সন্ধ্যার পর এই গ্রামের অন্ধকার দেখার মতো। সূর্য ডুবি-ডুবি করেও যখন শেষবার ওপাড়ার সেগুনের ঝাঁকড়া মাথায় শেষ পলক ফেলে টুপ করে টপকে যায় দিগন্তের দাগ, কালচে কুয়াশার মতো ঝুরঝুর নেমে পড়ে মিহিন কালো, তখন এক নিরাভরণ অন্ধকার বিস্তার হয়ে আসে ধীরে ধীরে। তারার আভরণে ভরে যায় আকাশ। টেমিদের মাটির ঘরটায় তখন আসর জমিয়ে গোল হয়ে বসে একবৃত্ত আলো। অল্প সলতের শিখা স্থির হয়ে জ্বলে। কুপির কান মুচড়ে আলো উসকে দেয় টেমি। উবু হয়ে বসে অগ্নিদণ্ড দেখে। কী ভেবে আবার ছোট করে দেয় আলোটা। ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। ওর হাতের ইশারায় আলো বাড়ে কমে। বেশ মজা পায়। উবু হয়ে বসে জানতে চায়: এই টেমি, টেমি। তুই না আমার সই। আমার নামে নাম। এত মন খারাপ কইরে জ্বলো ক্যান্, হা? দ্যাখো না তুমার চারদিকি কিরাম ফসসা হইয়ে গেচে, চাঁনে সভা করার মতন! কথাগুলো বলতে বলতে অনেকটা কাছে এসে পড়েছিল। নিঃশ্বাস আর মুখের বাতাসে শিখা শিউরে শিউরে দুলতে লাগলো। মার ডাকে বারান্দার দিকে তাকালো।
টেমি…। এতখোন্ কী করতিচিস ঘরের মদ্যি?
ন্যাম্পো ধরালাম মা। আসতিচি।
ঘর থেকে বেরিয়ে মার সামনে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে মা বলল, নোজ সইন্দে বেলা ন্যাম্পো ধরাইয়ে কী বকিস নিজি নিজি? ও কিচু না মা, বলে কবুতরের খোপের দিকে গেল। মুরগীর কোঠায় খিল দেওয়া হয়েছে আগেই। অনেকগুলো বাচ্চা তুলেছে মুরগীটা। সারাক্ষণ কদমফুলের মতো ফুলে থাকে। কুককুক কুক্কুস, আদুরে আদুরে শব্দ করে আর হেলেদুলে হাঁটে। বাচ্চাগুলো যখন দৌঁড়ায়, আবছা আলোতে মনে হয় একঝাঁক ডিম গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সারা উঠোনে। সেই নড়নক্ষম ডিম্বগুলো ওদের কদমফুল মার পেছনে পেছন কোঠায় গিয়ে ওঠে।
কবুতরগুলো কথা শুনতে চায় না। সন্ধ্যা বেলা তো নয়ই। সারাদিন উড়ে উড়ে এচালে ওচালে যায়। মাঠে উঠোনে খুঁটে খুঁটে খেয়ে কোঠার চালটার ওপরে গলার পাখনায় মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে। কোনো কোনোটা চোখ বন্ধ করে রাখে। টেমির আওয়াজ পেলে একচোখ খুলে দেখে নেয়। ওরে দুষ্টুর দল, তুইগের চালাকি আমি ধইরে ফেলিচি বলতে বলতে, মৃদু হাসতে হাসতে জিহবাটা মুখের ওপরের তালুতে কয়েকবার হেঁচড়ে চুচুক চুচুক শব্দ করতেই কবুতরগুলো যে যার কামরায় চলে যায়। মুখ নাড়াতে নাড়াতে বেশ পিটপিট করে তাকায় ওর দিকে। লম্বা কাঠের দরজাটা আস্তে করে টেনে দেয় তখন।
