রাত্রি দ্বিপ্রহর প্রায়। বিদ্যুন্মালা উল্লম্ফনপূর্বক শয্যাপরে উঠিয়া বসিল। তাহার যুক্তিসংগত কারণ বিলক্ষণ ছিল। বিদ্যুন্মালার স্বামী নবীন অকস্মাৎ নিদ্রার ঘোরে চক্ষু মুদিয়া বিদ্যুন্মালাকে প্রশ্ন করিল, ‘তোর নাম কী?’ বিদ্যুন্মালা অন্য কোনো মনুষ্যের স্ত্রী নহে। সে নবীনের স্ত্রী। সুতরাং তাহার মূর্ছা যাইবার কোনো কারণ নাই। অন্য কাহারও স্ত্রী রাত্রি দ্বিপ্রহরে এমন আজব প্রশ্ন শুনিলে কী করিতো, তাহা অন্য প্রসঙ্গ। বিদ্যুন্মালা এইরূপ বাক্য সমাহার এইরূপ সুন্দর পরিবেশে ও সুন্দর সময়ে এত শুনিয়াছে, এত শুনিয়াছে, তাহার আর অধুনা বিস্ময় জাগে না।
সে বিবাহপরবর্তী সময়ে নিজেকে সমস্ত পরিবেশের জন্য প্রস্তুত করিয়া ফেলিয়াছে। আপাদমস্তক সহনশীলতার পাঠ লইতে লইতে বিদ্যুন্মালা আজ সম্পূর্ণ অন্য এক নারী। কেহ কেহ তাহাকে মহীয়ষীও আখ্যা দিয়া থাকে। তবে সেইরূপ মনুষ্য স্বল্প। কারণ বিদ্যুন্মালা নিজের জীবনকাহিনী বড় বেশি বিবৃত করে না। সে এক মস্ত চিকিৎসকের ঘরণী। ইহাই মনুষ্যসমাজে তাহাকে কিছু গৌরবের স্থান দান করিয়াছে। বিদ্যুন্মালা তাহার পিতা-মাতার বেদবাক্য স্মরণে রাখিয়া নিজের সম্পর্কে কুটাটিও প্রকাশ করে না। ফলস্বরূপ তাহার নিজের ব্যক্তিগত বিষয়, আবেগ ইত্যাদি তাহাকে নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করিতে হয়। এইরূপে তাহার জীবন একেবারে যাহাকে বলে স্ব ও সুনিয়ন্ত্রিত হইয়া উঠিল।
এতদসত্ত্বেও নবীনের বাণী, রাত্রির অমন অমোঘ সময়ে বিদ্যুন্মালাকে একেবারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করিয়া তুলিলো। সাধারণত বিদ্যুন্মালা এমত সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে, মস্তিষ্ক শান্ত করিবার উদ্দেশ্যে, তাহার বারান্দাবাগানে উপস্থিত হয় ও কোন গুল্মে কয়টি পাতা, তাহা একমনে গণনা করিতে থাকে। তাহার পরেও মস্তিষ্কের চিড়বিড়ানি না হ্রাস পাইলে লতাগুল্মের তলদেশে উদ্ভূত মস গোত্রের শ্যাওলাগুলিকে নিজ সন্তানজ্ঞানে হস্তদ্বারা প্রবল স্নেহে মর্দন করিতে থাকে। তাহাতে এক সময় ক্রোধ প্রশমিত হইয়া আসে। কিন্তু অদ্য মধ্যরাত্রিতে, নবীনের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী তাহাকে কিঞ্চিৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় করিয়া তুলিলো।
বিদ্যুন্মালার যৎকিঞ্চিৎ তন্দ্রা আসিয়াছিল। তাহার স্বামী নবীন নিদ্রা গিয়াছে তা প্রায় ঘণ্টা দুই। বিদ্যুন্মালা আজকাল বিদেশি ভাষার কবিতার অনুবাদকর্মে ও নানা সাহিত্যকর্মে লিপ্ত। তাই তাহাকে অনেক রাত্রি অবধি তাহার কর্ম করিতে হয়। দিবাভাগে মাথা খুঁড়িলেও তাহার আবার লেখা আসে না।মাথা খুঁড়িতে ইচ্ছাও জাগে না তেমন অত শত গার্হস্থ্য কর্ম ও লোকের মাঝে। যাহা হউক, বিদ্যুন্মালা এমত রাত্রি দ্বিপ্রহরে তাহার কর্মসম্পাদন করিয়া, সবে, স্বামীর কিছু নিকটবর্তী হইয়া তাহার ঘুমন্ত স্বামীর মুখের উপর ঈষৎ অগ্রসর হইয়া আবেগভরা চক্ষু মেলিয়া নিরীক্ষণ করিতেছিল, এমন সময় কোথা হইতে ধরাধামে ভূমিষ্ঠ হইলো সেই অমোঘ বাণী, ‘তোমার নাম কী?’
