মমতা বেগম যখন ফোন করে আজগর আলীকে খবরটা দেন, তখনই তার মাথা ঘুরানি অবস্থা। দ্রুত তিনি টয়লেটে ছোটেন। জীবনে যখনই তিনি কোনো টেনশনে পড়েছেন, তখনই তার পেটে প্রচণ্ড জোরে মোচড় দিয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি অফিসের টয়লেটে বসে ছিলেন পাক্বা একঘণ্টা। সেখানে অনবরত ঘেমেছেন। টয়লেটও যে শান্তিমতো হয়েছে, সেও বলা যাবে না। হাই কমোডে বসে থাকতে থাকতে একসময় তার মাথা ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল ছোটখাটো কিংবা বড় কোনো স্ট্রোক হয়ে এখানে তার মৃত্যু হবে। টয়লেটে মৃত্যু হয়ে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকবেন। অনেক্ষণ পর আবিষ্কার করা হবে টয়লেট বন্ধ। তাকে বের করে আনা হবে। তিনি থাকবেন নাঙ্গা। অফিসের কোনো কলিগ সেই নাঙ্গা হয়ে পড়ে থাকার ছবি তুলবে। সেই নাঙ্গা ছবি একজন আরেকজনকে দেখিয়ে বলবে–আহারে আমাদের আজগর ভাই বড় ভালো লোক ছিলেন।
এসব যখন আজগর ভাবছিলেন তখন অনুভূত হলো বসে থাকতে থাকতে তার পাছা ব্যথা হয়ে গেছে। এটা অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গলগল করে পেট থেকে কিছু পানি বেরিয়ে এলো। আজগরের মনে হলো, কিছু টেনশন কমে এসেছে।
এরপর অফিসে কাউকে কিছু না বলেই রওনা দেন বাসার দিকে। যেতে যেতে ভাবেন, এমনটা কেন হলো? কেন এমন এক বড় প্রশ্নের মুখোমুখি আজগর আলীকে পড়তে হলো?
তিনি ঘামছেন, ভিজে একাকার হয়ে পড়ছেন। অতি টেনশনে এতই চিন্তামগ্ন হলেন যে, বাসে উঠতে হবে, সেই বিষয়টাই তিনি ভুলে গেছেন। তিনি দ্রুত হেঁটে চলেছেন সব ভুলে।
উত্তরা তার অফিস। বাসা মোহম্মদপুর। হেঁটে যাওয়া অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু দূরত্ব তো হেঁটে যাওয়ার মতো নয়। সেটা আজগরের মাথাতেই খেলছে না।
উত্তরা জসিমউদ্দীন সড়ক থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত তিনি হেঁটেই চলে এলেন। আসার পর মনে হলো একটা সিগারেট খাওয়া প্রয়োজন। তিনি একটি টং দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। এমন সময় আজগর আলীর একমাত্র শালা ইলিয়াস খাঁ ফোন দিলেন।
—হ্যালো। ইলিয়াস বলো। সিগারেটে টান দিতে দিতে বলেন আজগর।
—দুলাভাই ঘটনা শুনছেন?
আজগর আলীর মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। ঘটনা তিনি জানেন, এটা তো ইলিয়াস খাঁরও জানার কথা। শালা একটা আসলে শালার শালা! তবু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলেন, হ্যাঁ শুনছি। বাসায় যাচ্ছি। ইলিয়াস আবারও বলেন, তাড়াতাড়ি আসেন দুলাভাই। আমি একটা সিএনজি নিছি। আপনি আবার বাসে উইঠেন না। দেরি হইয়া যাইবো। এটা শুনেও আজগর আলীর মেজাজ খারাপ আরও বাড়ে। মনে মনে বলেন, শালা তোর বাপ তো আমাকে টাকা সাপ্লাই দেয়। আমি সিএনজিতে আসবো।
তবে সিএনজি-বাসের প্রসঙ্গ আসার পর আজগর আলীর কিছুটা জ্ঞান ফেরে। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। বুঝলেন এয়ারপোর্ট গোলচক্করে এসে পড়েছেন হেঁটে হেঁটে। তখন ‘হুম’ শব্দ উচ্চারণ করে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।
সিগারেটের টাকাটা দিয়ে তিনি সিএনজি নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এই শহরে সিএনজিওয়ালারা হলো জালেম নম্বর ওয়ান। মিটারে তো যাবেই না, উল্টো এমন ভাড়া চাইবে যে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তবু রিস্ক নিয়ে তিনি একটা সিএনজি ডাক দিলেন—যাবা নাকি মোহম্মদপুর তাজমহল রোড?
