয়ে অদৃশ্য শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি কোথায় যাবো? কেউ দেখুক আর না দেখুক, আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই। একটাই জায়গা আছে, পরম প্রিয় মৃত্য। হায় প্রিয় মৃতু, তুমি কত দূরে।
আনিস ভরাট গলায় পাঠ করে তাকায় রাখির দিকে। রাখিও তাকিয়ে, দারুণ।
-মানে?
-আমার সামান্য লেখা আপনি ভরাট গলায় পড়লেন, মনে হলো আপনি আবৃত্তি করছেন। খুব ভালো লাগছে। আমার লেখাটুকু সার্থক।
-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে আবৃতিচর্চা করতাম ভাবী। অনেক দিন চর্চ্চা নেই।
-আংকেল! দরজায় দাঁড়ানো সিলভিয়া, আমিও শুনেছি। সত্যি আপনার কণ্ঠ অসাধারণ।
-কী যে বলো না তুমি! দেখেছ তোমার মায়ের লেখা?
-আমি পড়েছি, অনেক বার। সময় পেলেই পড়ি। সুযোগ পেলে মা আমার অনেক বড় লেখক হতে পারতো। কিন্তু সুযোগটাই পেলো না, মায়ের নিঃশব্দ রোদন মেয়ের মধ্যে প্রসবিত।
আনিস আবার পৃষ্ঠা ওল্টান, বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টি ধরছি। বৃষ্টি শরীরে কামনার কাঁটা ফুটিয়ে দেয়। আমার শরীরের প্রতি বিন্দু কামনার আগুন বৃষ্টিতে জ্বলছে। অথচ আমি আত্মমেহনে জর্জরিত এক পাখি। পাখির ডানা আছে, উড়ে যায় নিঃসীম আকাশের বাড়ি। আকাশের কি বাড়ি আছে? কেমন সে বাড়ি? আমার মতো তিক্ত মানুষেরা কি থাকতে পারে আকাশের বাড়ি? হে অনন্তের আকাশ, আমাকে একটু জায়গা দেবে? দাও না হাত বাড়িয়ে।
ওর বাবা জুনায়েদ, আনিসের বন্ধু যখনই বিদেশে যেতো, সিলভিয়া ফোনে আমন্ত্রণ জানায়, আংকেল কোথায় আপনি? চলে আসুন, আপনার প্রিয় আলুর দম আর লুচি বানিয়েছে মা।
আনিসের ফোন বাজে। কানে নেয়, হ্যালো? হ্যাঁ সারোয়ার, আমি আসছি। একটা কাজে আটকা পড়েছি। বের হচ্ছি এখনই। ফোন রেখে তাকায় রাখীর দিকে, ভাবী অফিস থেকে ফোন এসেছে। আমি যাই। আর এই ডায়েরিটা নিয়ে যেতে চাই, যদি আপনি অনুমতি দেন।
-আমার এই ডায়েরি নিয়ে কী করবেন?
-পড়বো। বিশ্বাস করুন, আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমি পড়ে ফেরত দেবো আপনাকে। আপনার অন্তঃজমিনের গানটা আমি জানতে চাই, বুঝতে চাই, দাঁড়ায় আনিস, যাই? হঠাৎ করেই বিকেলটা আপনার সান্নিধ্যে খুব চমৎকার কাটলো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
-আংকেল? দরজা থেকে রুমের মধ্যে এসে আনিসের সামনে দাঁড়ায় সিলভিয়া নাজনীন, অফিসটা আপনার না?
-হ্যাঁ। আমারই অফিস। কেন মা?
-আজকে আমাদের সঙ্গে থাকুন। নিজের অফিসের যখন কাজ, কাল করবেন। আমাদের জন্য একটু সমস্যাই হলো!
-কী বলছ তুমি?