সে নবীনের বক্ষে হস্ত স্পর্শ করিয়া আরও আরাম প্রদান করিতে করিতে, কণ্ঠে একেবারে মধু ঢালিয়া জিজ্ঞাসা করিলো, ‘বলো না গো, কী উঠছে আর নামছে?’
বিদ্যুন্মালা তড়িৎগতিতে শয্যায় সটান হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল, কেন, কী উদ্দেশ্যে, কী পরিপ্রেক্ষিতে, একজন স্বামী তাহার ছাব্বিশ বছরের পুরাতন স্ত্রীকে এইরূপ বলিতে পারে।এমত সময়ে নবীন আবার উচ্চারিল, ‘উঠছে আর নামছে, উঠছে আর নামছে।’ বিদ্যুন্মালা উৎকর্ণ হইয়া আরও কিছু শুনিবার আশায়, নবীনের একেবারে বক্ষলগ্ন হইয়া কান পাতিল। এরূপ সময়ে বিদ্যুন্মালা তাহার নিজ মস্তিষ্ককে অধুনা একেবারে শীতল হত্যাকারীর (ঠাণ্ডা মাথার খুনি) ন্যায় শান্ত রাখে। ন-এর বক্ষে মস্তক স্থাপন করিয়া পরিপ্রেক্ষিত ধরিবার চেষ্টা করে। এমন সব মূল্যবান মুহূর্ত হাতছাড়া করিলে আর ধরা যাইবে না কিছু। তাই সেই চেষ্টায় পুনর্বার উৎকর্ণ হইলো সে। গোয়েন্দা গল্প বিস্তর পড়িয়াছে সে। মস্তিষ্ক শীতল রাখাই আসল কর্ম।
নবীন আরও কী যেন বলিতেছে। বিদ্যুন্মালা দেখিলো, ইহাই একেবারে মোক্ষম মুহূর্ত। ফসকাইয়া গেলে চোর ধরা মুশকিল হইয়া পড়িবে। সে আরও কন্ঠলগ্ন হইয়া নবীনকে মোলায়েম স্বরে শুধাইল, ‘বলো না, কী উঠছে আর নামছে?’
মন কিড়মিড় করিয়া উঠিয়া কিরিমিরি বাঁধন দিতে চাহিলেও মনের দরজায় কঠিন করিয়া আগল দিতে হইবে। সে নবীনের বক্ষে হস্ত স্পর্শ করিয়া আরও আরাম প্রদান করিতে করিতে, কণ্ঠে একেবারে মধু ঢালিয়া জিজ্ঞাসা করিলো, ‘বলো না গো, কী উঠছে আর নামছে?’ তাহাতে নবীন উৎসাহিত হইয়া বিড়বিড় করিয়া এইটুকুই প্রকাশ করিল, ‘হাওয়াতে উঠছে আর নামছে।’
বিদ্যুন্মালার চক্ষু ঘূর্ণিত হইলো। তাহার প্রয়াস সমস্ত বিফল হওয়ায় যারপরনাই বিরক্তও বোধ করিলো। প্রতিবার এইরূপ ঘটে। তীরেও তরীখানা আসে না। আজ অবধি কোনো ক্লু বাহির করা সম্ভবপর হয় নাই। বিদ্যুন্মালা এমত সময়ে আর একখানি পুরাতন অমৃতবাণী শুনিল।
নবীন কহিতেছে, ‘কতবার বলতে হবে সায়ার দড়ি ঢিলে করার কথা?’
