আসাদ ভাবছে, এবার সেই অমোঘ ঘোষণাটি দেবে। কিন্তু বুঝতে পারছে না, ঠিক কখন ঘোষণাটি দিলে তীরন্দাজ অর্জুনের শর পাখিকে অক্ষত রেখে ঠিক চোখ ভেদ করে চলে যাবে। ঘোষণাটি এমনভাবে দিতে চায়, যেন আদালতের রায় পুনঃবিবেচনা কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মতো সেই আদেশ তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ না থাকে। বহুদিন ধরে সে ভীমের হাতে দুর্যধন-বধের মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় ছিল। আজ তার বারবারই মনে হচ্ছে, সেই বহুলকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এসে গেছে। চোখ দুটিকে ঘূর্ণায়মান মার্বেলের মতো গোল গোল করে বারকয়েক চারদিকে তাকালো। দেখলো, এই বিগত যৌবনারাত্রির শেষপ্রান্তে এসে দেয়ালে দুটি টিকটিকি রোমান্সে মত্ত। হেমন্তের শিশিরফোঁটা যেমন কচিপাতায় ঈষৎ কম্পন তুলে মাটিতে পড়ে, তেমনি তার ঠোঁট দুটিও তির-তির করে কেঁপে উঠলো। মুহূর্তেই দিকচক্রবালের মতো হাসির রেখা ফুটিয়ে আবার দিগন্তে মিলিয়ে গেলো। তার মনে পড়ে গেলো, চল্লিশ বছর আগে ভরাযৌবনে ঘরে বউ হয়ে এসেছিল রুবিনা। রাত নেই, দিন নেই, দুজনে এমন টিকটিকির মতোই রোমান্সে মেতে উঠতো। যতটা না তার আগ্রহে, তারও বেশি রুবিনার আকর্ষণে।
রোগশয্যায় বাঁকা ধনুকের মতো শুয়ে আছে আসাদ। কী এক অজানা রোগে তাকে কাবু করে ফেলেছে। কষাইয়ের মতো নির্দয়-নিস্পৃহ স্বরে ডাক্তার বলেছে, বাঁচার আশা নেই। যে-কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। ডাক্তারের কথা আসাদও শুনেছে। তাই আহত চিতার মতো অক্ষম আক্রোশে কেবল ফোঁস-ফোঁস করে সে। আর তখনই সে ঘরভর্তি মানুষগুলোর দিকে তাকায়। দেখে কারও চোখ সন্ত্রস্ত, কারও বা উচ্ছ্বল মুখ। কারও ঈদের চাঁদ দেখার খুশির মতো চোখের কোণে আনন্দের বিদ্যুৎরেখা দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। আসাদের শেষ নিশ্বাস ত্যাগের অধীর আগ্রহে আছে রুবিনা থেকে শুরু করে নিকট আত্মীয়রাও। আসাদ ভেবে অবাক হয়, সারা বছর যারা তার খবরটুকু রাখতো না, মৃত্যুপথযাত্রার খবর পেয়ে গুড়লোভী পিঁপড়ার মতো সারি বেঁধে আসছে আজ তারাও।
আসাদ বলেছিল, প্রয়োজনে ডিভোর্স দিয়ে সবুজকে বিয়ে করো। তবু এমনটা করো না। রুবিনা তার আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় কমিশনার ও মসজিদের ঈমামকে ডেকে সালিশও বসিয়েছে। সালিশে আসাদকে রুবিনার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে।
আসাদ মনে-মনে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে বাঁচার। তার মনে হচ্ছে, বড় কোনো ডাক্তারের কাছে গেলে এই যাত্রা সে বেঁচে যাবে, নিশ্চিত। ছেলে রফিক ও ছেলের বউ সুমি সেই কথা বলেছিলও। সুমি বলেছিল, বাবাকে একবার হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয় না? পুত্রবধূর এমন আহাম্মকি প্রস্তাব শুনে কেউটে সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে রুবিনা—তোমার কি আক্কেলের মাথা খেয়েছ? এমনিতেই চিকিৎসার নামে সব টাকা শেষ। এখন হাসপাতালে ভর্তি করলে ঘটিবাটিসুদ্ধ বেচতে হবে। সব বেচে পথে বসলে খাবে কী? যে যাবার সে তো যাবে, আমাদের জন্য তখন কী থাকবে আর?