-যা বলছি, সেটাই করুন।
-মেয়েটা যখন বলছে, খুব অসুবিধা না হলে থাকুন না। রাতে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাবেন।
-রাইট, আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাবেন, দরজা থেকে মায়ের পাশে বসে মাকে সমর্থন জানায় সিলভিয়া। বাবা নেই বাড়িতে, তাতে কী? আমরা আছি না!
আনিসেরও খুব ইচ্ছে জাগে থেকে যেতে। না চাইতেই বৃষ্টির ঘ্রাণ নিয়ে এই রমনীর মুখের রমনীয় ভাষা, চোখের চকিত দৃষ্টি, মনের স্রোতে বেগবান কামনামন্দ্রিত আচ্ছন্ন সুখ বিলাস, সব দু’হাতে লুঠ করার আদিম অভিলাষ জাগে।
-থাকুন না, রাখির বিনম্র ধূসর চোখের তারায় খেলা করে রক্তলেখায় ধ্রুপদি নৃত্য। আনিসুর রহমান অস্বীকার করতে পারে না রাখির সন্মোহন মাখা নিঃশব্দ আমন্ত্রণ।
বসে সোফায়, এমন করে বলছেন, ঠিক আছে।
মা-মেয়ের মুখে বিজয়ের হাসি।
-মা তুমি আংকেলের সঙ্গে গল্প করো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমি তোমাদের জন্য চা পাঠাই, সিলভিয়া নাজনীন উঠে চলে যায়।
-সিলভিয়া তো লক্ষ্মী মেয়ে।
-হ্যাঁ, মেয়েটি আছে বলে শত সংকটে দুঃখে আমি বেঁচে আছি। ও আমার জন্য পরম আশীর্বাদ।
-আপনার ছেলে দুটো কই?
-ওরা থাকে নিজেদের ঘরে মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে আড্ডা মারছে। চলুন, ছাদে যাই।
-ছাদে? চলুন।
পাঁচ তলা বাড়ির তিনতলায় থাকে জুনায়েদ সংসার নিয়ে। বাড়ির মাঝ বরাবর সিঁড়ি। দুই দিকে সাড়ে তেরোশত স্কোয়ার ফিটের দুটি করে ফ্ল্যাট। তিন তলায় নিজেদের থাকার জন্য টোটাল সাতাশ শত স্কয়ার ফিট নিয়ে ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার দিয়ে সাজিয়ে নিয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে দুজনে উঠছে, পাশাপাশি। শরীরের সঙ্গে শরীরের স্পর্শে রাখির মধ্যে কোনো দ্বিধা দেখতে পাচ্ছে না আনিস। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে এসেই অবাক আনিস, গোটা ছাদ বাহারি মালিপ্ল্যান্টে সাজানো। ফুলে ও ফলে, সবুজ পাতায় মোড়া ছাদের চারপাশটা। মধ্যেখানে সুন্দর করে সোফা রেখে বসার ব্যবস্থা। ওপরে রঙিন টিনের ছাদ।
-বাহ! বলে আনিস, দারুন তো!
-আপনার ভালো লেগেছে? পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চায় রাখি।
হাসে আনিস, ভালো না লেগে উপায় আছে? কে সাজিয়েছে? আপনি?
-আমি আর সিলভিয়া।
-সত্যি মা মেয়ের দারুণ রুচি।
দুজনে হাঁটছে, কথা বলছে। বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যার আগে গোধূলি বেলা চারদিকে। পশ্চিমের আকাশে লাল আবির। উত্তরের আকাশে মেঘ জমছে। বৈশাখের তপ্ত দিনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।
-দেখছেন বাতাসটা কেমন ঠাণ্ডা! রাখির খুব পাশে দাঁড়িয়ে তাকায় আনিস, কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে।
-এখানে হলে ভালো হতো।
-কেন ভালো হতো?
-আপনার সঙ্গে ভিজতাম।
-আমার সঙ্গে ভিজতেন! অবিশ্বাস্য গলা আনিসের। ভয় করবে না আপনার?
