সন্ধ্যার আগে, পৃথিবীর কুটিল সব দৃশ্যও মায়া মায়া হয়ে যায়, যখন সে ফুলপুরে পৌঁছয়। দুপাশে তার হেমন্তের কুয়াশার মাঠ। যদিও সরু মেঠোপথ, তবু দুপায়ে চলার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু সচ্ছলভাবে সে আর হাঁটতে পারে কই? এই যে হেমন্তের মাঠ-ঘাট, চারদিকে ধূসর-সবুজের মিছিল, গাঁয়ের হেঁসেল থেকে উড়ে আসা ধোঁয়ায় কুয়াশায় মাখামাখি, এসব দৃশ্য তার করোটিকে কেমন শূন্য করে দেয়। অথচ কতদিন হয়ে গেলো সে গ্রামে আসেনি, তার শৈশবের গ্রাম। এরচে’ দারুণ কিছু আর কোথায় হতে পারে, ভেবে তার ভেতরটা ক্রমশ ঘন হয়। অথচ কোথায় কোথায় সে ছুটে বেড়িয়েছে, কতদিন হলো; কিন্তু তার অশান্ত মন জুড়াতে পারে এমন কিছুর সন্ধান সে পায়নি। আর আজ এই আধো-সন্ধ্যায় হেমন্তের মাঠ-ঘাট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে দারুণ এক শান্তি নামে। এই তবে তার সত্যিকারের ঠিকানা অথচ এতদিনে সে কথা তার একটিবারের জন্যও মনে পড়েনি। হয়তো এটাই সত্য কিংবা একে চিরন্তন রীতি বলা যেতে পারে যে, দুর্বল সময়েই শুধু মানুষের মাতৃছায়ার কথা স্মরণে আসে। এসব কথার ভেতরে সে বসবাস করতে করতে আধো সন্ধ্যায় কুয়াশা কাঁটতে কাঁটতে মেঠোপথে হাঁটতে থাকে, যে পথে হাঁটতে থাকলে যেখানে গিয়ে মাঠের সমাপ্তি ঘটেছে, সেখানে তার বাড়ির পেছন দরজার দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু মায়া মায়া সন্ধ্যা সামান্য সময় স্থায়ী হয় বলে ঝুপ্ করে অন্ধকার নেমে আসে, কিন্তু সে বিচলিত হয় না। যদিও সে দীর্ঘ দিন হয় এই পথে আসেনি কিন্তু শৈশবের এই সব পথ-ঘাট মন থেকে তার বিস্মৃত হয়েও যায়নি। স্কুল পালানো দুপুর আর দুরন্ত সেই সব সন্ধ্যা-বিকেল—এই তো সেদিনের কথা মনে হয়। অথচ মাঝ থেকে খসে গেছে নাকি কতগুলো বছর লক্ষ লক্ষ মিনিট আর অগণন মুহূর্ত। এভাবে যে মানুষ দিনে দিনে কোথায় যায় আর যেতে চায় কোথায়, সেটা ঠিকঠাক বোঝা যায় না, যেখানে একটা জীবন মোহগ্রস্তের মতো কেটে যায়। তবু মানুষ, যে কিনা সেরা আদমি হয় তাকে শেষ পর্যন্ত যে একটা জায়গায় পৌঁছতেই হয়। কিন্তু জীবন বয়ে বেড়ানো যে কী জটিল, যেখানে সচ্ছল বলে কিছুনি। সে এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটে আর তার পেছন দিকে ধীরে আস্ত একখানা চাঁদ উঠে পড়ে। কুয়াশার ভিড় ঠেলে চাঁদের মোলায়েম আলো তার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই সে বাড়ির পেছন দরজার কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে অজ্ঞাত কারণে তার হাত ওঠে না, সে আর কড়া নাড়তে পারে না। যেন এ দরজা কোনোদিন তার চেনা ছিল না। এ দরজার আড়ালের মানুষজনও তাকে দুচোখের দেখা কোনোদিন দেখেনি। তাই