মুহূর্তে সবশেষ!
দুঃখ আর অভিমানে চোখ বেয়ে উষ্ণ জল নামে গড়িয়ে। বেশ কবারই তো এসেছি এ বাড়িতে কিন্তু দৃষ্টির অগোচরেই ছিল মুখটা? তবে এই যে এত কষ্ট এখন উথালে-পাথালে কেন?
কলঙ্ক আর অপবাদের বোঝা মাথায় বয়ে বাকিটা জীবন কাটানোর-না কি দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিটা চোখে না পরার!
না কি দুটোই?
শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠা কাশতে কাশতে ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে মাটিতে উবু হয়ে পড়েন। উবু হয়ে পড়েন বললে কথাটা ঠিক হবে না, তাকে উবু হয়ে পড়ে থাকতে হয়। কাশব্যামোর হাত থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করতে এটাই বোধহয় মোক্ষম দাওয়াই; তখন দূর থেকে ওই অবস্থাটা সেজদার মতো দেখায়। এতে তার কাশি থামে না বরং বাড়তে বাড়তে শেষে কেবল খোলের আওয়াজ বের হয় গলা দিয়ে। শ্লেষ্মার শেষ নহরটা ঠোঁট বেঁয়ে নামতে গিয়ে জ্যাঠাকে হাঁপিয়ে তোলে। এমনই হাঁপ, কাছে-পিঠে থাকলে ঘন ঘন দম ছাড়ার শব্দও যেন বাতাসের শাঁ শাঁ গতির মতো শোনায়। অনেকটা সময় পর তিনি আস্তে আস্তে উঠে বসেন, মাথাটা তুলে দুই হাঁটুর মাঝে গুঁজে দিয়ে কুঁজো হয়ে থাকেন। আর কুঁজো হয়ে থাকতে থাকতেই একসময় তিনি স্বাভাবিক হন।
শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠা বসেন জিয়নপুর রেলস্টেশনে ঢোকার মুখে বাঁ পাশে। রোদ-বাদলা-ঝড় কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারে না। তবে মাঝে-সাজে ব্যত্যয় যে ঘটে না, তা না। তখন জ্যাঠা দুই-একদিনের জন্য লাপাত্তা হয়ে যান।
জুতা সেলাইয়ের সরঞ্জাম সামনে নিয়ে পাশে রাখা কাঠের বাক্সটায় ঠেশ দিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন জ্যাঠাকে দেখে আসছি অনেকদিন থেকে। তবে, তিনি জুতা মেরামত কিংবা পলিশ করছেন, তেমনটা খুব একটা দেখা যায় না। এ নিয়ে বোধ হয় তার কোনো বিকারও নেই। জুতা সেলাই-সারাইয়ের কাজ জুটলে দু’চার পয়সা রোজগার হয়, নয়তো লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের ওঠানামা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হলে বাড়ির পথ ধরেন।
জিয়নপুর এমনই একটা অজপাড়াগাঁ, যেখানে সন্ধ্যা নামে সন্ধ্যার বেশ আগে আর ভোর হয় ভোরেরও খানিকটা পরে। জিয়নপুর রেলস্টেশনটা তৈরি ব্রিটিশ পিরিয়ডের কোনো এক সময়। চাকচিক্য নেই একদম। দুই-চারখানা মেলট্রেন আর লোকাল ছাড়া কোনো ইন্টারসিটি থামে না এখানে। অন্তত ক্রসিং-এর জন্যও কোনোদিন থামতে দেখা যায়নি। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠা স্টেশনে আসেন। তার ক্ষয়ে যাওয়া চটিজোড়া ছাপিয়ে এক দঙ্গল পথের ধুলা ভোরের শিশিরে লেগে পায়ের গোড়ালি জাপটে থাকে। প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় মরচেপড়া যে লোহার জলকলটা আছে, ওটার হাতল চেপে চেপে পা দু’খানা ধুয়ে পরিষ্কা করেন। তারপর চট বিছিয়ে বসে পড়েন নির্ধারিত জায়গাটিতে। গত সাতচল্লিশ বছর ধরে তার একই রুটিন।
আমি কবে থেকে জিয়নপুর রেলস্টেশনে-সালটা ঠিক গুনতে পারছি না। বাবা নেই, নেই মানে আগে যে ছিল, এরকম কিছু না মনে নেই। তবে মাকে দেখেছি, আবছা মতন। অনেককেই বলতে শুনেছি আমি নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মেছি। একদিন এক ভদ্রলোক, হ্যাঁ ভদ্রলোক তো বটেই-কারণ তার পরনে ছিল ধোপাদোরস্ত কোট, নিপাট সুশ্রী দেখতে, আমার কাছাকাছি আসতে চাইলে পাশ থেকে তারই সঙ্গী আরেক ভদ্রলোক ইশারায় আমাকে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলছিলেন, হি ইজ এ বাস্টার্ড চাইল্ড। সঙ্গে আরও কী কী যেন, সব অবশ্য মনে নেই। জিয়নপুর আসার আগে যে স্টেশনে আমি জন্মেছিলাম-হাঁটতে শিখেছিলাম-যেখানে আমার শৈশব কেটেছে-ঐখানে। অন্যকিছু মনে না থাকলেও ওই একটি কথা আমি কেন যেন লুফে নিয়েছিলাম সেদিন। এরপর মনে মনে হাজারবার আওড়েছি। একদিন জ্যাঠাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম।
-জ্যাঠা?
