এক.
আড়িয়ালখার দুপাশের গ্রামগুলোর পেটের মধ্য দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। খোয়া বিছানো সে রাস্তা। প্রতিবছর রিপেয়ার করার পরও খোয়াগুলো বেরিয়ে আসে পিচ ঢালাইয়ের খোলস ছেড়ে। যেন ওরা বিদ্রোহ করছে বন্দি জীবনের বিরুদ্ধে। স্বাধীন, মুক্ত হয়ে থাকার ব্রত ওদের। সেই মুক্ত খোয়ার ছড়াছড়ি সদ্য রিপেয়ার করা রাস্তাজুড়ে। পথচারীদের দুর্ভোগ দেখে বুড়ো মানুষের ফোকলা মুখের মতোই হাসে যেন নড়বড়ে ভঙ্গুর রাস্তাটা। চেয়ারম্যানের লাভের কাছে সে হাসি বড়ই ম্লান দেখায়।
ক’টি ছোট-বড় পা সেই মুক্ত স্বাধীন খোয়াগুলোর ওপর দিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই। শৈশবের সে উদ্দাম ছোটায় আনন্দের বন্যা। ছুটতে ছুটতে পড়ে যায় নাইম রাস্তার ওপরে। রাব্বি টেনে তুলতে গিয়ে দেখে হাঁটু কেটে রক্ত পড়ছে ওর। ব্যথায় নাইমের মুখটা একটু বিকৃত হয়ে ওঠে। পরক্ষণে মুখ থেকে একগাদা থুথু নিয়ে হাঁটুতে লাগিয়েই দে’ ছুট। দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটা। রাব্বি আর নাইম জোরে দৌড় লাগায়, পোস্টার পেয়েছে একটা। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার পর নিলা কাঁদলেই দিয়ে দিতে হবে ওকে। নিলা নাইমের ছোট বোন। তাই আরও একটা পোস্টারের জন্য দৌঁড়াতে হচ্ছে নাইমকে।
মহিষ! মহিষ! মহিষ!
বিশাল মহিষ আনা হয়েছে সিলেট থেকে। যারা এই কোরবানিতে ব্যতিক্রম কিছু করতে চান, তাদের জন্যই এই আয়োজন। হ্যাঁ, ভাইসব, ঠিকই শুনছেন। দুটো মহিষ আনা হয়েছে বাবুরচরে। জবাই করা হবে কোরবানি ঈদের দিন। যারা ভাগে কোরবানি দিতে চান যোগাযোগ করুন জননেতা, জনদরদি চেয়ারম্যান কালাম চৌধুরীর সঙ্গে।
মহিষ! মহিষ! মহিষ!
পিকআপে করে মহিষ দুটোকে নিয়ে ধুলো উড়িয়ে, খোয়া ছিটিয়ে সারাগ্রাম, বাজার ঘুরছে কালাম চেয়ারম্যানের লোকেরা। পিকআপের পেছনে ছুটছে বাবুর চরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। পিকআপ থেকে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে পোস্টার। পোস্টার পাওয়ার লোভে ছুটে চলেছে ছেলেমেয়েগুলো। মহিষও এ গাঁয়ের লোকেরা দেখছে প্রথম। সবার মধ্যে একই আলোচনা এখন ‘মহিষ’।
আরও পড়ুন: দোপাটি ॥ ফরিদা ইয়াসমিন সুমি
কত দাম পড়বে এক-এক ভাগায়, কত মণ মাংস হবে, মহিষের মাংস কেমন হবে খেতে, এসব-ই বাজারে, দোকানে,পথ-ঘাটে আলোচনার বিষয়।
নাইম সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। অনেক কষ্টে আরও একটা পোস্টার ধরতে পারে নাইম। পোস্টার পেয়ে বাড়ির দিকে ঘুরে উল্টো দৌড় লাগায় ও। আকাশ তখন স্বেচ্ছায় কালো মেঘেদের দখলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দুই.
