অনেক মানুষের কোলাহল। চারিদিকে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ। মানুষের মাঝে যেন অতিমানব ও অমানব এসে হাজির হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ এখানে। কালো, সাদা ও বাদামিসহ কয়লা কালো এমনকি বিকৃত মানুষেরও উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড সব আজদাহা লোকের সমাগম। যেদিকে তাকাই শুধু বিচিত্র মানুষ আর মানুষ। এমন মানুষ জীবনে দেখা হয়নি। তবে এত মানুষের মাঝে দুজনকে আলাদা করতে মোটেও বেগ পেতে হচ্ছে না। তারা দুজন একেবারে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোলাহলের ভেতরে নীরবে সময় যাপন করছে।
চ্যাপ্টা পদ্মপাতা বা শালুকপাতার মতো মুখ নিয়ে একজন মহিলা কি অর্ধমহিলাটি বিকট জোরে মা-মা বলে চিৎকার করছে। সঙ্গে সঙ্গে আরেক সঙ্গীকে দেখা যাচ্ছে। তাকেও পুরোপুরি পুরুষ বা অর্ধপুরুষ বলা যেতে পারে। তারা ঠিক বাংলায় নয়, যে জাতির মধ্যে উপবিষ্ট, সে জাতির ভাষার সঙ্গে খিঁচুড়িমার্কা একটা ভাষার গোঁজামিল দিয়ে কথা বলছে। তাদের জিহ্বা অস্বাভাবিক রকমের বড়। চোখগুলো কুকুর কিংবা শিকারি প্রাণীর চেয়ে ভয়ার্ত। শরীরে বড় বড় লোম না থাকলেও মাঝে-মাঝে সে রকমই মনে হচ্ছে। নাক ও মুখ খানিকটা বানর বা হনুমানের মতো। তবে মাঝে-মাঝে সেটার পরিবর্তনও দেখা যাচ্ছে। দুজন তারা সবসময় একসঙ্গে। কখনো কাউকে ছেড়ে কেউ দূরে যাচ্ছে না।
এ মজমার লোক বা স্বজাতির লোকগুলো তাদের ভিড় করে উৎসুক চোখে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। এ রকম মানব এই প্রথম তারা দর্শন করছে। তাদের মতো কোনো জাতির সঙ্গেই আগে পরিচয় ছিল না কখনো। বা আশে-পাশের দেশে যে এ রকম কোনো জাতিবংশের লোক আছে, তাও তাদের জানা নেই। যে দুজনকে সবাই দেখছে, তাদের মধ্যে একজনের লিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। সাধারণত এ দেশের পাগলদের মতো তাদের বেশ ও পোশাক। যার লিঙ্গটা দেখা যাচ্ছে, তাকে মানবী মানে অর্ধমানবী বলা যায়। তার লিঙ্গটা ঠিক কচু ফুলের মতো। খানিকটা ষাঢ়ের লিঙ্গের মতো। তবে সামনের দিকটা ফুসফুসের মতো মেলানো অবিকল। পুরুষাঙ্গের মতো লম্বা হয়ে মুণ্ডুটা একেবারে পাবদা বা গরুছাগলের ফ্যাকসার মতো ঝুলে আছে। তা দেখে ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বুকের দিকটা একেবারে পুরুষের মতো স্তন দুটি বুকের সঙ্গে মেলানো। আর মানব বা অর্ধমানব পুরুষটার লিঙ্গটা চেষ্টা করেও দেখা যাচ্ছে না। বাবা! এ রাজ্যে পাগলের লিঙ্গ দেখার মানুষের অভাব নেই! তাদের বুকের দিকে কারও নাক নেই। না তাদের মুখের দিকে। এই বিকৃত লিঙ্গটা দেখে সবাই আরও বেশি আশ্চর্য হচ্ছে।
তাদের মুখের ও জিহ্বার বিকৃতি সম্পর্কে তারা নিজেরা তো দূরের কথা, কেউ জানে কি না—তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাওয়া প্রত্যেকটা সচেতন মানুষের জন্যও যেন স্বাভাবিক। তাদের গায়ের রঙ না কালো না সাদা না বাদামি। গায়ের রঙটাও বিকৃত। আধলা ইটে যেমন শ্যাওলা কালার হয় এমন। পানির যেমন কোনো রঙ নেই, ঠিক তেমন তাদের শরীরের রঙ!
