অপেক্ষা। একটি মৃত্যু সংবাদের জন্য অপেক্ষা। এমন নয় যে, দিনের পর দিন মৃত্যু কামনা করতে হয়েছে, তবু মৃত্যু সংবাদটি না শোনা পর্যন্ত এই গল্প লেখা সম্ভব নয়। স্মরণাতীতকাল থেকে পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে, তার সবই একেকটি গল্প—আশ্চর্য সব গল্প। যে গল্পটি লেখা হবে বলে মনস্থির করা ছিল, সেটি অসাধারণ ঘটনাশ্রয়ী কোনো গল্প ভাবনা নয়, বরং এই আয়ু ক্ষয়ী পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ক্রম—ধারাবাহিকতার কণামাত্র। গল্পটি লেখার সিদ্ধান্ত প্রায় পাঁচ ছয় বছর আগে নেওয়া ছিল। এমন নয় যে, এত ছর ধরে গল্পটি সাজাতে বা এর ভাব-প্রকরণ নিয়ে কোনো দ্বিধা কাজ করেছে—না, ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। মৃত্যু সংবাদটি—যদি কখনো ঘটে; একজনকে দায়িত্ব দেওয়া ছিল, সে খবর পৌঁছে দেওয়ার। শুধু একজনের ওপর এই দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়নি। আরও একজনকে দায়িত্বটি দিতে হয়েছিল। এরপর অপেক্ষার পালা। যাদের দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছিল, তারা দু’জনেই গত রাত প্রায় পৌনে তিনটার দিকে ফোন করে জানিয়েছেন সংবাদটি।
ঘড়ি হলো সময়ের দাস, ঘটতে থাকা বর্তমানকে রুখে দেওয়ার ক্ষমতা তার থাকে না
জনাব লকিয়তুল্লা, আপনার গ্রামের নাম কি বাবুপুর? চান্দলাই ইউনিয়নের বাবুপুর? পরিচ্ছন্ন উচ্চারণের এই শব্দগুলো লিফটের গুমোট বাতাসে ভর করে লকিয়তুল্লার কানে এসে ঠেকে। হঠাৎ ঘুম কেড়ে নেওয়া মানুষের মতো চমকে ওঠেন লকিয়তুল্লা। বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে-উঠতে লিফট আরও দুই ফ্লোর পার হয়ে আসে, মুখ তুলে তাকান লকিয়তুল্লা। লিফটের ভেতর বেশ কয়েকজন রোগী—পুরুষ-নারী। লকিয়তুল্লা বুঝে উঠতে পারেন না, কে বলল কথাগুলো। লকিয়তুল্লা এই হাসপাতালে কাজ করেন এর সূচনালগ্ন থেকে। লিফট ম্যান হিসেবে। এর চেয়ে ভালো কাজ পাওয়ার যোগ্যতা হয়তো লকিয়তুল্লা’র ছিল না। লিফটে একটি কাঠের টুল, সেই টুলে বসে ডিউটি করেন লকিয়তুল্লা। এই ওঠা নামা পথের যাত্রীরা অনেকে নিজেই গন্তব্যের সুইচে চাপ দেয়। দুই–চার–ছয়–আট; আট–ছয়–চার–দুই-নিচ তলা—এই চিরচেনা রাস্তায় চলাফেরা লিফটটির। দিনে আট ঘণ্টার ডিউটি লকিয়তুল্লার। লিফট ওঠে, নামে– লকিয়তুল্লা’র ঘুমের রেশ কাটে না। ইদানীং প্রায় ঝিমুনি ভাব এসে জড়ো হয় তার চোখেমুখে। পুরনো লিফটের দুলুনি—না, দুলুনিতে ঘুম আসে না, ঘুম আনে ডায়াবেটিস—মাত্রা বেশি হয়ে গেলে ঘুম আসে। বাগে আনতে পারেন না কিছুতেই, আনবেনই বা কিভাবে? আগের মতো নিয়ন্ত্রিত জীবন কি আর আছে লকিয়তুল্লার? ইনসুলিন নিতে নিতে পেটের চামড়া বিদ্রোহ করেছে, তার নিজেরও আর নিজেকে খোঁচাতে ইচ্ছা করে না। কিডনি দুটিও ক্ষয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস সর্বগ্রাসী। ডায়াবেটিসের কথা না শুনলে সে যাকে ধরে তাকে শেষ করে ছাড়ে। তবু লকিয়তুল্লার কোনো রাগ নেই ডায়াবেটিসের ওপর। এই রোগের জন্যই তো তার চাকরি পাওয়া। জোয়ান বয়সে অতিমাত্রায় পিপাসা, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, ঘন-ঘন প্রসাব—সেই সময়ে এই রোগ আর কে ধরবে? লকিয়তুল্লার এমন অবস্থা দেখে হুসেন ভাই প্রথম সন্দেহ করেছিলেন। ঢাকায় নাকি এই রোগ ধরার একটা নতুন হাসপাতাল হয়েছে। লকিয়তুল্লার বাপ বিঘা খানেক জমি বিক্রি করে ছেলেকে ঢাকা পাঠান। লকিয়তুল্লা বাড়ি থেকে রোগ ধরার জন্য ঢাকা আসেন, আসার