০১
শতবর্ষী কড়ইগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মালতি! এ কী কথা বলে রে! সর্বনাশ! মেয়েটা কী সর্বনাশ নিয়েই জন্মালো! মালতির কথায় কান না দিয়ে জানতে চায় মিনা।
মা, ও মা, এই কড়ইগাছ নাকি বাবারে খাইয়্যা ফ্যালছে?
তোরে এমন আজগবি কতা ক্যাডায় কইছে?
বস্তির মাইনষের কাছে হুনছি।
কথার জবাব না দিয়ে গাছের গোড়ায় দাঁড়ায় মালতি। এদিক-সেদিক তাকিয়ে বসে।
মিনা, মাইনষের কথায় কান দিস না। সবে হাঁচা কয় না।
মা, তুমি আমারে হাঁচা কও, বাবায় কই গ্যাছে?
বস্তির পাশের বড় বিল্ডিংয়ের দিকে তাকায় মালতি। তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে! মুখ ফসকে বলে, আসল নষ্টের মূল হইল ওই বিল্ডিংডা।
আসল নষ্টের মূল কিল্লই?
এত সব বুঝবি না! আগে বড় হ। বড় অইলে কমু।
আমি বড় অইছি। সব বুঝি।
বুঝছ! সব না। অহন আয় ঘরে যামু। খিদা লাকছে, ভাত খাবি।
বাবার কতা না কইলে ভাত খাইতে যামু না।
মেয়েকে দুহাতে কাছে টানে মালতি। কপালে চুমু খায়। রাইতে ঘুমাইতে গ্যালে কমু। অহন আয়। তবু না খাইয়া থাহিস না।
মিনা মাথা নেড়ে সায় দেয়।
বস্তিতে মালতির ঘর। মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে চলে মা-মেয়ের ছোট সংসার। বারো বছর বয়সী মিনা ছাড়া শহরে আপন বলতে কেউ নেই। লেখাপড়ায়ও আগ্রহ নেই মিনার। স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। পড়ার কথা শুনলে মাথায় আগুন জ্বলে। ভালো লাগে বস্তির ছেলেমেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি। ভালো লাগে খেলাধুলা। কাপড় দিয়ে পুতুল বানানো। দিনের বেশির ভাগ সময় এদিক-সেদিক থাকে। রোদ-বৃষ্টি মানে না। খেতে ভালোবাসে মাছ-মাংস। ভালো খাবার দেখলে দৃষ্টি আর ফেরে না। যদিও ভালো খাবার কপালে জোটে কম। অনেক সময় সাত দিনেও জোটে না মাছ, মাংস। হা-হুতাশ বাড়ে মিনার। কারো বাসায় মাছ-মাংস রান্না হলে সেখানে আনাগোনা বাড়ে। যদিও কেউ এসব সহ্য করতে চায় না! ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দেয়। মন খারাপ হয় মিনার।
০২
হঠাৎ উধাও হয়ে যায় মিনা। কয়েক দিন আর খবর থাকে না। মালতি বেগম পাগলের মতো একমাত্র সন্তানকে খোঁজাখুঁজি করে। বস্তির কেউ সন্ধানও দিতে পারে না। সবাইকে অবাক করে এক সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এবারও দুদিন পর ফিরে আসে মিনা। বান্ধবী রোজিনার বড় বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। না বলে যাওয়ার কারণে বকা দেয় মা। না শোনার মতো থাকে মিনা। আবার বুকে টেনে নেয়। ‘মা রে, আমারে ছাইড়া কোথাইও যাইস না। তুই ছাড়া আর ক্যাডায় আছে আমার? তর কিচ্ছু অইলে মইরা যামু।’ এমন আবেগমাখা কথাগুলো মিনার কানে বেশিক্ষণ থাকে না। সারা দিন এপাড়া-ওপাড়া করে ফেরে মিনা। প্রতিদিন মাছ-মাংস খেতে চায়। মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে না মা। সাধ্য নেই তার। মালতির চোখে পানি আসে। এমন সীমাবদ্ধতা মানতে ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে চলে যেতে। অজানা এক মোহে এখানে পড়ে আছে সে।
মুক্তা ঝরে না। শরীরটাও ভালো নেই। এসব মালতির মনে জন্ম দেয় প্রশ্ন। সন্দেহ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ের কথাও ভাবে না মালতি। মিনার জন্মের ছয় মাস পর নিখোঁজ হয় বাবা। অনেক খোঁজার পরও সন্ধান মেলে না। ঠাঁই হয় শহরের বস্তিতে। মালতির আশা ছিল মেয়ে লেখাপড়া শিখবে। স্কুলে যাবে। কিন্তু মিনা স্কুলে যায় না। লেখাপড়া করে না।
