একদিকে ভোরের আলো ফুটে ওঠে জলেশ্বরীর আকাশে, যে আকাশে কতকাল বৃষ্টির মেঘ নেই, আরেক দিকে গরুর গাড়িটি ধীরগতিতে শহরে প্রবেশ করে। আমাদের অনেকেই আমরা সারারাত ঘুমোতে পারিনি—বাতাসের অভাবে এবং এ তো নগদ আরও অনেক কিছুর অভাবে। আমরা শহর সীমান্তে রেললাইনের পাশে ঘুমটি ঘরের বুনোফুল ঘেরা চত্বরে বাঁশের লম্বা বেঞ্চটিতে শুয়ে-বসে রাত পোহাবার অপেক্ষায় ছিলাম। দুঃখের কালো রাত পোহালে কি হবে এ বিষয়ে মানুষের কোনো স্পষ্ট ধারণা বা প্রত্যাশা থাকে না। হঠাৎ এ গরুর গাড়ির শব্দে আমরা ঈষৎ প্রাণ ফিরে পাই। প্রথমে শব্দ পাই, তারপরে দেখতে পাই শীর্ণ গরু দুটিকে। চলার তালে ডানে বাঁয়ে দুলছে, বরং ডানে বাঁয়ে মাতালের মতো টলেটলেই অগ্রসর হচ্ছে—গরু দুটির এই ভঙ্গিতেই বোঝা যায় তারা বড় দূরের যাত্রী। এত ভোরে এই শহরে কে আসে। বিশেষ করে আজ শুক্রবার, আল্লাহর দিন। কাচারি বন্ধ, গদি বন্ধ, দোকান বন্ধ, তবু কার এত দরকার পড়ে এবং সে কেমন দরকার যে এত ভোরে জলেশ্বরীতে আসে। এত ভোরে যে জলেশ্বরীতে আসে সে না জানি কত রাতে রওয়ানা দিয়েছিল কিংবা আগের দিন দিনের বেলাতেই বা। আমরা সড়কের ওপরে এগিয়ে যাই, নাগকেশর গাছটির নিচে দাঁড়াই, তখন আমরা খোলা গরুর গাড়ির ওপর একটি লাশ দেখতে পাই।
লাশ কাফনে মোড়া নয়—কাফনের কাপড় আজকাল আর কে কিনতে পারে! লাশ একটি পুরনো ময়লা কাঁথায় জড়ানো। মৃত্যুর পরও নারী-পুরুষ ভেদ আছে। কাঁথায় মোড়া লাশটিকে আবার শুকনো খড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাতে নারীদেহের উঁচু-নিচুগুলো চোখে না পড়ে। আমরা তো বুঝেই যাই এটি রমণীর লাশ। দৃষ্টিপাতমাত্র আমাদের কাছে অপ্রকাশ থাকে না যে জীবদ্দশায় সে যুবতী ছিল। আমাদের বড় কৌতূহল হয়, আমরা গরুর গাড়ি অনুসরণকারী লোক দুটির দিকে তাকাই। তারা আমাদের দিকে তাকাই না। আমরা বড় নিকটে, তবু আমাদের নিঃশ্বাস তারা অনুভব করে না। আমাদের সন্দেহ হয়, লোক দুটি এই লাশ নিয়ে তবে জলেশ্বরী থানায় যাচ্ছে। লোক দুটির একজনের বয়স খুবই কাঁচা, গোঁফদাড়ি এখনো কামাতে শুরু করেনি, আরেকজন মজবুত গড়নের কালোকুলো মাঝবয়সী। এ তো পরিষ্কারই বোঝা যায় লাশের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে তরুণটির এবং অপর ব্যক্তিটি সঙ্গে এসেছে মুরব্বি হয়ে, কথাবার্তা কইতে। দুজনের কেউ তারা আমাদের দিকে তাকায় না। আমরা তাদের পাশাপাশি প্রায়, প্রায় একই গতিতে সহযাত্রী হয়ে এখন হাঁটছি, তবু মুখ ফেরায় না। গরুর গাড়ির গাড়োয়ান পর্যন্ত চোখ তুলে দ্যাখে না যখন আমাদের একজন হঠাৎ গাড়ির সম্মুখ দিয়ে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ চলে যায়। আমরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। আমরা প্রশ্ন করার জন্য ঘনিয়ে আসি। কিন্তু উচ্চারণ করার আগেই আমাদের চোখে নতুন এক ব্যক্তি ধরা পড়ে।
লাশটির পাশে একটি বালক শুয়ে আছে। বালকটির পরনে লুঙ্গি, শার্ট। বয়স সাত কিংবা আট। লাশ বালকের বলেই ঢাকা চাপা দেবার দরকার হয়নি। বালকের দেহ লঘুভার বলে গাড়ির দোলায় ডানে বাঁয়ে অবিরাম দোল খাচ্ছে। উপুড় হয়ে পেটের ওপর শুয়ে আছে বালক। তার মুখ বাঁপাশে ফেরানো। ভোরের আলোয় সে মুখের কচি ভাবটুকু বড় করুণ দেখাচ্ছে। কিন্তু আমাদের চমকে ওঠার মতো কোনো মানে থাকে না। জীবিত বা মৃতের তফাত কী করে আমরা করতে পারি জানি না, অচিরে আমরা টের পাই, বালকটি লাশ নয়, লাশের পাশে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে মাত্র। বরং এবার আমরা বিস্মিত হয়ে যাই, লাশের পাশে এমন নিরুদ্বেগ বালকটিকে ঘুমোতে দেখে। আমরা তো জীবিতের পাশেও ঘুমোতে পারি না এখন।
গরুর গাড়িটি রেল সড়ক পার হয়ে ঘোষপাড়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়। আমাদের সন্দেহ থাকে না, এ গাড়ি থানার দিকেই যাচ্ছে এবং খুনের লাশ বহন করে যাচ্ছে। বালকটির জন্যে আমরা বড় ব্যস্ত হয়ে পরি—আহা, সে কি জানে তার মা খুন হয়েছে?
যুবতীরা আজকাল বড় বেশি খুন হয়। কেউ তাদের কাছে শরীর না পেয়ে খুন করে, কেউ তাদের বাবা-মায়ের কাছে যৌতুক না পেয়ে খুন করে। আমরা অনুমান করি, এ যুবতী যৌতুকের কারণেই খুন হয়েছে। গরুর গাড়িটি একই তালে এগিয়ে চলেছে, অনুসরণকারী লোক দুটিও নতমুখে জগতের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যাবার ভঙ্গিতে পা ফেলে চলেছে। দেখে এতটুকু অনুমান করবার উপায় নেই যে, তারা গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমরাই বরং একটু পিছিয়ে যাই, ইচ্ছে করে। আমরা আগন্তুক ব্যক্তিদের প্রশ্ন না করে নিজেরাই উত্তর খুঁজি প্রত্যক্ষ সমস্ত কিছু থেকে। আমাদের একজন বলে, এটা যৌতুকের মামলা নয়। কারণ, যৌতুকের দাবি উঠতে এত দেরি হয় না যে রমণীর ঘরে সাত-আট বছরের সন্তান হয়ে যায়। গাড়িতে লাশের পাশে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা বালকটিকে আবার আমরা তাকিয়ে দেখি এবং এ কথার সারবত্তা স্বীকার করি। কিছুকালের জন্যে আমরা সাদা বোধ করি, আর কোনো অনুমান আমাদের মনে আসে না। অচিরে আমাদের একজন উচ্চারণ করে, ‘দুবাই না তো?’ তৎক্ষণাৎ আমরা একটি আলো দেখতে পাই। সম্ভবত এই যুবতীর স্বামী মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করতে যেতে চায়, শ্বশুরের কাছে টাকা চেয়েছিল, শ্বশুর টাকা দিতে পারেনি, যুবতীকে তাই প্রাণ দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সাত-আট বছরের একটি সন্তান থাকা অসম্ভব কিছু নয়।
