উনিশশ চল্লিশের মে মাসের মাঝামাঝি।
শেষ বৈশাখের বায়ু আর ঘরভরা লোকের গায়ের তাপ বিনয়কৃষ্ণ রায়ের বৈঠকখানা বেশ গরম করে তুলেছে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেছে; সুভাষচন্দ্র বসু দেয়ালে হেলান দিয়ে পালঙ্কের ওপর বসে আছেন। তালের পাখা দিয়ে বাতাস করছে ফরোয়ার্ড ব্লকের তরুণ কর্মী অসিত ভৌমিক। কিছুক্ষণ আগে এখানে আরো লোকজন ছিল, বাঙালির স্বভাবে খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারটা লজ্জাকর বিষয়, তাই মনে করে অনেকে উঠে গেছে। আবার কিছু লোক নির্লজ্জের মতো শহরের বড়লোক উকিল বিনয়কৃষ্ণ রায়ের বাড়ির এই আপ্যায়নকে দলীয় অধিকার মনে করে এমনভাবে পেট ভরে খেয়েছে যে এখন আর নড়তে পারে না।
দুপুরের আহারের পরে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা ও কর্মীরা আবার এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। একজন-দুজন করে তারা আসছে। সেগুনকাঠের বিরাট পালঙ্কের ওপর চাপাচাপি করে বসতে হচ্ছে তাদের। সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর সামনে রাখা বই-খাতা-কলম, আর কোলবালিশের জন্য সামান্য জায়গা রেখে সবাই পুরা পালঙ্ক দখল করে বসেছেন।
আসলে পালঙ্কের ওপরে যারা বসেছেন তাঁরা বিভির সিনিয়র নেতাকর্মী। দুর্গাদাস ব্যানার্জি, জ্যোতির্ময় রায়, মণীন্দ্র মিত্র, রমেশ ব্যানার্জি, কালীপদ ব্যানার্জি, রণদা চৌধুরী, সুকুমার সেন, হেমেন্দ্র দাস এবং দেবেন দাসের মতো লোকেরা। তাঁরা শহরের গণ্যমান্য লোক; পেশায় তাঁরা ব্যবসায়ী, আইনজীবী, স্থানীয় স্কুল ও কলেজের শিক্ষক ইত্যাদি। এখন তাঁরা আর ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে’র পরিচয় দেন না, ফরোয়ার্ড ব্লকের পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করেন। এই কিছুদিন আগেও তাঁরা কংগ্রেস করতেন। বিশাল এই বৈঠকখানার লাল ইটালি রঙ মেশানো সিমেন্ট দিয়ে বানানো মাছের শরীরের মতো পিচ্ছিল মেঝেতে যারা বসেছে তারা তরুণ কর্মী। অনেকে বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছে, আবার কেউ কেউ একটু ঘুরতে গিয়ে স্টিমারঘাটে বা কাছাকাছি কোথাও গিয়ে দোকান থেকে খেয়ে এসেছে।
নিচে বসেছে কালিপদ ব্যানার্জি, অবিনাশ দাস, মতিলাল ভৌমিক, ফণীন্দ্র পাল, অশ্রুমুকুল সেন, ধীরেন বিশ্বাস, জগন্নাথ কর্মকার, কালিদাস ভৌমিক প্রমুখ। দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে কাজকর্ম তদারক করছেন বিনয়কৃষ্ণ বাবু নিজে আর শান্তিময় গাঙ্গুলি। বাইরে দাঁড়িয়ে কর্মীদের সাথে কথা বলছে অবিনাশ দাস।
শান্তিময় আর অবিনাশ নেতাজির বেশি ঘনিষ্ট। বিশেষ করে শহরের প্রখ্যাত কংগ্রেস-নেতা বিমলামোহন গাঙ্গুলির পুত্র শান্তিময় তো সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে কলকাতা, জামশেদপুর, করাচি, গুজরাট এবং ভারতের অন্য অনেক শহরে গিয়েছে; নিয়মিত চিঠিপত্রে যোগাযোগ থাকে তার সাথে। সে এক সময় ছাত্ররাজনীতি করত, আর এই শহরে এলে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয় অবিনাশ।
খাওয়ার পরে ঘরটিতে বেশ নীরবতা নেমে এসেছে। গত তিনদিনে নেতাজি লক্ষ্য করেছেন সাবেক বিভির কয়েকজন মুসলমান কর্মীর সাথে মনসুর আলিও মনপ্রাণ দিয়ে খেটে যাচ্ছে। আজকের কর্মসূচির মধ্যে ছিল দলীয় কর্মিসভা, সেটি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলেছে, ঢাকেশ্বরী হাইস্কুল উদ্বোধন করে আসার পরেই কাজ শুরু হয়েছে। এ অনুষ্ঠানটি ছিল অনির্ধারিত, তাই গত দুই দিনের কর্ম পর্যালোচনা বলা যেতে পারে।
নেতাজিকে কেমন গম্ভীর দেখা গেছে আজ। মাটির ব্যাংক থেকে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে পয়সা বের করার মতো তাঁর মুখ থেকে কথা বের করতে হয়েছে। নিজে কথা বলেছেন খুবই সামান্য; তিনি সব কথা শান্তিময় গাঙ্গুলি, রমেশ ব্যানার্জি আর বিনয়কৃষ্ণ রায়কে দিয়ে বলিয়েছেন। পার্টির কর্মীদের করণীয়, দলের গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতি ইত্যাদি তো কাগজপত্রে লেখাই ছিল; তারা পাঠ করেছে আর ব্যাখ্যা করেছে। দেবেন দাস স্থানীয় হাইস্কুলের শিক্ষক এবং অভিজ্ঞ নেতা, তিনি সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে সঞ্চালনা করেছেন।
খাওয়ার পর অনেকের চোখেই অলসতন্দ্রা নেমে এসেছে। এ সময় পানদানে করে পান এনে দিয়ে গেল মিনু। পুরুষমহলে প্রবেশ করতে তার মধ্যে কোনো সংকোচ নাই। সে রমেশ আচার্যের আখড়ায় লাঠিখেলা শিখেছে। তার বড় বোন কিরণও তার মতো সাহসী কর্মী। বাড়ির অন্দরমহলে আরও আছে উপলার মতো সাহসী এবং বিচক্ষণ তরুণী।
প্রথমে ফেডারেশনের কর্মীরা মার খেয়েছে। পরে তারা বিপুল বিক্রমে পাল্টা হামলা করেছে, তাতে ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মী জ্যোতি মাথায় আঘাত পেয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে মারা গেছে।
সুভাষচন্দ্র সন্দেহ করছেন উপলা আর মনসুর আলির মধ্যে সাংগঠনিক পরিচয়ের বাইরেও কোনও ধরনের সম্পর্ক আছে হয়তো। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন বা মন্তব্য করা থেকে নিজেকে সংযত রাখছেন, কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বড়দের কথা বলা উচিত না। যদিও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নাই, থাকতেও পারে না। এমনিতেই তিনি গতকাল থেকে কেমন গম্ভীর হয়ে গেছেন। উপলা গত তিন দিনে মাত্র দুইবার এসেছে এখানে। সে স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে, এ ব্যস্ততার কারণে বেশি সময় দিতে পারে না। মনসুর গত তিন দিনের বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটিয়েছে। প্রতিদিনই সারাদিনের ব্যস্ততার পরে অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে।