সংকোচে তার হাত ওঠে না। সে যেন আরও গভীরে ডুব দেয়, যেখান থেকে আর সহজে উঠে আসা যায় না। তার মনে হয়, সেটা তো সত্যিই শুধু একটা ভাবনার কথা নয় বরং বাস্তব হলো এই যে, এই বাড়ির মালিক মালকিন যারা কিনা তার বাপ-মা হয়, তারা সত্যিই তাকে চেনে না। অথচ বাপ যিনি জন্মদাতা আর মা যে কিনা তার সমস্তটা দিয়ে পেটে আশ্রয় দিয়ে বড় করে তুললো, সেও নাকি তার সন্তানকে চেনে না। কৈশোর পেরোনো বয়সে সেদিনের সে সন্ধ্যার কথা তার মনে পড়ে যেদিন, মা তার মৃত মানুষের মতো মুখ করে এবং তখন সামনে কোনো দৃশ্যমান শ্রোতা ছিলো না যেন অদৃশ্য কাউকে লক্ষ করে, বলেছিল অনুর চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। কী আছে যে এই চোখে কতবার সে আয়না ধরে দেখলো অথচ নিরীহ সারল্য ছাড়া সেখানে আর কিছু ধরা পড়ে না। তবে তার চোখে মা কিসের ছায়া দেখে কিংবা কিসের সংকেত যে দেখতে পায়, সে কথা খোলাসা করে কোনোদিন সে বললো না। আজ তাকে দেখে মায়ের চোখে কি সে ছায়াই জেগে উঠবে? না এতদিন বাদে তার সন্তানের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না!
ওপাশে তখন, কারও ভেঙে পড়া ঘড়ঘড়ে গলার আওয়াজ শোনা যায় মানে কখন যে সাত সতেরো ভাবতে ভাবতে সে আনমনে কড়া নাড়তে শুরু করেছিল! ওদিকে ভেতর থেকে কেমন ঘসঘসে শব্দ আসে বুঝি মাটি ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দরজা খুলতে আসছে কেউ, হয়তো সে তার জন্মদাতা। তারপর কড়কড়ে একটি শব্দ করে টিনের দরজাটা খুলে গেলে নুয়ে পড়া তার বৃদ্ধ জন্মদাতাকেই সে দেখতে পায় কিন্তু গলার ভেতর থেকে শব্দের কোনো উৎস সে খুঁজে পায় না। বৃদ্ধ জন্মদাতার তেমনি ঘড়ঘড়ে কণ্ঠ। এখন আর চোখে দেখে না আগের মতো, রাত্রি বেলায় সব মানুষের চেহারা একরকম মনে হয়। বলে, সাদা চুলের বুড়ো বাপটা তার কান খাড়া করে আবিষ্কারের চোখে তাকায়। তখন ছায়ার মতো দেহ নিয়ে তার মা পেছনে এসে দাঁড়ালে সে শীতের মতো দারুণ জড়োসড়ো হয়ে পড়ে কিংবা শামুকের মতো সমস্তটা তার ভেতরে গুটিয়ে যায়।
তারপর হঠাৎ করেই ভাঙা গলায় কয়, আমি অনু।
ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও মায়ের চোখ থেকে আবেগের উচ্ছ্বাস কমে না। জন্মদাতা কিছুটা নির্বাক। মা বুঝি শেষবারের মতো শুধায়, সত্যিই তোর কিছু হয়েছে কি না, বল অনু। নয়তো এতদিন বাদে বাড়ি এসেও তোকে এমন ম্লান দেখাচ্ছে কেন? অনু মলিন হেসে মায়ের সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে আগের মতো শুয়ে থাকে। আর মা, নিবিষ্ট মনে কত বছরের জমানো গল্প করে। অথচ মা এভাবে মন খুলে কখনো কথা বলেছে কি না কিংবা শৈশবের পরে ঘনিষ্ঠ মমতায় তার পাশে এত সময় বসে থেকেছে কি না, অনেক স্মৃতি