তৃতীয়বারও একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তিতে অসহিষ্ণু হয়ে বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা রাখতেই গা শিরশিরিয়ে ওঠে তার। তিন কদম সে পৌঁছে ঘরের কোণায় রাখা মাটির কলসির কাছে। ঢকঢক করে গলায় পানি ঢাললে বুকটা জ্বালা করে ওঠে প্রচণ্ড উত্তপ্ত মাটিতে পানি পড়লে ভাপ ওঠে যেমন। বুকে আলতো হাত বুলায় কিছুণ। তারপর অন্ধকারে স্থির হয়ে থাকে সে। বেড়ার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে আলো আসছে, কাফনের মতো শাদা আলো। সালেহা তার সামনে এসে দাঁড়ালে সে দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করে। সালেহার কণ্ঠে হাহাকার, ‘আপনে অহনঅ আয়লেন না। পোলাডারে লইয়াত আর পারতাছি না।’ পরনে তার শাদা শাড়ি, নাকি সে কাফনের কাপড় নিয়েই চলে এলো? জলচৌকি টেনে বসে সালেহা, ‘বড় তিষ্ণা লাগছে, আমারে একগেলাস পানি খাওয়াইবেন?’ কী করবে কলিম বুঝে ওঠতে পারছে না কিংবা তার ভয়ভীতি সবকিছুর মতোই মাত্রাতিরিকে অনুভবের বাইরে। সে গ্লাসে পানি ঢেলে ধরিয়ে দেয় স্ত্রীর হাতে। সালেহা আর কিছু খাবে কি না জিজ্ঞেস করেই মনে পড়ে ঘরে কিছুই নেই।
মৃতের ঘরে উনুন জ্বালানো নিষিদ্ধ। গতকাল বিকেলে সালেহাকে কবরস্থ করে আসার পর বড় ভাইয়ের ঘরে ভাত খেতে বসে প্রথম কান্না পেল কলিমের, চোখের জলে নাকের জলে একাকার করে কয়েকদলা ভাত গোঁজে মুখে। মোটা চালের ভাত, আলু-পটলের ঝোল দলাদলা হয়ে আটকায় বুকের মাঝখানটায়। আতর-গোলাপে সুবাসিত সালেহাকে মাটি চাপা দিয়ে এল। কবরের কার্নিসে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো লালিমাভায় সালেহাকে দেখতে দেখতে আতর-গোলাপের সৌরভে সে স্থান এবং সময় বিস্মৃত হয়, কিংবা এ দেখাই শেষ দেখা-এ রকম অনুভূতির আক্রান্তিতে স্মৃতির দুয়ারে মাথা ঠোকে-অনিবার্য এক রাতের স্মৃতি টুকটুকে লাল শাড়িতে ঘোমটাঘেরা এক বালিকা, নরম শরীরের উষ্ণ স্পর্শ। শেষ বিকেলের সূর্য তাকে সুন্দর করে দেয় কিংবা মুত্যৃতেই আরো সুন্দর ও মোহনীয় হয়ে ওঠে সে। বাঁশের আঁড়ের আড়ালে হারিয়ে যায় সালেহা। মাটির প্রথম ঢেলাটি নিপে করতে গিয়ে হাত কাঁপে ভীষণ, অনেক সময় ক্ষয় হয় মৃত্তিকা খণ্ডটি নিক্ষিপ্ত হতে এবং তারপর অতিদ্রুত সালেহা হারিয়ে যায় অন্ধকারের অতল গহ্বরে। সালেহা কি শেষবারের মতো তাকে বলেছিল, ‘আমি মরলে আপনে আরেকটা বিয়া কইরেন’ না কি তার কদমফুলের রেণুর মতো যুগলভ্রূতে ছিল ঘৃণার কুঞ্চন। আসলে রাধামণি দাইয়ের ডাকে ছুটে গেলে সে কেবল একবার কলিমের হাত স্পর্শ করে এলিয়ে পড়েছিল বিছানায়।
