বেলা দশটা। একঝাঁক রোদ্দুর পশ্চিমের পরিত্যক্ত জায়গায়। সে রোদের বিচ্ছুরণ এক চিলতে রান্নাঘরে। একটা ছোট জানলা তার বাহক। সেই সাদা আলোয় এক মুখ। একটু লম্বাটে, কিন্তু, ধারালো নাক, পুরুষ্টু ঠোঁট, আয়ত চোখ, মাথার মাঝখানে সিঁথে। গায়ের রং ফরসা। বাম হাতে একটা সোনার বালা। ডানহাতে কাচের চুড়ি। বেশ লম্বা মানুষ। পরনে খয়েরি জমিতে সোনালি দাগ টানা শাড়ি। কড়াই গ্যাসের ওপর। কিছু সাঁতলানোর গন্ধ। গন্ধের পরিক্রমণ। মধ্যবর্তী দরজা একটু দালান মত আর রান্নাঘরের মাঝখানে। সে দালানে এক জীর্ণ সোফা। দালানের লাগোয়া আরও দুটো ঘর। তবে বাড়িটা শহরের মাঝখানে। আর, টিনের চালা। চারদিকে উঁচু বাড়ির ঘেরাটোপে সে যেন অদৃশ্য প্রায়। ঢোকার মুখে একটা সরু গলি। একটা লম্বা, উঁচু, সিড়িঙ্গে টাইপের বাড়ির সঙ্গে। খোলা নর্দমা পাশে। বস্তি টাইপ। এখন হা হা করা ফাঁকা। বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো ইস্কুলে। বিধুশেখর, মহিলার স্বামী, অফিসে। একটা ছোট আয়নায় মুখ। আঙুলের ডগায় চুলের পাক। পর্যবেক্ষণ। এ বাড়িতে বারো বছর। মানে এক যুগ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। এই সময়। বুকের ভেতর দুটো নাম। সন্দীপন আর বিধুশেখর। সন্দীপন কেন বিধুশেখরের আগে? চোখে এক অমল দ্যুতি এই মুহূর্তে। কেন? প্রশ্ন। দুষ্টু হাসি ঠোঁটে। বুকের ভেতরে সুখ। বা! বুকের ভেতরে সুখ। বেশ কথা। তারপরের শব্দাবলী? হাতে জেল পেন, আর টেবিলের ওপর গত মাসের ক্যালেন্ডারের পাতা। কোনো আঁচড় ছাড়া উল্টোপিঠ। একটা কবিতার জন্মক্ষণ। এ সময় হাজির সেই সব বেদনা, সৃষ্টি-সুখ, আতিপাতি কোনো শব্দের খোঁজ। আর প্রেম তার যেন বহির্প্রকাশ। এই অঙ্গে অঙ্গে রূপের লাবণী, ভাবে ঢলঢল হিয়া। সর্বনাশ!
কী হল, আজও অফিস নাগা?
এই মনীশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও অবশ্য কবিতা লেখে না। গদ্যের হাত দারুণ। বললাম, চলো, তোমার তো চাকরি-বাকরি নেই। লিখে রোজগার করবে, গোঁ। একজন কবির সঙ্গে চলো আলাপ করিয়ে দিই।
তোমার বউ জানে, আজ কামাই করলে?
আমি ওসব পরোয়া করি না। কতবার তো বিনে মাইনেয় দিন গুজরান।
আমার পতিদেবটি না থাকলে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে।
বড়রা ছোটদের চিরকালই ক্ষমা করে।
তুমি আর নেহাৎ ছোটটি নেই। বিয়ে থা করেছ। বাচ্চা-কাচ্চা হয়েছে।
দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবে?
স্যরি। এক্সট্রিমলি স্যরি।
আসুন।
তুমি ওকে আপনি বলছ কেন? কালকের ছেলে।
আচ্ছা। এসো।
সেই বারান্দার সোফায় ওরা দুজন। সন্দীপন ও মনীশ। রান্নাঘরে বিচ্ছুরিত আলো। চায়ের প্রস্তুতি। তার মুখ। সে মুখ যেন কত কথা বলে নীরবে। অদ্ভুত বাঙ্ময় চোখ। মনীশের কাছে চোখের ভাষা আর প্রেম সমার্থক। কিন্তু, বুকটায় টনটন। একা যদি কোনোদিন। তেমন সুযোগ। সন্দীপন পাগল। ছেলেমানুষ। যদিও মনীশের বুক জুড়ে অহেতুক ঈর্ষা। পৃথিবীর যত নারী শব্দের অভিঘাত সৃষ্টিতে অপটু, কিন্তু, চোখের ভাষায় সরব, তারা সকলেই ওর প্রেমিকা। এখানে দরকারে ডুয়েল ফাইট। তাই। এ মহিলার সঙ্গে দুদন্ড একা থাকা। এমন মনের বাসনা।
ভায়া। উনি যে সে কবি নন। বাঁধিছ কবরী কবিতার ছাঁদে। চিনি মেশাও চায়ে কবিতার সরগমে। আদতে ওঁর সবটাই কবিতা। কিন্তু, আত্মপ্রচার বিমুখ। নেহাৎ, আমার কলেজ সঙ্গিনী। তখনও হঠাৎ উদাস যখন, শিরীষ শাখায় কাঁপে পত্রমর্মর। আগুলিয়া উড়ন্ত কেশ বা শাড়ির আঁচল, চোখে জুটে ভাষা।
রান্নাঘর থেকে, এই। বাজে বকছ কেন। কবিতার সপিণ্ডকরণ করে ছাড়বে দেখছি।
হা হা হা হা। দেখলে দেখলে এগুলো যে কবিতা নয় ছবিতা ঠিক ধরেছে।
ছবিতা!
গল্প হলো না। কিন্তু, ঘটনা হলো। নকশা। তেমন। কবিতার বাঁধা গাঁথুনি নেই। কাব্যের হেলাফেলা। তবু, কী বলো, বুঝলে…
রান্নাঘরে শব্দের ঝংকার, এলোমেলো যা খুশি তাই। গদ্যের লোককে হেঁয়ালিতে রেখে নাম কেনার ছল। এ ফাঁকিবাজি চলবে না। তবে রাস্তা দেখো।
চা না পান করে নড়ছি না। সে তুমি প্যাটন ট্যাঙ্ক দাগো। নয়, এ.কে. ফর্টি সেভেন চালাও।
চায়ের সঙ্গে আর কী চলবে?