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। দুপুরের রোদ ঝুপ করে মেহগনি বাগানের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। মেঘের হাতে আকাশের দখল এখন। আসরের আজান হয়নি এখনো কিন্তু প্রকৃতি আজ অভিমান করেছে। সন্ধ্যা নামিয়ে দেবে এখনই। শুকনো কাপড় তুলতে ব্যস্ত গৃহিণী। নদীর চরের গরু বাছুরগুলো ঘরে তুলছে সবাই। এক-দুই ফোঁটা অভিমান ঝরে পড়তে শুরু করেছে, সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে হাওয়া।
বর্ষাকালের এ সময়টায় ঘন ঘন আকাশের মন খারাপ হয়। আড়িয়ালখা নদীর পাড়ে ইসমাইল শেখ তার পুরনো নৌকাটাতে আলকাতরা দিচ্ছে। দীর্ঘদিন নৌকাটাকে ডুবিয়ে রেখেছিল পানিতে। আজ তুলতে হলো। পাট কাটা শুরু হয়েছে। চান্দেরকান্দির চকে বর্গা নিয়েছে কিছু জমি ইসমাইল শেখ। নিজের কোনো জমিজিরেত নেই। বর্গা চাষি সে। চান্দেরকান্দির চকে গাঁয়ের শেষ মাথায়। সেখানে ফজলু শিকদারের জমি আছে অনেক। তার জমিই চাষ করে ইসমাইল। চক থেকে খাল বেয়ে পাট আনতে হয়, তাই নৌকার খুব প্রয়োজন। আসলে এ গাঁয়ে নৌকা ছাড়া বর্ষায় চলাই যায় না।
‘ও শেখের বেটা দেওয়া আইতাছে, আলকাতরা দেওন অয় নাই? বাড়ির ফিলা যাবানি?’
কাশেম মিয়ার কথায় নৌকা থেকে চোখ তুলে তাকায় ইসমাইল শেখ।
—আর কইয়েন না কাকা, ছাওয়াল দুইডারে কইলাম গাঙ্গে আইবার, কুনো খবরই নাই। একলা একলা নাও উডান যায় কন দেহি কাকা। অর্ধেক নায়ে দিবার-ই পারলাম না আলকাতরা, দেওয়াও আইসা গেল দেহেন, কী যে হরি এহন!
—নাও উডাইছো, মাছ পাও নাই? কাডা তো দিছালা ভালোই নাওয়ে।
—হ, মাছ পাইছি কয়ডা। মানুষ নাই, নাও টান দিওয়ার হাতেই মাছ লাফাইয়া গেছে। ইচা মাছ পাইছি কয়ডা আর ফুডি ট্যাংরা। এডা আইড় মাছও পাইছি বিঘাত দুই অবে। ছাওয়াল দুইডা থাকলে মাছে পাইলা ভইরা যাইতো। কুতায় কুতায় যে খেলবার যায়! আরে…দেওয়া দেহি আইসাই গেলো!
—হ। আকাশের ভাব ভালো না। তুফান অবে মনে অয়। আসো বাড়িত যাই। আর এহনকার পুলাপানের কতা আর কইয়ো না। কাম রে যে কী ডরান ডরায়! নও নও অইছে, তাগাদা, দৌড় দেও।
ইসমাইল শেখ আলকাতরা মাখা হাতে তালি দেওয়া স্যান্ডেল জোড়া, কাঁচি, গামছায় বাঁধা মাছ নিয়ে কাশেম মিয়ার পেছনে দৌড় দেয়।
তিন.
