গল্পের সৃষ্টির পাঠশালায়
কথাসাহিত্যিকের কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার প্রথম সোপান বিমুগ্ধ শৈশব।
বিস্ময়কর সত্য ,আমার অসাধারণ একটা দুরন্ত শৈশব ছিল। গ্রামের বাড়ির সামনে পাহাড়ের ছিচকে ঝরনার গতির একটা ছোট খাল। সেই খালের গোড়ায় বড় একটা খাল, গ্রামের নামানুসারে বোথলার খাল। সেই বড় খালের গোড়ায় বিশাল বিপুল আয়াতনের প্রমত্ত কচানদী। আমাদের বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের নানাবাড়ির সামনে আর একটা বড় খাল। যার নাম বাওনের খাল। দুই খালেরই উৎসমুখ প্রবল কচানদী। দুই খালে পারের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র শ্রমজীবী।
কৃষিকাজের পাশাপাশ শ্রমজীবী জনগণের আর একটা কাজ ছিল সমুদ্রে ইলিশ শিকারে যাওয়া। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাত লম্বা নৌকা। নৌকার মধ্যেখানে থাকতো একটা গোল ছই। আর বাকি অংশজুড়ে ইলিশ ধরার লম্বা ছান্দি জাল শুইয়ে রাখা। এক একটা নৌকায় পাঁচ থেকে সাতজন মানুষ থাকতো। একজন মহাজন বা মহাজনের পক্ষের কেউ। তারই আদেশ নিষেধ মানতো সবাই।
মহাজনের নৌকায় শ্রমজীবী হিসেবে যারা সমুদ্রে যেতো, তাদের যাত্রা ছিল বিস্ময়কর। আমরা ভেবে পেতাম না, দিকচক্রহীন সেই সমুদ্রে কিভাবে জাল ফেলে, মাছ ধরে, বিক্রি করে আমার ফিরে আসে? হারিয়ে যায় না? যখন এক মাসের চাল ডাল মরিচ হলুদ লবন নিয়ে যাত্রা করতো, যাত্রার সময়ে বউ-ঝি-ছেলে-মেয়ে-পিতা-মাতারা এগিয়ে দিতো। এক মাস পরে যখন ফিরে আসতো সমুদ্রে ইলিশ ধরে, মানুষগুলোকে চেনা যেতো না। সমুদ্রের নোনা পানিতে শরীরের ওপর পাতলা একটা আস্তর পড়ে যেতো।
শ্রমজীবীরা দরিদ্র। এক মাস যে সমুদ্রে থাকবে, বাড়িতে রেখে যাওয়া স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা কী খাবে? ঘরে তো খাবার নেই। বাধ্য হয়ে নৌকার মালিক বা মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে বাড়িতে চালডাল কিনে রেখে যায়। অনেক সময় দাদন নিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার পর আশা আকাঙ্ক্ষা অনুসারে ইলিশ যদি জালে ধরা না পগে, দাদনের টাকা শোধ করতে পারে না, অনিবার্যভাবে তৈরি হয় সংঘাত। আর মহাজন অপেক্ষা করে লোলুপ চোখে, শ্রমদাসের বউটার মখমলে শরীরের প্রতি। সমুদ্রের ইলিশের বিনিময়ে নারীর টাটকা মাংসের প্রতি লোভ। মহাজনেরা খুব ধীরে ধৈর্য ধরে শিকারের অপেক্ষায় থাকতো। অনেকে গলায় দড়ি দিয়ে মারাও গেছে মান বাঁচাতে, অপমানের জ্বালা থেকে মুক্তির জন্য।
অনেক সময়ে যদি কৌশলী পরিশ্রমী শ্রমজীবীরা কোনোভাবে একটা নৌকার মালিক হয়ে যায়, বনেদি মহাজনেরা মেনে নিতে পারে না। অপেক্ষায় থাকে নৌকাটা ডুবিয়ে দেয় বা রাতের অন্ধকারে সবার অগোচরে ছেড়ে দেয় ভাটার স্রোতে। লড়াকু মানুষটা হেরে যায়, ক্রন্দনে ক্রন্দনে। আমি ‘ইলিশের মাংস’ গল্পে আমার শৈশবে দেখা আমাদের গ্রামের, দুই খালের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের জীবন ও বেদনার লড়াই দুই চোখে দেখেছি। তখন কেবলই দেখেছি। কিন্তু জানতাম না সেই সব দেখার আলো ও পাথরের মধ্যে একদিন আমার সৃজন জগতের দরজা খুলে গল্পের পৃথিবীতে আসবে। আর সেইসব চরিত্র আমার গল্পের চরিত্র হয়ে উঠবে! গল্প লিখতে লিখতে আমার মনে সেই খাল দুটি, কচা নদী আর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া শ্রমজীবী মানুষেরা চরিত্র হয়ে উঠবে। বছর কয়েক আগে ইলিশের মাংস গল্পটা লিখি।
ইলিশের মাংস ॥ মনি হায়দার
ক.