সিএনজিওয়ালার মাথায় টুপি। হালকা দাঁড়িও আছে। গ্রিলের ফাঁকে দিয়ে বিদঘুটে হাসি দিয়ে বললেন, যাবো চাচা। ৩৫০ টাকা লাগবো। সঙ্গে সঙ্গে আবারও বিগড়ে গেলো আজগর আলীর মেজাজ। গালি দিয়ে বসলেন—ওই হারামি ওই, ৩৫০ টাকা মানে? শুয়েরের বাচ্চা তুই মিটার ছাড়। গালি শুনে সিএনজিওয়ালারও মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সেও গালি দিয়ে বসলো—গেলে যাইবেন, না যাইলে নাই। গালি দাও কেন চুদানির পোয়া? এই বলে সে সিএনজি দিলো টান। আজগর আলী কিঞ্চিৎ অপমানবোধ করলেন। নিম্নশ্রেণীর কারও গালি শোনার অভ্যাস তো তার নেই। তার তো গালি দিয়ে অভ্যাস। সুযোগ পেলেই তিনি সিএনজি ড্রাইভার, বাসের কন্ডাক্টর, রিকশাচালকদের গালি দিয়ে বসেন। কিন্তু পাল্টা কোনও গালি তাকে জীবনে প্রথম শুনতে হলো। এই অপমান শোধরানোর জন্য তিনি সিদ্ধান্ত বদলালেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বাসেই উঠবেন।
বাসে উঠেই মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দেখেন, মমতা বেগম ইতোমধ্যে চারবার কল দিয়ে ফেলেছেন। নরমাল প্যান্টের কারণে প্রায়ই তিনি কল মিস করেন। এবারও তাই হলো। তিনি কলব্যাক করতেই মমতা বেগম বলে উঠলো, কী হলো? আর কতদূর? তাড়াতাড়ি আসতেছো না কেন? আজগর সাহেব এই কথা শুনেই চিৎকার দিয়ে বলেন, তোমার বাপ তো আমারে যৌতুকে প্লেন উপহার দিছিল। সেটা দিয়ে তাড়াতাড়ি আসবো উড়ে উড়ে। ফাজিল মহিলা। মমতা বেগম এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। কেঁদেই দিলেন—তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতাছো কেন? আজগর আলী আবারও চিৎকার করে ওঠেন—ওই মহিলা চুপ থাক। শান্তি দিলি না তোরা জীবনে। বিয়ার পর থেকে তুই অশান্তি দিছস। এখন তোর পোলা দিতে শুরু করলো।
মমতা বেগমের সঙ্গে ২১ বছরের সংসার জীবনে এই প্রথম মনে হয় আজগর সাহেব এমন তুই-তকারি করে কথা বললেন। ২১ বছরে একটি দিনও তিনি এমন অস্বাভাবিক কোনো কথা বলেননি।
মমতারও বা কী করার আছে? সংসারের ঘানি তো আর আজগর আলী একটা টানছেন না। ঘরতো তাকেও সামলাতে হয়। একমাত্র ছেলে আসলাম আলী ছাড়া এই জীবনে আপন তার কেউ নেই বলেই মনে করেন মমতা।
আজগর আলী তো সকালে যান, রাতে আসে। ঘরে ফেরার পর টিভি ছেড়ে বসে বসে খবর দেখে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। মনের কথা এখন আর আজগর আলীর সঙ্গে বলতে পারেন না মমতা। বলেন শুধু আসলামের সঙ্গেই।
দুই.
