সত্যি বলতে কী, আমি ভীষণ চমকে গেছিলাম। আমার মধ্যে এমন অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হয়েছিল যে, মাথা কাজ করছিল না, ভাবনাগুলো কেমন ইয়ারফোনের তারের মতো তালগোল পাকিয়ে গেছিল। অনুভূতিটার সঙ্গে আমার কোনো পূর্বপরিচয় ছিল না। তবে হ্যাঁ, সেটাতে বিস্ময় ছিল, ভয় ছিল, আর ছিল ঘৃণা। এই তিন মিশ্র অনুভূতির ধাক্কা সামলে নিয়ে যখন আমি মহিলাটিকে আবার খুঁজছি, তখন লক্ষ করলাম, সে তার শনের মতো পাকাচুল ভর্তি মাথা দোলাতে দোলাতে, লাঠিতে ঠকঠক শব্দ তুলে এগিয়ে গেছে অনেকটা দূর।
তখন বেলা পড়ে এসেছে অনেকটা। বুড়ো বটগাছটার ছায়া দীর্ঘতর হতে হতে পাশের পানাপুকুরটাকে প্রায় গিলে ফেলেছে। সূর্য ডিমের কুসুম হয়ে নেমে পড়েছে দিগন্ত বরাবর। তার একপাশে একফালি নতুন চাঁদ ফ্যাকাশে মুখ বাড়িয়েছে। আমার ঘরে ফেরার তাড়া ছিল। বাড়িতে তখন আমার দেড় বছরের ছেলেটা অপেক্ষায়, বিছানায় অপেক্ষারত আমার পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা, মানসিক ভারসাম্যহীন একমাত্র ছোট ভাই, আর আমাদের সংসারের কাজে সাহায্য করার জন্য একমাত্র মানুষ মাফু।
ছেলেটা বুকের দুধ ছাড়েনি তখনো। সারাদিনে তাকে দুধ দিতে না পারার যন্ত্রণায় তখন টনটন করছে মাতৃভারে টইটুম্বুর আমার দুই স্তন। তার কচি, মিষ্টি মুখটায় মাতৃত্বের দাগ এঁকে দিতে উন্মুখ, অধীর তখন আমার মন। কিন্তু আমার মধ্যে যেন কোনো অপদেবতা ভর করলো হঠাৎ। আমি বেপরোয়া হয়ে পিছু নিলাম অপরিচিত, অদ্ভুত ওই মহিলার। আমার মধ্যে তখন বিস্ময়, ভয়, আর ঘৃণার সঙ্গে আরও একটা অনুভূতি এসে যোগ দিয়েছে, তার নাম কৌতূহল। মানবজীবনে এই কৌতূহলের চেয়ে মারাত্মক বস্তু বোধ করি আর কিছু নেই। ব্যাপারটার পর থেকে তেমনটাই ভাবি আমি।
মহিলাটি খুব দ্রুতলয়ে হাঁটছিল তেমন নয়। বরং খুবই শ্লথ, মন্থর ছিল তার গতি। বয়সজনিত কারণ আর শারীরিক অসুস্থতা তার দ্রুতগতি রোধ করেছিল, সম্ভবত। তবু আমার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল সে। আরেকটু হলে তাকে হারিয়েই ফেলেছিলাম বলা যায়। কারণ তাকে দেখে আমি এতটাই বিস্মিত আর ভীত হয়েছিলাম যে, কী করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না সেই মুহূর্তে। সেই সঙ্গে হঠাৎ গা গুলিয়ে ওঠার মতো এক অনুভূতি, সহজ করে সেটাকে ঘৃণাই বলা যায়, হতচকিত করে দিয়েছিল আমাকে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করছিলাম। নিজের ভেতর হঠাৎ এমন বিচিত্র বোধের দেখা পেয়ে যারপরনাই হতবাক আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, আসলে কী বলতে চাইছে আমার মন, শরীরেরই বা কী সুপারিশ। এই প্রথমবার, এই-ই প্রথমবার আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, মন