বর্ণকে আমি খুন করতে চাইনি, একদম না। খুন বলতে যদি শ্বাসরোধ বোঝায়, তবে তাতে আমার চরম অনাসক্তি। আমার বাবার শখের বানানো এই প্রাসাদসদৃশ কটেজের বন্ধ কামরার গরাদে দাঁড়িয়ে যেখানে প্রায় বিকেলে আমি ওয়েস্টিনের বার্গার অথবা হালফ্যাশনের সুদৃশ্য গলাবন্ধনীর সঙ্গে কাফলিংয়ের চিন্তায় সুখসময় কাটাতাম, সেখানে কাউকে খুন করার চিন্তা নিতান্তই অযৌক্তিক। কারও গাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অথবা কারও মৃতমুখ থেকে ঝুলে পড়েছে একহাত জিহ্বা, এসব চিন্তা আমার কোমল স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই যায় না। আমি মানুষটা মানবিক। রাত হলে ঘরে বসে পিয়ানোতে টিউনিং করে পবিত্র সুরে শুদ্ধ করি নিজের মন। মহৎ কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টায় আমার আত্মশ্রদ্ধেয় মন কত ভারী ভারী শব্দে বিশেষায়িত করে জীবন, জগৎ ও প্রেমকে, সেকথা আমি কাকে বোঝাবো! আর সেই আমিই কিনা খুন করে ফেললাম বর্ণকে! এও সম্ভব! এই তো এখন আমার আঙুলের ফাঁকে আটকে আছে বর্ণ’র শরীর। আহা মেয়েটা কেমন নিস্তেজ!
নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। দেয়াশলাইয়ের লম্বা কাঠির বিস্ফোরকের মাথায় আগুন লাগিয়ে সেঁকে দিতে ইচ্ছে করছে নিজের শরীর! বর্ণ’র সঙ্গে ডেট ছিল আজ। প্রথম! যাক সেসব! বর্ণকে লুকিয়ে রাখা উচিত! রাত হলে খুলে দেখবো ওর মৃতশরীর ঘিরে নৃত্যরত টিকটিকি, ইঁদুরের দৌড়! বর্ণ পচে যাক, দুর্গন্ধ ছড়াক ঘরে। কেউ না আসুক এখানে। এমনিতেই বর্ণ ছাড়া অন্য কোনো মানুষের সঙ্গ আমার কাছে অনাহূত দুষ্টগ্রহের মতো বিরক্তিকর! আর এখন অসহ্য ভয়ঙ্কর? আমার নতুন মাংসল শরীরে বিস্বাদ অনুভূতি কোথাও বা শুকিয়ে ওঠা চামড়ায় সর্বস্ব হারানোর শোক। পিঠে চাপিয়ে রাখা কাঁধব্যগের মতো মগজে জমিয়ে রাখছি একটু একটু করে পরিবার ও সমাজগত প্রেষণার দায়! আমার আবেগে থরোথর মন কী চেয়েছিল মানুষের কাছে? জীবনের কাছে? সময়ের ভাঁজে ভাঁজে আকাশ ফুঁটো করে টুকরো টুকরো মেঘ দেখতে চেয়েছিলাম, অথচ এখন আমি জানি, ঘরের ছাদের বাইরে পৃথিবীর যে ছাদ, সেখানে উড়ছে বিভৎস শকুন। আমি ভীতু, ভয়ে ভয়ে লড়ছি নিজের সঙ্গে, বর্ণের সঙ্গে, আজ থেকে না হয় নতুন করে লড়বো ওর মৃত শরীরের সঙ্গে।
মেয়েটা খুব আহ্লাদী ছিল, চঞ্চলও। ঠোঁট বাঁকা করে হাসতো। বর্ণ যতবার হাসতো, ততবার আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হতো, নিঃশ্বাস নিতে পারতাম না। খুব নিষ্ঠুর না হলে এমন একটা মেয়েকে খুন করতে মায়া হওয়ার কথা, আমারও হয়েছে। তবু শেষকালে পারলাম। খুব সহজভাবে হয়ে গেলো সব। নিজেকে হাল্কা লাগছে। বুকের ভেতর চাপধরা ব্যথাটা নেই। এখন আমি দীর্ঘসময় ঘুমোবো। আরাম লাগাছে। বালিশে মাথা ঠেকাই উশখুস লাগে, হাতের দিকে তাকিয়ে খুনের চিহ্ন খুঁজি, না নেই। হাতের চামড়া মসৃণ! আচ্ছা আমি কি দিনদিন অসুন্দর হয়ে যাচ্ছি? হবে হয়তো, গায়ের লোম কমে যাচ্ছে কেমন! বলা হয়নি বর্ণ খুব সুন্দর ছিল!