আসমান ভাই। ও, আসমান ভাই। তাড়াতাড়ি ঘুম দিয়া ওডো। বড় সর্বনাশ অইছে গো।
হোসেন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেও ঘুম ভাঙে না আসমান আলীর। ঘুম ভাঙে চুমকীর। চোখ মেলে তাকিয়ে নিজেকে প্রায় নগ্ন দেখতে পায়। দ্রুত উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করে আসমানের ডান পা ওর কোমরের ওপর গাছের মতো পড়ে আছে। শক্তি দিয়ে ঠেলে আসমানের ডান পা সরিয়ে দাঁড়ায় চুমকী। বিছানার পাশে পড়ে থাকা শাড়ি দ্রুত কুড়িয়ে শরীরে প্যাঁচায়। অন্যদিকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে করতে হোসেন দরজায় ধাক্কা মারে, ওরে মাবুদ! এত ঘুমায় ক্যামনে মাইনষে? ও, আসমান ভাই!
দরজা খুলে দাঁড়ায় আলুথালু চুমকী, কী অইচে? এত সকালে চিল্লাইতেছ ক্যা?
ভাবী সর্বনাশ অইচে গো, সর্বনাশ অইচে, মাথার ওপর নিজের হাত দিয়ে থাপ্পড় মারে হোসেন। উজানগাঁওয়ের সবাই জানে, ছোট্ট যেকোনো ঘটনায় খুব বিচলিত হয় হোসেন। কারও শরীর কেটে গেলে, পা মচকে গেলে হোসেন জানায় গ্রামের সবাইকে, ভাই হোনচেন? ওই তো তোবারক মিয়ার পা ভাঙছে।
কী অইচে কইবা তো!
আরামের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত চুমকী। গত রাতে একটুও ঘুমাতে দেয়নি আসমান। মাঝ রাতে নৌকা থেকে এসে আদরে আদরে জাগিয়ে রেখেছে। বলেছে, আর দুদিন পর সাগরে যামু। হারা রাইত নোনাপানির ওপর শুইয়া থাকুম। তোমারে তো পামু না সোনা।
হাসে চুমকী, এক মাসের রাইত তুমি এক রাইতে শ্যাষ করবা?
দুই বুকের মাঝখানে নাক রেখে শরীরের গন্ধ নিতে নিতে জবাব দেয় আসমান, হ। তোরে আমি আইজ খাইয়া হালামু।
কেমন কইরা খাইবা মাঝি? খলবল হাসে চুমকীর তেইশ বছরের ছিপ নৌকার শরীর।
দুই ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁটজোড়া রাখে আসমান, কিভাবে খামু? এইভাবে। চুমকীর ঠোঁট জোড়ায় হালকা দাঁত বসায়। চুমকীর শরীরে কামনার লহরী বয়ে যায়, দুহাতে বুকের উপত্যকায় ঝাপটে ধরে স্বামীকে, খাও, খাও আমারে খাইয়া যাও। দুটি শরীরের খেলায় সারারাত ছিল টলমল। শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিল শরীরের সুখ আর ক্লান্তিকে ধারণে দুটি শরীর মাথামাখি করে।
কী অইচে রে? ঘুম ঘুম চোখে দরজায় দাঁড়ায় আসমান আলী। হাতে গামছা। গায়ের গেঞ্জি এলোমেলো। হাই তোলে।
আসমান ভাই, তোমার নৌকা তো ঘাডে নাই?
হোসেনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে আসমান আর চুমকী। দুজনেই প্রথম রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালের মুখে দাঁড়িয়ে হোসেনের সর্বনাশের সংবাদ মাথায় ঢোকাতে পারে না কয়েক মুহূর্ত। চুমকী দ্রুত তাকায় আসমানের দিকে। চুমকীকে সরিয়ে আসমান সামনে আসে হোসেনের, কী কইতেছ তুই?
কইতেছি ব্যানে না তোমার নৌকায় আইয়া ছান্দিজাল রৌদে দেওয়ার কতা। সন্ধ্যা রাইতে কইলা তুমি রাইতে নায়ে ঘুমাইবা। তোমার কতায় মুই আমি বাড়ি গেলাম। ব্যানে আইয়া দেহি উজানগাঁওয়ের ঘাটে হক্কলের নাও আছে, খালি তোমারডা নাই। আমি বাছেদরে, বড় মামারে, লালমিয়ারে জিগাইলাম, কেউ কইতে পারলো না।
গলা ধাক্কা দেয় আসমান, তোর মাতা খারাপ অইচে হোসেন। দাঁড়ায় না, তীরের গতিতে দৌড় শুরু করে কচানদীর তীরে, উজানগাঁওয়ের উদ্দেশে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে শরীরের সুখ নিমিষে শোকের শূন্য থালায় পরিণত হয় চুমকীর। বসে পড়ে মেঝের ওপর। চোখে মুখে বিষণ্নতার কড়া আগুন। হোসেন আর দাঁড়ায় না, আসমানকে অনুসরণ করে দৌড়াতে থাকে। আসমান কচানদীর ঘাটে নিজের নৌকা লাগানো র্নিদিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ায়, নৌকার গেরাফিটা আছে তীরে কাদার মধ্যে গেঁথে আছে। কিন্তু ওর বিশাল নৌকাটা নেই। নৌকাটার পাছায় বড় একটা লাল সবুজের পাতাকা ওড়ে। সেই পতাকাই ছিল আসমানের মাছ ধরার নৌকার পরিচয়।