কবুতরের খোপের চালের চাইতে ওদের ঘরের চাল খুব বেশি বড় নয়। মাটির দেয়াল ক্লান্তিতে বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো। অল্প রোদে অনিচ্ছায় যেন এক শ্রান্ত কৃষক মাথায় ফেলে রেখেছে টোকা, তেমন করে খড়ের চাল মাথা উঁচু করে আছে। খোকন ডাক্তারের উঠোন থেকে ভাসতে ভাসতে ভিটেশুদ্ধ বাড়িটা যেন রাস্তার দেয়ালে এসে ঠেকে আছে। টেমিদের উঠোন নেই বললেই চলে। মেয়েরা মাঝখানে কিতকিত খেলার ঘর কাটলে দুইপাশে দাঁড়িয়ে দেখার মতো জায়গাটা কেবল থাকে। জায়গার অভাবে গোয়াল ঘর বানানো হয়নি। তার প্রয়োজনও নেই। একটিমাত্র গরু বলেকয়ে খোকনদের গোয়ালে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। আর তিনটে পোষাণী পাওয়া ছাগলের জন্য ছোট্ট ছাউনি করে খুঁটি পোতা আছে লাউয়ের মাচানের পাশে।
বারান্দার চাল একটু বাড়িয়ে তার নিচে মাটির চুলো বানানো। চাচের বেড়ার গায়ে কাঠের তাক ঝুলিয়ে রাখা। খালি হাড়ি-পাতিল উপুড় করা থাকে। তাক বরাবর একটা সিঁকা ঝুলে আছে। অতিরিক্ত ভাত-তরকারি থেকে গেলে তুলে রাখা হয় সিঁকায়। বেলা থাকতে থাকতে রাতের রান্না করে রাখে টেমির মা জাহিদা। মাঝে মাঝে শুধু ভাতটা ফুটিয়ে সানকির ভেতর মাটির সরা কাত করে রেখে মাড় গালতে রেখে দেয়। চুলোর পাশে ল্যাম্ফো রাখার জন্য একটি কাঠদণ্ড আছে। আলোদানিতে সরুশিখায় আলো জ্বলছে। ভাত প্রায় হয়ে এসেছে। শক্ত লালচে চালগুলো এখন পেটমোটা ভাত হয়ে পিচ্ছিল মাড়-সরোবরে সুখি-সুখি মাছের মতো চরে বেড়াচ্ছে। মাড়-বাষ্প সশব্দ সরোবর ছেড়ে উড়ে উড়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বেড়ার ফাঁক দিয়ে। নাকিড় ডুবিয়ে দুতিনটে ভাত তুলে টিপে দেখলো জাহিদা। সুক্ষ্ম দানা টের পেলো আঙুলের ডগায়। আরেকটু জ্বালাতে হবে। পাশে চিরদিনের বন্ধুর মতো শুয়ে থাকা সাদাসাদা পাটকাঠি থেকে দুটো তুলে চুলো ভেতরে দিলো। ওঠানোর সময় আরও কয়েকটা কাঠি উঠে আসতে চাইলো। ফেঁসোয় জড়িয়ে যেন রেখে দিতে চাইলো বন্ধুদের। ভাত হয়ে গেলে মাড় গালতে রেখে দিয়ে বাইরে এলো জাহিদা।
অন্ধকার ঘন হয়নি। দিনের চাদর উঠে গেলেও বাতাসে তখনো অল্প দূরে দেখতে পাওয়ার আভা আছে। একপাশে চাদর ঝুলিয়ে মাথা কাত করে হেঁটে আসছে কাদের। কাশছে। খুব শব্দ করে মুখ খুলে কাশে না। সামান্য খুশ খুশ শব্দ হয়, শরীর দুলে উঠে পেট গহবরের মতো হয়ে যায়। রাত তেমন না হলেও ক্ষিদেয় গা টলছে। রান্নাবান্নার অবস্থা বোঝার চেষ্টায় চুলার ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে ডাকলো,
ও জাইদা, ভাত কি হইলো?
এই হইয়ে গেচে, ডাইলডা শুদু তেলের পরে দিতি হবে আঁচলে চোখের ধোয়া মুছে নাকি নাকি গলায় উত্তর দিলো জাহিদা।
তা, মাইয়েডা গেল কনে?