বর্ণ, আমার প্রিয় বর্ণ! অভিমানী বর্ণ আমার উৎপাতে মানসসুন্দরী! ছোটবেলা থেকেই আমার আত্মমুখীন স্বভাবের কারণে কেউ গায়ে পড়ে এসে কথা না বললে অথবা জোর করে কাছে না ডাকলে গুটিয়ে থাকতাম শামুকের মতো! খোলস ভেঙে আমাকে আলো দেখানোর কথা ছিল যাদের, তারা আজ পর। বাবা চলে গেছে সে কত বছর আগে। আমাকে রেখে, মাকে রেখে! তার দ্বিতীয়পক্ষ নিয়ে তিনি কানাডায়। এ বিষয়ে আমার মাকে খুব একটা বিপর্যস্ত মনে হয়নি, এমনকী বাবার পক্ষের কারও সঙ্গে সম্পর্কও খারাপ হয়নি তার, সব ঠিকঠাক, শুধু আমার কেমন লাগে, রাত হলে মনে হয় আমার বাবা হয়তো খুব ভালো বাবা ছিলেন, ছুটির দিনগুলোয় যত্ন করে আমার পায়ের নখ কেটে দিতেন। গোসলের পর হলুদ তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতেন গা। বাবার উষ্ণতাময় অনুপস্থিতি আমায় কাতর করে, মনে পড়ে বাবার কাতুকুতু দেওয়া সুখ! মাকেও কাছে পাই না তার ব্যক্তিগত ব্যস্ততায়! গভার্নেসদের কোলঘেঁষে বড় হয়ে ওঠা এই আমি নিজেকে চিনেছি পরগাছার মতো, তবু আমি মানবিক, আমি গান শুনি, পিয়ানো বাজাই, ছবি আঁকি। বর্ণ ছিল বলেই আমি একটু একটু করে মানুষের জীবন পেয়েছিলাম।
আচ্ছা বর্ণকে খুন করার পেছনে কী ছিল কারণ? আমার অস্থিতিশীল প্রেমবোধ, আত্মঅস্তিত্বে বিরক্তি, না কি সাব-কন্সাস ঈর্ষা, কোনটা? আমি কি ব্যর্থ মানুষ! আমি জানি আমি বর্ণর মতো নই, ওর টান টান শরীর, হাসি, নাচ, উরু, গ্রীবা—সব অন্যরকম! আর আমি? আশৈশব নেতিয়ে পড়া, ঘুমিয়ে পড়া কেউ; আমার অন্তর্জাত ব্যর্থতা আমায় প্রশ্ন করেছে বারবার আমি কেন বর্ণ হতে চাই? যাক সেসব, আর চাইতে হবে না, এখন আমি মুক্ত! জোরে শ্বাস নেই, আজই যাবো পাহাড়ে, অরণ্য দেখবো, বৃক্ষশাখায় খুঁজবো মহুয়া ফুল। আকাশজোড়া জোছনার ছায়ায় ডুবিয়ে দেবো শরীর।
আমার কোথাও যাওয়ার কথা শুনলেই বর্ণ সঙ্গে যেতে চাইতো; চাইবেই তো বর্ণর জীবন আলোর জীবন, পাঁচ-সাতটা ভাইবোনের ভাগাভাগির সংসার তাদের। কত নেই-নেইয়ের মাঝেও অনেক সুখ তাদের। ওরা বিকেল হলে ফুটপাতে ফুচকা খায়, সপ্তাহ শেষে বলাকায় যায় সিনেমা দেখতে। অসহ্য রকম আবেগী জীবন! এই হাসে তো এই কাঁদে। আমার গোপন ড্রয়ারের তালা খুললে এখনো পাওয়া যাবে তার ভাঙা কাচের চুড়ি, আলতার শিশি; পায়েল পরতো পায়ে। বর্ণর সাদা পা। ন্যাকা ন্যাকা গেঁয়ো সাজেও ওকে মানায়! বর্ণকে দেখতে দেখতে প্রায়ই আমি রাগ হয়ে বলতাম, বর্ণ আমি কিন্তু তোমাকে মেরে ফেলবো