চৈত্রের ভরাদুপুরে পেট চোঁ চোঁ ক্ষিধের জ্বালায় মাঠ থেকে ফিরে দেখে সালেহা ঘুমাচ্ছে আর তরকারির ডেকচিতে পোড়া লেগে শোল মাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাড়িতে। তার মাথায় খুন চাপে, সে ভুলে যায় সালেহা অসুস্থ। আসলে এমনটা হতো না যদি পথে রইসউদ্দিনের সঙ্গে দেখা না হতো। রইসউদ্দিনের জমির বর্গাচাষী কলিম। রইসউদ্দিন এবার পাওয়ার পাম্পের টাকা না দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ভাগচাষীদের, সমস্যাটা ছিল ছোট এবং সমাধানযোগ্য আর কলিমের প্রতি রইসের একটা পক্ষপাত সব সময়ের। বোগলতলিতে গোটানো ছাতা নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিল রইসউদ্দিন। তখন কথা না বললেও চলত, পরে এক সময় কলিম যদি বলত, ‘আপনে আমার মা-বাপ, আপনে না চাইলে আমার ফিল চাইব ক্যাডা?’ রইসউদ্দিনকে দেখার পর অকস্মাৎ তার মাথায় যেন ভূতের আছর ধরে, হিসেব-নিকেশ করার অবসরটুকুও দেয়নি নিজেকে, আগে থেকেই তার মধ্যে একটা অস্থিতি ক্রিয়াশীল ছিল, নগদ দুপয়সার একমাত্র উৎস দুগ্ধবতী গাইটার মরমর অবস্থা দেখে মাঠে গিয়েছিল সে এবং সেখানে তাকে তাতিয়ে দিয়েছে রইসের অন্য ভাগচাষীরা। ফলত রইসউদ্দিনকে দেখে উত্তেজিত হয়ে একটা জটলা জমিয়ে ফেলে সে। রইসউদ্দিনের ক্ষীণ প্রচেষ্টা ছিল তাকে থামাবার, মিনমিনে গলায় দুয়েকবার সে বলেছে, ‘গাওরামি করিছনাত পাগল।’ সে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে কিংবা জটলাটা তার মধ্যে বীরত্ব জাগায়, রইসের পিতৃপরিচয়দানে ব্যাপৃত হয় সে, রইসের দাদা ছিলো কার কেনা গোলাম- এ সমস্ত সে জানায় সমবেত সমাবেশে, সত্য-মিথ্যার দুআঁশলা যে সব কথা জানা গাঁয়ের সবর্জনের, কিন্তু বলার মতো সাহসী কেউ নেই। ওই জটলাতেই রইসউদ্দিন কলিমের দখলে তার যে দশকানি জমি ছিল তার বিলি-বণ্টনের ব্যবস্থা করে। শুধু এ জন্যই ঘুমন্ত সালেহাকে দেখে, তরকারি পোড়ার কারণ বুঝতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারত সে। তদুপরি ঘরে ঢোকার আগে দেখল গরুটা মরে পড়ে আছে উঠোনে। চুলের গোছা মুঠোয় পুরে সালেহাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে কলিম। কিছু বুঝতে পারার আগেই তবিত হলো সালেহা। একটুও কান্না করেনি সে, দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছিল নিপীড়ন, কেবল জ্ঞান হারাবার আগে একবার আর্তনাদ করেছিল, যখন প্রবলভাবে কলিম লাথি ছোড়ে তার তলপেটে।
সালেহা বলে, ‘আমি যাইগা। আপনে তাড়াতাড়ি আয়েন।’ তখন কলিম বুঝতে পারে না স্বপ্ন না বাস্তবে তার উপস্থিতি। তৃতীয়বারের স্বপ্ন থেকে জাগরণের পর এক গ্লাস পানি খেয়েছে সে তা মনে করতে পারছে। তবু দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে কি না, তা বোঝার জন্য নানাভাবে পরীক্ষা করে নিলো, যেমন নিজের শরীরে চিমটি কাটা, একটু হেঁটে বেড়ানো, বেড়ার গায়ে হাত বোলানো ইত্যাদি। সালেহাকে চলে যেতে দেখে হঠাৎ মনে হয়, তাকে এভাবে যেতে দেওয়া যায় না। তার কপালের দুপাশের শিরা দুটো লাফায়, কানের ভেতর জেটপ্লেনের যাওয়া-আসা। ততক্ষণে সালেহা দরজা খুলে পৌঁছে গেছে উঠোনে। পেছনে কলিমও বেরিয়ে আসে। বারবাড়ির ঘাটা ছেড়ে সালেহা ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটে। কলিম দৌড়ায় প্রাণপণে অথচ ক্রমশ দীর্ঘায়িত হয় ব্যবধান। বাতাসে উড়ছে শাড়ির আঁচল যেন এক ঝাঁক শাদা বক।