মালতি যখন কাজে চলে যায়, তখন ঘুমিয়ে থাকে মিনা। দেরি হলে গৃহকর্ত্রীর বকা হজম করতে হয়। এসব আর সহ্য হয় না। তাই আগে আগে যায়। আগে গেলে বাসি ভাত-তরকারি পায়। সেসব মা-মেয়ে মিলে তৃপ্তির সঙ্গে খায়। অবশিষ্ট থাকলে তা দিয়ে পরের দিন দিব্যি চলে যায় মিনার। যদিও এসব খেতে চায় না। নাক সিটকায়। কিন্তু ক্ষুধায় কাতর হলে হাঁসের মতো গেলে।
মিনার বন্ধু মুনিরা, সালেহা ও শাকিল। এদের মধ্যে বস্তির ছোট-বড় সবাই জানে শাকিল চোর। সবাই ‘চোর শাকিল’ ডাকে। এ নিয়ে শাকিলের কোনো মাথাব্যথা নেই। চুরির প্রতি তার দুর্বলতা আছে। বড় হয়ে সে বিখ্যাত চোর হওয়ার স্বপ্ন দেখে। চুরির টাকায় শহরে বড় বিল্ডিং বানাবে, যেখানে থাকবে বস্তির মানুষ। পরিশ্রম করে বড় হওয়া না গেলেও চুরি করে ঠিকই ধনী হওয়া যায়। সালেহা ও মুনিরা এসব পছন্দ করে না। তারপরও একসঙ্গে আড্ডা দেয়, খেলে। কখনো পুতুল খেলে। কখনো বউ-জামাই। খেলা শেষে ঘরে ফেরে। মিনা ফেরে না। ফিরতে ইচ্ছে করে না তার। কড়ইগাছের তলে দাঁড়ায়। ভীষণ মন খারাপ। প্রশ্ন একটাই, বাবা কোথায়? হারিয়ে গেছে, নাকি মরে গেছে? নাকি মেরে ফেলেছে? তাহলে বাবা আর ফিরবে না? কেন ফিরবে না? এমন ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়। ঘুমাতে পারে না। প্রশ্নগুলো বারবার তাড়া করে। জানে না কার কাছে উত্তর মিলবে। মা হয়তো জানেন, কিন্তু একটা কিছু আড়ালের চেষ্টা করেন। লুকোচুরি খেলেন। তখন মনে হয় বাবা এক রহস্য। আর কখনো ফিরবেন না বাবা।
০৩
ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফেরে মালতি। বিছানায় গেলে চোখ লেগে আসে। ঘুমের ভেতরে হামাগুড়ি দেয়। এরপর দাঁড়ায়। দক্ষিণমুখী নদীর পাড়ে। প্রবল বাতাস বইতে থাকে। কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না সে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টির পানি সংঘবদ্ধ হয়ে ছুটে যায় নদীতে। মালতির ঘুম ভাঙে। উঠে বসে। কাঁপতে থাকে শরীর। ডানে-বাঁয়ে হাত রাখে; মিনা নেই। ডাকে। সাড়াশব্দ নেই। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ডাক দেয়। নাহ্, নেই! কোথাও নেই মিনা। বিকেলে খেলতে গিয়েছিল, তারপর ফেরেনি! কাঁপনের তীব্রতা আরও বাড়ে মালতির। তার চিৎকারে ঘুম ভাঙে বস্তির। সবাই ছুটে এসে জড়ো হয়। বিলাপ করছে মালতি। বলছে, মিনাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সবাই মিলে খোঁজ শুরু করে। বস্তির কারো ঘরে নেই, কড়ইগাছের তলেও নেই। বস্তিতে উদ্বিগ্নতা বাড়ে! এবার বুঝি গেল। আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে চায় মালতি। কাঁদতে পারে না, গলা বসে গেছে। জীবনের গতির মতো কমে গেছে শব্দের গতি। কয়েকজন যুবক মিলে মাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। প্রচার করছে নিখোঁজ সংবাদ। কোথাও খোঁজ মেলে না মিনার।
পরদিনও খোঁজ মেলেনি। মেয়ের খোঁজে পাগলের মতো এপাড়া-ওপাড়ায় যায় মালতি। বস্তিবাসী বলাবলি করছে, এবার আর ফিরবে না। পরিরা ধরে নিয়ে গেছে। মিনাও দেখতে পরির মতো। না হয় এত দিন কোথায় থাকবে? রাত যায় দিন আসে, অথচ মিনা আসে না। কোথায় আছে? কী খায়? বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে? স্বামীর পর এবার মেয়েটিও গেল! বুক ফেটে কান্না আসে তার। এত দুঃখ নিয়ে কীভাবে বাঁচবে সে!
বস্তিবাসী জানে, শতবর্ষী কড়ইগাছে পরি বসে। কাউকে একা পেলে নিয়ে যায়। অপছন্দ হলে পঙ্গু করে দেয়; না হয় মেরে ফেলে। তাই ভয়ে কড়ইতলে যেতে চায় না মিনার বান্ধবীরা। তারা জানে, পরিরা মিনাকে নিয়ে গেছে পরি বানাতে। যারা পরি হয়ে যায়, তারা ফেরে না মানুষের কাছে।
কবিরাজের শরণাপন্ন হয় মালতি। কামরূপ-কামাখ্যা থেকে জাদুটোনা শেখা কবিরাজ। আশ্বাস দেয় ফিরিয়ে আনবে মিনাকে। হুজরাঘরে তুষের আগুন জ্বালায়। হাজির করে জিন। ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে কথা বলে কবিরাজ। পরিরা নিয়ে গেছে মিনাকে। পেপার বাজারে আছে তারা। এখন জানতে চাইবেন, পেপার বাজার কোথায়? তা-ও বলছি, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে। মিষ্টি খাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আনন্দে আছে মিনা।
অস্থির মালতি আবার জানতে চায়, হুজুর, পেপার বাজার কোথায়?
বললাম তো, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে। সেখানে মানুষের বসতি নেই। কারও পক্ষে যাওয়াও অসম্ভব! আমার বশ করা জিন উড়াইয়্যা আনবে মিনাকে। কিছু টাকা খরচ করতে হবে। পারবি?
টাকা খরচ করতে রাজি মালতি। তারপরও মেয়েকে চায়। চিন্তা করার সময় নেয়। কবিরাজ বলে, দেরি করিস না, পরিরা এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না। আরো দূরে গেলে খরচও বাড়বে।
০৪
কান্নাকাটি করলে খাবার জুটবে না। যারা দিন আনে দিন খায়, দুঃসময়ে তাদের মাথার ওপর গাছের ছায়াও থাকে না। চাপা কান্না বুকে নিয়েও কাজ করতে হয়। সামনে বাসি খাবার থাকার পরও ওসবে আগ্রহ নেই মালতির। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, কী হবে খাবার দিয়ে? চোখে পানি আসে। মেয়ের কথা মনে পড়ে।
মালতির চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখ শেষ হয় না। যমুনায় পানি নেই। বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। সেটা এখন আরবের মরুভূমি। নৌকা ব্যবসায়ীরা রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারবে না। মরুবালির ওপর পা রাখে মিনার মা। প্রতি পদক্ষেপে ফোসকা পড়ে। সেদিকে নজর নেই মালতির। যে যেখানে যেতে বলে, যায়। লাভ হয় না। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। স্বাভাবিক হয়ে গেছে বস্তির মানুষ। একমাত্র মালতির মনেই ব্যথার পাহাড়। যদিও মালতি জানে, অন্ধকার কেটে সূর্য উঠবে। কুয়াশা দূর হবে। গজাবে নতুন গাছ। মালতি এক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করেছে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে মিনা ফিরবে। এসে জড়িয়ে ধরবে।
নিয়ত-মানতের পরও ফেরে না। মসজিদ, মন্দিরে শিরনি বিতরণ করে, তাবিজ দিয়ে ঘরের চারপাশ বন্ধ করে, কাজ হয় না। মালতির সন্দেহ বাড়ে, কবিরাজকে মনে হয় ভণ্ডের বাপ। কেবল ধর্মের দোহাই দেয়। সাপের মতো রাতের অন্ধকারে গাভীর ওলান থেকে দুধ নামায়। এসব চোখের কারচুপি। দুর্বলের সরল দিলে আঘাত করা ছাড়া কিছুই নয়!
ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে কান্নাকে বুকে জমিয়ে কাজে যায় মালতি। শোক ভুলে থাকতে পারে না। কাজেও মন বসে না। গৃহকর্ত্রী গালমন্দ করে। নতুন বুয়া নেয়ার হুমকি দেয়। পাড়ার রাস্তা ধরে আনমনে হাঁটে মালতি। আঁকাবাঁকা রাস্তায় মিনিট পনেরো হাঁটে। মিনার মতো হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যাবে কোথায়! মৃত্যু ছাড়া সব পথ যে বন্ধ। বস্তির কাছে পৌঁছায়। ঘর থেকে কথার শব্দ আসে। আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পেতে বিস্মিত হয়! পাশের ঘরের তহুরা খালা, কুলসুম ভাবি ও জনি কাকাকে ডাকে। লাঠি হাতে চারজন ঘরের চারপাশে দাঁড়ায়। হাঁক ছাড়ে জনি কাকা। বস্তিতে চোর! ভাবাই যায় না। বাইর না অইলে খুনের রক্তে মজমা মিলাইমু।
ভেতরে শব্দ নেই। একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। মালতির মনে দ্বিধা। একবার ভাবে চোর। আবার ভাবে মিনা! বস্তার এক কোণ সরিয়ে দেখে, মিনা শুয়ে আছে। মালতি কথা বলতে পারে না, কথা আটকে যায়। ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকে। এরপর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। জানতে চায়, তুই কোথায় ছিলি রে মা? তোরে পাগলের মতো খুঁজছি।
মিনা কথা বলে না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে মালতি। নির্বিকার ভঙিতে ইশারা করে। ওই বিল্ডিংয়ে ছিলাম। হাতে কিছু টাকা। মালতির চোখে-মুখে বিস্ময়! সর্বনাশ! মিনার মুখ চেপে ধরে। ডিমের কুসুমের মতো লাল হয়ে ওঠে চোখজোড়া! মিনার খেলার সাথিরা ছুটে আসে। কিন্তু ভয়ে কেউ কাছে ঘেঁষে না। তাদের বিশ্বাস, মিনার ওপর জিন-পরি ভর করেছে।
০৫
মেয়েকে কাছে পেয়ে মালতি যতটা খুশি, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত! ওই উঁচু বিল্ডিংয়ে মিনা যাবে কেনো! ওটাই নষ্টের মূল। মালতির উপলব্ধি, জীবনে সব পথ চিনতে নেই। চেনা পথে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কে বোঝাবে মিনাকে, কে বলবে, ফিরে এসো অবুঝ কন্যা। মিনার মুখে সেই উচ্ছ্বাস নেই। হাসি নেই। হাসলে এখন আর খলখল শব্দ হয় না। মুক্তা ঝরে না। শরীরটাও ভালো নেই। এসব মালতির মনে জন্ম দেয় প্রশ্ন। সন্দেহ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে।
সময় বদলে যায় পরিবেশের স্পর্শে। মিনা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। হইহুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখে বস্তি। যেখানে ভালো রান্না হয়, সেখানে মিনার আনাগোনা। একবার ভালো খাবারের লোভে জমিরের বাসায় ঝিয়ের কাজও করেছে মিনা।
মকসুদ অহন আর আমারে জিগায় না। ভাইবা কাজ করন লাগে, কইরা ভাবন যায় না। জমেলাকে নিয়েও মকসুদের নামে মুখরোচক গল্প বস্তিতে প্রচলিত আছে। যদিও সে এসব কুৎসা পাত্তা দেয় না।
মিনার ভাবনা, মাকে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ বানাতে হবে। কোনো দুঃখ থাকবে না। পরনে ছেঁড়া কাপড় থাকবে না। অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ করবে না। গালি শুনবে না। মায়ের দুঃখ দূর করবে সে। একটি শাড়ি কিনে দিতে চায় মিনা। কিন্তু যে টাকা আছে, তা দিয়ে ভালো শাড়ি হবে না। আর অল্প কিছু টাকা হলে শাড়ি কিনতে পারবে। গোপনে ঝিয়ের কাজ করে মিনা। এভাবে কিছু টাকা জমায়। জমানো টাকা থেকে আপেল কিনে খায়। বন্ধুরা মিলে হাতিরঝিলের নন্দন দেখতে গিয়ে বুট-বাদাম কেনে। জমা টাকা কমতে থাকে। হোটেলে গরুর মাংস ভুনা দিয়ে ভাত খায়। একদিন মায়ের সামনে পড়ে। মা কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চায়, তুই এত টাকা পাইছস কই?