-কিতা রে আনন্দ? কুস্তা কইতে না কিতা?
এই যা, জানাতে ভুলে গেছিলাম-আমার একটা নাম পরিচয় আছে। আমি আনন্দ। জ্যাঠা এই নামটা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই নামের কোনো বিকৃতি হয় না। আমিও অনেকবার চেষ্টা করেছি আনইন্দা, আনন্দ ইত্যাদিতে বিকৃত করতে। নাহ তেমন করে বিকৃতি হয়ই না!
-হ জ্যাঠা, একটা কতা কইতাম।
-ক। জুতা সেলাই করতে করতে জ্যাঠা অনুমতি দিয়েছিলেন।
-কতাডা অইল গিয়া, আমি না কি-হি ইজ এ বাস্টার্ড চাইল্ড?
জুতাটা হাতে ধরে জ্যাঠা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। সে কী চাহনি? রাজ্যের বিস্ময় যেন উপচে পড়েছিল। আমিও মজা পেয়েছিলাম জ্যাঠাকে এভাবে চমকে দিয়ে। জ্যাঠার অবস্থাটা তখন দেখার মতো! চোখ বড় বড় করে এমনভাবে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে, যেন ভূতের মুখে রাম নাম শুনলেন।
-এই কতাডা তরে কেডা কইসে? গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন।
-আগে যে ইস্টিশনে তাকাতাম অইগানো দুইডা বেডা আইসিল একদিন। টাইকোট ফরা, এরার একজন আমারে দেহাইয়া অন্যজনরে কইসিলো।
জ্যাঠা চুপ মেরেছিলেন কিছুক্ষণ। হয়তো ভাবছিলেন কি উত্তর দেবেন, নয়তো ভাবছিলেন কোনো উত্তরই দেবেন না। কিন্তু দিয়েছিলেন শেষে এবং আমি মহাখুশি হয়েছিলাম।
-হুন আনন্দ, কতাডার মানে খারাফ না। এর মানে অইসে গিয়া-তুই বালা পোলা।
আমি মুচকি হাসলাম। জ্যাঠার কথা শোনার পর একটা বুকচাপা পাথর নেমে গেলো মন গড়িয়ে। অনেকদিন আগের জ্যাঠারই একটা কথা মনে পড়লো। জ্যাঠা বলেছিলেন, ভালো লোকগুলাই কেবল ভালো লোকদের চেনে।
উচ্ছিষ্ট খেয়ে খেয়ে কতদিন পর যে দুমুঠো ভাত জুটলো? খেয়ে দেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ঝিমিয়ে গেছিলাম। দোতারার একটা মিহি সুরে ঝিমুনি কাটে।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে হিসাব করলে আমার বয়স ঊনপঞ্চাশ। তবে, জ্যাঠা যে তারও আগে থেকে প্রতিদিন জিয়নপুর স্টেশনে আসেন, আমি জানলাম কী করে? শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠাই আমাকে বলেছেন। জ্যাঠা আমাকে অনেক মায়া করেন।
জিয়নপুর রেল স্টেশনটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বীভাবে দাঁড়ানো। মাথার ওপর মরচে লাল হয়ে যাওয়া টিনশেড আর তার নিচে জালালি কবুতরদের দৌরাত্ম্য না কি ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকেই। এখনো আছে জালালি, তবে সংখ্যায় কমেছে অনেক। বেশ কিছু চড়ুই শালিক জুটেছে কবুতরের সঙ্গে। আমি প্রতিদিন চড়ুই, শালিক আর কবুতরদের খুনসুটি দেখি। আর আড়চোখে দেখি শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠাকে। যেদিন জ্যাঠার মন ভালো থাকে সেদিন কাছে ডেকে নেন আমায়।
শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠাকে মাঝে-মধ্যে খুব চিন্তিত দেখি। আমি অনেক ভালো করে লক্ষ করেছি, প্রতি পূর্ণিমার পরদিন জ্যাঠার অত্যধিক মন খারাপ থাকে। তখন অনেক রাত করে জ্যাঠা বাড়ির পথ ধরেন। আমি কয়েকবার তার বাড়ি গিয়েছি। প্রথম যেদিন জ্যাঠা আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল তখনো ছিল রাত। কী দূর রে বাবা! পথে তিন কি চারবার দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিয়েছি। আর জ্যাঠা হনহন করে এগিয়ে গেছেন। বুঝলাম এ নির্ঘাত অভ্যেস। জ্যাঠার অনেক দিনের হাঁটার অভ্যেস আর আমার না হাঁটার।
-আনন্দ।
-কী জ্যাঠা।
-আমার বাড়িতে তো কোনোদিন গেসত না-ল, আজকা যাইবেনি? কিতা কস?
আমার ভেতরের আনন্দ কয়েকগুণ লাফিয়ে উঠেছিল। অবশ্য কারণটা ছিল অন্যখানে-তৃপ্তি করে খাওয়া যাবে জেঠিমার হাতের খাবার। না করিনি আমি। সোজা জ্যাঠার পিছুপিছু হাঁটলাম। একটা দু’চালা ছনের ঘর পশ্চিম কিংবা উত্তরের ভিটায় হতে পারে-ঠাহর করতে পারিনি রাত্তিরে। সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট খড়ের একচালা, চারটা বাঁশের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ওটা রান্নাঘর।
-আনন্দ। এইডাই আমার বাড়ি।
-জ্যাঠা, ফেডে তো বুখ লাগসে।
আমার ধারণা, জেঠিমা রান্না করে রেখেছেন সন্ধ্যা রাতে। জ্যাঠা আসলেই খেতে দেবেন।
-হয় আমারও ভুক লাগসে। কিন্তু ইকটু কষ্ট সহ্য করতে অইব যে আনন্দ! অহন আমরা রান্দুম। এরফর দুই জনে মিল্যা খামু।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম টুপ করে-বৃষ্টি ফোটার মতো! এই রাত্তিরে রান্না করে কোন রাত্তিরে খাওয়া হবে? ভাবনা আমার এমন যে আমি মনে হয় প্রতিদিন রান্না করে খাই কিংবা কেউ আমাকে রান্না করে দেয়? অথচ কত দিন যে এই আনন্দের কপালে খাবারই জোটে না? আমি কতক্ষণ যে ঘোরের মাঝে ছিলাম মনে নেই। নাকি ঘুমিয়েও পড়েছিলাম? শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠার ডাকে জেগে উঠি। হাত-মুখ ধুয়ে এসে পেটপুরে খেয়েছিলাম সে রাতে। আহা অমৃত যেন মুখে তুলেছিলাম। উচ্ছিষ্ট খেয়ে খেয়ে কতদিন পর যে দুমুঠো ভাত জুটলো? খেয়ে দেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ঝিমিয়ে গেছিলাম। দোতারার একটা মিহি সুরে ঝিমুনি কাটে।
সেদিন জ্যোৎস্না বান ডেকেছিল। আকাশ ভরা গোল চাঁদ। আমি আরও অনেকবার দেখেছি, জিয়নপুরে পূর্ণিমায় তেমনি জ্যোৎস্না ঝরে। জমিন যেন রুপোর থালায় লেপা। জ্যাঠা বসেছিলেন বারান্দায় ঠেশ দিয়ে একখানা চাটাই পেতে। পা দু’খানা ছড়িয়ে কোলের ওপর দোতারাটা। আমি সামনে বসে তন্ময় হয়ে শুনছি। জ্যাঠার হাত যেন জাদুর কাঠি। তিন তারে ঢেউ খেলিয়ে চলছে আঙুলগুলো অবিরাম। আহা, কী অদ্ভুত মোহাগ্রস্ত সুর! কী এক হৃদয় বিদীর্ণ করা কষ্ট ঝরছিল দোতারা বেয়ে!
