যাকে বলে, ফেঁচা কলে আঁটকে পড়া। সকাল সকাল কী দরকার ছিল কাকটার? আরে বাবা তুই তো সিডিউল কাস্ট পাখি! পৃথিবীটা ডাস্টবিন হয়ে গেলেও কারও তাতে যায় অথবা আসে না। এটা সত্যি। কিন্তু তুই তো ঝাড়ুদার পাখি! মানুষের সমাজের মতো তোদের সমাজেও চতুর্বর্গ আছে! আর তুই হলি গিয়ে চতুর্থ বর্গের একেবারে শেষ বর্গ! তোকে ঈশ্বর নিয়োগ করেছেন, এই ভুবনের যত অসুন্দর, সেসব খেয়ে, সাফসাফাই করে সুন্দর করে দিতে।
খ্যাক থুঃ।
কে রে! রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিজন্ চেঞ্জের সময়ে বুকের জমা কফ্ ফেললি? বেচারা বেওয়ারিশ কাক! এমন জেলির মতো থকথকে দলা দেখে লোভাতুর হয়ে গেলো! অথচ আজ সত্যিই ও নিরুপায়! কে যে জন্মদাতা, মনে মনে নিজেকে বিদ্রূপ করে কেঁদে উঠলো ও!
চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তবু পাকা বেলের ফাটল থেকে কিছুতেই ঠোঁট ছাড়ানো যাচ্ছে না। তার ওপর আবার খ্যাঁক থুঃ!
পৃথিবীজুড়েই খাবারের লোভনীয় হাতছানি কাককে বারবারই টেনে নিয়ে গেছে গাছের বাসা থেকে রাস্তার নরকে। কিন্তু এখন, এই পরিস্থিতিতে কী করা যায়? ওই লোভনীয় সাদা থকথকে টাটকা শ্লেষ্মা! এক্কেবারে তিনমাথার মোড়টা যেখানে বাঁয়ে বেঁকে নদীর দিকে চলে গেছে, সেদিকে তনু মুদি, দোকানে বসে থেকেও ছটফট করছে! সেখানেই, মুদির দোকানের সিঁড়ির ধাপের সামনেই লোকটা খ্যাঁক করেছে। একদম তনু মুদির দোকানের দোর গোড়ায়। যাকে বলে, ছি, ছি, ছি!
পাড়ার কত লোক সকাল সকাল সওদা নিতে আসে দোকানে! নিজের মনে মনে কাক ভেবেই চললো, তারা তো আমার মতো বিদঘুটে নয়! তাদের জামা কাপড়ের নিচে যাই থাকুক, আসলে তারা তো সবাই পোশাক-পরিচ্ছদে মানুষই!
গতকাল দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে অত্যাচার হয়েছিল ঠিক ওইখানেই! মানে তনুর দোকানের সামনেই। গতকালই, দিনের শেষে যখন সমস্ত পাখির সঙ্গে সেও গাছের বাসায় ফিরে আসছিল, তখন হঠাৎই ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল চারপাশটা! বিকেল বেলাটা যেন অমাবস্যার মধ্যরাত! এত্ত ধোঁয়া যে, পাখিদের ভুলিয়েই দিয়েছিল ঘরে ফেরার পথ। কোনোরকমে রাস্তার ইলেকট্রিকের তারের ওপরে ঠাঁই নিয়ে পুরো ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছিল কাক। কাক জানে, কে দীপক। দীপক নাম হলেই তো আর হলো না! সন্ধ্যাবেলার রাস্তায়, আলো জ্বালানোর বাতিওয়ালা সে মোটেও নয়! বরং ওই যে, মনসা মন্দির তলার পেছনের টালির বাড়ির এক চোখ কানা লোক, যে নাকি করপোরেশন থেকে রাস্তার আলো নেভানোর কাজ পেয়েছে, তেমনই বিশ্রী দেখতে, ক্ষমতার দম্ভী একটা লোক। আস্ত শয়তান একটা!
আমফল খেয়ে কোকিল হলে, সামনের বসন্তে আমার নতুনতর জিন থেকে প্রমীলা গর্ভ ভাড়া দেবে বল-বীর্যহীন, ডিমশূন্য কাক আর কাকিকে
ইশ! সরু সরু ঠ্যাং দুটো নিসপিস করে উঠলো কাকের। কিন্তু ও যে নিরুপায় এখন! এই সূঁচালো ঠোঁট ছাড়ানো কি আর যেই সেই ব্যাপার! তার ওপরে বেলের আঁঠা একেবারে লেপ্টে গেছে ঠোঁটে! সকাল বেলা কার যে মুখ দর্শন করে বেরিয়েছিল আজ!
ওঃ! হোঃ! সে তো প্রমীলা! ওই যে সারোগেট মাদার! বচ্ছরান্তে কোকিলের জন্য গর্ভ ভাড়া দেয়। সেই তো প্রমীলা কাকি! স্ত্রী লিঙ্গে, একজন মহিলা কাক, তো কাকি-ই হয়!
কী কাণ্ড! সকাল বেলাতেই, কোথা থেকে এক খাবলা আমাশয় পায়খানা মুখে লেপ্টে দিয়ে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি তো জানো না প্রিন্স বায়স! এ হলো রাজফল খাওয়া মল! চতুর রাজা, শয়তান রাজা, ধূর্ত রাজা, ভণ্ড রাজা—সবাই এই রাজফল, ‘আম’ খায়, আর ‘আম’ হাগে। তবেই হয় আমাশয় রোগ! সেই রাজ রোগ আজ তোমার মুখে লেপ্টে দিলাম, হে, প্রেমিক আমার! তুমিও আজ থেকে ওই ধূসর রঙের চতুর্থ বর্গের শেষ বর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে, আমগাছের ডালে ডালে না থেকে, পাতায় পাতায় থাকো ডিয়ার!