সময় স্ত্রী ও তিন বছরের কন্যাকে নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য, ঢাকা শহর দেখানো। লকিয়তুল্লার রোগ ধরা পড়ে। চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু লকিয়তুল্লা তার জীবনের সবচেয়ে দামি সম্পদ হারিয়ে ফেলেন। সেই শোকে তিনি ঢাকা থেকে আর বাড়ি ফিরে যাননি। হাসপাতালের গেটেই দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করেন। তার ধারণা যেখান থেকে হারিয়েছে, সেখানেই ফিরে আসবে তার হারানো সম্পদ। আসেনি। হারিয়ে যাওয়া সম্পদ খুব কম সময় ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু চাকরি পেলেন। লিফট ম্যানের চাকরি। সঙ্গে ফ্রি চিকিৎসা। তার রোগের নাম টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস রোগ ধরা পড়লো ঠিকই কিন্তু নতুন রোগে আক্রান্ত হলেন লকিয়তুল্লা। এই রোগের নাম ‘মেয়ে হারানোর শোক’ রোগ। সেই থেকেই এই চাকরিটি আঁকড়ে রেখেছেন তিনি। ‘মেয়ে হারানোর শোক’ রোগ থেকেও মুক্তি পাননি তিনি। এই রোগ পুষতে পুষতে তার ঘরে আরও তিন জন এসেছে। বড় জন ছেলে, এরপর দুই মেয়ে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। পড়াশোনা করেছে। এই ব্যাপারটি লকিয়তুল্লার স্ত্রী রাহেলা বানু খুব ভালোভাবেই সামলে নিয়েছেন। দ্রুত তিনি বুঝে গেছিলেন, এই শহরে দু’ভাবে বড় হওয়া যায়। পড়াশোনা অথবা অসততা। লকিয়তুল্লার স্ত্রী প্রথমটিকেই সন্তানদের জন্য ঠিক হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছেন। বড় ছেলে ব্যাংকার, বেশ ভালো বেতন। ছোট মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে। মাঝেরটি স্কুল মাস্টার। তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। কাছেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। মেয়ে–ছেলে নিয়ে লকিয়তুল্লা এবং রাহেলা বানু বেশ আছেন। কিন্তু ‘মেয়ে হারানোর শোক’ রোগটা রয়ে গেছে। প্রথম সন্তান! ছেলে-মেয়েরা লিফট ম্যানের চাকরিটি ছাড়তে বলেছে। শোনেননি লকিয়তুল্লা। না ছাড়ার দুটি কারণ—এক, বারডেম, ডায়াবেটিসের মাত্রাতিরিক্ত সুগারের মতোই বারডেম তার রক্তে মিশে গেছে। এক অচেনা গ্রাম থেকে উঠে আসা অর্ধশিক্ষিত রোগীর অচেনা রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি চাকরি দেওয়া, এই ঋণ আমৃত্যু ভুলতে পারবে না লকিয়তুল্লা। অন্য কারণ, হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। এখান থেকেই তার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। ডায়াবেটিস তাকে দিয়েছে বাড়তি সুগার, বারডেম দিয়েছে চিকিৎসা কিন্তু কেড়ে নিয়েছে জীবনের সবচেয়ে দামি সম্পদ।
লিফট ততক্ষণে আট তলায় এসে পৌঁছেছে। রোগী—পুরুষ-নারী সবাই নেমে গেছে। ফাঁকা লিফটে আবার রোগী- পুরুষ-নারী উঠবে, নিচে নামবে—এই তো নিয়ম। সবাই নেমে পড়েছে কিন্তু একজন নামছে না।
লিফট আট তলায় এসে পড়েছে, আপনি কি নামবেন না? খানিকটা সন্দেহ নিয়েই কথাগুলো বলেন লকিয়তুল্লা। কথাগুলো বলার সময় লকিয়তুল্লা একবারের জন্য তাকালেন লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে, একটু ধন্দে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
জনাব লকিয়তুল্লা, আপনার গ্রামের নাম কি বাবুপুর? চান্দলাই ইউনিয়নের বাবুপুর? লকিয়তুল্লার মনোযোগ হোঁচট খায় আবারও। কিছুক্ষণ আগে এই কথাগুলোই লিফটের গুমোট বাতাসে খেলা করছিল। লকিয়তুল্লা খোঁজ করার চেষ্টা করেছেন, কথাগুলো কে বলেছে?