মনসুর আলি বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী ছিল আগে, বিভির পরিচয়ে সে সাংগঠনিক কাজ করত। আরও একজন মুসলমান কর্মী ছিল, তার নাম বোধহয় মোস্তফা কামাল। দুই বছর আগে যখন তিনি এই শহরে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে শেষবার এসেছিলেন, তখন এদের সম্পর্কে ধারণা নিয়ে গেছেন। তিনি খবর পেয়েছেন, উপলা, মনসুর আলি, মোস্তফা কামালসহ অনেক হিন্দু-মুসলমান কর্মী বিভির রাজনীতি করলেও তারা কংগ্রেসে যোগদান করে নাই। তিনি তাদেরকে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করতে বলেছিলেন, কিন্তু তারা সে নির্দেশ পালন করে নাই।
উপলাকে তিনি চিনতেন উজ্জ্বলার ছোটবোন হিসাবে। প্রথম দৃষ্টিতেই তিনি টেবিলে আঙুলের টোকামারার ভঙ্গি দেখে বুঝে নিয়েছেন, উপলা নিশ্চয়ই কালচারাল জগতের মানুষ, গানবাজনার সাথে জড়িত। উজ্জ্বলা এখন কলকাতার আলিপুর জেলে বন্দি আছে। ছয় বছর আগে সে দার্জিলিংয়ের লেবং অপারেশনে বাংলার গভর্নরকে হত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়ে এখন জেল খাটছে। উপলা আগে গোপন সংগঠনের পক্ষে বিচ্ছিন্ন রকমের কাজ করত, বড় বোনের কারাদণ্ডের পরে সে ঘনিষ্ঠভাবে বিপ্লবী রাজনীতিতে আসে; অস্ত্র সরবরাহের কাজ করত। কিন্তু ওই অপারেশন ব্যর্থ হলেও উজ্জ্বলাসহ কয়েকজনের কারাদণ্ড হয়ে গেছে। অপারেশনের প্রস্তুতিকালে, চৌকাঠে হোঁচট খাওয়ার মতো, শুরুতেই যাত্রা শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, গভীর রাতে মতি মল্লিক, সুকুমার ও মধু ব্যানার্জি ভুলবশত এই শহরের শীতলক্ষ্যা এলাকার দুজন ভিলেজ গার্ড রমজান সরদার আর আফজাল আলিকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনার সাথে সাথেই সুকুমার আর মধু পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও মতির মতো দুঃসাহসী এবং সুদক্ষ বিপ্লবী কর্মী এলাকাবাসীর হাতে ধরা পড়ে যায়; বিচারে মতির ফাঁসি হয়।
এ ঘটনা নারায়ণগঞ্জ শহরে তোলপাড় সৃষ্টি করে। এরপর অর্ধশতাধিক বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ষোলোজন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে বিভির কর্মী ছিল নিত্য সাহা, প্রাণগোবিন্দ গুণ, দুলু গুহ, বেণু ধর এবং শান্তিময় গাঙ্গুলি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছাড়া পায়, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারে নাই। তবে পুলিশকে তথ্য সরবরাহ করায় হিরু গুহের বিচার করা হয় পার্টির গোপন সভায়। হিরুর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়; প্রাণগোবিন্দ গুণ আর সুধীন ধরের ওপর দণ্ডাদেশ কার্যকর করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। দুজনে বন্ধুত্বের মমতার চেয়ে দেশপ্রেমকে অধিক সম্মান জানিয়ে গোপনসভার কথা বলে হিরু গুহকে শহরের উপকণ্ঠে চাঁদমারির বিলে ডেকে নিয়ে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
এসব ঘটনা যখন শহরে চলছিল, তখন বিপ্লবীদের আরেকটি শাখা গোপনে উজ্জ্বলাকে সাথে নিয়ে দার্জিলিং চলে যায়। সে দলে মুসলমান কর্মী মনসুরও ছিল। তবে দার্জিলিং গিয়েও তারা সফল হতে পারে নাই। ধরা পড়ে যায় উজ্জ্বলা, তারপর বিচারে তার কারাদণ্ড হয়।
উজ্জ্বলার মুক্তির ব্যাপারে কারও কাছ থেকে সহযোগিতা না পেয়ে উপলা বিপ্লবী রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। দুবছর আগে যখন সুভাষ এসেছিলেন, তখন উপলার সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। উপলা তার পরিবারের সমস্যার কথা নিজেই জানিয়েছে। “বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী, সংসারে আয় রোজকার করার মতো আর কেউ নাই, ছোট ছোট দুটি ভাই আছে। এ কারণে আমাকে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসার চালাতে হচ্ছে।”
সে বার তিনি কথা দিয়েছিলেন, “কলকাতা গেলে উজ্জ্বলার মুক্তির ব্যবস্থা করব।” কিন্তু করতে পারেন নাই। কংগ্রেসের সভাপতির পদ নিয়ে গান্ধিজীর সাথে ভুল বোঝাবুঝি এবং নানা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত এবং অস্থির থাকায় তিনি পেরে ওঠেন নাই।
এবার সুভাষ উপলার সাথে কথা বলার মতো সময় পেলেন না। তবে তিনি বোঝেন, জাতীয় নেতাদের সহযোগিতা না পাওয়ার অভিমানেই সে কংগ্রেসে যোগদান করে নাই। এবার তাকে কেমন মনমরা দেখা গেছে। সাংসারিক দায় এবং হতাশা তাকে কেমন বিষণ্ন করে তুলেছে।