-ভয়! মুখে মিশ্রি কাটার হাসি। আনিসকে অবাক করে ডান হাত ধরে রাখি, কেন ভয় করবে? আমার কি সুখ করার কোনো অধিকার নেই? মুখোমুখি হয়ে আনিসের বুকের ওপর নিজের বুক প্রতিস্থাপন করে রাখি, দুই পায়ের পাতায় ভর দিয়ে চোখের ওপর রাখে চোখ, আমি কি তোমার উপযুক্ত নই?
মুহূর্ত মাত্র, আনিস দুই হাতে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে, তুমি আমার রঙিন পুতুল। কেন তুমি আমার উপযুক্ত হবে না! দুই জোড়া ওষ্ঠ মিলিত হয় দগ্ধ গোধূলির ঠাণ্ড বাতাসের সময়ে।
সিঁড়িতে মানুষের সাড়া পেয়ে দুজন আপাতত মুক্তি দেয় দুজনকে। ট্রেতে খাবার আর চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঢোকে সিলভিয়া আর কাজের মহিলা। সোফায় বসে টেবিলের ওপর সব সাজায় সিলভিয়া। রাখি আর আনিস সোফায় এসে পাশাপাশি বসে।
-আংকেল আপনি ইলিশ মাছ পছন্দ করেন?
-আমার প্রিয় মাছ ইলিশ।
-আমি রান্না করছি, সঙ্গে গরুর মাংস ভুনা। সাদা ভাত। আশা করি খারাপ হবে না, মৃদু হাসে সিলভিয়া।
-ঠিক আছে মা।
-আপনারা গল্প করুন, সিলভিয়া আর কাজের মহিলা চলে যায়।
চায়ের কাপে চা ঢালে রাখি, দুজনে চায়ে চুমুক দেয়, আনিস টেনে রাখিকে বুকের সঙ্গে নেয়। দুজনে চা পান করে। চা পান শেষ হতে পারে না, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। দুজনে দাঁড়ায়, হাত বাড়ায় বৃষ্টির দিকে, বৃষ্টি ধরতে ধরতে আনিস টেনে নেয় রাখিকে। বৃষ্টির শরীরে শরীর রেখে খৈ ফোটায় আনিস আর রাখি।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারে কিন্তু চমক থাকে না। চমক না থাকলে গল্প সফল হয় না। গ্রহণ করবে না পাঠকেরা। সুতরাং আমাকে গল্পটার জন্য ভিন্ন একটা আখ্যান তৈরি করতে হচ্ছে। গল্পের শুরুটা হয়েছে, সিলভিয়ার ফোন দিয়ে। ফোন করেছে পিতার বন্ধু মায়ের গোপন প্রমিক আনিসুর রহমানকে।
কেন? প্রশ্ন করতে পারেন।
আমি গল্পের শেষটায় উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিয়ে গল্পের সমাপ্তি টানবো। গল্পটা দ্রুত শেষ হবে। টেনে টেন বড় করলে ‘যখন খুলে যায় অন্ধকার’ গল্পটা ঝুলে যাবে। ঝুলে যাওয়া গল্প পড়ে সুখ নেই। সিলভিয়ার ফোনে দারুণ উৎফুল্ল আনিসুর রহমান। কারণ, অনেক দিন ধরে মেয়েটিকে মায়ের মতো বাসনা করে আসছিল। সেই বাসনা আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সাধনা সার্থক। ধীরে ধীরে মেয়েটিকে একটু একটু করে মাকড়সার জালের লবণ ও লাবণ্যে জড়িয়ে আনছিল। বাকি মাত্র, সুযোগ বুঝে একটা টান!