আর শরীর সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বস্তু! দুই জন দুই রকম নির্দেশ দিয়ে সম্পূর্ণ দ্বিধাগ্রস্ত, এলোমেলো করে দিলো আমাকে। না, ভুল বলেছি। আগেও এমন হয়েছিল। আরও একবার এমন দ্বিধাগ্রস্ত, বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। সেবার শরীর না কি মন, কার নির্দেশ গ্রাহ্য করবো, ভাবতে ভাবতেই নাটাই ছিঁড়ে ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে উড়ে গিয়েছিল আমার নাগালের বাইরে। এবার তাই আরও বেশি বিপর্যস্ততায় আমি ভেবে চলছিলাম কার নির্দেশ মানবো। সেইসঙ্গে তীব্র এক কৌতূহল আমার মনের মধ্যে ডালপালা মেলছিল, খোঁচাচ্ছিল, অস্থির করে তুলছিল আমাকে। শরীর বলছিল, যেও না। সে নিজের আয়েশ খুঁজছিল। বিশ্রাম চাইছিল। তাছাড়া দুগ্ধভারে অসহ্য যন্ত্রণাও পোহাতে হচ্ছিল তাকে। অন্যদিকে, চমকে লক্ষ করলাম, মন কখন দুই টুকরো হয়ে গেছে আমার! একটুকরো শরীরের সঙ্গে যোগসাজসে আমাকে প্রলুব্ধ করতে চাইছে ফিরে যেতে, যেখানে অপেক্ষা করছে আমার শিশুসন্তান, আমার পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা, মানসিকভাবে অসুস্থ আমার ছোটভাই আর কাজের মেয়ে মাফু—আমার প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় পিছুটান। এই টুকরোটায় আছে ভয় আর ঘৃণা। ভয়ের উল্টো পিঠে যে ঘৃণা থাকে, সেটা আজকের আগে এমন করে উপলব্ধি করিনি কোনোদিন। হঠাৎ মনে হলো ভয় আর ঘৃণা মূলত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ভয় থেকেই ঘৃণার উৎপত্তি। ঘৃণা থেকেই ভয়ের জন্ম। এমতাবস্থায়, মস্তিষ্ক জটিল এক পরিস্থিতিতে পড়ে সাংঘর্ষিক সব নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। ভয় আর ঘৃণাতাড়িত হয়ে, সেই সঙ্গে শরীরের চাহিদা বুঝে সে নির্দেশ দিচ্ছিল ফিরে যেতে। অন্যদিকে, মনের অন্য যে টুকরো, সেই মুহূর্তে যার অস্তিত্ব বহুদিন বাদে টের পাচ্ছিলাম, সে আমাকে বলছিল এগিয়ে যেতে। অদ্ভুত ওই মহিলার পিছু নিতে। এই টুকরোটায় ছিল বিস্ময়, ছিল বিস্ময়কে জয় করার অদম্য কৌতূহল। শরীর আর নিজেরই মনের দ্বিধাবিভক্ত রূপে মস্তিষ্কের কোন নির্দেশটি মানবো, সে-কথা ভাবতে ভাবতে, মহিলাটি পেরিয়ে গেছিল অনেকটা পথ। লাঠি ঠুকে ঠুকে। শনের মতো সাদা, এলোমেলো চুলভরা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে। তবে, তার মাথা ছিল ভারী, কালো উলের চাদরে ঢাকা। চাদরের ফাঁক-ফোকরে তার শনের মতো এলোমেলো আর ধবধেবে সাদা চুলগুলো বেরিয়ে ছিল অনেকটাই। শীতের অস্বস্তিকর হাওয়ায় উড়ছিল শনশন। হঠাৎই সে মুখ তুলে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমিও, পথচলতি মানুষের দিকে যেমন আনমনে তাকায় মানুষ, তেমনি