স্ত্রীর এমন নির্দয় কথায় আসাদের দুই চোখের কোণ বেয়ে তপ্ত লবণাক্ত জল গড়িয়ে পড়ে। ছেলে-ছেলের বউ সেই করুণ-অসহায় দৃশ্য দেখে বটে, কিন্তু রুবিনার রক্তচক্ষুর ভয়ে কিছু বলার সাহস পায় না। তাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে হয়তো, কিন্তু ছেলের লোভী মন বাবার জীবন বাঁচানোর চেয়ে সম্পত্তি রক্ষায় অধিক তৎপর হয়ে ওঠে। সেই দৃশ্যও আসাদের দৃষ্টি এড়ায় না। আসাদ ভাবে, ‘এই সংসারে কেউ নয় আপনজনা’। এইটুকুই বারবার মনে পড়ে, বাকিটুকু স্মরণ করতে পারে না।
আসাদের মনের পর্দায় আবারও ভেসে ওঠে রুবিনার সঙ্গে বিয়ের প্রথম কদিনের ছবি। ফুটফুটে বউ। সারাক্ষণ ঘোমটা পরে থাকে। কেমন যেন লজ্জাবতি ললিত লতা। যেন হাতের স্পর্শ পেলে প্রস্ফূটিত ফুলদল আস্তে করে নিস্তেজ হয়ে যাবে। আহা সেই সব দিন! মনে পড়ে প্রথম সন্তানের জন্মের পর আসাদ-রুবিনার সংসারের আনন্দ ধরে না। রুবিনার বাবার বাড়ির লোকজন সারাক্ষণ হই-হুল্লোড়ে বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ হরিষে বিষাদ জাগলো তখন, যখন আসাদের বাবা-মা এলো নাতি দেখতে। আসাদের শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো, রুবিনার কোমল মুখ হয়ে উঠলো রুক্ষ। তার মুখের দিকে তাকানো যায় না। সে ক্ষেপে যায় আসাদের ওপর—তোমার বাবা-মা আসার আর সময় পেলো না? আমার বাবা-মা এসেছে, তারা নাতিকে নিয়ে একটু আনন্দ করবে। তাদের আনন্দ তো আবার তোমার বাবা-মায়ের সইবে না। আসাদ বুকের ভেতর থেকে উঠতে চাওয়া ক্ষোভের লাভা চেপে রেখে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, নাতির নানা-নানি, দাদা-দাদি সবাই একসঙ্গে আনন্দ করবে। এটাই তো বড় আনন্দ। সবাই মিলে নাতিকে দোয়া করবে, সবাই মিলে আনন্দ-উৎসব করবে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে?
আসাদের কথা শুনে রুবিনা দ্বিগুণ তেলেবেগুনে তেতে ওঠে, কী কও? তোমার গ্রাম্য-জংলি মা-বাপ আর আমার মা-বাপ সমান হইলো? যত্তসব! এমন কপাল নিয়ে দুনিয়ায় আইছি, খ্যাতের লগে সংসার করতে হয়। আসাদ দেখলো ঘরভর্তি মানুষ, এখন তর্ক করা ঠিক হবে না। নিজেকে প্রবোধ দেয়, দ্যাখ আসাদ, এই অন্যায়ের একদিন বিচার হবে। আখেরাত নয়, এই দুন্যাতেই হবে। খালি তোর ছেলেকে বড় হতে দে। ছেলে বড় হবে। বিয়ে-শাদি করবে। ছেলের বউ এসে এমনি করেই একদিন রুবিনাকে অসম্মান-অপমান করবে। তখন তুই কেবল দেখবি, আর হাসবি। তোর লগে হাসবে ওই ওপরঅলা বিধাতাও।
আসাদ কল্পনার ভেলায় অতীতের দুঃখ আর গ্লানিময় দিনগুলোয় ভাসতে থাকে। হঠাৎ রুবিনার কর্কশ কণ্ঠে সম্বিত ফিরে আসে, বুইড়া কোথায় কী রেখে গেছে কিচ্ছু তো কয় নাই আফা। কোন ব্যাংকে কত্ত টাকা রাইখছে তাও তো কোনো দিন কয় নাই। তার কথায় ফোড়ন কাটে, রুবিনার বোন, তাইলে বোন ক তো তোর জামাই কি গোপনে আরেক বিয়া করছে টরছেনি? খোঁজ-খবর কিছু নিছসনি?