মেয়েটির মা রাখি বছর দেড়েক আগে ক্লোন ক্যানসারে মারা গেছে। মা মরে মেয়েকে পাওয়ার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে আনিসুর রহমানকে। কিন্তু এক বছরের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল রাখি ও আনিসুরের, সেই সম্পর্কটা তৈরির কারিগর রাখীর বড় কন্যা সিলভিয়া নাজনীন। ওর বাবা জুনায়েদ, আনিসের বন্ধু যখনই বিদেশে যেতো, সিলভিয়া ফোনে আমন্ত্রণ জানায়, আংকেল কোথায় আপনি? চলে আসুন, আপনার প্রিয় আলুর দম আর লুচি বানিয়েছে মা।
-আসছি।
এক ধরনের প্রতিশোধও বলতে পারেন। আপনি আমার মানসিক রসায়নটা বুঝতে পেরেছেন আংকেল?
হাজার বছরের তীব্র ক্ষুধা নিয়ে চলে আসতেন আনিসুর রহমান। ক্ষেত্র প্রস্তুত। রাখিকে নিয়ে ছাদে চলে যেতেন। বিহার করতেন শরীরে শরীরে। গহন মগ্নতায়। পাহারায় মেয়ে সিলভিয়া নাজনীন। সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করতো সিলভিয়া। নিত্যনতুন খাবার। পিতার বন্ধুর সঙ্গে মায়ের অভিসারের ক্ষেত্র কেনো প্রস্তুত করতো মেয়ে, ভাবনায় আসেনি আনিসুর রহমানের। কেবলই মত্ত থেকেছেন মাংসতোরণের দরজা খোলার মত্ততায়। লোভ বেড়েছে বিপুল আগ্রাসনে, মায়ের পর মেয়ে! অভিনব একটা সার্থকতার স্বাক্ষর রচনা করতে চলেছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান।
পৌঁছলেন তিনি ধানমন্ডির ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টের তিন নম্বর কক্ষে। রুমের মধ্যে নক্ষত্রের আলো ছড়িয়ে অপেক্ষায় সিলভিয়া নাজনীন। অপরূপ সেজেছে মেয়েটি। বসেন মেয়েটির মুখোমুখি আনিস। লোভে চোখ চক চক করছে। হাত বাড়িয়ে দেয় সিলভিয়া, সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতের মধ্যে সিলভিয়ার ডান হাতটা লুফে নেন। কোমল, মাখন মাখা মাংসের গন্ধ আসছে আনিসুর রহমানের নাকে। সিলভিয়ার মুখে বিনম্র হাসি, সমর্পণ করার আগের মুহূর্তের ঢল ঢল আলোর মিছিল।
আপনার জন্য শাড়ি পরেছি, সিলভিয়া গলায় সুখ তরঙ্গ তোলে চোখে মুখে উচ্চারণে।
-তাই! উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কাঁপছেন আনিসুর রহমান। তোমাকে অস্পরী লাগছে, যদিও কখনো অস্পরী দেখিনি। কেবল গল্প উপন্যাসে রূপকথায় পড়েছি।
-থ্যাঙ্ক ইউ। তির তির আবেগে কম্পমান সিলভিয়া নাজনীন, আনিসুর রহমানের বন্ধুর মেয়ে, সদ্য প্রয়াত প্রেমিকার ভার্জিন কন্যা।
-সিলভি! মুখোমুখি বসার চেয়ার ছেড়ে আনিসুর রহমান সিলভিয়ার পাশের চেয়ারে বসেন, তাকান গভীর তৃষ্ণিত চোখে, এখানে কেন? চলো অন্য কোথাও যাই!
-কোথায় যেতে চান?
গাজীপুরে বা সাভারে কত কটেজ আছে। চলো সেখানে, কামনার রসে ডোবানো চোখের তারায় খেলা করে ভোগের খিদে। এখনই ফোন করে চলে যাই।
-যাবেন? ফিসফিসিয়ে কথা কয় সিলভিয়া নাজনীন।
দুহাতে বুকের কাছে টেনে নেয় সিলভিয়াকে, মুখের কাছে মুখ রাখে, নিশ্চয়ই যেতে চাই। তোমাকে নিয়ে ডুবে যেতে চাই অসীমে। এক মিনিট ফোন করে দেখছি, কাছের কোনো কটেজে রুম খালি আছে নাকি!