তাকিয়েছিলাম, কোনো কিছু না ভেবে, নির্দিষ্ট কিছু দেখার আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই। আর তাকিয়েই ভয়ানক রকম চমকে উঠেছিলাম। কেন তাকালাম, ভেবে, চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল নিজের। কেমন তীব্র অরুচিকর বোধ খামচে ধরেছিল আমাকে। আমি অসুস্থবোধ করছিলাম। গা গুলোচ্ছিল রীতিমতো। সেইসঙ্গে ভয়ানক আতঙ্ক কাঁপিয়ে দিয়েছিল আমাকে। বিস্ময়ও ছিল মাত্রাছাড়া। এমন অদ্ভুত কোনো মানুষ আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। কোথাও পড়িওনি এমন কোনো মানুষের বর্ণনা।
এমতাবস্থায়, শরীর আর মন একাট্টা হয়ে যখন নির্দেশ দিলো, যেও না, ঠিক তখন আমার মধ্যে কোত্থেকে আচমকা হাজির হলো মাত্রাছাড়া কৌতূহল, ফলে মনের মধ্যে তখনই ফাটল ধরে গেলো। প্রবল ঢেউয়ে যেমন হুট করে ভেঙে পড়ে নদীর কূল, নিশ্চিহ্ন হয়ে ভেসে যায় লহমায় উত্তাল ঢেউতোলা জলের বুকে, ঠিক তেমনি, একটু আগের ভয়, বিস্ময় আর চমকমিশ্রিত মন দুই টুকরো হয়ে একটুকরো আগের সব বোধকে নিয়ে ভেসে গেলো। অন্য টুকরোয় জেগে উঠলো অদম্য কৌতূহল। হতচকিত আমি তখন ঘোর কাটিয়ে মহিলাটির পিছু নিলাম। পিছু নিতে গিয়ে টের পেলাম, ততক্ষণে সে এগিয়ে গেছে অনেকটা দূর। সরু রাস্তাটার মাথা সে অতিক্রম করে গেছে প্রায়, আরেকটু হলেই হারিয়ে যেতো রাস্তার নতুন নেওয়া বাঁকটিতে। আর তারপর, একটু এগোলেই, ত্রিমুখী রাস্তার কোনটাতে সে গেলো, সেটা খুঁজে পেতে গিয়ে হয়তো হারিয়েই ফেলতাম তাকে।
কিন্তু আফসানের প্রতি ঘৃণা ছিল সীমাহীন। শুধু আফসান নয়, পৃথিবীর সব পুরুষের প্রতি। এখনও আছে। প্রবলভাবে আছে।
কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি তাকে ধরে ফেললাম। ছুটতে ছুটতেই গিয়ে আমি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম মহিলাটির গায়ের ওপর। বিরক্ত, ক্রুদ্ধচোখে মহিলাটি তাকালো।
আমি কুঁকড়ে গেলাম, শিউরে উঠলাম, ভয়ে। সেই সঙ্গে ঘেন্নাকর বমনেচ্ছায় গা গুলিয়ে উঠলো পুনরায়। মহিলাটি লাঠিতে ভর দিয়ে থেমে পড়লো। জিজ্ঞাসু চোখে আমার মুখের দিকে তাকালো। এবার মহিলাকে ভালো করে দেখার সুযোগ হলো। ভয়, বিস্ময়, বমনেচ্ছা আবার একবার কাঁপিয়ে দিলো ভেতরের আমাকে। কিন্তু তার পরও, আমার ভেতরে মাথাচাড়া দেওয়া অযৌক্তিক রকমের কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়ে শিগগিরই লেজগুটিয়ে পালালো তারা। এবার সব রকম দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে আমি মহিলার চোখে চোখ রাখলাম। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম আমার মাত্রাতিরিক্ত, লাগামছাড়া কৌতূহলের খিদে মেটাতে। কিংবা, যদি উল্টো করে বলি, কৌতূহলই আমাকে বাধ্য করলো তার চাহিদা মেটাতে।
