উপকার
শেওড়াগাছের পাশে ছোট একটা পাতাবাহার গজিয়ে উঠলো। পাতাবাহারের বেশ নাক উঁচু। কচি কচি পাতা, যেন নাচছে। পাশের শেওড়াগাছকে এটা বললো, ‘তুমি এত কুৎসিত যে তোমার পাশে আমাকে মানায় না।’ শেওড়াগাছ বললো, ‘তা অবশ্য মিথ্যে বলোনি।’ দুপুরে রোদে পুড়ে যাচ্ছে পাতাবাহার। বিশাল শেওড়াগাছটা ছায়া দিয়ে রাখলো, যেভাবে বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েকে আগলে রাখে। পাতাবাহার ভাবলো এমনিতেই ছায়াটা তার ওপর এসে পড়েছে। রাতে ভীষণ ঝড় উঠলো। সব বাতাস যেন শেওড়াগাছের ওপর। ডাল ভেঙে পড়লো। কিন্তু পাতাবাহারের যে কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য ডালগুলোকে অন্যদিকে নিয়ে ফেললো। সকালে পাতাবাহার বলল, ‘কী ঝড়টাই না হলো, আর আমার কোনো ক্ষতি হয়নি।’
শেওড়াগাছ হাসলো।
খুনি
সন্ধ্যারাতে ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করলো লোকটা। খুন করার পর জানতে ইচ্ছে হলো কফিনের ভেতর সময় কাটানোটা কেমন! সে নিজে কবর খুঁড়লো। এরপর একটি কফিনের ভেতর শুয়ে পড়লো—ওপরের দিকে মুখ করে। আকাশে চাঁদ-তারা খেলছে। কিন্তু সে বুঝতে পারলো চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ভয়াল নিস্তব্ধতা। ঘুমন্ত সেই কবরের সুর আত্মস্থ করার চেষ্টা করলো সে। এর মধ্যেই এক সময় তার চোখ বেয়ে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম।
চোখ মেলতেই দেখলো অবাক সকাল। চমৎকার ঘুমের শেষে শরীরটা বেশ চাঙা লাগলো তার। ভাবলো, যাক, এবার তাহলে বাড়ি যাওয়া যায়। বাড়ি যাওয়ার পথে নদীতে গোসলটাও সেরে নিলো। উঠোনে ঢুকতেই লজ্জায় ঘোমটা টানলো তার বৌ। লোকটা বললো, ‘এ কি, ঘোমটা টানছ কেন?’
তার স্ত্রী বলল, ‘কে আপনি? কাকে চান? হুট করে বাড়ি ঢুকে পড়লেন যে!’
লোকটা বেশ অবাক। তার বৌ তাকে চিনতে পারছে না! সে জানতে চাইলো, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার স্বামী!’
‘ছিঃ! ছিঃ! আপনি আমার স্বামী হতে যাবেন কেন!’ তারপর তার স্ত্রী চিৎকার করে ডাকলো, ‘এই কে, কোথায় আছ! দেখো একটা লোক এসে কী সব বলছে!’
ডাক শুনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো খুনির মেয়ে ও বাবা। মেয়েকে দেখে খুনি লোকটা বললো, ‘দেখ তো, তোর মা কী সব বলছে!’
মেয়ে বলল, ‘এ কি, আপনি আমাকে তুই-তুকারি করছেন কেন!’
লোকটার এবার আর বিস্ময়ের সীমা থাকলো না। কপালে উঠলো চোখ। মেয়েকে বললো, ‘আমি তোর বাবা! বাবাকে চিনতে পারছিস না!’
‘বাবা! আপনি কেন আমার বাবা হতে যাবেন!’
শুনে একেবার হা হয়ে গেল লোকটার মুখ। এবার সে এগিয়ে গেলো তার বাবার দিকে। বলল, ‘বাবা, তুমিও কি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার ছেলে!’
বুড়ো চোখ গোল গোল করে বললো, ‘ছেলে! তুমি কেন আমার ছেলে হতে যাবে। যাও, এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের হও।’ বলে প্রায় এক রকম ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো।
এ রকম ব্যবহারের পর লোকটা যেন আকাশ থেকে পড়লো। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখলো, না ঠিকই আছে। ব্যথা লাগছে।
সে আবার কবরখানায় গেল। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কফিনটাকে দেখলো। ওটার মুখ হা করা। কবরের ভেতর কফিন খালি থাকে কি না—তার ঠিক জানা নেই।
বোকা লোকটা
এক গ্রামে এক বোকাসোকা লোক ছিল। বোকা বলে সবাই তাকে কথায়-কাজে ঠকাতো। একসময় অন্যরা ধরিয়ে দিতো যে, তোমাকে ঠকানো হয়েছে। বোকা লোকটা মন খারাপ করে বলতো, ‘আহা ঠকে গেলাম।’ তবে ওই গ্রামে ভালো মানুষের অভাব ছিল না। অন্যদের দেখে তাদের দুই-একজনও বোকা লোকটাকে নিয়ে রসিকতা করতো। একদিন তেমনই একজন লোক বোকা লোকটিকে বললো, ‘আমি তোকে এমন জিনিস দিতে পারি, যা পেলে তুই আশ্চর্য হয়ে যাবি।’
বোকাটা অবাক হয়ে বললো, ‘বলো কী! দাম কত?’