এই আয়োজন কারা করেছে—তা কেউ জানে না! একটা দেশের গ্রামে কিছু সাধারণ ও সরল বিশ্বাসী মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, গ্রামই বলা যায়। কোথাও সুরম্য প্রাসাদ চোখে পড়ে না। একটা প্রকাণ্ড বড় মাঠ তাও নয়। তবে গ্রামের স্কুল মাদ্রাসা হাইস্কুল টাইপের একটা মাঠ। ফাঁকে-ফাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা চোখে পড়ার মতো। এই বৃক্ষ এই টিনের চালের লম্বা ঘর। এর ভেতরে অনেক মানুষের বসতি। এই তো জলাধার। জনারণ্যে রক্তের মতো ফুল। এখন তার নাম জানা অসাধ্য। নাম জেনে কী লাভ? এখানে সবকিছু বিস্ময় জাগানিয়া। এমনকি মাটির নিচ থেকে পানি তোলা পাম্পও। সেটা না কূয়ো না পানিকল। তবু সবাই জলাশয় থেকে পানি ব্যবহার করছে। হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া, বাসন মাজা—সব কাজই এই একটা পুকুর থেকে। এমনকি ছেলেমেয়েদের গু-মুথ ধোয়া হচ্ছে সমান তালে।
বাদামি কালারের একটা দীর্ঘ লোক গুটি-গুটি পায়ে খানিকটা ভয়ে-ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মজলিসের ভেতর। তার ডানে কিংবা বামের যেকোনো পাশে বিড়াল বা কুকুর ডাকলে সে যেন ভয়ে চিৎকার করে উঠবে—এমনই মনে হচ্ছে তাকে দেখে। বগলে ইংরেজদের মতো একটা ছোট ডাইরি বা ছাতা জাতীয় কিছু হতে পারে।
একটু আগেই বৃষ্টি হলো। কাদাজলে একাকার সবকিছু। সবার পায়ের জুতোয় কাদা আর কাদা। বৃষ্টি খানিক আগে থেমে গেছে। পাহাড়ি বৃষ্টির মতো। তবে এখানে কোনো পাহাড় দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশেও পাহাড় আছে বলে ধারণা করা ভুল হবে। এই এলাকা আমার হলেও এই মজলিসের বাইরের সব দৃশ্য এখন আমি অদৃশ্যের মতো আঁচ করতে থাকি। এই মজলিসে যারা আছে, তারাও আমার মতো এখানকার ঘটনা ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো ঘটনা এই মুহূর্তে মনে করার অবকাশ সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমি ট্রাই করেছি কিন্তু সফল হতে পারিনি।
আমার মা-বাবা-ভাই-বোন সংসার পরিজন আছে—এমন খেয়াল কাজ করছে না মাথায়। সবাই যেন এখানে বাবা-মা বা পরিজনহীন অনাথ একেক জন মানুষ। আবার গৃহহারাও তাদের মনে হচ্ছে না। তবু দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কখনোই তাদের কোনো ঠিকানা ছিল না, এখনো নেই। কালও কি হবে? হবে কিছু একটা বোধ হয়! মানুষের কি খুব বেশি স্থায়ী ঠিকানা দরকার? কেন মানুষ ঠিকানা চায়? কেন সে স্থিত হওয়ার বাসনা মেখে জর্জরিত করে সময়কে? ঠিকানা খোঁজা মানুষগুলো ক্রমেই কি স্বার্থপরতার দিকে ঝুঁকে পড়ে না?