মহিলার চোখের রঙ ঘোলাটে, আলো নিভে আসা বিকেলের মতো ম্লান। বয়সের ভারে ঝুলে পড়া, সাদা হয়ে আসা ভুরু। চোখের দিকে তাকালে হঠাৎ বুকের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা লাগে, ভয়ের। নাকও ভাঙা, দেখলে বোঝা যায় কোনো এককালে তীক্ষ্ণ ছিল খুব। কিন্তু তারপরের অংশটুকু! বিভৎস! আমার অনভ্যস্ত চোখ ঝটকায় সরে যেতে চাইলো সেখান থেকে। মানুষের মুখ এমন হতে পারে, এটা মেনে নিতে রীতিমতো আমার সঙ্গে বিদ্রোহ করতে চাইলো সে। সে-সব অগ্রাহ্য করে আমি তাকালাম। আবার। আবার। পলকহীন। মহিলাও চোখ রাখলো আমার চোখে। সাপের চোখের মতো ঠাণ্ডা, নিস্পৃহ দৃষ্টি ফুটে উঠতে দেখলাম আমি ধীরে ধীরে, যেখানে একটু আগেও ছিল বিরক্তি আর ক্রোধ।
মহিলার ওই দৃষ্টির সামনে আমি কুঁকড়ে গেলাম। ভেতরে তৈরি হওয়া অসম্ভব কাঁপন অগ্রাহ্য করতে নিজের সঙ্গে নিজেকেই তুমুল যুদ্ধ করতে হলো আমাকে। কৌতূহল তাতে ইন্ধন যোগালো, যোগালো শক্তিও। মহিলার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমি তার সারামুখে ফেললাম। তীক্ষ্ণভাবে, তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অস্বাভাবিকতা, যা আমার মধ্যে একইসঙ্গে ভয়, বিস্ময়, ঘৃণা, সেই সঙ্গে অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল।
আমি বরাহ দেখেছি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাকে অশূচি বলে জানি। তার প্রতি ঘৃণা আমার অজান্তেই রক্তে প্রোথিত করে দিয়েছে কেউ। আমি ধার্মিক নই, ধর্মে আমার আস্থা নেই, তবু শিশুবয়স থেকে যে বিতৃষ্ণা আমার মধ্যে তৈরি হয়েছে ওই বিশেষ জন্তুটির প্রতি সেটা অনেক চেষ্টা করেও আমি মন থেকে সরাতে পারিনি। জন্তুটির প্রতি যে বিতৃষ্ণা, যে ঘৃণা আমার মধ্যে টের পাই আমি, তা কোনোভাবেই দূর করা সম্ভব নয় আর। কিন্তু সেই ঘৃণা কী করে একজন জলজ্যান্ত মানুষের প্রতি স্থানান্তরিত হতে পারে, সেটা ভেবে একইসঙ্গে লজ্জিত, বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে উঠি। মহিলাটির মুখ অবিকল বরাহের মতো! নাকের নিচ থেকে বাকি অংশটুকু। নিচের দিকে, যেখানে ঠোঁট থাকার কথা, সেখান থেকে অনেকটা অংশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে, থলথলে মাংশের দলা হয়ে। সেখানে দগদগে ঘা। সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে হলুদাভ, অনেকটা পুঁজের মতো, আঠালো, দুর্গন্ধযুক্ত, লালা। আমার নাকে দুর্গন্ধ এসে লাগে, আমার নাড়ি-ভুঁড়ি উল্টে আসতে চায়, কিন্তু আমি মহিলাটির চোখে চোখ রেখে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকি। সে-ও আমার দিকে। তারপর, যেন অন্যকোনো ভুবন থেকে শব্দ ভেসে আসে, মহিলাটি নয়, যেন অন্যকেউ আমাকে প্রশ্ন করে, কী চাস?