জ্বি। হোঁচট খাওয়া মনোযোগের দলাটাকে গিলে নিয়ে বলেন লকিয়তুল্লা। একবার চোখ তুলে তাকান, কে এই কথা জিজ্ঞেস করছে? একজন নারী, বয়স অনুমান অযোগ্য। কিছুটা ধোঁয়াশার ভেতর পড়ে যান লকিয়তুল্লা। এত স্বচ্ছ উচ্চারণে বাংলা বলছেন তিনি? কিভাবে? জিজ্ঞাসাটা লকিয়তুল্লার চোয়ালে ঝুলে থাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য।
যা কিছু ঘটে তার পুরোটা পৃথিবীর নখদর্পণে থাকে না
প্রস্তুতির হাওয়া জোরেশোরে বইতে আরম্ভ করেছে গত দেড় বছর ধরে। সোফি অ্যাডেনবার্গ তার স্বপ্ন পূরণে কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। এ ব্যাপারে যারা তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে, তারা পিটার অ্যাডেনবার্গ আর আগাথা অ্যাডেনবার্গ—সোফির বাবা-মা। সোফির বয়স যখন পনের যোগ তিন বা চার অর্থাৎ আঠারো বা উনিশ ঠিক সেই দিন থেকেই সোফি একটা প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করেছিল। একটা যাত্রার প্রস্তুতি, সুদীর্ঘকালের প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতি কখনো একান্তে নিজের ভেতরে ভেতরে চলেছে, কখনো সপ্রকাশে, কখনো অজান্তেই। প্রস্তুতি চলেছেই, এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। প্রস্তুতি চলেছে শরীরে, প্রস্তুতি মনে। ফলাফলের জন্য উদ্গ্রীব সোফি অ্যাডেনবার্গ, কিন্তু সেটা পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া নেই। বহু আকাঙ্ক্ষার ফলাফল। এখন সোফির বয়স ছাব্বিশ। কম কাঠখড় তো আর পোড়াতে হয়নি, কী না করেছে এর জন্য? প্রায় প্রতি উইকএন্ডে বাংলাদেশি দূতাবাসে গেছে সে, অ্যামস্টারডামের বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রায় সব মানুষের সঙ্গে মিশেছে, কথা বলেছে। বাংলাদেশে থেকে নতুন কেউ গেলেই তার কাছে গিয়েছে, তার সঙ্গে মিশেছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। এই প্রস্তুতিকালে সোফির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এক বাঙালি যুবকের। জাহিদ, বাংলাদেশ থেকে অ্যামস্টারডাম গিয়েছিল পড়াশোনার জন্য- এপ্লাইড ফিজিক্স এ পোস্ট-ডক করতে। পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরিও হয় তার। দেখা হয়, মানে পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে না, আন্তরিকতাটা জাহিদের দিক থেকে যতটা না, তার চেয়ে বেশি সোফির দিক থেকে, ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। না, আহামরি কোনো গুনের কারণে নয়, তার একমাত্র গুণ, সে বাঙালি, বাংলাদেশি। বাংলাদেশি হতে পারাও তবে একটা গুণ? জাহিদও পছন্দ করে ফেলে সোফিকে। সোফি নেদারল্যান্ডসের নাগরিক বলে নয়, দুর্দান্ত সুন্দরী বলেও নয়—বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অসম্ভব আগ্রহ, বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে তার প্রবল ইচ্ছা, বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে তার অনেক জিজ্ঞাসা জাহিদকে ভাবিয়ে তুলেছিল, মুগ্ধ করেছিল। অ্যামস্টারডামে প্রত্যেক উইকএন্ডে বাংলাদেশি কম্যুনিটি একসঙ্গে আড্ডা দেয়। সেখানেই সোফির সঙ্গে জাহিদের পরিচয়। জাহিদের কাছে সোফি বাংলা শেখার আগ্রহ প্রকাশ করে। জাহিদ সানন্দে সোফির বাংলার শিক্ষক হতে রাজি হয়ে যায়। জাহিদ অনেক দিন জিজ্ঞেস করেছে বাংলাদেশ সম্পর্কে কেন এত আগ্রহী সোফি। সে বলেনি, বলেছে জাহিদের জন্য অথবা বলেছে পরে জানাবে। জাহিদ খুব ভালো করেই বুঝে গেছে জাহিদের জন্য সোফির বাংলাদেশপ্রীতি নয়। বন্ধুত্ব ক্রমেই সম্পর্কের দিকে গড়ায়। অ্যাডেনবার্গ পরিবারে জাহিদের যাতায়াত বাড়তে থাকে- অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় সোফির বাবা-মার সঙ্গে। সোফির বাবা-মা খুব ভালোবাসে জাহিদকে। জাহিদ অবাক হয়ে যায় তাদের আন্তরিকতায়। একদিন সাহস করে জাহিদ মিস্টার অ্যান্ড মিসেস অ্যাডেনবার্গকে জিজ্ঞাসা করে বসে, কেন সোফি বাংলাদেশ সম্পর্কে এত আগ্রহী। সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় জাহিদ। সোফির প্রতি তার বন্ধুত্বের শেষ বিন্দুটুকুও গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যায় ভালোবাসার দিকে। জাহিদ ভালোবেসে ফেলে সোফিকে। সোফি কি ভালোবাসে জাহিদকে? তা না বাসুন, সে যে বাংলাদেশকে এত ভালোবাসে, এর জন্যই সোফিকে নির্দ্বিধায় ভালোবাসা যায়।
আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। সোফি বলে, বলেই কাছে ঘেঁষে বসে জাহিদের। অফিস শেষে সোফির ফোন পেয়ে জাহিদ সোজা চলে আসে সোফির বাড়িতে।
বলো, কী বলতে চাও?—জাহিদ উন্মুখ হয়ে আছে সোফির মুখ থেকে কথাগুলো শোনার জন্য। কী বলতে চাই সোফি; বলুক।
জাহিদের আরও কাছে আসে সোফি, জাহিদের কাছে এই উষ্ণতাটুকুর মূল্য অনেক। জাহিদের ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে সোফি বলে, আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ, কেন নয়? অবশ্যই নিয়ে যাব। তোমার ভালো লাগবে বাংলাদেশে গিয়ে? জাহিদ সোফির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে কথাগুলো বলে। লাগবে, তুমি থাকবে না? সোফির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে জাহিদ। নেদারল্যান্ডসের একটি মেয়ে, যে বাংলাদেশকে ভালোবাসে, ভালোবেসে বাংলাদেশে যেতে চায়। জাহিদ সিদ্ধান্ত নেয় সে সোফিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসবেই।
তুমি আমাকে বিয়ে করবে? জাহিদের নিঃশ্বাসটুকু দখল করে নেয় সোফি। জাহিদ নিজেকে জিজ্ঞেস না করেই উত্তর দিয়ে দেয়, হ্যাঁ। বছর খানেক সময়ের ভেতর সোফি বাংলা শিখে ফেলে, সোফিকে শেখানো প্রথম বাক্য—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
অ্যামস্টারডামের আত্মা পোড়ানো দীর্ঘশ্বাস
জাহিদ? আমাকে তোমার দেশের পোশাক কিভাবে পরতে হয় দেখিয়ে দেবে? সোফি একটা প্যাকেট নিয়ে এবার জাহিদের পাশে বসে। প্যাকেটে কী? অত্যুৎসাহে জাহিদ ঝুঁকে পড়ে সোফির হাতে থাকা প্যাকেটটার দিকে।
এটা একটা শাড়ি—মুখে অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সোফি জাহিদের দিকে তাকায়।
শাড়ি! ওহ মাই গড, শাড়ি তুমি কোথায় পেলে? সোফির কাছ থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে প্যাকেটটা খুলতে উদ্যত হয় জাহিদ। প্যাকেট খুলে অবাক হয় সে, এ মেয়ে পাগল নাকি?
কোথায় পেলে তুমি এই শাড়ি? কে দিয়েছে তোমাকে? কার কাছ থেকে পেয়েছ?—বিস্ময়ের স্রোতে ডুবে যেতে যেতে আবার জেগে ওঠে জাহিদ।
আমি, আমি এটা এনেছি মিসেস রহমানের কাছ থেকে—জাহিদের মুগ্ধতা আর বিস্ময় মিলিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়। কে বলে শুধু বাঙালি মেয়েরা লজ্জা পেলে তাদের দেখতে সুন্দর লাগে? সুদূর নেদারল্যান্ডসে বসেও জাহিদ দেখছে এক নারীর লজ্জাবনত মুখ, আরক্তিম। যেন শেষ বিকেলে সূর্যের আভা সূর্য নিজে এসে মাখিয়ে দিয়ে গেছে সোফির সারাগায়ে।
শেখাবে আমাকে? আমি যখন বাংলাদেশে যাব তখন বাংলাদেশি হয়েই যাব? তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো জাহিদ? সব কিছু শোনার পর আমাকে বিয়ে করবে?—সূর্যাস্ত লেপটে থাকা মাখনের মতো উজ্জ্বল মুখ হঠাৎ গলতে আরম্ভ করল। এক রাশ দুঃখবোধ এসে জড়িয়ে ধরলো সোফিকে।
তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? সোফি? তাকাও আমার দিকে, আমি তোমাকে বিয়ে করব, তোমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবো।—নিজেকে যতটা সম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে জাহিদ। শাড়ির প্যাকেটটা হাতে নেয়। পুরোটা খোলে, ভেতরে একটা লাল শাড়ি, সঙ্গে লাল ব্লাউজ, সায়া নেই! মিসেস রহমানকে চেনার চেষ্টা করে জাহিদ। যা অবস্থা তাতে এখানকার বাংলাদেশি কম্যুনিটিকে জাহিদের চেয়ে সোফিই বেশি চেনে। মিসেস রহমান? হ্যাঁ, এবার চিনেছে জাহিদ, বাংলাদেশি দূতাবাসের প্রথম সেক্রেটারির ওয়াইফ।
এদিকে এসো—সোফিকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলে জাহিদ। সোফি সামনে এসে দাঁড়ায় জাহিদের। শাড়ির ভাঁজটা খোলে জাহিদ, ব্লাউজটা হাতে নেয়, হঠাৎ জাহিদের সামনেই সোফি তার পরনের টি শার্টটি খুলে ফেলে। জাহিদ চোখ বন্ধ করতে পারে না, আবার খোলা রাখতেও পারে না। চোখ বন্ধ করতেও পারে না এই কারণে যে, এমন বিপুলসম্ভবা পৃথিবীর এই বিপুলা রূপ যদি আর না দেখতে পায় সে, এর আগেই যদি অন্ধ হয়ে যায়! আবার চোখ খোলা রাখার সাহস পায় না এই ভেবে যে, এই অপরূপ দৃশ্যের আগুনে পুড়ে যদি এই বিপুলা রূপ দেখার চোখদুটো নষ্ট হয়ে যায়? এই দোলাচলে দুলতে দুলতেই জাহিদ লাল রঙের ব্লাউজটা পরিয়ে দেয় সোফিকে। সোফি জিনসের প্যান্টটা খোলার জন্য প্রস্তুত হতেই জাহিদ চিৎকার করে—ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওটা খোলা লাগবে না। এ কথা বলে স্কিন টাইট জিনসের প্যান্টের ওপর দিয়েই লাল রঙা শাড়িটা সোফির ঢেউ তোলা কোমরে পেঁচিয়ে দিতে থাকে। সোফির শরীরের অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সুন্দর গন্ধটা জাহিদের মনোযোগে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়, সরেও যায়, আবার কাছে ঘেঁষে। জাহিদ নিজেকে নিজের ভেতরে গুটিয়ে নিতে চায় কিন্তু সে সুযোগ পায় না, সোফিই জড়িয়ে ধরে জাহিদকে। বিন্দু বিন্দু আদর ক্রমেই রূপান্তরিত হতে থাকে পরিপূর্ণ সোহাগের আগুনে। বাংলাদেশের নদী ভেজা পলি মাটি মিশে যায় নেদারল্যান্ডসের পেলবতার সঙ্গে। হঠাৎ জাহিদ খেয়াল করে সোফির দুই চোখের কোণায় অশ্রু, সোফি কাঁদছে! জাহিদ এ কান্নার মানে বুঝে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু পারল ন। তবে এটুকু বুঝলো মেয়েদের সব কান্নার অর্থ কান্না নয়। বাধা দিলো না সে। সোফি কাঁদুক। যত ইচ্ছা কাঁদুক। অ্যামস্টারডামের এই শীতসন্ধ্যা বড়ই শোকানন্দিত। জানালার বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো জাহিদ, তার বুকে লেপটে আছে প্রায় শিশু, প্রায় কিশোরী, প্রায় যুবতী—পরিপূর্ণ শাশ্বত এক নারী।
এই উদার আকাশ বাঁচার ইচ্ছাকে সুদীর্ঘ করে দেয়
তিন দিন হয়ে গেলো এখানে আসা। বাংলাদেশের আকাশ সীমায় পৌঁছানোর এনাউন্স শোনা মাত্র সোফির সে কি উত্তেজনা! দীর্ঘ প্লেন জার্নি জনিত কোনো ক্লান্তি নেই তার মধ্যে। আসার আগেই সোফি অ্যাডেনবার্গ রুম ঠিক করে রেখেছিল হোটেল শেরাটনে। হোটেলে উঠে একটু ফ্রেশ হয়েই জাহিদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। এর আগে পিটার অ্যাডেনবার্গ আর আগাথা অ্যাডেনবার্গকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে তাদের নিরাপদে ঢাকা আসার খবর। হোটেল থেকে বেরিয়েই ছুটে গেছে সাভারে। পিটার অ্যাডেনবার্গের দেওয়া সূত্র ধরে ঠিকানাটা খুঁজে বের করেছে। সেখান থেকে একটা ধারণা পায় তারা—সেটা বুকে নিয়েই উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ছুটে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মল্লিকপুর উপজেলার চান্দলাই ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রামে। সেখান থেকে আবার ছুটে আসে ঢাকায়। এসেই বারডেম হাসপাতালে ঢোকে সোফি অ্যাডেনবার্গ, সঙ্গে জাহিদ, জাহিদ হায়দার। বেশভূষায় আর ভাষায় সোফি অ্যাডেনবার্গ এখন পুরোদস্তর বাংলাদেশি। বারডেমে ঢুকে রিসিপশনে এসে জিজ্ঞেস করে জনাব লকিয়তুল্লা ডিউটিতে আছেন কিনা? লকিয়তুল্লা, হ্যাঁ, জনাব লকিয়তুল্লা মণ্ডল, চান্দলাই ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রামের লকিয়তুল্লা।
আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই, আমাকে একটু সময় দিতে হবে আপনার। বাক্যটার ভেতর এমন দরদ, এমন আকুতি এবং এমন দাবি মেশানো—লকিয়তুল্লা না করতে পারলেন না।
একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে। কিছুক্ষণের ভেতর আমার ডিউটি শেষ হবে, তখন কথা বলব, এই তো মাত্র কয়েক মিনিট। অসুবিধা হবে আপনার? মেয়েটির দিকে তাকালেন লকিয়তুল্লা, ঘড়ির দিকেও তাকালেন, দু’জনের মধ্যে একটা সমন্বয় করার গোপন চেষ্টা করলেন তিনি। বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলেন মেয়েটি অধৈর্য হয়ে উঠছে কিনা, কিংবা ঘড়িটি। না, তাদের ভেতর ধৈর্য হারা হওয়ার লেশমাত্র নেই বরং তাদের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে। কিসের উত্তেজনা তা লকিয়তুল্লা পড়ে দেখার চেষ্টাও করছেন না। তিনি বরং অপেক্ষা করতে থাকলেন কখন ঘড়ির উত্তেজনা দু’টার কাঁটায় এসে ঠেকে।
না, ঠিক আছে। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। আট তলার লিফটের পাশে দাঁড়ালো সোফি। করিডোরের স্বচ্ছ গ্লাসের বাইরে দৃষ্টিকে ছুড়ে দিল। বাংলাদেশের আকাশ এত উদার? আর মানুষগুলো! জাহিদের চেয়েও স্বচ্ছ। অনেক সংশয়, অনেক অনিশ্চয়তা নিয়ে সোফি আর জাহিদ ঢাকা আসার সিধান্ত নিয়েছিল। এবারের দেশে আসার ব্যাপারটা জাহিদ বাড়ির কাউকেই জানায় না—মা ছাড়া। জাহিদ এক ফাঁকে মায়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে। মা’কে সবকিছু খুলে বলেছে। মা, মা-ই তো জাহিদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। মা আপত্তি জানাননি। এতেই জাহিদের সাহস বেড়ে গেছে বহুগুণ। জীবনে এই প্রথম ব্যাপারটা ঘটলো—একই শহরে থেকেও নিজ বাড়িতে ওঠেনি জাহিদ। কাল মায়ের সঙ্গে বাড়ির বাইরে দেখা করবে জাহিদ; সোফিকে নিয়েই দেখা করবে।