গদির পেছনে একটা আলাদা রুম আছে, বসতে বসতে কোমর ব্যথা হলে রুমে ঢোকে শোয়। সুন্দর ছোট একটা খাটে বিছানো তোষক বালিশ। যদিও গদিতে বসে আছে কেরামত, চোখ রাখে সব দিকে। সবচেয়ে রহস্য, এখনো বিয়ে করেনি লোকটা।
উজানগাঁও বাজারে ইতোমধ্যে ঘটনা চাউর হয়ে গেছে। জেলেরা একে অন্যের খুব ঘনিষ্ঠ। কাছে এসে দাঁড়ায় সুবল, লালমিয়া, বাছেদ, সোমনাথ, মোজাম্মেল, আলতাফ। ঘাটের প্রত্যেকের নৌকা আছে, নৌকার ওপর ছান্দি জাল লম্বা করে রাখা। ছান্দি জালের একদিকে ওজনের গোল মাটির পোড়ানো বাটখারা, উল্টোদিকে শুকনো বাঁশের চোঙ্গা বান্দা। নদীর জলে যখন ইলিশ ধরার জন্য জাল ফেলে জেলেরা, মাটির পোড়া বাটখারা নিচের দিকে চলে যায়, আর বাঁশের চোঙ্গা পানির ওপরে ভাসতে থাকে। নদী বা সমুদ্রের জলে ইলিশের ছান্দি জাল লম্বা হয়ে থাকে গভীর জলের সঙ্গে। আর ইলিশেরা তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করলে ছান্দি জালের ফাঁদে আটকা পড়ে। জলের গভীর থেকে জাল যখন জেলেরা টেনে নৌকায় তোলে, জালের ফাঁকে গেঁথে যাওয়া রুপালি ইলিশেরা উঠে আসে। কয়েক মুহূর্ত প্রাণের আকুতি জানিয়ে ছটফট করতে করতে মারা যায় ইলিশ। রাশি রাশি রুপালি ইলিশ সাদা বরফের মধ্যে জমা করে নিয়ে আসে তীরে, গঞ্জে, শহরে। মানুষ মাছ কেনে, জেলেরা বেঁচে থাকে। সেই জেলেদের একজন উজানগাঁওয়ের আসমান। শক্ত সবল মানুষ। তাকিয়ে দেখছে খলবল কচানদীর ঢেউ নির্বাক চোখে, কী করতে পারে?
কাঁধে হাত রাখে লালমিয়া, আসমান? ফিরে তাকায় ও। কাইল রাইতে নাওয়ে আছিলা না?
ছিলাম লাল ভাই। তয় মাঝ রাইতে ভালো লাগছিল না। বাড়ি গেছিলাম।
ও! লাল মিয়ার কিছু বলার থাকে না। তাগড়া জোয়ান বউ বাড়িতে রেখে জামাই কতক্ষণ নৌকায় থাকতে পারে? কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করে, হোসেন ছিল কই?
হোসেনের মায়ের শরীর খারাপ। দাস্ত বমি। হের লাইগার ওরে বাড়ি পাডাইছিলাম।
বুজঝি, কচানদীর বিশাল গহীন বুকের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বলে সোমনাথ, তোমার নাওয়ের ওপর নজর ছিল কারও। সুযোগ পাইয়া নাও বাসাইয়া দেছে।
তোমরা কেউ দেখলা না? হু হু কান্নার সঙ্গে আসমান বসে পড়ে মাটির ওপর, এহন আমি কী করুম। কোতায় যামু? কী খামু?
হোসেন এসে দাঁড়ায় কচার পাড়ে। আসমানকে ঘিরে জটলা ক্রমশ বাড়ছে। অনেকে নিজের মতো করে মন্তব্য করে। কেউ কেউ থানায় যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। মুড়ার বাড়ির আজিজ মিয়া বলে, থানায় যাইয়া কাম নাই। মনে আছে, কয়েক বচ্চর আগে সোলেমানের নৌকাডাও এই রহম আরাইয়া গেছিল। থানায় মামলা করেছিল সোলেমান।
থানায় মামলা হরার পর কি নৌকাডা ফিইরা পাইছিল? প্রশ্ন করে লালমিয়া।
মাথা নাড়ায় ডানে বামে আজিজ মিয়া, না। নৌকা পায় নাই। একবার নৌকা ঘাট দিয়া ছুইট্যা গেলে আর পাওয়া যায় না।
তাইলে আসমানরে থানায় যাইতে কও ক্যা? লাল মিয়ার গলায় ঝাঁঝ। এই নাও কি বাইরের মাইনষে ছাইরা দেচে? না, এই নাও ছাইরা দেচে এইহানের মাইনষে। এই উজানগাঁওয়ের মাইনষে। নাইলে দুহার রাইতে কার নৌকায় কেডা থাকলো না, কেডায় খেয়াল রাহে?