এখানে কাউকে ক্ষমতাবান বলে মনে হচ্ছে না। কাউকে সরকারি বা বিরোধীদলীয় বলেও মনে হচ্ছে না। কিংবা এসব বিষয় মাথায় আনার সুযোগ ঘটছে না। এখানে কোনো বাহিনীও দেখা যাচ্ছে না। এটা কি কোন দেশ? না কি দেশের বা মানচিত্র বা পৃথিবীর বাইরের কোনো গ্রাম। না কি এই গ্রামই বিশ্ব? তা এই মজলিসের কেউ তফাৎ চিন্তা করার সাহস ও সময় দুইই হারিয়ে একটা অসময় বা সময়হীনতার ভেতর ছোটাছুটি করছে। সবাই খুব ব্যস্ত। তবে কী কাজে ব্যস্ত, তার কোনো নিদিষ্ট কারণ নির্ণয় করা বড্ড দূরুহ। সঠিকভাবে কেউ কোনো কাজের বিবরণ বা সঠিক উত্তর কস্মিনকালেও দিতে পারবে না বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এমন কেউ নয় যে, সে ছুটছে না। কারও পোশাক-আশাক এখানে মুখ্য চরিত্র দিতে একেবারে ব্যর্থ। সবাই হট্টগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে নিজেদের কথা শোনানোর জন্য বা শুনতে জোরে জোরে আওয়াজ করে কথা বলছে। নিজের অবস্থান যেন জানান দিতে চায় সবাই। নিজের স্তূতি গাওয়া ছাড়া এই সব মানুষের কি আদৌ কোনো কাজ আছে?
একটা বাদামি লোক পিটপিট করে চলছে। তার পেছনে পাগলের মতো ছেলেমেয়ে নয়, প্রাপ্তবয়স্ত লোকেরা ভয়ার্ত ঠিক না অবিশ্বাস্য চোখ নিয়ে পিছু নিয়েছে। এটা কি কিয়ামতের ময়দান নাকি? এটা কি ইস্রাফিল ফেরেশতা? তাকে খানিকটা ফেরেশতার মতো দেখতে লাগছে। যদিও এর আগে আমি কখনো ফেরেশতা দেখিনি। বা বলা যেতে পারে দেবতার মতো বেশ ফুরফুরে। তার চোখে একটা অপরিষ্কার ছায়ার গতি দৌড়াচ্ছে। এমন গতি কারও চোখে দেখা যায়নি কখনো। বিশেষ করে এই গোত্রের কেউ এমন কোনো ব্যক্তিকে আগে কখনো দেখিনি। আমিও এই মানচিত্রের মানুষ কি না—তা ভুলে গেছি। এটা ভুলেই থাকা যেন স্বাভাবিক! কী লাভ মনে করে? ভুলে থাকাই তো সুখের একমাত্র মহাধাতু।
এই মানচিত্রের লোকগুলো ক্রমেই ভুলে গেল যে, এটা তাদের জন্মভূমি। তাদের বেড়ে ওঠা মাটি। এখানে তাদের ঘর আছে। পরিজন আছে, সন্তান আছে এমনকি ভবিষৎও আছে। এসব কিছুই তারা একেবারে ভুলে গেছে। কেউ কাউকে এটা মনে করিয়ে দিতেও ভুলে গেছে। সবাই যেন একটা ধাঁধার রাজ্যে বা যাদুর রাজ্যে প্রবেশ করেছে। এসব কিছু বাদামি কালারের লোকটা তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ করছে। জাতিসংঘ নামক একটা সিলমোহর বা নকশা তার শরীরের কোনো এক অংশে মাংসের সঙ্গে ঝুলে আছে। তবে তাকে ফেকিং না মনে করে ভোলিং বলে মনে হচ্ছে। সংশয় ভরা তার চোখ। কৌতূহলী তার পদক্ষেপ। সর্তক তার কান। এগুলো যে কাউকে বোকা বানাতে প্রস্তুত। গোয়েন্দার মতো তার আচরণ। তবে এখনো কোনো কথা তার মুখ দিয়ে নিসৃত হয়নি। এইমাত্র তার স্বাভাবিক গতি একটু মন্থর হলো। তার পোশাক একটু অন্য রঙের। কিন্তু তার একটা বৈধ আইডি আছে বুকে ঝোলানো। আমাদের মানচিত্রে যারা আছে, তাদের অবশ্য এমন কোনো কার্ড নেই কারও।