যা তুমি ভালো বোঝ। কলেজ ক্যান্টিনের ননিদার কাছ থেকে শেখা রেসিপি, ঐ চপটার, ভুলেছ, না বিধুদা সেই বিরলতম ভাগ্যবান যিনি সেই অমৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছেন।
চা। বিস্কুট। বাজার চলতি। সোফার শেষে সে কবির অধিষ্ঠান। এবার উত্তর, তুমি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়বে। তাই বলছি না।
আমার জানতে ভারি বয়ে গেছে। তবে, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গর্বিত পুরুষ মনে করার অধিকারে এই দাবি রাখা যেতে পারে।
ওরে বাবা! লোকটা পাগল নয়। সেয়ানা। কানায় কানায় রসে পরিপূর্ণ। লেখার তো ঐ ছিরি। কী করে এই দাবি। ছিঃ! আর এই কবি মহিলাটি কেমন। বাধাবন্ধহারা উদ্দাম, কীসের টানে? রাগ বা ঈর্ষা বা দুইই। পানসে তাই চা।
ভাত খেয়ে অফিস যাবে বলে বেরিয়েছ। এখনই খাবার লোভ। ভালো না। চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই। সুগার দেখাও।
তুমি যখন ডাউন টু আর্থ, আমার ভালো লাগে না। ওগুলো বলবে আমার বউ। যে এখনও পোসেনজিৎ বলে। আর, কী করে বাংলায় অনার্স পাস করল, ভেবে আশ্চর্য হই।
যেমন করে তুমি কবি। তোমার পরের বইটা কতদূর?
প্রুফ দেখা সারা। মলাটটার ছবি হয়নি।
সে যাই হোক।
চোখের প্রতিস্থাপন মনীশের চোখে। তাই, দুরুদুরু বুক। শ্রবণ উন্মুখ কান।
বইটই করলেন? সন্দীপনের মতো? আমার মনে হয়, সত্যজিৎ ওর খোঁজ পাননি। পেলে, আর এক জটায়ুর সৃষ্টি হতো।
বোকা বোকা ভাব। বিড়ম্বিত সন্দীপন, এটা কী হচ্ছে? তুমি চপ না খাওয়াতে পারো। কিন্তু, আমার কবি চেতনা খোয়া যাক এমন শত্রু তুমি হতে পারো না।
না। না। ভাই। সন্দীপনকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছিলাম। ও হলো আমার বরের পাতানো ভাই। কিন্তু, আমার বন্ধু। প্রাণের বন্ধু। ওকে ছাড়া আমার দুদিনও চলবে না। তবে, ওর বউটা গোবেচারা। আমাকে দিদি দিদি করে। সতীনের সঙ্গে এত সোহাগ কিসের। বোকা না, তুমি বলো?
এরকম নির্লজ্জ, অকপট স্বীকারোক্তি? ছিঃ! কিন্তু মুখে, বটেই তো বটেই তো।
এ কী বলো গো আমার নাগর, এ ছানাটা কি বীরভূমে জন্ম লয়েছে বটে?
সন্দীপন হা হা হাসিতে ভেঙে, এই, ও কিন্তু এবার নার্ভাস হয়ে পড়বে।
পড়ুক। পড়লে বুঝব জন্মসুত্রে পুরুষ। আসলে কী, সে এক মস্ত হেঁয়ালি।
তুমি কি অবমানব বলতে চাইছ?
না। তেমন কই বললাম। লোকে রাধাকৃষ্ঞের বিগ্রহ করে পুজো করে আর পরকীয়া প্রেম শুনলে নাক কুঁচকোয়। কী বন্ধু ঠিক বলিনি। আমার মন চেয়েছে প্রেম করতে। করছি। একটাই পুরুষকে সারাজীবন ভালোবাসব, কিংবা সে আমার ভালোবাসার যোগ্য কিনা জানতেই পারলাম না। দেখো দিকি, তার মধ্যে দুটো বাচ্চা হয়ে গেল। ও দুটো আমার স্বামীরই দান। কোনো খাদ নেই। মাইরি। কিছুই বুঝি না। প্রেম কী আর যৌনতাই বা কী, সব কেমন গুলিয়ে যায়। গাদ্যিক বন্ধু, তোমার কী মত? যৌনতা আর প্রেম সমার্থক?
সোফা ছাড়া শরীর। কোনোদিকে যাওয়ার বাসনা। এবার স্পস্ট। কারণ, উত্তর তার স্বরে, ভাবার সময় দিলাম। ননিদা’র চপ। না দিলে নেরুদা নড়বে না।
এবং সেই আলো। সেই রান্নাঘর। সেই বাঙ্ময় চোখ। সেই শ্রুত, নীরব, শব্দসম্ভার। সেই পিকোসো কিউবিজম। বা, সুররিয়াল কোনো ছবি। আচ্ছা, বিধুশেখর মানুষটা কেমন? কাকোল্ড? ভাবতে কষ্ট। কিন্তু, সময় কম। এক বিশাল জিজ্ঞাসার উত্তর, যদি সম্ভব, যৌনতা এবং প্রেম। দুটি বাচ্চা। হলফনামা প্রায়। নিখাদ। তবে, এই মতিবিভ্রম। এত সহজ? এই প্রেম উবাচ সমস্ত সময় জুড়ে। না। হাসি ঠাট্টার ছল। পরীক্ষা এমনই। এ এক প্রাপ্তি। গল্পকারের। হয়ত এরপর সন্দীপন ব্যতিরেকে নিমন্ত্রণ, যদি উত্তরে পাসমার্ক। ভাবনার গভীরে ডুব।
ভাবনায় বিধুশেখর। ঈষৎ মোটা। বৃষস্কন্ধ। থপথপে হাঁটাচলা। ভারি মুখ। কুতকুতে চোখ। ফোলা। চোখের পাতা। এমনই। তাই কী? না! বড্ড গোলমেলে। ঐ না পরিচিতির বিভ্রমে। তার চেয়ে–মহিলার নাম, সঙ্গত, কোনো এক তৎসম চার অক্ষরের শব্দ, যেমন নীলাঞ্জনা, পারমিতা বা ঐ সব। অবাক। যখন দু অক্ষরে সাদামাটা-গীতা। তাহলে বিধুশেখর, না। বেঠিক সম্ভবত ভাবনায় যে ছবি।
ননিদা নাম। অচেনা এক ব্যক্তি। কলেজ ক্যান্টিন। ক্যান্টিন মানে এক চুম্বক। ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিন। আলুরদম। ঘুগনি। সেঁকা পাউরুটি। লাল চা। কিংবা চাফি। কফি মেশানো দুধ চা। এ প্রসঙ্গ। কারণ, ননীদা অমর তার চপে। সামনে। নড়বড়ে টেবিলের ওপর। স্টিলের ডিশে। সন্দীপন তার চোখা নাকে, আর পিটপিটে চোখে, অয়ত্নের কলপে ময়লা, কোঁকড়া, মাথায়, সঙ্গে, তার নাতি উচ্চ একহারা গড়নে, প্রমাণিত কামুক, যুক্ত অভিধা, লোভি ও পেটুক। বড় হাঁ। মুখগহ্বরে খাদ্য-বস্তু। বিশ্রি শব্দ। চা আবার। সেই সুরুৎ সুরুৎ শব্দ। অসহ্য। কিন্তু, গীতা বাঙ্ময়। গীতা এখন সন্দীপন সন্দীপন। তার কবি-কৃতিতে উচ্ছ্বাস।
চপটা অসাধারণ। একেবারে ননিদা। কলেজ জীবনের দিনযাপন। সে স্মৃতি।
নকশা!