বোনের কথা মনে ধরে রুবিনার। বলে, হ আফা, আমারও সে-রহম সন্দেহ হয়। কিন্তু পোলা আর পোলার বউরে কইছিলাম, খবর নিতে, পোলার বউ তো দজ্জাল মাইয়া। আমার কথার পাত্তাই দেয় না। বলে, কী কন এসব মা? বাবা আরেক বিয়া করলে আপ্নের এত্ত অত্যাচার সহ্য কইরাও একই বাড়িতে থাইকতেন? পোলার বউটা না কেমন যেন! শ্বশুরের দিকে যত টান। আর পোলাটা মাগের ভাউরা। মাগের কথার বাইরে যায় না। মায়ের কথার কোনো দাম নাই। রুবিনার এসব অভিযোগ আসাদের কানে আসে। আসাদের ঠোঁট ঈষৎ বাঁকা হয়ে আসে, সঙ্গে ঈদের চাঁদের মতো একচিলতে বাঁকা হাসির রেখাও ফুটে ওঠে। সেই অভিব্যক্তি রুবিনার চোখ এড়ায় না। তীব্র বিদ্রূপের ছলের বোনকে বলে, দ্যাখ দ্যাখ আফা। বুইড়ার একপা কবরে চলে গেছে, যে-কোনো সময় আজরাইল এসে জান কবজ কইরবো। আর বুইড়ার কারবার দ্যাখ। আমার দুক্ষের কথা শুনি মুচকি হাসে!
রুবিনার কথার জবাবে তার বোন কী বলে, তা আসাদের কানে পৌঁছয় না। সে অপেক্ষায় আছে তার উকিল কখন আসবে! জবান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ছেলেকে পাঠিয়েছে উকিলের কাছে। বলেছে, উকিল সাহেবের কাছে আমার দুইটা দলিল আছে। উকিল সাহেবকে বলবি দলিলগুলো নিয়ে আসতে। আসাদ প্রহর গুনছে উকিল আসার, রুবিনা গুনছে আসাদের মৃত্যুর প্রহর। রুবিনা জানে না, আসাদের মনে কী আছে। কিন্তু আসাদ জানে রুবিনার লোভের জিহ্বা লকলক করছে। ব্যাংক ব্যালেন্স, জমিজিরাত, ফ্ল্যাট-প্লট, কোথায় কী আছে, তার হিসাব আর দলিলের জন্য রুবিনা উদগ্রিব, এই সত্য বুঝতে আসাদের কষ্ট হয় না। কিন্তু রফিক ও সুমির মনোভাব সে বুঝতে পারে না। রফিক কখনো মায়ের দিকে পক্ষপাত দেখায়, কখনো বাপের দিকে। কিন্তু সুমি শাশুড়িকে একমুহূর্তও সহ্য করতে পারে না। তবে আসাদকে সম্মান করে ঠিক নিজের বাবার মতো। আসাদের নিজের কন্যাসন্তান নেই, ছেলের বউকে নিজের কন্যাই ভাবে। তাই কখনো বউ মা সম্বোধনে কথা বলে না। নাম ধরেই ডাকে। বিষয়টি যদিও রুবিনার পছন্দ না। এই নিয়ে আসাদ-রুবিনার মধ্যে কম ফ্যাসাদ হয়নি। ফল যে যার অবস্থানে অনড়। রফিকের জন্মের পর যেদিন রুবিনার নতুন রূপ দেখলো, সেদিন থেকে এক সংকল্পে নিজেকে বেঁধেছে আসাদ।
আসাদ ক্ষণ গোনে, ভাবে আর কয়েক মিনিট আছে এই পৃথিবীতে। এরপর চলে যাবে অনন্তলোকে। কী আছে সেই অনন্তলোকে? সে জানে না। সে ভাবেও না। তবে অনন্তলোকে পাড়ি দেওয়ার আগে, সে ভাবে, পৃথিবীতে এসে সে কী কী কাজ করেছে? সমাজ-রাষ্ট্র-মানবকল্যাণে তার কোন কাজ লেগেছে? মনে করতে পারে না। আবার ভাবে, এমন কী কাজ সে করেছে, তা সমাজ-রাষ্ট্র-মানবজাতির ক্ষতির কারণ হয়েছে? তা-ও মনে করতে পারে না। কুরুক্ষেত্রে মহারথী কর্ণের যেমন অন্তিমকালে রথের চাকা মাটিতে দেবে গেছে, তার বিদ্যার বিস্মরণ ঘটেছে। মহারথীকে কর্ণকে তারই অনুজ অর্জুনের হাতে প্রাণ ত্যাগ করতে হয়েছে। তেমনি আসাদেরও সমস্ত কর্মের বিস্মরণ ঘটেছে। পাপ কিংবা পুণ্য কোনো কর্মের কথাই তার স্মরণ হচ্ছে না।