দেখো, একদম খুন! বর্ণ হাসতো আমার ঈর্ষায়। হিহি। খামচে দিতো, ওর নখ বড় বড়, দস্যি মেয়ে! বর্ণ ডাকাত! বর্ণ মাঝে মাঝে আমার গা থেকে খুলে নিতো টিশার্ট, পরতো কিছুক্ষণ। আমার তখন ওকে চুমু খেতে ইচ্ছে হতো, যেতাম কাছে। গা গুলিয়ে আসতো, পারতাম না। সেই কৈশোরের প্রাক-মুহূর্ত থেকে আমার কী এক রোগ! যন্ত্রণা! তবু আমি বড় হয়েছি, বেড়েছি অনেক। রোগের কথায় মনে পড়ে আমার ঘরের ড্রয়ার ভরা ওষুধের কৌটোগুলোর কথা। এগুলো আসার পর বর্ণর জিনিসপত্র কমে গেছে। কিছুদিন আগে আমার ঘর পরিষ্কার করতে পাশের বস্তি থেকে এক ঠিকে কাজের মহিলা আসতেন। মা সিকিউরিটির কাছে চাবি দিয়ে চলে যেতেন অফিসে। ময়লা পরিষ্কারক সে মহিলা সময় করে এসে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে ঘর মুছতেন, বইয়ের সেলফ গোছাতেন, ফ্রিজের খাবার গরম করে দিতেন আমায়, আমি হা করে তাকিয়ে দেখতাম তাকে। নারী শরীর কী অদ্ভুত! মহিলা হাসতেন, বাবা-মায়ের ফটো ফ্রেম মুছতে মুছতে বলতেন, ভাইজান আপনে আপনার বাপের ধারে চইল্যা যান, হুনছি বিদ্যাশে আপনের লাহান মাইনষের কোনো অভাব নাই, এই দ্যাশেই সমেস্যা। তয়, আপনের আম্মার টেকা আছে, আপনেগোর আর কী! অইতেন যদি আমগোর বস্তির কেই, তইলে বোঝতেন; ঠ্যালার নাম বাবাজি!
ঠ্যালার পুরোটা বোঝার আগেই ওই মহিলা একদিন তার কয়েকজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে আমায় দেখতে এসেছিলেন। আমি তাদের টোস্ট খেতে বলেছিলাম। তাদের মুখ টিপে সে কী হাসাহাসি! আমার মা বিষয়টা জানতে পেরে ভয়ঙ্কর রকম রেগে ওঠেন, ভয়ঙ্কর! সেই থেকে আমার ঘরে মা কিংবা মা সম্পর্কিত কেউ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। বর্ণর কথা আলাদা, সে আসে যখন-তখন! ওকে আমি দেখি জানালায়, ছাদে, কিচেনে এমনকী ঘরের বড় স্ক্রিনের এলইডি টিভিতেও।
আমার মাথায় অদ্ভুত চিন্তা খেলা করে ড্রয়ার খুলে দেখি বর্ণর কী কী জমানো আছে। জামাটা পাই হাতের কাছে। গায়ে পরি। আমি আর বর্ণ সমবয়সীই হবো হয়তো! আমি তার গায়ের গন্ধ পাই জামায়। কেমন ঝিমঝিম মাতাল! বুকের আরও কাছে টেনে আনি। পেটের ভেতর পাক দেয় সব। রাগ, ঘৃণা, বিরক্তি, ব্যর্থতা! মগজে কুৎসিত হয়ে যায় একটাজোড়া লিপস্টিক মাখা ঠোঁট, কাজলে থ্যাঁতলানো চোখ, আধখাওয়া চায়ের কাপ, বর্ণর নরম উষ্ণ শরীর! আমার কামড়ে ধরতে ইচ্ছে হয় বর্ণর ঘাড়ের রগ! কান, নাক, মুখ। জিভে এখন তেঁতো স্বাদ! এলার্জির রেশ উঠছে