মনসুর আলিকে তিনি খাওয়ার সময় দেখতে পান না। গত তিনদিনই দেখা গেছে খাওয়ার সময় সে কোথায় হারিয়ে যায়। আগের বার ব্যাপারটা তিনি লক্ষ্য করেন নাই; সে বোধহয় বিনয়কৃষ্ণ রায়ের বাড়ির কোনও দানাপানি মুখে না দেয় না। হয়তো মনসুর আলির ব্যক্তিগত সংস্কার এটা, অথবা হতে পারে বিনয়কৃষ্ণের মতো কায়স্থ উকিলের সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক আভিজাত্য মনসুর আলির মতো সাধারণ পরিবার থেকে আসা মুসলমান কর্মীদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। অথবা স্থানীয় অন্য কোনও ব্যাপার-স্যাপার থাকতে পারে। তিনি কাউকে কিছু বললেন না, তবে লক্ষ্য করেছেন উপলা আর মনসুরের চোখের ভাষা ভিন্ন। তাঁর সামনে দুইবার উপলা আর মনসুর মুখোমুখি হয়েছে, দুইবারই তিনি এটা লক্ষ্য করেছেন। সুভাষ কটকের স্কুলে, প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং স্কটিশচার্চ কলেজে পড়ার সময় প্রেম করার সময় পান নাই, তবে বন্ধুদের প্রেম করার সময় তিনি চোখের ভাষা বুঝতে পারতেন। ইউরোপে গিয়ে এমিলি শ্যাংকেলের মতো পাশ্চাত্য নারীর চোখেও সেই ইশারা দেখতে পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, প্রেমের ভাষাই আসলে আন্তর্জাতিক; তাই সবাই বোঝে।
তবে তিনি এটা উপলব্ধি করেছেন, মানুষ ঘৃণার ভাষাটা সহজে ধরতে পারে না। গান্ধিজী যে তাঁকে এত ঘৃণা করেন, তা তিনি গত বছরের আগে কখনও বুঝতে পারেন নাই। পারলে তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সকে অনেক আগেই ফরোয়ার্ড ব্লকে রূপান্তর করতেন, হয়তো অনেক আগেই তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে চলে আসতেন, হয়তো ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রাম ভিন্ন পথে পরিচালিত করে এতদিনে অনেক দূর পথ অতিক্রম করে যেতেন। পারেন নাই গান্ধিজীর কারণে। তাঁকে তিনি এত শ্রদ্ধা করতেন, প্রতিটি জনসভায়, প্রতিটি কর্মিসভায় তিনি গান্ধিজীকে মহিমান্বিত করতেন। তার বিনিময়ে তিনি কী পেলেন, অপরিসীম ঘৃণা!
আচ্ছা, তিনি যে মনে করেন, প্রেমের ভাষা আন্তর্জাতিক, অনুবাদ ছাড়াও সবাই বোঝে, তাহলে গান্ধিজী কি কখনও বুঝতে পারেন নাই যে সুভাষ তাঁকে এত ভালোবাসেন? সুভাষের গান্ধিপ্রেম কি ভারত মহাসাগরের জল দিয়ে মাপা যাবে! এত বছর ধরে তাঁর মুখনিঃসৃত সকল কথা, তাঁর হাত দিয়ে লিখিত সকল বাক্য আর সকল অভিব্যক্তি কি অসীম শ্রদ্ধা, ভক্তি আর প্রেমের ওজনই বহন করে নাই! নাকি গান্ধিজী সব বুঝেও না বোঝার ভান করেন অন্য কোনো গূঢ় রহস্যজনক কারণে!
খাওয়ার আগে এসব নিয়ে কথা উঠেছিল। তিনি শান্তিময়কে তার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “শান্তি, তোমার বাবার শরীর খারাপ নাকি? তিনি কি এবার আমার সাথে দেখা করতে আসবেন না?”
শান্তিময় না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো লজ্জায় মাথা নত করত, শান্তিময় নিঃসংকোচে সাহস করে পিতার ব্যাপারে বলেছিল, “বিমলামোহন গাঙ্গুলি এখন শহরের গান্ধিবাদী, শান্তিবাদী নেতা। তিনি অহিংসনীতিতে থাকতে চান, সেভাবেই দেশের কাজ করতে চান। এ কারণে আপনার সশস্ত্র সংগ্রামের পথ তিনি পরিহার করে চলতে চান।”
নেতাজি পিতা সম্পর্কে পুত্রের মুখে এ কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ তিনি শান্তিময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, বাইরে থেকে শান্তিময়ের মুখটা ভিন ভাষার গ্রন্থ বলে মনে হচ্ছিল। ফরোয়ার্ড ব্লকের স্থানীয় সভাপতি দুর্গাদাস ব্যানার্জি সম্ভাব্য প্রশ্নবুলেটের ভয়ে তখন কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। কারণ, তাঁর ভাই নৃপেন ব্যানার্জি প্রাদেশিক কংগ্রেসের বড় নেতা। তিনিও সুভাষের পথকে আপন মনে করেন না, গান্ধিজীর পথেই আছেন। বরং নৃপেন ব্যানার্জি সময় এবং সুযোগ পেলে সুভাষচন্দ্রকে গালাগালি করেন।
সম্পাদক রমেশ চ্যাটার্জি বইপড়া লোক। তিনি জেলে বসে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়েছেন। পৌরসভার নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনারও ছিলেন, তিনি দুর্গাদাসের বিব্রতকর অবস্থা কাটানোর জন্য প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি সকালের সেই বিরাট ঘটনা নিয়ে থাকতে চেয়েছেন।
ঢাকেশ্বরী হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সূর্যকুমার বসু কয়েকদিন আগেই চিঠিতে জানিয়ে রেখেছিলেন, নেতাজি এবার নারায়ণগঞ্জে এলে তাঁর স্কুলটি যেন উদ্বোধন করেন। সুভাষ সাগ্রহে সম্মতি জানিয়ে চিঠির উত্তরও দিয়েছিলেন। গতকাল ছিল সেই দিন; সকাল থেকেই ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা সে আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা নানা জায়গায় অবস্থান নিয়ে কাজ করছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে স্টিমারঘাটে। একটা স্টিমার আগেই বলে রাখা হয়েছিল, নেতাজি ঢাকেশ্বরী ঘাটে সেই স্টিমারে চড়ে যাবেন ।
স্টিমারটি ছিল আইজিএন অ্যান্ড আরএসএন নামক ব্রিটিশ কোম্পানির, তাই সে জাহাজের অগ্রভাগে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ছিল বৈশাখের পাটপাতার মতো তপ্ত বাতাসে। সুভাষচন্দ্র তো ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজে চড়বেন না! দলীয় কর্মীরা পতাকা নামিয়ে ফেলার অনুরোধ করে জাহাজের স্টাফদের, কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হয় না। তারা কাতর স্বরে জানায়, তাদের চাকরি চলে যাবে। স্টিমারের কেবিনে তখন নেতাজি বসে আছেন, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সূর্য বসু, তাঁর পুত্র সুনীল বসু এবং স্থানীয় নেতাকর্মীরাও আছেন, কিন্তু জাহাজ ছাড়ছে না। সারেং, সুকানি সবাই চাকরি যাবার ভয়ে হোক অথবা ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে হোক জড়সড় হয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছে।