থতমত খায় মিনা। বলতে চায় না। অনেকক্ষণ পরে বলে, মাইনষের বাসায় কাম কইরা।
মাইনষের বাসায় কাম করছ তুই! চোখ বড় করে বলে মালতি।
মাঝেমইদ্যে যাই।
তোরে কইছি ল্যাহাপড়া কর। মাইনষের বাসায় আমি কাজ করি, তুইও করবি? মায়ের সঙ্গে তর্কে না কুলিয়ে দৌড়ে পালায় মিনা।
মালতি সেদিকে তাকিয়ে বলে, দৌড় দিয়া সোন্দর জীবনডারে পিছনে ফ্যালাইয়া দিলি মিনা। হারাইয়া দিলি ভালা মোহূর্ত। অহন অনেক দৌড়াইতে হইব, ভবিষ্যতে য্যান কম দৌড়াইতে হয়। দৌড়াইতে চায় না মিনা। আমার মতো বয়স হইলে ঠিকই দৌড়াইব, তখন পোথের শেষ হইব না। দৌড়াইতে দৌড়াইতে আইস্যা দেখব, আগের জায়গায় খাড়াইয়া আছে। তহন অভাগিনী মালতিরে মনে অইব।
০৬
বস্তির সামান্য উত্তরে মকসুদের বিল্ডিং। বিশাল বাড়ি। সামনে খোলা জায়গা। আছে নানারকম ফুল ও ফলের গাছ। বাড়িটা মিনার খুব পছন্দ। আবার অপছন্দও। শুনেছে এই বাড়িটা নারী খায়, টাকা খায়। কেবল মকসুদরে খায় না। মকসুদ ত বাড়ির মালিক।
বাড়ির রান্নার কাজ করেন জমেলা সুন্দরী। মিনা তাকে খালা ডাকে। তার কাছে আসে। খালার কাছে শোনে নানারকম খাবারের নাম। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে মিনা। এসব খাওয়া তো দূরের কথা, চোখেও দেখে না।
মকসুদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে মিনা। ভেতরে যেতে চায়, কিন্তু পারে না—দারোয়ান বাঁধা দেয়।
মিনা জানায়, জমেলা খালার কাছে যাব।
দারোয়ান জানতে চায়, জমেলা খালা আবার কে?
—এই বাসার কাজের বুয়া।
—বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে মিনা। যত এগিয়ে যায়, ততই অবাক হয়! সবকিছুতে নতুনের ছোঁয়া। সিঁড়িতে ফুলের টব। টবে হরেক রকম ফুল। ফুলে ফুলে বসে আছে প্রজাপতি। অথচ এরা ওড়াউড়ি করছে না। শিল্পী পিকাশো’র আঁকা মনোমুগ্ধকর ছবি শোভা পাচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে। এখানে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবি নেই। নেই এসএম সুলতানের কালো কৃষকেরা। পটুয়া কামরুলের শিংঅলা জানোয়ারটা আজরাইলের জিম্মায়। বিষণ্নতা কখনো কখনো সুন্দর। ভালো সবসময় সর্বোত্তম নয়। কলোনিয়াল বেইলের দেমাগ রক্ষা করে পিকাশো চেয়ারে বসে মকসুদ। এসব ছবির অর্থমূল্য জানে না মিনা। ছবিতে থুতু ছোড়ে সে। ‘হারমজদা, আমগরে খাইতে দেয় না। ছবি দিয়া কী অইব?’ দেয়ালে লাগানো বাঘ-হরিণ-হাতির ছবি। ছবিতে দুইবার থুতু ছিটিয়ে ওপরের ওঠে মিনা। ভাবে, এই বাঘ-হাতি আমাদের পথে বসিয়েছে।
রান্নাঘর তিন তলায়। মিনা সেখানে যায়। রান্নাঘরেও দারুণ কারুকাজ! দেখে চোখ জুড়িয়ে আসে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে। মিনাকে দেখে অবাক হয় জমেলা। জানতে চায়, তুই আবার আইলি! কেম্নে আইলি মিনা?