না। বিশ্বাস রাখো। পাশ থেকে এক টুকরো, ধরো।
আমি স্নান পুজো না সেরে কিছু খাই? তুমি জানো না?
তাহলে, এতটা ব্যক্তিগত। বাবা! এই প্রেম। যা স্বামীর কাছে অধরা। তা প্রেমিকের কাছে?
উত্তর পেয়েছি।
কিসের? বেশ আগ্রহে মুখের উদ্দীপ্ত ভাব।
আপনার প্রশ্নের জবাব।
ওমা! তাই নাকি?
হ্যাঁ।
চপ কেমন?
এ ক্লাস।
সদানন্দ বোধহয় পজেসিভ। ও কিভাবে কমপেয়ার করবে, ও কি ননিদার চপ খেয়েছে?
হিংসুটে। ভারি বদ লোক। প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসর। তবে, এবার, মুখের মতো জবাব, ননিদাকে জানিনা। মমতাজ বেগম কেল্লার লোকেদের পুষ্টির জন্যে নতুন এক ধরনের খাবার বানিয়েছিলেন। তা এখন জিভে জল আনা বিরিয়ানি। খুব সম্ভবত, যদিও আমার ধারণা ওটা হবে বীর প্লাস ইয়ানি। অর্থাৎ, বীরেদের জন্যে বা বীরত্ব পাওয়ার জন্যে।
আবার পজেসিভ, বদটা, কোথায় ননিদা আর কোথায় মমতাজ।
গীতা এবার মনীশের দিকে, পড়াশুনো আছে। অবশ্য, না পড়লে কি আর লেখক হওয়া যায়। যাক, সে কথা। আমার প্রশ্নের উত্তর।
হুঁ।
ঐ প্রশ্নের উত্তর একটু বাদে জানলেও হবে। আমরা বরং গীতার সদ্যেজাত কবিতাটার পোস্ট-মর্টেম করি।
মৃতের কাটা ছেঁড়া হয়।
তার পর?
মাথার ওপর একটা ছবি। এক মৃতের। সেই সদাহাস্য মুখ। খোঁপার কাছে ডালিয়া। গলায় ঝুটো মুক্তোর মালা। আবক্ষ ছবিটার ভাষা, মৃত্যুঞ্জয় আমি। আমি সেই প্রাণ। আমার অনন্ত গান মহাশূন্যে চির অম্লান। গীতার শেষ কবিতা মনীশের হাতে। ছবির নীচে বিধুশেখর। হুইল চেয়ারে। মাঝখানে চলে গেছে কুড়ি কুড়ি বছর। দরজায় এক অন্য মুখ। গীতা দি?
নেই।
কে আছেন?
ওনার স্বামী।
অ।
নিমেষে সে মেয়েটা, থুরি, কাঁচা বয়সের মেয়েটা, অন্য দরজার অন্য পারে। হাওয়া।
কে?
আমার ছেলের বউ।
অ। এক দ্যুতিহীন হাসি। মাথার ওপর সি.এফ.এল।
বাড়িটার ধাঁচা বদল। উর্ধমুখী। কোনো প্রমোটারের সংকীর্ণ চিন্তাভাবনার বাণিজ্যিক ফসল। এখন বাইরে প্রভুত আলো। এখানে সব কটা আলোর আঁধার। সে বাড়িটার, সেই প্রাচীন বাড়িটার ভব্যতার কাছে এ এক অশ্লীল আবহ। সন্দেহাতীত ভাবে ঐ কাঁচা বয়সের বউটা। এক সার্থক সংযোজন। অবশ্যই। বা, অনাবশ্যক। কিন্তু, সকুন্ঠ, সে প্রস্তাব, চা। চিনি খান তো? কই? স্বাভাবিক ভদ্রতা। দেশের বাইরে অনেক বছর। পোশাকি ভদ্রতা নির্ভর জীবন। না ঈর্ষা। না ক্ষোভ। না উচ্চকিত কন্ঠে তর্কের প্রবণতা। সত্যজিত না ঋত্বিক। সৌমিত্র না উত্তমকুমার। জীবন সেখানে দশটা পাঁচটার। ফিরে আবাসনের ছতলায়। টিভি। দুটি প্রাণ। ক্লান্ত। রাতে একজনের মুখ চওড়া আঁধার মুখি। অন্যজনের আলোকিত শহরের ছিটেফোঁটা মাখা দেয়ালে। একই বিছানায়। ফেরার প্লেনের ডানায় স্বপ্নমাখা অতীত স্মৃতি। অবশ্যই গীতা। তার কবিতার নম্র কলকন্ঠ, অথচ ঋজু শব্দ সম্ভার। আবার জীবনের, তর্কের, নন্দন-চত্বরের, নতুন সিনেমার কয়েকটা দিন। আবার গীতার সেই বাড়িতে। সদানন্দ হয়ত, বা হয়ত নয়। প্রয়োজন এবং অপ্রয়োজনের মধ্যস্তরে, বা কোথাও নয়। এমন। বিধুশেখর, গীতা, ওদের দুই পুঁচকে ছেলেমেয়ে, অবিসংবাদিতভাবে বিধুশেখর তাদের পিতা, এরা সকলেই, মনীশ, বা, মনীশকাকু। প্রেম ও যৌনতার মধ্যের সম্পর্কের তর্ক সম্বন্ধ যদিও উদাসীন। সে সব সময়। সময় চলমান। সন্দীপন যথার্থ প্রেমিক, কিংবা গীতা। এই আলোড়ন। কদিন মাত্র। তার পর কখনও যখন বন্ধুরা বা বাহির প্রকৃতি অন্তরময় নয়, সেসময় এ বাড়ির সেই চারদিকে ইঁদুর ইঁদুর গন্ধ, আলোছায়া মাখা সে রান্নাঘর, গীতার মুখে আঁচলের রাশ, ক্যামেরা শাটারের ক্লিক–বাসা মগজে। কিন্তু, এই দীন বাসায়, জায়গার সফলতম ব্যবহার, জীবন কার্যত স্থবির। বদ্ধ। রুদ্ধ, বা, নিঃশেষ আবেগ।
লালির বিয়ে হয়েছে?