হাতড়েও সে মনে করতে পারে না। শুধু এটুকুই নয়, মা এখন তার গল্পের প্রধান সময়টুকুই তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকছে আগে যেটা ব্যাপকভাবে দেখা যায়নি। তাহলে তার চোখে কি আগের সে ছায়া মুছে গেছে, যেটা দেখলে মায়ের ভেতরটা তুমুল গুটিয়ে যেতো। না মায়ের চোখের আলো কমে গেছে বলে সে ছায়া আর চোখে ধরে না। তার একবার ইচ্ছে হয়, মাকে সে কথা শুধায়, তার চোখে সত্যিই সে ছায়া আর দেখা যায় কি না। কিন্তু সেটা আর করা হয় না বরং সে নিজের ভেতরে আমূল সেঁধিয়ে যায় আর সময়ের কথা ভাবে। তখন তার মনে বৃষ্টিভেজা আয়নার মতো অস্পষ্ট জীবনানন্দের মুখ ভেসে ওঠে আর মগজে ঘোরে এক অতৃপ্ত পঙ্ক্তি— জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। সেটা সত্যিই নাকি যে, সংক্ষিপ্ত জীবনের জার্নিতে এ এক দীর্ঘ সময় বটে, যে সময়ের ভেতরে খোয়া গেছে কত কত অনুচ্ছেদ-অধ্যায়। আর চোখের ছায়া সেতো নমস্য, যে বিষয়ে কখনো স্পষ্ট প্রমাণ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবু তার মনে আর সান্ত্বনা আসে না এবং এ বিশ্বাস তার মনে পাকা হতে শুরু করে যে, সে সত্যিই ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে। এবং সে কথা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বিশ্বাস নিয়ে মনে জেগে উঠতেই পৃথিবীটা তার কাছে ছোট কমলালেবুর মতো হয়ে আসে। তখনো তার মা কী সব জটিল গল্পে মজে থাকে আর জন্মদাতার ছায়া তখন আর ঘরময় ঘুরতে দেখা যায় না। তার মনে হয় এখন একটু শান্তি দরকার পানাঢাকা পুকুরের মতো শীতল শান্তি।
সে বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখনো বুঝি রাত প্রথম প্রহরের ঘোর থেকে বের হতে পারেনি। রূপার থালার মতো চাঁদখানা বেশরমের মতো ঝকঝক করে ভিন্ন জগতের কথা বলে যায় আর অনেক অনেক দূরে কোনো উৎসব বুঝি হয়—এদিকে তেমনি শব্দ আসে। হয়তো তখনো তার করোটিতে ঘুম পুরোপুরি জমতে পারেনি। তাই দূরের উৎসবের শব্দ তার কানে আসে কিংবা আধো ঘুমে সে স্বপ্নের আজব রাজ্যে চরে বেড়ায়। তখন ফকিরের মতো বেশে অলস দেহখানা টেনে টেনে সে চেনা এক বাড়ির প্রধান ফটকের কড়া নাড়ে, ঝাঁকায়। তারপর কোথাও কারও আওয়াজ তার কানের ভেতরে তুমুল আছড়ে পড়লে আধো ঘুম স্বপ্ন, সব টুটে যায় আর তখন সত্যিই তাদের ফটকের ওপাশ থেকে কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া যায়। হয়তো রক্তের কেউ, নয়তো পাড়া-পড়শী ভেবে সে পাশ ফিরে শুলে ফটকের ওপাশ থেকে অচেনা নাম ধরে ডাকতে শোনা যায়। দিতি তাহলে কে, যার নাম ধরে এমন উৎকণ্ঠাভরে ডাকা হচ্ছে এবং এ নামের কারুর কথা এ তল্লাটে শোনা যায়নি। তখন মায়ের কণ্ঠে দারুণ বিরক্তি ঝরে পড়তে শোনা