মানুষকে নিশি পায়। আমাকে পায় আঁধারনাশী ছায়াবৃত্ত। আমি কিভাবে কিভাবে যেন জাগা পেয়ে যাই হঠাৎ। জাগা পেয়ে পাশ ফিরতে গিয়ে পারি না। কী এক আড়ষ্টতা আমাকে জড়িয়ে ধরে। কী যেন হয়েছে আমার! বলতে পারি না! একটু ধাতস্থ হলে উঠে বসি। সেটাই যেন কাল হয়ে যায়। বসলামই যখন একটু হাঁটতে ইচ্ছে করে। তখনই কেমন করে যেন হাতটা চলে যায় দরোজায়। তারপর দরোজা খুলে যায়। আমি আস্তে আস্তে বের হয়ে পড়ি। পুরোনো আমলের এই বাড়িটির সিঁড়ি ভাঙার সময়ও যেন শুনতে পাই বহু আগের ফেলে যাওয়া মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ। আমি সিঁড়ি ভাঙতেই থাকি। ভাঙতে ভাঙতে যখন বাড়িটির নিচে নামি তখন একগুচ্ছ আমের গাছ আমাকে অভিনন্দন জানায় পাতা নাড়িয়ে। আম্র-বাতাসে আমার দেহ-মন আবেশিত হয়ে ওঠে। তাও যেন ওটুকুই। আমি ঠিক ঠিকই ওই আবেশ অথবা অভিনন্দন অতিক্রম করে মূল গেট খুলে ফেলি।
ধেয়ে আসা আলো কিভাবে আঁধারকে গিলে খায় তা বোঝার চেষ্টা করি। কিংবা অন্ধকার থাকলে আলোর প্রয়োজনীয়তা কী, তা যেন আরেকবার আমাকে বিহ্বল করে। বিন্দু ও কণার এইসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াশয় ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পারি না। গেট খুলে রাস্তায় পা দিতেই বোঝা যায় আঁধারের তীব্র গাঢ়ত্ব। আরেকটু হাঁটলে দেখা যায় হালকা জোসনার সঙ্গে কুয়াশার মাখামাখি। ঘুমের ঘোরে ঠিকঠিকই দুলছে জোসনার ঢেউ। ঢেউয়েল কলসি। পাণ্ডুর মুখে চাঁদটা তখনো জেগে আছে। কিন্তু কী স্নিগ্ধ! আমি হাঁটতে হাঁটতে ল্যাম্পপোস্টটার দিকে যাই। এইবার তো কৃত্রিম আলো-আঁধারি। ওপরে তাকাই। লাইট। আমি তাহলে এখন কোথায়। পলায়নপর আঁধারের মাঝে যেখানে প্রাকৃতিক আলো তার ছায়াবৃত্ত অতিক্রম করে ধেয়ে আসছে, সেখানে? নাকি পাণ্ডুর মুখে স্নিগ্ধ জোসনা বিলিয়ে দেওয়া চাঁদের আওতায়? নাকি ল্যাম্পপোস্টের ওই আলোয়?
এটাই শেষ ল্যাম্পপোস্ট। এরপর পদ্মা নদী। আমি ল্যাম্পপোস্টটার নিচে বসব কি বসব না, এসব ভাবছি। তখনই চোখের সামনে কী যেন নড়ে ওঠে।
কুত্তা।
কুত্তা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। তখনই কতিপয় শব্দ ভেসে আসে কানে। কেউ একজন বলে, এই করোনা যদি বাংলাদেশে আসে, তাহলে কোরান মিথ্যে হয়ে যাবে। আরেকজন বলে, এই করোনা হলো বিধর্মীদের জন্য গজব আর মুসলমানদের জন্য আল্লাহর রহমত।
বুঝতে পারি ইউটিউবে কেউ এই ওয়াজ শুনছে। আমিও শুনেছি। রাত্রি এখন কত। জানি না। কে এই ওয়াজ শুনছে? জানি না। তবে কি সুবহে সাদিক হয়ে গেছে? কোনো এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রাতঃকালীন প্রার্থণা শেষে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ পাবার জন্য এই ওয়াজগুলো শুনছেন?
আমি বোধ হয় চোখ বন্ধ করে এসব ভাবছিলাম। হঠাৎ চোখ খুলি।
দেখি হাজারো কুত্তা আমাকে ঘিরে ধরেছে। তারা একই রকম দেখতে। চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। ঘাড় ফুলে উঠছে। তারা বিকট আওয়াজ তুলে ভুক ভুক করছে। বিষাক্ত দাঁত বের করছে। এবং আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমার ডানে এরকম হাজারো কুত্তা। আমার বামে এরকম হাজারো কুত্তা। আমার সামনে এরকম হাজারো কুত্তা। বাদ রইল আমার পেছনটা। পেছনে পদ্মা নদী। আমি এই সব বিষাক্ত কুকুরের নিঃশ্বাস থেকে বাঁচার জন্য নদীতে ঝাঁপ দিতে পারি। আমি ভালো সাঁতার জানি।
আমি পেছন ফিরে তাকাই নদীটির দিকে। দেখি সেখানেও হাজারো কুত্তা। একই ভঙ্গিতে দাঁত বের করে ঘেউ ঘেউ করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি আবার চোখ বন্ধ করি। আমি বুঝে গেছি যে আমার পালানোর পথ নেই। আমার মনে পড়ে আসহাবে ক্বাহাফের কথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড়। প্রাচীন জনপদ। অত্যাচারী রাজা। ইত্যাদি।
এভাবে কতক্ষণ আমি জানি না। হঠাৎ দূর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে।আমি আমার অজান্তেই চোখ খুলি। বোধহয় আজানের শব্দে কুত্তাগুলোর হিংস্র ছন্দে ব্যাঘাত ঘটেছে। তাদের হিংস্রতা একটু কম মনে হচ্ছে।
কিন্তু না। দেখলাম ওরা দৌড় দিয়ে আমার দিকে আসছে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। ঠিক তখনই আকাশে দেখা যায় আলোর ঝলকানি। সেই ঝলকানির দিকে আমার চোখ যায়। কুত্তাগুলারও। কুত্তাগুলো থেমে যায়।
সূর্য উঠছে…