আজ থেকে আমার আনন্দগুলোকে খুঁজতে এসো না, যদি আসো তাহলে তোমরা চরমভাবে দুঃখিত হবে—এটাই ছিল বাবার প্রতি আমার সর্বশেষ আকুতি। কথাগুলো আমি বরাবরের মতো বাবাকে সরাসরি বলতে পারিনি, কথাগুলো বলতে হয়েছে আমার জন্য নির্ধারিত মইটি ব্যবহার করে। আমার মা। আমার মা-ই হচ্ছেন আমার মই। বাবা পর্যন্ত পৌঁছানোর মই। আমি মইটি হারাতে বসেছি। হয়তো বাবা পর্যন্ত আর কোনোদিনই পৌঁছানো হবে না আমার। হয়তো মা পর্যন্তও না। হয়তো কোনোদিনই পৌঁছানো হবে না সাত বছরবয়সী একমাত্র বোন পর্যন্ত।
হিসাব করলে এই মুহূর্তে আমার বয়স ষোলো বছর সাত মাস একুশ দিন কয়েক ঘণ্টা প্রায় আর জন্মক্ষণ অনুযায়ী আরও নয় মাস এগারো দিন যোগ করে নিতে হবে। বাস্তবতা হলো আজ আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, যে বাড়ির একচ্ছত্র অধিপতি আমার বাবা। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে কবিতা পড়ার অপরাধে, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে কবিতা লেখার অপরাধে। বলা যেতে পারে আমিই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছি কবিতা লেখার স্বাধীনতা না পেয়ে। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছি কবিতা পড়ার অধিকার হারানোর কারণে। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে বা আমিই বের হয়ে যাচ্ছি—এর জন্য কে দোষী, এটা নির্ণয়ে পৃথিবীর ব্যস্ত ওঠার কোনো কারণ অন্তত আমি খুঁজে পাচ্ছি না। পৃথিবী, তুমি বরং তোমার প্রতি ক্রমশ নির্দয় হয়ে ওঠা তোমার উত্তর-অধিবাসীদের সামলাতে সচেষ্ট হও, যারা তোমার যোনিপথে প্রতিদিন প্রবেশ করাচ্ছে অপূর্ণ গমের গুচ্ছ গুচ্ছ শিষ। আচ্ছা পৃথিবীর লিঙ্গ কী? স্ত্রী না পুং?
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়টা খুবই পিচ্ছিল। জানি সময়টাকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারব না আমি। সেটার সক্ষমতাও আমার নেই। বাবাও সময়টাকে ধরে রাখতে পারবেন না বা রাখতে চাইবে না। আজ থেকে নিজেকে অন্য নামে ডাকব আমি। আজ থেকে আমার ভেতর অন্য কেউ বাস করা আরম্ভ করবে, যে আমার ফেলে যাওয়া সতেরো বছরকে আমলে নেবে না। আমার বাবা আজ থেকে আমাকে তার সন্তান পরিচয় থেকে বঞ্চিত করবে। আজ থেকে আমি আমার মাকে মা বলে ডাকতে পারব না, কারণ বিবাহসূত্রে আমার মায়ের একচ্ছত্র মালিক আমার বাবা। আমি এও জানি, আমার বাবা যত দিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন আমার একমাত্র বোন আমার সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখতে চাইলেও পারবে না, কারণ তার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমার বাবাই তার একমাত্র অভিভাবক। অবশ্য বিয়ে হওয়ার পর তার মালিক হবে তার স্বামী। জীবন পাল্টে ফেলার এই দিনে আমি তোমাকে (বাবা) কথা দিচ্ছি—আমি কোনোদিনই তোমাদের আগামী দিনের জীবনযাপনকে হিংস্র পশুর মতো আঁচড় কাটব না।
সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি ঘড়ির দিকে তাকাইনি। তাকাব কিভাবে? কোনোকালেই ঘড়ি বলে আমার কিছু ছিল না, যেমন বাড়ি বলেও আমার কিছু ছিল না কোনোদিন। আমার বাবার একটা বাড়ি আছে, আমার বাবার একটা ঘড়িও ছিল, ক্যাসিও ঘড়ি, ওয়াটার প্রুফ। বাবা ঘড়িটা কিনেছিলেন, যখন আমি সবে ওয়ান-টু- থ্রি পড়তে শিখেছিলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি একবারও পেছন ফিরে আমার বাবার বাড়ির দিকে তাকাইনি। আমার বাবার ঘড়িটা অনেক দিন আগেই পানিতে ডুবে মরে গেছিল। আমার সতের বছরের অতীত ঠিকানা মুছে ফেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমার নতুন ঠিকানার খোঁজে। বেরিয়েই একটা সিগারেটের মুখে আগুন দিলাম, দ্রুতগতির পায়ের তালে তালে সিগারেটটাও আমার শ্বাসের সঙ্গে দৌড়চ্ছিল। কোথায় যাব আমি? নিশ্চিত না কোথায় যাব। দেখি কোথায় যাওয়া যায়! সত্যিকার অর্থে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কে আমাকে গ্রহণ করবে? একজন মানুষের কবিতা পড়াকে সহ্য করতে পারছে না কেউ। একজন কবিকে কবিতা লিখতে দেওয়ার স্বাধীনতা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তাকে গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। আমার মনে হয় বাবা আমাকে ভয় পাচ্ছে, আমাকে ভয় পাওয়া মানে আমার কবিতা পড়াকে ভয় পাওয়া, সুস্পষ্ট করেই বলি বাবা আমার কবিতা লেখাকেই ভয় পাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে সতের বছর বয়সকে। পৃথিবীর সমস্ত বাবা এই বয়সটাকে ভয় পেয়ে এসেছে, ভয় পেয়েই যাবে যতদিন বাবা নামক পরাধীন তাবু টাঙানো থাকবে পৃথিবীর বুকে। আমার কাছে বাবা অনেকটা রাষ্ট্র আর মা হচ্ছে দেশ।
ঋদ্ধির বুকে মুখ রেখে আজ আমি কবিতা লিখব
স্ট্রাইপের একটা সুতি শার্ট আর কালো গ্যাবাডিন প্যান্টে খুব হালকা বোধ করছি আমি। সিগারেটটাকে টান দিচ্ছিলাম আর ধোঁয়ার কুণ্ডলীটাকে বিশেষ কায়দায় উড়িয়ে দিচ্ছিলাম। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে দেওয়া একধরনের শিল্পের মধ্যে পড়ে, শিল্পটা আমি নিবিড় প্র্যাকটিসের মাধ্যমে আয়ত্তে এনেছি। শুরুর দিকে ধোঁয়া গিলে ফেলতাম, কাশি আসত, এখন একটুও ভেতরের দিকে না নিয়ে পুরোটাই উড়িয়ে দেই—উড়িয়ে দেওয়ার ভেতর অন্য ধরনের মজা কাজ করে। প্রশ্ন হলো কোথায় যাব আমি? কেউ আমাকে আশ্রয় দিতে আগ্রহী না, বাধ্যও না। আমার নাম ভোটার লিস্টে এখনো ওঠেনি। রাষ্ট্র কি আমাকে আশ্রয় দেবে না? আমার কোনো সার্টিফিকেট নেই। কিছু পড়াশোনা আছে আর আছে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সতের বছরের একটা উর্বর শরীর।
হ্যালো, তুই কই? বাড়ি আমারে বাইর কইরা দিছে।।
মানে আমার সন্দেহটারে তুই আনুষ্ঠানিক রূপ দিলি, তুই কই এহন?
