অনেক দিন বাড়ি ফেরেনি রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, ভর্তি পরীক্ষা ও ভর্তি—সব মিলিয়ে সে এতদিন বাড়ি ফেরার সময়ও পায়নি। কিন্তু ক্লাস শুরু হতে না হতেই ছুটি হয়ে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয় কী, তাও বুঝে উঠতে পারলো না সে। তাই মন কেমন করছিল!
বাড়ির গলির সামনে রিকশা থেকে নামতেই মন কেমন করাটা কেটে গেলো। রাস্তায় পরিচিত মানুষরা জানতে চাইলো, কেমন আছ? কতদিন থাকবে, জিজ্ঞেস করছে। বাড়ির গেট আটকানো। তবে বাইরে থেকে গেট খোলার কায়দা ওর জানা। টিনশেড বাড়ি ওদের। অনেকটা ইউ শেফের মতো। গলিটার ওধারে আরও একটা বাড়ি আছে রিয়াদের। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথমে ওই বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়। পরে আবার ওদের ইউ শেফের এক মাথার দুটি রুমও ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাকি চার রুমে থাকে নিজেরা থাকে।
গেট খুলতেই রিয়া দেখে, ওদের ভাড়াটিয়ার বাচ্চারা উঠোনে খেলছে। ওর অবর্তমানে উঠোনটা যেন আরও সুন্দর হয়েছে। বেলী ফুলের গন্ধে ওর মনটা ভালো হয়ে গেলো। ওকে দেখে বাচ্চা দুটো দৌড়ে এলো। ওরা দুজন রিয়ার খুব প্রিয়। দুজনের জন্মই এই বাড়িতে।
ওদের দেখে দ্বিগুণ হয়ে গেলো ভালো লাগাটা। পাঁচ বছরের বাচ্চা আনন এসে জানতে চাইলো, এতদিন পর আন্টি তার জন্য কী নিয়ে এসেছে? তাদের জন্য আনা চকলেটগুলো দিয়ে সে ঘরে ঢুকে গেলো। জানলা দিয়ে বললো, ‘আন্টি আগে ফ্রেশ হয়ে নেই। তারপর তোদের আদর করবো।’ কে শোনে কার কথা, এর মধ্যে দুই বছরের বাচ্চা নয়ন এসে কিছুক্ষণ পরপর ‘আন্নি আন্নি’ বলে দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছে।
রিয়া বুঝতে পারছে ঘরবন্দি থাকার করোনাকালে মায়ের এই নির্দেশটা মানা যাবে না!
মা টেলিভিশন দেখছিলেন। রিয়াকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন, ‘তুই আসবি আগে জানাবি না? আমরা তো মাত্র খাওয়া শেষ করলাম। তুই কী খাইবি?’
রিয়া নির্বিকার। ও জানে মায়ের হাতে জাদু আছে। সে গোসলের প্রস্তুতি নিতে নিতে টেলিভিশনে চোখ রাখে। বাচ্চা দুটো বাইরে থেকে ‘আন্নি, আন্নি’ বলে ডেকেই যাচ্ছে।
‘দাঁড়া, গোসল সেরে তোদের ডেকে নেবো’ বলে চোখ রাখে টেলিভিশনে। দেখে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন মারাও গেছে। খবর পাঠিকা বলছেন, বয়স্ক, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের মতো বিভিন্ন জটিলতায় আক্রান্ত রোগীদের করোনায় মৃত্যু ঝুঁকি বেশি৷
কিচেন থেকে মা কেমন যেন আর্তনাদের মতো করে ডাকলেন। ছুটে গিয়ে দেখে মা নোংরা মেঝেতে বসে হাঁফাচ্ছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর মায়ের শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয়েছে। মাকে মেঝে থেকে টেনে তুলে বিছানায় নিয়ে আসতে আসতে রিয়ার মনে হলো বাইরের মায়া ছাড়াতে হবে। সব কিছুর আগে তার মাকে বাঁচাতে হবে।
মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফ্যানটা চালিয়ে দেয়। তখনো বাচ্চা দুটো করুণ সুরে ‘আন্নি, আন্নি’ বলে দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। মা ইশারায় দরজা খুলে দিতে বলছেন। রিয়া বুঝতে পারছে, ঘরবন্দি থাকার করোনাকালে মায়ের এই নির্দেশটা মানা যাবে না!