যায় আর জন্মদাতা ধমকে উঠে ততক্ষণে বুঝি ফটকের দিকে আগায়। এসব দৃশ্য আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে থাকলে, দুচোখের পর্দা ভোরের কুয়াশার মতো ঝাপসা হতে থাকলে ঘুমের জার্নি পুরোপুরি তাকে অধিকার করে বসে। কিন্তু এখানেও নিরপদ্রব কিছু হয় না বলে হুট করে আবার স্বপ্ন এসে হানা দেয়। এখানে, চরাচরজুড়ে যখন জোসনাজলে বেআব্রু মাখামাখি, তখন মাঠ-ঘাট পেরিয়ে সে জোসনা খুঁজতে বের হয়। সে যে কত মাঠ-ঘাট পাড়ি দেয় কখনো যেন সমুদ্র নদী আর সবুজ জলের ঝিল, কিন্তু কোথায় যে তার শৈশবের মাঠ-ঘাট, কাউনের বন, বিকেল বেলার উৎসব, যেখানে গেলে দুমুঠো জোসনা পাওয়া যায়। অথবা হঠাৎ করে, দীর্ঘ ও ঘন কাশবনের ভেতরে বালিকা বয়সের কাকে দেখা যায়, চেহারা যেন অবিকল তার মা, তারে দেখে দারুণ মমতায় ছুটে এসে মুঠোস্তন তুলে ধরে কয় খোকা খা। সে যেন কোথায় ছুটে চলছিল যেন কিসের আশ্রয়ে, শৈশবের মাঠে-ঘাটে দুমুঠো জোসনায়, সে ভুলে যায় আর কখন যে শিশু হয়ে ধুলোয় গড়াগড়ি যেতে লাগে, কোত্থেকে ছুটে এসে কিশোরী মা তাকে কোলে তুলে নেয়। কিসের আর অপেক্ষা, তখন সে কিশোরী মায়ের বুক থেকে কাপড় সরায় আর দেখে স্তন যেন কত যুগের আলোর ফোয়ারা, তার চোখ ধাঁধিয়ে গেলেও সে উৎসব অনুভব করে মুখ বাড়ায়। তখন মায়ের স্তন থেকে আলোর ফোয়ারা ম্লান হতে থাকলে হঠাৎ ঘুমটা বুঝি ছুটে যেতে থাকে আর সে দারুণ বেদনায় ডুবতে ডুবতে পুরোপুরি জেগে উঠে দেখে ভোর হয়েছে। তার জানালা দিয়ে ভোরের প্রথম ভাগের রোদ এসে মেঝের ওপরে ফালি ফালি সোনার মতো ছড়িয়ে আছে। তার ভেতরটা কেমন হাল্কা বোধ হয় আর সে বেদনা, যেটা সে একটু আগে মরণের মতো অনুভব করেছিল, সে বেদনাও উড়ো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সম্ভবত পাশের বাড়ি থেকেই একখানা দারুণ দুঃখের মিউজিক বেজে চলছিল, তাতেও তার মনের ভেতরের উচ্ছ্বাস কমে না। তারপর সে কতক্ষণ এমনি এমনিই শুয়ে থেকে, কিংবা দীর্ঘস্বরের দুঃখের মিউজিক শুনতে শুনতে একটি টিকটিকির শিকারের কৌশল দেখে সে বিছানা থেকে উঠে চোখের পিচুটি ডলতে ডলতে বের হয়ে আসে। মা তখন হেঁসেলে মশলার ঝাঁঝে আকস্মিক সর্দির প্রভাবে আঁচল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে তার দিকে চোখ পড়লে মধুর করে হাসে। সেও একটু হাসে যেন কতদিন পর, রান্না ঘরের দরজার কাছে চেয়ার পেতে বসে। তারপর সে দেখে ভেতর থেকে তার ঝর্ণার মতো কল কল করে কথা বের হয়ে আসছে। যেন কতদিন পর, এমন প্রাণ নিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, মমতার বাটিতে করে গরম গরম পুঁটিমাছ ভাজা খেতে খেতে রাতের কথা মনে পড়লে সে দিতির কথা জিগ্যেস করে। সে তবে কে আর তারে অমন করে ডেকেছিল কে?