শরীরে। আমি নিজের নখে কেটে কেটে আচঁড়ে ফেলি নিজের হাত পা। আরাম হয়! ক্লান্ত লাগে মাথায় সব ফাঁকা, বর্ণ, বস্তির মহিলা বা প্রবাসী বাবা। আমার ঘুমিয়ে পড়া দরকার, ঘুম ঘুম ঘুম। সব রেখে সত্যি সত্যি আমি ঘুমিয়ে পড়ি। বুকের ভেতর কী যেন হয়! কুণ্ডুলিত ধোঁয়া গোল চক্রাকারে আটকে থাকে ফুসফুসে। আমার আর কেউ নেই, কেউ ছিল না কখনো। সবসময় অজস্র হিংস্র প্রাণী মুখ বাড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করেছে কত! অথচ আমি শুনতে পাইনি কখনো। আমি সুখী ছিলাম। সেই আমি আজ কুণ্ডুলিত ধোঁয়ায় ভেসে যেতে যেতে পৌঁছে যাই অন্ধকার এক গুহামুখে। আমার ডানে-বাঁয়ে সম্মুখে পশ্চাতে গর্জন আর গর্জন, পালাতে গিয়ে ছুটি দিগ্বিদিক। অন্ধকার! আতঙ্কিত আত্মা নিয়ে ছুটছি এদিক-সেদিক। বুকের ভেতর শূন্যতা, হাহাকার ছলাৎ-ছলাৎ। এইতো কাছেই বর্ণর হাসি শুনতে পাচ্ছি আবার, বর্ণ কাছেই, ওর বৃত্তাকারমুখ আরও বৃত্তাবদ্ধ হয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, পা ভারী চলতে থেমে যাই, সংকুচিত হতে হতে নিজের গায়ের জামার ভেতরে ঢুকে খুঁজি গোপন অস্তিত্ব, গুহামুখ আড়াল করে বর্ণ আবার দাঁড়ায়, হাসে, এবার সে নিষ্পাপ! আমি হিাংস্রতা ভুলে নরম হই! আমার এত আদর লাগে, আমি আর কিছু বলতে পারি না তাকে। ভেবেছিলাম বকবো, আবার কেন সে? অথবা মারবো, ক্ষত করবো, পুরুষ হবো। বর্ণ হাসে। তার সে হাসিতে ভয়ঙ্কর অন্ধকার গুহামুখ মুহূর্তেই হয়ে যায় ফুলশয্যার চাদর! আমি আলতো করে ওর নরম সিল্কি চুলে হাত রাখি, ও বেড়ালের মতো আমার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে, আমার শীত বাড়ে, গত সপ্তাহে ওর জন্য একটা উলের হাফহাতা সোয়েটার কিনেছি সঙ্গে একটা কানটুপি, আমি জানি কানটুপি পরলে বর্ণকে খরগোশের মতো লাগে, কানটুপির মাথায় লাল রঙের দুটো ফুলও আছে, আমার বর্ণকে লালে খুব মানায় আমি জানি!
পৃথিবীকে আজ জানিয়ে দেব আমাদের পৃথিবীতে
আমরাই একমাত্র অ্যাডাম আর ইভ!
দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে, ইন্টার লক খোলার শব্দ! বর্ণের লাশটা ঢাকার আগেই মা আর ডক্টর ঘরে ঢোকে। ডক্টর বলেন, হ্যালো ইয়াং ম্যান? হাউ আর ইউ? আই উড বি প্লিজ টু নো ইউর বেটার পজিশন, ইজ এভরি থিংস ওকে ডিয়ার?
বলি—নো ডক্টর, নট ওকে। বর্ণ ইজ নো মোর অ্যান্ড ফর দ্যাট আই আম রেসপনসিবল। ইউ নো ডক্টর উইদাউট বর্ণ আই উড বি নো, আই হেভ এ কমিটমেন্ট টু ডু সুইসাইড!
