এক.
ইয়েসিন নামে সতেরো আঠারো বছর বয়সী এক কিশোর রূপোসনগরের প্রান্তিক শহর দুর্বাপাড়ার মসজিদে বছর খানেকেরও কম হলো খাদেমের সঙ্গে থাকছে। দরিয়ানগরের সাগরবর্তী গ্রাম ধনুকার নিসর্গে বেড়ে ওঠা এই কিশোর এককথায় মাঠের রাজা। গায়ে শক্তি ধরে খুব। শহুরে ছেলেরা যখন খেলার মাঠে ঘামঝরিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ইয়েসিনের শরীরে তখনো মাইল দশেক হাঁটার শক্তি কেবলই বেরোনোর পথ খোঁজে, দেখেছে সবাই। আরও একটি গুণ আছে তার। ভালো গান করতে পারে। রূপোসনগরে এসেই সে রোজার মাস পেয়েছিল আর মাঝরাতে সেহরির সময় মাইকে গজল গেয়ে জয় করেছিল অনেক পুণ্যার্থীর মন। শ্রোতারা কেউ কেউ বলত, ইয়েসিনের গলাটা শুনতে তেমন ভালো নয়। কিন্তু সুরের ওঠানামার ওপর দখল তার অসাধারণ। প্রিয় গজল মদিনার বুলবুল নবী রাসুল-আল্লা ছিল মাঝরাতের সবচেয়ে বড় হৃদয়জয়ী গীতমন্ত্র। ওর ওই গজলের যারা ভক্ত-শ্রোতা ছিল, তাদেরই কেউ একজন কোনো একদিন বললো, রাসুল-আল্লাহর শেষ লা-এ এসে এমন রহস্যময় এক টান ওর কণ্ঠে আসে, তা শুনলে তার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়।
পরকালের নিদান নিয়ে লেখা মোটা এক বই বুকে করে ঘোরা খাদেম কেফায়েত প্রথম দিন লোকের কাছে পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিল, আমার বোনের ছেলে, ইয়েসিন নাম। ভালো ছেলে। ভাগ্নেকে সরিয়ে দিয়ে গলা নামিয়ে বলেছিল, হাফেজি লাইনে ছিল কিন্তু এখন নাই। মাদ্রাসা থেকে পালিয়েছে দানে দানে তিন দান—মুসলমানের এক জবান। শেষে মাদ্রাসাই ইবলিশ তাড়িয়েছে। সঙ্গে আরও একটাকে; এর সাগরেদ। কে রাখবে এসব বিষপিঁপড়া? কেউ রাখে না বলেই শেষমেশ আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। কাছে থেকে ধর্মকর্ম শিখছে, শিখুক। নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিতে পারলে আপজল। ঢুকতে বেরোতে দুটো পথই খোলা।
কোনো কোনোদিন মোয়াজ্জেন হুজুর আজান দিতে না পারলে তার হয়ে ইয়েসিনই দাঁড়িয়ে যায়। ইমাম দাঁড়ানোর খুপরির পাশে তাকের ওপর রাখা কালো বাকসের সামনে গিয়ে ছোট মাইক্রোফোনটা হাতে তুলে দু’বার ফু দিয়ে সতর্ক করে তোলে পাড়া। এরপর বাতাসে তরঙ্গিত হয় মরুভূমির সুর। গলার ওঠানামায় ইয়েসিনের দখল ছিল বলে আজানটা হতো মুয়াজ্জিনের সাধারণ হর-লবের আজান থেকে ভিন্নরকম। কোনো কোনো লোকে বলতো, মোয়াজ্জেনের চেয়েও যেন ভালো।
আজান ব্যর্থ করে দিয়ে নামাজের ধার না-ধারা দস্যি ছেলেরা ব্যাট-স্ট্যাম্পের ঠোকাঠুকিতে ইয়েসিনকে মেঝেতে পাতা মাদুরের ওপর অস্থির করে তোলে। অল্প আলোয় ঝুঁকে পরলোকের কথা পড়তে থাকা খাদেম তার অস্থিরতা টের পেয়ে অপাঙ্গে তাকিয়ে বলে, আল্লাহ তুই দ্যাখ, তার মন পড়ে আছে কোথায়। যেটা পড়িস, তাকে আর নামাজ বলে না, বলে পশ্চিমে কপাল ঠোকা। ওই ঠোকাটা ঠোকা হলে এরপর যাও, আগেই না ধড়ফড়াও।
মসজিদের দোতলায় খাদেমের ঘরের জানালার কাছে দাঁড়ালে রাস্তার নিচটা দেখা যায়। ইয়েসিন গলা বাড়িয়ে দেখতে চায় দলের লোকেরা কোথায়। তার কালো মাথাটা চিলেকোঠার জানালায় দেখা দিলেই ছেলেদের উদ্দেশ্যপূরণ। খেলায় দুই দলের কোনটির পক্ষ হয়ে সে খেলবে তা নিয়ে অম্ল-কটূ তর্ক সেখান থেকেই শুরু হয়ে অলিগলি পেরিয়ে তুরাগ নদের পারে বিরাট বালুমাঠ পর্যন্ত গড়ায়।
মসজিদের পাশেই ছিল টিনের চালার একতলা বাড়ি। বাড়ির মালিক কিরমান। দুই গালে সাদা চাপদাড়ি, সুরমা দেওয়া চোখ। লোকটা ভীষণ গৌরববিলাসী। কিসে তার গৌরব ছিল না সেটাই খুঁজে বের করা শক্ত। তার বাড়ি মসজিদ লাগোয়া- এও এক গৌরবের কারণ। বড় ছেলেটি দার্জিলিঙে কোথায় যেন পড়ে, গৌরব না করে উপায় কী! একমাত্র মেয়ের বয়স মাত্র ষোলো কি সতেরো আর এখনই বিয়ের প্রস্তাবের পর প্রস্তাব ফেরাতে তাকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। না না, পর্দাপুশিদাপ্রিয় মেয়েটিকে তার কেউ দেখেনি, তবে কিরমানের বংশকথা কারই বা অজানা। অশীতিপর বাবার সেবাযত্ন করার সুযোগ খোদা তাকে দিয়েছে এও এক বিরল গৌরব। এতো বছর এ এলাকায় বাস, তার পত্নীর কণ্ঠও কেউ শুনেছে কি না—এই প্রশ্নেও গৌরবের পাত্র উপুড় হয়। শেষ নয়। পেছনের উঠোনে হিমসাগর আমের গাছটা তার মুকুল ছাড়ে এলাকার বাকি সব গাছের আগে। নদের ওপারের এক বিয়ের কনে এসে ওর বাগানের ঘৃতকুমারী পরশুদিন চেয়ে নিয়ে গেল; আসা যাওয়ার পথে কে দেখে নাকি তাকে বলেছে। যা-তা ব্যাপার। খাসি করা মোরগটা টিনের চালায় নৈশযুদ্ধে শ্বাপদ বেড়ালের একটা চোখ উপড়ে তবেই মরল। তার পোষা পাখিও বীরত্বে কম যায় না। আরশোলায় ভরা তার রসুইঘর। কেন হবে না? ঘরময় এত খাবার। মানুষই লগ ছাড়ে না, সেখানে সামান্য আরশোলায় আর ভুরু তোলা কেন।