সংসারের সমস্ত লাঞ্ছনার স্মৃতি তার মন থেকে কে যেন ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে। কেবল রুবিনার দেওয়া প্রতিটি আঘাত, প্রতি অপমানের হুল তার বুকে নতুন করে বিঁধছে। হাত-পা নাড়াতে পারছে না। চিৎকার করে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কণ্ঠ থেকে স্বর বের হচ্ছে না। অক্ষম আক্রোশে সে একবার গোঁ-গোঁ করে ওঠে। সুমি আর্তস্বরে কেঁদে ওঠে, ও বাবা কী হয়েছে? পানি দেবো? রুবিনা দেখেও না দেখার ভান করে। একবার কেবল ছেলের খোঁজ নেয়। তখন সুমি জানায়, উকিল আনতে গেছে। উকিল কেন? রুবিনা ভ্রূ কোঁচকায়। বুইড়া মরণের সময় আবার কি কেলেঙ্কারি করতে চায়? না কি সত্যি আরেক বিয়া করেছে, ওই বউরে সম্পত্তি লিখে দেবে? যদি তেমন কিছু হয়, কিছুতেই রুবিনা মেনে নেবে না। তিল তিল করে এই সংসার সাজিয়েছে সে, এই সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সমাজ্ঞী সে। সেখানে কাউকে ভাগ বসাতে দেবে না। আসাদ মরবে, তার মরণব্যাধী হয়েছে। সে মরুক।
রুবিনার আর বয়স কত। সে হিসাব কষে ৪৫/৪৬। এই বয়সে এখনো তরুণীই বলা যায়। পছন্দের পুরুষ তো আছে। আসাদ আজ মরুক, ইদ্দতকাল পার হলেই বিয়ে করবো। আসাদের কাছে কী পেয়েছি? দ্বিতীয় বিয়ে করেছে কি না সন্দেহ করায়, আসাদ গত ৫ বছর আমার সঙ্গে শোয় না। আমার কি শরীরের ক্ষুধা নেই? আসাদেরও কি ছিল না? আসাদ তাহলে কিভাবে চাহিদা মিটিয়েছে? আমার কিভাবে মেটাবো, সেটা কি সে ভেবেছে? রুবিনার দৃঢ় বিশ্বাস—আসাদ কোনো গোপন সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। আরেক বিয়ে করুক বা না করুন, পরকীয়া-টিয়া কিছু একটা অবশ্যই আছে। পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই। বিষয়টি খালাতো ভাই সবুজকে বলতেই সে বলেছে, হতে পারে। তার চাল-চলন সন্দেহজনক। আসাদ যেমন আরেকটা সম্পর্ক করেছে, তুমিও করো। তারটা যেমন গোপন রেখেছে, তোমার সম্পর্কও গোপন রাখবে। সবুজের পরামর্শ রুবিনার মনে ধরে। শুধু মনেই ধরেনি, সে সবুজকেই মনে মনে কামনা করে।