কলিম যখন বড় ভাইয়ের দরজায় ধাক্কা দেয় ততক্ষণে অন্ধকার কেটে কেটে ছাইরঙা ভোর নেমেছে। বড় ভাইয়ের কাছে তিন তিনবারের স্বপ্ন বিবৃত করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সে এবং বর্ণনার একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। সলিম তার ছোট ভাইয়ের ঘরে একজন মৃতের আগমনের কথা শুনে বিস্মিত, কিছুক্ষণ সে কোনো কথাই বলতে পারেনি। অবশ্য সলিম প্রথমে বিশ্বাস করতেই চায়নি এ কথা; কিন্তু তার স্ত্রী টিমটিমে হারিকেনের আলোটা উসকে দিলে দেখে কলিমের সারামুখে বসন্তের ক্ষতের মতো ঘামের বিন্দু। বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেয়ে কলিমের অস্থিরতাই বিশ্বাস্য করে তোলে বর্ণিত ঘটনাকে। ভাইকে শান্ত করার চেষ্টায় মসজিদে যাওয়ার প্রস্তাব করে সলিম।
নামাজের শেষে কলিম তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত বলে। সাক্ষী সলিম জানায়, যে গ্লাসে সালেহা পানি খেয়েছে সে নিজে সেই গ্লাসে আধা গ্লাস পানি দেখেছে। তখন মুসল্লিদের মনে প্রশ্ন জাগে এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সলিম বলে, ‘সালেহা যেই খাডত বয়ছিল তার পেড়েকঅ এক টুকরা শাদা কাপড় আটকায় রইছে।’ মসজিদে বহু কণ্ঠের অনুরণন শোনা যায়। ইমাম তার সফেদ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, ‘এমুন একটা ঘটনা অসম্ভব কিছু না’ কবর খুঁড়ে তিনি যদি দেখেন পোয়াতী সালেহা সন্তান ভূমিষ্ঠ করেছে কবরের ভেতর, আশ্চর্য হবেন না। মাছের পেটে ইউনুস নবীর বেঁচে থাকা, সোলেমান নবীর তখত আর মুসা নবীর জাদুর লাঠির গল্প বলেন তিনি। বহুবার শোনা এসব গল্প, অথচ একটুও বিরক্ত হয় না কেউ। ইমাম সাহেবের সুরেলা গলা টুং টাং বাজে। রজবালির বউ এতণে নিশ্চয়ই সকালের রান্না সেরে তার জন্য অপো করছে, কামলা ছেলেটারও এর মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা, নতুন সিজনে আজকেই প্রথম লাঙ্গল যুতবার কথা ছিলো তার। শহরে যাওয়ার প্রথম ট্রেনটা ধরতে চাইল এতণে যাত্রা করা দরকার ছিলো আবু করিমের, গত তিরিশ বছরে বিশেষ কোনো ছুটিছাটা ছাড়া ট্রেনটা মিস করেননি তিনি, পাকিস্তান আমলে সততা আর নিয়মানুবর্তিতার জন্য একবার পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। শাক-সবজি বিক্রেতা সামাদ যদি বেলাবেলি ফুলতলীর হাটে পৌঁছতে চায় তারও উচিত এখনই রওয়ানা হওয়া।