লাল মিয়ার ঝাঁজালো কথায় সবাই চুপ। কচার পাড়ে সর্বহারার শোকে বসে আছে নির্বাক আসমান। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে নৌকাটা তৈরি করেছে দুই বছর আগে। ধীমান ঘোষের কাছ থেকে এগারো হাজার টাকা সুদেও এনেছে। এক বছরের মাছ বিক্রি করে ধীমান ঘোষের আট হাজার টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে। চুমকীকে বিয়ে করেছে। পুরাতন ঘরটাকে মেরামত করেছে।
উজানগাঁওয়ের সবাই জানে, আসমান যে নাওয়ে কাজ করে, সেই নাওয়ে মাছ পাওয়া যায় বেশি। কেউ মাছ না পেলেও আসমানের নৌকা কখনো শূন্য ফেরে না। সবাই ওকে নৌকায় চায়। এই সুযোগে আসমান নিজের দাম বাড়িয়ে দেয়। যখন অন্যরা সমুদ্রে মাছ ধরার মওসুমে নিতো খাওয়াসহ ছয় থেকে সাতশো টাকা, তখন গোপনে মহাজনদের সঙ্গে চুক্তি করে নিতো দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। কয়েক বছর সিজনে সমুদ্রে যাওয়ার টাকা জমিয়ে, ধীমান ঘোষের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে, শারীরিক পরিশ্রম করে নৌকাটা বানিয়েছে আসমান। নৌকা বানানোর সময়ে দিন রাত পরে থাকতো কচানদীর পাড়ে, নৌকার কাছে। দুপুরের দিকে, কিংবা রাতে অথবা হাটের সময়ে কেউ যখন থাকতো না, ছুটে আসতো চুমকী।
খ.
চুমকী উজানগাঁওয়ের কলিম সরদারের ছোট মেয়ে। গ্রামের দুই মাথায় দুই গৃহস্থের বাড়ি। কলিম সরদারের সঙ্গে আসমানের বাবা এলাহী মিয়ার বন্ধুত অনেক দিনের। সেই সুবাধে প্রায়ই আসা যাওয়া ছিল দুই বাড়ির মানুষের মধ্যে। আসা যাওয়ার সূত্রে দুজনে দুজনকে আবিষ্কার করে এক শীতের সন্ধ্যায়। কলিম সরদারের বাড়িতে ধানের মাড়াই চলছে। শীত আকাশের গায়ে অর্ধ চাঁদ। গ্রামের পথে পথে নারকেল গাছের, সুপুরী গাছের, আম গাছের, গাব গাছের, কলা গাছের পাতা চুইয়ে চুইয়ে পরছে ফোটা ফোটা স্নিগ্ধ শিশির। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। চারদিকে মিহি কুয়াশার চাদর। উঠোনে ধানের গোলাকার মাড়াইয়ের ওপর ছেলেমেয়েরা গরুর পেছনে পেছনে ঘুরছে। একে অন্যের ওপর হুমড়ি খাচ্ছে। শরীরে একটা কালো চাঁদর পেছিয়ে আসমান দেখছে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের খেলা। ঘরের মধ্যে থেকে বের হয়ে আসে চুমকী। চুমকীর বয়স ষোলো বছর। স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যেতে দেয়নি বাবা কলিম সরদার। মনে মনে ভালো একটা ছেলে খুঁজছে। আসমান ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর বাবার ছান্দি জালের নৌকায় উঠেছে। নৌকা, ছান্দিজাল, জলের নিচের ইলিশের জলপ্রেম আসমানকে খুব ভাবায়। জলের ভেতরে রুপালি ইলিশের রহস্য বোঝার চেষ্টা করে। চকচকে ইলিশ জলের ঘরে বসত সংসারের রহস্য কী? কিন্তু কোনো সন্ধান পায় না ইলিশ মনের। ইলিশ মনের সন্ধান না পেলেও আসমান লতার মতো লতানো চকচকে চুমকীর মনের-শরীরের রহস্য জানতে খুবই আগ্রহী। দুই সংসারের আসা যাওয়ায় একটা সম্পর্ক থাকলেও নিবিড়ের খনন এখনো করে উঠতে পারেনি। সেই খননের আশায় যখনই সুযোগ পায়, চলে আসে সরদার বাড়ি। তাকিয়ে থাকে চুমকীর দিকে। চুমকী মুখে গোপন ধারালো হাসির ছুরিতে উপভোগ করে গোপন খেলা কিন্তু ধরা দেয় না আসমানের কাছে। চুমকী ঘর থেকে নেমে উঠোন পার হয়ে রাস্তার দিকে যেতে থাকলে, নিঃশব্দ বিড়ালের মতো পিছু নেয় আসমান। পেছনে গিয়ে দেখে চুমকী এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। দ্রুত হেঁটে চুমকীর পাশে চলে আসে আসমান।
চুমকী, কই যাও?
বিদুত্যের গতিতে পেছনে তাকায় চুমকী, কমু ক্যা? আর আপনে আমার পিছে পিছে আহেন ক্যা?
আইলে কী অইবে?
মাইনষে দেখলে কী কইবে? আপনে চইলা যান। আমার পিছে আপনার এই ঘুরঘুর আমার ভালো লাগে না, চুমকীর গলায় বিরক্তি।
হাচাই? দুজনে কথা বলতে বলতে গেন্দা মিয়ার নাড়ার পাজা পার হচ্ছে। বাড়িতে পান নাই। গেন্দা মিয়ার বাড়ি থেকে দাদি পান আনতে পাঠিয়েছে।
যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ায় চুকমী, হ। হাঁচাই কইতেছি। আপনের এই ঘুরাঘুরি আমার ভালো লাগে না। আপনে আর আমার পিছে ঘুরঘুর করবেন না।
ঘুরলে কী অইবে?
