ছলাৎছলাৎ শব্দটা হয়তো জলের ধারাভাষ্য। ডিঙি নৌকা জলের কিনারে উলটে রাখলে ভাঁটার পরে জোয়ারের জলের ধাক্কায় এমন শব্দ হয়। এগুলো হলো ভাই পৃথিবীর গোপন আস্তানায় অজানা-অচেনা দুটি মানুষের সম্পূর্ণ নিজস্ব বাক্যালাপ! সুখলাল এভাবেই জলের জীবন ব্যাখ্যা করতে ভালোবাসে। সুখলালের আদতেই কোনো ভাই নেই। কিন্তু কথায় কথায় তার এই ভাই ডাকটিকে পরিচিতজনেরা আজ আর কঠিন করে না ভেবে সহজ করে নিয়েছে। এটাতে একটা সুবিধা এই যে, সুখলালের ভাইয়েরা অগুনতি! কখনো সে নিজেই তার ভাই, আবার কখনো কখনো অতি ক্ষিপ্ত অবস্থায় হাতে ধরা জাল, নৌকো, বৈঠা সবকিছুই তার ভাই হয়ে যায়! এমনকি মুনিয়া অনেকক্ষণ ধরে চন্দ্রপুকুরে বাসনকোসন মেজে ঘরে ফিরলে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে জামগাছটায় লেজ ঝুলিয়ে বসে শিস দেওয়া দোয়েল পাখিটার মতো করে বউকেও ভাই ভাই বলে শিষ দিয়ে ডেকে ওঠে।
করতোয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা তিরতির করা টাঙন আর ডিঙি নৌকার মাঝি দেবনাথ, দীননাথ, রবিউলেরা সব মাঝি। মাঝি মানে জল আর জলযানের মাঝে যারা থাকে। মাঝি মানে খাদ্য আর খাদকের মধ্যে থাকা পাটনি। চলতি কথায়, ‘পার হলে পাটনি শালা’।
আজ সকাল থেকেই ওলট-পালট বাতাসে নদীর পাড়ে জলা-জংলা কেবলই মাথা নাড়ে। এসব বাতাসের কারসাজি, বলেই সুখলাল তার নৌকার দড়ি খুলতে খুলতে দেখতে পেলো, জলজ ঘাস লতার ভেতর দিয়ে সন্তর্পণে এঁকেবেঁকে চলেছে ফিকে সবুজের ওপর সাদা ছিট ছিট প্রাণীটি। এই শান্তিপ্রিয় প্রাণের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে সুখলাল। নিজের মনে মনেই বলে ওঠে, সবুজে সাদায় কী সুন্দর ভাই তুমি! ওদিকটায়, যেদিকে নতুন সেতুটার ওপর দিয়ে সবে শুরু হয়েছে গাড়ি চলাচল, সেদিকেই সাপটা একবার ঘাড় উঁচু করে দেখে নিয়ে আবারও দলিত শ্রেণীর মতো ছোট করে নিজের শরীরকে গুটিয়ে জলাজমির ভেতরে ঢুকে গেলো।
এখন ভাঁটা চলছে। খানিক আগে জোয়ারের জলে বোধহয় ভেসে এসেছে সাপটা! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সুখলাল তার শেষ বিড়িটায় সুখটান দিয়ে নৌকায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। মাঝদরিয়ায় কিছু সময় কাটাতে হবে। কেননা, রবিউল, হুসাইন, কিশোর আগেই সুখলালকে বলে রেখেছে, হাফ বেলায় মাঝদরিয়ায় নৌকা নিয়ে ওদের সঙ্গে মিলিতভাবে গোল গোল করে ঘুরে জলের ওপর বৈঠার আছাড়ি মারতে হবে। এটা একটা সমবেত প্রয়াস। মাল্লাদের বিশ্বাস, সকাল থেকে নদীর ধার বরাবর স্নানঘাটে স্নান, কাপড়কাচা চলতে থাকে বলে মাছেরা মানুষের ভিড় এড়িয়ে মাঝনদীর গভীরে চলে যায়। নিস্তব্ধতা তাদের বেশি পছন্দ। অতএব সেই নিস্তব্ধতাকে সমবেত বৈঠার আছাড়িতে বিদীর্ণ করলে জলতল থেকে মাছেরা আবার অস্থির হয়ে তীরের দিকে চলে আসবে। এরপর পড়ন্ত বেলায় খাপলা জাল ফেলে মাছ ধরা সহজ হবে।
মুনিয়া তার বাম হাত দিয়ে স্বামীর মুখ চেপে ধরে বললো, ও নাম এই সাঁজ বেলায় নিতে হয় না গো!