বাচ্চাটা ইস্কুল যাচ্ছে। এইবার ক্লাস ওয়ান হবে। পড়ার খুব চাপ। মেয়েটা আসতেই পারেনা।
ক্লাস ওয়ান। তার চাপ?
একটা কিছু তো বলতে হয়। তাই বলে। আসতে চায় না। আর আসবেই বা কেন।
ঘেরা বারান্দার একদিকে এক ছোট জানলা। কোন দিক? ধারণা-লব্ধ? না। সম্ভবত। কিন্তু, সেখানে ক্ষীয়মাণ দিবালোক। উঁচু-নিচু বাড়িগুলোর গায়ে গায়ে। বাতাস মৃদু। ঠাণ্ডা। ধারণা। জলদভার দূরে কোথাও।
এবার স্বগতোক্তির মতো, বিধুভূষণ, মেয়েটা আসেনা। আমি যে যাব। উঁহু অসম্ভব। ছেলে, ছেলের বউ একই ছাতের তলায়। কিন্তু, বাক্যালাপ নেই। বড় ব্যস্ত। দিনগুলো সব বদলে গেল। বড় তাড়াতাড়ি।
আপনার সেবা? আয়া টায়া কেউ নেই?
দরকার পড়ে না।
ছেলের বউ?
আয়ার কাজ পারবে না। ছেলেকে বলে দিয়েছে।
বিধুশেখর তার অতীত ও এই সময়-দু মেরুর দূরবর্তী। পুলিশ মানুষ। উর্দি ছাড়া। এস.পি সাহেবের অফিসে বড়বাবু। মাইনে, বদলির, মাস্টারমশাই। উর্দি ছাড়া। অস্ত্র ছাড়া। কিন্তু, প্রতাপ দোর্দন্ড। বহির্প্রকাশ কদাচিৎ। তাও নিজস্ব স্বার্থবাহী, ঘোরতর শত্রুর মুখেও, উঁহু। কারও বিপদে শুধু। তাছাড়া, সন্ধেয় অফিস ফেরৎ। গীতা ব্যস্ত রান্নাঘরে। জলখাবার। ছেলে মেয়েদের। ছেলেটা বড় বাপ ন্যাওটা। গায়ে গায়ে মাখা। আর প্রশ্ন অবিরাম। বিধুশেখর একটু তেলেভাজা প্রিয়। আর, মুড়ি। বড় এক কাপ চা। সিগারেটে সুখটান। সকালের না পড়া কাগজ। কোলে। ইজিচেয়ারে বিধুশেখর। চোখে ভারি চশমা। আ! বাবান দুষ্টুমি কোরো না। চশমার খাপটা কোথায় ফেললে? এই দ্যাখো। দেখছ। গীতা একে সামলাও।
এই। দিদি পড়তে বসে গেছে। তুই কখন বসবি? দাঁড়া যাচ্ছি।
শুনছ। মনীশ এসেছে।
হুঁ। যাও বাবান। পড়তে বসো। দেখছ মায়ের বন্ধু এসেছে।
কলিং বেল। বউটা দরজায়। কী হোলে চোখ। বাবান। ওরফে সুপ্রতীম।
নামটা মন্দ রাখিনি বলো।
কবির কাছ থেকে এমন নাম আশা করা বাঞ্ছনীয়।
মেয়ের নামটাও আমি রেখেছি। যাজ্ঞসেনী। যদিও মহাভারত থেকে টুকলি। ওর বাবা রেখেছিল সোনালি। কী পচা পচা নাম না? ওই যেমন আমার মা বাবা। গীতা। কী রকম না! এত চলতি।
এফিডেবিট করে চেঞ্জ করে নিন। একটা লাগসই কবি কবি নাম। রুমাণি। বা রৌম্যণী।
ওসব র জিনিস চলবেনা। তবে ভেবে দেখব। অবশ্য, বিধুভূষণ নামটারও…
খোলা দরজা। অন্য ঘরে সুপ্রতীম। দালানে গীতা ছবি।
আরে সন্দীপন দা? কাঁধে ফ্লাস্ক?
সে সব পড়ে হবে। বিধুদা মুড়ি তেলেভাজা এনেছি। তবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে। মনীশ ভাগ বসাবে।
হা হা হা হা! এক দঙ্গল হাসি।
দূরের বন্ধ ঘরে মুখোমুখি। এক নারী ও এক পুরুষ। নারীর তির্যক ভ্রূ। পুরুষের অসহায় মুখ। এমনটা বাস্তব।
বাথরুম যাওয়া হয়নি। দাঁড়ান।
সেবামগ্ন সন্দীপন। তার প্রেম। এই মহত্ব। যার জন্যে বারে বারে রোষানল। অকারণ। লজ্জাগ্রাসী মুখ। অধোবদন। কানে হুইলচেয়ারের ঘর্ঘর। বিধুভুষণের অপারগ শারীরিক এই অবস্থান। সন্দীপন কোন এক দেবদূত। তাছাড়া, এই বৃদ্ধের ছবি। বৃদ্ধ ও গীতা। যৌন সমীকরণ। বিবাহ। আদর্শ। প্রজনন। বংশবৃদ্ধি। একা বৃদ্ধ। অসহায়। সেখানে সন্দীপন। কী স্বার্থে? কিছুই না। স্বার্থ নয়। অন্য কিছু। অন্য তার অভিধা। বাবা সুপ্রতিম। বাপের কোল ন্যাওটা। চোখাচুখি পর্যন্ত নয়। এ কেমন যৌন দাসত্ব?
মুড়ি তেলেভাজা ও চায়ের সুনিপুন ভাগ। বড় পটু যেন সন্দীপন।
কবিতা চলছে?
না।
শেষ অব্দি কটা বই?
তোমার?
বাড়ি ফিরে ঘাঁটতে গিয়েছিলাম। এত ধুলো, ছেঁড়া, ইঁদুরে কাটা, পোকা ধরা। বিবর্ণ পান্ডুলিপি।
যেখানে ছিলে?
