পড়া না পেরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে বিজয় সরণী। মোড়ের চারিদিক থেকে জানাজায় যোগ দিতে আসা মানুষের ব্যস্ততায় জড়ো হচ্ছে বাস, পকেটমার, প্রাইভেট, ঘাম, টেম্পো, হিজড়া, মাইক্রো, ভিক্ষুক, জিপ, ছিনতাইকারী, পুলিশ, বেশ্যা, হর্ন, ধোঁয়া, অবিশ্বাস, অসুখ, ঐশ্বর্য, চাকরিজীবী, আমলা, রোগ, মন্ত্রী, ছাত্র, জনতা, মোটরসাইকেল, উড়োজাহাজ, ঠেলাগাড়ি, প্রশ্বাস, ট্র্যাফিক, অসুখ ইত্যাদি। পৃথিবীতে আর কোনো দেশের রাজধানীর রাজপথে এত বিচিত্র অনুষঙ্গের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় কি না, তা নিয়ে বড় বাজেটের একটা রিসার্চ হতে পারে। তবে আনন্দিত হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, যেকোনো দিন এই শহর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে ঘোষিত হতে পারে।
এসবের ভেতরেই প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে বসে আছে একুশ বছর বয়সী এক তরুণ।
ফার্মগেটের দিক থেকে আসা রাস্তার পাশের মসজিদের দেয়াল সেঁটে লম্বালম্বি ঝুলছে বিশাল একটা ব্যানার। ব্যানারে লেখা শব্দগুলো ছেলেটির উত্তেজনা প্রশমিত করার বদলে তার ভেতরের অস্থিরতাকে উস্কে দিচ্ছে। তবু পরিস্থিতি থেকে সাময়িক ছুটি নেওয়ার জন্য ব্যানারটিকেই লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয় সে। ভুল বানানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ব্যানার। ব্যানারজুড়ে নিয়ামত ব্যাপারী নামের একজন মানুষের ছবি। দলে তার পদের ফিরিস্তি দিয়ে ব্যানারের বাকি জায়গা ভরা। ব্যানারের ডান পাশের এক কোনায় কোনো মতে জায়গা পেয়েছে নিয়ামত ব্যাপারীর নেতার ছবি। বাম পাশের কোণায় আরও ছোট্ট করে নিয়ামত ব্যাপারীর নেতা’র নেতা’র নেতা’র নেতা’র ছবি। কিছুতেই ছেলেটির মাথায় ঢোকে না, কিভাবে এই কিটগুলো দেশের প্রধান একটা রাজনৈতিক দলে নিজেদের জায়গা করে নেয়। না কি এদের নেতারা এদেরই মতো?
এই তো মা, আর একটু—কথাগুলো বলে ছেলেটি নিজেই নিজের বিশ্বাসকে অবিশ্বাসের ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে কাটতে থাকে। এক মিথ্যা শহরে দাঁড়িয়ে আছে সে। অতএব মিথ্যা বলা তার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আর মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থায় মিথ্যা বলা জায়েজ। পৃথিবীর চতুর্দিক হাসপাতাল, চারদিক চিকিৎসক, উড়ে বেড়াচ্ছে ওষুধ, প্রত্যেকের পকেটে সুস্থতা। অথচ একটা আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রায় মিনিট বারো ধরে অনবরত কাঁদছে একটা মুমূর্ষু অ্যাম্বুলেন্স। মাঝেমাঝে সৃষ্টিকর্তাকে গালি দিতে ইচ্ছে করে। স্তরে স্তরে তিনি কেন এত সৃষ্টিকর্তা বানিয়ে রেখেছেন? শাসনের করার জন্য? না কি শোষণের সুবিধার্থে?
অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে সদ্য পানি থেকে তোলা কাতলা মাছের মতো তড়পাচ্ছেন জাবেদা বেগম। মাঝেমাঝে নেতিয়ে পড়ছেন, কিছুক্ষণ পর পুনরায় তড়পাচ্ছেন—আ-র ক-ত দূ-র? জীবন হাতড়াতে হাতড়াতে ক্লান্ত জাবেদা কণ্ঠনালীতে এর বেশি শব্দ জড় করতে পারছেন না। তার বায়ুথলি ভরা আকুতি। বেঁচে থাকা ও মারা যাওয়ার পিচ্ছিল আইল দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বার বার আছাড় খাচ্ছেন তিনি, পুনরায় উঠে দাঁড়াচ্ছেন।
মা, আর একটু মা, চলেই এসেছি মা—ছেলেটি আবারও মিথ্যা কথাগুলোর নবায়ন করল।
আ র পা র ছি না—অ্যাম্বুলেন্সের পেছনের সিটে মায়ের সঙ্গে বসে আছে ছেলেটির ছোট বোন। পিউলি।
ভাইয়া! মার খুব কষ্ট হচ্ছে, ভাইয়া—পিউলি তার কান্না কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না, আটকে রাখতে পারছে না তার মাকেও।
মার কিচ্ছু হবে না। দোয়া কর বোন—মনে মনে স্বগতোক্তি করে ছেলেটি। দোয়া! কার কাছে দোয়া চাইতে বলছে সে? সবাই তো মজা লুটতেই ব্যস্ত।
ছেলেটির ভেতরের অস্থিরতা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে ক্রোধে।
শাহবাগের দিকে মুখ করে বেশ কিছুক্ষণ থেকে আকুল আর্তি তুলে চিৎকার করছে অ্যাম্বুলেন্সটা। ঢাকা মেডিক্যাল তার লক্ষ্যস্থল। কখনো পু…উ….ও….পু…..উ….ও, কখনো পু- পা- পা- পু, কখনো বা পুপ- পুপ- পুপ; একেকবার একেক স্বরে চিৎকার তুলে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে।
পি-উ, পি-উ-লি, আ র ক দূ ?
অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডারে অক্সিজেনের দাগ নিচের দিকে ছুটছে। গাজীপুরের মাওনা থেকে প্রথমেই মাকে থানা হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা। সেই হাসপাতাল মাকে ফিরিয়ে দেয়। সেখান থেকে উত্তরা আসতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। দুই তিনটা ক্লিনিক ঘুরেও কোনো লাভ হয় না। এত মুমূর্ষু রোগীকে ভর্তি নেয় না তারা। অন্য কোনো বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। উত্তরা থেকে অ্যাম্বুলেন্স ছুটতে থাকে ঢাকার দিকে। বিশ্বরোডের মাথায় এসে অ্যাম্বুলেন্সের মুখ ঘুরে যায় ডান দিকে। কাছাকাছি দুটি পাঁচতারা হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হয় মাকে, দুই জায়গাতেই ত্বরিতগতিতে দৌড়ে আসেন ডাক্তার। অ্যাম্বুলেন্সে রেখেই তারা মাকে দেখেন। দুজনেই বলেন, উনার আইসিইউ লাগবে। আপনি একটু রিশেপসনে কথা বলেন। দুই হাসপাতালের দুই জন ডাক্তারই একবার ছেলেটির দিকে তাকায়, একবার ছেলেটির মায়ের দিকে তাকায়, তার তাকানোর তালিকা থেকে বাদ যায় না পিউলিও। ছেলেটি বুঝতে পারে না তাদের চেহারায় কি এমন খুঁজছেন ডাক্তার সাহেব। দুই হাসপাতালের রিশেপসনে বসে থাকা মানুষগুলো ছেলেটির সামর্থ্যের গভীরটা যাচাই করতে নানান প্রশ্ন করে। অবশেষে জানায় আইসিইউতে অনেক খরচ।
কত?
ভর্তির সময় পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। আর প্রতিদিন ষাট থেকে সত্তর হাজারের মত খরচ হবে। বেশিও লাগতে পারে, পারবেন? ছেলেটি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করে দুই হাসপাতাল একই কথা বলছে, যেন টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করা আছে কথাগুলো, রোগী এলেই চালু করা হয় টেপরেকর্ডারের ক্যাসেট।
ছেলেটি তার বোন পিউলির দিকে তাকায়, দুজনের সামর্থ্য যোগ করে। যোগ ফলে যা আসে তাতে সমাধান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় তারা। ছেলেটির বুঝতে বাকি থাকে না, এই হাসপাতালগুলো মানুষের চিকিৎসা করে না, রোগীর চিকিৎসাও করে না, এরা শুধু টাকার চিকিৎসা করে।
অ্যাম্বুলেন্স ছুটতে থাকে ঢাকা মেডিক্যাল অভিমুখে। বিজয় সরণির মোড়ে এসে স্থির হয়ে পড়ে গতি। দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই।
এদিকে মার একটা শ্বাস থেকে আরেকটা শ্বাসের দূরত্ব ক্রমশই বেড়েই চলেছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে ছেলেটি এদিক ওদিক তাকায়। জ্যামের এক মুখ ঠেকেছে টঙ্গীতে, আরেক মুখ মিরপুর এগারোয়, বাকি দিক তেজগাঁ পেরিয়ে কোথায় গেছে কে জানে। শুধু ফার্মগেট থেকে যে রাস্তাটা এসেছে এবং শাহবাগের দিক থেকে যে রাস্তাটা গেছে, সেটা একদম ফাঁকা। মাঝে কিছু দূরে দূরে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। মোড়ের মাঝখানে ব্যতিব্যস্ত কয়েকজন পুলিশ সার্জেন্ট।
ভাই কী হয়েছে? এতক্ষণ ধরে সিগন্যাল বন্ধ কেন? এক দৌড় দিয়ে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের সামনে দাঁড়ায় ছেলেটি।
মন্ত্রী যাবেন।
ভাই অ্যাম্বুলেন্সটা ছেড়ে দিন ভাই, প্লিজ। আমার মা অ্যাজমার রোগী। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। দয়া করে সিগন্যালটা একবারের জন্য হলেও ছাড়ুন। এ কথা বলে ছেলেটি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এত অসহায় বোধ আর কোনো দিন সে করেনি।
ট্রাফিকপুলিশ কিছুই শোনে না। বলে, এই রাস্তা দিয়ে মন্ত্রী যাবেন এখুনি। যান অ্যাম্বুলেন্সে গিয়ে বসেন। সময় হলেই ছেড়ে দেব। যান। যান। এখানে ঝামেলা করবেন না। ছেলেটি রিকোয়েস্ট করতেই থাকে। এদের কাছে জীবনের মূল্য নেই। মাকে কি শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা দিতে পারবে না সে!
অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর মায়ের জীবন মৃত্যু নিয়ে খেলছেন ওপরের বিধাতা, আর নিচে তারই প্রতিনিধি রাস্তা বন্ধ করে রাখার আদেশ জারি করে খেলাটাকে জমিয়ে তুলেছে। উঠে দাঁড়ায় ছেলেটি। একবার অ্যাম্বুলেন্সের দিকে তাকায়, তো আরেকবার সামনের ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকায়। বার বার অনুরোধ করে। কোনো কাজ হয় না। দৌড়ে যায় ট্র্যাফিক সার্জেন্টের সামনে। তার পা দুটি জড়িয়ে ধরে, স্যার, আমার মা মরে যাবে স্যার, দয়া করে শুধু অ্যাম্বুলেন্সটাকে যেতে দিন স্যার।
ঝামেলা করবেন না। যান, অ্যাম্বুলেন্সে গিয়ে বসুন। এই রাস্তা দিয়ে এখন নেতা যাবেন। অ্যাম্বুলেন্স কি, নেতা না যাওয়া পর্যন্ত একটা মশাকেও যেতে দেওয়া হবে না।
স্যার,কিছুক্ষণের মধ্যে হাসপাতালে নিতে না পারলে মা আমার মারা যাবে।
আপনার মা মরলে আমার কী?
রাস্তা ছেড়ে দিন।
শুয়োরের বাচ্চা আবার চোখ রাঙায়—বলেই ছেলেটির কলার চেপে ধরে ট্রাফিক সার্জেন্ট।
ছেলেটি তার ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। হঠাৎ ট্রাফিক সার্জেন্টের নাকে সজোরে মারে একটা ঘুষি। ঘুষির জোর সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে যায় সার্জেন্ট। ততক্ষণে আশপাশ থেকে অনেক পুলিশ এসে ঘিরে ফেলে ছেলেটিকে লাথি, কিল, ঘুষি মারতে থাকে অনবরত। তার নাক ফেটে রক্ত বেরুতে থাকে। যদিও সেদিকে খেয়াল নেই ছেলেটির। মাকে মনে হয় আর বাঁচানো যাবে না। রাগে কাঁপছে সে, আর কাঁদছে। কেউ তার কান্না দেখতে পাচ্ছে না। তার মা মরলেই কার কী? মন্ত্রীর নিরাপত্তা সবার আগে।
ট্র্যাফিক সার্জেন্টের গায়ে হাত তোলার অপরাধে ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এখুনি অ্যারেস্ট করা হবে ছেলেটিকে।
আপনারা কি কেউ দেখছেন না! আমার মা মৃত্যুপথযাত্রী। হাসপাতালে নিতে না পারলে এখুনি মারা যাবে। আপনাদের কি মা নেই, আপনারা কি কথা বলা ভুলে গেছেন? আপনারা কি প্রতিবাদ করা ভুলে গেছেন? আপনাদের বিবেক নেই? অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসে পিউলি, চিৎকার করে বলতে থাকে কথাগুলো, নির্মম পৃথিবীর প্রতিবাদহীন মানুষগুলোর উদ্দেশে উগরে দিতে থাকে তার সমস্ত ক্ষোভ। এত জোরে চিৎকার করে যেন তার স্বর সাত আসমান ফুটো হয়ে পৌঁছে যায় বিধাতা অবধি।
জ্যামের চেয়েও স্থির জ্যামে পড়া মানুষগুলো। এরা প্রতিবাদ করা ভুলে গেছে। ছেলেটিকে অ্যারেস্ট করার জন্য হাতকড়া পরানো হলো। তার নাক গড়িয়ে তখনো রক্ত ঝরছে। শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া উধাও। ডান হাতের কুনই এর নিচে বেশ কিছুটা অংশ কেটে গেছে। সেখান থেকেও রক্ত ঝরছে। একজন পুলিশ তার ছেঁড়া শার্টের কলার চেপে রেখেছে। ছেলেটির চোখেমুখে তখনো ক্রোধের আগুন। ইতোমধ্যে একটা পুলিশ ভ্যানও এসে হাজির। এখনি ভ্যানে ওঠানো হবে ছেলেটিকে।
এর ভেতরেই একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। বাস, কার, টেম্পো থেকে এক এক করে বহু মানুষ নেমে আসতে থাকলো। প্রথমে একটা টেম্পো থেকে নেমে এলেন ষাটোর্ধ্ব এক নারী, হোন্ডা থেকে নেমে এলো এক তরুণ, বাস থেকে বাসের হেলপার, প্রাইভেট কার থেকে কোটটাই পরা এক ভদ্র লোক, এরপর বাকিরা—সবাই মিলে পুলিশের ছোটখাটো দলটার দিকে এগোতে থাকে।