কিন্তু শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠার মতো খাঁটি মানুষ একজনকেও পাইনি। তাই আমার রুগ্ণ বৈরাগ্যের সঙ্গে পণ করেছি, শেষ জীবনটা জ্যাঠার কাছাকাছি থেকেই কাটিয়ে দেব।
পরদিন বেশ সকাল সকাল রওয়ানা হয়েছিলাম স্টেশনের দিকে। সেদিন সারাটা সময় জ্যাঠা চুপ মেরে বসেছিলেন। এরকম তো প্রায়ই দেখি, তাই গা লাগাইনি। আরেকটা জিনিস আমি লক্ষ করেছিলাম রাত্তিরে। দোতারা বাজাতে বাজাতে জ্যাঠার চোখ ছলকে ছলকে উঠেছিল। এতটা তন্ময় ছিল জ্যাঠা-আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। জ্যাঠার এই মোহগ্রস্ত অবস্থা অন্য কারও মুখে শুনলে বিশ্বাস করতাম না। নিজ চোখে দেখা তো, অবিশ্বাস করি কী করে!
ব্যক্তিপরিচয়ে আমি মানুষ। নাম পরিচয়ে আনন্দ। আগেও বলেছি একবার, বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি কোনোদিন। মাকেও মনে নেই ঠিকমতো। জন্মের পর থেকেই এখানে ওখানে, পথে পথে বড় হয়েছি। যে জায়গায় জন্মেছিলাম মানে আমার শিশুকাল কেটেছে যেখানে, ওই জায়গাটা ছাড়তে হয়েছে শৈশবে। ওখানে সবাই আমার দিকে এতটাই অবজ্ঞার চোখে তাকাতো, নিজেকে নর্দমার কীট মনে হতো। কাছে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতো। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি সব। আমার অভিমান হয়। সে সময় একদিন কিছু মানুষ ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল ওখানে। ওরা আমারসহ আরও অনেকেরই ফটো তুলে নেয়। পরে জেনেছিলাম ওরা সাংবাদিক। ঢাকা থেকে এসেছেন। ওদেরই একজন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে। বেচারা একা থাকতেন। ভালোই চলছিল আমার। একদিন সন্ধ্যায় ভদ্রলোক বাসায় ফিরলেন অনেকটা বিমর্ষতা নিয়ে। রাতে কার সঙ্গে যেন তুমুল বাহাস হয় টেলিফোনে। অতপর আমার ওপর চড়াও হন। রাতভর সে কী নির্যাতন! আমার দিব্যি মনে আছে সেখানেও একটা শব্দ শুনেছিলাম বার কয়েক-বাস্টার্ড। এর পরদিনই আমি পথে নামি।
এখানে-ওখানে কিছুদিন করে থেকে থেকে অবশেষে জিয়নপুর স্টেশনে থিতু হই। জীবনের প্রতিটা মোড়ে মোড়ে কেবলি আমি জেনেছি, শিখেছি। নানান রকম মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠার মতো খাঁটি মানুষ একজনকেও পাইনি। তাই আমার রুগ্ণ বৈরাগ্যের সঙ্গে পণ করেছি, শেষ জীবনটা জ্যাঠার কাছাকাছি থেকেই কাটিয়ে দেব।
জ্যাঠা আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন একেবারে। যাইনি। তাছাড়া স্টেশনে থাকতে আমার ভালোই লাগে। প্রতিদিন জ্যাঠার সঙ্গে দেখা তো হয়ই। লক্ষ্য করেছি, জ্যাঠা আর আমার মাঝে একটা অদ্ভুত মিল আছে। জ্যাঠা নিত্য স্টেশনমুখী আর আমি স্টেশনে থিতু। এই স্টেশনটাই মিল আর বাকি সব অমিল।
এক পূর্ণিমার আগের দিন। সকাল থেকে রোদের দাপট বেড়েই চলেছে। চামড়া জ্বলছে রোদের আঁচে। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। আমার উমফোঁটা লাগছে। তাই স্টেশনের বাইরে এসে ঘোরাঘুরি করছি। এদিকে, বেলা বাড়লেও শ্বৈত্যস্বর জ্যাঠা আসার নাম গন্ধ নেই। বেশ চিন্তায় পড়লাম। গতদিনই ভেবে রেখেছিলাম, আজ সন্ধ্যায় জ্যাঠার সঙ্গে তার বাড়ি যাব। সারারাত ধরে জ্যাঠার দোতারা শুনবো। কোথায় কী? সূর্য মাথার ওপরে এলেও যখন জ্যাঠার দেখা পেলাম না মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো। জ্যাঠার কিছু হয়নি তো? ভাটি বেলায় রোদের তেজটা একটু কমে আসলে রওয়ানা দেই তার বাড়ির উদ্দেশ্যে। নানান শঙ্কা মন ঘিরে ধরে। পথ যেন ফুরাতে চায় না। এত এত চিন্তা মনে নিয়ে হাঁটা যায়? বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই কাশির শব্দ শুনতে পাই।
দৌড়ে ঘরে ঢুকে জলের কলসিটা খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়ে মাটির দেয়ালে। ফ্রেমে বাঁধাই ঝাপসা ছবিটা দেখে আবছা মতো শৈশবে দেখা মুখটা ভেসে উঠে চোখে। তবে কে আমি?