আমার পিছে ঘুরলে করলে আমি বাজানরে কইয়া দিমু।
চুকমীর কথা শেষ হতে পারে না, আসমান দু’হাতে জড়িয়ে ধরে পাশে ডাই করে রাখা শুকনো নাড়ার মধ্যে গড়িয়ে পড়ে। চুমকীর বুকের ওপর আসমান, দু’জনের মাথা ও শরীরের ওপর নাড়ার হালকা আচ্ছাদন। আচ্ছাদনের নিচে চুকমী, চুমকীর ওপর আসমান। চুকমী ভয়ে বিহ্বল হয়ে জড়িয়ে ধরে আসমানকে। আসমানও জড়িয়ে আছে চুমকীকে। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোনো জাগতিক শব্দ নেই। এক সময়ে চুমকী অনুভব করে ওর মুখ আটকে গেছে একজোড়া নির্মম নরম আঠালো ঠোটের আক্রমণে। আক্রমণটা ভালো লাগছে চুমকীর কিন্তু ভয়ও আসছে শরীর কাঁপিয়ে।
আমারে ছাড়েন, ফিসফিসিয়ে বলে চুমকী।
আমারে ভালোবাসো?
জানি না। আমারে ছাড়েন, দাদি আমারে পানের লাইগা পাঠাইচে। দেরি অইলে খবর আছে। ছাড়েন। নাড়ার মধ্যে একটু শক্তি প্রয়োগ করা চেষ্টা করে চুমকী। কিন্তু পাথরের ওজনে শরীরের ওপর আসমান।
না কইলে ছাড়মু না। চুমকী কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব ধীরে একটা কামড় দেয়, না ছাড়লে আরও জোরে দিমু।
দেও, অস্ফুট বোল চুমকীর গলায়।
না কইলে কামড়াইয়া কান ছিইরা গেলেও আমি তোমারে ছাড়মু না সোনা।
আপনে একটা গাধা। কিচ্ছু বোঝেন না!
চুকমীর আলতো কথায় আসমান কচানদীর অথৈ জলের সকল ইলিশ রহস্য আবিষ্কার করার আনন্দে ওর বুকের ওপর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। দ্রুত উঠে দাঁড়ায় চুমকী। চলে যায় আরও দ্রুত। কিন্তু আসমান শুয়ে থাকে সোজা নাড়ার ওপর চিৎ হয়ে। সরাসরি তাকালে একেবারে চোখের ওপর আকাশের আধফালি চাঁদ নেমে আসে ওর ঘোরলাগা চোখের ওপর। মেয়েদের শরীরে এত সুন্দর গন্ধ! গোটা চেতনার জগৎটাই পাল্টে যায় আসমানের এক সন্ধ্যার শুকনো নাড়ার বনে, চুমকীর সঙ্গে ইলিশ জলের সাঁতারে।
গ.
কচানদীর গভীর জলের স্রোতে মাছ ধরার নৌকা হারিয়ে যাওয়ার ছয় মাস পর এক দুপুর। উজানগাঁওয়ের সবচেয়ে বড় মহাজন কেরামত আলীর আড়তে ঢোকে আসমান। কেরামত আলীর গায়ে সাদা ফুরফুরে পাঞ্জাবি। মাথায় হালকা চুল। হালকা পাক ধরেছে চুলে। কিন্তু মেন্দীর রঙ লাগিয়ে চুল লাল করে রাখে। মুখে থাকে সুগন্ধী জর্দার পান আর হাতে জ্বলে সিগারেট। লম্বা একহারা গড়নের শরীরে কোনো মেদ নেই। দেখলে মনে হয়, প্রাচীন কালের কোনো মানুষ। মুখে সব সময়ে হাসি লেগেই থাকে। যখন কথা বলে, মনে হয় কথায় কথায় মিহি সুতোয় জাল বোনে। শরীরের তুলনায় গলার স্বর একটু কম। গদির ওপর আসন দিয়ে বসে এমন এক জায়গায়, যেখান দিয়ে উজানগাঁও মোকামে যত নৌকা আসা যাওয়া করে, ঘাটে ভেড়ে—সবই দেখতে পায়। কেবল উজানগাঁওয়ের ঘাট নয়, কচানদীরও অনেক খানি চোখের সীমানায় থাকে। কেরামত আলীর আড়তে দিন রাত জেলে, ক্রেতার আনাগোনা। নাম কেরামত আলীর মাছের আড়ৎ। গদির পেছনে একটা আলাদা রুম আছে, বসতে বসতে কোমর ব্যথা হলে রুমে ঢোকে শোয়। সুন্দর ছোট একটা খাটে বিছানো তোষক বালিশ। যদিও গদিতে বসে আছে কেরামত, চোখ রাখে সব দিকে। সবচেয়ে রহস্য, এখনো বিয়ে করেনি লোকটা।
বয়স তো কম অইলো না। বিয়া করবা না? ইয়ার বন্ধুরা প্রশ্ন করলে, হাসে।
বিয়া করার যন্ত্র নাই আমার কাছে। বিয়া কইরা কী করমু? বিয়া করার পর আমার পেয়ারের বউ পিরিত করবো আমার আড়তের কোনো পোলার লগে। সহ্য করতে পারমু না। খুন কইরা হালামু। তার চাইয়া মাঝে মধ্যে বানীশান্তা যাই হেউডা ভালো, কেরামতের সাফ উত্তর। ফলে, বন্ধুরা কেরামতের বিয়ে বিষয়ে আর আগ্রহ দেখায় না। সুখী উড়ন্ত জীবনের প্রতিবিম্ব উজানগাঁওয়ের সুপুরুষ কেরামত আলী।
আসমানকে আড়তে ঢুকতে দেখেছে কিন্তু চারপাশের জেলে আর ক্রেতাদের সঙ্গে কথায় আর ব্যবসায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখেছে আগের সেই তাগড়া বলিষ্ঠ আসমান নেই। শুকিয়ে গেছে। মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি। শরীরে একটা পুরনো গেঞ্জি। মাথায় ওর বাবরী চুলের তেল চকচকে ভাবটাও হারিয়ে গেছে। মায়া লাগে খুব কেরামতের। লোকজন কমলে হাঁক পারে কেরামত, ও আসমান? আসমান?