অবিলম্বে আমাদের এই অনুমানও উড়ে যায়। খুনের যদি লাশ হয়, তবে লাশের সঙ্গে চৌকিদার কই? অনুসরণকারী লোক দুটির পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ধুলো, চোখ রাতজাগা, সারা শরীরে ক্লান্তি। অন্তত মাইল দশেক দূর থেকে তারা আসছে, আরও বেশি হতে পারে। তাই যদি হয়, তবে থানার জন্যে জলেশ্বরীতে আসার দরকার পড়ে না তাদের, তার আগেই থানা আছে। লাশ আগে যাবে সেখানে, তারপর সেই থানা তার নিজের পুলিশ দিয়ে লাশ পাঠাবে জলেশ্বরীতে। বাঁশবনের পাশে আচমকা এক লালরঙা ছোট্ট ঘর, সেই লাশকাটা ঘরে পরীক্ষার জন্যে।
তবু আমাদের মন ইতস্তত করে। আমরা পা চালিয়ে গরুর গাড়ির কাছাকাছি যাই, অনেক পেছনে পড়ে গেছি তখন। লোক দুটি এবার আমাদের দিকে ক্ষণেকের জন্যে চোখ তুলে দ্যাখে। আমরা সে চোখে আশা করেছিলাম দেখতে পাবো ভয়, আমরা দেখি মিনতি। প্রশ্ন আবারো আমাদের করা হয় না। আমরা লোক দুটির চোখে জগতের অনুনয় প্রত্যক্ষ করে বেপথু হয়ে পড়ি।
গাড়িটিও থানার পথ ছেড়ে বাজার সড়কের দিকে মোড় নেয়। কেন নেয়? তবে থানায় নয় গন্তব্য? কোথায় তবে যেতে চায়? গাড়ির গাড়োয়ান যেভাবে গরুর ল্যাজে মোচড় দিয়ে হাতের লাঠির আঘাতে গাড়ির দিক পরিবর্তন করায় তাতে আমাদের সন্দেহ থাকে না এই শহরে সে বহুবার এসেছে সোয়ারি নিয়ে। অনুসরণকারী লোক দুটিও যে জলেশ্বরীতে নতুন নয় তাও অচিরেই বোঝা যায়। কারণ তারা বাজারের ভেতরের রঙবেরঙের সাইনবোর্ড, দোকানপাঠ কিছুই চোখ মেলে দ্যাখে না, যেন তারা স্রোতের মুখে ভেসে চলে, অনির্বাণ একটা গতির ভেতরে নিশ্চেষ্ট তারা অগ্রসর হয়ে চলে, নিয়তি তাদের টেনে নিয়ে যায়।
বাজারের ভেতরে নীরবে আরো লোক জুটে যায়। নিঃশব্দে তারা আমাদের সহযাত্রী হয়। এখনো একটি লাশ আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। মৃতের মুখের ছবিতে মানুষ সম্ভবত দেখে নিতে চায় জীবিতের সঙ্গে জীবিতের সঙ্গে কতটুকু ভিন্নতা তার। মৃতের কাহিনীর সঙ্গে সম্ভবত মানুষ তার জীবনের কাহিনী মিলিয়ে দেখতে চায় যে আরো কোন পথে সব কিছু সমাপ্ত হয়। অচিরে গরুর গাড়ি এসে হযরত শাহ সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের মাজারের সমুখে পৌঁছয়, এটাই যে এদের গন্তব্য এবার তা বোঝা যায় গাড়োয়ানের লাফ দিয়ে নেমে যাওয়ায়। নেমে গিয়েই সে লাঠির ঠেকনা দিয়ে গাড়ির সমুখভাগে উত্তোলিত অবস্থায় রাখে এবং গরু দুটিকে জোয়াল ছাড়া করে গামছা দিয়ে মুখ চোখ মুছতে থাকে, অনুসরণকারী তরুণ লোকটি গাড়ির ওপরে লাশের পাশে ঘুমন্ত বালকটিকে ধাক্কা দিয়ে জাগায়, মুরব্বি লোকটি মাজারের সিঁড়ির দিকে পিছন ফিরে একটা বিড়ি ধরায়, আমরা এ সকলই অনুপুঙ্খ দেখতে থাকি, এবং অবিলম্বে আমাদের