কিরমানের গৌরব বাড়ে শ্যালকের নতুন কেনা জমিতে। গৌরব বাড়ে পত্নীর সখের সোনালি মাছে, ভায়রার ইরানি গালিচায়। বাড়ে শ্বশুরের রাদো ঘড়িতে, ভাতিজার বেলজিয়ান আয়নায়। এমন অনিঃশেষ বিষয়ের অনন্ত ধারা কষে কষে গণিতে ক্রমশ দক্ষ হয়ে ওঠে তার বন্ধুস্থানীয় জামাল, ফয়েজ, আজগর, পটল, হালদার আর মুৎসুদ্দি। ওদের কাছ থেকে বাড়ির লোকেরা জানতে পারে, কিরমানের গৌরব অনেক আকাশ ফুঁড়ে, বাতাসে উড়ে, দক্ষিণ সুরবঙ্গের একরত্তি উর্বর কালো মাটির মালিকানায় গিয়ে ঠেকেছে। ঠেকেও কাবু নয়। মাটি ফুঁড়ে সে ঢুকে যেতে চায় আরো সাড়ে তিন হাত। বলে, বুঝলে ভায়া, কবরের মাটিও আমার ঠিক করা আছে। কেবল জান্নাত নসিব করা আল্লার মর্জি। পত্নী যখন বলে, তোমার মতো ভালো মানুষ আর কে আছে, তখন ভয় পেয়ে যাই। আবার বুকে সাহসও পাই। আল্লা মালিক।
বাড়ির দরজার দুপাশে বসার জন্য মুখোমুখি দুটো টানা হেলান-আসন আছে সিমেন্টবালুতে গড়া, গ্রামে লোকের পুকুরঘাটে যেমন থাকে। এক হেলানের ওপর এসে পড়েছে একটা ঝুপড়ো জবাগুল্ম, অন্যটার ওপর পড়েছে কালচে সবুজ নিসিন্দা। নিসিন্দার দিকটায় বসে জবার দিকে তাকিয়ে কিরমান বিনত মুখে তার বিবিধ সৌভাগ্যের কথা বলে যায়।
কেউ বলে, আর সবার কাছে যাও, শুধু দুঃখের কথা বলবে। কেবল এই এক কিরমান ভাই আছেন, কাছে এলে শুধু সুখের পরশ পাওয়া যায়। ভালোই লাগে, কী বলো।
জবাবে অন্য কেউ বলে, সুখের পরশ না মাথা-মুণ্ডু। সারাক্ষণ নিজের বিজ্ঞাপন করে বেড়ায়। দুই মিনিটের বেশি তিন মিনিট কথা বলা দায়।
একদিন কিরমান হেলানে শরীর এলিয়ে হাসতে হাসতে পাড়ার সমবয়সী জামালকে বললো, এ পাড়ার ওপর মায়া পড়ে গেছে যদিও, তবু কী করব বলো, না গিয়ে তো উপায় নেই। ফ্ল্যাট যে কিনে ফেলেছি। মাস তিনেকের ভেতর ওরা হাতে তুলে দেবে। সামনে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। ছেলেকেও একটা সাংসারিক গদিতে তুলে দেওয়ার ব্যাপার আছে। আছে না? শালা বাবু চাকরি নিয়েছে দরিয়ানগর, কাল পরশু চলে যাবে। অতো বড় বাড়িতে আমাদের একা থাকতে হবে, ভাবতেও ভয় লাগছে বিশ্বাস করো। তবু কী করব, খোদার ইচ্ছা। বলতে-বলতে জামালের ঈষৎ ঈর্ষান্বিত চোখের সামনে কিরমানের মুখচোখ ঝলমল করতে থাকে।
ওদিকে পশ্চিমে কপাল ঠোকা শেষে ইয়েসিন রাস্তায় নেমে এসে শুনতে পেল বড় এক দুঃসংবাদ। তুরাগ পারের যে অংশে তারা খেলত, কারা যেন ওই অংশ কিনে নিয়েছে, ওদের খেলতে দেবে না। গতকালই এসে বলে গেছে।
আমি জানলাম না কেন? বলল ইয়েসিন।
তুমি তো কাল অন্য জায়গায় খেলতে গেলে হায়ারে। বলল একজন।
অপর একজন বলল, কত দিলো রে? নাকি লিটার বাজি।
ইয়েসিন বলল, তাহলে আরেকটা মাঠ লাগবে আমাদের। বিকল্প।
কই পাব। আশপাশের সবগুলোতেই অন্য-অন্য পাড়ার ছেলেরা খেলে। বরাবর আমাদের কপালেই ঠুয়া।
আচ্ছা, আগে তো যাই। চলো। দরকার হলে আমরা নতুন জায়গায় ঝোপ কেটে পিচ বানাব, ঠেকায় কে।
এসব কথা যখন চলে, কিরমানের সামনের ঘরের পর্দাটা তখন নড়ে থেকে থেকে। ভেতর থেকে উঁকি দিতে চায় একটা কালো চোখ। কালো ওড়নার পার পেরিয়ে আসা মসৃণ চুলের গোছা বৈকালি হাওয়ায় এক দুই দোল দিয়ে উধাও হয়ে যায়। তার আগেই বিকেলের আলো পড়ে ঝিকিয়ে ওঠে ঢেউ। ইয়েসিনের চোখের মণিজোড়া ছিল বেড়ালের মতো ঘোলাটে। দৃষ্টি শিকারিতুল্য। মামার সঙ্গে থেকে থেকে অপাঙ্গে তাকানোটাও বেশ রপ্ত করে নিয়েছে। সেই বিদ্যা কাজে লাগল। ঠোঁটে খেলে উঠল চাঁদ, কণ্ঠের জোর গেল বেড়ে। আরো উচ্চকণ্ঠে সে নতুন মাঠের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করল ছেলেদের। আপসকামী কণ্ঠটা এবার আপসহীন হয়ে উঠল। প্রয়োজনে তাদের অধিকৃত খেলার মাঠের উড়ে এসে জুড়ে বসা মালিকের সঙ্গে সে ‘বৈঠকে বসতে’ রাজি।
হঠাৎ কিরমানের বাড়ির ভেতরে কোনো চাপা ধমকের স্বরে পর্দার নড়চড় থেমে গেল। ইয়েসিনের উচ্চকিত কণ্ঠটিকে কেউ আকশি দিয়ে টেনে নিচে নামিয়ে আনল তখন। আর দেরি না করে মাঠে যাওয়ার উৎসাহ-বাণীতে কথা বাগিয়ে দলটিকেও এগিয়ে নিলো দূরে নদের পথে। মসজিদের নিচ, পাড়ার রাস্তা ক্রমে শান্ত হয়ে এলো।
সেই দিনটা গেল মাঠ নির্বাচনে। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত ছেলেদের দল সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলো। নিরক্ষরেখার বৈকালিক সূর্যটা অস্তায়মান বটে কিন্তু কম তাতায়নি। ক্লান্ত ছেলের দল তাই নিজেদের লেনে ফিরে এসে পেটের জামা তুলে ভেতরে হাওয়া খেলাতে থাকল। ইয়েসিন বড় হয়েছে গ্রামে। প্রতিক্রিয়া প্রকাশের একটা বড় অংশে অকপট। সহজেই ঊর্ধ্বাঙ্গের পরিধেয় খুলে তার একপ্রান্তে ধরে মাছি তাড়ানোর মতো বাতাস খেলিয়ে ঘাম শুকিয়ে নিতে সে পারে, ভব্যতায় বাধে না। এলাকার ছেলেদের কেউ এখনও তার মতো করে উদোম হওয়াটা রপ্ত করতে পারেনি। কিন্তু প্রায় সবার চোখে একটা নীরব সমর্থন দেখতে পাওয়া যায়।
পাড়ায় ফেরার পর পশ্চিমে একবার তাকিয়েই কেউ একজন সন্ধ্যার-কিল শুরু করে দিলো। মুঠো পাকিয়ে ধাঁ ধাঁ করে বসাতে থাকল একে অন্যের পিঠে। হাসতে হাসতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে থাকল কারও বাড়ির ঘেরাও-দেয়াল থেকে বিদ্যুতের থামে কি পাকা রাস্তায়? উচ্ছ্বসিত ইয়েসিন। নগরে বেড়ে ওঠা ছেলেদের তরুণাস্থির মতো হাড়গোড়ের বিপরীতে ইয়েসিনের হাড় রীতিমত জীবাশ্মতুল্য। তার সন্ধ্যার কিল যে খেয়েছে সে দুর্ভাগাকে পথে বসে পড়তে হয়েছে। তবু প্রতি সন্ধ্যায় নিজেদের লেনে ফিরে ঘরে ঢুকে পড়ার প্রাক্কালে ছেলেরা ঝুঁকিটা নেবেই। কারণ কিলপর্ব শুরু হলেই ইয়াসিন দারুণ সব ঘটনার জন্ম দিতে থাকে। প্রথমে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে; জায়গাটা হয়ত বিন্দুবাসিনীদের কপাটখোলা জানালার শিক, ওখানে হয় বাঁদরঝোলা; নয়ত পাঁচকন্যাদের কুখ্যাত যে বরইগাছ আছে, তার ডালে উঠে হয় মিশকালো জ্বিন। সময় বুঝে অন্তর্ধান, আবার সময় মেপে আত্মপ্রকাশ। এরপরএরএর মুঠো পাকিয়ে গুড়ুম। তার চোখ ভূতের মতো ঠিকরে বেরিয়ে আসে। আগে-পরের এটুকুই কিশোরদের কাছে সন্ধ্যার কিলপর্বের শ্রেষ্ঠ সময়। দৃশ্যের পর দৃশ্য, কৌতুককর-রকম নান্দনিক। কেউ বঞ্চিত হতে চায় না।
সেদিন শেষ বিকেলের আলো ইয়েসিনের বুকে পিঠে। ওদের সবার শরীর কৈশোরের দড়িখেলা দেখাতে দেখাতে ক্রমশ তারুণ্যের পথে পেশল হয়ে উঠছিল। এরপরও সবার তুলনায় ইয়েসিনের শরীর ছিল আলাদা, ছেনি কুঁদে গড়া কাঠের দেবসৌষ্ঠব। পিঠ বাঁচানোর কপট সতর্কতায় হাসতে হাসতে এক দৌড়ে মসজিদের কাছে চলে এসেছিল ইয়েসিন। আর তখনই পর্দাটা আবার নড়ে উঠল। বুঝতে পেরে মুহূর্তে বুক চিতিয়ে পুবদিকে ফিরে দাঁড়াল ঝিকিয়ে ওঠা শ্যামল দেহের ওই কিশোর। পর্দার ফাঁক বন্ধ হলো না। পরমুহূর্তে পুবে ঘামঝিকমিকে পিঠ ফিরিয়ে বন্ধুদের ডাকতে থাকল ইয়েসিন আমুদে কণ্ঠে, ওই ওই! কই? আসো!
আবিষ্ট সময় খুব দ্রুত কেটে যায়। ইয়েসিন আড়চোখে তাকায় কিরমানের জানালায়। পর্দার ফাঁক বন্ধ হয়ে গেছে।
দুই.
এরপর ক’দিন যাবত ইয়েসিন রাত নামলেই মসজিদের ছাদে উঠে প’ড়ে পশ্চিম কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতে লাগল। সেখান থেকে নিচে তাকালেই ছিল মসজিদলাগোয়া কিরমানের টিনের চালার বাড়ি। এই চালার নিচেই কোথাও চুল আঁচড়ে চোখে কাজল পরছে সেই মেয়ে। হয়ত ফিকহ বইয়ের আড়ালে কোনো প্রেমের উপন্যাসের পাতা উল্টে এইমাত্র চোখ মুখে নিল। মনে আর কোনো রাজকুমারের কথা, যে রাজকুমার একাধারে ঠগ, লম্পট, হৃদয়হীন। কোনোভাবে যদি আজ রাতেই ইয়েসিন নিজ শ্রেষ্ঠত্বটুকু বুঝিয়ে দিতে পারত!
হঠাৎ পেছনে শব্দ পেয়ে চমকে তাকিয়ে ইয়েসিন বিচিত্র এক দৃশ্য দেখতে পেল। ছাদে জমা চটের টানা মাদুরের স্তূপ থেকে একটা মাদুর নামিয়ে এনে ঢালাইয়ের ওপর একজন শোবার মতো করে বিছানা পাততে লেগেছে।
কে তুমি? পায়ে পায়ে তার কাছে গিয়ে জানতে চাইল ইয়েসিন।
আমি আরিফ। তোমাকে আমি চিনি। তোমার নাম ইয়েসিন। খুব ভালো ব্যাট করো।
ইয়েসিন আধো আলোয় ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। হ্যাঁ, একে যেন দেখেছে কোথাও আগে।
তুমি এখানে শুচ্ছো কেন। বাসায় কেন যাও না।
আমি এখানে একটু শোবো ভাই ইয়েসিন। তুমি কিছু মনে করো না। আর কাউকে বলোও না, প্লিজ। আমি জানি তুমি বলবে না। আজ রাতটা এখানে থাকব আমি, কেমন?
কেন? বাসায় কি হয়েছে। চুরি করেছ?
চুরি করব কেন? শোনো, তোমাকে এটুকু আপাতত বলি, বাসার পরিবেশ খুব খারাপ। ওখানে থাকলে হয় আমি পাগল হয়ে যাব, নয় আমাকে ওরা নিশ্চিত মেরে ফেলবে। তুমি কাউকে বলো না যেন, হ্যাঁ?
ইয়েসিন কিছু না বলে ঘুরে দাঁড়ায়। খানিক বাদে আরিফ ছেলেটার শুকনোমতন বাবা ভেজা চোখে মসজিদের খাদেমের ঘরে আসে। মুখটা কাঁদো কাঁদো। বলে, আমার ছেলেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। মসজিদের মাইকে কি এটা একবার বলা যায়? একবার বলা যায় ভাই? কেউ যদি খোঁজ পায়, কেউ যদি দ্যাখে?
সম্মত হয়ে লোকটার কাছ থেকে বৃত্তান্ত শুনছে খাদেম। পাশ ফিরে দাঁড়ানো ইয়েসিন ভীষণ দোটানায় পড়ে। একবার তার মামার দিকে তাকায়, আরেকবার ওই লোকের দিকে। এই লোকটিকেও সে দেখেছে আগে। কোথায় দেখেছে তা ওই মুহূর্তে মনে করতে পারে না। তার আর্দ্র চোখজোড়া ইয়েসিনের মনকে আলোড়িত করে। খুব ইচ্ছে করে বলে দিতে, আরিফ কোথায়। আর একতলা ওপরেই দিব্বি গড়াগড়ি দিয়ে যাচ্ছে ওই ছেলে। বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে ইয়েসিন নিজেকে দমায়। ওদিকে খাদেম মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকটিকে নিয়ে কয়েক লেন পরের মসজিদের পথে রওনা হয়। খানিক বাদে সেখান থেকেও ‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি’ উচ্চারিত হতে থাকে। এলাকার অনেকেই এবার ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে আসতে শুরু করে। এ তাকে সে ওকে জিজ্ঞেস করতে থাকে- কী ব্যাপার?