সুখলাল আজ তার নৌকাটাকে নিয়ে সবার সঙ্গে মাঝদরিয়ায় ঘুরছে বটে। কিন্তু সে একবারও বৈঠা হাতে তুলে জলের ওপর আছাড়ি-বিছাড়ি করছে না। তার মনে তখন অকুল দরিয়ার গভীরে জলজ প্রাণগুলোর শান্তির জন্য আরাধনার ছবি ভাসছে। কখনো কখনো জলের ওপরে ভেসে ওঠা এক একটি মাছকে সে ডেকে বলছে, ভাই, কী নাম তোমার? প্রবীণ সেই গৈরিক দাঁড়ি গোঁফওয়ালা মাছ, বশিষ্ঠমুনি, বলেই জলের গভীরে চলে যাচ্ছে। এমনভাবেই দধীচী, বিশ্বামিত্র, কাশ্যপ, এসব অতি প্রাচীন ভারতীয় আর্য বংশীয় মাছের ঝাঁক উঠছে, ভাসছে, সাঁতার দিতে দিতে গভীর নিস্তব্ধতায় একে-অন্যকে আপন করে নিতে শান্তির জন্য জলতরঙ্গের ওপর তাদের ছায়াটুকু রেখে জলের গভীরে, কোনো এক উপবনের ধ্যান মন্দিরে চলে যাচ্ছে।
শেষ বিকেলের রূপ ছড়িয়ে পরেছে সূর্যপোড়া মাছহাটায়। আড়তদারেরা নিলাম ডাকছে। সুখলালের ধরা আজকের সবচেয়ে বড় আইড় মাছটার ওজন নয় নয় করেও চার থেকে সাড়ে চার কেজি হবে। এসব মাছের কিলো প্রতি দাম হয় না আড়তদারদের কাছে। ঠিকা দাম কড়কড়ে ছয়কুড়ি পঁচিশ টাকা নিয়ে সন্ধ্যার একটু বাদে ঘরে ফিরে এলো সুখলাল।
মুনিয়া…মুনিয়া…আরে ভাই মুনিয়া…। আজ মুনিয়াকে কত কিছু বলার আছে তার!
শ্বশুরের বেটি তবে কি এই সাঁজ বেলায় ঘুমিয়ে পড়লো! সুখলাল এ ঘর সে ঘর করে আঙিনালাগোয়া চন্দ্রপুকুর থেকে দেখলো, একটা লতানো ছায়া এঁকেবেঁকে তার বাস্তুর দিকে এগিয়ে আসছে। সুখলালের চোখে আবারও সেই ঘোরলাগা ভাব। সে স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করে উঠলো, আপনি এখানে? আপনাকে তো আমি সকালের দিকে ঘাটের ধারের জলাজায়গার ওপর দিয়ে সর্ সর্ করে চলে যেতে দেখেছিলাম!
সবুজের ওপরে সাদা ছিট ছিট ছাপের শাড়িটি অন্ধকারে এখন আর অস্পষ্ট নয়। তবে, মুনিয়ার আট মাসের স্ফীত গর্ভের উপরিভাগে উদ্ধত দুধ আসা স্তনের কুঁড়ি দুইয়ের মধ্যে থেকে দধীচী, অত্রি, পুলহ, বিশ্বামিত্র; এসব বড় বড় প্রাচীন সাধক মাছেদের পাশাপাশি আরও এক জলজ সাপ যে, এঁকেবেঁকে সুখলালের বাস্তুর দিকে এগোচ্ছে, সে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলো।
সুখলাল চিৎকার করতে পারলো না। সেই মধ্য দুপুরের মাঝদরিয়ার গভীর ছায়ায় হুঁশ করে ডুবে যাওয়া সেই মৎস্য অবতারটি কোথা থেকে যেন এসে এবার সুখলালের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলো, আমিই বাস্তু। জলা-জংলাতে এখন আর শান্তি নেই! একই মাটিতে গেঁড়ি-গুগলি, কেঁচো, জলজ পোকারা হাওয়া হয়ে বাতাসে মিশে গেছে! বড় একা লাগে মাঝি! তোমার উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাকে তোমার বাস্তুতে একটু ঠাঁই দেবে?
মুনিয়া আজ খুব ভালো করে সেজেগুজে তার স্বামী সুখলালকে ভাতের থালা সাজিয়ে খেতে দিয়েছে। পঞ্চমীর কাস্তে চাঁদ মায়াবী জোছনার জাল দিয়ে সুখলালের মুদ্রা দোষ, ‘ভাই’ নামক সংসার ধর্মের শান্তিকে আচ্ছাদন দিতে চাইছে। আসো। আরও একটু কাছে আসো…সুখলালের গলায় এখন কামনার কামিনী কাঞ্চনের ঘোর লাগা জোয়ারের জলের শব্দ ঘঁৎ ঘঁৎ, আবার কখনো বা ছলছলাৎ আওয়াজ তুলছে।
মুনিয়ার বাহু এখন প্রায়ই সুখলালের বাহুতে ঠেকে গেছে। এঁটো হাতটা ইচ্ছে করেই মুনিয়ার সবুজ-সাদা ছিটছিটে ছাপের শাড়ির ওপর দিয়ে স্ফীত হয়ে ওঠা পেটে রেখে সুখলাল বলে উঠলো, ভাই, তুমি কে? তোমার নাম কী?
মুনিয়া তার বাম হাত দিয়ে স্বামীর মুখ চেপে ধরে বললো, ও নাম এই সাঁজ বেলায় নিতে হয় না গো!
বলো, আস্তিক, আস্তিক, আস্তিক।
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা