চৈত্রের আদুরে হাওয়ায় মন খারাপের মধ্যে মল্লিকার খুব ইচ্ছে করছিল দ্যুতি আর অরিত্রির সঙ্গে আড্ডা দিতে, কিন্তু কোথায় কে? দ্যুতি সমাজ উদ্ধার করতে আসাম আর অরিত্রি সম্পর্ক রক্ষার তাগিদে মুম্বাই। ওরা না থাকলে মল্লিকার বেশ একলা কাটে। কলেজ, সংসার, ছেলে; সব সামলে নিজের অবসর বড় কম। সেই অবসর বুননের সময় যাপন সে তো একারই। সাধ করে লাগানো নীলমনি লতার দিকে চেয়ে চোখে জল আসে অজানা কারণে অথবা কোনো এক ফোনকলের অপেক্ষায়। ফোন বাজলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করে মল্লিকার, পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে। মনের মধ্যে জমে থাকা সব শব্দ মাঝে মাঝে থেমে যায়। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে পাখার ব্লেডের চারপাশে নরম পলির মতো ধুলোর আস্তরণ। ঝাড়া হয়নি অনেকদিন। আনমনেই হাত চলে যায় পাশে ঘাড় কাত করে পড়ে থাকা মোবাইলের দিকে। মনে মনে বলে তুই কেন এত নিষ্ঠুর, একবারও কি তোর মনে পড়ে না আমার কথা!
মল্লিকার ছোটোবেলার বন্ধু। সেই সময়ে কখনো কথা বলেনি তারা। কিন্তু মল্লিকার মনে হতো ছেলেটি তাকে পছন্দ করে, অনেক না বলা চাহনির মাঝে সে হারিয়েই ছিল, হঠাৎ এতদিন বাদে আবার যোগাযোগ, সেই বলতে না পারা কথার রেশ যেন চৈতি হাওয়ায় ভেসে এলো। অপেক্ষায় ঘিরে থাকা সারাদিন।
দুই.
এখনো দ্যুতি ও অরিত্রি কেউ ফিরলো না। অপেক্ষারা এদিক-ওদিক দিয়ে হাত-পা মেলে দিয়েছে। কলেজ, বাড়ি, ছেলে, বর সামলে যখন আয়নায় নিজেকে দেখে তখন ক্লান্ত লাগে। হাঁপিয়ে ওঠে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেমনভাবে কেটে যায়, টের পায় না। হঠাৎ দেখে দিন শেষ। মনে পড়লো না শেষ কবে তিনজনে আড্ডা দিয়েছিল। কতদিন গায়ে গা এলিয়ে পা ছডি়য়ে বসে খোলা গলায় তিনজনে গান গাওয়া হয় না। কান্না পাচ্ছে। কাল আবার অফ ডে। সাধারণত ছুটির দিনগুলোতে মল্লিকা, দ্যুতি আর অরিত্রি একসঙ্গে কাটায়। কখনো লং ড্রাইভে, কখনো নাটমুলসে বসে চা খাওয়া, কখনো বা বাড়ির ছাদে বসে আড্ডা। কাল তো সে একা। কেউ নেই এই শহরে যে তার কথা শুনবে, বুঝবে। খুব রাগ হলো বাকি দুজনের ওপর। এইভাবে কেউ ছেড়ে চলে যায়। কী করবে আর ভাবতে না পেরে ক্লান্তি জড়ানো শরীর বিছানার আশ্রয় নেয়।
তিন.
বৃহস্পতিবার সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙতেই দেখলো সব এদিক-ওদিক হয়ে যাচ্ছে। ছেলের কলেজের দেরি ঠিকসময়ে খাবার জোগাড় দিতে না পারায়। বর চা পায়নি বলে বাথরুমে যেতে পারছে না। সকালে উঠে বাড়িতে সবাই মিলে এমন নাচন শুরু করলে কার ভালো লাগে। আড়মোড়া ভাঙা দিন গুটোতে থাকে। সুতোয় টানপড়া জীবন। মল্লিকা ভাবে, কখন একটু একা হবে। নিজের সময়। পলক ফেলতে না ফেলতে কাজগুলো শেষ করতে হয়। সবাই বেরিয়ে গেলে একটু দম নিয়ে দু মিনিট বসে। আবার চোখ চলে যায় অযাচিতভাবে মোবাইলের দিকে, অন্তত একটা মেসেজ। না থাক, একটার পর চাহিদা বাড়তে থাকে, আরও আরও…সারাদিন, ঘুমোতে যাওয়ার আগপর্যন্ত। মল্লিকা মনে মনে বলে ওঠে, নিজেকে উন্মোচন করবো তোর কাছে। সে তো হওয়ার নয়। বৌ বাচ্চা নিয়ে ভরপুর সংসার তোর। নিজেও তো আটকে আছি। তার চেয়ে এই চিনচিনে ব্যথাটাই ভালো। অন্তত তুই তো জড়িয়ে রইলি ব্যথার সঙ্গে।
চার.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, ছেলের কলেজ থেকে আসার সময় হলো। তার আগে একটু ঘুরে আসা যাক। বেশি সময় নেই হাতে। অলস দুপুরের হাতছানি। ছায়া দীর্ঘ হতে থাকা জীবন। মোবাইলে হঠাৎ চোখ পড়ে। না কোনো বার্তা আসেনি। এসেছে না চাওয়া দুটো মেসেজ। ইস এখন যদি প্যারিসের কোনো নিজন রাস্তা দিয়ে হাঁটা যেতো। কল্পনায় ডানা মেললেও পৌঁছাতে পারবে না, শাশুড়ির ফোন এলো বলে, ছেলে কি এলো, তা জানতে। ব্যাগ গুছিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে গিয়ে নিজেকে দেখলো অনেকদিন বাদে। এত রোগা আর বিষণ্ন দেখতে হয়ে গেছে। কেন এত বিষাদ, কেন এত জীনর্তা হৃদয়জুড়ে?