বারডেম হাসপাতালের আট তলার করিডোরে দাঁড়িয়ে সোফি বারবার তার হাত ঘড়ির কাঁটাকে তাগাদা দিতে থাকে। কখন দু’টা বাজবে? একবার ঘড়ির দিকে তাকায়, আর লিফটের দরজার দিকে তাকায়—এর মধ্যেই লিফট পাঁচ বার ওপরে উঠেছে পাঁচ নিচে নেমে গেছে। জনাব লকিয়তুল্লাকে একবারও দেখা যায়নি। সোফির ভাবনারা দৌড়ে বেড়াচ্ছে অ্যামস্টারডামের অত্যুজ্জ্বল ঐশ্বর্য থেকে ঢাকা শহরের নিঃশঙ্ক আকাশে। একান্ত শাসনের ভেতর আটকে থাকা দেশ নেদারল্যান্ডস থেকে নিয়ম না মানা বাংলাদেশে এসে এতটুকুও অসুবিধা হচ্ছে না সোফির। সবকিছুই ভালো লাগছে তার। এই আকাশ, বাতাস, প্রকৃতি, ধোঁয়া, ধুলো, দুর্গন্ধ, অপরিচ্ছন্নতা, অনিয়ম সবকিছুই ভালো লাগছে সোফির। ভালো লাগার কারণ—দীর্ঘ দিনের চাওয়া ভেতরে-ভেতরে একটু-একটু করে এ সবকে ভালা লাগাতে প্রস্তুত করেছে সোফিকে। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা বাংলাদেশ থেকে বাস্তবের বাংলাদেশ অনেক সুন্দর। সুন্দর এই দেশে থেকে যেতে পারলে কি আনন্দই না হতো! এতকিছু ভাবতে ভাবতে ঘড়ির কাঁটা দু’টায় এসে দাঁড়ায়। সোফির সামনে এসে দাঁড়ান জনাব লকিয়তুল্লা মণ্ডল। ভাষা আটকে যায় সোফির।
জ্বি বলুন? নিরাসক্ত একজন বয়স্ক মানুষ জনাব লকিয়তুল্লা মণ্ডলের কণ্ঠনালী উৎসারিত শব্দগুলো বেরিয়ে আসে ।
জনাব লকিয়তুল্লার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সোফি। খুব আগ্রহ ভরে নিরীক্ষা করছে মানুষটিকে। কিন্তু কী বলবে সে?
কিছু জিজ্ঞেস করবেন বলেছিলেন!—লকিয়তুল্লা এই প্রথমবারের মতো সরাসরি সোফির দিকে তাকিয়ে বললেন কথাগুলো। তাকিয়েই একটু অবাক হলেন। এই মেয়েকে দেখে তো এ দেশের মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। পোশাক-আশাকে বাংলাদেশি সাজার একটা জোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এ মেয়ে যে বাংলাদেশি না, সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। গায়ে একটা লাল রঙের শাড়ি, কপালে সূর্যের চেয়ে গাঢ় লাল রঙের টিপ। অসম্ভব ফর্সা গায়ের রঙ, মুখে লালচে আভা, চোখ থেকে মুক্তোদানার মতো ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে পড়ছে। মেয়েটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লকিয়তুল্লার দিকে, কী যেন জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু করছে না। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যান লকিয়তুল্লা। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখছে জাহিদ হায়দার, কিন্তু কিছু বলছে না। জাহিদ এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। পৃথিবীতে এমন কিছু সময় আসে যখন কিছু না বলে শুধু শুনে যাওয়াই শ্রেয়। কিছু কিছু মুহূর্তে পৃথিবী স্থির হয়ে যায়—এই মুহূর্তটা তেমনই এক মুহূর্ত।
মৃদু অনুভূতির বাতাসেই বিশ্বাসের জানালায় দোলা দেয় অবিশ্বাস
নিজের ভেতরের অবাক ভাবকে গোপন করেন লকিয়তুল্লা। জিজ্ঞেস করেন, ম্যাডাম, আপনি আমাকে কী যেন বলতে চেয়েছিলেন? সোফি অ্যাডেনবার্গ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। অনেক চেষ্টায় ভেতরের এলোমেলো সোফিকে স্থির করে সে। একবার তাকিয়ে নেয় জাহিদ হায়দারের দিকে, তাকিয়ে সাহস জড়ো করে বলে, আমি সোফি অ্যাডেনবার্গ, আমি আপনার মেয়ে। আপনার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, সোফি, সোফিয়া! বলেই চোখ বন্ধ করে সোফি, লকিয়তুল্লাকে বাবা বলার সাহস পায় না, যদি অস্বীকার করে বসেন? এই মুহূর্তে কান্না কবলিত চোখ লুকাতে এর চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি তার আর জানা নেই। একটা অনিশ্চয়তার ভেতর দুলতে থাকে সোফির অনুভূতি। লকিয়তুল্লা পৃথিবী বুঝতে না পারা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সোফির সামনে। তার মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরনে একটা অচেনা কম্পন তৈরি হয়—যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না লকিয়তুল্লা। তার মুখ থেকে পরিচিত অক্ষরেরা হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, কী বলছে এই মেয়ে? না, এ কিছুতেই হতে পারে