—প্লিজ শিলা, তুমি আর ওসবে যাবে না।
—মানে?
—আড্ডা না ঘোড়ার ডিম, ওসবে!
— কেন?
—সব কেন’র উত্তর নেই, যাবে না বলছি, যাবে না।
—এমন করছ কেন তুমি আজ, কী হলো বলবা তো?
—কিচ্ছু না, তবু যাবে না আর ওসব কাজে।
আড্ডাফেরত শিলা জামা বদলের আগে বরের এমন কথা শুনে নিজের আয়নায় আবিষ্কার করে, আকাশটা তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে অথবা সে দাঁড়িয়ে আছে সাতহাত পানির ওপর। যাবার সময় রিকশা বাদ দিয়ে সিএনজিতে, পছন্দের শাড়িটি পরিয়ে রাজ্যের হর্ষে শিলাকে নিয়ে বের হয় রাজন। চেহারায় কত রকম দুষ্টুমির চিহ্ন। কথার পর কথা, প্রশ্নের পর প্রশ্নে শিলা বোঝে, বর তার স্বীকৃতিতে উচ্ছ্বসিত। এই প্রথম কবিবউ পেয়ে নিজেকে অন্যরকম ভাবতে থাকে রাজন। অথচ আগে কতবার বলেছে শিলা, কত পেটারকাটিং দেখিয়েছে, না বাপু জনাবের ওদিকে নজর দেওয়ার টাইম নেই! ছুটির দিনে বোমা ফাটিয়েও তাকে বাসা থেকে বের করা যায় না। আজ সকালে উঠে কিনা বলে, বাজারের থলেটা দাও শিলা, কাঁচাবাজারে যাব। দুপুরে ভালোমন্দ খেয়েই আড্ডায় যাব তোমাকে নিয়ে। হাজার হোক, ঘরণীকে আজ আড্ডার কবি করা হলো তো!
শিলার কবিতাচর্চায় রাজনের আগ্রহ কোনোদিন ছিল না, অনাগ্রহও না। ফেসবুকে শিলাকে নিয়ে প্রিয়ভাজনদের পোস্ট দেখে রাজনের বোধে নাড়া দেয় অচেনা রঙরাঙ পাখি। টুপ করে পাখিটা বলে ওঠে, যাওরে রাজন, একই চাদের নিচে থাকো, দেখে এসো তার দুনিয়া!
একটা রুমে গোল করে বসে আছে কবিরা। তীর্থের কাক কি তবে এভাবেই থাকে? যাদের মাথায় শব্দ খেলে যায় প্রতিনিয়ত তারাই কিনা বসে আছে ফ্লোরে, মাদুর পেতে! ওদিকে গদিঅলা সোফায় তিন আলোচক, শিলা আর আড্ডার সহকবি। সবার দৃষ্টি সোফার দিকে। সঞ্চালক উপস্থিত কবি, পাঠক, আলোচকদের ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করে আজকের আড্ডা। আড্ডার দুই কবিকে নিয়ে পড়ে শোনান নাতিদীর্ঘ শংসাবাণী। তিনি উপস্থিত একেকজনের নাম বলেন আর অমনি দাঁড়িয়ে কবিতা শোনায় মাদুরে বসা কবিরা; শিলাদের কবিতা নিয়ে করে দারুণ সব মন্তব্য। দুই আড্ডার কবি ঠোঁটে মিহি হাসি ধরে রেখে উপভোগ করে যায় শংসাভরা বিকেল। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগে রাজনের। ফ্লোরে বসা প্রত্যেকের চোখে নিজেকে নিযুক্ত করে রাজন। চমকে ওঠে তার দিলদরিয়া। একেকজনের লোভাতুর দৃষ্টি শিলার বুকে, মুখে, সারা শরীরে।
আলোচকদের দিকে তাকায়, তারাও কামনার জিহ্বাটি দিয়ে যেন চাটতে থাকে শিলার শরীর। ভার্সিটিপড়ুয়া এক কবি কবিতাপাঠের আগেই শুরু করে দেয় বন্দনা, শিলাপুর যেমন রূপ, তেমন গুণ। পিত্তি জ্বলে ওঠে রাজনের। আরে কবি, না কবির রূপ, কোনটা মুখ্য? বউ আড্ডার কবি। মনকে গালি দেয় একচোট, কেন আজ শিলাকে অমন সাজটা করতে বললাম! কেনই বা পরতে বললাম ওই শাড়িটা। ব্লাউস না ছাঁই, সিরিয়াল দেখে কী বানালো, নিজেকে এত প্রদর্শন করতে চাইলে ফেলে দাও না সব, বজ্জাত নারী! অনুষ্ঠানশেষে ফটোশেসন আর সেলফিবাজি। শিলার পাশে দাঁড়ানো লোকটা পারে না তাকে জড়িয়ে ধরে। কনুই ঠিকই স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে শিলার শরীর। হাসি হাসি ভাব নিয়ে শিলার দাঁড়িয়ে থাকা জ্বালিয়ে দেয় রাজনকে। ভদ্রজনের প্রলেপ দিয়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়, এটা নিজের বাসা না, এটা টোটালি ভিন্ন পরিবেশ! বি কুল জেন্টলম্যান!
প্রেম করে বিয়ে তাদের। রাজনকে এমন কথা বা আচরণ করতে কখনো দেখেনি শিলা। ভেবে পায় না আড্ডায় কী অমন হলো তার সঙ্গে! শিলা অধৈর্য হয়ে যায় যেন। সংযমের হালকা আবরণ মেখে বরকে আবারও জিজ্ঞেস করে, কেন যেতে পারবো না, বলবে তো?
উত্তর নেই রাজনের। তার চোখে ভেসে উঠে কতগুলো লকলকে জিহ্বা, বিষাক্ত নখ। কামাতুর দাঁত আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শিলার দিকে ধেয়ে আসছে বিদ্যুৎবেগে; প্রাণপণে দৌঁড়োচ্ছে শিলা। শিলা দৌঁড়ে যতই কাছে আসতে থাকে রাজনের, তার চেহারায় দৃশ্যমান হতে থাকে অজস্র দাগ, অজস্র বেদনার বিধ্বস্ত খতিয়ান!
বিড়বিড় করে রাজন বলে যায়, প্লিজ যেও না শিলা, প্লিজ!