আরিফের বাবার নাম ওয়াকিল। এলাকায় একমাত্র উকিল বলে বেশ একটা দাপট তার আছে। কিরমানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয়। উপলক্ষ- লোকের ভাষ্য অনুযায়ী, গুরুতর। মসজিদে বসে দুনিয়াবি কথা বলা যাবে কি-না এই নিয়ে ওয়াকিল-কিরমানের তর্ক একদিন মুসুল্লিদের পাক্বা দুটো দলে বিভক্ত করে দিয়েছিল। ওয়াকিল ছিল দুনিয়াবি কথা বলার পক্ষে আর কিরমান ছিল উল্টোটা। ওয়াকিলের ভাষ্য, নবী মুহম্মদ মসজিদে বসে আঙুল নেড়ে রাষ্ট্র চালিয়েছেন। রাষ্ট্র তো দুনিয়াবি বিষয় রীতিমতো। তবে আর তর্ক কেন? বিপরীতে কিরমান প্রথমে ছোটবেলায় তার কোরান পাঠে মুগ্ধ হয়ে রামপুরার মসজিদে আসা ভবঘুরে এক মিশরীয় ক্বারির তাকে জড়িয়ে ধরার গল্পটা দু’কথায় বলে দিনি পথে তার জ্যেষ্ঠতা প্রমাণের চেষ্টা করে। এরপর গলা উঁচিয়ে বলে, মসজিদ আল্লার ঘর। বান্দার সিজদা করার জায়গা। একারণেই নাম হয়েছে মসজিদ। তাহলে এখানে দুনিয়াবি কথা কেমন করে বলে? মসজিদে বসে নবী রাষ্ট্র চালিয়েছেন নিত্য, এ কথা ওয়াকিল উকিল কোথায় পেয়েছে! এই তার ওকালতি!
ওয়াকিলের দাপুটে ভাবের চেয়ে কিরমানের আলাপী ভাব লোকের বেশি প্রিয় ছিল বলে উকিলের পক্ষে লোক ছিল কম আর গর্বীর দিকে বেশি। ইয়েসিন দুই পক্ষের কথাই শুনেছিল। দুপক্ষের কথাই তার মনে ধরেছিল।
হাঁ, এবার মনে পড়েছে ওয়াকিলের কথা। কোথায় তাকে দেখেছে।
মাইকের ঘোষণা শুনে কিরমান বেরিয়ে এসে প্রথম সুযোগেই মোটাসোটা শরীরের কাজীর দিকে তাকিয়ে সগৌরবে ঘোষণা করল, বিপদে পড়লে আমার কাছে ভাই কোনো শত্রু-মিত্র বিচার নাই। ওয়াকিলের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বের হয়ে এলাম।
শুনতে পেয়েই ইয়েসিন রাস্তায় নেমে এলো, এইতো উপযুক্ত সময়। হাতের দুপাশে সারি সারি টিনসেড বাড়ি পুব দিক থেকে এসে পশ্চিমে ঝিলের দিকে চলে গেছে। সবচেয়ে কাছের ল্যাম্পোস্টটাও প্রায় গজপাঁচেক দূরে। কিরমানের বাড়ির জবাগুল্মের ঝাড়ে জমাট অন্ধকার। ইয়েসিন ওখানটায় দাঁড়িয়ে মনে মনে আল্লাকে ডাকতে থাকল। আল্লা প্রেমিকের ডাক শোনে, এই তার জোর ভরসা। পর্দাটা নড়ে উঠল খানিক বাদেই। ইয়েসিন একবার গলা ঝাড়ল, কোনো কথা বলতে পারল না। এমন সময় কিরমানকে হঠাৎ এদিকটায় ফিরতে দেখে বুকের পাচিলে এমন হাতুড়পেটা শুরু হয়ে গেল যে সেদিনের মতো সটকে পড়ল। রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করল কেবল, ঘুম আর এলো না। ভোরে ফজরের নামাজের সময় বাহুতে চিমটি খেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে, দাঁত বের করে হাসছে আরিফ। বলল, তুমি খুব ভালো।
পরদিন মাঠে আরিফের সঙ্গে দেখা। আরিফ খেলায় যাচ্ছেতাই। তার জন্যে দর্শকের আসনের চেয়ে বড় কোনো বরাদ্দ জোটে কম। নিজ দলের ব্যাটিঙে উন্মনা ইয়েসিন সেদিন চটজলদি আউট হয়ে আরিফের পাশে গিয়ে বসল।
তারপর? মারল তোমাকে?
মাথা খারাপ?
কী হয়েছিল বাসায়?
কিছু না।
তাহলে পালালে যে?
পালালাম আর কোথায়। এবার তো ফিরেছি। পরেরবার আর ফিরবও না।
কথা আর না-বাড়িয়ে ইয়েসিন ক্রিজের দিকে তাকিয়ে থাকল। ধীরে হলেও যুক্ত হচ্ছে রান। তার দল ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
ফেরার কালে ইয়েসিনের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকল আরিফ। মাঠ ছেড়ে এলাকার লেনে ওঠার পর সাদা এক দোতলা বাড়ির দেখা পাওয়া গেল। তার কালো ফটক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ জামার ঝলমলে একটি মেয়ে আরিফের ওপর থেকে চোখ আর সরায় না। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টিতে কাউকে কিছু জানিয়ে দিলো কি? ইয়েসিন বলল, ওই মেয়েটা তোমাকে চায়।
জানি। আমিও তাকে চাই। সমানে সমান।
বলো কী! এখন?
আরিফ হেসে বলে, এখন আর কী ভাই! জানি না, কিছুই জানি না।
ইয়েসিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আমিও একজনকে চাই।
আরিফ আগ্রহ নিয়ে তাকাল তার দিকে। বলো কী! কে?
ইয়েসিন কোনো উত্তর দিলো না।
সেই রাতে ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে ইয়েসিন গজল গাইতে থাকল। আল্লা আমার রব, এই রবই আমার সব। গজল গীত হওয়া ছিল উদ্দেশ্যমূলক। বিফল হলো না। মাথায় কালো কাপড় জড়িয়ে কেউ একজন কিরমান-বাড়ির পেছনের উঠোনে আমগাছতলায় এসে দাঁড়াল। তার নামটা পর্যন্ত জানে না ইয়েসিন। আরিফ কি জানে?
মাথায় কাপড় জড়ানো অবয়বটা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে দুয়েকবার ওপরে তাকালে নক্ষত্রের আলোয় একটা আধভাসা মুখ ইয়েসিনের চোখে পড়ে। তাতেই চোখে মুগ্ধতা খেলে যায়। কোনোদিন কোনো মেয়ে তার দিকে এভাবে মুখ তুলে তাকাবে তা ইয়েসিনের ভাবনার অতীত। এখানে কোনো পাপ নেই তো? রীতিমত আল্লা আমায় সাহায্য করতে লেগেছে, পাপের পথ কোথায়। তবুও। বেশিদিন এমন চালালে হয়ত তিনি আর খুশি থাকবেন না। কী করা যায়? কিছুই জানা নাই; আরিফ যেমন বলে।
সেদিন প্রথমবারের মতো ইয়েসিন একটা চিঠি লিখল। প্রথমে তার জ্ঞানের পরিসীমা বোঝাতে চিঠিটা লিখল আরবী ভাষায়। পরে সেটা ভাঁজ করে ট্রাঙ্কের নিচে রেখে নতুন করে বাংলায় লিখতে শুরু করল। নিচে, মসজিদে তখন তাবলীগ জামাতের লোকেরা তালিমে বসেছে। নতুন দাড়ি গজানো তরুণ থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধ- কে নেই। খাদেমও সুরমা চোখে উপস্থিত। সবাই মধ্যবয়স্ক মেহেদিরাঙা দাড়ির স্থূলদেহী সাথীর কথায় মাথা নাড়ছে বিস্তর। দুনিয়ার আকর্ষণগুলোকে আখিরাতের রাঙতায় মুড়ে তাকে তুলে রাখার প্রতীজ্ঞা করছে। পরে হবে, পরে হবে সব। দুনিয়া তো মুমিনের জেলখানা। হায় নফস, হায়! তোমার ওপর কত অত্যাচারই না আমরা করেছি। জ্ঞাতে অজ্ঞাতে, বুঝে না-বুঝে। ইয়া খোদা, আমাদের ক্ষমা করে দিও মালিক!