এ খবর রটতে বেশি দেরি হলো না। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিভি আর ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা পিকেটিং শুরু করে। মিল-কারখানা থেকে সুভাষপ্রেমিক শ্রমিকরা বেরিয়ে আসতে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় তারা স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সারা শহরে ভাংচুর শুরু হয়ে যায়। ঘটনা অনেক বড় হয়ে যেতে পারে ভেবে স্টিমার কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে নেতাজিসহ সবাইকে ঢাকেশ্বরী ঘাটে নিয়ে যায়।
সুভাষচন্দ্র চোখের তন্দ্রা কাটিয়ে উঠে ঘোষণা দিলেন, “বিকালে ঢাকায় জনসভা আছে করোনেশন পার্কে। আমাকে আপনারা এখনই ট্রেনে তুলে দিন। আর যাদের সময় হবে তারা আমাদের সাথে চলুন।”
নেতাজির এ কথায় উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো, যাঁরা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন তাঁরা সোজা হয়ে বসলেন, যাঁরা কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিলেন তারা নেতাজির দিকে তাকালেন, কেউ কেউ পিকদানির দিকে মুখ এগিয়ে পানের পিক ফেললেন। তবে ঢাকার জনসভা আকস্মিক না; সেটা অবিনাশ, শান্তিময়, রমেশ, দুর্গাদাসসহ অনেকেরই আগে থেকে জানা। তাঁদের মধ্য থেকে অনেকেই একটু পর সুভাষের সহযাত্রী হয়ে ঢাকা যাবেন। ঢাকার জনসভাটি একদিন পরে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শিঘ্রই পার্টির নতুন কর্মসূচি আসছে, সেটা অনেক কঠিন হতে পারে, নেতাজিকে আবার গ্রেপ্তার করা হতে পারে; এসব বিষয় মাথায় রেখে সভার কাজ একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে।
সুভাষচন্দ্র বিকালের ট্রেনে চলে যাচ্ছেন শুনে অনেকেই তাঁর সাথে দেখা করতে আসছেন। আবার ভিড় বাড়ছে বিনয়কৃষ্ণ রায়ের বাড়িতে। দরোজার দিকে মুখ করে বসার কারণে হঠাৎ সুভাষ দেখতে পেলেন মনসুর আলিকে কে যেন বাহুতে ধরে বাড়ির গেট দিয়ে টেনে ভেতরে আনছে। পেছনে সালোয়ার-কামিজ-পরা একটি মেয়ে, মুসলমান নারী বলেই মনে হচ্ছে তাঁর, সেও আসছে, বোধহয় মনসুরের কোনো আত্মীয়া। সুভাষ মনে মনে আশাবাদী হয়ে উঠলেন, এই মেয়েটির মতো মুসলমান নারীরা যদি তাঁর দলে ভেড়ে তাহলে এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আসতে বিলম্ব হবে না। স্বামীজী মনে করতেন হিন্দুরা ভারতের মাথা আর মুসলমানরা শরীর, এই পূর্ণাঙ্গ শক্তি নিয়ে লড়াই করলে অচিরেই ভারতবর্ষ স্বাধীন করা সম্ভব হবে।
গতরাতে স্থানীয় মুসলমান নেতাদের সাথে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, তাঁরা কংগ্রেসের মতো ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রতিও অনীহা, বিতৃষ্ণা এবং বিরক্তিকর মনোভাব নিয়ে আছেন কি না। যদিও অনেক মুসলমান গত কয়েক বছরে কংগ্রেস ছেড়ে, কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে এমনকি বিপ্লবী রাজনীতি ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। ফজলুল হক সাহেবের কৃষকপ্রজা পার্টির কর্মীরাও নাকি এখন মুসলিম লীগে যোগদান করছে। এরমধ্যে কয়েকবার নারায়ণগঞ্জে এসে গেছেন ফজলুল হক সাহেব। তিনি তাঁর কৃষকপ্রজা পার্টির হয়ে মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশনে ক্ষমতায় আছেন, কিন্তু মন্ত্রিত্বের প্রতি তাঁর যতখানি প্রসারিত দৃষ্টি নিজের পার্টির প্রতি ততটা নাই, কর্মীরা সরে যাচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি নাই। সুভাষের সন্দেহ ফজলুল হক সাহেব নিজেই নিজের দল জিন্নাহর কাছে বিক্রি করে দেন কিনা! কারণ, মুসলিম লীগ মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। জিন্নাহ সাহেব মাত্র কিছুদিন আগে লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব ঘোষণা করিয়েছেন ফজলুল হককে দিয়ে। তাঁরা মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করছেন। এই লাহোরে সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন উনিশশ তিরিশ সালে। আর ঠিক দশ বছর পরে সেই শহরেই সম্মেলন করে জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা সারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা চান না, মুসলমান অধ্যুষিত আংশিক মানচিত্র চান শুধু।
নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইলের ফল ব্যবসায়ী শরবত আলী আর নলুয়াপাড়ার খেলাফত আন্দোলনের সাবেক কর্মী শাহেদ বেপারি সেই লাহোর মুসলিম লীগের সম্মেলনে ডেলিগেট হিসাবে গিয়েছেন, এখনও ফেরেন নাই। হয়তো তাঁরা এই সুযোগে আগ্রা-আজমির ঘুরে আসছেন বলে ফিরতে সময় লাগছে। তাঁরা এসে যখন জনসভা করবেন, তখন মুসলমানদের জোয়ার মুসলিম লীগের দিকেই যাবে। তার আগেই ফরোয়ার্ড ব্লককে শক্তভাবে কর্মসূচি দিতে হবে। কংগ্রেস নষ্ট হয়ে গেছে; দক্ষিণপন্থীদের হাতে, আপোষপন্থীদের হাতে গিয়ে কংগ্রেস এখন আর স্বাধীনতা চায় না, গণতন্ত্র চায় না, ভারতবাসীদের মর্যাদা চায় না, মানুষের অধিকার চায় না; তারা এখন ব্রিটিশদের উন্নয়নের ভাগীদার হতে চায়। ইউরোপে দেখে এসেছেন সুভাষ, আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বজুড়ে নেমে আসছে বৈশাখের শিলাবৃষ্টির মতো, গান্ধিজীর কংগ্রেস এখন যুদ্ধে ব্রিটিশদের সহযোদ্ধা হতে চায়, ব্রিটিশ জাতকে রক্ষা করতে চায়। গান্ধিজীর মতো নেহরুও তো তাই বলেছেন।