চোখ তুলে তাকায়। মুখে হালকা হাসি আনে, আইচি তো অনেক আগে। দেহি আপনে মাইনষের লগে কতা কইতেছেন।
হ, আমিও তোমারে দেখছি। কিন্তু হালার মাইনষের জালায় একটা কতা কমু, হের সুযোগ নাই। আহো কাছে আহো। দূরে বইয়া থাকলেতো কতা কওন যায় না, ইশারায় দেখায় কেরামতের সামনের চেয়ারটা। আসমান উঠে কেরামতের সামনের চেয়ারে বসে। দুপুরের পর, সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। গঞ্জের আলীশাহ হোটেল থেকে খাবার চলে এসেছে।
আসমান, আমার লগে দুইডা ভাত খাইবা? খুব দরদি গলায় জানতে চায় কেরামত আলী। আসমান চোখ তুলে তাকায় কেরামতের দিকে, হোনো আসমান। আমি তোমার নাও আরাইয়া যাওয়ার খবর তো হেইদিনই হনুচি। কয় মাস অইলো তোমার নাও আরাইচে? ছয় মাস? হয়, ছয় মাস তো অইবেই। কত মানুষ তোমার কাচে গেচে, আমি কিন্তু যাই নাই একফিরও। ক্যান যাই নাই, জানো? তোমার লগে একটা ঝামেলা ছিল। তোমার সামনে আমারে দেকলেই কইবে, ওই কেরামত হারামজাদা, কেরামত আইচে কাডা গায়ে নুনের ছিডা দেতে। মুই এই উজানগাঁওর পোলা। এই দ্যাশের সব হালারে চিনি। হের লাইগা যাই নাই। বোজ্জো?
ঘাড় কাত করে আসমান, বুঝজি।
এই কাঞ্চন, আমাগো দুইজনরে খাইতে দে।
আড়তের কামের মানুষ কাঞ্চন দুই থালায় ভাত, গরুর মাংস, সীমের ভর্তা, চিংড়ি মাছের সঙ্গে লাউয়ের তরকারি সামনে রাখে। বদনার পানিতে হাত ধুয়ে খেতে বসে দু’জনে। খেতে খেতে জানতে চায় কেরামত, যহন আইচো বুঝতে পারছি একটা উদ্দেশ্য আইচো। হেইডা কী?
আমি আপনের নৌকায় সমুদ্দুরে যাইতে চাই কেরামত চাচা। ঘরে কোনো খাওন নাই। বৌডার মোহের দিকে আর চাওন যায় না, গলা ধরে আসে আসমানের।
অবাক তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত কেরামত, এগিয়ে দেয় পানির গ্লাস। ছাড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস, তুমি আমার নৌকায় আগেও তো গেছ সমুদ্দুরে। তুমি যে নাওয়ে যাও, হেই নাও বেশি মাছ পায়। তোমারে লইয়া কাড়াকাড়ি পরতো। আর হেই তুমি আমার নায়ে সমুদ্দুরে যাইবা? তোমার বাপের লগে আমার কম খাতির আছিল, তুমি ক্যা, হারা উজানগাঁওয়ের মানুষেও জানে। তয় এতদিন বাদে আইলা ক্যা?
আমি অন্যর নৌকায় যাইতে চাইছি কিন্তু আমার নৌকা আরাইয়া যাওয়ার পর আর কেউ নিতে চায় না। আমার সামনে না, পেছনে কয়, যার নৌকা আরায় হের ভাগ্য ভালো অয় ক্যামনে!
এতদিনে তোমার স্বামী আসমান সমুদ্দুরের জলে ধুইয়া গেচে নাইলে কুমোইরে খাইয়া হালাইচে। আর যদি বাঁইচ্চাও থাহে আর হাতরাইয়া আইতে পারবে না। এহন আমিই তোমার আসমান। তুমি আমার ইলিশ। এক্কেরে কাঁচা ইলিশ!