মোবাইল কেড়ে নেয় সিলভিয়া, ফোনের আগে আপনার সঙ্গে আমার আলাপটা শুনুন আংকেল!
-না, কটেজে গিয়ে শুনবো।
-না, আমি এখনই বলতে চাই, একটু শক্ত গলায় বলে সিলভিয়া নাজনীন।
ভেতরে ভেতরে ক্রোধ হলেও মুখে হাসি টেনে বলেন আনিসুর রহমান, তুমি খুব জিদ্দি মেয়ে। আমি অবশ্য জিদ্দি মেয়েই পছন্দ করি। বলো, কী বলতে চাও। শাড়ির নিচে নাভীর ওপর হাত রাখেন। সিলভিয়া হাতটা ধরে টেবিলের ওপর রাখলেও নিজের মুঠোয় ধরে রাখে, আমার বাবা আপনার বন্ধু জুনায়েদ রাব্বীর হাতে অঢেল টাকা আসতে শুরু করলে একটু একটু করে পাল্টে যেতে থাকেন।
-আমি এসব জানি সিলভি। তোমার মা আমাকে সব বলেছে, অসহিষ্ণু আনিসুর রহমান, সিলভিয়ার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়াতে চায়, কিন্তু সিলভিয়া হাতটা ছাড়ে না।
-মা আপনাকে সবটা বলেনি। আমি বলছি, শুনুন।
গভীরের সুরঙ্গে প্রবেশ করতে হলে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে এইসব মেয়ের অনেক অপ্রয়োজনীয় অন্তসারশূন্য বাক্যের মূল্য দেওয়ার ভান করতে হয়। অবশ্য একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর বাধা থাকে না। ঠিক আছে, বলো।
আমি শৈশব থেকেই সচেতন পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্ম্পকে। যখন দেখলাম আমার মাকে বঞ্চিত করে বাবা বিকৃত খেয়ালের নৌকায় দাঁড় বাইছে আমার বুকটা ভেঙে যেতে লাগলো মায়ের কষ্টে। এমনকী মায়ের ক্যানসার চিকিৎসার প্রতিও বাবার তেমন কোনো আগ্রহ দেখিনি। বাবা চাইছিলেন মায়ের মৃত্যু। মা আমার খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি কিন্তু মায়ের ছিল অবাক সংবেদী মন।
-আমি তো জানি সিলভি, তোমার মায়ের ডায়েরি পড়েছি। আমার ইচ্ছে ছিল, তোমার মায়ের ডায়েরির লেখা দিয়ে একটা বই প্রকাশের। কিন্তু…
-আমিই প্রকাশ করবো। এখন শুনুন, মায়ের রোদনভরা নিঃশব্দ কষ্ট আমাকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করতো। মায়ের সুখের জন্য কী করা যায়, সারাক্ষণ ভাবতাম। সেই সময়ে আপনি এলেন বর্ষার স্রোতধারা হয়ে আমার মায়ের জীবনে। বাবা যদি দেশে বিদেশে অসংখ্য নারীর সঙ্গে বিছানায় যেতে পারে, মায়ের অপরাধ কী? মায়ের তো ভালোবাসা, শরীরের সুখ পাওয়ার অধিকার আছে। আমি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে আপনাকে দিয়ে মায়ের জীবনে একটু সুখের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম। বৈধ বা অবৈধ আমি ভাবিনি। এক ধরনের প্রতিশোধও বলতে পারেন। আপনি আমার মানসিক রসায়নটা বুঝতে পেরেছেন আংকেল?
উত্তর না দিয়ে অবাক তাকিয়ে থাকেন আনিসুর রহমান।