নতুনত্বের আদর আর ভালোবাসার স্বাদ! আহা! তল পেটটা কোঁৎ কোঁৎ করে উঠলো কাকের। নারীকে কামনা করলে পুরুষের পেটের তলার এমন একটা সুন্দর জায়গা থেকে জমাট বরফ গলতে থাকে। আর, জল চোয়াতে চোয়াতে পেশীতে খিঁচুনি আসে। দুই, থেকে তিনটা কুক্ কুক্ করার পরে তো, পৃথিবীটাই অচৈতন্যে চলে যায়!
এসব সুখানুভব নিয়ে কা…আ… বলে যেই না দুটো ডানা মেলেছে, অমনি পেছন থেকে প্রমীলা চিৎকার করে বলে উঠলো, ফিরে এলে, তোমার বীর্যে কোকিল জন্মাবে আমার গর্ভে।
বিশিষ্টজনেরা বলেন, পিছু ডাক ভালো নয়। বেশিদূরও যাওয়া হলো না। এরই মধ্যে ফাল্গুনের পাকা বেলের ম্ ম্ গন্ধে দিশাহীন কাক গন্তব্যের দিকে উড়ে গেলো। আর, লক্ষ্যবস্তু একটা আধা কমলা রঙের কাঁচাপাকা বেলে কামড় দিতেই সেই ফ্যাঁচা কলে আঁটকে গেলো কাক!
একবার ডান, তো একবার বাম! আজ যদি মানুষের মতো দুটো হাত থাকতো, তবে তো কিছু একটা ব্যবস্থা হতোই! অন্তত একবার হাত দিয়ে ওষধি ফলটা’র ফাটল থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা যেতো, এসবই কাকের মন কে বাত।
ওখানে কী হচ্ছে? ঝগড়াঝাটি নাকি? তনু মুদিকে উঠিয়ে কোমরে দড়ি বাঁধছে! ওরা কারা? এরপর দু’হাতে বালা পরিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিলো? উর্দিধারীই তো? হ্যাঁ! তবে তো ওরা পুলিশই!
গোল গোল, কালো ধূসর রঙের লোমে ঢাকা ছোটো ছোটো কানের ফুটো দুটো দিয়ে শুনতে থাকলো কাক, বেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দু’জন উচ্চপদাধিকারীই হবে সম্ভবত, বলছে, ঘটনার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতেই হবে! এমনই নির্দেশ এসেছে ওপর মহল থেকে। এই দোকানির কাঠের দোকানের নিচে এক বস্তা পেটো পাওয়া গিয়েছে। ওই দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে গতকাল ল্যাংচু, ভজারা সবাই মিলে যে পেটোগুলো ফাটিয়েছে, তনু মুদির দোকানের সামনে, সেগুলো আগেই স্টক করা ছিল দোকানের কাঠের পাটাতনের নিচে একটা বস্তার মধ্যে। তনু রাতে দোকান বন্ধ করে চলে যাওয়ার পরের ঘটনা এটা।
এদিকে বেলা বাড়ছে ক্রমশই। আঠা ল্যাপটানো ও বেলের ফাটলে ঠোঁট আঁটকে পড়া কাকের মনে পড়ে গেলো। আজ ভোরের বেলায় আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে তাকে প্রমীলা কাকি বলেছিল, আমফল খেয়ে কোকিল হলে, সামনের বসন্তে আমার নতুনতর জিন থেকে প্রমীলা গর্ভ ভাড়া দেবে বল-বীর্যহীন, ডিমশূন্য কাক আর কাকিকে। ওইসব নপুংসক, না-নাড়িরা এরপর পিতামাতা থেকে রাজা উজিরে পরিণত হবে। প্রচুর লাভ হবে এতে! সেই অর্থ দিয়ে, প্রমীলার কথায়, মানুষের মতো বাড়ি, গাড়ি, খানাখন্দ ভরাট করা জমি হবে।
নাঃ! সেইসব পেছনের কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমশই নাকের ফুটোতেও বেলের আঁঠা লেপ্টে যাচ্ছে কাকের। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কমে আসছে তার। তবু কান দুটো তো খোলা! শুনতে পাচ্ছে, দূরে ওয়াচ টাওয়ারের বেসমেন্টে অনেক কাক জড়ো হয়েছে একটা তরতাজা জীবনের ধীরে ধীরে, চুপিচুপি, নিঃশর্তে এবং পূর্ণ অ-রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মরণের দিকে চলে যাওয়া দেখতে।
ওরা রেডি! এক…দুই…তিন…
তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে আস্তে আস্তে জীবনের সব ভাঙাচোরা স্বপ্ন থেমে গেলো কাকের। প্রথমে লেজের দিকটা কাত হতে হতে বেল থেকে ঠোঁট ছেড়ে গেলো। আর উল্টানো শরীরের জোড়া পা দুটো আকাশের দিকে বিদ্রোহের মতো করে, শেষ পর্যন্ত ঠ্যাংই দেখিয়ে দিলো। আর তৎক্ষণাৎ, ঝাঁকে ঝাঁকে করোনাভাইরাসের ত্রাসের মতো ওয়াচ টাওয়ারের বেসমেন্ট থেকে উড়ে এলো শত সহস্র কাকের দল, কাকের মাংস খেতে।