তিনি এখানে এসে বুঝতে পারছেন বঙ্গের মুসলমানদের মনোকষ্ট দূর করতে হলে, কংগ্রেসের স্টাইলে রাজনীতি করলে হবে না। ফরোয়ার্ড ব্লককে নিজের মতো করে কর্মসূচি নিতে হবে। মুসলমানদের ভালোবেসে কাছে টানতে হবে। সতেরো বছর আগে মুন্সীগঞ্জের রেকাবিবাজারে কর্মীসম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “ইংরেজদের আগমনের জন্য বাঙালীই প্রধানত দায়ী। কাজেই প্রায়শ্চিত্ত বাঙালীকেই আগে করতে হবে। কংগ্রেসের প্রোগ্রামের মধ্যে চাষী, মুটে, মজুর ইত্যাদি টেনে আনবার কোনও কথাই পাই না। তাঁদেরকে সংঘবদ্ধ না করলে স্বরাজ হবে না।”
সুভাষচন্দ্র বসু এবার নারায়ণগঞ্জে এসেছেন বিরাট আশা নিয়ে। উনিশশ আটত্রিশ সালে কংগ্রেসের হয়ে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শহরে প্রচার অভিযান চালিয়ে বুঝেছিলেন, পূর্ববঙ্গের মানুষেরা, বিশেষ করে মুসলমানরা কংগ্রেসের রাজনীতিকে ঘৃণা করে। তিনি কয়েকটি শহরে কংগ্রেস কর্মীদের ওপরে মুসলিম লীগ কর্মীদের ইট-পাটকেল ছোড়ার ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছেন। এ শহরেও টানবাজারে বিরাট জনসভা করেছিলেন। মুসলমানদের দূরত্ব তিনি এখানেও অনুভব করেছেন, অথচ তিনি যখন কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্য পট্টভি সীতারামাইয়ার সাথে নির্বাচন করেছেন তখন অনেক মুসলমানের সমর্থন পেয়েছিলেন। নরেন্দ্র দেব, প্রফুল্লচন্দ্র রায় আর রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদের সাথে পেয়েছিলেন রফি আহমদ কিদোয়াই, হুমায়ুন কবীর, নবাবজাদা হাসান আলি চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, এম আর মাসানি এবং চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অনেকের অকুণ্ঠ সমর্থন আর বিপুল সহযোগিতা। এক হাজার পাঁচশ আশি ভোটের মধ্যে মুসলমানের ভোট অনেক ছিল। কাছের মানুষদের মধ্যে শুধু মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আর আবদুল গাফফার খানের সমর্থন পান নাই। কিন্তু পূর্ববঙ্গের ব্যাপার একেবারেই ভিন্ন।
এখানে এসে এবার তিনি বেশ বড় রকমের হোঁচট খেয়েছেন; একেবারে আকাশের রঙ বদলে যাওয়ার মতো ঘটনা। আগেই তিনি চিঠিতে শান্তিময় আর দুর্গাদাসকে বলে রেখেছেন তিনি এখানকার সম্মেলনের আগে ফরোয়ার্ড ব্লক আর বেঙ্গল ভলান্টির্য়াসের কর্মিদের নিয়ে বসবেন। আর সভার পরে কংগ্রেস, বিপ্লবী দলগুলো, কমিউনিস্ট পার্টি এবং মুসলমানদের নিয়ে পৃথকভাবে ঘরোয়া সভা করবেন। সবাইকে সেভাবেই দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি এসেই শুনলেন কমিউনিস্ট পার্টির হামলায় তাঁর দলের বিশ্বস্ত কর্মী জ্যোতির্ময় ভৌমিকের নিহত হওয়ার ঘটনা। তাঁর সম্মেলনের মাত্র কয়েকদিন আগে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। কেউ কেউ গোপনে তাঁকে জানিয়েছে, এই হামলার জন্য নাকি জ্যোতিই প্রধানত দায়ী ছিল। ছাত্র ফেডারেশনের সভায় জ্যোতিই তার দলবল নিয়ে আগে হামলা করেছিল। প্রথমে ফেডারেশনের কর্মীরা মার খেয়েছে। পরে তারা বিপুল বিক্রমে পাল্টা হামলা করেছে, তাতে ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মী জ্যোতি মাথায় আঘাত পেয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে মারা গেছে।
এই যে এই শহরে রমজান সরদার, আফজাল আলির মতো সাধারণ মানুষ খুন হলো, বরিশাল ও কুমিল্লাতেও মুসলমান পুলিশ হত্যা করা হলো, এগুলো মুসলমানরা ভালোভাবে নেবে কি?”
জ্যোতিদের পরিবারটি নেতাজির কাছে বিশ্বস্ত, ওরা নয়টি ভাই, সবাই সুভাষের সমর্থক। আগে ওরা বিভি করত, এখন ফরোয়ার্ড ব্লক করে। তাদের বাবা উমেশচন্দ্র ভৌমিক সেই বঙ্গভঙ্গের যুগে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবী বীর ছিলেন। এখানে এসে সুভাষচন্দ্র পুত্রহারা পিতাকে সান্ত্বনা দিতে তাদের দেওভোগের বাড়িতে ছুটে গেছেন। শোকাহত পিতা উমেশচন্দ্র সুভাষকে জড়িয়ে ধরে জানিয়েছেন, তাঁর সকল পুত্রই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
সুভাষচন্দ্র গোপন কথা যেটা শুনেছেন, ঘটনার সত্যতা কতটুকু কে জানে! জ্যোতি অন্যায় করে থাকলে সিনিয়রদের উচিত ছিল ঘটনার রাশটানা। কিন্তু সিনিয়রদের দায়িত্বহীনতায় কেমন হয়ে গেল ব্যাপারটা! তিনি বলেছিলেন, এ সময় তিনি একাধিক ফ্রন্টে লড়াই করবেন না; শুধু কংগ্রেসের সাথে লড়াই হবে, কমিউনিস্ট পার্টি, মুসলিম লীগ বা অন্য সব দলকে তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নামাতে চান। গত জুন মাসেই তো ‘বামপন্থী সমন্বয় কমিটি’ গঠন করেছেন, সেখানে ফরোয়ার্ড ব্লক, সোশালিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, এমএন রায়ের র্যাডিকেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং ভারতীয় কিষাণ সভা ছিল। যৌথসভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করে থাকলে এখানকার কর্মীরাই দায়ী থাকবে। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি এখন দূরে সরে গেল। অভিজ্ঞতা বলে, পুলিশ নানা ধারায় মামলা দিয়ে এই দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয় ধাক্কা খেলেন সম্মেলন করে। তিনি অনেক লোকের সমাগম নিয়ে আশা করেছিলেন, কিন্তু এবার লোক হয়েছে আগের বারের চার ভাগের এক ভাগ। কংগ্রেসের নেতারা তলে তলে ফরোয়ার্ড ব্লকের এই সম্মেলনে না আসার জন্য শহরের এবং শহরের বাইরের জনগণকে ভয় দেখিয়েছে। তাদের দলের লোকজন তো সভা বর্জন করেছেই, অন্য লোকদেরও আসতে নিষেধ করেছে। তবে জ্যোতির্ময় ভৌমিকের হত্যাকাণ্ডের কারণেও লোকজন ভয়ে না আসতে পারে।