‘দাম খুব বেশি না। তোর কাছে আমি পাঁচ শতেই বেচে দেব।’
জিনিসটা কী বোকাটা জানতেও চাইলো না। ওই টাকাতেই রাজি হয়ে গেল। ওই লোকটা বললো, ‘তুই রাতে আসিস তবেই পাবি। রাতে ছাড়া এটা বিক্রি করতে পারব না।’
বোকাটা তাই করলো। রাতে গেল ওই লোকটার বাড়ি। লোকটা তাকে রাতের চাঁদ আর তারা দেখিয়ে বললো, ‘এগুলো দেখছিস? আজ থেকে এগুলো সব তোর। তুই যেখানে যাবি, এগুলো তোর সঙ্গে-সঙ্গে যাবে। কিন্তু শুধু রাতের বেলা। তবে মেঘলা রাতে নয়।’ বোকাটা দারুণ অবাক হলো। কথাটা সত্যি কি না, বোঝার জন্য একটু দৌড়ে মাঠের দিকে গেল। দেখলো, তাই তো, চাঁদ তারারা তার সঙ্গে-সঙ্গে আসছে। আবার একটু দূরে সরে দেখলো, না, ঠিকই তার মাথার ওপরে আছে। দৌড়ে আবার লোকটার কাছে গেল। বলল, ‘তুমি একদম ঠিক বলেছ। এই নাও পাঁচ শ টকা। আজ থেকে এই চাঁদ-তারারা তাহলে আমার হয়ে গেল।’
বাড়ি যেতে যেতে বারবার আকাশে তাকালো। একবার একটু পিছিয়ে, একবার একটু এগিয়ে দেখরো চাঁদ-তারারা তার সঙ্গেই হাঁটছে। বোকাটার আর আনন্দে সয় না। মনে মনে বললো, আমার মাথার ওপর দিয়ে যখন ঘোরে, যা-ই চাঁদ-তারাদের একবার নদী দেখিয়ে নিয়ে আসি।
একবার নদীতে, একবার মাঠে, এমনি করে অনেক সময় কাটল। ভাবলো যাক, এবার অন্তত ঠকিনি। ঘরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমালো। আর ঘুমানোর আগে ভাবলো সকালে গিয়ে ওই লোকটাকে একবার ধন্যবাদ দিয়ে আসতে হবে।
বোকাটা ঘুমালো ঠিকই, কিন্তু যে লোকটা তার সঙ্গে রসিকতা করেছে, সে সারারাত ঘুমাতে পারলো না। তার মনে বারবার একটা কথাই আসতে লাগলো, মোটেও সে ঠিক করেনি কাজটা। বোকাটাকে এভাবে ঠকানো মোটেও ঠিক হয়নি তার।
সকালে বোকা লোকটা তার কাছে ধন্যবাদ জানাতে এলো। সে বোকাটাকে রসিকতার কথা বুঝিয়ে বললো। কিন্তু বোকাটা বুঝতেই চাইরো না। বরং ভাবলো লোকটা তার সঙ্গে মশকরা করছে। আর এমন একজন লোক তাকে ঠকাতেই পারে না। তারপর সারাজীবনই বোকাটা ভাবলো আকাশের চাঁদ-তারা তার। আর বোকাটাকে দেখলেই ওই লোকটা আফসোস করতো!
দেশের উজ্জ্বলতা
এক রাজা ছোটদের রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। এক শিশু লিখলো, ‘এক ছিল এক রাজা। রাজার কিছু ছিল না। একটা গামছা ছিল। গামছা পরে রাজা মাছ ধরতে নদীতে নামলো।’
এক শিশু লিখলো—‘এক ছিল রাজা। রাজা শার্ট পরে বাজার করতে গেল।’
এক শিশু লিখলো—‘এক ছিল রাজা। রাজার মাথায় ছিল একটা শিং। না না, একটা না, তিনটা শিং। শিং দিয়ে সে শিশুদের ভয় দেখাতো।’
একজন লিখল—‘রাজা ছিল এক ছিচকে চোর। আমাদের বাড়ির থালাবাসন চুরি না করে ভাত-সবজি চুরি করে নিয়েছিল।’
একজন লিখল—‘এক বাড়িতে কাজ করতো রাজা। একদিন গরু চরাতে গিয়ে গরু হারিয়ে ফেলেছিল।’
এসব রচনা পড়ে রাগে রাজার মাথায় চুল দাঁড়িয়ে গেল।
মন্ত্রীদের বললেন, ‘এই বাচ্চাদের আমার দেশ থেকে বের করে দাও।’
রাজার কথা বলে কথা। সবাইকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। তারপর অনেক বছর কেটে গেল। পাশের দেশটি সবকিছু দিয়ে উন্নত হয়ে গেল, আর এই রাজার দেশের কোনো উন্নতিই হলো না। রাজা মন্ত্রীদের বললো, ‘আমার রাজ্যটা ভিখিরি হয়ে যাচ্ছে আর পাশের রাজ্যটা কী দারুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।’
মন্ত্রী বলল, ‘আমরাই তো আমাদের উজ্জ্বলতা আর ঐশ্বর্য ওদের দিয়ে দিয়েছি রাজা মশাই!’
রাজা চিৎকার করে বললেন, ‘কী বলছ এসব!’
‘আমরাই তো আমাদের শিশুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। তারাই ওই রাজ্য উজ্জ্বল ও উন্নতি করে তুলছে।’
এক পায়ের কাহিনী
এক পা অন্য পাকে বললো, ‘আমরা তো একে অন্যের প্রতি পুরোপুরি নির্ভরশীল।’
‘হুম’ বলে অন্য পা সম্মতি দিল। তখন অন্য পা প্রশ্ন করলো, ‘কিন্তু যারা এক পা হারিয়েছে, তাদের পৃথিবীটা কেমন?’
‘তাদের পৃথিবী সুরহীন গানের মতো।’