যাই হোক আপাতত ভাবনাগুলোকে হাওয়ায় ভাসিয়ে মল্লিকা বাড়ি থেকে বেরোয়। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কোনদিকে যাবে, তারপর হঠাৎ মনে পড়ে অনেকদিন সিগালে যাওয়া হয় না। মল্লিকার যত ভালোবাসা কবিতার প্রতি। একটা নরম মন আছে ওর। সেই নরম মনটা মাঝে মাঝেই ভালেবাসা পেতে চায়। দুহাত মেলে সেই মানুষটিকে আঁকড়ে ধরতে চায়, আর চায় নিজের না বলা অনেক কথার আগল খুলে দিতে, প্রিয় মানুষের কাছে। শব্দবন্ধ ভেদ করে তার সেই অক্ষরগুলো উন্মুক্ত হোক। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সাদান এভিনিউয়ের রোদ আলোমাখা ছায়া ফেলা রাস্তা দিয়ে সোজা হাজির হয় গিগাল।
পাঁচ.
অনেকদিন বাদে আসলে যা হয়, দোকানের চরিত্র পাল্টে গেছে। যেভাবে সাজানো ছিল বইগুলো আর সেইরকমভাবে নেই। বুঝে নিতে একটু সময় লাগলো। কত নতুন কবিতা নিয়ে বই এসেছে, এসব খবর না রাখলে নিজেকে আপডেটেড করা যায় না যেটা খুব জরুরি। বই এর অনুষঙ্গই আলাদা। তার গন্ধ, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে মনে হয় প্রিয়জনের সঙ্গেই আছি। কবিতা থেকে পিছিয়ে এসে সিনেমার তাকের সামনে যখন দাঁড়িয়ে দেখে তাকের ঠিক অন্যদিকে একজন বিদেশি খুব মন দিয়ে বই দেখে যাচ্ছে। ভারি সুন্দর সে, সুপুরুষ, নীল চোখ, একটা ছোট্টো হাসি ছিল হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যাওয়াতে। আবার মনোযোগ দিয়ে বই দেখতে শুরু করলো। মল্লিকার চোখ সরছিল না, বই ছেড়ে চোখ আটকে গেছে ওই বিদেশিতে। লাল রঙের ফ্যাবের পাঞ্জাবিতে আর ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। ছেলেটিকে সিগালের কর্মচারীরা অনেকেই চেনে। হয়তো কলকাতায় আছে অনেকদিন বা মাঝেই মাঝেই আসে।
মল্লিকার যে কটি দরকারি বই নেওয়ার ছিল, তা তুলে নিলো। হাত ভরে গেছে। ইচ্ছে করছিল বিদেশি ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে। দৈনন্দিনতার একঘেয়েমি কাটাতে যদি বন্ধুত্ব করা যায়। ছেলে কলেজ থেকে ফিরবে তাকে খেতে দিতে হবে, মনে পড়ে যায়। মল্লিকা বইয়ের ভার নিয়ে এগোতে থাকে কাউন্টারের দিকে বিল করানোর জন্য। বিলিংয়ের ছেলেটি অন্য জায়গা থেকে তরিঘড়ি তাকে দেখে ছুটে আসে। দিদিকে অনেকদিন বাদে দেখলাম। বিদেশির সঙ্গে আর ও দুই-একবার চোখাচোখি হলো। মল্লিকার চোখে কি কোনো নীরব আহ্বান ছিল?? হঠাৎ লক্ষ করলো ছেলেটিও অনেক বই নিয়ে বিশেষ করে সিনেমা-সংক্রান্ত বই নিয়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ালো বিলিং কাউন্টারে। মল্লিকা তো খুব লাজুক। কারও সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আলাপ করার সাহস নেই। এই দ্যুতি হলে এতক্ষণে আলাপ সেরে কোন দেশ, কবে এসেছে, কবে যাবে, বাড়িতে কে কে আছে, কোন স্কুল কলেজ সব জেনে ফোন নং নিয়ে চলে আসত। মল্লিকা এইসব কারণেই ওকে খুব মিস করে। ও লজ্জা ভাঙার সাহসটা পায় ওদের কাছ থেকে, তাই ওরা শহরে না থাকলে মল্লিকার এত অসহায় লাগে। বিলিং কাউন্টারে বিল হয়ে গেলে একটু পিছিয়ে এসে ব্যাগের মধ্যে বইগুলো গোছাতে শুরু করে সে, আর মাঝে মাঝেই ছেলেটিকে দেখে নেয়। খানিকটা ইচ্ছে করেই দেরি করছিল ছেলেটির বিল করা হয়ে গেলে যদি একসঙ্গে বেরুনো যায়! যদি দেখে নেওয়া যায় সে কোনদিকে যাচ্ছে। ছেলেটির ও বিল হতে দেরি হচ্ছে, অনেক বই তার ওপর অন্য কী একটা বই আনতে আবার সে ভেতরে চলে গেলো। ধুর আর লাভ নেই অপেক্ষা করে।
ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে এলো। চৈত্র হাওয়ায় এলোমেলো চুল, ব্যাগ, বই সব সামলাতে সামলাতে মনের কোনো এক অজানা ইচ্ছাকেই প্রশ্রয় দিয়ে ফেললো। ছেলে হয়তো কলেজ থেকে ফিরে এসেছে, বর হয়তো চায়ের অপেক্ষা করছে, তা ও একদিন এই মুহূর্তটা নিজের জন্য বাঁচা, বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইল সেই বিদেশি ছেলেটি আসার অপেক্ষায়। মনের মধ্যে যেন ফুল ফুটছে, আলাপ করেই ছাড়বে, প্রায় কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। একটাই তো পথ এদিক দিয়েই তো বের হতে হবে, তাহলে কি আবার বই দেখতে শুরু করলো? হয়তো হবে, সবটাই তো অনুমান। অতএব, সিদ্ধান্ত বাড়ি ফেরার, যা হওয়ার নয় তার জন্য অযথা ভেবে লাভ নেই। মন খারাপের পারদ চড়লে শরীর খারাপ, সংসারে অশান্তি, তাই নিয়ে বাকি কিছুদিন আরও খারাপ থাকা! পা সরছিল না, খুব বোকা লাগছিল ওর নিজেকে। তাও ফিরতে হবে, ট্যাক্সি ধরে বাড়ির দিকে রওনা, মনে পড়লো সকালে দেখেছিল নীলমনি লতার গায়ে কুঁডি এসেছে, আসলে এরাই আপন, থেকে যায়, যাবে অন্যরা অস্থায়ী ক্ষনিক।
ছয়.
বাড়ি ফিরলো। ব্যাগ রেখে সোজা রান্নাঘর ছেলে হা করে বসে আছে। মা এলে খাবার দিলে খাবে, ছেলের বাবা চায়ের আশায় বসে পা নাচাচ্ছে, ছেলের ঠাকুমা বৌমা বাড়ি ফিরেছে দেখে নিশ্চিন্ত। ছেলের মা কোনোমতে হাত ধুয়ে সংসার সামলাতে দৌড়। প্রায় একঘণ্টা বাদে যখন নিস্তার ঘটলো, তখন জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে হঠাৎ সেই বিদেশির কথা মনে পড়লো। কোথাও বুকের মধ্যে রিনরিন করে বেজে উঠলো। একটা দুষ্টুবুদ্ধি ও মাথায় খেললো। মল্লিকা ভাবলো, চেষ্টা করেই দেখা যাক না। ফোনে ডায়াল করলো সোজা সিগালে, আচ্ছা আমি একটা করপোরেট সংস্থা থেকে ফোন করছিলাম। আমরা একটা সার্ভে করছিলাম। কলকাতা রিজিয়নে বিভিন্ন বইয়ের দোকানে যারা মূলত ইংরেজি বই রাখেন, তাদের, কত সংখ্যক বিদেশি কলকাতায় আসে, আপনাদের দোকান ভিজিট করে বই কেনে? উল্টোদিকের উত্তর কত সংখ্যক বলতে পারব না, সেটা একটু ডেটা চেক করে বলতে হবে। কিন্তু এই তো আজকেই একজন বিদেশি এসেছিলেন, অনেক বই কিনেছেন। মল্লিকা বলে ওঠে, তার ফোন নম্বরটা যদি পাওয়া যায়, তাকেই সরাসরি প্রশ্ন করতে পারতাম। ওপাশ থেকে জবাব এলো, সরি ম্যাডাম ব্যক্তিগত কোনো তথ্য আমরা শেয়ার করতে পারব না, জানলেও না।
সাত.
ফোনটা মুহূর্তে কেটে যায়। দরজায় বেল বাজে, বোধহয় ড্রাইভার চাবি দিতে এসেছে। চৈত্রের শেষে হাওয়ার দাপট বাড়তে থাকে কোনো এক কালবৈশাখীর আশঙ্কায়!