প্রিয় পাঠক, নিশ্চয় ভাবছেন আসল ঘটনাটা কী! কী এমন হলো? এবার বলি। ঘটনাটা হলো, আজগর আলীর একমাত্র পুত্র আসলাম আলীর খাটের বালিশের নিচে আজকে একটা পিস্তল আবিষ্কার করেছেন মমতা বেগম। এমন পিস্তল নাকি সিনেমায় মমতা প্রায়ই দেখেন।
বিষয়টা হলো, এটা দেখে তব্ধা খেয়ে দুই বার জ্ঞান হারিয়েছেন মমতা। তার ছেলে সকালে কলেজে চলে গেছে। এমন সময় ছেলের খাট গোছাতে গিয়ে এই পিস্তলটা আবিষ্কার করে রীতিমতো পরিবারের সবার ওপর এক বিরাট প্রশ্ন হাজির হয়ে গেছে। মমতা বেগম প্রথমেই জানিয়েছেন তার স্বামী আজগর আলীকে। তারপর জানানো হয়েছে মমতা বেগমের ছোট ভাই ইলিয়াস খাঁকে।
গল্পটা এখান থেকেই বলা যেতো। কিন্তু নিতান্তই আপনাদের আগ্রহটা একটু টানার জন্য এতদূর আনা। কিছু মনে করবেন না। মাঝে মাঝে লেখকরা একটু খেলে। আমিও খেললাম। মাফ করবেন। চলুন আমরা আবার ফিরে যাই গল্পে।
তিন.
আজগর আলী তীব্র জ্যামে আটকে আছেন বনানী কাকলীর দিকে। তখনো তিনি ভাবছেন। আসলাম তার একমাত্র ছেলে। কোনও বাজে সঙ্গ যেন আসলাম না পায়, এজন্য ছোটবেলা থেকেই তাকে বন্ধুর মতো করে সময় দিয়েছেন। কিন্তু আসলাম অনার্স পড়ার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে যাওয়ার পর থেকে কিছুটা বিচ্ছেদ ঘটেছে বাপ-ছেলের। কারণ ছেড়ে পড়তে চেয়েছিল ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্ট্যাডিজ। কিন্তু আজগর আলী চেয়েছেন, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। এই দ্বন্দ্বে বাপ-ছেলের সম্পর্কে একটা অদৃশ্য দেয়াল হাজির হয়েছে। বাপের প্রিয় বিষয়েও পড়া হয়নি আসলামের। আর নিজেরটা তো নয়ই।
আজগর আলীর তখন খুব খারাপ লাগা শুরু করে দিলো। তার অপরাধবোধও কাজ করতে থাকলো। মনে হলো, ছেলের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে কি খারাপ হয়ে গেলো?
ছেলে যেদিন প্রথম এই আবদার করলো, সে ঘটনাটির কথা স্পষ্ট মনে আসে আজগর আলীর। একদিন রাতে খাবার টেবিলে আসলাম প্রথম বললো, আব্বা আমারে কি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি পড়াবেন?
—কেন, পাবলিক কোনোটাই চান্স পাবা না?
আসলাম ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, পেতেও পারি আব্বা। কিন্তু ভালো সাবজেক্ট যদি না পাই?
আজগর বললেন, না পাইলে প্রাইভেটে পড়ানোর চেষ্টা করবো। কিন্তু এত খরচ কেমনে টানবো, সেটাও কথা।
আজগর আলীর একটা গোপন খবর কেউ জানে না। আসলাম জন্ম নেওয়ার দুই মাস পর একটা ইন্স্যুরেন্স করেন আজগর। এটা সম্পূর্ণ তার ছেলের পড়াশোনার জন্য। দশ লাখ টাকার ইন্স্যুরেন্স। ব্যাপারটা মমতাও জানেন না। এই ইন্স্যুরেন্সের টাকা দিয়ে আজগরের প্ল্যান ছিল দেশের বাইরে আসলামকে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু আসলাম যত বড় হতে থাকলো, তত সন্তানের জন্য তার মায়াও বাড়তে থাকলো। যখন আসলাম এসএসসি পাস করলো, তখন আজগর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন– ছেলেকে হাতছাড়া করবেন না।
তখন থেকেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে—আসলামকে দেশের সেরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াবেন, যদি আসলাম পাবলিক ইউনিভার্সিটির কোথাও সুযোগ না পায়।
যাইহোক, আসলামকে খাবার টেবিলে আজগর জিজ্ঞেস করলো, হঠাৎ এই প্রশ্ন করলা কেন? কিছু বলবা? আসলাম মাথা নিচু করে বললো, আব্বা আমার একটা বিষয়ে পড়া নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাচ্ছিলাম। আজগর হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললেন, বলো। কী নিয়া পড়বা? আসলাম মায়ের দিকে একবার তাকায়। চোখ ছলছল করে। আসলাম জানে তার আব্বা রাজি হবে না। তবু ধীরে ধীরে বলে, আব্বা ফিল্ম নিয়া পড়তে চাইছিলাম।
আজগরের সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। এক গ্লাস পানি খেলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, পাবলিকে ভালো সাবজেক্ট পাবা না। প্রাইভেটে পড়বা। এইটা তোমার ভালো সাবজেক্ট?
আসলাম আবারও বলে, আব্বা, ফিল্ম নিয়ে বাংলাদেশে পড়লে অনেক ক্যারিয়ার আছে। আমারও ইচ্ছা আব্বা।
আজগর এবার চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে যান। বলে ওঠেন, হ, খুব ভালো সাবজেক্ট। বাংলাদেশে অনেক ক্যারিয়ার আছে। নায়ক হইবা। নায়িকা নিয়া রঙ্গলীলা করবা। নায়ক না হইলে কী হবা? সিনেমা বানাইবা? তোমার সাহস কেমনে হইলো আমারে এই কথা কওয়ার? হারামজাদা কোথাকার। থাপড়ায়া দাঁত সব ফালায়া দেব।
মমতা কিছু একটা বলতে নিলেন, তখন আজগর মমতাকে বলে বসলেন, খবরদার ওকালতি করবা না। সিনেমা বানাইবো। ছি ছি ছি। মান ইজ্জতের কথাও তোমার পোলা চিন্তা করে নাই?
এসব বলে আজগর আলী তার রুমে চলে যান। এরপর আসলাম অবশ্য এই আব্দার আর ওঠায়নি। তবে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার বিষয়েও আসলাম আর কোনও কথা বলেনি। পাবলিকে কোথাও চান্স পায়নি। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে ফিজিক্সে অনার্স পড়তেছে ছেলে।
আজগর আলীকে এক রাতে মমতা বলেছিলেন, পোলাটা কান্দে খালি। ওর সঙ্গে কথা বলেন। প্রাইভেটে না হয় পড়লো।
আজগরের দম্ভ তখনো কমে না। তিনি সাফ বলে দেন, যেই পোলা সিনেমা বানাইতে চায়, নাচা-নাচি করতে চায়, ওই পোলার কান্দাই উচিত।
আর বাপ-ছেলের তেমন কথা হয় না। তবে ছেলে মন দিয়ে ফিজিক্স পড়ে, তা আজগর আলী বেশ বুঝতেও পারে। আজগর তখন অপরাধবোধেও ভোগেন। ভাবেন, ছেলের সঙ্গে এই অভিমানের দেয়ালটা তৈরি না করলেও তিনি পারতেন। ছেলের শখ আহ্লাদ রাখাটা তার উচিত ছিল। আবার ভাবেন, বাংলাদেশের কোন বাপ তার ছেলেকে দিয়ে সিনেমা বানাতে চায়? মধ্যবিত্ত কোন বাপ চায় তার ছেলে বড় হয়ে সিনেমার নায়ক হবে কিংবা ভিলেন হবে কিংবা সিনেমা বানাবে? এমন বাপ আছে নাকি?
আজগর আলীর মাথায় আসে, বাপ চায় না, তাও তো ছেলেপেলেরা এসব লাইনে চলে যায়। এত বড় বিনোদন তৈরি হয়ে আছে। কত নায়িকা তো আজগর আলীরও পছন্দ। অথচ পেশাটারে কেন তিনি মন্দ ভাবলেন?
এসব ভেবে রাগও হয় আজগর আলীর। তিনি মধ্যবিত্ত বাপই হলেন। একটু বড় করে চিন্তা করতে পারেননি কেন?