বিদ্যুন্মালা বিন্দুমাত্র বিচলিত হইলো না, কারণ সে ইহার অর্থ বোঝে। পূর্বে নবীন চেম্বারে বা হাসপাতালে রোগী পরীক্ষাকালীন বিদ্যুন্মালা কোনো কারণবশত ফোন করিলে, চার পাঁচটি বাক্য বিনিময়শেষে ফোনে এই বাক্যটি ধ্বনিত হইতো ওপার হইতে। প্রথমবার তো বিদ্যুন্মালা বুঝিতেই পারে নাই, সে কেন এই কর্মটি করিবে। তাহার কণ্ঠ হইতে প্রথমে এক হিক্কাধ্বনি ও তারপরে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে, ‘অ্যাঁ!’ এই ধ্বনি নির্গত হইলে, নবীন চরম বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিল, ‘আরে তোমাকে না, পেশেন্টকে বলছি।’
বিদ্যুন্মালা চিত্রার্পিতের ন্যায় থম মারিয়া চাহিয়া রহিল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজিতে লাগিল, ‘ওই মহা সিন্ধুর ওপার থেকে…।’
নবীন একজন সুদক্ষ আল্ট্রাসোনোলজিস্ট। সে পেশেন্টকে মোলায়েম করিয়া হউক, ধমক দিয়া হউক উক্ত (বিদ্যুন্মালার কাছে ইহা অশালীন বাক্য শতবার, সহস্রবার, লক্ষবার, নিযুতবার, কোটিবার) বাক্য ব্যবহার করিতেই পারে, কারণ তাহাকে বহু রোগী পরীক্ষা করিতে হয়। তাহার সময়ের মূল্য অনেক। কিন্তু কথা হইলো, প্রতিবার ফোনে এই বাক্য শ্রবণ একজন স্ত্রীর পক্ষে কতটা সুমিষ্ট হইতে পারে, সে বিষয়ে কোনোদিনই নবীনের কোনো মাথাব্যথা নাই।
প্রথমবার এই বাক্য শ্রবণে বিদ্যুন্মালার বক্ষে বেশ ভারী একখানা শক্তিশেল নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল ঠিকই, কিন্তু শ্রবণ করিতে করিতে, ইহা ন-এর ফোনালাপের এক অনিবার্য বাক্যবিন্যাস বুঝিয়া, খুব জরুরি কারণ ব্যতীত সে আর ফোন করে না এখন তাহার স্বামীকে। এইসব সাতপাঁচ ভাবিতেছিল বিদ্যুন্মালা কঠিন প্রস্তরখণ্ডবৎ। এমন সময় পুনর্বার নবীনের নিদ্রিত কণ্ঠবাণী নির্গত হইলো, ‘তোর কটা বাচ্চা?’
আর একইসঙ্গে কী জানি কেন এই প্রায় প্রাতঃকালীন সময়ে দূরভাষ হইতে সংগীত নির্গত হইলো, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে।’
নবীন আড়মোড়া ভাঙিয়া উঠিল, ‘কী গো, তুমি ঘুমোওনি এখনো? আমার মর্নিং ডিউটি আছে তো, কত করে বললাম, ঘুমোও, ঘুমোও।’ বিদ্যুন্মালা চিত্রার্পিতের ন্যায় থম মারিয়া চাহিয়া রহিল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজিতে লাগিল, ‘ওই মহা সিন্ধুর ওপার থেকে…।’
নবীন কহিল, ‘কী যে করো না, রাত জেগে জেগে।’