মনে হয় ব্যাপারটি খুব সরল। এটি খুনের লাশ নয়, স্বাভাবিকভাবেই মৃত এই যুবতীকে স্বজনেরা জলেশ্বরীতে এনেছে হযরত শাহ সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের মাজারের মাটি তার কপালে ছুঁইয়ে দিতে। সকলেই সমুখের অন্ধকারে সাহস পেতে চায়, তাই বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ লাশ নিয়ে আসে এই মাজারে জানাজা পড়াবার জন্যে। লাশের কপালে কি কাফনের কাপড়ে মাজারের মাটি খানিক মাখিয়ে দেবার জন্যে। এরাও তাই এসেছে যদিও কোথা থেকে এসেছে এখনো আমরা জানি না। আমাদের আর কৌতূহল থাকে না, আমরা যারা শহর সীমান্ত থেকে গাড়ির পেছনে এসেছিলাম, আমরা তবু দাঁড়িয়ে থাকি, নইলে এতটা পথ অনুসরণ করবার জন্যে নিজেদের কাছে কৈফিয়ত কী দেবো? কিন্তু যারা মাজারের ভেতরে সঙ্গ নিয়েছিল তারা দ্রুত কেটে পড়ে।
আমাদের একজন হঠাৎ এক সন্দেহ প্রকাশ করে বসে। হ্যাঁ, এ কথা সত্যি, বহুদূর থেকে মানুষ লাশ আনে এই মাজারে জানাজার জন্যে, কিন্তু সেসব লাশ গরিবের লাশ নয়, আর গরিবের লাশ যদিওবা দু-একটা কালেভদ্রে আসে, রমণীর লাশ তো কখনো এ মাজারে কেউ আনেনি! তাহলে আজ ভোরে এই লাশ এখানে উপস্থিত করবার মধ্যে কোন কথা? কোন ভীষণ কথা?
যেন এরই উত্তর হিসেবে বালকটি হঠা ৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে, যদিও আমরা ছিটকে পড়ি। তার সেই কান্না তরুণ বা মাঝবয়সী, গাড়োয়ান বা গরু দুটি কাউকে বিচলিত করে না। তরুণটি সিঁড়ির ওপরে দু’হাতে নিজের কপাল ধরে নতমুখে বসে থাকে, মাঝবয়সী লোকটি বিড়ি টেনেই চলে, গাড়োয়ানটি গামছায় নিজের মুখ মাজে আর গরু দুটি সিঁড়ির সমুখে বাঁধানো চত্বরে সম্ভবত ঘাস আশা করেছিল, না পেয়ে করুণ হাম্বা ডেকে চলে।
বালকটি সেই যে একবার ডুকরে ওঠে, সেটি নিয়ে সে আর অগ্রসর হয় না। মাঝপথেই সেটি ছেড়ে দিয়ে সে একটানা খিনখিন করতে থাকে। বোঝা যায়, আজ সমস্ত দিনের জন্যে এই সুরটি এখন সে স্থির করে নিয়েছে। আমরা তখন এই ঘটনা থেকে আর কোনো বিস্ময় নেই ভেবে যে যার মতো ফিরে যাই।
কিন্তু বিকেল পর্যন্ত পার হয়ে পায় না। সমস্ত শহরে এক সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, কোথা থেকে এক রমণীর লাশ কারা আজ নিয়ে এসেছে জলেশ্বরীতে। সেই লাশ তারা নামিয়ে রেখেছে হযরত শাহ সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের মাজারে যাবার সিঁড়িতে। তারা কী চায়, কেন তারা এ লাশ নিয়ে এখানে এসেছে, কিছুই বলছে না। মাজারের লোকজন বহুবার বলা সত্ত্বেও লাশটিকে তারা সিঁড়ি থেকে সরিয়ে নিচ্ছে না, এবং এটাও তো ভাববার কথা যে, কাঁথায় মোড়ানো বস্তুটির ভেতরে সত্যি সত্যি রমণীর বা কোনো মানুষের লাশ আছে কি না কে বলবে? আমরা যে ভোরে এই লাশটিকে গরুগাড়ি বাহিত হয়ে শহরে প্রবেশ করতে প্রথম দেখেছিলাম, সে কথা এখন বলাও মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, অনেকেই দাবি করছে যে তারাই প্রথম লাশ নিয়ে গাড়িটিকে শহরে ঢুকতে দেখেছিল। আমরা যে দু-একজনকে বলতে চেষ্টা করি, আমরাই প্রথম বড় অবিশ্বাসের পাত্র হয়ে পড়ি। আমরা মাজারের দিকে দ্রুত যাই।