থালার শেষ লোকমা মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে হাসে কেরামত, সব হালায় বলদ। আরে নৌকা আরাইয়া যাওয়ার লগে ভাগ্যের কি কোনো যোগাযোগ আচে? আমার তিনটা নৌকা গেছে সমুদ্দুরে। আর একটা রেডি অইতেছে। আগামী শুক্রবার জুম্মার নামাজ পইরা রওয়ানা করাইয়া দিমু। তয় একটা কতা আসমান।
আসমান অজানা আশঙ্কায় চকিতে তাকায়, কী কতা চাচা?
তুমি আমার এই নাওয়ের প্রধান মাঝি অইবা।
এইডা কেমনে অইবে? আমি তো জানি, আপনের এই নৌকার মাঝি আগেই ঠিক অইয়া আছে, সেকান্দার কাকা।
ঠিকই আছে, আমি হেরে পরের নৌকায় পাডামু। তুমি এই নৌকায় যাও। তুমি গেলে নৌকায় মাছ পরবে বেশি। আমার আয়ও অইবে অনেক। তোমারে যা কইচি, হোনো।
আপনে যা কইবেন চাচা, গ্লাসের পানি শেষ করে সম্মতি জানায় আসমান।
আর হোনো, পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে দেয়, জানি তো ঘরের অবস্থা। তুমি যদি নাও আরাইয়া যাওয়ার লগে লগে আইতা আমার কাছে, তোমার এত কষ্ট অইতো না। মাইনষে আমারে খারাপ কয়, আমার বাপ মা তুইলা গালাগাল করে, সব আমার কানে আহে। কিন্তু কিচ্চু কই না। কইয়া কিচু অয় না। আমি আমার কাম ঠিকই কইরা যাই, কোনো হালায় ঠেহাইতে পারে না। যেমন তোমারে আমি আমার নাওয়ে প্রধান মাঝি বানাইয়া পাঠামু সমুদ্দুরে, হ্যাতে কোন হালার কী? একটু হাসে কেরামত, যাও। বাড়ি গিয়া বালা কইরা বাজারঘাট হরো।
ঠিক আছে চাচা, টাকাটা হাতে নিয়ে কেরামত আলীর আড়ৎ পার হয়ে রাস্তায় নামে আসমান। কেরামত একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে সিদ্ধান্ত নেয়, বিকালের গাড়িতে মংলার বানীশান্তায় আখিরানীর কাছে না যাইতে পারলে শরীর আর মন সুস্থ অইবে না। সারা শরীর আগুনের নাহান জ্বলতেছে। শরীরের এই জ্বলুনিটাই যত্ত সমস্যা।
ঘ
হয়! আসমানের নৌকা আমিই দড়ি কাইট্টা ভাসাইয়া দিছি শ্যাষ রাইতে, বাসরঘরের সুজ্জিত খাটে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে হাসি হাসি মুখে কথা বলছে কেরামত আলী। সামনে নতুন বৌয়ের সাজে বসে আছে চুমকী। গভীর আয়াত দৃষ্টিতে দেখছে বিছানায় শোয়া মানুষটিকে। কী নির্বিকার বলে যাচ্ছে সর্বনাশের পাঁচালী নির্বিকার উদ্দীপ্ত মুখোশে। বাসরঘরের নরম বিছনায় শরীর এলিয়ে আত্মকর্মের পাঠশালা খুলে বসেছে নতুন স্ত্রীকে শোনানোর জন্য। চুকমীর শরীরের ওপর দিয়ে প্রথম ঝড়টা বয়ে গেছে বাসরঘরে ঢোকার পর পরই। এখন রাত কত? গভীর? না শেষ দিকে? চুমকীর ইচ্ছে করছে বাসর ঘরের দেয়াল, চারদিকে ঝোলানো ফুলের ঝালড়, শরীরের দামি শাড়ি, কানের দুল, হাতের বালা খুলে ছিঁড়ে বের হয়ে যেতে। কিন্তু যাবে কোথায়?
আসমানের সঙ্গে বিয়ের বছর খানের পর কালা জ্বরে মারা যায় বাবা কলিম সরদার। মা মারা যায় ছোটবেলায়ই। যে দাদির ছায়ায় বেড়ে উঠছিল, সেই দাদী মারা যায় পুত্র কলিম মারা যাওয়ার তিন মাসের মাথায়। দুই ভাই আগেই বিয়ে করেছে। বউ-সংসার-ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের মতো আছে, ছোট বোনের দিকে তাকানোর সময় নেই। আর আসমান? আসমান তো ছিল চিরকালের সর্বহারা। ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় মা বড় বন্যার বছর। বাবা সুন্দরবনের মৌ সংগ্রহ করতো প্রতি বছর শীতকালে। এক শীতে মৌ সংগ্রহ করতে গিয়ে আর ফেরেনি, বাঘের পেটে আশ্রয় নিয়েছে। লাশটাও পাওয়া যায়নি। একেবারে শিকড়বাকড়হীন একটা মানুষ আসমান। চুমকীকে আঁকড়ে ধরেছিল জীবনের শেষ দান হিসেবে। কিন্তু অলক্ষ্যের শিকারি আগেই ওঁৎ পেতে ছিল জীবনের দুয়ারে, ক্ষুধার্ত নেকড়ের দাঁতাল হা নিয়ে।
মানুষটা সাগর দিয়া ফিইরা আইলো না ক্যা?
