সোনা দানার লাইগা যাগো বাড়িতে বিয়া শাদির কতা বন্ধ অইয়া রইছে, তাগো জন্যি সুখবর! সুখবর!! সুখবর!!! ২২ ক্যারেটের সিঙ্গাপুরি সোনার ৮ আনার চেন। লুহার সাতে ঘইষ্যা, ছ্যাপ দিয়া ডইল্যা দেইহা নেবেন আফারা, বাইজানরা। কালার গেরান্টি পাক্বা। যাবেন কোন দোকানে কিনার লাইগ্যা লাগব ১০০ টাকা। কিন্তু এই মানিক মিয়া আপনাগো ২২ ক্যারটের ৮ আনার সিঙ্গাপুরি সোনার চেন ২ পিচ দিবো মাত্র ৬০ টাকা, ৬০ টাকা, ৬০ টাকা। চেন কিইন্যা বাড়ি যাইয়াই বিয়ার আলাপ শুরু করে দেবেন। কী ভাবতাছেন? কালার টিকব না? ঠকবেন? মনডা উসখুস করতাছে? শোনেন বাইজানরা এই মানিক মিয়া গরিব অইবার পারে কিন্তু মিছা কতা কয় না বাইজান। এই লাইনে আইজ ১০ বছর। একজন যদি কইবার পারেন প্রমাণসহ যে আমার চেনের কালার নষ্ট হয়, তারে ১০০০ টাকা জরিমানা দিমু। আমারে পাইবেন কুতায়? হাসাইলেন বাইজান। আমি কোন অপরিচিত বা অচিনা মানুষ না বাইজান। এইসব জায়গায় অলিতে গলিতে আমারে পাইবেন। মানিক মিয়া কইলেই সবাই চিনাইয়া দিবো। চিনা মুখ আমার। আছেন নাকি কোনো বাইজান? হাত ডা তোলেন কষ্ট কইরা। ওইতো গাড়ির পেছনে হাত তুলছে এক বুদ্ধিমান বাইজান।
মামুন খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকালেন চেন বিক্রেতার দিকে। কালো কুচকুচে চেহারা, ঘন জাড়া ভ্রূর নিচে কালো গভীর চোখ। মাথার কোঁকড়া চুল ঘাড় অব্দি নেমেছে। সুঠাম দেহ, বেশ লম্বা। লোকাল বাসে কিছুটা কুঁজো হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতে কতগুলো সোনালি রঙের চিকন হার, গলায় ঝুলে আছে শ’ খানেক। মুখে হাসি লেগেই রয়েছে মামুনর। মানিক মিয়ার কথায় বেশ জোর, আর ভরসা করার সুর। এত আত্নবিশ্বাস নিয়ে বলছে কথাগুলো, যেন চোখ বন্ধ করে তাকে বিশ্বাস করা যায়, ভরসা করতে ইচ্ছে করে। কিছু কিছু মানুষ এমন হয়—পুরো মিথ্যে দিয়ে মোড়ানো শব্দগুলোকে বিশ্বাসের সুরে ছড়িয়ে দেয় বাতাসে, যাদের ভরসা করতে ইচ্ছে হয় ভালোবেসে, ঠকতে হয় অবশেষে।
মানিক মিয়ার দিক থেকে চোখটা সরিয়ে বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন মামুন। মাত্র কয়েকটা দিন আগে হলেই এই মানিক মিয়াকে নিয়ে তার আগ্রহের শেষ থাকতো না। হয়তো মানিক মিয়ার এই হার বিক্রি নিয়েই লিখে ফেলতেন গল্প। আজ তার আর কিছুতেই মন নেই। দৃষ্টি ঘোলাটে। তাকিয়ে আছেন বাইরে কিন্তু দেখছেন না কিছুই। কিছুই দেখার ইচ্ছে নেই তার। শূন্যদৃষ্টি।
আরও পড়ুন: ওয়াজিব আলী মাস্টার ও একটি সুপারি গাছ ॥ ফরিদুর রেজা খান