গিয়ে দেখি লাশটিকে এখন নামিয়ে রাখা হয়েছে সিঁড়ির ওপর। এই সিঁড়ি দুই মানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠে গেছে ধাপে ধাপে। ওপরে চওড়া একটি চত্বর। তারপরে আবার ওদিকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে মসজিদের চত্বরে। পরে মসজিদ, তারপরেই কুতুবউদ্দিনের মাজার। এখন বহু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়িটির বিভিন্ন ধাপে, সকলেই তাকিয়ে আছে লাশটির দিকে। এখানেও কাঁথা মোড়া লাশটির ওপর খড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে আওরতের আব্রু ষোলোআনা রক্ষিত হয়। গাড়োয়ানটিকে বা তার গাড়িটিকে দেখা যাচ্ছে না, গরু দুটিও নয়। সম্ভবত তারা লাশ নামিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে ফিরে গেছে। আমরা দেখতে পাই লাশের মাথার পাশে বসে তরুণটি, আর সেই বালক এখন তার মায়ের কাছে চুপ করে বসে আছে এবং বড় বড় চোখ মেলে জগৎ দেখছে। সম্ভবত তাদের কারণে এত লোক জমায়েত হতে আগে কখনো দেখেনি সে। মানুষের মনোযোগ এই বালক এখন প্রতিষ্ঠিত প্রৌঢ়ের মতোই স্থৈর্যের সঙ্গে প্রাপ্য বুঝে নেবার ভঙ্গিতে গ্রহণ করতে থাকে।
আমরা সেই মাঝবয়সী মজবুত গড়নের লোকটিকে সন্ধান করি। কোথাও দেখতে পাই না। অনেকক্ষণ পরে আবিষ্কার করি সে মাজারের দিকে নেমে যাওয়া ভেতরের সিঁড়ির ওপর একটি ভিড়ের কেন্দ্রে রয়েছে। তাকে ঘিরে রয়েছে জলেশ্বরীর নেতৃস্থানীয় কয়েকজন তরুণ। এই তরুণদের রাজনৈতিক দল ভিন্ন, যারা গান-বাজনা করে তাদের প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন, এমনকি এদের মধ্যে যারা বাপের পয়সা নষ্ট করে তারাও ভিন্ন ভিন্ন চায়ের স্টলে বিভক্ত। তবু এখন তারা সকলেই এক জায়গায় একটি মানুষকে ঘিরে একসঙ্গে এই ঘটনার তত্ত্বতালাশ করছে।
এই মজবুত মুরব্বি লোকটিই বলে, লাশের পাশে বসে আছে ছোকরা, ঐ হলো মৃতের ভাই, আর ছেলেটি হলো পোষ্য ছেলে। তার নিজের কোনো সন্তান নেই। স্বামী ছিল, সে মারা গেছে সাত-আট বছর আগে। তখন থেকেই রমণী করিমন বেওয়া নামে পরিচিত। লোকটির গলা দরাজ, কথাও বেশ গুছিয়ে বলতে জানে, ভাষাও খুব এখতিয়ারে। আমাদের এখন যেন স্মরণ হয়, লোকটিকে আমরা কাছারি অঞ্চলে দেখলেও দেখতে পারি। কাছারিঘোরা মানুষ না হলে আর কে এমন শহরে এসে টনকো গলায় কথা বলবে?
