আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে শোভনের করলাভাজি, সামান্য ঘি, লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। তার এমন ইচ্ছা হওয়ার পেছনের গল্পটি লিখেছে তার স্ত্রী পিয়া। সকালবেলা করলাভাজি আর ঘিয়ের স্বাদ স্বাদ গন্ধে শোভনের ঘুম ভেঙেছে। এখন তো এসব খেতে ইচ্ছা হবেই। শোভন বিছানা থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে ব্রাশ করলো। ছুটির দিনের মোলায়েম বোধ তার শরীর ও মনে ছড়িয়ে গেলে বারান্দায় চেয়ারে বসে গ্রিন টির মগে চুমুক দেয়। গতরাতে পিয়াকে একটু বেশিই মোহনীয় লাগছিল। কেমন যেন অচেনা-অচেনা। সকালে উঠে শোভনের মনে হলো যে পিয়া রান্নাঘরে কাজ করছে, তার সঙ্গে যেন গতরাতের পিয়ার কোনো মিল নেই।
মনে যখন এমন সুরভিত গুঞ্জন চলছিল, এমন সময় তার কাছে একটা ফোন এলো। ফোনটা রিসিভ করার পর সে নিজের ভেতরে অস্থিরতা বোধ করতে থাকে। তাকে ফোন করা হবে কেন! এটা ভাবতে পারে না যে, এইরকম সুন্দর সময়ে এমন একটা ফোন না এলে কী হতো! শুধু ভাবতে থাকে তাকে কেন ফোন করা হলো! সে এখন সোমার কে হয়! ফোনের ওপাশের নারীকণ্ঠ বললো সোমার ফোনের ডায়াললিস্টে প্রথমেই তার ফোন নম্বর ছিল। তাই গুরুতর আহত সোমার খবর জানানোর জন্য তাকে সে ফোন দিয়েছে। অথচ সোমার সঙ্গে তার গত চার বছরে একবারও কথা হয়নি।
ফোনটা এসেছিল সোমার সেই পুরনো নম্বর থেকেই, সে অবাক হয়ে দেখলো—এই নম্বরটা তার এখনো মুখস্থ। তাই ফোনের স্ক্রিনে যখন নম্বরটা ভাসলো মুহূর্তেই শোভনের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল। ধরবে না ধরবে না করেও শেষ সময়ে সে ধরে ফেলেছে। ফোনের ওপারে অন্য কারও গলার আওয়াজ শুনে ধাতস্ত হতে কিছুটা সময় লেগেছে তার। তখনো সে বুঝতে পারেনি যে, তার জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছে।
সোমার ফোনের ডায়াললিস্টে প্রথম নম্বরটা তার! শোভন তার ফোনের রিসিভলিস্ট বারবার চেক করে। কোনো ফোন তো আসেনি। এমনকি গত চার বছরেও না। ফোনের ওপাশে থাকা অপরিচিতার গলায় বিষাদ ও তাড়াহুড়া ছিল। তিনি কোনো একজনের কাছে সোমার দায়িত্ব দিয়ে বাড়ি যেতে চান। তিনি নিজেও নাকি আহত। তারা একই বাসের যাত্রী ছিল। পাশাপাশি সিটে বসে তারা নাকি গল্প করতে করতে যাচ্ছিল টাঙ্গাইল। মধুপুরে এসে একটি বাসের ধাক্কায় তাদের বাসটা উল্টে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও সোমা নাকি হাসছিল। মাথায় আঘাত লেগে সোমা তার সিট থেকে ছিটকে গিয়েছিল। জানালার পাশের সিটে থাকায় তার মাথায় একটু বেশিই আঘাত লেগেছে। অ্যাক্সিডেন্টের আধঘণ্টা পর ওখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেড় ঘণ্টা পরও রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না।
শোভন চায়ের মগটা বারান্দার রেলিংয়ের ওপর রেখে মানিব্যাগটা নিয়ে বাইরে বের হয়। সে এখন মধুপুর যাবে। বাস অ্যাক্সিডেন্টে গুরুতর আহত সোমা রহমানের সে কেউ নয় ঠিকই। তাই বলে সোমার বিপদে সে যাবে না! চার বছর আগেও এই সোমা তার অনেককিছু ছিল! বলতে গেলে তার সবকিছু।