ওখানে পেটটাকেই চেনা। মস্তিষ্ক দাসত্বের। ক্রীতদাস। থাক, তুমি কবিতা লিখছনা কেন?
লিখছিনা কিন্তু লিখছি।
মানে?
সে কথা সময়ে বলব। এখন চা খাও।
বিস্ময়। বিস্ময়। জীবন যখন জীবন। ঘণ্টাখানেক। তার মধ্যে হোম ডেলিভারি। বিধুভূষণের গলা থেকে হাঁটু অবধি অ্যাপ্রন। সামনে গোল ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর ডিশে রাতের খাবার। বড় চামচ সন্দীপনের হাতে।
এটা খাবনা।
তা বললে চলবে কেন।
রোজ এই একঘেয়ে।
কী করব বলুন। আপনার রান্নাঘরটা বেদখল। আপনার নামের গ্যাসটাও রেখে দিয়েছে। নিন খেয়ে নিন। আমারও তো যেতে হবে। রাত নটা বাজল।
রাতে আজ আসবেন না?
না আজ একটা অন্য জায়গায় যাব।
এ তো আনন্দের কথা। যাবার জায়গা তৈরি হলো। বা। বা। আমি খুশি। তবে খাওয়াটা সেরে যাবেন।
না না তা কখনও নষ্ট করি।
সন্দীপন ও মনীশ এখন গঙ্গার ধারে। তার আগে সন্দীপন, বাড়ি যেতে রাত হলে অসুবিধে আছে। থাকলে অন্যদিন কিছু কথা বলব।
না। আজ শুনতে চাই।
কলকাতা শহরের আলো ওপারে।
শহরটা বোধহয় অনেক বদলেছে?
হুঁ।
তুমি ভাবতে সবকিছু একরকম আছে?
আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমোলে তো কিছু মনে থাকে না।
হুঁ। ঘুমই বটে।
জানতাম না, জীবিকার দায় কতকিছু কেড়ে নেয়।
লেখার অভ্যেস আছে?
দীর্ঘশ্বাস, নাহ্!
কী করবে ভাবছ?
ফিরে যেতে হবে।
কতদিনের জন্যে?
আরও কম করে বারো-তেরো বছর। বিজ্ঞান এত এগিয়েছে, অথচ টাইমমেশিন কল্পনাতে রয়ে গেল।
পেছনে না তাকানোই ভাল। তাতো আর ফেরে না। জীবন থেকে চলে যায়।
জীবন থেকে গতদিন শুধু স্মৃতিতে। এয়ারপোর্ট। ফ্লাইট লেট। এখন সেই রান্নাঘরের বেলা দশটা। গীতা। তার মুখ। এখন সেই বিধুভূষণ হুইল চেয়ারে। সেই কচি বউটার দরজায় মুখ। তার কাছে মৃত্যু বা জীবনের ছাপ অবোধ্য। সেই গীতার ফটো। ফ্রেমে বাঁধানো। গঙ্গার পাড়ে সদানন্দ। তার আবাস। এক চিলতে ঝুপরি। রোজ নয়। কোনো কোনো রাত। তার পলকা কাঠের চৌকি। তার ওপর বিছানা। ধুলি ধুসর। একটা হলুদ আলো। দেখোনা ব্রাদার। হুক করা। একটা জলের কুঁজো। একটা টিনের বাক্স। এইসব। অতি অকিঞ্চিত।
তাড়া নেই তো?
না না।
দেখো। বউয়ের হাতে মার খেয়োনা যেন।
সে আসেনি।
কেন?
কলকাতার জলহাওয়া ওর স্যুট করে না। তাছাড়া এখানে শুধু রাজনীতি।
তা কি তোমারও কথা?
না। তা হবে কেন। তবে, বাইরে গিয়ে এটা বুঝেছি লোকে সবার আগে পেটের ব্যবস্থা করে নেয়। এখানে হলো না। কিন্তু, গলা ফাটিয়ে গালাগাল করতে পারলে তৃপ্তি। ভোরের চায়ের দোকান থেকে রাতের বিছানা অব্দি, সেই এক জিনিস, রাজনীতি। আন-প্রোডাক্টিভ সব কিছু।
এখানে আসার জন্যে মন ছটফট করে না?
করে। কিন্তু, এ দেশ আমাকে কোল পেতে দেয়নি। পরের ঘরে ননী মাখন যাই খাই। দুদিনে অরুচি ধরে।
ভাবনায় যতি। এয়ারপোর্টের মাইকগুলো বরাবরই অস্পষ্ট। উৎকর্ণ। তবে, বিন্দু-বিসর্গের আভাস। বাকিটা অভিজ্ঞতায়। গেট নম্বর পাঁচ। মানে, আবার দোতলায়। তবে বাসে নয়। এর মধ্যেই কিউ। যেন আগে ভাগে তো, মুড়োয়। বোকা।
মানুষ জিততে চায়। সবাই।
গীতা দি?
সে তো জিততে চেয়েছিল। ধরো, সে বুঝতে পেরেছিল, বিধুদা ভালো মানুষ। কাজের লোক। সংসারী। ছেলে-মেয়ে অন্ত প্রাণ। গীতার মুখ থেকে কিছু খসাবার আগেই হাজির। গয়না, শাড়ি, গেরস্থের আসবাব। বা, কবিতার জন্ম হলে বুঝুক না বুঝুক, বলত, পড়ো।
নির্ণিমেষ চেয়ে থাকো/বাতাসহীন অরণ্য স্থির/তেমনই, কিংবা, স্থির জল-মুকুর/তুমি এত ভালোবাসো।
এ কবিতা সন্দীপনের জন্যে। অথচ, বিধুভূষণের বুকের অরণ্যে সে কবিতার শব্দ সব, কেমন? শুধু অস্ফুট বিস্ময়, বা! বা! খুব সুন্দর।
মুখে আলো কই? সে লাবন্য?
লোকটা একজন প্রকৃত কবির আইনি স্বামী। কিন্তু, তার মন উচাটন। উন্মন। সদানন্দ। প্রেমিক ও কবি। তাই সদানন্দ, আরে! বা! আমার রাতের ঘুমের বারোটা। কী অসাধারণ। না মনীশ। তার মন পাবার জন্যে। তাই নয়। প্রকৃত সে কবি। ঈর্ষা হতো এক এক সময়। কবি মাত্রেই জেলাস তুমি জানো। কারণ তার মধ্যে একটা ইন-বিল্ট জগত আছে। সেখানে তার ভাষা। তার ছবি। তার চরিত্ররা। কেউ যখন, সেখানে চ্যালেঞ্জ জানায়, দেখবে সে যতবড় লেখকই হোক, তার কত বড় কাজ রয়েছে, তবু সে ছোট হয়। মানে, একগাল হাসি, ছোটলোক হয়। আলটু ফালটু বকে। আমার ভেতরে সে রকম এক মানসিক প্রতিক্রিয়া চলতে থাকল। ভাবলাম। নাহ! নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চলতেই থাকব, যদি গীতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বজায় থাকে। তাছাড়া, একজন বিবাহিত পুরুষের কাছে, ঐরকম এক। তুমি বলো। গীতার এমন একটা আকর্ষণ আছে।
হুঁ। কৃষ্ণের গোপিনীদের মতো পরকীয়া।
সেটা কী বস্তু। পরকীয়া প্রেমের জন্যে ঈশ্বর তাদের মর্তে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু, শর্ত একটাই, তাদের বিবাহিতা হতে হবে। প্রত্যেকের স্বামী থাকবে। কিন্তু, তারা কৃষ্ণে সমর্পিত প্রাণ। তাদের কাছে বিশ্বে একজনই পুরুষ। তিনি কৃষ্ণ।
এটা জানতাম না। কী বললে, পরকীয়া?
হুঁ।
তোমার গীতাকে দেখে কি মনে হয়নি, তার জিনের মধ্যে ঐ পরকীয়া ব্যাপারটা ছিল?
হ্যাঁ। প্রথম দিনই আমার মনে হয়েছিল। আর আজকে আমার অস্বীকার করে লাভ নেই, আমি একটু জেলাস হয়ে পড়েছিলাম।
বিধুদার ওপর?
না।
আমার ওপর?
হ্যাঁ।
পাগলা ছেলে।
আমি তোমাকে লুকিয়ে আসতাম। একা মুহূর্তগুলো এনজয় করতে চাইতাম। ইন ফ্যাক্ট, আমার মনে হত, যদি তার প্রেমের কণামাত্র পাই।
কী, চলবে? সেই গঙ্গার ধার। সেই রাত। সন্দীপনের ঝোলার বাইরে। হাতে। এক পাঁইট।
আপত্তি নেই।
মদ্য পান। সঙ্গে সিগারেট। গঙ্গার হাওয়া। খানিক দূরে শশ্মান। খ্যাপা চণ্ডী চিৎকার। বল হরি হরিবোল।
শূন্যে দুহাত। সন্দীপন। খ্যাপাটে মাতাল। বাচ্চা যেন। হাঊ হাঊ কান্না। চিৎকার। বল হরি হরিবোল।
কার্পেট। গুড আফ্টারনুন। প্লিজ। বিমান সেবিকা। হাসি হাসি মুখ। তবু কাঠ কাঠ।
এফ টুয়েল্ভ। জানলার ধার। এই ছোট গোল জানলা। এর বাইরে এয়ারপোর্ট। একটু বাদে আকাশ। মেঘ। মেঘেদের ঘরবাড়ি। লিখে রোজগার? পাঠক কই? আবার গোলামির দেশে তিন চার ঘন্টার পর। ফোন। বউ। গাড়ি। এয়ারপোর্ট। পাকা ব্যবস্থা। লেখক শূন্য মন। তবে কেন কলকাতা? ভিটের টান? বাবা-মা। আত্মীয় জন। অনেকদিন পর যখন কলকাতায়, গীতা, গীতা তখন সর্বব্যাপ্ত। কতদিন পর। মনে সেই রান্নাঘর। সেই প্রথম দিন। সেই বেলা দশটার আলো। সে যে ছবি। কেন ছবি, তার উত্তর, গঙ্গার ধারে। তবে, প্রায় সারারাত, এই জীবন। মধ্য রাত, তখন, চারদিক শান্ত।
গীতার প্রেমে পড়া পাপ নয়। আমি বলছি। পাপ নয়। কিন্তু, ভাই, তুমি বীর্যহীন কাপুরুষ। পালিয়ে গেলে। দম ছিল না। বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো। হয়ত সে হাসত। এক দমকা হাওয়ার মতো। তাতে, তুমি বুঝতে, ও তোমার প্রেম কে অ্যাকসেপ্ট করেছে। তোমাকে নয়। বুঝলে ভায়া। তোমার প্রেম কে ও বুকে পুষে রাখত। কোনোদিন বার করত না।
আর তোমার সঙ্গে?
ছাড়ো আমার কথা। আমি একটা অন্যরকম। কবি কিনা। ঈর্ষার ভারে অবনত মন। ওর বাড়ি যাই। সময়ে অসময়ে। ও একের পর এক কবিতা পড়ে যায়। তখন, আমি, সাতদিনে এক ছত্রও লিখতে পারিনি। তার মধ্যে একদিন দেখাল এক কোঁচড় কবিতার পত্রিকা। তারা ওর কবিতা ছেপেছে। ও বলল, বিধুভূষণ চায় ওর একটা বই বেরোক। ওর নাম হোক। দুর ছাই! আসবইনা। এলাম না। সাতদিন। ও ফোন করল, কী ব্যাপার, তুমি কোথায় রয়েছ? শরীর টরীর ভালো তো। মিথ্যে বললাম।
সিট-বেল্ট ঘোষিকার কন্ঠস্বর। তার আগের নানাবিধ সতর্কতা। অস্ফুট প্রায় ইংরেজি। আর আধোবোল হিন্দি। এসময় ঈশ্বর। তার নাম। তার স্মরণ। ঈশ্বর অনুপস্থিত। গীতা। ছবির গীতা। বিধুভূষণ। হুইল চেয়ার। তার পায়রার খোপ ফ্ল্যাট। সেই বিকেল। সেই মরা রোদ। রানওয়ে। রান। মাটি থেকে শূন্যে। শূন্যে। শূন্যে। আরও শূন্যে যদি। গীতার সেখানে হলুদ হাত। গ্রীবায় ঘাম। সেখানে কিছু কেশ। রোদ্দুর ঘাম ও গলার ত্বক রঙ। তার নাক। তার চোখ। মেঘেদের বাড়ি। ওখানে গীতার ঘর। ওখানে কবি গীতা। চিবুক আর ঠোঁটের মাঝখানে পেন। ভাবুক দৃষ্টি। শব্দ সন্ধানী।
শব্দ কোথা থেকে যে জোটাত। অত শব্দ। মেয়েরা সবাই কবি হয় না। কারণ, তাদের মনে জোয়ার কম। ছোট ছোট বাসায়, ট্র্যাডিশনের জাঁতাকলে এক এক সংসার। সেখানে কখনও আকাশ ভারী হয়ে আলো ফুরোয়। কখনও একচিলতে রোদ দাওয়ার এক কোনে। আর যে মেয়ে কবি, সে তার বুকের গভীরে গড়ে নেয় মাঠ। টিয়া সামখোল। পলাশের বন। তবু তাকে নাগরিক মননে ঢেলে সে এক এক কবিতা বটে। কোন এক দুপুরে দেখা নির্জন পুকুর। কোনো এক রাত্রির মেঘ। ঝড়ে লুটোপুটি হাওয়া। কোনো এক সন্ধ্যার হলুদ ডুমের আলো। কোনো রাত্রির শূন্য মন। বিছানা। স্বামী। সন্তান। তখন বন্ধ হওয়া জুটমিলের হা হা করা আকুতি। কী যে হয়। তারা সব কবিতার উল। কবির বুনন নৈপুন্যে এক এক কবিতা।
তুমি বললে কবিতা ভুলেছ। এই তো কবিতা।
ভায়া। জড় সন্ধানী হয়েছ। তাই। এইগূলোয় কবিতা দেখছ। ঠিক আছে। তবে এরা কবিতার শব। আর কোনোদিন কবিতা হবে না।
কেন? গীতা কি তোমার জানা শেষ কবি?