—আপনের কথা কইলাম আর দারোয়ান ছাইড়া দিলো।
—ছাহেব দেখে নাই?
—না
—দেখলে আবারও বিপদে পড়বি তুই
—আর ডরাই না।
—ডরাছ না?
—না। কষ্ট হইলেও ছাহেব ভালা ভালা খাইতে দেয়। খাওনের লইগ্যা অকটু কষ্ট করণ যায়, খালা।
—তুইত আমাইরে বিপদে ফ্যালাইবি, মাইয়া। তোর মারে আমি কী জোয়াব দিমু?
—খালা, আর কিয়ের বিপদ? যা অওনের অইয়াই গ্যাছে। অহন ডরাই না।
—মাইয়া, আমার মোতন জীবনডারে নষ্ট করিস না। মকসুদ অহন আর আমারে জিগায় না। ভাইবা কাজ করন লাগে, কইরা ভাবন যায় না।
জমেলাকে নিয়েও মকসুদের নামে মুখরোচক গল্প বস্তিতে প্রচলিত আছে। যদিও সে এসব কুৎসা পাত্তা দেয় না।
০৭
বাসায় মেহমান আসবে। ভালো-মন্দ রান্নার আয়োজন চলছে। জমেলার কাছে জানতে চায় মিনা, মাছ মাংস কে খাইবো খালা?
—হুনছি, ছাহেবের মেহমান আইবো।
—মেহমানরা সব খাইবো?
—হ।
—আমারও খাইতে মোন চায় খালা।
—মা’রে আমারও খাইতে মোন চায়। চাইলেই খাওন যায় না। এগুলি ছাহেব’গ খাওন। রাইতে মেহমান আইব। হ্যাগো লগে কয়ডা মাইয়াও থাকব।
—খালা, ছাহেবের ব্যবসার খবর পুলিশ জানে না?
—জানি না। জানলেও ধরব না। পুলিশের লগে ছাহেবের ভালা খাতির। নাইলে বিদেশ থেইক্কা অষুধ আনব ক্যামনে? বেচাকিনা করব ক্যামনে? হুনছি ব্যপসায় অনেক লাভ।
—খালা, এই অষুদ মাইনষ্যে খায়?
—হেইডাও জানি না রে মা। হুনছি, জোয়ান পোলাপাইনে খায়। এত কতা কইছ না। ছাহেব আমারে ডাকছে। তুই থাক।
এবার কুকুরের দিকে তাকিয়ে মিনা বলে, ওই মকসুইদ্দা, তুই আমার খাওনও কাইড়া নিলি? তুই আস্ত একটা হারামজাদা!
রান্নাঘরে হরেকরকম খাবার দেখে জিহ্বার পানি টলটল করছে মিনার। এদিক-সেদিক তাকায়। লোভ সামলাতে পারছে না। এক টুকরো ভাজা ইলিশ হাতে নেয়। মজা করে খায়। আরো খেতে মন চায়। কিন্তু ভয় হয়, যদি জমিলা খালা এসে যায়! তাড়াহুড়া করে; মুরগির দুইটি ভাজা রান ও কয়েক টুকরো মাছ পলিথিনে প্যাঁচায় মিনা। আশপাশে কেউ নেই। এরপর দৌড় দেয় মিনা। আবার থেমে যায়। সিঁড়িতে দুইজন পুলিশ। ভয়ে হাত পেছনে নেয় মিনা। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। কাঁপতে থাকে হাত। চোখ জুড়ে ভয়! দেয়ালের বাঘ হা করে তাকিয়ে আছে। সুন্দরবনে অনেক বাঘ। সাবধানে পা ফেলতে হয় পর্যটকদের। বাঘের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা কঠিন। মিনার কাছে মনে হয় দেয়ালের বাঘটি জীবন্ত। আক্রমণ করবে। একপাশে বাঘ। অন্য পাশে পুলিশ। কোন দিকে যাবে সে।
পুলিশ ওপরে চলে যায়। মিনা দৌড়ে নিচে নেমে আসে। গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাশেই কুকুরের ঘর। দুইটি বিদেশি কুকুর বাঁধা। সামনে দামি খাবার। তার পাশে দারোয়ানের থাকার ঘর। সেখান বসে গেট দেখা যায়। মিনাকে ডাকে দারোয়ান, ওই চেমড়ি, চইল্লা যাইবি?