কবরস্থানে কেবল রজবালি, আবু করিম কিংবা সামাদ নয়, আরো অনেক মানুষের ভিড়। তাদের শ্রুতি উৎকর্ণ, দৃষ্টি কোনো অতিলৌকিকতার জন্য অপেক্ষমাণ। নতুন কবরটার শরীরে ঝিকিমিকি রোগ, সযত্নে রোপিত মরমর হলদেটে ঘাস। যদিও সবার সরল কিংবা কৌণিক দৃষ্টি স্থাপিত কবরের গায়ে। তবুও কেউ রোদের ঝিকিমিকি কিংবা ঘাসের গায়ে রোদের খেলা দেখছে না। কবরটাকে কেন্দ্র করে একটা বৃত্ত গড়ে ওঠে এবং বৃত্তায়ন রেখায় তিন-চার জনের ছোট ছোট দলে চলে ফিসফাস, প্রত্যেকেই এ জাতীয় অন্য কোনো ঘটনার কথা বলে, যারা নিশ্চুপ গুপ্তধন খোঁজার মতো হাতড়ায় স্মৃতি আর সৃজনশীলেরা নির্মাণ করে নতুন গল্পের। সময় ব্যয়িত হয় সিদ্ধান্তহীনতায়। নিজেকে খুনি ভেবে নিজের ওপর রেগে ওঠে পায়চারি করে কলিম, যদিও তার ভাবনাগুলো মোটেই সরলরৈখিক নয়। হঠাৎ তার মনে হয় সমবেত সকলে জানে, সালেহা মরেছে তার পিটুনিতে! তাগড়া জোয়ান সালেহার ছোট ভাইটা জেলা শহর থেকে আসছে জনাকয়েক পুলিশসহ।
খবর পাঠান বড় মওলানা, কবর খোঁড়া যাবে না। মাদ্রাসার বয়েসী ছাত্রটি তার অদ্ভুত মুখভঙ্গিতে হুজুরের বয়ান শোনায়, ‘আল্লাহ চাহেনত সবকিছু করতে পারেন, দরিয়াকে মরুভূমি কিংবা মরুভূমিকে দরিয়া; কিন্তু আল্লাহ নিয়মের ব্যত্যয় করেন না।’ সমবেত সকলে মওলানার খবরের জন্য অপেক্ষা করছিল, এখন কান্তি অনুভব করে তারা। ছাত্রটি আরো বলে, ‘মৃতকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠান না আর। কে কবে শুনেছে, একজন মৃত মহিলা সন্তান প্রসব করেছে কবরের ভেতরে?’ স্থানীয় মসজিদের পেশ ইমাম লাফায় ছাগশাবকের তৃতীয়টির মতো, মরণ দিয়ে আল্লাহ আবার জীবিত করেননি ঈসা নবীকে?’ অকাট্য যুক্তি কিন্তু এইসব মানুষ আগ্রহবোধ করে না কূটতর্কে। সামাদ, আবু করিম, রজবালি এবং অন্যরা, যারা এতণ উৎসুক অপোয় ছিল, এখন ধীরে ধীরে হাঁটে তারা যে যার গন্তব্যে।
কবরকেন্দ্রিক জমায়েতটা ছোট হয়ে আসে কবরস্থানের পাশে গাছের ছায়ায়। তারা পরস্পর কথা বলে, একজন আস্ফালন করে কলিমের জড়তায়, সে নিজে এমন একটা স্বপ্ন দেখার পর এত সময় বসে থাকত না। প্রতিক্রিয়া হয় কলিমের, দ্রুত কদমে সে পৌঁছে কবরের কাছে এবং রুদ্ধশ্বাস সবাইকে হতাশ করে স্থবির হয়ে থাকে কবরের পাশে। তারা কিছুণ অপোর পর কলিমের অচলিষ্ণুতায় নিজেদের মধ্যে আলাপ-সালাপে ব্যাপৃত হয়—প্রসঙ্গ কবর এবং কবরের আজাব। তারা সবাই সালেহার পূতপবিত্রতায় নিঃসন্দেহতা ব্যক্ত করে। বড় বালা মাইয়ালোক আছিন কলিমের বউ। বালা না অইয়া পারে, দেখতে অইব না ক্যামুন বাপের মাইয়া?সমবেতদের জ্যেষ্ঠজন ব্যস্ত সালেহার পিতা-পিতামহ তার কতটা চেনা তা জানাতে। দ্রুত অন্যপ্রসঙ্গে কিংবা পূর্ব প্রসঙ্গেই প্রত্যাবর্তিত হয় তারা, অর্থাৎ সালেহা, সালেহার কবর এবং প্রসঙ্গক্রমে বেহেশত-দোজখ। এই সমস্ত অনুগল্প শাখা-প্রশাখা বিস্তারি, পত্রপুঞ্জে পল্লবিত;—শাদা ঘোড়া, যে ঘোড়াটা প্রতিরাতে ঘাস খেতে আসত কবরস্থানে; ভরদুপুরে কবরস্থানের পাশে জ্যেষ্ঠের এ গল্প যারা প্রথম শুনল এবং যাদের আগে শোনা ছিলো প্রত্যেকেই শিহরিত। কলিমের ফিরে আসা টের পায়নি কেউ; সে বলে ‘শাদা শাড়ি পিন্দাইল সালেহা ওড়তে লাগল আসমানের ফিল আর তহন একটা শাদা ঘোড়া আইয়া খাড়াইল তার কাছে। গোড়ার পিঠত কইরা গেল সালেহা।’ সকালে খেতের আইলে দাঁড়িয়ে কোনো ঘোড়া দেখেছিল কিনা এ প্রশ্ন উত্থিত হয় না তার মনে। স্পষ্টত সে এখন দেখছে শাদা ঘোড়ার পিঠে শাদা শাড়ি পরিহিত সালেহা উড়ে যাচ্ছে আসমানের পর আসমান ফুঁড়ে।
সমবেতদের কেউ একজন সন্দেহ প্রকাশ করে কবরে কোনো শিশুর অবস্থিতি সম্পর্কে কিন্তু তাতে চিড় ধরে না কলিমের নিঃসংশয়তায়। আবার কবরের কাছে যায় সে। কবরের মাটিতে খাবলাতে শুরু করলে সমাবেশটা পৌঁছে সেখানে। তার অস্থিরতায় বিভ্রান্ত হয় অন্যরা, বড় মওলানার নিষেধ স্মরণে আসে তাদের। জ্যেষ্ঠ তৎপর কলিমকে থামাতে; কলিম একখানা কতা হুন।’ দ্রুততর হয় কলিমের হাত। তাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকজন। দীর্ঘসময় ধরে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেমাণরা এখন ঘটনার আকস্মিকতায় বিভ্রান্ত। জ্যেষ্ঠ বলে, ‘জুহুর গিয়ানি মানু, তাইনে যেই হবর পাটাইছে তা অমান্য করা কি ঠিক অইব? হুম তুই বউয়ের গোরের আজাব বাড়াইয়া দিছ না। কিতাবের কতা হুন একটা।’ সে বলে, কিতাবের কথা বলতে বলতে তার কণ্ঠ অস্বাভাবিকতা কিংবা অন্যমাত্রা পায়, বাক্য মধ্যস্থিত ক্রিয়াপদগুলোতে সাধু-চলিতের মিশ্রণ ঘটে, ‘রাসুলের যামানায় এক বুড়ি একদিন মাইঝরাতে স্বপ্নে দেখিল তার মরা কইন্যা দোযখের মধ্যে এক বিরাট আগুনের কুণ্ডে পুড়িতেছে আর ফেরেশতাগণ তার পায়ে লোহার পেরেক বিন্ধাইতেছে। হাত-পায়ে তার বেড়ি পিন্ধাইল। সে চিৎকার কইরা কান্দিতেছে। মায়ে জিগাইল মাতঃ তোমার এই দুর্দশার কারণ কি, দুনিয়াতে তুমিত ইবাদত কম কর নাই? মেয়ে কইল ইবাদত আমি করছি; কিন্তুক স্বামীরে বড় কষ্টও দিছি। আমি তার লগে রাগ কইরা কথা কইতাম, তার হুকুম বিনা ঘরের বাইরে যাইতাম, আর তার অনুমতি ছাড়া ঘরের জিনিস পরেরে দান করিতাম। এইজন্য আল্লাহতালা আমার ইবাদত কবুল করেন নাই। ঘুম ভাঙিলে বুড়ি কান্দিতে কান্দিতে গেল জামাইর বাড়িতে। মেয়ের অইয়া মাফ চাইল মেয়ের জামাইর কাছে। মাফ মিলল না। তখন বুড়ি গেল রাসুলের দরবারে। রাসুল পাক বুড়ির মেয়ে জামাইরে ডাকাইয়া মাফ করতে অনুরোধ করিলেন। সে তখন মাফ করিল। সেই রাইতে বুড়ি স্বপ্নে দেখিল বেহেশতে তার মাইয়া বড় সুখে আছে। হুরে গোলমানরা তার সেবা করতাছে।’ জ্যেষ্ঠের কিতাবের বয়ান শেষ হতে হতে তারা পৌঁছে কলিমের বাড়িতে। আরো কিছু সময় এ বাড়ির উঠোনে ছিলো কেউ কেউ। হঠাৎ জ্বর জ্বর লাগে কলিমের। ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। কেউ একজন এই অবেলায় ঘুমাতে নিষেধ করে তাকে। তখন বিকেল উত্তীর্ণ প্রায়। শীত অনুভূত হলে সে একটা কাঁথা জড়ায় গায়ে। অনেকদিন ধরে এ কাঁথাটা বানিয়েছে সালেহা। সুঁইয়ের ফোড় দিতে দিতে সে গান গাইত গুনগুনিয়ে। তাকে দেখলেই থেমে যেত ওর গুনগুনাগুন। কলিম বলত, ‘আমার কালা ভোমরা থামলা কিল্লাইগা? গাও না গাও।’