এই ভয়াবহ খবরে ডক্টরের কোনো ভাবান্তর হয় না। তিনি নির্বিকার—ওকে ইয়াংম্যান ইটস ওনলি সাব টু ইউ, বাট নট নাউ! টেক অ্যা টাইম। নাউ ইউ হেভ টু টেকিং ভিটামিন, নাও হা করো, হা৷
আমাকে ডক্টর জোর করে একগাদা ক্যাপসুল খাইয়ে দিলেন। লোকটা খুব খারাপ। ভিটামিন বলে বলে আমাকে গাদা গাদা কী খাইয়ে দেন, আমার শুধু ঘুম পায়! তবে আজ মনটা কেমন! ঘুম হবে না জানি। তলপেট ব্যথা করছে। ডক্টরকে বলবো? না থাক! মা কেমন করে তাকিয়ে আছেন ঠিক আমার বুকের দিকে। আমার সংকোচ লাগে, মায়ের চোখ করুণ। আমি বিছানা থেকে কাঁথা টেনে নিয়ে গায়ে জড়াই। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বো, ঝিমুনিতে শুনতে পাচ্ছি ডক্টরের অস্পষ্ট কথা। মাকে বোঝাচ্ছেন!
রোজ একই কথা, তবু বলেন! হয়তো আমাকে শোনানোর জন্যই বলেন, আমি কখনো শুনি, কখনো শুনি না, কখনো বুঝি, কখনো বুঝি না। আমার মনে হচ্ছে মাও আজ বুঝবেন না, ফিচফিচ করে কাঁদবেন। আচ্ছা মা তো কখনো এমন ছিলেন না, কী শক্ত ধাঁচের মানুষ! কী হয়েছে মায়ের? আমার কি আজ মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত তাদের কথা? তলপেটের ব্যথা বাড়ছে, আমি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠি, ইশ! আমার দুপায়ের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ছে তরল স্রোত! পায়ের পাতায় নেমে আসছে লাল! এই লাল আমার না কি বর্ণর!
মা ফোঁপাচ্ছেন, ডক্টরের মুখ থমথমে—আপা ধৈর্য ধরুন। পিরিয়ডিক্যাল সিমটম! আস্তে আস্তে এ সিমটমগুলো আরও প্রকট হবে, আপনাকে এটা মানতেই হবে।
মা এবার বাধাহীন কাঁদছেন! কাঁদুক আমি ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিয়েও কান পেতে থাকি। আজকে ঠিক ঠিক বুঝের মতো শুনবো তাদের কথা।
—আর সহ্য হয় না, ছেলেটা তো উন্মাদ হয়ে যাবে!
—ঘাবড়াবেন না আপা, রাফির এই ট্রান্স সেক্সুয়াল ডিসঅর্ডার অ্যাবজর্ব করতে সময় লাগবে৷ আপনি ভেঙে পড়লে ক্যামনে হয়! এত বছর একটু একটু করে সামলেছেন, এখন একটু শক্ত হোন। বয়ঃসন্ধিকালের পরের সময়টাই ঝুঁকির ছিল!
—রাফি কি আমার ছেলে? ওকি এখনো পুরুষ! জন্মের পর কী সুন্দর ফুটফুটে নাদুস নুদুস ছিল, খৎনা করিয়েছি!
—আপা এটা জেন্ডার রেসিসমেন্টের বিরল সমস্যা, সে তো পুরুষই!
—তাই জানতাম, এমনকী সারাক্ষণ বর্ণ বর্ণ করতো তাতেও খুশি ছিলাম। গত একটা বছরে সব পাল্টে গেলো।
—মেয়েটা যোগাযোগ করেছিল আর?
—কাল একবার এসেছিল, আমি ওর সাথে দেখা করতে দেইনি।
—ভালো করেছেন, রাফি এখন ট্রমায় আছে। সার্জরিটা হয়ে যাক। তারপর ওকে সব বলা যাবে। আপাতত ও ঘরেই থাকুক। বাঙালি মানসিকতায় ওর এই আকস্মিক পরিবর্তন খুব সহজে মেনে নেওয়ার মতো নয়, আর সে যদি হয় খুব কাছের কেউ মানুষ আই মিন উড বি অ্যা গার্লফ্রেন্ড!
—মেয়েটার কথা কী বলবো, রাফি নিজেই কি মানতে পারছে? পারছে না তো?