আমি মৃত। তুমি জানো মৃত্যু মানে অন্ধকার নয়।
তবে কি ডিভাইন লাইট?
না, আলো নয়। আলো নয়। অন্ধকার নয়।
তবে মৃত্যু কী?
আলোহীন অন্ধকারহীন লুপ্ত-চৈতন্য।
পাঁইটটা প্রায় শেষ। তবে শেষহীন রাত যেন।
বোতলটা উপুড় করলে, না অমৃত। না বিষ। দাঁড়াও ভায়া।
কাঁধে হাত। একটু বেতাল। তবু টলমল খানিক। তার পর ঋজু। চটির ফটর ফটর।
সন্দীপন দা। প্লিজ।
ভয় নেই ভায়া। নট টু ফিয়ার। আসছি।
গঙ্গা। নিস্তরঙ্গ। কলকাতার আলোকবাতি মূহ্যমান। বিদ্যাসাগর সেতু আলো ঝলমল। সারারাত। এ এক এক্সপেরিয়েন্স। কিন্তু, সারারাত। এই যে সময়। ফাজিল আবহ। আবার মদ। আবার আসক্ত কামনার বীজ। সন্দীপন একা। একা এক কবি। স্ত্রী পুত্র পরিবার তাদের কথা। এখনো না। শুধু অন্তর ও বাহির গীতাময়। গীতা আচ্ছন্ন।
তার পর কী ঘটল?
কিছু ঘটেনি। কিছু না।
মানে?
রাত এখনও অনেক বাকি। চালাও না। তারপর দেখা যাক।
অন্তঃপুরে মদ। সে খানিক গেরিলা যুদ্ধের নায়ক। একা তার অধিষ্ঠান। সব শব্দ। তারা বাহিরে। পরাজিত। ধ্বস্ত। বিধ্বস্ত।
কবিতা আসেনা। কিন্তু, গীতার দুচোখ। ওর মুখের ওপর আলোছায়া। ওর ভরাট। সুন্দর। কণ্ঠস্বর। ওর গায়ের গন্ধ। হাতের পেছন দিয়ে আড়াল করা ঢেকুর। আঙুল দিয়ে চুলের লতি পাকাতে পাকাতে স্থির চোখ। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস। তখন এল প্রেম। তার হৃদয় উজাড় করা সর্বস্ব শক্তি নিয়ে। শরীর নয়। মন নয়। গান নয়। কবিতা নয়। জান্তব আচার বা পাশবিকতা নয়। এ এক কী যে। জানি না। জানি না। না!
মেঘের রাজত্বে এই সাদা রাজহাঁস। তার বিশাল ডানা। সে যেন স্থির।
বিবাহিত জীবনটা একটা ডোবার মত। কাপড় কাচা। বাসন মাজা যায়। দু একটা ডুবও হয়ত বা। কিন্তু সে জলে প্রমোদতরী ভাসে না। আর যে একবার সেই প্রমোদতরী যাত্রী তার কাছে গোটা বিশ্ব যেন বদলে যায়। একটা মরকুটে গাছ। তার গোড়ায় পানের পিক ফেলতে দ্বিধা নেই। সে কেমন যেন প্রাণময়। সেদিন জর্দা শুদ্ধ গিলে ফেলা পিক। তার পাতায়। তার শাখায়। সমস্তের মধ্যে এক চৈতন্য। তোমার অবচেতনে। এক টুকরো রোদ। গলির ভেতর তার যেন কত মায়া। এমন কি ঘেয়ো কুকুরটা গলি জুড়ে শুয়ে থাকে তার চোখে আকাশ। আকাশের রঙ। সে যেন কতকালের এক স্থবির দার্শনিক। পাতার পর পাতা জুড়ে শব্দের উল্লাস। বিধুদা অফিস থেকে ফিরে দেখে তার লুঙ্গি ফতুয়া পাট করে রাখা। কাচা। সাফ। কাচের গ্লাসে জল। টলটল। একটু বাদে চা। মুড়ি। তেলেভাজা। তাতে জিরে জিরে করে কাটা কাঁচালঙ্কা। একটা বোন চায়নার ডিশে এক কোয়ার্টার পেঁয়াজ। আর এদিকে, বউ শাড়িওলি মাসির কাছ থেকে একটা দামি শাড়ি এনে রেখেছে। ভয়ে ভয়ে দেখিয়ে। এটা নেব বলিনি। অনেক দাম তো। দুর! দাম। নাও। ইউ আর মাই সুইট হার্ট। কিন্তু, বিছানায় তার সেই হঠাৎ পাওয়া শাড়ির আবেগ। তার কী গতি? না। আজ না। শরীরটা কী রকম ম্যাজ ম্যাজ করছে। আসলে তখন আমার চলা ফেরা। হাঁটা। বসে থাকা। আমার ঘুম। আমার ছোটাছুটি। স্নান। আমার সমস্ত সে। গীতা। বউ ঘুমিয়ে পড়ল পাশ ফিরে। আমার জেগে থাকা চোখে কড়িকাঠ। সেখানেও গীতার গন্ধ। ওর হাসি লুটোপুটি। ওর কবিতার শব্দ। আমি একা নয়। ঘর সংসার। তৈজসপত্র। এই একানে রান্নার ঘর। বাহিরের আকাশ। সেই সমগ্র আমার সবের ভেতর। আমি একা নয়। একা নয়। বলে গেল প্রেম। চারুহাসি রেখে যাব। দুদণ্ডের মায়া। চিরন্তন বুঝি। আর একা নয়। তুমি ঘুমাও। তোমার রোমকুপে রোমকুপে আলস্য শৃঙ্গার। না! বড্ড ইমোশনাল। ওর কবিতার খাতা সাদা পাতা। আমার সব কুটি কুটি লেখা। শুধু সকালের অপেক্ষা।