তৃতীয় ধাক্কা খেলেন আজ সকালে, ঢাকেশ্বরী যাওয়ার সময় স্টিমারের কাণ্ডে। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ কোম্পানির জাহাজে চড়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। আরও কয়েকটি বিষয় তাঁকে হতাশ করেছে। তিনি স্থানীয় মুসলমানদের তাঁদের সম্মেলনে আসার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন, কেউ কেউ এসেছিলেন, সংখ্যায় তারা খুব কম। সভার পরে তিনি মুসলমান নেতাদের সাথে বসতে চেয়েছিলেন, পৌরসভার চেয়ারম্যান আহাম্মদ আলী, মুসলিম লীগের সভাপতি ওসমান আলি, বড় আলমাস আলি এবং আউয়াল সাহেবের মতো কয়েকজন এসেছিলেন। ছোট আলমাস এবং আরও অনেকে আসেন নাই। যাঁরা এসেছেন তাদের সাথে কথা বলে তেমন কিছু বোঝা গেল না, কারণ তাঁরা মুখ খোলেন নাই, যেন শুধু শুনতে এসেছেন, তাই শুনে গেছেন। তবে অনুমান করা গেল, তাঁরা ফজলুল হকের কথায় আস্থা রাখেন, জিন্নার কথায় স্বপ্নও দেখেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা তাঁরা সমর্থন করছেন বলেই মনে হচ্ছে।
কিছুদিন আগেই সুভাষচন্দ্র জিন্নার সাথে দেখা করেছেন, আলাপ করেছেন, পরে পত্রেও মতবিনিময় করেছেন, কিন্তু জিন্নার মত পাল্টাতে পারেন নাই। তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতার কথা, আগে দেশটা স্বাধীন হোক, তারপরে দেশগড়ার সময় হিন্দু-মুসলমানের পদ-পদবি এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলাপ করার অনেক সময় পাওয়া যাবে।
এখানে এখন হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠনের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। বাঙলায় এই দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। পরেশ কর আর শীতল চক্রবর্তীরা লোকজন নিয়ে ঘন ঘন সভা করছে ডাক্তার মনীশ সেনের বাড়িতে। সেখানে নাকি নিয়মিত উপস্থিত থাকেন সোনারগাঁয়ের জমিদার আনন্দমোহন পোদ্দার। তাঁরা নাকি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে নারায়ণগঞ্জে আনার চেষ্টা করছেন। এখানে আনন্দমোহনের ব্যক্তিগত স্বপ্নও আছে। তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চান। মনীশ সেন প্রকাশ্যে সকলের সম্মানের পাত্র হলেও গোপনে অনেকেই তাঁকে নিন্দা করে, এ খবরও নেতাজি পেয়েছেন। সুভাষ অনেক আগেই হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে ইঙ্গিতে বলেছিলেন, “আমাদেরকে একদিকে ‘বৈদিক যুগে ফিরে যাও’-চিৎকারে বাধা দিতে হবে, তেমনি অপর দিকে আধুনিক ইউরোপের অনুকরণে অর্থশূন্য পরিবর্তনের বিরোধিতাও করতে হবে।”
মনসুর বিভির সাবেক কর্মী, এখনো হয়তো সেখানে আছে। তলে তলে বিপ্লবী রাজনীতি করে, কমিউনিজমের প্রতি তার টান আছে। তবে সে মুসলমান বলে স্থানীয় মুসলমানদের মনোভাব সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারে; এ কারণে তাকে খুব প্রয়োজন। সুভাষচন্দ্র দরোজায় দাঁড়ানো রমেশকে ডেকে মনসুরকে ডাকার জন্য ইশারা করলেন।
মনসুর ডাক পেয়ে কচুরিপানা ঠেলে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো কক্ষের মেঝেতে বসা সবার পাশ কাটিয়ে গিয়ে নেতাজির সামনে উপস্থিত হলো। সুভাষ একটু পরে চলে যাবেন, এ শহরে আর আসা হবে কিনা কে জানে, যাওয়ার আগে সন্তানের মতো মনসুরের মুখের দিকে তাকালেন। মনসুর নেতাজির চোখের দিকে তাকাতে সাহস পেল না, চোখ নামিয়ে ফেলল। সুভাষচন্দ্রের মনে হলো এই ছেলে আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। আগে সে চোখে চোখ রাখতে ভয় পেত না, বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর হাতের বোমার মতো ছিল তার চোখ। এখন তার মধ্যে একটা মুখচোরা স্বভাব দেখা দিয়েছে।
গতবার এসে তিনি মনসুরের সাথে অনেক কথা বলেছিলেন। মনসুরও মন খুলে সাহস নিয়ে কথা বলেছে, সে কংগ্রেসে যোগ না দেওয়ার কারণগুলো স্পষ্ট জানিয়েছিল। এবার সে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে, কাজ করে চুপচাপ, মুখে রা করে না। কে জানে হয়তো সে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি চোরাটান থেকে জ্যোতির্ময় ভৌমিকের হত্যাকাণ্ডে কোনওভাবে জড়িত আছে কি না। মনসুর দিনের বেলা পাটের গুদামে কাজ করে, কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছ থেকে ধার করে বই নিয়ে রাত জেগে পড়ে। শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষেও কাজ করে। তবে সে ছাত্র নয় বলে ছাত্র ফেডারেশন করে না, কিন্তু দলীয় স্বার্থে জ্যোতির বিরুদ্ধে যেতে পারে বলে মনে করেন সুভাষ।
সুভাষচন্দ্র মনসুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাকে সাথে নিয়ে এসেছ?”
“স্যার, আমার এক ভাইঝি, ঢাকা যাবে, গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্য স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম, ওরা ধরে আনল আপনার কাছে। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আবার এখানে আসতাম!”
মনসুর নেতাজিকে স্যার বলে। নেতাজি পালঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে বললেন, “মনসুর, তুমি যদি ফরোয়ার্ড ব্লকে না আসতে চাও, তোমার ভাইঝি, ভাবি এবং আরো যারা নারী আছেন তাদের যোগ দিতে বলো। আমরা কিন্তু কংগ্রেসের মতো মুসলমানদের ঘৃণা কুড়োতে চাই না। আমরা ভারতবর্ষের সকল মানুষের ভালোবাসা পেতে চাই। তুমি কী মনে কর? মনে কোনো দ্বিধা আছে?”