টিনের চালে পাটকাঠির বেড়া। ঘরের পেছনের বেড়া পচে গেছে প্রায়। গতবছর বর্ষায় ঘরের সব বেড়া বদলেছিল ইসমাইল শেখ। গতবছর ঘরের সঙ্গে দিয়েছে একটা বারান্দাও। সব বেড়া ভালো থাকলেও পেছনের বেড়াটা ৬ মাসেই নষ্ট হয়ে যায়। ঘরের চালাটা ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। মিস্ত্রি ভুল করে এমনভাবে পেছনের চালাটা দিয়েছে যে বৃষ্টি হলেই চালের সব পানি চুইয়ে বেড়ার গা বেয়ে পড়ে। এ এক অশান্তি। পানি পেয়ে পাটকাঠির বেড়া পচে যায় খুব দ্রুত, সঙ্গে উইপোকার অত্যাচার তো আছেই।
বারান্দার একপাশে মাচা পাতা। সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা। মাচার নিচে ভাতের পাতিল, কড়াই, পানির জগ, থালাবাসন, খেজুরের পাটিটা মুড়িয়ে রাখা। মাচার ওপরে আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, রসুন, মশলা বাঁটার থালা, বটি ইত্যাদি। অন্যপাশে একটা চৌকি আর একটা পড়ার টেবিল। পড়ার টেবিলে নাইম আর মামুনের পড়ার বই সাজানো। মামুন অষ্টম আর নাইম পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একটা ক্যালকুলেটর, দুজনের একটা জ্যামিতি বক্স, একটা কলমদানি আর তাতে কয়েকটা কলম। বিছানার ওপরের দিকে টিনের চালের সঙ্গে বোতলের নানা রঙের ছিপি দিয়ে বানানো ফুল ঝুলছে। মামুন আর নাইম জমিয়েছিল লাল, নিল, সবুজ এই বোতলের ছিপি। মনিকা ছেলেদের আবদার রাখতে বানিয়ে দিয়েছিল এই ফুল।
ঘরের ভেতরে একপাশে একটা চৌকি। তাতে তোষক মোড়ানো, মশারির দুই কোণা খুলে একদিকে চাপিয়ে রাখা। জামাকাপড় রাখার একটা আলনা। একটা বড় ট্রাংক। পাল্লাভাঙা একটা পুরনো শোকেস। তাতে সাজানো রয়েছে ছেলেদের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া কাচের কতগুলো প্লেট, ফুটবল, ক্রিকেট খেলায় পাওয়া কতগুলো ক্রেস্ট, কাপ। ঘরের অন্যপাশে ফাঁকা একটা চৌকি। সেখানে জমির পাট, ধান, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর যখন যতটুকু হয় রেখে দেয় ইসমাইল শেখ।
আরও পড়ুন: আঠারো কলার একটি ॥ জগদীশ গুপ্ত
বাড়ির পাশে বাঁশের ঝোপ। বাঁশের ঝোপের পাশে গরুর ঘর। পাটকাঠির বেড়া, পাটকাঠির চাল। নিজের ঘরে ইট না থাকলেও গরুর ঘরের মেঝেতে বিছিয়ে দিয়েছে ইট। বড় মশারি দিয়ে ঘরের চারপাশ আটকে দিয়েছে ইসমাইল, যেন গরুকে মশার কামড় সহ্য করতে না হয়।
চার.
কাক ভেজা হয়ে দৌড়ে ঘরে ফেরে ইসমাইল শেখ। মাছভর্তি গামছাটা এগিয়ে দেয় মনিকার দিকে। গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ছেলেদের কথা জানতে চায়।
—জমিদারের বাচ্চা দুই জন কুতায়? ঘরে ঘুমায়নি??
—নাইম তো আইলো কেবল, নিলারে নিয়া কী পোস্টার দেহে জানি, মইষের ছবি, মইষের আবার গলায় মালা দিওয়া। পাশে চেয়ারম্যানও ছবি, তার গলায় ও মালা। ও মামুনের বাপ! নাইম কী কী জানি কইলো…মইষ আইছে বলে গেরামে? চেয়ারম্যান মইষ জবো দেবে? হাচানি?
—অ, নাইম তাইলে মইষের পিকাপের পাছ পাছ দৌড়াইছে! আমি যে কামে যাইবার কইলাম, তা কানে যায় নাই তোমার ছাওয়ালের? বড়োজন কুন গেরামে গেছে?
—আমি কিছু জানিনি? আমারে তোমার ছাওয়ালরা মা বইলা কত দাম দেয় জানি!
মইষের কতা হাচাইনি? কওনা ক্যা কিছু?