সবুজও সেই অপেক্ষায় ছিল। সময়-সুযোগ বুঝে একদিন তাদের মধ্যে মনোদৈহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বিষয়টি আসাদ টের পেলে রুবিনার সঙ্গে রাগারাগি হয়। আসাদ বলেছিল, প্রয়োজনে ডিভোর্স দিয়ে সবুজকে বিয়ে করো। তবু এমনটা করো না। রুবিনা তার আত্মীয়-স্বজন, স্থানীয় কমিশনার ও মসজিদের ঈমামকে ডেকে সালিশও বসিয়েছে। সালিশে আসাদকে রুবিনার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে। সব শুনে আসাদের বাপ-চাচা বলেছিলেন, এই বউকে তালাক দে। তোর জীবন তো মাত্র শুরু। সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। এই বউ নিয়ে সারাজীবন লাঞ্ছনা পোহাতে হবে। আসাদ রাজি হয়নি। বলেছিল, বউকে তালাক দিলে বউয়ের আরেক বিয়ে হবে। আমারও হবে। কিন্তু আমার ছেলেটার কী হবে? বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের জন্য ছেলেটা আজীবন আমাকেই দোষারোপ করবে।
সে জানে মহাপ্রস্থানের পথে একবার পা বাড়ালে আর পেছনে তাকানো যায় না। ভাই-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনের মায়া ত্যাগ করেই যেতে হয়।
আসাদের যুক্তি শুনে তার চাচা করিম মাতুব্বর মানুষের সম্পর্ক নিয়ে ছোটখাটো বক্তৃতা না দিয়ে পারেনি। মাতুব্বর বলে, দ্যাখ বাবা যখন কোনো ভবনের ভেতর থেকে যখন ফাটল ধরে, তখন তাকে ভেঙে ফেলে নতুন ভবন তৈরি করা উচিত। কিন্তু মানুষ তা না কলে ওপর থেকে প্লাস্টার করে ফাটলটা মুছে দেয়। তাতে বাইরে থেকে ভবনকে মসৃণ মনে হয় মাত্র, কিন্তু ভেতরের ফাটল আরও ভয়ানক হতে থাকে। ভবনের ফাটল মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সতর্ক বার্তা। যখন কোনো সম্পর্কে ফাটল ধরে, তখন মানুষের উচিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। আর সম্পর্কে সম্পৃক্ত লোকদের পরস্পরের কাছ থেকে সম্পূর্ণ রূপে আলাদা করে দেওয়া।
চাচার কথা শোনার মতো ধৈর্য ও মানসিক শক্তি কোনোটাই আসাদের ছিল না। তাই সে অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বলে, চাচা এসব তাত্ত্বিক কথা রাখেন। মানুষের জীবন আর ভবন কি এক হলো? করিম মাতুব্বর ভাতিজার কথায় ভেতরে ভেতরে অপমানিত হলে ওপরে তা প্রকাশ করেন না। বরং রাতের কলাপাতায় চাঁদের আলোর ঝিলিক দেওয়ার মতো একচিলতে হাসি দিয়ে বলেন, সম্পর্ক আছে বাবা। মানুষের সম্পর্কের ফাটল ও ভবনের ফাটলের মধ্যে গভীর মিল আছে। ভবনের ফাটলের ওপর যেমন প্রলেট দিলে ফাটল সারিয়ে তোলা যায় না, তেমনি টক্সিক রিলেশনেও বাইরের লোকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের আভরণ পড়ে হয়তো। কিন্তু তাতে ওই সম্পর্কের কোনো উন্নতি ঘটে না। বরং দুটি মানুষ যতদিন একই ছাদের চিনে থাকে, ততদিন অসুখী জীবন যাপন করে। নারীপুরুষের পরস্পরের ক্ষেত্রে এ নিয়ম বড় নির্যাতনের সামিল। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, শ্রদ্ধাহীনতা, ক্ষোভ ও ক্রোধ নিয়ে তারা সামাজিক কারণেই বাধ্য হয়ে একই ছাদের নিচে বসবাস করে। তাদের রাত্রির বিছানা হয়ে ওঠে পশুর মতো ধস্তাধস্তির আস্তানা, দিনের কথোপকথন হয়ে ওঠে বন্য জন্তুর মতো দুর্বোধ্য।
মাতুব্বরের এত ভারী ভারী কথা শোনার ইচ্ছা ও ধৈর্য কোনোটাই আসাদের সেদিন ছিল না। তাই সে মাতুব্বরের কাছ থেকে সরে অন্যপথ ধরেছিল। আর মাতুব্বর বা তার বাপ আর কিছু বলেনি। তবে তারা আসাদের দাম্পত্য সংকট নিয়ে পরবর্তী সময়ে মাথাও ঘামায়নি। এদিকে ওই সালিশের পর থেকে আসাদ-রুবিনা একই ছাদের নিচে থাকে সত্য, কিন্তু দুজন দুই ঘরে। আসাদ কী এক আক্রোশে আকাশের দিকে তাকায়, দেখে সেখানে কেউ নেই। সেখানে কেবল নীল আর নীল, তারকারাজি সেই নীলের মাঝে-মাঝে ফুলের মতো ফুটে আছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আসাদের মনে হয়, সেই দীর্ঘশ্বাস বাউকুড়ানি হাওয়ার মতো ঘুরতে ঘুরতে ঊর্ধ¦কাশে বিধাতার বুঁকে গিয়ে শেল হয়ে বিঁধে দেয়। অত্যাচারী স্ত্রীলোকের কাছে বিধাতাও অসহায়, তাই আসাদের নিস্তার মেলে না। আসাদের বিশ্বাস—জীবদ্দশায় স্ত্রী ও কামান্ধ সমাজের লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি না মিলুক, মৃত্যুতে মিলবে। আজ তার মৃত্যুর দিন উপস্থিত। সমাজ-সংসারকে সে এক মহাশিক্ষা দিয়ে যাবে। যা অনন্তকাল ধরে লোকে লোকে মানুষ মনে রাখবে।
মরণযাত্রী আসাদকে দেখতে এসেছে সবুজ। সবাইকে শুনিয়ে বলে গেছে, আল্লাহর মাল আল্লাহ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে জোরাজুরি করা বেশরিয়তি কাজ হবে। আল্লাহ আল্লাহ ডাকো। যেন সহজে জান কবজ হয়। সবুজের কণ্ঠ শুনে ঘৃণায় গা রি রি করে ওঠে আসাদের। বন্ধ চোখের পলক একটু খানি ফাঁক করে সে তাকায় রুবিনার দিকে। দেখে রুবিনার চোখে খুশির ঝিলিক, কথা হচ্ছে রুবিনা-সবুজের চোখে-চোখে। বেদনায় চোখ-মুখ মলিন হয়ে ওঠে সুমির।
ঘরের ভেতর আবার গুঞ্জন ওঠে—আসাদের টাকা-পয়সা, জায়গা-জমির দলিল কোথায় লুকিয়ে আছে। এগুলো বের করা দরকার। রুবিনার বোন বলে, ঘরের আলমারি-সিন্ধুকের চাবি কার কাছে। চাবি নে, আলমারি-সিন্ধুক খুলে দ্যাখ, কোথায় জায়গা-জমির দলিল, টাকা-পয়সা আছে। সব আগে-ভাগে তোর জিম্মায় নিয়ে নে। তাদের টাকা-টাকা জিকির আর কারও আর্তনাদের মাঝখানে মিজান উকিলকে নিয়ে হাজির হলো রফিক। আসাদের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে রফিক বলে, আব্বা উকিল সাহেব এসেছেন। কাগজপত্রও নিয়ে এসেছেন। সবার চোখ তখন উকিল আর আসাদের দিকে। আসাদ চোখ খোলে। উকিলকে ইশারা করতেই দুটি কাগজ এগিয়ে দেয়। স্বাক্ষরের জায়গা দেখিয়ে দেয় উকিল। কাঁপা-কাঁপা হাতে দুটি কাগজেই স্বাক্ষর দেয় আসাদ।
আসাদের স্বাক্ষর শেষে ঘরময় শোরগোল পড়ে যায়। রুবিনা এগিয়ে আসে, উকিল সাহেব কী দলিলে স্বাক্ষর করলো সে? আমি তার স্ত্রী আমাকে আগে শোনান। উকিল বলে, ধৈর্য ধরুন, এসব দলিল আপনাদের জন্যই তৈরি করা। অবশ্যই আপনারা জানতে পারবেন। তার আগে রোগীর দিকে আপনারা একটু মনোযোগ দিন। উকিলের কথায় রুবিনা, তার বোন কেউ কর্ণপাত করলো না। কেবল সুমি তাকিয়ে দেখলো তার শ্বশুর জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দুটি চাটছে। আর চোখের ইশারায় কী যেন বলছে। সুমি ত্রস্তপদে ছুটে গেলো টেবিলের দিকে। একগ্লাস পানি নিয়ে এলো। এরপর শ্বশুরের মাথা নিজের কোলে বসলো। পানির গ্লাস শ্বশুরের মুখে তুলে ধরলো। সুমি দেখলো তার চোখের সামনে আসাদের হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে একসময় নিথর হয়ে গেলো। আসাদের কানে তখনো স্বজনদের কথাবার্তা যাচ্ছে। সে শুনলো একমাত্র সুমি ‘ও বাবা গো’ বলে তার মাথার ওপর নিজের কপাল ঠুকলো। ততক্ষণে আসাদের কিছুই করার নেই। তার তখন মনে হলো, পৃথিবীতে ধর্ম স্থাপনার পর পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে পা বাড়িয়েছে। তারও সে মহাপ্রস্থানের পথে পা বাড়াতে হবে। যুধিষ্ঠির তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। তাকে যেতেই হবে। সে জানে মহাপ্রস্থানের পথে একবার পা বাড়ালে আর পেছনে তাকানো যায় না। ভাই-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনের মায়া ত্যাগ করেই যেতে হয়।
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে জল নেই, প্রাণ নেই, যেন আকাশকে বিষণ্ন করে দেওয়া কালো পাথরের দুটি মার্বেল।
আসাদের লাশ ঘিরে সবাই বসে আছে। প্রতিবেশীদের কেউ এগিয়ে এসে জানাজার সময় জানতে চায়, কেউবা দাফনের জায়গা কোথায় হবে, তা জানতে চায়। রুবিনা এবার উঠে দাঁড়ায়, লাশের জানাজা, দাফন সব হবে। তার আগে কিছু কাজকর্ম আছে, সেগুলো করতে হবে। রুবিনার কথা শুনে প্রতিবেশী নারীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো—এ কেমন কথা! স্বামী মারা গেছে, অথচ স্ত্রীর কোনো শোক নেই, সে আছে সহায়-সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে!