তাদের বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে হবে যেখানে আছে পুরি নামক সামান্য এক বাজার। যেটা কিনা সারারাত ঘুমিয়ে থাকার পর সূর্যের সঙ্গে একটু একটু করে জেগে ওঠে কিন্তু তখনো, সবজি বাজারের ভাঙা মেঝেয় কিংবা মনি ঘোষের দোকানের বারান্দায় পড়ে ঘুমোয় মৃতের মতো এক প্রাণ। সামান্য এ বাজারের পড়শী গ্রামের সবাই তার ক্যারেক্টারের কথা জানে বটে, কিন্তু কয়েক মাস হলো আবির্ভাব হওয়া মাথা বিগড়ানো মানুষটার নাম কেউ এখনো জানতে পারেনি। তবে সবজি বাজারের ভাঙা মেঝেয় কিংবা মনি ঘোষের দোকানের বারান্দায়, তার ঘুম আর দীর্ঘ হওয়ার উপায় থাকে না, যখন সকালের বাজার গমগমে হয়ে ওঠে আর দুধের শিশুদের চে আরেকটু বড়োরা হুল্লোড় করতে করতে মর্নিং স্কুলে ছোটে। কখন যে ঘুমোতে যায় এই লোকটা সারারাত প্রায় ডিউটি দিয়ে শেষে সেটাও কোনোদিন কারও নজরে পড়েনি। সারাদিন তাকে বাজারের এখানে ওখানে দেখা গেলেও সন্ধ্যার পর রাত আরেকটু গাঢ় হলে মানুষজন যখন রাস্তা-ঘাটে কমে আসতে থাকে, তখন সে বের হয়ে, পাশের কোনো এক গ্রামে এসে মানুষের দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ে আর দিতি বলে ডাক পাড়ে। প্রথম দিকে, যখন তার আবির্ভাব হয়, তখন এই ডাক শুনে মানুষের অন্তরে আউলা বাতাসে উঠতো, ঘন হয়ে কান্না আসতো; হায়। দিতি কি তাহলে তার বউ; যুবক বয়স যাদের আর যে সমস্ত বিবাহিতের গত হয়েছে বউ, তারা দিতি নামের মানুষটিকে তার বউ বলেই দৃঢ় মত দেয়, যাকে হয়তো হারিয়েছে কোনো দুর্যোগে। কিন্তু থৈ থৈ মায়া আর কতদিন জিইয়ে থাকে, তখন রসিকথা খুঁজতে গিয়ে মানুষজন তার বউয়ের পরকীয়া করে বের হয়ে যাওয়ার ঘটনা রটায়। বয়সীদের বাইরে দুয়েকজন মানুষ শুধু, আর বুড় বয়সে আদরের কন্যা হারানো আতা হক, যারা বিশ্বাস করে দিতি তার কন্যাই হবে, যে ছিল নিশ্চয় বড্ড আদরের আহ্লাদের।
কিন্তু এসব শোনার পর, একটা সরু কীট যেন অনুর গলা বেয়ে নিচে নামতে থাকে অনবরত এবং দেখা যায়, বুকের ভেতরে কমলালেবুর আকৃতির ভার চেপে বসেছে। তবে একে নিয়েই দু’কথা লেখা যাক; ভাবতে গিয়ে সে চরিত্রের বেদনার জটিলতা সম্পর্কে দিশা খুঁজতে গিয়ে কোনো কিছুর আর ঠাহর করতে পারে না। এই তো ভোর বেলা হলো যখন সে ঘুম থেকে জেগে উঠতে উঠতে মেঘের মতো ফুরফুরে হয়ে উঠলো যেন পৃথিবীর গায়ে কোনো ক্ষত নেই। আর এখন কী এক গল্প শুনে মুখোশ যেন সরে গেলো আর সত্যিকারের সুরতখানা বের হয়ে পড়লো। সে তবে আগের মতো আর কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারেনি। সত্যিই এখন এক দারুণ দুঃসময়; তবে ফুরিয়েই গেলো! অথচ এখনকার এই বিধ্বস্ত শিল্পমানস রাজার মতো তুমুল সতেজ ছিল সে বেশি দিনের কথা নয়। শিল্পপাড়ার রাঘব বোয়ালদের কথা বলা যায়, যারা তাকে প্রশংসা করে পেজের পর পেজ ভরালো শুভেচ্ছায়। যেটা এক দারুণ সফলতা বটে আর সেটা তো বেশ্যার মতো এমনি এমনিই ধরা দেয়নি। বরং সে নিজের সমস্তটা দিয়ে সমর্পণ করেছে এবং শিল্প তো প্রথমত এবং শেষ পর্যন্ত দাবি করে এই সমর্পণটাই। আর তার কারণে যেটা হয়েছে, সমাজের চোখে সেটা দারুণ ঘিনঘিনে অস্বস্তিকর; বাবা-মায়ের সঙ্গে মতের মিল হয়নি দেখে সে ঘর ছেড়েছে। জীবনটা যে চলে গেলো কুড়ি কুড়ি বছরের পার তবু, তার সংসার করা হয়ে ওঠেনি। তবে শিল্প আর কী দাবি করে; একটি জীবনের সমস্তটা পেয়েও যেখানে দেওয়ার মতো আর কোনো প্রিয়-অপ্রিয় কিংবা গোপন অনুষঙ্গ বাকি নেই!