গাড়িটা যে কেন ছাড়ছে না, কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না তার। গাড়িতে একটা সিটও খালি নেই আর, ইঞ্জিন কভারেও বসানো হয়েছে যাত্রী। তবু হেল্পারটা চেঁচিয়ে যাচ্ছে সিট খালি সিট খালি বলে। কেন যে চারপাশজুড়ে মিথ্যের রমরমা ব্যবসা! কে জানে! তার পাশের সিটে বসেছে এক মধ্যবয়সী মহিলা। ওঠার পর থেকেই ঘুমিয়ে যাচ্ছে। এত চিৎকারে কী করে যে ঘুম আসছে, সেটাই অদ্ভূত লাগছে তার কাছে। কখনো তার ঘাড়ের ওপর, তো কখনো সামনে, কখনো আবার পাশে ঝুঁকে পড়ছে ঘুমের তোড়ে। মহিলার গা থেকে ভুর ভুর করে জর্দার গন্ধ বেরুচ্ছে। এক ফাঁকে কোমরে গুঁজে রাখা পোটলাটা বের করে মুখে গোটা একটা পান পুরে নিলো। বাম হাতের তালুতে অনেকটা জর্দা আর হতের আঙুলে খানিটা চুন রেখে পোটলাটা আবার কোমরে গুঁজে দিলো মহিলা। জর্দা মুখে নিয়ে হাতের অতিরিক্ত চুনটুকু মাথার ওপরের অংশের সিটে মুছে নিলো। বার কয়েক লেখকের গায়ের ওপর দিয়ে পানের পিক ফেললো জানালা দিয়ে। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। হেল্পার কয়েকজন মহিলাকে সিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টেনে তুললো বাসে। আর তখনই বাসটি বিকট আওয়াজ করে চলতে শুরু করলো। হেল্পারের সঙ্গে মহিলাদের চেঁচামেচি শুরু হলো। বাসের বসে থাকা যাত্রীরাও যোগ দিলো তাতে। হেল্পারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। বরং মুখজুড়ে বিজয়ের হাসি। মানুষকে ঠকিয়ে অনুশোচনা হওয়ার পরিবর্তে ঠকানোর আনন্দে বিজয়ের হাসিতে হাসে অনেকে।
দুই.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্র মামুন মোস্তাফিজ জিয়া হলের তিন তলায় যখন জামা কাপড় আর ৩০ ইঞ্চি বাই ১৮ ইঞ্চি পুরনো ট্রাংক নিয়ে ঢুকল, তখন ওকে দেখেই রুমের বাকিরা হাসির খোরাক পেলো। তার ওপর হাতে রবীন্দ্রনাথের বিশাল পোস্টার। মামুন রুমের সবার হাসিতে একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে জানালার কাছের সিটটা তার চাই, সেটা জানিয়ে দিলো। কারণ হিসেবে তার কবিতা আর গল্প লেখার কথাটাও জানিয়ে দিলো সগর্বে। আকাশ, প্রকৃতি না দেখলে মামুনের যে লেখাই আসে না। তাই লজ্জা, ভয় ফেলে বলতেই হয়েছে কথাটা। মামুনের এমন কথায় জিয়া হলের ৩০৪ নম্বর রুম হাসিতে ফেটে পড়লো। মন খারাপ হলো মামুনের। হয়তো জানালার পাশের সিটটা সে পাবে না। একজন বললো, আরে দিয়ে দে জানালার কাছের সিটটা, কবি-টবি মানুষ! ফ্রিতে কবিতা শুনতে তো পারব। আবারও হাসির জোয়ার রুমে। বিদ্রূপ শুনে হলেও জানালার পাশের সিটটা পেয়েছিল মামুন। বন্ধুরা যখন টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা, ফুলার রোড, হাকিম চত্বর, ডাকসু দাপিয়ে বেড়াতো আড্ডা করে, মামুন তখন তার ৩০ বাই ১৮ ইঞ্চি পুরনো ট্রাংক থেকে লেখার খাতা বের করে জানালার পাশে বসে পড়তো। সিগারেটের পর সিগারেট পুড়তো আর লেখায় ডুবে যেতো মামুন মোস্তাফিজ। চারুকলার কোন ঝোঁপের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতো সে। কখনো কখনো শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দেখতো মানুষের জীবন। কথা খুব কম বলতো বন্ধুদের সঙ্গে। সারক্ষণ কী এক ভাবনার সাগরে ডুবে থাকতো! বন্ধুরা আড্ডায় ডেকে ডেকে বিরক্ত হয়ে একসময় বন্ধ করে দিলো মামুনকে ডাকা। তবে মামুনের যখন ইচ্ছে হয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় নিজে থেকেই যোগ দেয়। তখন সে অন্য এক মানুষ। কথার তুবড়ি ফোটায়। দারুণ আবৃত্তি করে। বন্ধুরা তাকে ভালোবেসে লেখক সাহেব, কবি সাহেব কখনো বা ভাবুক সাহেব বলে ডাকতো। দেশের বড় বড় আর নামিদামি এক একটা পত্রিকায় যখন মামুনের লেখা ছাপতে শুরু করলো, তখন তার আগ্রহও অনেকগুণ বেড়ে গেলো। ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে লাগলো আগের চেয়ে বেশি। একটা স্বপ্ন দেখতো মামুন কলেজে পড়ার সময় থেকে। এখনো প্রতিদিন সেই স্বপ্নে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে তার স্বপ্নের চারাগাছও। স্বপ্ন এখন প্রত্যয়ে পরিণত হওয়ার পথে। প্রিয় বন্ধু সোহেল, অবনী, মায়া, বর্ণ আর জিশু। ওরা সবাই মিলে মাঝে মাঝে সিনেমা, থিয়েটার দেখতে যায়। মামুন সিনেমা বা থিয়েটারের প্রোগ্রাম কখনো মিস করে না। সিনেমা বা থিয়েটারে জীবনের গল্প খুঁজে পায় সে। খুব ভালো করে বুঝতে পারতো ওর প্রতি অবনীর দুর্বলতা। দিন দিন তা বেশি মাত্রায় যেন প্রকাশ পাচ্ছে। অবনীর আচরণে তা বেশ স্পষ্ট। দলের বাকি বন্ধুরাও বুঝতে পারে মামুনের প্রতি অবনীর ভালোবাসা। ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় সোহেল আর বর্ণ একদিন চেপে ধরেছিল মামুনকে।—তুই কি অবনীর ভালোবাসা বুঝতে পারিস না? না কি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকিস? অবনী সুন্দরী, রুচিশীল, বড় লোকের মেয়ে। কোন দিক থেকে তোর অযোগ্য বল আমাদের? তুই এত কবিতা, গল্প লিখিস, সে কবিতার চরণে চরণে প্রেম। অথচ বাস্তব জীবনে তোর মতো প্রেমহীন একটা মানুষও চোখে পড়েনি আমাদের। ধুর শালা, তোর কবিতার সাথে তোর কোনো মিল-ই নেই।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১০॥ শিল্পী নাজনীন
মামুন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে শুকনো হাসি হেসেছিল। ভেবে নিয়েছিল সুযোগমতো অবনীকে ওর স্বপ্নের কথাটা জানিয়ে দেবে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই অবনী এমন ঘটনা ঘটাবে ভাবতেও পারেনি। সেদিন খুব সকাল থেকেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। চারুকলার ভেতরে একটা গাছের গুঁড়ির ওপরে বসে প্রেমের কবিতার শেষ অংশটা লিখছিল মামুন। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হওয়ায় চারুকলার মূল ভবনের বারান্দায় উঠে এসেছিল মামুন। দুই-একজন ছাত্র-ছাত্রী আসতে শুরু করেছিল মাত্র। একটা হুড ওঠানো রিকশা এসে থামল চারুকলার গেটের ভেতরে। পলিথিন সরিয়ে দৌড়ে বারান্দায় উঠে এলো অবনী। বৃষ্টির ছাঁটে কাঁচা হলুদ রঙা সালোয়ার কামিজের বেশির ভাগ অংশই ভিজে গেছে। চোখদুটো ছলছল করছে, মামুনের মনে হলো অবনী ঘুমায়নি সারারাত। মামুন হাতের সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো বাইরে। আধ খাওয়া সিগারেটের অংশটুকু ভেসে চললো বৃষ্টির তোড়ে, কিছুক্ষণ পর