শাহবাগের দিকে আইতাসি।
আয়।
সাকুল্যে ঋদ্ধির সঙ্গে এটুকুই হলো কথাবার্তা। বেশি কথা বলা যাবে না। ইচ্ছা থাকলেও না। ব্যাল্যান্স নেই। ঋদ্ধি? ঋদ্ধি হলো কবিতাকে ভালোবাসা একটা মেয়ে, যে মেয়ে সিগারেট খায়। ঋদ্ধি? ঋদ্ধি হলো আমার কবিতাকে অকাতরে ভালোবেসে ফেলা একটা মেয়ে, যে জিনস ও ফতুয়া পরে, যে মেয়ে সিগারেটও খায়। খারাপ লাগলো? আচ্ছা ঋদ্ধি হলো আমার কাছে আমার কবিতার বিনিময়ে তার ভার্জিনিটি নিঃশর্তে আমার হাতে তুলে দেওয়া বড়লোকের একমাত্র মেয়ে, যে সিগারেট খায়, জিনস ও ফতুয়া পরে। এর চেয়ে ভালো করে বলতে পারব না। আচ্ছা কেউ আমাকে বলতে পারেন কবিতা কি একটা সামাজিক ব্যধি? ভাবতে থাকুন, ভেবে বলুন প্লিজ। আপনাদের ভাবনা কি কখনোই সে পর্যন্ত পৌঁছায় না যে, কেন একজন মানুষকে কবিতা পড়ার দায়ে তার অতীতকে মুছে ফেলতে বাধ্য করা হবে।! সন্দেহাতীতভাবে ঘটে যাওয়া এই সত্যগুলোকেই বলতে এসেছি, আমার কবিতার মাধ্যমে। এও বলতে এসেছি—আমি এখন থেকে আমার কবিতা বেচেই খাব। বহুবিধ খাবারের দিকেই আমার ঝোঁক। আজিজের অন্তরা থেকে আরম্ভ করে এই সমাজের সমস্ত নোংরা ময়লা আবর্জনা গিলে খাব আমি। কেন? শার্ট-গেঞ্জির দোকানগুলা যখন বইয়ের দোকানগুলোকে নিয়মিত রেইপ করে চলেছিল তখন, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? ওহ! বই পড়লে আপনাদের অনেক সমস্যা, তাই না?
কই রে? শাহবাগ আসতে তোর এতক্ষণ লাগে, শালা—ঋদ্ধির ফোন। এই মেয়ে আমাকে মাঝে মাঝে শালা বলেও সম্বোধন করে, আপত্তি আছে?
শাহবাগ যেতে তো এত সময় লাগার কথা নয়! শাহবাগ কি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে? আমার বাবার বাড়ির মালিক আমাকে ছুড়ে ফেলেছে অন্ধকার গলিপথে, সেখান থেকে শাহবাগ যেতে এত দেরি হচ্ছে? মাত্র এক ঘণ্টার পথ যেতে কয়েক যুগ ধরে হাঁটা লাগছে? তবে কি কেউ সামনে এগোনোর রাস্তাটাকে ইচ্ছা করে ডাস্টার দিয়ে মুছে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ক্রমাগত বর্ষণে আমার পাঁজর ডুবে গেছে ময়লার ভাগাড়ে। বুঝতে পারছি আমার জুতোর ভেতর ঢুকে পড়ছে অসংখ্য ধারালো বালি। আমার পায়ের পাতা রক্তে লাল হচ্ছে। হাতের সিগারেটটাও এতক্ষণে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের জালে আটকা পড়েছে। নিজেকে চিনতে পারছি না আমি। গমের আটার মতো শরীরের রঙের সঙ্গে নিয়ন আলো মিশে আমার একটা আর্যমার্কা আর্কিটাইপ পরিচয় তৈরি করেছে। ত্বক স্পর্শ করেও কোনো ধরনের সাড়া পাচ্ছি না। আমি সজ্ঞান না কি অচেতন, বুঝতে পারছি না। এই মুহূর্তে কোথায় আমি? শাহবাগ কতদূরে? আমার ভেতর অসংখ্য শব্দ ভিড় করছে, বোবা শব্দ, দৃষ্টিযুক্ত ব্যাখ্যাতীত কিছু শব্দ। ঋদ্ধির বুকে মুখ রেখে আজ আমি কবিতা লিখব, যে কবিতা কোনো কবি কোনোদিন লেখেনি। আচমকা ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো আচরণ করতে থাকলাম, বাতাসের দিকে অসংখ্য গালির তীর ছুড়ে মারতে থাকলাম। একনাগাড়ে চিৎকার করে বলতে থাকলাম ঋদ্ধি, ঋদ্ধি? বাবা নামক রাষ্ট্র আমাকে কবিতা পড়তে দেবে না, বাবা নামক রাষ্ট্র আমাকে কবিতা লিখতেও দেবে না।
ঋদ্ধি, ঋদ্ধি! তুই আমার রাষ্ট্র হবি? রাষ্ট্র হবি? তুই আমার…