স্বরটা এত অদ্ভুত আর অপরিচিত শোনায়, মহিলাটির মুখের নিম্নাংশে এমন ভয়ঙ্কর রকম আন্দোলন ওঠে যে, আর সহ্য করতে পারি না। সারাশরীর থরথর কেঁপে ওঠে আমার। মুহূর্তেই আমি দিক-বিদিক ভুলে ছুটতে থাকি। কতক্ষণ পরে হুঁশ ফেরে আমার, জানি না। আমি টের পাই, বাড়ির উল্টোপথে ছুটছি আমি। আমি বসে পড়ি রাস্তার পাশে, তারপর ওয়াক শব্দ তুলে উগরে দেই পেটের মধ্যে হজম না হওয়া খাদ্যের অবশিষ্টাংশ। কোত্থেকে তখনই দুটো কুকুর দৌড়ে এসে হামলে পড়ে তাতে। ঘেন্নায় আরও একদমক বমি করে শ্লথ পায়ে আমি হাঁটতে থাকি বাড়ির পথে। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে আমার, দুর্বলতা জেঁকে বসে তাতে। ততক্ষণে অন্ধকারও জেঁকে বসেছে সাঁঝের শরীরে। ক্লান্তপায়ে হাঁটতে হাঁটতে আর প্রকৃতির অকরুণ রহস্যময় আচরণের কারণ খুঁজতে খুঁজতে আমিও মনের মধ্যে টের পেতে থাকি ঘোরতর এক অন্ধকারের অস্তিত্ব।
বাড়িতে ফিরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে স্নান করি আমি। মন থেকে কিছুতেই ওই মহিলার কিম্ভুত মুখটা সরাতে পারি না। অনেকটা দুধ চেপে ফেলে দিয়ে আমি এবার সন্তানকে টেনে নেই বুকের মধ্যে। আর তারপর ভাবতে বসি পুরো ঘটনাটা। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে আমি আমার মানসিক অসুস্থতাকে প্রকটভাবে উপস্থিত থাকতে দেখি এবং এবার আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাই যে, পুনরায় পাগল হতে যাচ্ছি আমি। এবার হয়তো পুরোপুরিই। আমার ছেলেটা তখন সারাদিন পর মাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে ভীষণরকম উচ্ছল হয়ে উঠেছে। একবার মাতৃস্তন মুখে পুরছে, খাচ্ছে তৃপ্তিভরে, পরমুহূর্তেই সে মুখ থেকে তা সরিয়ে দিয়ে হেসে উঠছে খিলখিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসায় উথলে ওঠে আমার বুক, কান্না উছলে পড়ে আমার দুই চোখ বেয়ে।
আমাকে সুস্থ থাকতে হবে! যেকোনো মূল্যে আমাকে সুস্থ থাকতে হবে! বিড়বিড় করি আমি। চুমু খাই আমার ছেলের কপালে। সে আহ্লাদে গলে যায়। আমার গলা জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় আমার জলভেজা মুখ।
আমার মনে পড়ে যায় আফসানের কথা। আমার ছেলের বাবা ছিল সে। হ্যাঁ, ছিল। আফসান আর নেই। সম্ভবত, আমিই খুন করেছিলাম তাকে। ঠিক মনে নেই। ঝাপসা যেটুকু মনে পড়ে, তাতে এমন সন্দেহই দৃঢ় হয় আমার মনে যে, আমি তাকে খুন করেছিলাম। কেন করেছিলাম? জানি না। আফসানকে মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করেছিলাম আমি, নিতান্তই অনিচ্ছায়। তবু তাকে ঘৃণা করার কোনো কারণ ছিল না আমার। সে ভালোমানুষ ছিল। খুব ভালোমানুষ বললেও অত্যুক্তি হবে না হয়তো। তবু তাকে আমি ঘৃণা কেন করতাম? এ প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজি মনে মনে। উত্তরটা আমি জানি। শুধু আফসান নয়, সব পুরুষকেই ঘৃণা করি আমি। সীমাহীন ঘৃণা। এই ঘৃণার উৎস কী? বরাহ! চমকে উঠি আমি আবার! আফসানকে ভাবতে গিয়ে কেন আবার ওই জন্তুটিকে ভাবি আমি? কেন আমার মনে আবার ভেসে ওঠে ওই মহিলার অমন বিভৎস মুখ!