আজগর খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন ছেলেকে নিয়ে। পিস্তল কেন তার কাছে আসবে? আবার ভাবেন, আসলাম কি জঙ্গিটঙ্গি হয়ে পড়লো? এই প্রশ্নও হাজির হয় আজগর আলীর মনে। কিন্তু জঙ্গি হওয়ার সুযোগই তো দেখেন না আজগর। যেই ছেলে সিনেমা বানাতে চায়, সে কেমনে জঙ্গি হয়? পরক্ষণেই মনে হয়, হতেও তো পারে। টিভিতে জঙ্গিবিরোধী বিজ্ঞাপনের কথাও তার মনে পড়ে। যেখানে বলে, সন্তান কী করছে কার সঙ্গে মিশছে, এসব খোঁজখবর রাখতে। আজগর আলীর তখন মনে হয়, তার কৈশোরে সে কার সঙ্গে মিশেছে এই খোঁজ কি তার বাপ নিয়েছে? নজরে রাখা যায়, কোনো ছেলেকে এই বয়সে? তিনিও তো ছেলেকে এত নজরবন্দি করে রাখেননি।
জঙ্গি হওয়ার কোনও সূত্র আছে কি না, তা মেলাতে শুরু করেন আজগর আলী। নিজেকে নিজে কিছু প্রশ্ন করেন:
১. আসলাম কি ঘরের দরজা অধিক সময় লাগিয়ে রাখে?
উত্তর: না (যতক্ষণ তিনি ঘরে থাকেন)।
২. ঘরে কি এমন কোনও বন্ধু আসে, যারা এলে আসলাম ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়?
উত্তর: না।
৩. আজগর কি হুট করে বেশি ধর্মকর্ম করা শুরু করেছে? কিংবা ঘরে কি হঠাৎ করে ধর্মীয় উগ্রবাদী বই আসা শুরু হয়েছে?
উত্তর: না। (অবশ্য সেভাবে আজগর খেয়ালও করেননি। মনে মনে ভাবেন এই নিয়ে মমতার সঙ্গে আলাপ করতে হবে।)
৪. অধিক সময় কি আসলাম কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে?
উত্তর: না। তবে, অধিক সময় আসলাম বই পড়ে। উপন্যাস পড়ে। রবীন্দ্রনাথের পুরো সেট সে দুই মাস আগেই ইলিয়াস খাঁ-কে দিয়ে কিনিয়েছে। ক্লাস টেন থেকেই রবীন্দ্রনাথ বলতে সে পাগল।
নিজে নিজে এই উত্তর দিয়েই আর নতুন প্রশ্ন হাজির করেন না আজগর। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন আসলাম জঙ্গি হয়নি। যে রবীন্দ্রপ্রেমী, সে কিভাবে জঙ্গি হবে?
তখন তার মাথায় অন্য চিন্তা ভর করে। রাজনৈতিকভাবে আসলামের অবস্থান কী? বিশেষ করে কলেজে পড়ার সময়ই ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনে গিয়ে পড়ে থাকার কথা শুনেছেন মমতার কাছে। এটা শুনে আজগর আলীর বুকটা উঁচু হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, তার ছেলে এই দেশকে ভালোবাসে। দেশের ইতিহাসকে ভালোবাসে। আজগর আলীও যৌবনে জাহানারা ইমামের গণ আদালতে হাজির হয়েছিলেন। কী মানুষ সেখানে। শত শত, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে মানুষ। এত মানুষ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ছিল, তা মনে করলেই আজগর আলীর শরীর শিউরে ওঠে। তার মনে হতে থাকে, ওই উত্তাল সময় সরকারের দিকে চোখে চোখ রেখে তারা হাজির হয়েছিলেন গণআদালতের ময়দানে। সেই ২৬ মার্চ, ১৯৯২। ভুলতেই পারেন না আজগর আলী।
আজ তার ছেলে বড় হয়ে ২০১৩ সালে শাহবাগেই তো যাবে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি তো করবেই। তার রক্তই তো আসলামের শরীরে বহমান।
আজগর আলী অনেকের কাছে শুনেছেন, তার ছেলে নাকি ফেসবুকে অনেক সোচ্চার। যেহেতু আজগরের ফেসবুক নেই, সেহেতু তার পক্ষে তাকে সেখানে ট্র্যাক করা কঠিন।
তখন তার মাথায় আসে আজগরের পাশের ফ্ল্যাটের জলিল সাহেব ফেসবুক ব্যবহার করেন। তাকে ফোন দেওয়া যায়। জলিল সাহেব নাকি আসলামের ফেসবুকে আছেন। আসলামই একদিন হাসতে হাসতে আজগরকে বলছিলেন, আব্বা জলিল আংকেলও ফেসবুক ব্যবহার করেন, আর আপনি এখনো ফেসবুকই খুলেন নাই!