আসাদের ভাইও বসে আছে স্বজনদের মাঝখানে। হাত তুলে বলে, আমার একটা দাবি আছে। আমার ভাইয়ের লাশ আমাদের গ্রামে নিয়ে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করতে চাই। দেবরের কথা শুনে রুবিনা ক্ষেপে ওঠে, তোমার কথা মতো হবে? আমি তার স্ত্রী, আমার অধিকার সবার চেয়ে বেশি, আমি যেখানে দাফন করতে বলবো, সেখানেই দাফন করতে হবে।
মিজান উকিল এতক্ষণ আসাদের পরিবারের সদস্যদের ঝগড়া শুনছিলেন। ঝগড়ার শুরুতে থামাতে চাননি। কারণ তিনি জানেন, যে-কোনো ঝগড়ার শুরুটা হয় দুরন্ত ঝরনার গতির মতো। সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে আসা দ্রুতগামী ঝরনার মুখে বাঁধ দিলে যেমন তার গতি রোধ করা যায় না, তেমনি তেমনি ঝগড়ার শুরুতে বাধা দিলেও থামানো যায় না। এতে ঝগড়ার মূল বিষয়ের সঙ্গে বহুমুখী ডালপালা গজিয়ে তুচ্ছ পারিবারিক ঝগড়াও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার মতো ঘটনায় পরিণত হয়। পাণ্ডব-কৌরবদের ইন্দ্রপ্রস্থ নিয়ে ঝগড়ার মীমাংসা না হয়ে সেটা শেষপর্যন্ত রূপ নিয়েছিল কুরুক্ষেত্রে। তাতে ভাইয়ে-ভাইয়ের ঝগড়া গিয়ে মহাযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। তাই মিজান আগে এই পরিবারের ঝগড়ার কারণ ও গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলেন। এরপর তার হাতে থাকা দলিলগুলো পড়ে শোনানো শুরু করলেন।
প্রথম দলিলের সারমর্ম এমন, আসাদ তার পুত্রবধূ সুমিকে নিজের কন্যার মতো দেখতো। সুমিও আসাদকে বাবার মতো শ্রদ্ধা-ভক্তি-সেবা করতো। তাই আসাদ তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সুমিকে দান করে গেছে। এছাড়া আরও অসিয়ত করেছে, তার মৃত্যুর পর লাশ দাফন নিয়ে কেউ যেন টানাটানি না করে। তার লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজকে গবেষণাকাজে ব্যবহারের জন্য দান করে গেছে। সুতরাং তার সম্পত্তিবণ্টন ও লাশ দাফন সংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব স্বজনদের মধ্যে আর কারও ওপর বর্তাবে না। উকিল এই পর্যন্ত বলে দম নিলো।
প্রথম দলিলের সারমর্ম শুনে সুমি নতমুখে বসে আছে। রফিক চুপচাপ, তার ছল-ছল চোখ ঘরের ছাদের দিকে। রুবিনা কেউটে সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে, কী! এত্তবড় জালিয়াতি? আমি তার স্ত্রী। তার ছেলে আছে। আমাদের জন্য কিচ্ছু নাই। সব ওই সুমিকে দিয়ে গেলো? আমি মানি না এই দলিল। রুবিনার চিৎকার থামলে উকিল বলে, আপনারা মানা-না মানায় কিছু এসে-যায় না। আসাদ আপনাদের সামনেই দলিলে স্বাক্ষর করেছে। আসাদের সম্পত্তিতে আপনার এখন আর হক নেই। ক্ষেপে ওঠে রুবিনা, নেই মানে? উকিল বলে, নেই মানে, দ্বিতীয় দলিলে আসাদ আপনাকে তালাক দিয়ে গেছে। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার সাবেক স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পায় না। আপনি কেবল দেনমোহরের টাকা পাবেন। উকিলের কথা শেষ হলে হঠাৎ ফুটো বেলুনের চুপসে যায় রুবিনা। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে জল নেই, প্রাণ নেই, যেন আকাশকে বিষণ্ন করে দেওয়া কালো পাথরের দুটি মার্বেল। সেই মার্বেল দুটি বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রের মতো ঘূর্ণন তুলেছে। কোথায় থামবে, আপাতত বলা যাচ্ছে না। তবে লক্ষ্য আসাদের দিকে। আসাদের চোখ দুটি তখন বন্ধ। তার দিকে রুবিনার ঘূর্ণায়মান চোখ থেকে অগ্নিবাণ ছুটছে।