বন্ধুরা, অথবা তার প্রতি শুভাকাঙ্ক্ষী যারা, তাদের অনেকে বলে, মনের ভেতরে দারুণ অস্থিরতা নাকি ঘটিয়ে থাকতে পারে দুটো ঘটনা। তার একটা হলো তখন, যখন শিল্প হবে না, হোক তা লেখা-জোকা অথবা প্রতিমা গড়া। অন্য ঘটনা হলো তার বিপরীত সত্য; দারুণ সব সৃষ্টি হবে এবং দিন শেষে মনে হবে এসব হয়তো দৈবঘটনা। এখন, এসব কথা আবার মনে হলেও প্রসঙ্গটা তার অপ্রিয় মনে হয় না, বরং ডুবুরির মতো ডুবে, গোপন অসুখের মতো কোথায় অস্থিরতা বাসা গাড়লো তার খোঁজ করে। কিন্তু বাসাটা যে কোন অতল তলে সেখানে বুঝি আর পৌঁছনো যায় না। অবশ্য কেউ কেউ বললো, এসব থেকে বের হয়ে কয় দিন নিরালায় কোথাও সময় কাটাও। হয়তো পাহাড়ে, চূড়ায় উঠে দেখো পৃথিবী কত বিশাল, যারে কমলালেবুর মতো ভেবে থাকো, আর নীলিমা, আদতে যেটা শূন্য, তবু মনকে কেমন বিশাল করে দেয়। অথবা সমুদ্রের ধারে, সেখানকার বিস্তৃত নীলিমা নাই বা দেখো, কিভাবে বয়ে এসে মাথাকুটি করে বড় বড় ঢেউ দেখো। দেখো শুধু একটা শামুক, যেটা কিনা মহাবিশ্বের মতো দেখতে যে কমলালেবু, তার মতো ছোটো। তবু বিশাল সমুদ্র থেকে, প্রতাপশালী ঢেউ থেকে বের হয়ে এসে সূর্যের উত্তাপ সয়ে দীর্ঘ উপকূলে দাগ ফেলে চলে যায়। অথবা শৈশবের পাঠ্যবইয়ের ছবির মতো গ্রামে, যেখানে সবাই মিলে মিশে থাকে আর বোশেখ মাসে হাঁটুজল থাকা নদী এঁকে-বেঁকে চলে, হেমন্তে সন্ধ্যায় কুয়াশার নবান্নের উৎসবে ঘ্রাণে চারিদিক ম ম করে।
তারপর সে সত্যিই বের হয়ে পড়েছিল প্রথমে সমুদ্রে, পাহাড় হয়ে বন-অরণ্যে এবং কোথাও কোনো প্রশান্তির ছোঁয়া না পেয়ে শেষে এসেছে গ্রামে, তার শৈশব কৈশোর এবং প্রথম প্রেমের স্মৃতির মতো যে গ্রাম। কিন্তু এখানে, মাতৃছায়ার আঙিনায় এসেও ভেতর থেকে অন্ধকার ছায়া আর কাটে না। আসলে গভীরে, গোপন কি অসুখ লোভীর মতো সেঁধে বসেছে, যা তার আর আগের মানসটি অটুট থাকতে পারেনি। হায় কতদিন হয়ে গেলো, সারাদিন সে মনের ভেতর কথা সাজিয়ে রাতভর টেবিলে বসে থেকেছে টাইপরাইটারে, তবু মনের মতো দুটো লাইন সে গুছিয়ে উঠতে পারেনি। অথচ জীবনটা তার সমর্পিত হয়ে আছে এখানেই। এর বাইরের যাপনটা কি তবে মৃতের মতো অথর্ব নয়!