মনসুর বুঝতে পারলো নেতাজি তার কাছে পার্টিতে যোগদান করার অঙ্গীকার আদায় করে নিতে চাইছেন। সে ভেতরে ভেতরে মেরুদণ্ড সোজা করে ফেললেও বাইরে থেকে তা বুঝতে দিল না। তবে সে কথা দিতেও চাইল না। এ সময় ওড়নায় মুখঢাকা নারী মনসুরের মতো করেই ঘরে বসা সমস্ত বেগানা পুরুষ লোকের হাঁটুর বা পিঠের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে নেতাজির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওড়নার আঁচল সরিয়ে ডানহাত কপালে ঠেকিয়ে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম।”
সুভাষচন্দ্র মুসলমান নারীটির দিকে তাকিয়ে রয়েছিলেন, তার সাহস আর কাছে আসার কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। মুখের ঘোমটা সরাতেই তিনি দেখতে পেলেন, তার বয়স বেশি হবে না, সতেরো-আঠারো হতে পারে। ভালো উচ্চতা তার, মনসুরের কাছাকাছি। উজ্জ্বল ফরসা মুখ, তার মুখে বয়সের লাবণ্যের সাথে কাঠিন্য আছে; তবে রুক্ষ নয়।
সুভাষ মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি তো অনেক সাহসী, আমার পার্টিতে আপনার মতো নারী যোগদান করলে খুশিই হবো। এখানে এত হিন্দুপুরুষের মাঝে যেভাবে এলেন, তাতে আমি অবাক হয়ে গেছি। আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখবেন। ভয়ের কিছু নেই, এখানে উপলা আছে, মিনু আছে, কিরণ আছে, ঝুনু আছে, তাদেরকে ভগ্নি বলে মেনে নিতে আশা করি আপত্তি থাকার কথা না। আপনার মতো পর্দানশিন নারী আমাদের পার্টিতে প্রয়োজন আছে।”
সুভাষ তার সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ সকলের দায়িত্ব কর্তব্য এবং অধিকার নিয়ে কথা বললেন, তাঁর পার্টির রীতিনীতি, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক কথা বললেন। তারপর মনসুর অনুমতি নিয়ে বিদায় জানিয়ে তার আত্মীয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সুভাষ তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও তাকিয়ে রইলেন। এরমধ্যে মেয়েটির নামটা জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গেছিলেন। যাক, পরে মনসুরের সাথে দেখা হলে জেনে নিতে পারবেন। না হলে কারও চিঠিমারফত জানতে পারবেন।
মনসুর গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতেই অন্দরমহল থেকে ভেতরের দরোজা দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে উপলা। সুভাষের পালঙ্কের কাছে এসে ঘাড়টা একটু কাত করে বাইরের দিকে তাকিয়ে সে যেন মনসুরের চলে যাওয়াটাই লক্ষ্য করছিল, সুভাষ তা লক্ষ না করে পারেন নাই।
সুভাষচন্দ্র মনসুরের পরিবর্তনটা টের পাচ্ছেন। আগে সে অনেক কথা বলত, অনেকগুলো বাক্য একনাগাড়ে উচ্চারণ করত। এখন সে ছোট ছোট বাক্যে কথা বলে। আগে তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি অনুচ্ছেদের শেষে একটি করে প্রশ্ন রেখে যেত, এখন সে কোনও প্রশ্ন করে না, শুধু প্রশ্নের উত্তর দেয়।
গতবার সুভাষ মনসুরের সাথে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের কংগ্রেসবিরোধিতার কারণ নিয়ে আলাপ করেছিলেন, তখন মনসুর বলেছিল, “এই অঞ্চলের মুসলমানরা গান্ধিজীকে শ্রদ্ধা করলেও বিশ্বাস করে না। আর আপনার গান্ধীভক্তি তো সর্বজনবিদিত। আপনি প্রকাশ্যে ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করেছেন, পতন দাবি করেছেন। ফজলুল হকের ক্ষমতায় থাকার সাথে এই অঞ্চলের মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষা এবং নানা রকম উন্নতির আশা-আকাক্সক্ষার গভীর সম্পর্ক আছে। ফজলুল হকের হাতে এদেশে সম্প্রতি অনেকগুলো কলেজ এবং স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অনেকগুলো নির্মাণাধীন, কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথে, আর কিছু আছে বিবেচনাধীন। মুসলমানদের কাছে ফজলুল হক সরকারের বিরোধিতা করার মানে, তাদের দুর্গতির শামিল। তাহলে মুসলমানরা আপনার কথা রাখবে কেন?”
“আপনি মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের বিরোধিতা করেছেন, পঁয়ত্রিশ সালের ভারতশাসন আইনের বিরোধিতা করেছেন, এগুলো তারা ভালোভাবে নেয় নাই। আসামের মুসলমান মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়ে কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশনে যেতে বাধ্য করেছেন, এতে কি আপনার প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস ও ভক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা?”
“সেই বঙ্গভঙ্গের কালে শ্রী অরবিন্দের পরামর্শে মুসলমান পুলিশ অফিসার শামসুল আলমকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই মামলায় অরবিন্দের ভাই বারীন্দ্রের কালাপানি হয়েছে। শ্রী অরবিন্দ নিজের ভুল বুঝতে পেরে রাজনীতি ছেড়ে পন্ডিচেরিতে চলে গিয়ে সন্ন্যাসী জীবন যাপন করছেন। সেই ঘটনার বিশ বছর পরে আপনি আবার সেই হত্যার রাজনীতি শুরু করেছেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সও সেসব ঘটনার জড়িত হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলমানদের হত্যা করাচ্ছে। যদিও আমি বিভির একজন কর্মী, দার্জিলিংয়ের লেবং অপারেশনে আমিও ছিলাম, কিন্তু এখন নিরপরাধ মানুষের হত্যাকে সমর্থন করি না। শ্রী অরবিন্দের কাছে এটা ছিল ‘তত্ত্বহীন উন্মার্গগামিতা’, সেটা আপনাদের কাছে মহৎমার্গ বলে বিবেচিত হলো! এই যে এই শহরে রমজান সরদার, আফজাল আলির মতো সাধারণ মানুষ খুন হলো, বরিশাল ও কুমিল্লাতেও মুসলমান পুলিশ হত্যা করা হলো, এগুলো মুসলমানরা ভালোভাবে নেবে কি?”