অতপর নিজেই গেয়ে ওঠত ভাঙা গলায়। জ্যেষ্ঠের কাছে শোনা কিতাবের কথা মনে পড়ে তার। সালেহা কি তার কাছে কোনো অপরাধ করেছিল? সালেহা তার সঙ্গে রাগ করে বিয়ের এক বছর পর একবার পালিয়েছিল বাপের বাড়িতে, অপরাধের প্রধান হচ্ছে এটি। সে খুব পান খেত, সব সময় তার ঠোঁট থাকত পাকা পইলতার মতো লাল। পান জোগাতে প্রতিদিন সে এক-আধমুষ্টি চাল সরাত ঘরের খোরাকি থেকে। কারো কষ্ট সে সইতে পারত না বলে ঘরের এটা-ওটা চলে যেত অন্যের মালিকানায়। সালেহার এই সব দোষ কিংবা গুণের কারণে কলিম ওপরে ওপরে রাগ দেখালেও মনে ছিলো তার প্রশস্তি। সালেহার পানরাঙা ঠোঁট তাকে মাতাল করত, ওর উদারতায় সে মুগ্ধ হতো। সোনার হারের বিনিময়ে বেহেশত কিনেছিলেন খলিফার বেগম। পাগলের ময়লা ছেঁড়া-খোঁড়া একখণ্ড কাগজ ছিলো বেশেতের দলিল। খলিফাতো রাগ করেছিলেন বেগমের বোকামিতে। তবুও বেগম কি অনায়াসে পৌঁছে যায় সব সেরা জান্নাত-জান্নাতুল ফেরদাউসে। বেগম কি বেহেশতি বাড়িতে খলিফার প্রবেশ অনুমোদন করতে পেরেছিলেন? পাগলত বেহেশত বিক্রেতা নয়, বিশ্বাসের ক্রেতা।
তখন রাত অনেক ঘুমন্ত গ্রামটাকে একটু আগেও মনে হতে পারত মৃত এক জনপদ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় আবিষ্কৃত। এখন ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে উঠেছে। কয়েকজোড়া বুটের শব্দ গ্রামটাকে জাগিয়ে কলিমের উঠোনে এসে দাঁড়াল। সময় তার অননুমেয়; কিন্তু ওঠোনে বুটের শব্দে সে দ্বান্দ্বিক মুহূর্তে প্রবেশিত। টক…ট…ক. র. কুঁউ…কুঁ…উ..ঝক….ঝক. ঝ.. ক….র.. রেলের গাড়ি।
অচেনা একটা ঘুমটি ঘরের কাছে চলতি ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামে সে। পালাচ্ছে, পালাচ্ছে—পেছনে ফেলে যায় ছোট একটা গ্রাম, গ্রামের হাট-বাজার। অতপর একটা নদী, সাঁতরে পার হয় নদী, ভীষণ কষ্টে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পায় সবুজ অরণ্য। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বলে-নিভে। রাত-দিন; আবার রাত, আবার দিন। নদীর প্রতিটি জলবিন্দুতে, অরণ্যের প্রতিটি বৃক্ষে রূপান্তরিত হয় সে।
বহুদিন পর কলিমের মনে পড়ে একবার সালেহা ডেকেছিল তাকে। সালেহা রঙিন সুতায় রঙিন কাঁথা বানাত তাদের অনাগত সন্তানের জন্য। কষ্টটা তীব্রতর হলে সে একটা সুড়ঙ্গ বানাতে বানাতে পৌঁছে যায়, চিনতে ভুল হয় না; কিন্তু কবর শূন্য কবর থেকে অন্য একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে অজানা পথে; যুগপৎ সে আর খলিফা হারুন হাঁটে এ পথে—পদতলে নুড়িপাথর, দুপাশে পাথুরে দেয়াল। পথটা সরু হতে হতে এক সময় চুলের মতো চিকন এবং বিপজ্জনক হয়ে ওঠে—পুলসিরাত যেন।
(দ্রৌপদী ও তার প্রেমিকেরা থেকে)