নাতি-নাতনি হবে খবরটা সাময়িক আনন্দ দিলেও মেয়েটাকে নিয়ে ময়না রানীর দুশ্চিন্তাই হয় বেশি। মেয়েটা তাদের সম্প্রদায়ের মতো হয়নি। কেমন যেন একরোখা। চেহারা সুরতও ওদের ধারে কাছে যায় না। কুড়ি বছর আগে এই মেয়ের জন্মের সময় প্রতিবেশী মহিলারা টিপ্পনী কেটে বলেছিল- ‘এ যে এক্কেবারে পাক্কা মেমসাহেব! সোয়ামীকে এভাবে ঠকাইছিস ময়না!’ ময়না রাজেশ ওদের দু’জনেরই গায়ের রঙ যথেষ্ট কালো। রাজেশ তখন তাগড়া জোয়ান পুরুষ। পাকানো দড়ির মতো তার পেশীবহুল শরীর, তবে মনটা খুবই নরম স্বভাবের। এই মানুষটার সঙ্গে ময়নার সম্পর্কটা ছিল সবসময়ই খুব বোঝাপড়ার। প্রতিবেশীদের হাতে স্ত্রীকে এভাবে হেনস্থা হতে দেখে রাজেশ এগিয়ে এসেছিল। ময়নাকে কিছু বলতে হয়নি, সেই প্রতিবেশীদের তাড়া দিয়ে বলেছিল-‘যা-যা আমাদের বেটি মেমসাহেবই, তাতে তোদের কিরে?’
রাজেশের তাড়া খেয়ে প্রতিবেশীরা খিলখিলিয়ে হেসে পাড়ামাত করেছিল-‘বাপরে বউয়ের প্রতি এতো টান!’ তবে রাজেশ যাই বলুক, ময়না নিজেও মেয়ের চাঁদপনা মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভেবেছে বহুবার, এত রঙ মেয়েটা পেলো কোত্থেকে! স্ত্রীর মনের ভাব বুঝতে পেরে রাজেশ উত্তর যুগিয়েছে-‘শোন্ বউ। সেই রাইতটা ছিল পূর্ণিমা। মনে নেই তোর! আলো এইসে ঘর কেমন ভরে গেছিল! তুই লজ্জাতে মুখ ঢেইকে রাখছিলি বারে-বারে। মেয়েটা সেই আলোতেই এমন হইছে রে।’
‘ধুর তুমার যেমন কথা’- ময়না কপট রাগ দেখিয়ে স্বামীর মতকে অগ্রাহ্য করে। এক সময় রাজেশ সত্যটা উদঘাটন করেছিল অন্যভাবে, তার দিদিমার গায়ের রঙ ছিল দুধে আলতা, এত বছর পর দিদিমা মেয়ের মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছে ওদের ঘরে। হতেও পারে, ময়না রাজেশের এই মতটাকেই গ্রহণ করেছে। দিদি শাশুড়ির রূপ নিয়েই হয়তো মেয়েটা এমন রূপসী হয়েছে, নইলে ওর পেটের সন্তান এত রঙ পাবে কোথা থেকে? সৌন্দর্যের কারণে সবাই মেয়েটাকে রূপসী বলেই ডাকতো, তাই আলাদা করে তার আর নাম রাখার প্রয়োজন হয়নি। তো রূপসীকে নিয়ে রাজেশের আদিখ্যেতার সত্যি যেন শেষ ছিল না। মেয়েকে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, মেয়ের আবদার মেটাতে এটা-সেটা কিনে আনা নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল তার। শুধু তাই নয়, ওদের সমাজে যা কেউ কোনোদিন ভাবেনি তাই সে ভেবে বসলো। মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবে, সমাজের মান্যিগণ্যি কিছু একটা বানিয়েই ছাড়বে। হয়তো দীর্ঘ দাসত্বের শেষ এভাবে সে করতে চেয়েছিল। ফলে নিজের সামান্য আয়ের সিংহভাগই সে মেয়ের শখ-আহ্লাদ পূরণে ব্যয় করে ফেলতে লাগলো। মেয়েও দিনে দিনে হয়ে উঠলো আহ্লাদি, বাপনেওটে। তবে সব দেখেশুনে ময়না রানী মন মাঝেমধ্যেই শঙ্কিত হয়ে উঠতো। পেখম লাগালেই কি ময়ূর হওয়া যায়! ময়না-রাজেশরা অন্যের বাড়ির ময়লা আবর্জনা সাফ করে আসছে বংশ পরম্পরায়। শহরের একপ্রান্তে ওরা বাস করে। মূল সমাজের