বুঝি তার কান্না আসে এবং মহাবিশ্ব সমান ভার নিয়ে সে কখন যে মায়ের পাশ থেকে উঠে আসে আর বাড়ির পেছন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখে সূর্যটা পুকুরে পড়ে আগুনের বলের মতো এদিক ওদিক শুধু দৌড়ায়। কয়েকটি সংকীর্ণ জলের মাছ মহাসমুদ্রের কথা ভেবে পিঠ উল্টিয়ে এক হাত লাফ দিয়ে শুধু রোদের দেখাটুকু পায়। আর অনু পুকুরপাড় ছেড়ে এসে ছোট একটি জংলা পেরিয়ে হরিতকি বাগানে ঢুকতে ঢুকতে, উত্তরপাড়ার হরিহর দাসের আঙিনা থেকে কুণ্ডুলী পাকিয়ে সাদা ধোঁয়া উড়তে দেখে সে দাঁড়ায়; ধোঁয়া উড়ছে মানে নিছক সেটা ধোঁয়া নয় কিংবা, সরল সাদা কোনো বস্তুও নয় বরং তার নিচে আছে সুপ্ত এমন আগুন, যার ক্ষমতা আছে জগৎটারে ছারখার করে দেওয়ার। ভেবে তারপর, আপন হৃদয়টারে সে সুপ্ত আগুনের আকর কল্পনা করতে করতে হরিতকি বাগান পেরিয়ে, দক্ষিণপাড়ার আঙিনা আর অলি-গলি মাড়িয়ে সে মেছোবাজারে এসে ওঠে। ততক্ষণে লোক জমেছে বটে; ক্রেতারা চকচকে পণ্যের লোভে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে আর বিক্রেতারা দীর্ঘ গলায় হাঁক ছাড়তে ছাড়তে মুখে ফেনা তোলে। কয়েকটা চঞ্চল মাছ, জলাশয়ে পড়ার প্রত্যাশায় ডেকচি থেকে তুমুল লাফিয়ে উঠে খোয়া ওঠা সড়কে পড়লে পথ খুঁজতে খুঁজতে ড্রেনে গিয়ে পড়ে। অনু তখন মেছোবাজার ছেড়ে, মাংসের বাজারের বীভৎস গন্ধ সয়ে কাচাবাজারের সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধ একটা মুদি দোকানের বারান্দায় তাকে পেয়ে যায়। এই হেমন্তে শীত শীত সকালেও সে আধ নেংটো কিন্তু সমস্ত শরীরে তার বিশ্রী রকমের সাদা-কালো ঘন লোম বলে নগ্নতা অতটা চোখে ধরে না। লোকটা, যে কিনা রোজ রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিতির সন্ধান করে আর মানুষ মূলত যাকে পাগল ঠাহর করে, সে আসলেই সাদামাটা পাগল কি না, অনু ভাবতে ভাবতে হাতড়ায়। যেহেতু পাগলের ভেতরে জেগে আছে গভীর এক যাতনা, হতে পারে কী বরং সেটাই হয়তো বা সত্য যে গভীর সে যাতনার উপশম খুঁজতেই সে রোজ রোজ দিতিরে তালাশ করে। কিন্তু তারে তো আর পাওয়া যায় না এবং অনু জানে যে, গভীর যাতনা কত রকম ভার নিয়ে আসে-যায়, ভেতরটা কেমন শূন্য করে দেয়। তখন লোকটার প্রতি দারুণ মায়া হয় তার কিন্তু দিতির খোঁজ সে জানে না বলে মনের ভেতরে করুণ শোকগাথা তৈরি হয়।
আমি অন্তত তোমার জন্য দু’লাইন লিখতে পারি; বলে সে নিজেই দারুণ অবাক হয়ে যায় আর ততগুণ মুষড়ে পড়ে। তার সঙ্গে আসলে কথিত পাগলটার কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই যেহেতু, তাই দুজনই চরম কিছু হারিয়েছে অথচ কোনোদিকে তার সন্ধান নেই।