চোখের আড়ালে হারিয়ে গেলো। সিগারেটের আধখাওয়া অংশের হারিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে চোখ ফেরালো মামুন অবনীর দিকে। ঠিক তখনি অবনী মামুনকে অবাক করে জড়িয়ে ধরলো, আর কাঁদতে কাঁদতে যা বলতে শুরু করলো, তার সারমর্ম এই দাঁড়ায়—বাবা-মা অবনীর বিয়ে ঠিক করেছে, কানাডায় থাকে ছেলে। কিন্তু অবনী শুধু মামুনকেই ভালোবাসে, তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। অবনী জানে মামুনের সব কবিতা শুধু ওকে ঘিরেই লেখা। ও ভেবেছিল মামুন নিজেই ওকে বলবে, একদিন নিজের ভালোবাসার কথা, আর তারই অপেক্ষায় সময় কেটেছে ওর। কিন্তু বাবা-মা তার বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে।
অবনীর ছোঁয়ায় মামুন শিহরিত হয়নি বা ওর বুকটা কেঁপে ওঠেনি, তা নয়। সেদিন বাইরের ঝড়ের তুলনায় কোনো অংশেই কম ঝড় ওঠেনি মামুনের বুকে। পার্থক্য শুধু বাইরের ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি পৃথিবীকে ভিজিয়ে দিয়ে শীতল করে দিচ্ছিল। মামুনের মনে শুধু তপ্ত মরুভূমির বালুঝড়। মামুন নিজের মনের ঝড়কে উপেক্ষা করে নিজেকে সামলে নিয়ে অবনীকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল নিজের থেকে। অবনীকে স্পষ্ট ভাষায় বুঝয়ে দিয়েছিল নিজের আজন্ম লালিত স্বপ্নের কথা। একজন লেখকের স্বপ্নের কথা। বিয়ের পরে প্রথম আমি আমার বউয়ের মুখ দেখতে চাই অবনী। কোন পরিচিত মেয়েকে নয় বরং অচেনা, অদেখা একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। তোমাদের কাছে হয়তো এটা খুব সেকেলে ব্যাপার, কিন্তু একজন কবির কাছে তা অন্য অনুভূতির। আমি একটা অচেনা মেয়েকে একটু একটু করে আবিষ্কার করতে চাই। আবিষ্কার করতে চাই ওর রূপ,সৌন্দর্য, প্রেম। জয় করতে চাই ওর ভালোবাসা। আমার এই অদেখা প্রেমকে বাঁচিয়ে রেখেছি আমার কবিতার প্রতিটি চরণে চরণে। কেমন হবে তার অভিমান, কত তীব্র হবে তার ভালোবাসা, কতটা ডুবিয়ে দেবে তার চোখে আমায়, তার রূপের নেশায় কতটা বুঁদ করে রাখবে আমায়! এমন অজানা প্রশ্নে শিহরিত হতে চাই প্রতিদিন আমি। একটু একটু করে সারাজীবন ধরে পড়তে চাই তাকে আমি। আমাকে এ স্বপ্ন ভেঙে দিতে বলো না অবনী। আমার এ অপারগতা ক্ষমা করো। তুমি খুব ভালো মেয়ে, দেখবে, তুমি খুব সুখী হবে জীবনে। বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল মামুন। অবনীর চোখে তাকিয়ে কথা বলার সাহস হয়নি তার। কথা শেষ করে ঘুরে তাকিয়ে অবনীকে কোথাও দেখতে পায় না মামুন। খুব ভালো মেয়ে অবনী, মামুনের ভালো বন্ধু। কতটা আঘাত দিয়ে ফেললো অবনীকে মামুন! ওর ভালোবাসাকে আঘাত করতে চায়নি মামুন। কিন্তু একজন লেখকের আজন্ম লালিত স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে পারবে না সে। পরেরদিন সকালেই অবনীর বিয়ের কার্ড এসেছিল বন্ধুদের নামে। মামুনের কার্ডের সঙ্গে এসেছিল হলুদ রঙের ছোট এক চিরকুট।
তিন.