যাবে আর কনে, ওই ফেরদুসীর সাতে যাইয়ে গল্প কইরতেচে।
ফেরদুসির মতোন যদি আমার টেমিরে এটটু পড়াতি পারতাম, মনডা কী ভালো লাইগদো।
ছোট থাকতি আমি তো কইলাম স্কুলি দিতি, তুমি তো সারাদিন কান্দে কইরে ঘুরোই বেড়াইয়ে এই বড় কইরলে। কাল দেখতি আসপে। পছন্দ হলি বে হবে। একন আর ওসব কতা মনে কইরে কষ্ট পাইয়ে লাব নেই। আইসো, ভাত খাইয়ে ন্যাও।
দুই.
টেমির ঘরে আলো জ্বলছে। নিবু নিবু সলতের কুপি খাটের পাশে, মাটির ওপর সারারাত ম্লান হয়ে জ্বলে। অন্ধকারে ঘুমোতে পারে না টেমি। আলোটা নিষ্প্রাণ থেকে সপ্রাণ হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। বাইরে জোরে বাতাস হলে চাচের বেড়া ফুঁড়ে কুপির শিখায় ফুঁ এসে লাগে। দুলে ওঠে আলো। টেমি কথা বলে, কী রে আলো-সই, তোর গায়েও লাইগলো নাকি দোলা। খুব যে দুলতিছিস দেকতিছি। আমার না হয় দেখতি আসবে। তোরও কি তাই? হিহিহি।
ওপাশের বারান্দায় শুয়ে থাকা বাবা মা টেমির ফিসফিসিয়ে বলা কথা শুনে হাসে।
মা বলে, দেকো মাইয়ের কাণ্ড। একা একা আলোর সাতে কতা কয়।
তা কবে না ক্যান? টেমির আলোয় পয়লা মুখ দেইকে বলিলাম, ঘরে আমার আলো আইয়েচে। ও আমার টেমির আলো। এক ন্যাম্পোর তে হাজার আলো জ্বলবে এই দেশে। অন্ধকার আর থাকপে না। কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে কাদেরের। মেয়ের একলা বিড়বিড়ানির দিকে দুইজোড়া কান সচকিত হয়। কদিন পরে ওই ঘরটা খালি পড়ে থাকবে। কেউ আর কথা বলবে না আলো-সইর সাথে।
চাচের দেয়ালে টাঙানো সারি সারি ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে টেমি। পুরনো ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো চেয়ে নিয়ে এসেছে ফেরদৌসীর কাছ থেকে। কি সুন্দর সুন্দর সব ছবি। মডেল মেয়েরা সেজেগুজে ছবি তুলেছে। টেমি ওদের দেখাদেখি সেজেছে কতবার। বান্ধবীকে দেখিয়েছে। ছবি তোলা হয়নি। নিজের ছবি দেখতে কেমন হয় তা দেখতে মন চায় ওর। ছবিগুলোর একটিতে নিজের চেহারাটা বসিয়ে এক পলকে তাকিয়ে থাকে। সেই নিষ্পলক চোখে ঘুম নেমে আসে।
অন্যান্য দিন ভোর হওয়ার আগেই উঠে পড়ে। উঠোনে বসে বাবার হুঁকো টানা দেখে। অন্ধকারের ভেতর অচেনা পাখির মতো যেন ডাক ভেসে আছে, কুড়ুক, কুড়ুক, কুড়ুক…। শব্দের সঙ্গেসঙ্গে মাথা বরাবর কলকের ভেতর আগুন ফুঁসে ওঠে। রাগত অগ্নিস্রোত-ধোঁয়া ঠেলে দেয় ওপরে। তপ্ত ধোঁয়া আর বাবার ফুসফুস নিঃসৃত নীলাভ শুভ্র মেঘময় কুণ্ডুলী মিলে উড়ে যায় দূরের নীলে। আজ উঠে দেখে, ভোর নেই। চারদিকে আলো আনার সেইসব মিহিন বাতাসেরা নেই। বিছানায় বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে। কেমন