জ্যাঠা উবু হয়ে পড়ে আছেন ঘরের দাওয়ায়। হাঁপাচ্ছেন। শ্লেষ্মার শেষ ধারা মাটি কামড়ে কামড়ে এগোচ্ছে অতি ধীরে। শুষ্ক মাটি চুষে নিচ্ছে জলের ভাগটুকু। একসময় মনে হলো জ্যাঠা জ্ঞান হারিয়েছেন। পালকের মতো হালকা শরীর। তাকে শুইয়ে দেয় চাটাইয়ে। বার কয়েক জলের ছিটা দিতেই জ্যাঠা চোখ খোলেন।
-সৌদামিনী!
চমকে উঠি আমি। আশপাশে তাকিয়ে জ্যাঠার সৌদামিনীকে আবিষ্কারের চেষ্টা করি। না, কেউ নেই কোথাও। তবে জ্যাঠা যে সৌদামিনী নাম ধরে ডাকলেন?
-জ্যাঠা, আমি আনন্দ।
এবার জ্যাঠার চমকের পালা। ঠিক এভাবে এই মুহূর্তে আমাকে আশা করেননি বোধ হয়।
-কোন সম্ আইলা?
-ইট্টু আগে জ্যাঠা। আফনে তো অইজ্ঞান অইয়া ফরসিলাইন। অহন কিতা ভাল্লাগতাসেনি?
-হ। ইট্টু সুস্থ লাগতাসে। বও ইগানো।
রাত আস্তে আস্তে গভীর হচ্ছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্রের ফোয়ারা। জ্যাঠা একটু স্বাভাবিক এখন। আমরা দাওয়ায় বসেছি। কথা নেই কারও মুখে। রান্নাবান্না হয়নি তাই মুড়ি আর গুড়যোগে রাত্তিরের ভোজ চলছে। একপর্যায়ে জ্যাঠা দোতারাটা টেনে নেন কোলের ওপর। জ্যাঠাকে মানা করি না, আজ যে পূর্ণ চাঁদের ফোয়ারা ঝরছে জিয়নপুরে! আজ যে জ্যাঠার দোতারা বাজানোর দিন! পরম মমতায় হাত বোলান তারে। টুং টাং শব্দ ওঠে।
পরদিন অনেকটা বেলা করে ঘুম ভাঙে। চেয়ে দেখি জ্যাঠা দেয়ালে ঠেশ দিয়ে আছে-নির্বিকার। আস্তে আস্তে ডাকি।
-জ্যাঠা, ও জ্যাঠা। ইস্টিশনে যাইতাইন্না না কিতা?
জ্যাঠা স্থির। সাড়া নেই নিঃশ্বাসের। ভয় পেয়ে যাই আমি।
দৌড়ে ঘরে ঢুকে জলের কলসিটা খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়ে মাটির দেয়ালে। ফ্রেমে বাঁধাই ঝাপসা ছবিটা দেখে আবছা মতো শৈশবে দেখা মুখটা ভেসে উঠে চোখে। তবে কে আমি?
মোহগ্রস্ততা ভেঙে এসে জ্যাঠার চোখে-মুখে জলের ছিটা দেই। ততক্ষণে ঠাহর করি সব শেষ।