মিনা মাথা নাড়ে, হ্যাঁ চলে যাব।
এদিক আয়। তোর আতে কী?
মিনা দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বলে না। দারোয়ানের সামনেও যায় না। দারোয়ান আবারও জানতে চায়, প্যাকেটে কী? কই থিইক্কা আনলি? খালায় দিছে?
আবারও মাথা নাড়ে মিনা। হ্যাঁ, খালায় দিছে।
আইচ্ছা, গেট খোলা আছে, চইল্লা যা, আর আইছ না, কোন সোম কোন ঝামেলা অয় কওন যায় না। হব্বরি যা, ছাহেবে দেকলে সমস্যা অইব।
মিনা এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেয় দৌড়…
বস্তিঘরে ফিরে পলিথিন নিয়ে বসে মিনা। একটি রান খেয়ে বাকিগুলো আবার পলিথিনে প্যাঁচায়। ঘরের এক কোনে লুকিয়ে রাখে। ভাবে মাকেও একটু দেবে। কতদিন ভালো খাবার খায়নি। আবার ভয়ও হয়। যদি মা জানতে চায়, কোথায় থেকে এইগুলি আনছি। তখন কি বলুম।
শহরে বস্তিতে দ্রুতই সন্ধ্যা নামে। বাড়তে থাকে অন্ধকার। সকাল এসে লুটোপুটি খায় মিনার পায়ে। তবু মিনার ঘুম ভাঙে না। কর্মক্লান্ত মানুষের মতো ঘুমায়। যেন হারিয়ে গেছে স্বপ্নে।
০৮
সাত সকালে ঘুম ভাঙে মালতির। লবণ-পেয়াজ দিয়ে বাসি ভাত খেয়ে কাজে যায়। যাওয়ার সময় মিনাকে ডেকে বলে, ভাত আছে থালে, খাইস।
বস্তার ফাঁক গলে সূর্য ঢোকে ঘরে। আলো পড়ে মিনার বুকে ও মুখে। আড়মোড়া ভেঙে বসে সে। মা ঘরে নেই। মনে পড়ে সেই পলিথিনের কথা। চোখ যায় ঘরের কোনে। আড়মোড়া ভেঙে বসে সে। মা ঘরে নেই। মনে পড়ে সেই পলিথিনের কথা। চোখ যায় ঘরের কোনে। জায়গাটা এলোমেলো। বড় বড় চোখে তাকায়। থরথর কাঁপতে থাকে হাত-পা। একবার চোখ বোজে আবার মেলে। সত্যিই এলোমেলো! মাকে সন্দেহ হয়! বিছানা থেকে নেমে ঘরের কোনে যায়। পলিথিন পড়ে আছে। ছেঁড়া। ভেতরে মুরগির রান, মাছের টুকরো নেই। মন খারাপ করে বসে থাকে। ভাবে, কে নিল?
ঘরের বাইরে আসে মিনা। একটি কুকুর শুয়ে আছে। পাশে ছেঁড়া পলিথিন। মুরগির রান, মাছের টুকরো কোথায় বুঝতে বাকি রইল না মিনার। রাগে গজগজ করে শরীর, চোখে পানি আসে।
সারা রাত খেয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে কুকুরটা। পেট ভরা থাকলে ঘুম ভালো হয়। কুকুর ঘুমায়, মকসুদ ঘুমায়। কুকুর যা পায় তা খায়, মকসুদও খায়। মকসুদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে মিনা ভাবে, মকসুদ চাল, ডাল, লবণ খায়, জামা-কাপড় খায়, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট খায়, গ্রাম ও শহর খায়, পুরো দেশ খায়। বাবাকে খেয়েছে, জমেলা খালাকে খেয়েছে, আমাকেও ছাড়েনি।
এবার কুকুরের দিকে তাকিয়ে মিনা বলে, ওই মকসুইদ্দা, তুই আমার খাওনও কাইড়া নিলি? তুই আস্ত একটা হারামজাদা!
আরও পড়ুন: প্রথম গল্প