মামুন মোস্তাফিজের বাড়ি আজ স্বপ্নের সবগুলো রঙ দিয়ে সাজানো হয়েছে। সে রঙ আবার আলো হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে, যেন তা লেখক মামুন মোস্তাফিজের খুশির সঙ্গে একাকার হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে জ্বলছে। পড়াশোনা শেষ করে রংপুর কারমাইকেল সরকারি কলেজের বাংলার শিক্ষক মামুন মোস্তাফিজ লেখক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বেশি প্রিয়। আজ তার বিয়ে। তার স্বপ্নকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তিনি, লালন করেছেন সযত্নে। পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক করার পর বোনেরা অনেকবার মেয়ের ছবি দেখাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে বহুবার। বোনদের কাছেই শুনেছে মামুন মেয়ে খুব সুন্দরী। তবে কথা বেশি বলে না, চুপচাপ। মেয়েটার শরীর খারাপ ছিল বলে বাড়ির কেউ তেমন কথা বলেনি মেয়ের সঙ্গে।
আরও পড়ুন: সেলিব্রেটি অন্ধকারের রোশনাই ॥ রুমা মোদক
চারপাশ ইলেকট্রিক আলোর বন্যায় ভাসলেও মামুনের ফুলশয্যার ঘরসহ পুরো দোতলায় জ্বালানো হয়নি কোনো ইলেকট্রিক বাতি। মোমের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো দোতলা। কাঁচা ফুলের ঘ্রাণে মোমের আলো যেন আরও স্নিগ্ধ, মোহনীয়। মোমের মিষ্টি আলো, রজনীগন্ধা আর গোলাপের সুবাসে লেখকের ভালোবাসা আর লালিত স্বপ্নের আবেগে নেশাতুর আজ। দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে, কাঁপা হৃদয় নিবেদন করে রজনীগন্ধা, গোলাপবেষ্টিত বকুলের কাছে। ও, নতুন বউয়ের নাম বকুল। মোমের আলোতে ঘুমন্ত বকুলের মুখ বড্ড পবিত্র আর মোহনীয় মনে হয় মামুনের। মুগ্ধ হয়ে ঘুমন্ত বকুলের রূপে ডুবে যায়, কতক্ষণ এভাবে পার হয় তার হিসাব নেই মামুনের কাছে। হঠাৎ বকুলের কথায় সম্বিত ফিরে পায়। নতুন বউয়ের কথায় স্নিগ্ধ মোমের আলোও অস্থির হয়ে ওঠে যেন। তার অসংলগ্ন কথায় গোলাপ, রজনীগন্ধার সুবাসেও দম বন্ধ হয়ে আসে মামুনের। দৌড়ে পালিয়ে বাঁচতে চায় মামুন। কিন্তু ঘুমন্ত বকুলের পবিত্র মুখখানা মনে করে আটকে যায় পা। নাড়াতে পারে না কিছুতেই। পরিবারের বাইরে যেতে হবে তাকে বুঝতে পারে মামুন, কিন্তু কিছু করার নেই তার আর। একজন লেখক জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারে না। স্বপ্নের মৃত্যু হলেও থেমে যেতে পারে না সে, শূন্য থেকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাই লেখকের কাজ।
চার.
লোকাল বাস সার্ভিস হ্যাপি—পপির পরিবেশ এখন একটু হালকা। মামুনর পাশে বসা মধ্যবয়সী মহিলা কখন যে নেমে গেছেন, তিনি তা খেয়াল করেননি। এখন বাসে বসা এক তরুণ। সদ্য গোঁফওঠা। হাতে তার কতগুলো রজনীগন্ধা আর গোলাপের তোড়া। তারও মনে হলো আজ বকুলের জন্য ফুল নিয়ে যেতে হবে। অনেকদিন পর দেখা হবে আজ বকুলের সঙ্গে। ফুল নিয়ে গেলে অভিমান ভাঙানো যাবে সহজে বকুলের। চাকরি বাঁচিয়ে এতটা সময় পায় না লেখক বকুলকে দেখতে আসার, দূরত্বটাই যত সমস্যা। তবে বকুলকে ঘিরেই তার সারাবেলা। বকুলের পরিবারের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে আর যোগাযোগ রাখেননি লেখক। না, যেতে দেননি বকুলকেও। কোনো মিথ্যেবাদী, প্রতারকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না লেখক ও তার পরিবার। লেখকের পরিবার বকুলকেও মানতে রাজি হননি, কিন্তু লেখকের জেদের কাছে তারা টিকতে পারেন না কিছুতেই। লেখক চান না তার বকুল কোনো প্রতারকদের কাছে ফিরে যাক। হেল্পার দরজায় আঘাত করে চিৎকার দিয়ে ওঠে, মামা নামেন, নামেন, আইয়া পড়ছি মেন্টাল—মেন্টাল—মেন্টাল। মামুন চুপচাপ নেমে পড়েন গাড়ি থেকে। পাবনা মানসিক হাসপাতালের গেটের পাশের ফুলের দোকানগুলো থেকে কিনে নেন কতগুলো গোলাপ। পাবনা মানসিক হাসপাতালের ২০৫ নম্বর রুমে অপেক্ষায় আছে তার বকুল। হ্যাপি পপি লোকাল সার্ভিস হেলে দুলে চোখের বাইরে চলে যায়। লেখক গেটের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে পকেটে হাত দেয়, তার হাতে উঠে আসে একটা পুরনো হলুদ চিরকুট।