না, কিছুতেই না। হ্যাঁ, তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের নাম সোফিয়া, তাতে কী? কতজনের নামই তো সোফিয়া হতে পারে, না এ কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। হ্যাঁ, না, কিন্তু, না—এ মেয়ে মিথ্যা বলছে, এ মেয়ের নিশ্চয় কোনো খারাপ মতলব আছে। সে নাকি নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছে। কেন এই মেয়ে তার ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা ঝড়কে জাগিয়ে দিতে এসেছে? কী উদ্দেশ্যে? নিশ্চয় কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু এত নিষ্পাপ চেহারায় মেয়ে কেন এমন কথা বলবে? কেন সে পুরনো ক্ষতে আগুন জ্বালাতে এসেছে? কী বলবে লকিয়তুল্লা বুঝে উঠতে পারেন না। পরক্ষণেই নিজের ভেতর ফিরে আসেন তিনি, বলেন, না, হতেই পারে না, আপনি কেন আমার মেয়ে হতে যাবেন? আমার মেয়ে হারিয়েছে এ কথা আপনি হয়তো কারও কাছ থেকে জেনেছেন, কিন্তু নিজেকে আমার হারানো মেয়ে দাবি করে আপনার কী লাভ? কী উদ্দেশ্য আপনার? আপনি আমার মেয়ে হতেই পারেন না, হ্যাঁ আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের নাম সোফিয়া! কিন্তু আপনি আমার হারানো সোফিয়া হতে যাবেন কেন? এ কোনোভাবেই সম্ভব নয়, না এ হতেই পারে না।
সোফিয়া কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, সোফিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লকিয়তুল্লা হাসপাতালের করিডোর ধরে হন হন করে হাঁটতে থাকলেন। এ রকম অবস্থায় কী করা উচিত? জাহিদ নিজেও সেটা বুঝে উঠতে পারছে না, সোফিয়া তার চাপা কান্না ঢাকতে জাহিদের বুকে মাথা গুঁজে ফোঁপাতে থাকে। তবে কি এত কাছে এসেও এতদিনের অপেক্ষার যন্ত্রণা বুকে নিয়েই সোফিয়াকে ফিরে যেতে হবে অ্যামস্টারডামে? পৃথিবীকে খুব নিষ্ঠুর মনে হয় সোফির। ফোঁপাতে ফোঁপাতে গোঙানির শব্দ তুলে জাহিদের বুকে মাথা রেখে সোফি বলে, বাবা! বা-বা। জাহিদ চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। কিন্তু কী-ই বা করার আছে তাদের। আশপাশের মানুষজন দেখছে, একজন নারী একজন পুরুষকে জড়িয়ে অঝরে কাঁদছে। অবশ্য হাসপাতালে এমন দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক। ভাবছে হয়তো কোনো নিকট আত্মীয় মারা গেছে।
পাঠোদ্ধারের খেলায় মেতে ওঠে শ্বাসের শব্দ যাপন
লকিয়তুল্লা হাঁটছেন, এইমাত্র পেছনে ফেলে এসেছেন একজন নারীকে, যে নারী বলছে, সে নাকি লকিয়তুল্লার হারিয়ে যাওয়া সম্পদ সোফিয়া, তেইশ মাস বয়সের সোফিয়া। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে লকিয়তুল্লার। আল্লাহ তুমি এমন পরীক্ষায় কেন ফেললে আমাকে? তুমি তো আমার সোফিয়াকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলে, সহ্য করেছিলাম, বুকে পাথর চাপা দিয়ে ছিলাম, ধীরে ধীরে সেই বেদনার্ত স্মৃতিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম, কেন তুমি এ শেষ বয়সে আমাকে পরীক্ষার সামনে দাঁড় করালে? মাবুদ তোমার খেলা বোঝা বড় দায়। লকিয়তুল্লার বৃদ্ধমস্তিষ্ক তার সোফিয়ার স্মৃতিকে নবায়ন করেন,তেইশ মাস বয়সের সোফিয়া! নিজের নাম আর আব্বা শব্দ ছাড়া কিছু বলতে শেখেনি। লকিয়তুল্লার হাত ধরেই দাঁড়িয়ে ছিল বারডেমের গেটে। লকিয়তুল্লার মনোযোগ একটু আলগা হয়েছিল। ঘুরে দেখে মেয়ে তার হাতে নেই—নেই তো নেই। কত খোঁজাখুঁজি! কোথাও পাওয়া যায়নি। লকিয়তুল্লাও মেয়েকে ফিরে পাননি। পেয়েছিলেন একটি চাকরি। প্রতিদিন বারডেমের গেটে বসে থাকতে দেখে ইব্রাহীম স্যার একদিন তাকে ডেকে পাঠালেন। সব কিছু শুনে তাকে চাকরির ব্যবস্থা করলেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলেন, কিন্তু হারানো মেয়ে তিনি দিতে পারবেন কিভাবে? আজ এতগুলো বছর পর আবার হঠাৎ করে এসে এক মেয়ে দাবি করে বসে, সে নাকি লকিয়তুল্লার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, সোফিয়া। লকিয়তুল্লা মায়া নামক এক ভয়ঙ্কর অস্বস্তির ভেতর পড়ে যান। লকিয়তুল্লার মন বলে, মেয়েটি যা বলছে তা যদি সত্য হতো! কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা।
লকিয়তুল্লা ভাবেন, ভাবতে ভাবতে ফিরে আসেন, ফিরে এসে দাঁড়ান সোফির সামনে। জিজ্ঞেস করেন—কী এমন প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে, আপনি বলছেন আপনি আমার হারিয়ে যাওয়া সোফিয়া?