লোকটি বলে, জলেশ্বরীর মানুষেরা করিমন বেওয়াকে চিনবে না, সে বড়ই সাধারণ মানুষ। তবে বল্লার চরে যদি যাই, তাহলে তার নাম শুনতে পাবো। এবার ভোটের সময় করিমন বেওয়া বিরোধী জোটের পক্ষে বৌঝিদের ভেতরে একা কোমর বেঁধে প্রচার কাজ চালিয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দল যে প্রার্থী খাড়া করেছিল ভোট কারচুপির জন্য সে জিততে পারেনি, জিতেছে সরকার সমর্থক দলের প্রার্থী। করিমন বেওয়া তাকে বলেছিল, এত সহজে তার পার নাই।
তবে কি করিমন বেওয়াকে জয়ী দলের লোকেরা মেরে ফেলেছে? না, তেমন কিছু নয়। করিমন বেওয়া স্বাভাবিকভাবেই মারা যায়। ভোটের সময় নাওয়া-খাওয়ায় ঠিক ছিল না, শরীর ভেঙে গিয়েছিল, পুরনো কিছু অসুখ ছিল, তাছাড়া স্ত্রীলোকের ব্যাধি সম্পর্কে বিস্তারিত বলা ভদ্রতা নয়। গত পরশু সন্ধ্যার সময় করিমন বেওয়া এ জগৎ থেকে চিরদিনের মতো যাত্রা করে।
তারপর আমরা বল্লার চরে মাটি দিতে পারি নাই, লোকটি আমাদের সংবাদ দেয়। এই সংবাদ সে আমাদের দেয় বটে, বড় নাটকীয়ভাবে দেয়। কেন বল্লার চরে করিমন বেওয়াকে তারা মাটি দিতে পারেনি, অবিলম্বে সে ব্যাখ্যা দেয় না। কাহিনী শেষ, এক রকম একটা ভঙ্গিতে বিশ্রাম নেবার জন্যে সে উদগ্রীব হয়, সিঁড়ির ওপরে বসে পড়ার আয়জন করে। সে ভালো করেই জানে, সমস্ত চোখ এখন তার ওপর, এভাবে কাহিনী সে ফেলে রাখতে পারে না।
লোকটি নিজেই একটু পর মাথা নেড়ে জানায়, যে-বল্লার চরে করিমন বেওয়ার জন্ম হয়, সেই বল্লার চরে করিমন বেওয়ার মাটি নেই।
আমরা লক্ষ্য করি, সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ এখন মানুষের ভিড়ে উপচে পড়ছে। তবু মানুষ আসছে, মানুষ কান খাড়া করে শুনতে চাইছে, পায়ের পাতা উঁচু করে দেখতে চাইছে, আর যারা সিঁড়ির বাইরের দিকে, রাস্তার ওপরে লাশের কাছে রয়েছে, তারা প্রতি মুহূর্তে সিঁড়ির ওপরের ধাপের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, কি কিছু শুনলেন? বিষয় কি? হয়েছিল কি?