এক বিষণ্ন শব্দের সুরে সচকিত হয়। আলতো পায়ে উঠে বারান্দায় যায়। দেখে, বিছানার একপাশে কাত হয়ে মা শুয়ে। তার শিয়রে বসে মাথা নিচু করে আছে বাবা। দুহাতের কনুই ভেসে আছে দুপাশে। তার মাঝখানে ঝোঁপের মতো মাথাটা দুলে দুলে উঠছে। সেই দুলুনির ভেতর থেকে উঠে আসছে অবিরাম কান্না। টেমি অবাক হলো। কারণ বুঝতে চেষ্টা করল। ধীর পায়ে এগিয়ে বাবার কাঁধে হাত রাখলো, কী হইয়েচে, আব্বা। এইরাম, বাইচ্চা মানষির মতোন কানতিচাও ক্যান্? কাদের চুপ করে থাকে। জাহিদা তড়াক করে উঠে, টেমির গলা জড়িয়ে ধরে সুর করে কেঁদে ওঠে, ও রে, আমার টেমি রে…। তুই ছাড়া আমার কেউ নেই রে…। তুই চইলে গেলি আমাগের কী হবে…।
তুমরা আইজ বিয়ানবেলা কী শুরু কইল্লে? পালা কইরে কানচিতাও যে? আরে আমি তো এই, তুমাগের সামনে। আমি আবার কনে যাব?
আইজগে তোর দেখতি আসপে, ভুইলে গিচিস? ওরে, আমার আল্লা রে…। আমার কলজেডা কোন্ পরের লোক্ নে যাবে রে…।
হেসে ফেলল টেমি। ভাবল, মা-বাবার একি পাগলামি। হাসি-হাসি মুখে নরম শান্ত গলায় বলে, মা, আব্বা, তুমরা এইরাম ভাব করতিচাও য্যান্ আমি মইরে যাচ্চি। দেকতি আসপে আমার, বে তো না-ও হতি পারে। আর হলিও মাইয়েগের তো শ্বকুর বাড়ি যাতিই হয়। মা, তুমিও তো আইচাও আব্বার বাড়ি। আইচাও না?
হ্যাঁই, আইচি। আমরা ছিলাম চার বুইন। তুই আমার এটটা মাত্র মাইয়ে।
তা-লি এক কাজ করো, মা।
কী?
ওই বিটাগের কইয়ে দ্যাও, মাইয়ে আমরা বে দোবো না। পুষাণী দোবো।
কাদের ও জাহিদা খিলখিল করে হেসে ওঠে। টেমি গম্ভীর হয়ে দেখে।
তিন.
আজ শুক্রবার। স্কুল নেই। ফেরদৌসী সকালের পড়া শেষে উঠোনের কোণের আমতলায় কিতকিত খেলার কোট কাটছে কলসীভাঙা চাড়া দিয়ে। সব বয়সের মেয়েদের এই খেলায় নেয় ফেরদৌসী। একেবারে ছোট্ট দুএকটি ছেলে যারা কিছুটা বড়দের দলে, ফুটবলে ঠাঁই পায় না, ওদেরও নেয়। ওরাও খুশি। খেলা যা-ই হোক, খেলতে অন্তত পারছে। টেমি আর ফেরদৌসী দুজন দুই দলের প্রধান। অন্যদিন খেলার সময় টেমির হাসি আর হইহল্লা শোনা যায় চারপাশের বাড়িঘর থেকেও। আজ নীরবে খেলে যাচ্ছে ও। চাড়া চেলে চেলে এক পা উপরে উঠিয়ে অন্য পায়ের নখ দিয়ে সামনে সরিয়ে দিতে গিয়ে মাটিতে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে পায়ের বুড়ো আঙুলটা। মুচড়েও গেল কয়েকবার। ব্যথা ছড়াল পা বেয়ে শরীরে। চোখমুখ শক্ত করে মুখে হাসি ফুটিয়ে খেলতে লাগলো আবার। হারজিতের মধ্য দিয়ে কখন দুপুর হয়েছে টের পায়নি কেউ। আমগাছের ছায়াটা সরে নেমেছে পাশের পুকুরে। গরমে ঘামে নেয়ে উঠেছে সবাই। আড়চোখে ফেরদৌসী বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েকবার।