চিঠিটি সুভাষচন্দ্রের এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ফিরে এল, কারণ তিনি তখন কারাগারে।
“যখন চাকরি-বাকরিতে মুসলমানদের সংরক্ষিত সুবিধা দেওয়ার কথা সরকারিভাবে পাকা হচ্ছে, তখন আপনি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছেন, আবার ভেতরে ভেতরে মুসলমান চাকরিজীবীদের হত্যায় জড়িত আপনাদের কর্মীরা। এতে কি মুসলমানরা মনে করবে না যে আপনি তাদের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত?”
“মিসেস রোকেয়ার একটি বিখ্যাত উদাহরণ আছে, গরুরগাড়ি বা ঘোড়ারগাড়ির দুটি চাকার মধ্যে একটি ছোট এবং অপরটি বড় হলে, সেই গাড়ি এক স্থানেই ঘুরপাক খাবে, সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। ভারতবর্ষের, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের চাকাটা বড় হওয়ার সুযোগ না দিলে এইদেশ কিছুতেই সামনে যাবার পথ পাবে না। আপনি কী মনে করেন?”
সুভাষ আগে শুনেছিলেন মনসুর আলি পাটের গুদামে কাজ করে আর হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে রাত জেগে বই পড়ে, সেদিন তিনি টের পেয়েছেন কথাটা আসলে সত্যি।
এবার এসে শুনলেন, এবং দুর্গাদাস সেদিন প্রধান সড়কে রেলগেইটের কাছে দেখিয়েছে এখানকার মুসলমানরা ‘রহমতউল্লাহ ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এর পেছনে কারণও আছে। তিনি কমিউনিস্ট নেতা অনিল মুখার্জির কাছে শুনেছিলেন, এখানকার পাঠাগারে মুসলমান ছেলেদের বই পড়তে দেওয়া হয় না, মুসলমানদের কোনও বই রাখাও হয় না। তাই অনেকদিন ধরেই স্থানীয় মুসলমান নেতারা নিজেদের জন্য পৃথক পাঠাগার গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন; তারই ফল এই ইনস্টিটিউট। মনসুর সেখান থেকেও বই পড়ে।
মনসুরের কথা শুনে সুভাষ ভেতরে ভেতরে কিছুটা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু সেটা প্রকাশ হতে দেন নাই। তিনি মনসুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মনসুর, এসব কি তোমার কথা, নাকি এই অঞ্চলের মুসলমানেরা এসব বলাবলি করে?”
তখন মনসুর স্পষ্টভাষী ছিল, সে পরিষ্কারভাবেই বলেছিল, “এসব আমার কথা নয় স্যার, মুসলমানরা পথেঘাটে আলাপ আলোচনা করে। অনেকের কাছেই তো শুনি।”
সুভাষ কিছুটা চিন্তিত মনে বলেছিলেন, “তোমার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো আমাকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। আমি বোধহয় মনের কথাটা, নিজস্ব চিন্তাটা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে পারি নাই। তোমার কথাগুলোর উত্তরে আমি কি কিছু বলব, নাকি ভবিষ্যতে কোনও সভায় বলার জন্য এখন রেখে দেব?”
মনসুর বলেছিল, “বলার থাকলে এখন বলা উচিত, তাহলে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতে সময় নেবে কম।”
সুভাষ তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন, “বাড়িতে আগুন লাগলে আগে কি আগুন নেভানো উচিত নাকি জমির হিস্যা নিয়ে ঝগড়া করা উচিত? এখন উচিত ব্রিটিশদের বিতাড়ন করে দেশ স্বাধীন করা। তারপরে হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা নিয়ে সহস্রবার আলোচনায় বসা যাবে। আমি ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করেছি কংগ্রেসের অবস্থান থেকে, তবে তা অবশ্যই রাজনৈতিক কারণে; সাম্প্রদায়িক দিক থেকে নয়। তুমি তো বিপ্লবী রাজনীতি করেছ, তোমার তো জানা আছে এদেশের বিপ্লবীরা যাদেরকে টার্গেট করে তা ধর্মীয় পরিচয় থেকে করে না, তার অপরাধের মাত্রা থেকে করে। তুমি সেই শামসুল আলমকে হত্যা করার কথা বলেছ। শামসুল আলম হিন্দু হলেও রেহাই পেত না, যেমন রেহাই পায় নাই নরেন গোঁসাই। আর এখন তুমি রমজান সরদার আর আফজাল আলির নিহত হওয়ার কথা বলেছ, কেন তুমি শুধু মুসলমানদের ঘটনাই দেখছ, আমাদের বিপ্লবীদের হাতে কি খ্রিস্টান মারা যাচ্ছে না, হিন্দু মারা যাচ্ছে না? পুলিশ সুপার ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো কেন আমলে নিচ্ছ না?”
এবার আর মনসুরের সাথে তেমন আলাপ করার সময় পেলেন না, সুযোগও মিলল না। বিনয়কৃষ্ণ রায়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে রেলস্টেশনে গিয়ে সুভাষ দেখেন সেখানে অনেক মানুষ। প্লাটফর্মগুলো লোকারণ্য। এই ভিড়ের মধ্যেই তিনি গাড়িতে ওঠার সময় দূরে দেখলেন মনসুর সেই নারীকে ট্রেনে তুলে দিচ্ছে অন্য একটি বগিতে। আর আশ্চর্যের বিষয় উপলার উপস্থিতিও তাঁর চোখ এড়াল না! সে পুরুষদের ভিড় থেকে একটু দূরে অন্যমনস্ক এবং বিষণ্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করার আশায় সুভাষ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু উপলা তাঁর দিকে তাকাল না। তিনি ট্রেনের সিঁড়িতে উঠলেন।
পুনশ্চ: মাস দেড়েক পরে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানানোর জন্য সুভাষকে চিঠি লিখল অবিনাশ। সেখানে সে অনেক কথার সাথে উপলার কথাও লিখেছে, “উপলার বাবা মারা গিয়াছেন। সে এখন হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়াছে। ডাক্তার মনীশ সেনের ভ্রাতুষ্পুত্রের সহিত তাহার বিবাহের আগাম কথাবার্তা শুনিতেছি।”
মনসুর আলির কথাও বাদ দেয় নাই অবিনাশ। লিখেছে, “মনসুর মুসলিম লীগে যোগদান করিয়াছে। সে রমজান সরদারের কন্যা নূরজাহানকে বিবাহ করিয়া একটি মসজিদের ইমামতির পেশা গ্রহণ করিয়াছে। কংগ্রেসের মোস্তফা হোসেনসহ আরো কয়েকজন মুসলমান কর্মীও মুসলিম লীগে যোগদান করিয়াছে।”
চিঠিটি সুভাষচন্দ্রের এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ফিরে এল, কারণ তিনি তখন কারাগারে।