মানুষের সঙ্গে ওদের তেমন উঠাবসা নেই বললেই চলে। ওদের ঘরের ছেলে-মেয়েরা কখনো কোনো স্কুল, কলেজে যায়নি। বিয়ে, আকিকা, পূজা-পার্বণ কোনো উপলক্ষেই সমাজের অন্য মানুষের সঙ্গে ওদের চলাফেরার অনুমতি নেই। অনুমতি নেই বাজারের চায়ের দোকানে এক টেবিলে বসে খাওয়ার। অঘোষিত এই নিয়মের বেড়াজালে আটকে আছে ওদের জীবন বহুকাল থেকে। এ নিয়ে অবশ্য কারো কোনো মাথা ব্যাথাও নেই। সম্প্রদায়ের পুরুষরা জীবনের বেশির ভাগ সময় নেশার ঘোরেই পার করে দেয়। মেয়েরা বাচ্চা বিয়ানো আর ঘরদোরের কাজ ছাড়া অন্যকিছুই তেমন জানে না। ময়না তার শ্বশুরের কাছে শুনেছে, শহর যখন এতোটা আধুনিক হয়নি, তখন ভদ্রলোকদের বাড়ির ময়লা মাটির চাঁড়িতে মাথায় করে দূরে ফেলে আসতে হতো সকালের সূর্য ওঠার আগেই। এখন অবশ্য ওতো কষ্ট নেই। মানুষের বাড়ি বাড়ি পাকা ল্যাট্রিন হয়েছে। সাপ্লাই পানি, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার কাজকে অনেক সহজ করেছে। তারপরেও সমাজের উচ্ছ্বিষ্ট তারা, ওদের মনে স্বপ্ন থাকা সেটা যে এক ধরনের পাপ। ময়না স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কাজ নেই মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর। ওদের সম্প্রদায়ের মেয়েকে ওদের মতো করেই বড় করা ভালো। নইলে জীবনে কষ্ট বাড়বে। কিন্তু রাজেশ শোনে না। সে নিজে যে সরকারি অফিসে কাজ করে, সেই অফিসের লোকজনের সাহায্যে মেয়েকে এক স্কুলে ভর্তি করিয়ে আসে। আনন্দে ডগমগ হয়ে বাড়ি ফেরে-‘দিন আর আগের মতো নাইরে বউ। মেথরের বেটি বলে স্কুলের মাস্টার এখন আর দূর-দূর করে তাড়ায় না। দেখ আমার বেটিকে কত সুন্দর সুন্দর বই দিছে মাস্টার।’
তো বই খাতা নিয়ে সুন্দর জামাকাপড় পরে রূপসী সত্যি স্কুলে যেতে শুরু করে। ফুটফুটে মেয়েটা স্কুলে কেমন জায়গা করে নেয় সবার মাঝে। জাত পাত নিয়ে কোনো সমস্যা তো হয়ই না বরং স্কুল মাস্টাররা নাকি ওকে একটু বেশিই গুরুত্ব দেয় বলে শুনেছে ময়না। দিন বসে থাকে না। রূপসী স্কুলের ছোটো ছোটো ক্লাস পেরিয়ে বড় ক্লাসে ওঠে। এক সময় স্কুলের গণ্ডিও পার হয়ও। পুরো সম্প্রদায়ে যেটা কেউ পারেনি, তাই করে দেখায় রূপসী। গর্বে ভরে যায় রাজেশের বুক। পেরেছে তার মেয়ে, পেরেছে সমাজের তৈরি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে। রূপসীর স্কুলের টিচাররা আরও স্বপ্ন দেখায় সামনে এগিয়ে যাবার। কিন্তু পথের শেষটুকু দেখতে না পেয়ে মা হিসেবে ময়না রীতিমতো আতঙ্কিত বোধ করে। এমনিতেই সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে ওদের একটা দূরত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মেয়েটা ওদের সমাজের লোকেদের সঙ্গে একেবারেই মিশতে পারে না। সমাজের মানুষেরা ব্যাপারগুলো ভালোভাবে নেয় না। তারা নানান কথাবর্তা বলে কান ঝালাপালা করে দেয়। বয়স্করা বলতে শুরু করে-‘মেথরের বেটি লেখাপড়া শিখে কি রাজরানী হবি? সমাজের আচার বিচার কিছুই মানবিনে?’
তারচেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় রূপসীর নিরাপত্তার ব্যাপারটা। ওদের সম্প্রদায়ের মধ্যে রূপসীর বয়সী কোনো মেয়ে অবিবাহিত থাকে না। বিয়েশাদী করে ছেলেপুলের মা হয়ে তারা ঘরে প্রবেশ করে। রূপসীর ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। রূপসীর ঘর-বর হয়নি, কিন্তু সৌন্দর্যের কারণে মেয়েটা সবার নজর কাড়ছে। বাড়ির আশেপাশে উঠতি বয়সের ছেলেপেলেদের আনাগোনা লক্ষ করে ময়না রাজেশকে বোঝানোর চেষ্টা করে-‘অনেক হইছে, এমুন সেয়ানা মেয়েকে আর ঘরে রাখা ঠিক না। কোনো অঘটন ঘটলে সমাজে মুখ দেখাবার আর জো থাইকবে না!’ রাজেশও অনুভব করে এভাবে টিকে থাকা কঠিন। মেয়েটা স্কুল পাস দিয়েছে এই অবস্থায় ভালোভাবে পাত্রস্থ করতে পারলেই ওর শখ আহ্লাদ মিটে যায়। তবে দিনে দিনে রাজেশ একটা সত্য উপলব্ধি করে, তা হচ্ছে সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে মেয়েটা বইখাতা হাতে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু ভিনজাতের কেউ সহজে রাজি হবে না ওর মেয়েকে গ্রহণ করতে! জাতের গন্ধ এত সহজে দূর করতে পারবে না সে মেয়ের শরীর থেকে! বাবা হিসেবে রাজেশ এই প্রথম বাস্তবতার মাটিতে পা রাখে।
এরমধ্যেই ঘটে যায় এক ঘটনা, সম্প্রদায়ের এক বখাটে কলেজে যাওয়ার পথে রূপসীর পথ আটকায়। রূপসী দমবার পাত্র নয়, সে সোজা চড় কষে মারে ছোঁড়াটার গালে। সাংঘাতিক হৈ চৈ লেগে যায় পাড়ায়। মেয়ে মানুষের এত দেমাগ! মেয়ে মানুষ গায়ে গতরে দেখার মতো হলে পুরুষ তার সঙ্গ নেবেই। চিরকাল এমনটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু রাজেশের মেয়ের এ কি আচরণ! ব্যাপারটা মেটাবার জন্য গোত্রের সর্দার এবার এগিয়ে আসে। এক রাতে সর্দারের বাড়িতে রাজেশের ডাক পড়ে। সর্দার খুব নির্লিপ্ত গলায় বলে-‘রাজশ্যা, তুই তোর বেটিক পড়ালিখা শিখায় ম্যালা মেমসাহেব বানাইছোস। এইবার ক্ষ্যান্ত দে। তোকে দুই দিন সময় দিলাম বিয়াবাদির যোগাড় যন্ত্র করতে। দু’রাত পরই নিরেনের বেটার সাথ তোর বেটির শাদি হো যাবে যা।’ রাজেশ তো আকাশ থেকে পড়ে। মাত্র দু’রাত সময়! তাও আবার নিরেনের ছেলে, মানে একটা মাতালের সঙ্গে। এ জন্যেই কি সে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। রাজেশ কিছুতেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। ব্যাকুল হয়ে সে সর্দারকে অনুরোধ করে-‘তুমার পায়ে ধরি সর্দার এ কথা তুমি ফিরায় লাও। হামাক আর ক’টা দিন সময় দেও।’ অফিসের বাবুদের কাছে গল্প শুনেছে রাজেশ বড় লোকের ছেলেমেয়েরা নাকি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। উপযুক্ত পাত্র না পেলে রূপসীকে এমন কোথাও পাঠানোর চিন্তা আসে ওর মাথায়। কিন্তু সর্দার লোকটা আর কোনো কথাই শুনতে চায় না। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘এ রাজেশ্যা এত প্যাচাল পাড়িস না, যা ভাগ।’ ওর সঙ্গে থাকা লোকগুলোও অঙ্গভঙ্গি করে রাজেশকে তাচ্ছিল্য করে। রাজেশ কিচ্ছু করতে পারে না। দু’দিনের মধ্যেই অনেকটা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবার মতো করে ওরা মাতালটার সঙ্গে রূপসীর বিয়ে দিয়ে দেয়। নিজেদের গোত্রের মানুষদের এ অবিচার রাজেশ মেনে নিতে পারে না। মানুষটা আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়ায় আর সব ভার দিয়ে যায় ময়না রানীর কাঁধে। ময়না পালাতে পারে না জীবন থেকে। রাজেশের সংসারে আসা অবধি ময়না বুঝেছে মানুষটা অন্য ধাঁচের। গোত্রের আর দশটা চেনা পুরুষের মতো নয়। কঠিন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যেমন