চিঠি প্রস্তুত হলে ছাদে উঠে গেল ইয়েসিন। ফের গজল শুরু করতে গিয়ে থেমে গেল। এরপর বহুক্ষণ মসজিদের ছাদে পায়চারি করে, নক্ষত্র দেখে সময় কাটিয়ে দিলো। চিঠি তার মুঠোতেই থেকে গেল।
তিন.
শরীরের প্রতি ভীষণ যত্নবান হয়ে উঠল ইয়েসিন। আগে কেবল খেলাধুলা করত। এখন সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বুকডন, দুই হাতে দুই-দুই চারটি ইটের ওঠানামা। দূরের তুরাগ-তীরের তালতলা গাঁয়ের বারোয়ারি পুকুরে সাঁতার। আর বিকালে খেলা শেষে লেনে ফিরে এসে ঝিকিয়ে ওঠা দেহের উদ্দেশ্যমূলক প্রদর্শনী। তার চোরা চাহনী কে আর ধরতে পারে? সে-ই কেবল দ্যাখে কিরমানের সামনের ঘরের পর্দাটা নড়ে উঠছে থেকে থেকেই। কখনও দৃষ্টিভ্রমও হয়। ইয়েসিনের দেখাদেখি তার খেলার সাথীদেরও অনেকে ঊর্ধ্বাঙ্গের পরিধেয় খুলে শরীরে হাওয়া করতে থাকে। ইয়েসিনের ছেনিহাতুড় পেটা লোহাকাঠ-শরীরের তুলনায় ওদের শরীর শিশুর মতো দেখায়। ইয়েসিন তা দ্যাখে আর প্রীত বোধ করতে থাকে। দ্যাখে আর তৃপ্ত হতে থাকে। কিশোরের দেহের ভেতর আরো প্রবল পুরুষ হয়ে ওঠে ইয়েসিন। মেয়েটির নাম তখনো জানে না। কী করে জানা যায়? কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? আরিফকে নিশ্চয়ই। আপাতত একমাত্র পরিচয়-চিহ্ন : মাথা ঢাকার ওই কালো জর্জেট ওড়না। নাহ, মন মানছে না। হৃদপিণ্ডে ছন্দপতন, সারাক্ষণ। এখানে আছো কোনো জ্বিন? ও ভাই। কোকাফ থেকে আমাকে আয়না এনে দাও না। আমি দেখব কী করছে সে এখন। আমি দেখতে চাই। আমাকে বাঁচাও।
সেই রাতে আবারও মসজিদের ছাদে ওঠে ইয়েসিন। গুনগুনিয়ে গায়, তোমার নামে গজল গাইল খোলাফায়ে রাশেদীন। এমন স্বরে গায় যে নিজেই ঠিকমতো শুনতে পায় না। আমতলাতেও কেউ আসে না। কিনার থেকে সরে আসে ইয়েসিন। খানিক বাদে আবার যায়। আবার সরে আসে। এভাবে দোদুলদোল আরো বেশ ক’বার। ওদিকে আকাশে চাঁদটা খুব ধীরে দিগবদল করে। আকাশের গ্রহরা তাদের গন্তব্য বোঝায়, নক্ষত্ররা ধকধকিয়ে প্রেমিকের হতাশ চোখ আলো করতে চায়। পারে কই। ছাদ থেকে চলে আসে ইয়েসিন। চিঠি ওর কাবুলি জোব্বার জেবে থেকে যায়। এবড়োথেবড়ো সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে মাথার টুপিটা খুলে ফু দিয়ে আরো চেপে বসায়। খাদেমের সন্দিগ্ধ চোখের সামনে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে।
ক’দিন বাদে খেলতে গিয়ে দেখে, তুরাগের অদূরে সরকারি উদ্ভিদ উদ্যানে ভাঙা দেয়ালের কাছে আগে পরে হাঁটছে সেদিনের সবুজ জামা পরা মেয়েটি, সঙ্গে তার সখী। একেই বুঝি সেদিন পেছন ফিরে ডাকছিল? আজ বোধয় ওরা জামা বদল করেছে। কাছেই শারদীয় কাশের আড়ালে দাঁড়িয়ে আরিফ। ইয়েসিন উচ্ছ্বসিত হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। আরিফের মুখের ওপর একটা আলগা গাম্ভীর্য ঝুলে আছে। উচ্চতায় ইয়েসিনের চেয়ে কিছুটা উন্নত আরিফ, আজ সেটা আরো প্রকটভাবে বোঝাতে চায়। ক্ষণে ক্ষণে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে শরীর ওপর-নিচ করছে। কণ্ঠও যেন খানিকটা মোটা করে কথা বলতে চায়।
তা, সেদিন মাত্র চেয়েছিলে। এতো তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলে? মেয়েটির দিকে চোখ-ইশারায় আরিফকে বলল ইয়েসিন। আরিফ জবাব না দিয়ে হাসল। ইয়েসিন বলল, তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
আরিফ দূরের কিশোরীর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ইশারায় জানাল, এই তো আসছি। ফিরল ইয়েসিনের দিকে।
সামনে চলো। এখানে ওরা শিউলি টিউলি কুড়াক।
শিউলি তো ভোরে কুড়ায়।
ওই হলো।
আচ্ছা। একটা ব্যাপারে তোমার সাহায্য দরকার। জরুরি।
আকাশ ক্রমে লাল হয়ে উঠতে থাকল। দূরে খেলা ভাঙল। ইয়েসিনের আবিষ্কৃত জায়গায় আগাছা সরিয়ে বানানো পিচের ওপর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট চালানো এবং হারতে থাকা তার দল তখনও যুঝছে। সবার চোখে মুখে অসন্তোষ। উদ্ভিদ উদ্যানের সীমানা দেয়ালের কাছে ধীর গতিতে ঘুরছে একটা কালো বড় রাডার। কেউ একজন বলছে, ওই রাডারের দিকে একবার বন্দুক তাক করে দেখিস। গুলি সোজা বুকে এসে বিঁধবে। শুনে ইয়েসিন তাকায় ওই রাডারের দিকে। পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে এক চোখ বুজে তাক করে। সঙ্গে সঙ্গে একটা বুলেট এসে ওর বুক ভেদ করে কিছু মাংস নিয়ে পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকা ইয়েসিন লাল চোখ নিয়ে জেগে ওঠে।
ওয়ারদা! ওয়ারদা!
গলা শুকিয়ে কাঠ। জিভ টাকরার সঙ্গে সেঁটে আছে আঠার মতো।
চার.
মেহজাবিন! মেহজাবিন? তোমার সঙ্গে দুটো কথা ছিল মেহজাবিন!
এই দীদামতি নাম ডাকতে বুঝি খুব ভালো লাগছে? কী সাংঘাতিক!
আমার বন্ধুর জন্যে পরামর্শ দাও মেহজাবিন! ও মেহজাবিন! লাগেই তো।
ওকে বলো, মেয়েরা কিছু জিনিস খুব ভালো পায়। পছন্দ করে। কিন্তু ছেলেরা মনে করে ওরা বুঝি রাগ করবে খুব। ছেলেরা একটু বোকা তো, তাই।
মেয়েরা কী পছন্দ করে মেহজাবিন?