হাওর এক্সপ্রেসে চড়ে শোভন আর সোমা অনেকবার সুনামগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছে। শেষবার যখন গেলো তখন যাওয়ার সিদ্ধান্ত খুব তাড়াহুড়ায় হয়েছিল। ঢাকা শহরের জ্যাম আর রেলস্টেশনের ভিড় ঠেলে যখন ওরা ট্রেনে উঠে নিজেদের কামরায় গিয়ে বসলো, তখন শোভনই প্রথম খেয়াল করলো যে, সোমা দুই পায়ে দুই রকম জুতা পরে চলে এসেছে। দুজনে হাসতে হাসতে সেদিন সেই কামরায় লুটিয়ে পড়েছিল। সোমার চোখ ভিজে উঠেছিলো। একটু বেশি হাসলে ওর চোখ ভিজে উঠতো। হাসতে হাসতে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতো সে। এখনো সোমা ওরকম করে হাসে কিনা, শোভন বহুদিন জানতে চায়নি।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রথমে মহাখালী যেতে হবে। কার্তিক মাসের মিষ্টি সকালেও বাসে বসে শোভন ঘামছে। ফোন বাজছে। পিয়ার ফোন। খেয়াল হলো পিয়াকে সে বলে আসেনি। কী বলবে, তাও মাথায় আসছে না। মধুপুর যাচ্ছে জানলে পিয়া তার কাছে সেখানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইবে। সত্যি বললে রেগে যাবে নিশ্চয়। তার দ্বিধায় আড়ষ্ট আঙুল ফোনকল কেটে দেয়।
রাস্তাঘাট ফাঁকা। শোভন মহাখালী পৌঁছে মধুপুরের বাসে চড়ে বসেছে। তার মনে হলো সে অনন্তকাল ধরে বাসে বসে আছে। তার পেছনের সিটে বসে থাকা মাঝবয়সী লোকটাকে ধমকের স্বরে বলে ওঠে—এত চিৎকার করছেন কেন? আর্শ্চয! ধমক খেয়ে লোকটা উঁচু গলায় ফোনে কথা বলা থামিয়ে কটমট করে তাকায়।
এক মাঘের সকালে অপরাজেয় বাংলার সামনে সোমার সঙ্গে শোভনের প্রথম আলাপ হয়েছিল। খুব সাধারণ চেহারার মেয়ে সোমা। তার সঙ্গে সাদামাটা কথা বলতে বলতে সেই সকালটা দুপুরে গড়িয়েছিল। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ। হঠাৎ করেই সাভারের বাসে উঠে বসেছিল ওরা দুজন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বটতলায় নানারকম ভর্তা-ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়ার উদ্দেশ্যে। শাহবাগ থেকে সাভার যেতে যেতে বাসে বসে রাজ্যের গল্প করেছিল ওরা। জানালা দিয়ে বাতাস এসে সোমার খোলা চুল এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছিল। সেদিন তার মন অদ্ভুত মাদকতায় কতটা এলোমেলো হয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে।
হর্নের কর্কশ শব্দ শোভনের কানে বাজে। আজ মধুপুর যাওয়ার পথেও কোনো যানজট নেই। শোভন একটা মূর্তির মতো তার সিটে বসে থাকে। মাঝে মাঝে বাসের জানালা গলে বাতাস এসে তার গায়ে লাগে। তার পেছনের সিট থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ক্রমশ বেড়ে চলে। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে—এগারোটা বেজে ছাব্বিশ মিনিট। শোভন চোখের চশমা খুলে আবার পরে। কখনো ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাম হাতের আঙুল ঘষে। আবার কখনো বা হাতের আঙুল দিয়ে ডান হাতের আঙুল ঘষে।
সাড়ে বারোটা নাগাদ শোভন যখন হাসপাতালে পৌঁছে তখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মানুষের ভিড় ঠেলে সে হাসপাতালে ঢুকে যায়। সোমার নম্বরে ফোন করে। এবার ফোনের ওপাশে এক পুরুষকণ্ঠ—কাকে চাচ্ছেন?