আফসানের সঙ্গে আমাকে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার আগেই আমি আমার মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলাম। আমার আপত্তি ছিল সে কারণেই। কাউকে বলিনি। অতটা উদার পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা নয়, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য কোনো গুরুত্ব পেতে পারে। মূলত, মনেরও যে স্বাস্থ্য বলতে কিছু থাকতে পারে সে ধারণাই ছিল না আমাদের পরিবারের কারও। আমারও ছিল না। আমি শুধু জানতাম পুরুষের প্রতি কোনো মানসিক আকর্ষণ নেই আমার। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও, বন্ধুরা যখন চুটিয়ে প্রেম করেছে, তখন আমি শুকনোমুখে লাইব্রেরিতে বসে বই ঘেঁটেছি, কিংবা কোনো এক নির্জনে বসে উদাস মনে আকাশ দেখেছি, নয়তো তেমনই কোনো অর্থহীন কাজে ব্যস্ত থেকেছি। এমন নয় যে, আমি শারীরিকভাবে অসমর্থ ছিলাম। আমার ছেলেই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আমি মা হয়েছি। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। আমি প্রেমে পড়তে পারি না, পারিনি কোনোদিন। অনেকের প্রতিই শারীরিক আকর্ষণবোধ করেছি আমি, এখনো করি, কিন্তু প্রেমানুভূতি খুঁজে পাইনি, পাই না কারও প্রতিই। বিপরীতে শুধু বিতৃষ্ণা জন্মে, ঘৃণা! কেন? জানি না। আফসান আমাকে ভালোবাসত, আমি টের পেতাম। মানুষ হিসেবে তাকে আমিও ভালোবাসতাম বৈকি। সঙ্গী হিসেবেও সে আদর্শ ছিল নির্দ্বিধায়। কিন্তু গোলটা ছিল অন্য জায়গায়। প্রেমিক হিসেবে, পুরুষ হিসেবে, স্বামী হিসেবে তার প্রতি কোনো প্রেম, কোনো ভালবাসা আমার মধ্যে ছিল না। কারও প্রতিই ছিল না। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেছি, করি, কোনো এক পুরুষের তুমুল প্রেমে পড়তে, আমার সব যন্ত্রণা, সব দুঃখ, সব কষ্ট তার সঙ্গে ভাগ করে নিতে। আমার মধুভাণ্ড কাউকে উজাড় করে দিয়ে, হৃদপিণ্ডের সবটুকু অমৃত নিঃশেষে কারও জন্য ঢেলে দিয়ে বুকের মধ্যে উজ্জ্বল এক মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালতে চেষ্টা করেছি আমি, যার আলোয় পূতঃ হব আমি, পবিত্র হবে আমার চারপাশ, এমন চেষ্টায় ছটফট করেছি, করি আমি, সেই কিশোরী বয়স থেকে।
আফসানের সঙ্গে এমনিতে কোনো সমস্যা ছিল না আমার। কিন্তু গোল বাধত সেইসব রাতে, যখন সে শারীরিকভাবে চাইত আমাকে। আগেই বলেছি, শারীরিক চাহিদা আমার ষোলোআনা আছে। অন্য অনেকের চেয়ে হয়তো বেশিই আছে। সে কারণে আফসানকে আমি বাধা দিতাম না প্রথম প্রথম। কিন্তু, প্রায় প্রতিরাতেই, মিলনের পর আফসান যখন নাক ডাকিয়ে ঘুমুতো, আমি তখন ভয়ানক মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করতাম বিছানায়, অভিশাপ দিতাম নিজেকেই নিজে। ভয়াবহ মানসিক দ্বন্দ্ব আমাকে বিপর্যস্ত, অস্থির করে তুলত, আর