—হুনি তো তাই। তয় মইষ ভাগে কোরবানি দেওয়ার কতা মাইকিং করলো হুনলাম। ভালোই হবে। এই গেরামের মানুষ মইষের গোস্ত খাওয়া পারব।
—আমাগো বাছুরডারে খাবার দিছনি?
—ফ্যান কুঁড়া মিশাইয়া দিছি। আমাগো গরু হাডে নিবা কবে? কোরবানি আর কয়দিন আছে?
—শুক্কুরি শুক্কুরি আষ্ট…শনি…রবি…দশদিন আছে। সোমবারে কোরবানি।
—কাইল তো মালিগার হাট…গরু নিবানি?
—ভাবছালাম তো নেবো…তয় ফজলু শিকদার আরব দেশের তা পরশুদিন আইছে। আইজ দেহা তার হাতে, কইলো তো গরু হাটে নিও না দাম যা নেওয়ার নিও। কাইল আইবার পারে গরু দেখবার।
বাবুরচরে বর্গা চাষি ইসমাইল শেখ। ১৭ বছর আগে এ গ্রামে আসে, বিয়ে করে বাবা-মামরা মনিকাকে। মনিকার বাপের ভিটায় থেকে যায় ইসমাইল। দুই ছেলে এক মেয়ে ইসমাইল আর মনিকার। কষ্ট করে, গায়ে খেটে খায় ওরা। ইসমাইলের সঙ্গে মনিকাও রাত দিন চকে, বাড়িতে খাটে। ছেলে দুইটারে স্কুলে দিছে। ওরা চায় না ছেলে দুইটাও ওদের মতো কষ্ট করে, মানুষের ক্ষেতে কামলা খেটে জীবন কাটাক।
এবার গ্রামের সমিতি থেকে লোন নিয়ে গরু কিনেছিল ৬ মাস আগে ইসমাইল। কোরবানি পর্যন্ত ভালো করে যত্ন করলে বেশ দাম পাওয়া যাবে ভেবে। মনিকার কাজও বেড়ে গিয়েছিল অনেক। গরুর ভূষি, কুঁড়া রান্না করা, চক থেকে ঘাস আনা, নদী থেকে কচুরি এনে গরুকে দেওয়া। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যেতো মনিকা। এত খাটনি সহ্য হয় না ওর। তবু কেমন জানি মায়া জন্মেছে গরুটার প্রতি। মামুন তো গরুর সঙ্গে কথা বলতে থাকে, গোসল করায় গরুকে নদীতে নিয়ে। গরুটা মামুনকে কিছু বলে না।
আজ গরুটাকে কোরবানির জন্য বিক্রি করার আলোচনা করতে গিয়ে মনিকা, ইসমাইল দুজনেই ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে।
পাঁচ.
ফজরের আজান দিলে নামাজের জন্য মনিকাকে ডেকে তুলে মসজিদে চলে যায় ইসমাইল। মসজিদে আজ নামাজের পর হট্টগোল খুব। মসজিদে কে বেশি দান করে, কার মূল্য কতটুকু এটাই আলোচনার বিষয়।
বাবুরচরের এই মসজিদের বয়স দুই বছর। এলাকার ধর্মপ্রাণ কয়েকজন নিজেদের উদ্যোগে তৈরি করে এই মসজিদ। এখানে ওয়াক্তের নামাজ পড়া হলেও ঈদের নামাজ পড়া হয় পশ্চিমপাড়ার পুরনো মসজিদে। ওটাই বাবুরচরের ঈদগাহ। কিন্তু ফজলু শিকদার এবার বেঁকে বসেছে, মিটিং ডেকেছে ঈদের নামাজ কোথায় পড়া হবে, তা নিয়ে! ফজলু শিকদারের মতে বাবুরচরের চরকান্দার মানুষ এতদিন পশ্চিমপাড়ার ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাইতো। কারণ এ পাড়ায় মসজিদ ছিল না। কিন্তু এখন যখন মসজিদ হয়েছে তখন ঈদের নামাজ এখানেই হবে। আরব থেকে এসেই মসজিদের জন্য চারটা ফ্যান কিনে দিয়েছে ফজলু শিকদার। তাই তার ওপর কথা বলার সাহস কেউ দেখাচ্ছে না। সবাই ফিসফাস করছে। কেউ বলছে ফজলু ঠিকই বলছে, কেউ বলছে না না এটা করা ঠিক হবে না।