লোকটি বলে, হবে আবার কী? ভোটে জিতেও তার খায়েশ মেটে নাই, সে এখন প্রতিশোধ নিতে চায়, আমাদের মসজিদের মওলানা সাহেবকে সে বলে দিয়েছে, করিমন বেওয়ার জানাজা হবে না, কারণ এই যে শিশুটিকে দেখছেন এটি নাকি করিমনের জারজ সন্তান। তার স্বামী মারা যাবার পর পেটে আসে। কিন্তু এত বড় ডাহা মিছে কথা আর নাই, কারণ মানুষের স্মরণশক্তি এখনো একেবারে নষ্ট হয়ে যায় নাই। এই শিশুটিকে মওলানা সাহেবের সাক্ষাতেই, তার হাত ধরে পোষ্য নিয়েছিল করিমন। এখন সে কথা মওলানা সাহেবকে স্মরণ করিয়ে দেয় কে? করিমনের জানাজার জন্যে যখন মওলানা সাহেবের কাছে যাওয়া হয়, তিনি হাতজোড় করে বলেন, বাবা সকল, আঁরে আফনেরা মাফ করিয়েন। তারপর থেকে তিনি উধাও।
তাই করিমন বেওয়ার লাশ নিয়ে তারা বল্লার চর থেকে এসেছে হযরত শাহ সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের মাজারে। এখানে আপনারা বলে দিন, করিমন বেওয়া কোথায় ঘুমাবে?
এ এক ভারী মুশকিলের কথা হয়ে যায়। কোথায় ঘুমোবে করিমন বেওয়া, কে তার উত্তর দেবে? উত্তর বোধহয় আশাও করে না তার লাশের অনুসরণকারী দুজন। মাগরেবের আজানের পর দেখা যায় মাঝবয়সী লোকটি ধারে কাছে কোথাও আর নেই। গরুর গাড়ি ও গাড়োয়ান তো আগেই উধাও। এশার নামাজের পর দেখা যায় তরুণটি এক হোটেলে বসে আছে, বালকটি তার সমুখে বসে গোগ্রাসে ডালভাত গিলছে। পরদিন ভোরে তারাও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
একা লাশ শুয়ে আছে মাজারের সমুখে, পথের ওপর, সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে, ঠিক যে ধাপটিতে বসে তিরিশ বছর ভিক্ষে করেছে কানা ট্যাংড়া দোতারা বাজিয়ে গান করে এবং একাত্তরের নভেম্বরে যেখানে সে মিলিটারির গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে। কারণ সে নাকি যে গান গাইছিল তা দেহতত্ত্বের ধারে কাছেও নয়। কানা ট্যাংড়া নিজের রচনা ছাড়া গান গাইত না। এই গানটিতে আসলে সে নাকি রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছিল যে, ‘দেহের মসজিদে আরে বাস করে শয়তান।’—শুয়ে থাকে করিমন বেওয়া, সে অপেক্ষা করে, কিন্তু তার ভাই আর ফেরে না, পোষ্যপুত্র ফেরে না, তার কোনো গতি কেউ করে না।
লাশ একটি প্রকাশ্য জায়গায় ফেলে রাখা অপরাধ কি না কেউ ভালো করে বলতে পারে না। এ সম্পর্কে জলেশ্বরীর নানা জন নানা মত প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে লাশ ফুলে ওঠে, লাশ পচে ওঠে, লাশ একটি রমণীর কৈশোরব্যাপী রচিত কাঁথার ভেতর থেকে ফেটে বেরিয়ে পড়তে চায়। দীর্ঘ হয়, বৃহৎ হয়, মীমাংসা হয় না। জলেশ্বরীর সর্বত্র করিমন বেওয়ার লাশের গন্ধ কেবলই পাওয়া যায়। বৃষ্টির অপেক্ষায় জলেশ্বরীর মাটি স্বস্তিহীন, আকাশ মেঘহীন, বাতাস গতিহীন, মানুষ ঘুমহীন। মানুষ ঘুমোতে চায়, ঘুম আসে না। আমরা শহর সীমান্তে রেল সড়কের ঘুমটি ঘরের চত্বরে বসি বাতাসের আশায়। ঘুম হয়তো একটু আসে আবার চমকে জেগে উঠি, পাতলা কাচের পর্দার মত ভেঙে যায় সবকিছু। আমরা বিকটভাবে আবিষ্কার করি, করিমন বেওয়া আমাদেরই পাশে ঘুমিয়ে আছে, কারণ সে আর কোথায় ঘুমাবে?