সময় কম। একটু বাদেই স্যান্তাক্রুজ বিমান বন্দর। আবার সিট বেল্ট। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান মুম্বাই নগরী। এখন এক অদ্ভুত স্থির শান্ত আবহ। মৃত্যু ও জীবনের বাজি। এক অসম্ভব প্রতিজ্ঞার জের। শূন্যের এই সকল জীবন। তারা সকলে নিরাপদ। এমন চাকরি। মাটির অঙ্গ পরশ। মাটি জীবনের সুঘ্রাণ। মাটি অনন্ত নয়। তবু। মাটি। মাটি। মাটি। আর আকাশ আকাশ আকাশ। বনস্পতি। জীবকুল। মানুষ। ছবি। আর এক ছবি।
গঙ্গার তীর। নিমগ্ন রাত্রি। ঝোড়ো বাতাস। বাতাসে মদের গন্ধ। অপার যেন জল। ঐ জলে প্রমোদতরী।
বুঝলে ভায়া। যে প্রেমে পড়েনি। প্রেম মানে ওই ফুলটুসির সঙ্গে ফুচকা। কদিন এদিক ওদিক। ছুঁকছুঁক। তারপর হয় ফ্যাঁচ ফ্যাচ। ধুস! শালা। ওটা প্রেম। না। যৌবনের কাল সমাগত। বারান্দায় বিকেলের রোদ। রাস্তার গলিতে ফেরে সন্ধ্যা। বাতি জ্বলে। একটা হাওয়ার ঝোঁকা। খূলে গেল আলগোছে করা খোঁপা। তোমাকে চাই। কে তুমি? এবার সে প্রশ্ন বুঝি শত সহস্র কাল। তুমি আর আমি। এই একা। এই এক হয়ে যাওয়া।
প্লিজ! ওঃ স্যরি। আনমনা। ভাব বিভোর। অথচ, এখানে জগৎ গদ্যের দাস। কাল। আগামিকাল। বেলা দশটা। পাঞ্চিং। মি. মনীশ। নাউ। প্লিজ। টেক অ্যা ব্রেক। নট ফাইন। গেট রেস্ট। গো। ছিঃ!
সুতপা। স্নানগ্লাস। হাওয়ায় ওড়না। বেশ ভালো প্রিন্ট। চুড়িদার ও কামিজ। কাঁধে ব্যাগ। ঘড়িতে চোখ। ফোনে ঠোঁট। অ্যাই। কোথায় তুমি?
কোথায় তুমি? না মেঘলোকে। না মাটির শীতল আস্তরণে। তুমি আসলে আমার বুকের ভেতর। তুমি আমার অন্তরে। তুমি সর্বলোকে। তুমি আমার। হু হু হু কান্না। বুঝলে ভায়া। সেদিন মন জুড়ে কী আনন্দ। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি কেটেছি। নিউ মার্কেটে ঢুকে পড়েছি। বউয়ের অনেকদিনের শখ ক্রকারি। বোন চায়নার। সামান্য কেরানি। তবু ইচ্ছে। মনে হলো বিধুদাকে যেমন ও যত্ন করে, তেমন করেই আমার বউয়ের শখ মেটাব। দরকার পড়লে রাতটা…
ঘর। কিংবা, বাসা। এই নোংরা শহরটার। একটা শ্রী হীন অ-সম্পদ। একটা সিলিং ফ্যান। একটা শরীর। একটা জীবনহীন শরীর। আলো আঁধারি। একটা তীব্র, বিশ্রী, গোঙানি। এরপর সাত বছর। ঘেরা বাসস্থান। চারদিকে শুধু হতাশ জীবন। এক মল্লভূমি। লড়াইতে মন ও মনন বনাম পশুত্ব। এরপর মুক্তির আবেগ। এরপর এক নিখিল ভুবন। গেটের দরজায় বিধুদা। গায়ে আলোয়ান। পাঞ্জাবি। পরিধানে ধুতি। সময় গোধূলি।
গীতা। গীতা বৌদি?
এক চিলতে হাসি। নিরুত্তর। গাড়ি। কালো। অ্যামব্যাসাডার।
গাড়ি। এসি। সামনে। খোলা দরজা। লাগেজ।
প্লিজ।
হুঁ।
জানো তোমার নামে ডাকে একটা চিঠি এসেছে। আমি খুলে দেখেছি।
কে দিয়েছে?
কে আবার। তোমার আবার গল্প লেখার বাতিক কবে থেকে হলো।
কী লিখেছে?
কী আবার? গল্পটা ফেরৎ দিয়েছে। ছাপতে চায়নি।
তুমি খুশি।
ডুবে ডুবে জল খাওয়া বন্ধ করো বুঝলে?
মানে?
মানে, তুমি ভালো করে বোঝো। আর ওসব ট্র্যাশ লিখো না।
গল্পটা ট্র্যাশ? তুমি সাহিত্যের কী বোঝো?
কিন্তু, গীতা, মনীশ আর সন্দীপন, বিধুভুষণ, এরা কারা?
জানি না।
তোমার চেনা কেউ নয়?
না।
তোমার কি ফিল্ম ইন্ড্রাস্টির নেশা পেয়েছে।
কেন?
না। হঠাৎ করে গল্প লিখলে।
আগে একটু আধটু লিখতাম।
তা এখন?
সেদিন তুমি ছিলে না। আমার জ্বর জ্বর মতো লাগছিল। তুমি বললে, তবে বেরিয়ো না থাকো। ওই দশতলার বারান্দায় বসে আরব সাগরের হাওয়ায়, হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলাম। ফিরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে গল্পটা শেষ করলাম। পরদিন নিজেই ডাকে পাঠিয়ে দিলাম।
গীতার ছবি। একটা তাজা রজনীগন্ধার মালা। কী সুখি মুখ। খোঁপায় জুঁইয়ের মালা। তার গন্ধ। রজনীগন্ধার হার। জয়ী জুঁই। সে? মৃত? না। সে জীবন।
আ! কেয়া ড্রাইভ করতে হ্যাঁয়। জান চলা জাতা।
আবার ব্রেক।
সুতপা কেন এ গল্পে?
নিরুত্তর মনীশ।
মন্তব্য