চুপ। আর একটা কথাও বলবি না। তোর সঙ্গে মিছেমিছি আড়ি।
আর তোর সঙ্গে মিছিমিছি ভাব।
আরিফের পিঠচাপড় পেয়ে সাহসী হয়ে ওঠা ইয়েসিন সেদিন আবার মসজিদের ছাদের সিড়ি ধরল। খাদেম বলে উঠল, আজ মুয়াজ্জিন হুজুর নাই। শুনেছেন লায়েক বেটা, আজ মুয়াজ্জিন হুজুর নাই।
খাদেমের দিকে না-তাকিয়েই ঘাড় কাত করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে জানিয়ে আধো অন্ধকার ছাদে গিয়ে উঠল ইয়েসিন। কিছুক্ষণ পায়চারি করে, নক্ষত্রের কাছ থেকে আলো ধার করে, অবশেষে কিনারায় দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করল, আল্লা আমার রব, এই রবই আমার সব। এই এক গীতিবাক্য বারকয়েক ভাঁজার পর নিচের অন্ধকারে তাকিয়ে কোনো নড়চড় দেখতে পেল না। আবার গাইল। বাক্য অভিন্ন, তবে হতাশা চেপে বসায় সুর খানিকটা নমিত। দূরের রাস্তা থেকে মসজিদের ছাদে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে থাকতে যদি কেউ দেখে ফেলে তো ভালো হবে না। ইয়েসিন সরে এলো। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, এশার আজানের সময় হয়ে গেছে। নেমে গেল দ্রুত। সেদিন আজান শুনে লোকে বলল, ইয়েসিনের গলা না?
না, মনে হয় অন্য কেউ।
অন্তত মুয়াজ্জিন তো না। হ্যাঁ, ইয়েসিনই তো। তাহলে?
না, না, ইয়েসিন না।
মসজিদের নিচতলায় যখন রাতের নামাজ চলছে তখন আবার দৌড়ে ছাদে উঠে গেল ইয়েসিন। কিনারে দাঁড়িয়ে গাইল, অনাদী অনন্ত হে মাবুদ সোবহান। এই একটিই বাক্য বাজতে থাকল অবিরত। হঠাৎ আমগাছের নিচে কে যেন এসে দাঁড়াল। আর তার পেছন পেছন এসে দাঁড়াল আরো একজন। দু’জন তো আসার কথা নয়! কোথাও কোনো অসুবিধা হয়েছে। কিনার থেকে সরে এলো ইয়েসিন। আর নিচে একটা হুটোপুটির সঙ্গে অস্ফুট চিৎকার শুনতে পেল মুহূর্তের জন্যে। নাকি কানের ভুল!
পরদিন কিরমানের চোখমুখ অন্ধকার ভীষণ। ঝড়ের আভাস দেখা দিলেও কোনো ঝড় এলো না। এরও দিনকয়েক পর শীতের ছুটিতে কিরমানের দার্জিলিংবাসী ছেলে ফিরল ঘরে। মুখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাসায় মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন খাদেম আর ভাগ্নের মেজবানি ডাক পড়ল। সবাই গেল সাগ্রহে, ভাগ্নে কেবল গেল না। রাতে খাদেম দার্জিলিঙের সাপের মতো রাস্তা আর বাঘমতি পর্বতের সূর্যশোভা নিয়ে পড়ল। কিছু ছবি দেখে এসে আর ভুলতে পারছে না। আল্লার কী মোসলেহাত, কী মোসলেহাত- এই বলছে সারাক্ষণ। ইয়েসিন অনড় কানে শুনে গেল কেবল, কোনো কথা বলল না।
এলো রোজার মাস। সেবার ইয়েসিন একদিনও গজল গাইল না, খেলতে গেল না। পথে বেরোল খুব কম। চোখের সামনে পাঠ্যবই তুলে ধরে খানিক বাদেই নামিয়ে রাখল। ছাদে তাকে একটিবারও দেখা গেল না। তার হলুদাভ চোখে অসুস্থতার চিহ্ন, আধবৃত্ত কালশিটে : নির্ঘুম রাতের ছাপ।
শেষ জুমায় রমজানজুড়ে লোকের দানের টাকার ভাগবাটোয়ারা হলো। ইমাম মোয়াজ্জিন মসজিদের খাদেমের সঙ্গে বাদ গেল না ইয়েসিনও। লটে যা জুটল তার অঙ্ক শুনে ভীষণ চমকাল ছেলেটা। এর পরপরই হঠাৎ করে প্রাণ পেয়ে গেল এতোদিনের দারুময় পুতুল।
মসজিদে যারা এতেকাফ-ধ্যানে বসেছিল, শেষ সময়ে এসে তাদের এঁটো থালা ধুয়ে দিতে, মশারি টাঙিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগল ইয়েসিন। আহ্নিক তেলমালিশও বাদ পড়ল না। তার চোখে, মুখের ভাবে, অস্থিরতা কিন্তু ঠোঁটে কথা নেই। ঈদের আগের রাতে গোটা ঈদগা মাঠ ঝেঁটিয়ে মেঘ করে তুলল। ভোরে সময় হবে না বলে রাতগভীরে সারিতে সারিতে পেতে রাখল চটের মাদুর। শামিয়ানার দড়ির গিঁট খুলে আবার বাঁধল। কাজের গতির সঙ্গে পরিমাণ বাড়তে থাকল সমানুপাতে।
এক লোক বলল, এই ছেলের হয়েছে কী! এতো দেখি মরবে।
শুধু কি মরবে? মারবেও। বলল আরেকজন।
মনে হয় বাড়ি যাবে বলে উত্তেজিত।
আরে ধুর, খাদেম ওকে দৌড়ের ওপর রেখেছে। এসব তো খাদেমের কাজ, দেখো না?
আহা, বাপ নেই ছোকরার, অনাথ। এই ছেলের ওপর সুযোগ পেয়ে সব চাপানো কেন?
পয়সা কিন্তু এবার খারাপ পায়নি- এই বলে হাসল আরেকজন।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল আরিফ। বিড়বিড়িয়ে কী যে বলল, কেউ শুনতে পেল না। ঈদগা থেকে বেরোনোর পথে ইয়েসিনকে আটকাল আরিফ। বন্ধু!
দিয়েছ? ইয়েসিনের চোখে প্রশ্ন। কণ্ঠে অস্থিরতা।
হুঁ।
আচ্ছা- বলে ইয়েসিন আর দাঁড়াল না।
ঈদের দিন কাতারে চালানো রুমালে আরো অনেক পয়সা পড়ল। এবারও ভালোই পেল ইয়েসিন। কে একজন বলল, আমরা তোকে ভালোবাসিরে ভাই! অনেক খাটতে পারে এই ছেলে।
আর কী সুন্দর গায়- যোগ করে আরেকজন। যদিও এই রোজায় ফাঁকি মেরেছে।
অসুখ করেছিল বোধয়, নাকি গো?
কই আর অসুখ, দিব্যি তো খেলে বেড়িয়েছে।
না না, কোথায়। রোজায় সে একদিনও বেরোয়নি।
তাহলে ইতেকাফে বসেছিল বোধয়, বলে আরেকজন। খুব একপর্ব হাসি হলো এ কথার পর।
পাঁচ.
মেহজাবিন! মেহজাবিন! ইয়েসিনরা আজ পালাবে, রাতে।
আজ রাতেই? কী সাংঘাতিক! কোথায় যাবে?
প্রথমে ট্রেনে করে যাবে ঠাকুরগাঁও। এরপর বাসে পঞ্চগড়। এক বন্ধুর বাড়িতে নাকি উঠবে। একটা নদী আছে, মহানন্দা। ওখানে পাথর তোলে ওই বন্ধু, যতদূর বলল আমায়। মাদ্রাসা থেকে ওদের নাকি একসঙ্গে বের করে দিয়েছিল। দু’জন ক্লাস পালাতও একসঙ্গে। খুব বন্ধু। মেহজাবিন! মেহজাবিন? চলো না আমরাও পালাই!