তাদের পৃথিবীতে আবারও সন্ধ্যা নামে। আর হেমন্তের লাল সন্ধ্যার কুয়াশায়-শীতে চারিদিক কেমন মায়া মায়া হয়ে যায়। আর সমস্ত বিকেল সে শীতের মতো দারুণ জড়োসড়ো হয়ে মুখগুঁজে পড়ে থেকে যখন উঠে আসে বাইরে, তখন বাড়ির ঝিঁঝিঁরা সন্ধ্যা মাতানোর তালে সুড়ঙ্গের মুখে এসে থির হয়েছে। রান্নাঘরে মায়ের লাল মুখ তারুণ্যের মতো সতেজ দেখা যায় আর জন্মদাতাকে সারা বিকেলে বাড়ির চারদেয়ালের ভেতরে সাড়া পাওয়া যায়নি। সে সন্ধ্যায় সে মনের ভেতরে আর দারুণ কিছু অনুভব করে না বরং কান্নার মতো দেহ নিয়ে সে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসে।
এ যে নিদারুণ করুণ সময়, দেহে প্রাণ আছে কিন্তু মৃতের মতো অসাড়। পাগলটার ভেতরে তবু চঞ্চলতা আছে, ভেবে সে আবার আধো আধো সন্ধ্যায় পুকুর পাড় ধরে হরিতকি বাগান পেরিয়ে, দক্ষিণপাড়ার আঙিনা আর অলি-গলি মাড়িয়ে সে বাজারের পাশে বুধপাড়া আসে। সেই শৈশবে কয়েকবার এসেছিল দারুণ কৌতূহলে লুকিয়ে, যদিও তখন নিষিদ্ধ কিছু এপাড়ায় চোখে পড়েনি। আরেকটু বড় হলে অবশ্য বুঝে এসেছিল নিষেধের কী বিষয়-প্রকরণ, হরিজন পল্লীর এ পাড়ার সবাই নাকি নেশা করে বাঁচে। কিন্তু এখন, ক্রেতা হিসেবে এসে সে আর দিশা খুঁজে পায় না বলে অন্ধকার এক গলির ওপরে দাঁড়িয়ে ইতিউতি তাকায়। জায়গাটায় যেন কেমন এক অ্যালকোহলিক আবহ তৈরি হয়ে আছে; মগজের ভেতরে ঘন কিছু নড়াচড়া করতে করতে চেপে বসার তাল ধরে। যদিও এখান থেকে দৃষ্টি বেশিদূর ছড়িয়ে দেওয়া না। আধো অন্ধকারে কুয়াশায় খুব কাছেই লাগোয়া ঘুপরি ঘরের সার চোখে পড়ে। কয়েকটি খুপরির ফাঁকফোঁকর গলে টিমটিমে কিছু আলো লম্বা ও সরু হয়ে বের হয়ে এলেও একটি শিশুর কান্নার মতো (সম্ভবত বিড়ালের কান্না কিংবা বিশেষ সময়ের ডাক) থেকে থেকে একটি শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ শোনা যায় না। শৈশবের শোনা সে কথাই তবে সত্য এবং এখন বুঝি সবাই দারুণ নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। কিন্তু এখন সে যে কোথায় যায়; ভাবতে থাকলে দারুণ অসহায় অনুভব করে। তখন হঠাৎ, যখন সে কোনো এক খুপরিতে ঢুকে পড়বে ভাবে, সে সময়ে পেছন থেকে কোমর বাঁকানো এক বুড়ি এসে—এই যে সাহেব, বলে গোপন ইশারা করে।
ছোটো একটি কুঁড়ে তাতে অসবাব বলে তেমন কিছু নেই শুধু বিছানার কোনায় জড়োসড়ো কিন্তু হাসি হাসি মুখে বসে থাকে এক উঠতি কন্যা। সে অবশ্য সেসব দেখতে চায় না বরং দেখে কেমন কৌশলে বুড়ি নেশার বোতল খুলে কাচের পেয়ালায় তরল ঢালে। তারপর অনু, দুয়েকবার সখ করে বিদেশি মদ খাওয়া জনপ্রিয় লেখক সাজিদ অনু, দারুণ দুঃখে বিষের মতো দেশি মদ গেলাসের পর গেলাস গলায় ঢালতে ঢালতে ভাবে; তবে দারুণ হতো, যে মৃত্যুর ভেতরে সে ডুবে গেছে, তারচে কিঞ্চিৎ সহজ মৃত্যু হলে।