জাহিদের বুক থেকে দ্রুত মাথা তোলে সোফি। সদ্য নিভে যাওয়া আশার প্রদীপ আবার তার চোখেমুখে জ্বলে ওঠে। সে দ্রুত হাত চালায় তার ব্যাগে, সেখান থেকে একটা মাদুলি বের করে। লকিয়তুল্লার চোখের সামনে ঝুলতে থাকে সোনার মাদুলিটা।
আমি হারিয়ে যাওয়ার সময় এটা, এটা আমার গলায় পরানো ছিল, চিনতে পারছেন? চিনতে পারছেন, এটা? চিনতে পারছেন না আব্বা?
আব্বা ডাক শুনে লকিয়তুল্লার বুকের ভেতর এক অনির্বাচিত ঝড় ওঠে। লকিয়তুল্লা বিশ্বাস করতে চান, যে এই মেয়েটি যা বলছে তা সত্য হলে সমস্যা কী? কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন না। মাদুলিটা হাতে নেন তিনি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন। সোফিয়ার জন্মের পরে প্রথমবার পুতির মুখ দেখতে গিয়ে তিনি একটা সোনার মাদুলি পরিয়ে দিয়েছিলেন লকিয়তুল্লার মা। চিনতে কষ্ট হয় মাদুলিটা, নেড়েচেড়ে দেখে নিশ্চিত হন যে এটাই লকিয়তুল্লার মায়ের মাদুলি, যেটা মা সোফিয়ার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটির মুখে আব্বা ডাক শোনার পর খুব করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে যে, এই মেয়েই তার হারিয়ে যাওয়া সোফিয়া। কিন্তু একটা মাদুলি দিয়ে তো সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যায় না? এমনো তো হতে পারে, এই মেয়ে এই মাদুলি কুড়িয়ে পেয়েছে। অতএব, আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে, ছুড়ে ফেলেন লকিয়তুল্লা। না, কিছুতেই একটা মাদুলি দিয়ে প্রমাণ হয় না যে, এই মেয়েই তার হারিয়ে যাওয়া সোফিয়া। কোথাকার কোন এক মেয়ে একটা মাদুলি দেখিয়ে বলল যে, সে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, একবার আব্বা বলে ডাকল, অমনি লকিয়তুল্লার বিশ্বাস মোমের গলে যেতে আরম্ভ করলো? আবেগের মোমবাতির তাপে গলে যাচ্ছেন দেখে তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতেও পিছ পা হলেন না। এই মেয়েকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। কিছুতেই না। লকিয়তুল্লা আবার ভাবেন, কেনই বা একটি মেয়ে এত দূর দেশ থেকে এসে নিজেকে তার হারানো মেয়ে সোফিয়া হিসেবে দাবি করবে? আর কিভাবেই বা সে এই সোনার মাদুলিটা পেল? লকিয়তুল্লার ভাবনা এক ধাপ মেয়েটিকে মেনে নেওয়ার দিকে এগোয় তো তিন ধাপ পিছিয়ে যায়। এই শেষ বয়সে তাকে আবারও এমন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কী লাভ আল্লাহর?
দেখি, আপনার পা দুটো দেখি? লকিয়তুল্লা এ কথা বলেই সোফিয়ার পায়ের দিকে তাকালেন। কোনো কিছু না বুঝেই সোফিয়া তার পায়ের গোড়ালি এগিয়ে দিলো লকিয়তুল্লার সামনে। লকিয়তুল্লা একটু ঝুঁকে গিয়ে সোফির বাম পা টা দেখার চেষ্টা করলেন। আঁতকে উঠলেন তিনি। এই মেয়ের বাম পায়ের ছোট আঙ্গুলে নখ নেই, মানে পুরোটা চামড়া দিয়ে আবৃত! তার সোফিয়ারও তো এমনই ছিল। উঠে দাঁড়ালেন লকিয়তুল্লা। হ্যাঁ, এর চোখ তো রাহেলার চোখের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে, রাহেলার নাক, থুতনি, কপাল, ভ্রূ। লকিয়তুল্লা সোফির হাত দুটো নিজে হাতে নিলেন। বাবার স্পর্শ তবে এমন নিশ্চিন্তের স্পর্শ হয়!
(নোট: লকিয়তুল্লাহ’র মৃত্যুর পর গল্পটি লিখিত)