ঝিরিঝিরি ঝর্না বয়, রাজেশের ভেতরটা ছিল তেমন একগুঁয়ে মমতায় ভরা। মেয়েটা বাপের মতোই হয়েছে। তাই মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়াবাড়ি দেখে ময়না মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও মাঝেমধ্যে ওর নিজের মনেও উঁকি দিয়েছে স্বপ্ন। মেয়ে লেখাপড়া শিখছে হয়তো সত্যি জীবনের বাঁকে কিছু অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। কিন্তু রাজেশের মৃত্যুর পর নিজেকে গাছের শুকনো ঝরা পাতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না ও।
সাত দিনের মাথায় রূপসী স্বামীর ঘর ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসে। শুরু হয় আরেক জীবন। নিরেন নামের লোকটা হুমকি দিয়ে যায় মা-মেয়েকে একঘরে করে রাখার। রাতের অন্ধকারে ঘরের পাশে জোয়ান পুরুষদের আনাগোনা বাড়ে। ময়না রানী প্রমাদ গোনে। সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না।
এ দিকে দিন রাত ঘরে নিজেকে আটকে রাখে রূপসী। চটপটে প্রতিবাদী মেয়েটা কেমন যেন মিইয়ে যায়। বাপের মতো কিছু করে বসবে নাতো মেয়েটা! ময়না রানী ভয়ে কাঁটা হয়ে যায়। ভাগ্যের পরিহাসে বিশ বছরের সংসার জীবনে ময়নার আর কোনো ছেলেপুলে হয়নি। মেয়েটার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়েই ওদের সময়গুলো তরতর করে বয়ে গেছে একদিন। আজ আবারও মেয়ের মুখের দিকে এক প্রত্যাশা নিয়ে তাকায় ময়না রানী। রূপসীকে নিয়ে চলে যাবে ও দূরে কোথাও, অনেক দূরে। এখানে থাকলে বাঁচাতে পারবে না ও মেয়েটাকে। এতবড় দুনিয়ার কোথাও না কোথাও ঠিক জায়গা হয়ে যাবে ওদের মা-মেয়ের। কিন্তু রূপসীর চোখের দিকে তাকিয়ে সে অন্যকিছু দেখতে পায়। খুব অপরিচিত লাগে চিরচেনা মেয়েটাকে। দিনে দিনে পরিষ্কার হয়ে যায় ব্যাপারটা। রূপসী মা হতে চলেছে। খবরটা ময়নাকে হতবিহ্বল করে দেয়। আনন্দ-বেদনার মিশ্রণে বেচারার অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। ঘরে নতুন অতিথি আসছে, ব্যাপারটা আনন্দের। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ অনুভব করতে পারে না ময়না রানী। বরং অজানা এক অনিশ্চয়তা আচ্ছন্ন করে ফেলে ওকে। দিন গড়ায়। রূপসীর শরীরটা ময়নার চোখের সামনে বদলে যেতে থাকে একটু একটু করে। শারীরিক মানসিকভাবে মেয়েটাকে খুবই বিপর্যস্ত দেখায়। এ অবস্থায় রূপসীকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার ভাবনাটা তাই ময়নাকে বাদ দিতে হয়। রূপসীর শ্বশুর বাড়ির লোকজন কিংবা পাড়া পড়শীদের সাহায্য ছাড়াই মা-মেয়ের নিস্তরঙ্গ জীবন চলতে থাকে। তবে রাজেশের রেখে যাওয়া চাকরিটা স্ত্রী হিসেবে ময়না পায় বলে জীবনে খানিকটা গতি সঞ্চার হয়। তারপর আসে সে মাহেন্দ্রক্ষণ। মানব শিশুর ভূমিষ্ঠ হবার চিরচেনা অভিব্যক্তি। রূপসী ব্যাথায় কাতর হলে ময়না আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। নিজের মা হবার স্মৃতি হাতড়ায় সে। সুখময় স্মৃতিতে ভরা সে অনুভূতি। সেদিন পাশে ছিল পাড়াপড়শী মেয়েরা, ছিল রাজেশ। কিন্তু রূপসীর জীবনটা একেবারেই আলাদা। গোত্রের লোকেরা ওদের আলাদা করে রেখেছে, মেয়েটা স্বামীর আদর যত্ন থেকে একেবারে বঞ্চিত। ময়না বুঝতে পারে রূপসীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ও একা কিছুতেই কিছু করতে পারবে না। তাই একটা রিকশা-ভ্যানে মেয়েটাকে তুলে কাছের সরকারি মাতৃসদনে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসে সে। লম্বা বারান্দাওয়ালা একতলা একটা বাড়ি। বারান্দার একধারে ছোটো একটা ঘরে কাচের ফোকরের মধ্যে হাত গলিয়ে টিকিট কিনে রোগী ভর্তি হচ্ছে। দশ/বারো জন নারী পুরুষ কাচের জানালাটা ঘিরে জটলা করছে। রিকশা-ভ্যানে রূপসীকে বসিয়ে রেখেই ময়না দৌড়ে যায় জানালার কাছে। দু’হাত জোড় করে বলে- ‘বাবু আমার ম্যায়াটার ব্যাথা উঠছে, জলদি ওকে ভর্তি কইরে ল্যান।’