এমনকি ও ব্যক্তি যদি এখনই ঘোষণা করেন যে, এই মানচিত্রের মালিক তিনি; তাহলে সবাই তাই মেনে নেবে। কেউ কিছু বলবে না। বলবে না বলতে কি, বলার কিছু থাকবে না। এখানে সবাই যেন কোনো একটা নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। সবাই নিজের-নিজের বিষয় নিয়ে এত বেশি মাতাল যে, অন্য কোনো বিষয় নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এমনকি অর্থের জন্য তারা তাদের বউ ও মেয়ের খোঁজও রাখে না। কারও যেন কেনো বিষয় নিয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই। কাকে কে কী বলছে। সবাই যেন বৃক্ষ দর্শক। যাদুর মন্ত্রে সবাই যেন হতবাক। সবাই ভয়ার্ত। চোখে চোরের ছায়া। মুখে সত্য প্রকাশের ভয়। কামের ছায়া ছাড়া কারও চোখে প্রেমের বাণী নেই। সবাই যেন কামের অভাবে তাড়িত হয়ে আছে। সুন্দর হরিণ পেলেও তারা শিকার করছে কলাবাগান থেকে। এসব কলাবাগানে এখন কলা হয় না। শুধু রক্ত কালারের এক ধরনের ফল হয়। এখানকার সবাই যেন এক একটা বিশ্ব ভবঘুরে।
অদ্ভুত কদাকার সেই অর্ধমানব ও অর্ধমানবী এ্ই মানচিত্রের কিছু কিছু লোককে দোষী সাব্যস্ত করছে। তাদের খবরদারি এই মানচিত্রের সবাই যেন মেনে নিতে বাধ্য। আমাকে তারা অনেক নারী গ্রহণের দ্বায়ে ইতোমধ্যে দোষী বানিয়ে ফেলেছে। আমি বোবা থাকার চেষ্টা করলাম। বেশিক্ষণ টেকা গেল না। প্রতিবাদ করলাম। এবার আমার মানচিত্রের প্রতিবেশীরা বললো তাদের সঙ্গে এমন করো না। হেন কোনো কাজ নেই যে, তারা তা করতে পারে না। তারা প্রভূ। তাদের কথা তুমি মেনে নাও। তুমি একার কারণে আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিও না। সঙ্গে সঙ্গে চিনুবা আচেবের উপন্যাসের প্লট মনে হলো। সেই সাদা চামড়ার মানুষগুলো কী না করল! পুরো একটা জাতিকে তারা সমূলে ধ্বংস করে দিল। আমার গোত্রের সবাই বলল, তুমি কি চাও, তোমার জন্য আমাদের সবার একই পরিণতি হোক? আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের বংশ রক্ষা করা আমাদের এখন একমাত্র দায়িত্ব।
প্রথমে আমি মানসিক রোগীর মতো না, না, হা, হা, এ রকম চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকি। এগুলো মানা সম্ভব না। কে যেন আমায় মনে করিয়ে দিল তুমি না কবি! তুমি তো মুখে না বলে কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ করতে পারো? আমি তাই করতে উদ্যত হলাম। খর্বাকৃত্রির সেই অতিমানবী দুজন আমাকে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিল তোমার কবিতা লেখা নিষেধ। আমি সবকিছু যেন ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আমার সবকিছু মনে পড়ছে। বেশ আনন্দ লাগছে আমার। ভয়-ড়র একেবারে নেই বললেই চলে কলিজায়। সবাই কানেমুখে ফিসফাস করছে। জানি না তারা কে কী বলতে চায়। এই বিচারলয় থেকে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে বের হতে দেওয়া হবে না। এমন ঘোষণা একটা প্রকাণ্ড লোহার মঞ্চে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দেওয়া হলো। মানুষ জ্বালিয়ে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করার পদ্ধতি তারাই জানালো আমাদেরই মানচিত্রে মানুষগুলোকে। তারা সবাই ভয়ে ভয়ে তটস্থ।
এবার যেন কবির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান আরও পরিষ্কার হলো কাজের বিবরণ দেখে। এ গোত্রের লোকদের সামনে হাজির করে একে একে। সবাই কবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। এখন কবি একা একাই নিজেকে একা মনে করছে না। কারণ তার বিরুদ্ধে যারা অবস্থান করছে, তারা এখনো ভুলের মধ্যে বুঁদ হয়ে আছে।
ঘুম থেকে জেগে বিপ্লব এসব কোনো কিছুই আর মনে করতে পারল না! ঘেমে তার শরীর একাকার। অন্ধকারে মাথার কাছে রাখা ম্যাচ খুঁজতে লাগলো সে। নাহ! আলো জ্বালানোর মতো কিছুই সে খুঁজে পাচ্ছে না!
মন্তব্য