এই নিয়ে বাপ-ছেলের হাসি-ঠাট্টাও হয়েছিল।
আজগর আলী ভাবলেন, জলিল সাহেবকে একটা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা যায়। জলিল সাহেবকে বাসে বসেই ফোন দিলেন আজগর আলী।
জলিল সাহেব ফোন ধরলেন। দু’জনের কুশোল বিনিময় হলো। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, জলিল ভাই, কিছু মনে না করলে একটা বিষয়ে আলাপ করতে চাই।
জলিল সাহেব কিছুটা বিচলিত হয়ে বললেন, আরে কী বলেন আজগর ভাই? বলেন। আমরা তো নিজেরা নিজেরা।
জলিল সাহেবকে বললেন, আসলে আমার তো ফেসবুক নেই। আমার আসলাম ফেসবুকে আছে। আপনারা নাকি ফেসবুকে বন্ধু। ও আজেবাজে কিছু করে না তো ভাই? আজকালকার পোলাপান। বুঝেনই তো খোঁজখবর রাখতে হয়।
জলিল সাহেব হেসে উঠেন। তিনি বলেন, আরে নাহ আজগর ভাই। আসলাম তো ভালো ছেলে। ভালো ভালো কথা লেখে। রাজনীতি-সমাজ নিয়ে সে তার বিশ্লেষণ দেয়। মন্দ কিছু করে না। চোখে পড়লে তো বলতামই।
আজগর আলী কিছুটা স্বস্তি পান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যত কিছুই হোক তার ছেলে পিস্তল হাতে নেওয়ার কথা না।
সবকিছুর শেষ কথা হলো পিস্তলটা আসলামের বিছানাতেই পাওয়া গেছে। তাহলে কোথা থেকে আসলো? যেহেতু আসলামের খাটে বালিশের নিচে ছিল। তারমানে এটা তারই।
চার.
আজগর বাস থেকে শ্যামলী নেমে রাস্তা পার হয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা হন। বাসায় পৌঁছাতে পাঁচ দশ মিনিটই লাগে। তার শরীর কেন যেন অবশ হয়ে পড়ছে। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে তিনি ভাবেন, তার ছেলেকে তিনি কখনো কুশিক্ষা দেননি। পরক্ষণেই আবার মনে হয় পৃথিবীর কোনো অপরাধীর বাবা-মাই তাদের সন্তানদের মন্দ শিক্ষা দেন না। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থায় তারা মন্দ হয়ে পড়ে। কী করার। আজগর আলীর হঠাৎ চোখও ভিজে আসে। তার সাতজন্মের ধন হলো আসলাম। সে কেন অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াবে?
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সিদ্ধান্ত নেন–আসলাম এলে তাকে বকা দেবেন না। শুধু জানতে চাইবেন, কেন এই পিস্তল তার ঘরে হাজির হলো। কে দিলো? আজগর এও সিদ্ধান্ত নেন, এই পুরো চক্রকে তিনি পুলিশে দেবেন। তার ছেলেকেও পুলিশে দেবেন। কোনও রেহাই নেই। বাবা হিসেবে কষ্ট হবে। কিন্তু এই কষ্টের তোয়াক্কা আজগর করবেন না।
আজগর আলী ঘরে ঢুকে দেখেন এলাহি কাণ্ড। ইলিয়াস খাঁ ও তার বউ। মমতার বড় বোন রুবিনা বেগম, ছোট বোন রুকসানা বেগম। আজগরের ছোট ভাই আজমল আলী। এমনকি এলাকার আসলামের দুই বন্ধু মোবিন ও রুস্তমকেও নিয়ে আসা হয়েছে বাসায়।
এত লোক দেখে আবারও মেজাজ বিগড়ে গেলো আজগর আলীর। মমতা এক কোণে বসে বসে কাঁদছিলেন। তার কান্না দেখে আজগর অবশ্য রাগেননি। বরং মনে মনে বলেছেন, শালার মাইকিং কইরা গুষ্ঠি নিয়া আইছে।
আজগর আলী এক গ্লাস পানি খেয়ে চেয়ার টেনে বসেন। ওই সময় আজমল সামনে এসে বলে, ভাইজান আপনি চিন্তা কইরেন না। দুই বন্ধুরে নিয়া আসছি। তাদের পুলিশে দেব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুলিশ যখন পুটকি দিয়া ডিম ঢোকাবে তখন এমনেই বাইর হইবো কোথা থেকে এই মাল আসলো।
দুই ছেলে অসহায় হয়ে বসে আছে। আজগর তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত, এরাও নিরপরাধ। তবু কিছু বললেন না।
মমতারে জিজ্ঞেস করলেন, আসলাম কই? তারে ফোন দাও নাই?