জানালায় ওধারে বসা লোকটা একটু ভ্রূ-কুঁচকে ময়নার দিকে তাকায় তারপর আবার অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। ময়না আবারও বলে- ‘বাবু একটু জলদি করেন।’ ‘হেই বেটি জলদি বললেই জলদি হয়।’জানালার ওধারে বসা লোকটা ধমক লাগায়। ময়না চুপসে যায় লোকটার ব্যবহারে। রূপসীর দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা কাতরাচ্ছে। ভ্যানওয়ালাও তাড়া দেয় যাত্রী নামিয়ে ভাড়া দিয়ে দেবার জন্য। ময়না রূপসীকে নিজের কাঁধে ভর দিয়ে ভ্যান থেকে নামিয়ে আনে। এর মধ্যেই ভ্যানওয়ালা লোকটা বিশ টাকা বেশি দাবি করে ময়নার কাছে। ওর কিছু করার থাকে না। বিশ টাকা বেশি দিয়েই সে ঝামেলা মেটাতে হয়। কিছুক্ষণ বাদে আর একটা ঘরে লোহার তৈরি একটা বিছানার ওপর রূপসীকে শুইয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়েটার প্রসব যন্ত্রণা লাঘবে কোনো ডাক্তারি প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় না। মেয়েটা ব্যথায় ছটপট করে। বেশ কিছুক্ষণ পর সাদা গাউন পরা এক মহিলা ওই ঘরে প্রবেশ করেন। সঙ্গে তিন/চার জন উঠতি বয়সের যুবক। ময়না দৌড়ে যায় মহিলার কাছে- ‘ডাক্তার আপা আমার ম্যায়াটার খুব কষ্ট হইছে। দয়া কইরে একটু তাড়াতাড়ি দেখেন।’ মহিলা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে যুবকদের দিকে তাকান। তাদের মধ্যে একজনকে বলতে শোনা যায়-‘ম্যাডাম, হরিজন পল্লীর রোগী।’
মহিলার চোখের ভাষা হঠাৎ পাল্টে যায়। তাদের নিজেদের মধ্যে কিছু কথা হয় তারপর মহিলা ঘর থেকে বের হয়ে যান। ময়না রানী কিছু বলতে গেলে এক যুবক ধমকে ওঠে- ‘সিজার করার টাকা দিতে পারবি বেটি? ডাক্তার ম্যাডামকে ডাকিস ক্যান। মেথরের ডেলিভারি ম্যাডাম করবোনি! আমরাই তোর ম্যায়ার ব্যবস্থা করছি দাঁড়া।’ যুবকের চোখ দুটো জুলজুল করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও ঘরের দরজাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ময়না রানী হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। বদ্ধ ঘরের ভেতর তখন রূপসীর শুরু হয়েছে অন্যরকম লড়াই। প্রসব যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে মেয়েটি তার শরীরের নিচের অংশে অনুভব করে ভিন্ন প্রকৃতির স্পর্শ। যুবকদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। তারা সেলফীতে ধারণ করে চলেছে, প্রকৃতির অতি গোপন ছন্দ। মেয়েটি ভুলে যায় তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা, অনাগত সন্তানের নিরাপত্তা কিংবা আর কিছু। মানুষের চরিত্রের পশুবৃত্তি ওকে এর আগেও দেখতে হয়েছে, কিন্তু এত কদর্যতা আগে কখনো দেখেনি। প্রসবব্যথায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন তার গা গুলিয়ে বমি উঠে আসার মতো অবস্থা হয়। ঘেমে ভিজে যাওয়া হাতে প্রাণপণে বিছানার চাদর শক্ত করে ধরে ওর শরীরের কাছে উপুড় হয়ে থাকা যুবকের দিকে লক্ষ করে একটা লাথি মারে রূপসী। তারপরেই ও জ্ঞান হারায়। ঝনঝন করে ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে মানুষের বিকট চিৎকার এবং শিশুর কান্না। মুহূর্তে মাতৃসদন বাড়িটির চারপাশে চাউর হয়ে যায় কথাটি- ‘খুন।’
মন্তব্য