আমি, এভাবে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্যহীনতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকতাম। কিন্তু এই মানসিক যন্ত্রণা কিসের? কিসের এই অবসাদ? ভেবে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম আমি। এমন নয় যে, আফসানের সঙ্গে শারীরিকভাবে অতৃপ্ত ছিলাম আমি। তেমনটি কোনোদিনই ঘটেনি প্রায়। যখন মিলিত হতাম, শরীর চাইতো তাকে, ভীষণভাবেই চাইতো, কিন্তু মন বেঁকে বসত ভয়ানকভাবে। সেখানে বরাবর জেগে থাকত সীমাহীন বিতৃষ্ণা, ঘৃণা। ফলে ব্যাপারটা শেষে যখন ঘুমিয়ে পড়তো আফসান, তার ঘুমন্ত, মৃতপ্রায় শরীরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতাম আমি। আমার চোখ বেয়ে জল গড়াতো। মন ঘৃণায় রিরি করে উঠতো। ঘৃণাটা মাঝে মাঝে নিজের প্রতিও টের পেতাম আমি। কিন্তু আফসানের প্রতি ঘৃণা ছিল সীমাহীন। শুধু আফসান নয়, পৃথিবীর সব পুরুষের প্রতি। এখনও আছে। প্রবলভাবে আছে।
সেই দিনের কথা মনে পড়ছে এখন। তখন অন্তঃসত্ত্বা আমি। শারীরিক সম্পর্কে আফসানকে তখন স্বাভাবিক কারণেই বাধা দিতাম, তার আগেও দিতাম, তবে সেটা নিয়মিত ছিল না, কিন্তু গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে আফসানকে আর মেনে নিতে পারছিলাম না একদম। না শারীরিকভাবে, না মানসিকভাবে। কিন্তু সেদিন আফসান শুনলো না। জোর করলো। দাঁতে দাঁত চেপে আমি সহ্য করলাম তাকে। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো আফসান। আমি যথারীতি বসে রইলাম তার পাশে। নিষ্পলক, নিষ্কম্প চোখে। তারপর হঠাৎ কী হলো আমার। মাথার মধ্যে কে একজন প্রবলভাবে জেগে উঠলো, আমাকে কিছু একটা নির্দেশ দিলো। কী নির্দেশ, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমি ধীরে ধীরে পাশে থাকা বালিশটা নিয়ে এগিয়ে গেলাম আফসানের দিকে। মন বাধা দিতে চাইলো, কিন্তু শরীর এগিয়ে গেলো তীব্র অবাধ্যতায়। মন তখনো দুই টুকরো, এক টুকরো সমর্থন দিলো শরীরকে, অন্যটুকরো বাধা দিলো। কোন টুকরোর নির্দেশ গ্রাহ্য করবো, সে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত আমি শরীরের নির্দেশে ঘুমন্ত আফসানের খুব কাছে পৌঁছে গেছি তখন।তারপর আর কিছু মনে নেই।
যন্ত্রণায় প্রায় নীল হয়ে গেছে ওর মুখ। ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। ওর মুখে বরাহের আদল নেই। কোনো সন্তানের মুখেই থাকে না কোনোদিন।
বছর দুয়েক পরে আমি নিজেকে ফিরে পেলাম, সঙ্গে আমার নয় মাস বয়সী ছেলে। আফসান মারা গেছে। আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম বাপের বাড়ির সেই পুরনো, দমবন্ধ করা পরিবেশে। ততদিনে বাবাও পটল তুলেছে, মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায়, আর ছোটভাইটা, যে আগে থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল, আমার ছেলেটাকে জ্যান্ত খেলনা হিসেবে বেশ পছন্দ করে নিয়েছে, এবং মাফু স্বামীর সঙ্গে কী এক ঝামেলায় গর্ভের বাচ্চাটাকে অ্যাবরশন করিয়ে পুনরায় এবাড়ির কাজেই বহাল হয়েছে।