ইলিয়াস খাঁ বললেন, দুলাভাই এসব কেসে ঠাণ্ডা থাকতে হয়। আসলামরে বুঝতেই দেওয়া হয় নাই যে, পিস্তলের খবর আমরা জাইনা গেছি। তারে বলা হইছে, আজকে সবাই মিলা বেড়াইতে যামু। সে যেন তাড়াতাড়ি আসে।
আজগর জিজ্ঞেস করেন, সে কখন আসবে? বলছে কিছু?
ইলিয়াস খাঁ উত্তর দেবে, এমন সময় মমতার ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে আসলামের নাম। মমতা কান্না থামিয়ে ফোন ধরে বলেন, তুই কই। বাসায় আসবি না?
কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দেয়।
মমতা আজগর আলীর দিকে তাকিয়ে বলে, সে বলসে, দাওয়াতে যাইতে পারবে না। তার কাজ আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ইলিয়াস খাঁ বলেন, উফ! সে কী বুঝে গেলো নাকি?
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন। এবারও আসলাম।
এবার মমতা কথা বলা শুরু করে। তারপর, ‘ও আচ্ছা’, ‘ও আচ্ছা’ বলে কথা শেষ করে। মমতা শুধু বলে, আমরা তো ভেবেছি সত্যি সত্যি। এটা বলে মমতা কেঁদে দেয়।
একটা অন্যরকম সাসপেন্স তৈরি হয় সবার মধ্যে। ‘সত্যি সত্যি’ শব্দ দুটির অর্থ তারা বোঝে না।
ফোন রেখে মমতা ভেউ ভেউ করে কেঁদে দেন। আজগর তাকিয়ে থাকেন। মমতা আজগরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। আজগরের তখন খুব মায়া হয়। তিনি কিছুই বলতে পারেন না।
মমতা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ওইটা খেলনার পিস্তল। তারা কলেজের কোনো অনুষ্ঠানে নাটক করতেছে। ওই নাটকের জন্য এটা কেনা হইছে। সে ভুলে এটা রাইখা গেছিল। তাদের সন্ধ্যায় রিহার্সেল আছে। তার এক বন্ধু আসবে এটা নিতে। বন্ধুরে দিয়া দিতে বলছে।
পাঁচ.
আজগর আলী বন্দুকটা হাতে নেন। হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ান। একটা সিগারেট ধরান। ভালো মতো নেড়ে চেড়ে দেখে নিশ্চিত হন, এটা আসলেই খেলনা পিস্তল। আজগরের হাসি পায়।
মায়ের মন পিস্তল দেখেই ভড়কে গেছে। ওটা আসল না নকল তা দেখার কোনো প্রয়োজনই বোধ করেনি। ঘরে এতগুলো লোক আসলো, তারা সবাই এটা ধরেও দেখেনি। হাতের ছাপ পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
সত্যি তো দূর থেকে দেখলে মনে হবে সত্যিকারের পিস্তল।
আজগর আলীর এবার হাসি পায়। ছেলে তার সিনেমার ডিরেকটর হতে চেয়েছিল। সত্যি সত্যিই নিজ ঘরে এক সিনেমা নির্মাণ করে ফেললো আসলাম।