—হু রাফি ওভার শকড। ওর ভেতরে স্কিজোফ্রেনিক প্রবলেমও শুরু হয়েছে একারণেই। আশা করছি ম্যাসটেকটমি আর বোনগ্রাফটিংয়ের পর এই ট্রমা কেটে যাবে। ততদিন ওকে সময় দিন।
—আর কত, বাইরে নিতে পারছি না এখনো, আমি রিজাইন দিয়েছি জবে।
—আপা সাহস রাখেন, আমি একটা হসপিটালের সাথে কথা বলছি, সামনের মাসেই হয়তো সিডিউল পাবো ওদের, থেরাপিসহ আরও বছর খানেক লেগে যাবে৷ তার মধ্যে নিউরোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট, সাইলোলজিক্যাল সেশন সব মিলিয়ে অনেকটা সময়। এখন শুধু ধৈর্য রাখাটাই আসল।
—আমি আর পারব না রাহাত, তুমি ওর বাবার খুব কাছের ছিলে, তোমার ওপর ভরসা করছি। তুমি যা পারো, করো। ও কিছু বুঝতে চায় না পাগলামি করে। একা একা সামলে যাচ্ছি সব।
—হু বুঝতে পারছি, দাঁড়ান আমি একজন সাইকিয়াটিস্ট রেফার করছি, ও আসবে, বোঝাবে রাফিকে। একদিনেই বোঝানো সম্ভব না।
—আমার ছেলেটা কী সুন্দর পিয়ানো বাজাতো, ছবি আঁকতো, ওর আশৈশব অস্তিত্ব, অভ্যাস ভালোলাগা, মন্দলাগা সব এভাবে মিথ্যে হয়ে যাবে সব, সামান্য একটা হরমোনের কাছে এভাবে মানুষ পরাজিত হয়! কিভাবে মেনে নেই রাহাত?
—আপা প্লিজ! সাইকিয়াটিস্ট মেয়েটা এলে ও রাফিকে বোঝাবে সব। আপনার কাজ রাফিকে বিশ্বাস করানো ওর নামই বর্ণ! কিন্তু খবরদার ওর বান্ধবী বর্ণ ইজ নট অ্যালাও দ্যান!
আমার হাসি পায় ডক্টরের কথায়, তিনি কি পাগল! আশ্চর্য কথাবার্তা, আমি স্কিজোফ্রেনিক রোগী, আমি ট্রান্স-সেক্সুয়াল ডিসঅর্ডারে ভুগছি, কী অদ্ভুত! আচ্ছা আমি কি সত্যি সত্যি উভয়লিঙ্গের মানুষ হয়ে যাচ্ছি? ডক্টর বলছে, আমি বর্ণকে চিনবো না। আমার হাসি পায়! আমি চিনবো না বর্ণকে? আচ্ছা আমি নিজেই কি বর্ণ, না কি আমি রাফি? আয়না খুঁজি ঘরে। নেই। মা সরিয়েছেন, আমার অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী মায়ের বেশ বুদ্ধি! আয়না নেইতো কী হলো? আমি টেনেটুনে আমার আমার গায়ের জামাটা ছিঁড়ে ফেলি, এইতো আমার পশমি বুক! এবরোখেবড়ো যোনিপথ। উঠতি নিপলের ডগা মসৃণ। আমি হাত রাখি নিতম্বে নাভিতে। কেমন শীত শীত অনুভূতি। লজ্জা লাগে। বিছানায় যাই, কম্বল খুঁজি। এই তো বর্ণ এখন উঠে বসেছে, ওমা ওকে তো আমি মেরে ফেলেছিলাম, মরেনি তবে? যাক ভালোই হলো—আজ সারারাত বর্ণকে নিয়ে আকাশে কালপুরুষ দেখবো। হাতে থাকবে মগভরা কফি, এই শীতের রাতে ঘোলা আকাশের মেঘ সরিয়ে আমরা দুজন নক্ষত্র দেখবো, খুঁজবো অরুন্ধতী, স্বাতীপ্রভা, কালপুরুষ! আজ সারারাত জেগে জেগে আমরা শরীরবৃত্তীয় ব্যর্থতা ঢাকবো। আমি জানি আমি পুরুষ! অরুন্ধতী নই, কালপুরুষ! ঘুমে আমার দুচোখ জড়িয়ে আসছে, আহা বর্ণ কাছে আসো, কালপুরুষ আজ তোমার কপোল ছুঁয়ে দেবে, ঠোঁটে ছুঁয়ে দেবে প্রেম! আদরের ভাঁজে চেনাবে সমুদ্রসঙ্গম। পৃথিবীকে আজ জানিয়ে দেব আমাদের পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র অ্যাডাম আর ইভ!