দরকার পড়লে পালাবই তো। এখনও দরকার পড়েনি।
আমার বড়’পা কী বলে জানো?
কী বলে?
বলে, আমাদের আগের প্রজন্মটা হলো তাদের বাবা-মায়ের স্বেচ্ছাচারিতার, এবং কী বলে, মূর্খতার চূড়ান্ত খেসারত দেওয়া একটা প্রজন্ম। সুতরাং পরের প্রজন্ম, অর্থাৎ এই আমরা হব শক্তরকম পলাতক হব। যা বললাম, আগের প্রজন্ম তাদের বাবা-মায়ের স্বেচ্ছাচারের সবচেয়ে বেশি খেসারত দিয়েছে বলে শোধ তুলতে চাইবে। তুলতে গিয়ে আমাদের ওপর ঘটাবে মুর্খতার চূড়ান্ত, বুঝলে? নিজেদের না-পাওয়াটা, নিজের না-পাওয়াগুলো চাপাবে। এবং, ও বন্ধু আমার, এবং এটাই সবচেয়ে বড় মূর্খতা। মানুষ বাবা-মা’র জন্যে এর চেয়ে বড় মূর্খতা আর নাই। এটা একটা দুটো পরিবারে ঘটে শেষ হবে না। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ। আমাদের পর আরো প্রজন্মের ওপর এটা চলবে। তো এরইমধ্যে কোনো একটা হবে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ঘরপলাতক প্রজন্ম। হয়ত আমরাই- কে জানে! ঘরে ঘরে ঘরপলাতক ছেলে মেয়ে জন্ম নেবে। নিচ্ছেও কিন্তু, দেখো! এই স্রোত চট করে থামবে না।
থামো থামো! কী বিদঘুটে কঠিন সব কথাই না তুমি বলতে পারো। ঈদ মোবারক বলেছ একবারও?
এসব আপার কথা। আমারও বলতে পারো অবশ্য। ঈদ মোবারক আমার মেহজাবিন!
তোমার আপা কি রাজনীতি করে?
না। তবে করবে। ও সুরবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হবে একদিন। এই সব ঘরপলাতকদের এক করবে। তাদের সন্তানদের এক করবে। ওরাই মরা বাংলাকে বাঁচাবে। এরপর মরা পৃথিবীকে।
আবার বড় বড় কথা!
সত্যি! পড়নি? ফ্রান্স ওয়াজ সেভড বাই হার আইডলার্স! মাতা ফ্রান্সকে তার উচ্ছৃঙ্খল বখাটে সন্তানেরাই বাঁচিয়েছিল। তেমন ব্যাপার। আমাদের মোস্তাফিজ স্যার বুঝিয়েছিলেন, এখনও মনে আছে।
পড়েছি তো বাংলা বইয়ে, এখন মনে পড়ল। তোমার মতো সারাক্ষণ মনে করে রাখি নাকি যে সময়মতো ছেড়ে হাততালি কুড়াব!
এতো নরম নরম পারি না-য় চলবে না মেহজাবিন। তোমাকেও দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে হবে।
তোমার আপার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে? কী সাংঘাতিক! পারব না, অসম্ভব। আপা আমাকে পেড়ে ফেলবে।
ঈদের রাতে কিরমানের বাড়ি কান্নায় ভেঙে পড়ল। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে, বাসায় গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে এসে, অবশেষে বাড়ি যাবে বলে লটবহর গোছাতে বসল খাদেম। ইয়েসিনের কেন দেখা নেই? ট্রাঙ্কটা পাশ করতে গিয়ে একটা ভাঁজ করা কাগজ পাওয়া গেল। আরবিতে লেখা একটা চিঠি। এখন পড়ার সময় নেই। দ্রুত একঝলক চোখ বুলিয়ে জোব্বার পকেটে ঢুকিয়ে নিলো কেফায়েত। রাতের গাড়ির সময়টা ক্রমে কাছিয়ে আসছে। এখনও দেখা নেই ফুলবাবুর। ভাগ্নের জন্যে একটা কাগজে ভালোমন্দ কিছু লিখে মুয়াজ্জিনের হাতে দিয়ে বেরিয়ে এলো খাদেম।
বাসে উঠে ধীরেসুস্থে পকেট থেকে বের করল ভাঁজ করা সেই চিঠি। ভেতরের আলোয় পড়তে পড়তে ক্রমে দু’চোখ বড় হয়ে উঠল তার। হাতের লেখাটাও যেন চেনা চেনা ঠেকল এবার। দেরি না-করে কাগজটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে হাঁপাতে থাকল খাদেম।
ব্যাপার তবে এই!
ছয়.
কিরমান এরপর বহুদিন আর বেরোয়নি। নামাজেও যেত না। তার বাড়ির সামনের দুই প্রাণবন্ত সখা জবা আর নিসিন্দায় এবার শীতের আগেই শীত এলো। ওদিকে খাদেম কেফায়েত দরিয়ানগর ফিরে গিয়ে তার চুপস্বভাবা বোন আর মারকুটে বোনাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে রূপোসনগর ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলো।
সপ্তম দিনে ভ্যানের ওপর ট্রাঙ্ক তোলার পর হাত ঝেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, ভেবেছিলাম আর কোনোদিন ওইমুখো হতে পারব না। কিন্তু, সিদ্ধান্ত এখন বদলেছি। আল্লাহর কী মোসলেহাত, তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল।
ঈদের ছুটির পর স্বাভাবিক সময়ে ফিরে এসে মসজিদের দোতলায় নিজ ঘরে সব আগের মতো রেখে নেমে এলো খাদেম। কিরমানেরকির ঘরে ঢোকার মুখে বিবর্ণ নিসিন্দা আর জবাগুল্মের দিকে তাকিয়ে তার বুক দুরুদুরু করতে থাকল। কর্তব্যের ভরে হৃদপিণ্ড চাপা পড়লে থামল কাঁপুনি। দরজায় আঙুল ঠোকালে কিরমানই এসে কপাট খুলে দাঁড়াল। এই কি সেই সদাগর্বী কিরমান? কোটরে বসে গেছে চোখ, কালশিটে অধিকার করেছে চোখের নিচের পরিধি। কপাল বড় হয়ে গেছে আরো। খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছে আগের চেয়ে। বুকের পাটাও খানিকটা চুপসে গেছে। খাদেমের দিকে তাকিয়ে বলল, কেফায়েত এসেছ? ভালো। কিছু বলবে?
মাসখানিক পরে দেখা গেল কিরমান আবার এসে বাড়ির সামনের ওই সিমেন্টবালুর হেলান আসনে বসেছে। চোখেমুখে আগের সেই স্ফূর্তির ভাব নেই। আগে ব্যাটস্ট্যাম্প নিয়ে ছেলেরা বাসার সামনে ভিড় করলে তাদের দূরদূর করত। এবার নির্লিপ্ত চোখে তাদের দেখে গেল কেবল। খুব নিচু স্বরে একবার বলল, আবার যদি তোদের মতো হতে পারতাম!