তরিকুল, এ যুগের ছেলে, শিক্ষিত। এই গ্রামের এক শিক্ষকের ছেলে। বললো, ‘আমরা এ বাবুরচরের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে পশ্চিমপাড়ার ঈদগাহে নামাজ পড়ি ঈদের। বছরের অন্য সময়টা যেকোনো মসজিদে নামাজ পড়াটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ঈদে সারাগ্রামের মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়ার আনন্দই আলাদা। তাই ঈদের নামাজ আমরা ঈদগাহেই পড়ব।’
তরিকুলের কথায় বেশিরভাগ মানুষ রাজি। সবাই বলছে তরিকুল ঠিক বলছে, একদম ঠিক। ফজলু শেখ জানিয়ে দিলো যারা পশ্চিমপাড়া মসজিদে নামাজ পড়তে যাবে তাদের কোরবানির মাংস আলাদা হবে, আমরা আলাদা কোরবানি দেব। আর তাদের মাংস আমরা খাব না। শোনো সবাই, ঈদের দিন ওই মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে সারাবছর যেন ও পাড়ায় যায় তারা। এই মসজিদে তাদের কোনো জায়গা নেই।
এমন কথার পর শুরু হলো হট্টগোল। চিৎকার চেঁচামেচিতে অমীমাংসিত রয়ে গেলো বিষয়টা।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে যে যার কাজে চলে গেলো। ইসমাইলের কিছুই ভালো লাগছে না। ঈদ, নামাজ, কোরবানি নিয়ে ঝগড়া তার পছন্দ নয়। অশিক্ষিত হলেও এটুকু বোঝে ইসমাইল, কোরবানি নিয়ে প্রতিযোগিতা, মাংস নিয়ে রেষারেষি ইসলাম সমর্থন করে না। কোরবানির মাংসে প্রতিবেশীর হক আছে। সেখানে অন্য মসজিদে নামাজ পড়লে কোরবানির মাংস থেকে বঞ্চিত হবে, এমন চিন্তা করাটা পাপ।
ইসমাইল বাড়ি এসে মনিকাকে খাবার দিতে বলে। চকে যাবে পাট কাটতে। মনিকা মাটির বাসনে পান্তা ভাত আর গতকালের নৌকা থেকে পাওয়া মাছ ভাজা সামনে দেয় ইসমাইল শেকের। কাঁচা মরিচে লবণ লাগিয়ে কামড় দিতে দিতে ইসমাইল মনিকাকে বলে, তোমার ছাওয়ালগো তো আইজ স্কুল নাই। শুক্কুরবার। আমার হাতে চকে যাবার কও। কোন জাগা এডা কিষ্যাণ পাইলাম না। বারেক ভাইরে কইলাম আইজ আমাগো পাট কাটার কিষ্যাণ দাও, হে কয় ৭০০ টাহা লাগবে, আর একদিন কিষ্যাণ দিলে তো অবে না। তাই তারে না কইয়া দিছি। ৫ কাডা ভুইর পাট কাটবার গেলে যদি কিষ্যাণরে এত টাহা দেই তাইলে মালিকরে কী দেব আর আমরাই কী রাখব? পাটে এহনই হাটু পানি…পাট এহন না কাটলে ঝামেলায় পড়ব।
আরও পড়ুন: রাত্রির রোমান্স ॥ মনোজ বসু
—ওরা পুলাপান মানুষ, পাট কাটবার পারবে? কুনদিন করছে এমন কাম?
—তাইলে আমি এহন কি হরব? আমি এই সব কাম কাগো জন্য হরি? একলা খাই আমি?