আফসান কিভাবে মারা গেলো, সে প্রশ্ন কাউকে করিনি আমি, মা ছাড়া উত্তর দেওয়ার মতো আদতে ছিলও না কেউ। মাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করেনি। মা-ও কোনোদিন জানায়নি কিছু। সম্ভবত আমিই তাকে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছিলাম, সে রাতে। তবে পুলিশি ঝামেলা থেকে কী করে বেঁচে গেলাম, জানি না। ছেলেটার প্রতি মায়াতেই আবার একটা কাজ জোগাড় করে নিয়েছিলাম আমি। আমাকে সুস্থ থাকতে হবে, যেকোনো মূল্যে। ছেলেটাকে মানুষ করে তুলতে হবে।
হঠাৎ ওই মহিলার মুখটা আবার ভেসে উঠলো আমার মনে। তীব্র আতঙ্কে আবার কেঁপে উঠলো আমার সারাশরীর। বরাহ। চমকে উঠলাম আমি। বিদ্যুচ্চমকের মতো আচমকা একটা দৃশ্য জ্বলে উঠলো আমার স্মৃতিতে। একঝলক আলো যেন পট করে জ্বলে উঠলো জমাট অন্ধকারের এককোণে। কিংবা একচাপ অন্ধকার এসে লহমায় নিভিয়ে দিলো আমার চারপাশে জ্বলা আলো। বহুবছর আগে, আমি তখন তিন কী চার! এক বরাহ তার কুৎসিত, বিভৎস মুখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার শিশুশরীরে। আমার অপরিণত, অস্ফুট শরীরে অন্ধকারের আবাদ করেছিল, ছড়িয়েছিল যন্ত্রণার বীজ। মুহূর্তেই ভীষণ অস্থির লাগে আমার। ওই মহিলার মুখ দেখে কেন অত ঘৃণা, ভয়, বিস্ময় জমেছিল মনে, স্পষ্ট হতেই, বুকের ভেতরটা পুড়ে যায় লহমায়। আমার বুকের মধ্যে সংগোপনে গেঁথে আছে একরাশ অন্ধকার, ঘৃণ্য এক বরাহের মুখ, যে আমাকে কোনোদিন বুকের মধ্যে জ্বালতে দেয়নি কোনো মঙ্গলপ্রদীপ। ছুঁতে দেয়নি প্রেমের পবিত্র শিখা। অথচ নিজেই টের পাইনি এতদিন।
ঘৃণায় থরথর কেঁপে উঠি আমি। বুকের মধ্যে লেপ্টে থাকা ছেলেটার দিকে চোখ যায় আমার। দ্রুতহাতে চেপে ধরি গলা। না, আর কোনো বরাহ জন্মাতে দেবো না আমি! চিৎকার করে উঠি।
ধীরে ধীরে চোখদুটে বিস্ফারিত হয়ে আসতে থাকে আমার ছোট্ট সোনাটার। একটু একটু করে চাপ বাড়াতে থাকি। ভীষণ লাল দেখায় ওর ছোট্ট, তুলতুলে মুখটা। মরে যা! তুই মরে যা! ফিসফিসিয়ে বলে উঠি আমি।
তারপর, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই কেমন করে ওঠে আমার বুকের ভেতরটা। গলা ছেড়ে দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি আমি। চিৎকার করে কাঁদি।
না! একজন মানুষের মা হবো আমি! আমি পাগল হতে চাই না আর! বরাহের মুখে আমি ফুটিয়ে তুলবো মানুষের আদল!
ছেলেটা তখন বড়-বড় শ্বাস টানছে। কাঁদার শক্তিটুকু তার অবশিষ্ট নেই আর, গলায় আটকে যাচ্ছে স্বর। দু চোখে অবিশ্বাস আর অভিমান নিয়ে সে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর সবচে’ নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। যন্ত্রণায় প্রায় নীল হয়ে গেছে ওর মুখ। ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। ওর মুখে বরাহের আদল নেই। কোনো সন্তানের মুখেই থাকে না কোনোদিন।