পাড়ার কিশোররাও এদিক-ওদিক শুকনো মুখে ঘুরে ফিরে ইয়েসিনের অভাবজাত ব্যথা প্রকাশ করত। একসময় তা-ও ফিকে হয়ে এলো। ততদিনে ওই ঝোপাল মাঠটাও কোন্ এক ভূমিদৈত্য কিনে নিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। ইয়েসিন নেই, তাই তার সঙ্গে ভূঁইফোড় মালিকের কোনো রফার ব্যাপারও নেই। সন্ধ্যার দিকে সন্ধ্যার-কিল ব্যাপারটা টিকে আছে কেবল। তবে আগের সেই হুটোপুটি আর হয় কোথায়। সন্ধ্যার পর কিরমান বাইরের হেলানে আগের মতো বসে থাকে। লোকে তার সামনে দিয়ে নামাজে যায়, ভাঙলে ফেরে। কেউ কেউ ফেরার কালে তার পাশে এসে বসে। বলে, সব আল্লার ইচ্ছা।
কিরমান বলে, না। সব মানুষের শয়তানি।
একদিন ওই নিথর হয়ে বসাতে ছেদ ঘটিয়ে আবার মসজিদে যাতায়াত শুরু করে কিরমান। কেবল ফরজটুকু পড়ে চলে আসে, দেরি করে না।
এরও কিছুদিন পর ঘনিষ্ঠ জামালকে বলছিল, না রে ভাই। ফ্ল্যাটে আর উঠছি না। কার জন্যে উঠব? ছেলে দার্জিলিঙ থেকে যাবে ব্যাঙ্গালুরু, কী এক কাজে ঢুকেছে। আমরা দুটি টোনাটুনি এখানেই বেশ থাকব, এই এলাকায়। এই জায়গাটাকে শুরু থেকে এই অব্দি বাড়তে দেখলাম, বুঝলে? কিরমানের কণ্ঠে সেই পুরনো উচ্ছ্বাসের ছায়া। তখন এই মসজিদ ছিল না। এখানে জংলা ছিল, এখন কার মনে আছে ওসব? আমি, কাজী, মুৎসুদ্দি এরা মিলে বেড়া দিয়ে রেখে বলেছিলাম, মসজিদ হবে। হয়েছেও। সেখানে ইমাম এসেছে, মুয়াজ্জিন এসেছে, খাদেম এসেছে। খাদেমের সঙ্গে ভাগ্নে এসেছে!
ঠিক এখানটায় নিয়ন্ত্রণ হারায় কিরমান। তার বেদম হাসি পায়। হাসতে হাসতে, এবং হাসতে হাসতেই শরীর বেঁকে গিয়ে তাল হারিয়ে পড়তে যায় লোকটা। ঘরের দরজা খোলা তখন। একটা পুরনো রঙওঠা পর্দা কেবল হাওয়ায় ভেতর-বাহির করছে। হঠাৎ সেই পর্দা উড়িয়ে দরজাপথে উদ্যত শিকারির মতো বেরিয়ে আসে সাদা চুলের এক নারী। কিরমানের কাঁধ খামচে ধরে বলল, চুপ, একদম চুপ! খবরদার! মেরে ফেলব! তোকে মেরে ফেলব। তোকেই মারব আমি, আর কাউকে না। তোকেই!
বলতে বলতে হাঁপাতে থাকা সেই নারীর চোখ দুটো ঘৃণায় ছোট হয়ে আসে। কিরমানের পত্নীকে এর আগে কোনোদিন দেখেনি কেউ।
সাত.
সেদিন এশার নামাজের পর খাদেম তার ঘরে ঢুকে টিনের দরজাটা মাত্র ভিড়িয়েছে এমন সময় দরজার ওপারে টুনটুনিয়ে শব্দ করল কেউ। এরপর যুবা পুরুষের ভরাট কণ্ঠে বলে উঠল, খাদেম মামা কি আছেন?
কেফায়েত বিভ্রান্ত। এক ইয়েসিন ছাড়া কেউ তাকে মামা বলে ডাকতো না এখানে। ছোট হুজুর বলত সবাই, এখনও বলে। যে এসেছে সে কি কোনোভাবে ইয়েসিনের সঙ্গে যুক্ত? নাকি খোদ ইয়েসিন! দরজা খুলে ধরে খানিকটা পিছিয়ে এলো কেফায়েত।
ভালো আছেন? আমি আরিফ। ইয়েসিনের বন্ধু।
একটু আগের যুবা পুরুষকণ্ঠ বিদায় হয়েছে। মুখটা বেশ চেনা। একবার ইতস্তত করে খাদেম বলল, আপনি ওয়াকিল সাহেবের ছেলেটা না?
হ্যাঁ। আমি ইয়েসিনের বন্ধুও। ও আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। আপনাকে তা দিতে বলায় এলাম।
আমি কোনো চিঠি নেবো না।
দয়া করে চিঠিটা নিন। আপনার চেয়েও ওয়ারদার বাবা মায়ের বেশি কাজে আসবে।
তাহলে ওদেরকে গিয়ে দিন। আমাকে না।
চিঠিটা যে আপনাকে লেখা! কী করে ওদের দেবো?
তার মানে আপনি পড়েছেন!
জ্বি না। আমাকেও আলাদা চিঠি লিখেছে। সেখানে লেখা ছিল বাকিটা আপনার।
কেফায়েত আর কোনো কথা না বলে ক্ষুব্ধ চাপা শ্বাস ছাড়তে থাকল। ভেতরে এক পা এগিয়ে চৌকির ওপর চিঠিটা রেখে পিছিয়ে এলো আরিফ। মাথা না তুলেই খাদেম বলল, ঠিকাছে, এবার যান।
সিঁড়ির পথ ধরল আরিফ। তার ছন্দিত পায়ের শব্দ ক্রমে নিচে নেমে হারিয়ে গেল। খোলা দরজাটা বাতাসে আগপিছ করছে। খাদেম এগিয়ে সশব্দে তা বন্ধ করে চৌকির ওপর এসে বসল। মোড়ক ছাড়াতেই একটা ছবি পড়ল বিছানায়। সঙ্গে দুই ভাঁজ করা একটা দাগটানা কাগজ। উল্টোপিঠ ঠেলে বেরিয়ে আসছে পেটের বর্ণমালা। কালির রং নীল।
ছবিটা বহুক্ষণ ধরে দেখল কেফায়েত। উচ্চতায় প্রায় সমান এক মেয়েকে পাশে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ইয়েসিন। দাড়ি ছেঁটেছে। মাথায় এলো চুল, কাকাতুয়ার ঝুঁটি। মেয়েটা কপালের ওপর চুল খানিকটা ফাঁপিয়ে ব্যান্ড বসিয়েছে। কাঁধ ছাপিয়ে সামনে চলে এসেছে চুলের অবশিষ্ট ঢেউ। ত্রিকোণ মুখাকৃতি, আধফোলা গাল। আয়ত চোখ, ঠোঁট দুটো পাখির মতো ছোট। কিরমানের পর্দানসীন মেয়েকে কখনো দেখেনি খাদেম। অবচেনতনার আলোড়নে বলে উঠল- আসলেই ওয়ারদা! গোলাপ!
ছবির রঙ হাওয়া লেগে মরে গেছে। মরা ছবিতে দুই কৈশোরের দেউড়ি পেরোতে থাকা নর-নারী জীবনের আভাস ফুটিয়ে স্থির। কেফায়েত চোখ সরাতে পারে না। ইয়েসিনকে দেখে, ওয়ারদাকে দেখে, দেখে বাঁশঝাড়। দেখে পাশ থেকে বেরিয়ে আসা চওড়া ঘোলাটে নদী, নদীতে সাদা বয়া আর লাঠি নিয়ে তৎপর ভাসমান সব মানুষ।
ছবিতে ভাগ্নের বেড়ালচোখ কিছুটা বোঝা যায়। সেদিকে তাকিয়ে ধীরকণ্ঠে কেফায়েত বলে, তুই ঠেকবি না ইয়েসিন। তোকে আমি চিনি।