এরপর বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
এইবারই শ্যাষ…আর কারও জমি বর্গা নেব না। মালাই বেঁচব আর নয় কাটা কাপড়ের গাট্টি নিয়া গেরামে গেরামে ফেরি হরব। আর আমার সহ্য অয় না। গতরে আর কুলায়না।
খাবার প্লেট ফেলে উঠেপড়ে ইসমাইল। মনিকা অবাক হয়, কী এমন বলেছে সে বুঝতে পারে না। ভাতের প্লেট রেখে উঠে পড়তে ইসমাইলকে সে এই ১৭ বছরে একদিনের জন্যও দেখে নাই। ভাবনায় পড়ে যায় মনিকা। মামুন আর নাইমকে অনেক বুঝিয়ে চকে পাঠিয়ে দেয়।
ছয়.
মনিকা কাজ করতে থাকে বাড়ি কিন্তু তার মন নেই কাজে আজ। ইসমাইলের কিছু একটা হয়েছে। না হলে এমন আচরণ করতো না কিছুতেই।
ফজলু শিকদার গরু দেখে গেছে। কোনো দাম বলেনি, হাঁটে নিতেও নিষেধ করেছে গরু। বলেছে যা দেওয়ার দেব আমি। তোমরা গরিব মানুষ তোমাদের ঠকাবো না আমি। কিন্তু মনিকা এতে একটুও খুশি হয়নি। দাম তো বলবে একটা। পছন্দ না হলে ইসমাইল হাটে নিয়ে বেচে আসবে। সবাই তো বলে এই গরু আশি-নব্বই হাজার দামে বিকোবে। ৬ মাস আগে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিল গরুটা। ৬ মাসে এর পেছনে খরচও তো কম হয়নি ওদের। আর খাটুনি তো আছেই। কত আশা নিয়ে এই গরু কিনেছে, লোন তুলে। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে দিতে জীবনের কিছু নেই আর ওদের। খাবার না জোগাড় করে কিস্তির টাকা গুছিয়ে রাখতে হয়েছে। এখনো চলছে কিস্তি। গরুটা ভালো দামে বিক্রি করতে পারলে ইসমাইল মনিকাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেবে বলেছে, ছোট একটা বাছুর কিনবে পরের কোরবানির জন্য। ছোট ছোট কত স্বপ্ন দেখেছে ওরা।
গামছায় করে আটার গরম গরম রুটি, বাটিতে করে তালের ঝোলা গুড়, একজগ পানি আর সিলভারের একটা গ্লাস নিয়ে ক্ষেতের দিকে এগুতে থাকে মনিকা।
ইসমাইল আর মামুন পাট কাটছে, নাইম আঁটি বাঁধছে পাটের। বাঁধা হয়ে গেলে আঁটি ধরে নিয়ে জড়ো করছে এক জায়গায়।
সাত.
কোরবানির ছুটি পড়ে গেছে স্কুলগুলোতে। পশ্চিমপাড়ার ঈদগাহের পাশেই চেয়ারম্যানের বাড়ি। শয়ে শয়ে লোক প্রতিদিন মহিষ দেখতে জড়ো হয় সেখানে। ফজলু শিকদারের কথা শুনেছে চেয়ারম্যান। ক্ষেপেছে সে খুব। একটা মহিষ সে একাই কোরবানি দেবে। অন্যটাতেও শেয়ার আছে তার। সেও ঘোষণা দিয়েছে বাবুর চরের ঐতিহ্য এই ঈদগাহ। এখানে ঈদের নামাজ না পড়ে যারা রাজনীতি করবে, তাদের ঘরে পশ্চিমপাড়া থেকে কোনো কোরবানির মাংস যাবে না।
বছরের পর বছর ধরে এ গাঁয়ে যতগুলো কোরবানির পশু হয়, সব এক জায়গায় জবাই করা হয়, সবার মাংস একসঙ্গে মিলিয়ে গ্রামের প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। এবার ক্ষমতা আর টাকার লড়াইয়ে পড়ে দুই ভাগ হয়ে গেলো গ্রাম।