এই কণ্ঠস্বর শোভনের অপরিচিত নয়। বরং অতি পরিচিত। যে পরিচয় সে গত চার বছর ধরে ভুলে যেতে চেয়েছে। এই পরাগের প্রতি তার বন্ধুত্বের হাত সে গুটিয়ে নিয়েছে। কী কথা বলবে আজ শোভন! তার মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শিরশির করে ওঠে। বিস্ফারিত চোখে সামনের দিকে তাকায়। তার ডান হাতের বাধ্য আঙুল মুহূর্তেই ফোনকল কেটে দেয়। হাসপাতালের গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করে। এক্ষুণি তার ফিরে যাওয়া দরকার। হাসপাতালের গেটের বাইরে জমে থাকা কাদা ভেঙে সে হেঁটে যায়। তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। পিচঢালা রাস্তায় পৌঁছে তার হাঁটার গতি ধীরে ধীরে কমে আসে। ঝকঝকে রাস্তায় জনমানুষ নেই, হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুটা দূরপাল্লার দ্রুতগামী বাস পাশ দিয়ে চলে যায়।
একদিন চেরাপুঞ্জির রাস্তায় এইরকম বৃষ্টির ভেতর এমনই নীরব রাস্তায় ওরা হেঁটেছিল। তখনো মাস্টার্স শেষ হয়নি। শোভন জেদ ধরলো দুজনে মিলে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি দেখতে যাবে। ফাইনালের মাত্র চারমাস বাকি। কয়েকদিনের মধ্যে শোভন সব আয়োজন করে ফেললো, ওরা ছয়দিনের ট্যুরে চেরাপুঞ্জির পথে উড়ে গিয়েছিল।
এর কিছুদিন পরে টিএসসিতে এক সন্ধ্যার আড্ডায় আসতে বলার জন্য পরাগকে সে ফোন দিয়েছিল। পরাগ তার ফোন ধরেনি। এমনকি আর কখনোই তাদের ফোনে কথা হয়নি। সামনাসামনি দেখা হলেও পরাগ তাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল। শোভন ভেবেছিল, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো সোমার সঙ্গে শোভনের এই সম্পর্কের কথা জেনে পরাগ সহজে মানতে পারছে না। বিভাগের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও পরাগ সোমার চাচাতো ভাই হওয়ায় শোভন ওদের সম্পর্কের কথা তাকে বলতে পারেনি।
তারও মাস ছয়েক পর সোমা ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে গেছে। দুই দিন ওর ফোন অফ পেয়ে শোভন অস্থির হয়ে তাকে বারবার ফোন করছিল। হঠাৎ যখন সোমার ফোন আসে তখন অদ্ভুত গলায় সোমা শোভনকে যা জানায়, তার জন্য শোভন একদম তৈরি ছিল না। পরাগের সঙ্গে গতকাল নাকি সোমার বিয়ে হয়ে গেছে।
সোমার বাবা গত ছয়মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। ডাক্তাররা শেষ কথা বলে দিয়েছেন। এখন তিনি সোমার সংসার দেখে মরতে চান। বাসার এমন পরিস্থিতিতে এখন সোমার কোনো পছন্দ অপছন্দের কথা বলার সুযোগ নেই। হুট করে পরাগকে বিয়েটা তার করতে হয়েছে…
সোমার কাছ থেকে ফোনে এসব জেনে শোভনের ভেতরটা চিন চিন করতে থাকে। এসব কী হয়ে গেলো! হঠাৎ তার চারপাশের সবকিছু স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। তার চোখে সবকিছু নিজ নিজ সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলতে থাকে। এইসব আলাপ যখন চলছিল, তখন শোভন তার চাকরির ইন্টারভিউয়ের ওয়েটিংরুমে। চোখের সামনে একেকজন চাকরিপ্রার্থী ইন্টারভিউ রুম থেকে মুখ কালো করে বের হচ্ছে।
শোভন তার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো—তুমি এখন কী চাও সোমা?
আমি মাকে ধীরে ধীরে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। একটু সময় লাগবে। তাছাড়া পরাগভাইয়া তো সবই জানে…
বলতে বলতে ফোন কেটে যায়। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও শোভন আর সোমাকে ফোনে পায়নি। এরপর চার বছর কেটে গেছে।
ধীরে ধীরে পরাগ সব বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। একসময় বাধ্য হয়েই সোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছাটা শোভন নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছে। এমনকি নিজের কাছেও এই ইচ্ছাটা এখন অস্বস্তি বয়ে আনে। তাই বহুদিন কোনো চেষ্টা করেনি সে। কতদিন হলো সোমাকে একটা ফোনও সে করেনি। ফোনটা সে পকেট হাতড়ে হাতে নেয়। তখনই তার মাথায় হাজারটা চিন্তা খেলে যায়। সোমার ফোনের ডায়াললিস্টে তার নম্বরটা পেয়েছে সেই মেয়েকণ্ঠ। কিছুক্ষণের মধ্যে শোভন খেয়াল করে সে দৌড়াচ্ছে। উল্টো দিকে। যেদিকে হাসপাতাল। যেদিকে আহত সোমা। আচ্ছা, সোমার এখন কী অবস্থা!
এক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে শোভন আউটডোরে আসে। এখানেই বাস অ্যাক্সিডেন্টের সব রোগী রাখা হয়েছে। বেশি গুরুতরদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ মারা গেছে আর বাকিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শোভন একজন মাঝবয়সী নার্সের কাছে সোমার কথা জানতে চায়। নার্স তাকে জানায় সে তো এই অ্যাক্সিডেন্টের নতুন রোগীদের কারও নাম জানে না, শোভন যেন নিজেই খুঁজে দেখে। শোভন সারা হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে সোমাকে খুঁজতে থাকে। মিনিট দশেকের মধ্যেই সোমার মুখটা যখন শোভন দেখতে পায় শোভনের বুকটা ধক করে ওঠে। মুহূর্তেই সে তাকিয়ে দেখে সাদা কাপড়ে জড়ানো সোমাকে একটা মাইক্রোবাসে তোলা হয়েছে। পরাগকে সেই গাড়িতে উঠতে দেখা যায়।