আড়মোড়া ভাঙে কেরামত আলী। শোয়া থেকে বসে চুমকীর মুখোমুখি, তোমার তো এইডা দ্বিতীয় বাসর। আমার তো পরথম। হুনচি বাসর রাইতে বউরা নানান রহমের গল্প হরে। আর তুমি? তুমি তোমার সমুদ্দুরে আরাইয়া স্বামীর খবর লইতে আছো আমার কাছে? তুমি কও, আমার কি এইডা ভালো লাগে? বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে চুমকীকে, গভীর অনুরাগের সঙ্গে চুমু খায় চুমকীর শুকনো ঠোটে। ওর শরীরটা কাঠের মতো শক্ত, নিরেট। কিন্তু নির্বিকার কেরামত চুমু খেতে খেতে এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে তাকায় নতুন বউয়ের মুখের দিকে। নতুন বউ কাঁদছে। দুই চোখের কোণ বেয়ে নামছে নির্মল পানি।
চুকমীকে আড়াআড়ি কোলে নিয়ে ওর এলায়িত বক্ষযুগল নাড়াতে নাড়াতে বলে, চুমকী তুমি আমার একমাত্র বিবাহিত বউ। আমার চরিত্র বিষয়ে তোমার জানা থাহা ভালো। আমি মানুষটা একটা খাটাশ। খাটাশ তো বোঝো? বাড়ির পালা মুরহা ধইরা ধইরা খায়। তয় আমি খাটাশ না, ইশিলের ব্যবসা করি। বুঝি ইলিশোর গোন-কহন কোতায় ইলিশ পাওয়া যাইবে, বুইঝা নাও পাটাই, নাও ভইরা ইলিশ আহে। ইশিল বেচি। টাকা কামাই। গভীর গাঙ্গ বা সমুদ্দুরের ইলিশ মাছের রহস্য এহনও বুঝতে পারি নাই। তয় মাইয়া মাইনষের রহস্য কিছুডা অইলেও বুঝঝি। হারা জীবন বিয়া না কইরা কাঠাইলাম। ভাবছিলাম, জীবনে আর বিয়াই করমু না। কিন্ত একদিন তোমারে সরদার বাড়ির সামনের পুহুর দিয়া কলসী ভইরা পানি নেওনের সমায় দেখলাম। তোমারে দেহার লগে লগে সিদ্ধান্ত নিলাম, তোমারে বিবাহ কইরা সংসার করমু। কিন্তু পারলাম না আসমানের লাইগা। আমি কেরামত তো আমার ইলিশ শিকার না কইরা সুস্থ থাকতে পারি না। তয়, আমি জানি ইলিশ শিকারে ধৈর্য লাগে, আল্লার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া, আমারে ধৈর্য দিয়া দুনিয়ায় পাডাইচে। তুমি ছিলা আমার অনেক সাধের ইলিশ। ইলিশের মাছ আর মাইয়া মানুষের শরীরের কাঁচা মাংস আমার খুবই প্রিয়। তোমারে পাইতে আমার পাঁচ বচ্ছর অপেক্ষা করতে অইচে। কিন্তু পাইছি তো আমার ইলিশের মাংস। ঠোঁট নেমে আসে চুকমীর দুই বুকের মাঝখানে কাঁচা ঘামের নোনতা ফোটার ওপর। চুমকী জড়িয়ে ধরে কেরামতকে। শরীরের কোষে বইছে ঝড়। কাপড় খুলছে কেরামত, চুমকীর সোনারঙ শরীর প্রায় উন্মুখ চোখের সামনে, আহ কী সুন্দর জ্যান্ত ইলিশ, গলায় সুর ধরে কেরামত, তুমি আমার ইলিশ, তুমি আমার ইলিশের মাংস।
আপনে কইলেন না?
কী? বুকের গহন গহীন থেকে মুখ তোলে কেরামত।
মানুষটা ফিইরা আইলো না ক্যা?
কেরামত বিছানার ওপর খুব যত্নে, অভিজ্ঞ শিকারির সোপানে শোয়ায় চুমকীকে। নিজেকে স্থাপন করে চুমকীর ওপর, আহারে আমার ইলিশ! তুমি কিচ্ছু বোঝো না? আমার লোকেরা রাইতের আন্দারে ঘুমন্ত আসমানরে গভীর সমুদ্দুরে ফালাইয়া দিচে নৌকা দিয়া। সমুদ্দুর! অনেক দূর। হাতরাইয়া আর আইতে পারবে না আসমান কোনোদিন। এতদিনে তোমার স্বামী আসমান সমুদ্দুরের জলে ধুইয়া গেচে নাইলে কুমোইরে খাইয়া হালাইচে। আর যদি বাঁইচ্চাও থাহে আর হাতরাইয়া আইতে পারবে না। এহন আমিই তোমার আসমান। তুমি আমার ইলিশ। এক্কেরে কাঁচা ইলিশ!