মহিষের মাংস খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে প্রায় সবাই। কিন্তু বাবুরচরের চরকান্দার লোক পশ্চিমপাড়ায় নামাজ পড়তে গেলে ফজলু শেখের রাগের কবলে পড়তে হবে। কোরবানির ঈদ তাই এবার সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিছে।
নাইম ওসব বোঝে না। স্কুল বন্ধ। সারাদিন সে চেয়ারম্যান বাড়িতে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে নিলাকে নিয়ে যায় মহিষ দেখাতে। খুব আনন্দ পায় মহিষের জন্য কাঁচা ঘাস আনতে, মোটর ছেড়ে পাইপের পানি দিয়ে মহিষকে গোসল করায় চেয়ারম্যানের কাজের লোক, নাইম মহিষের গা ঘষে দেয়।
নাইম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মহিষ কিভাব চিবিয়ে চিবিয়ে ঘাস খায়। রাতে শুয়ে শুয়ে মার কাছে সেসব গল্প করে নাইম। ইসমাইল শেক ছেলের গল্প শোনে আর তার চোখ বেয়ে পিতৃত্বের দায় ঝরে পড়ে।
গতকাল এসে ফজলু শেক শাসিয়ে দিয়ে গেছে ইসমাইলকে। নাইম যে চেয়ারম্যান বাড়ি পড়ে থাকে সে খবর তাদের কাছে আছে। ফিরিয়ে আনতে বলে গেছে নাইমকে। এখানে ইসমাইল শেক ঘরজামাই তা শোনাতেও বাঁধেনি ওদের, ইসমাইলদের এখান থেকে তাড়াতে ফজলু শিকদারের একটা ইশারাই যথেষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে কথায় কথায়।
আরও পড়ুন: দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের অলিখিত জীবনী ॥ অথির চক্রবর্তী
গরুর জন্য ৬০ হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছে ইসমাইলের হাতে। কিছু বলার আগেই থামিয়ে দিয়েছে ইসমাইলকে ফজলু শিকদারের লোকজনেরা। বুঝিয়ে দিয়েছে ঘরজামাই হয়ে এতদিন এদের দয়াতেই বেঁচে আছে তারা।
আট.
চরকান্দা মসজিদের আজান শোনা যাচ্ছে। একটু একটু করে ফর্সা হয়ে আসছে চারপাশ। বাজি ফাটাচ্ছে এত ভোর থেকেই কেউ কেউ। ইসমাইলের খুব জ্বর এসেছে রাত থেকে। শুয়ে আছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে।
নাইম আর মনিকার কথাগুলো বুকের মধ্যে এসে লাগছে যেন।
-মা, এই ঈদে তো জামা কিনা দেওনা । নতুন জামা ছাড়া তো ঈদ হয় না মা, চেয়ারম্যান কাকার ছাওয়াল কইছে।
-কেডা কইছে তোরে? ও তো ছোড মানুষ। ও জানে না কিছু। এইডা কোরবানির ঈদ, কোরবানি দিতে অয়, গোস্ত রানতি অয়।
-আমাগো কোরবানি দেও না ক্যান মা তাইলে? আমাগো গরু আমরা কোরবানি না দিয়া ফজলু কাকারা কোরবানি দেবে ক্যান মা? ও মা…চুপ কইরা রইলা ক্যান? ও মা।
দুই দুইবার খবর পাঠিয়েছে চেয়ারম্যানের লোকেরা, পাঠিয়েছে ফজলু শিকদার। মাংস আনতে যেতে বলেছে। জ্বর বলে কোথাও ঈদের নামাজ পড়তে যায়নি ইসমাইল। কিন্তু মাংস আনতে তাকে যেতে হবে যেকোনো এক জায়গায় সন্তানদের দিকে তাকিয়ে। কোথায় যাবে সে? নাইমের কথা ভেবে মহিষের মাংস আনবে? না তার নিজের গরু কোরবানি হয়েছে ফজলু শিকদারের বাড়ি, সেখানে যাবে? কিছুই ভাবতে পারেনা ইসমাইল। জ্বর বাড়তে থাকে, মাথা ঝিমঝিম করে।