এই টেমি, চল গাঙে যাই। চ্যান কইরে আসি।
চল্। হঠাৎ খেলা থামিয়ে উত্তর দেয় টেমি।
আমি জামাকাপড় নে আসি।
যা, আমি কলসিডা আনি, গাঙের পানি দে ভাত রানলি ভালো লাগে। কলের পানিতি কীরাম য্যানো কশ্। কাইলচে হইয়ে যায় ভাত।
ঠিক আচে, আয়। আমি ইকেনে দাঁড়াবানে।
টেমির কাখে কলস। ঘাড়ে নতুন চেকের শাড়ি। সালোয়ার কামিজের বদলে শাড়ি পরার মন হয়েছে আজ। তাই মার শাড়িটা আর গা মোছার জন্য বাবার গামছা নিয়ে গোসলে যাচ্ছে। খালপারের পাশের সরুপথটার দুধারে বিস্তীর্ণ মাঠ। ফসলে ফসলে সবুজ এখন। বেশিরভাগ জমিতে ধান। শীষ হওয়ার আগে আগে পলকা দোলে দুলছে মিহি বাতাসে। এই বাতাস ওদের ওড়না নিয়ে খেলছে। দুজনের ওড়নার কোণা একেকবার এসে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যেতে চাইছে। আবার খুলে খুলে উড়ছে। মনে হচ্ছে, আরেকটু জোরে হাওয়া হলে মেঘ হতে পারতো ওড়না দুটো। ফেরদৌসী হাঁটছে পাশাপাশি। বারবার তাকাচ্ছে টেমির দিকে।
তোর আজ কী হইয়েচে রে টেমি?
কই কিচু নাতো।… মাঠটা কী সুন্দর লাইগদেছে আইজ, দ্যাখ্ দ্যাখ্ ফেরু। বাতাসে মনেই হচ্ছে না এখন গরমকাল। গা-গতর ঠাণ্ডা হইয়ে আইসতেচে।
কিচু না, কলিই হবে? মাঠ কীরাম সুন্দর তা আজ নতুন দেখতিচি? কথা ঘুরোচ্চিস ক্যান্। খেলার সুমায়ও দ্যাকলাম মন খারাপ। আঙুলি ব্যথা পাইয়েও কিচু কলি নে। আমার ক দিনি, কী হইয়েচে?
কথার মাঝখানে ওরা গাঙের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়ল। দুজনই দৃষ্টি মেলে দিলো। সরু জলরেখা ভেসে চলেছে। রোদ সুবোধ বালকের মতো ঢেউয়ের বোটায় তারা ফুটিয়ে চলে যাচ্ছে দক্ষিণের সমুদ্রের দিকে। চরের ঘাটের বাবলা-তলায় কেউ একজন বসে আছে দেখলো ওরা। সাদাকাপড় পরনে। ঘোমটা টানা। ঘোমটার ভেতর থেকে টানা টানা স্বর ভেসে আসছে। ঢেউয়ের ওঠানামার মতো কান্না। এই ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে, গাঙের ঘাটে কেউ নেই। দুপুরের পর মাঠের জনেরা স্নানে গা জুড়িয়ে চলে যাবে বাড়িঘরে। এই সময়ে গাঙের পাড়ে কে এমন করে কাঁদে, ভাবে দুজন। থেমে দাঁড়ায়। ওই পার থেকে কেউ তাকালে দেখতে পেতো, এই ভরদুপুরের রোদে দুটো মোমের প্রতীমা-দুর্গার মতো দেহভঙ্গিতে দাঁড়ানো। বুঝতে চাইছে, মানুষ কেন কাঁদে নদীর কাছে। নদী তো নিজের কুলুকুলু কান্নার ভার নিরন্তর সাগরের কাঁধে সঁপে দেয়। অন্যের কান্না শুনবার সময় কই তার?
একসময় বৃদ্ধা চোখ মুছতে মুছতে উঠে ঘাটের দিকে যায়। এগিয়ে এসে দুজন সেই ছায়ায় বসে।
তোর আইজ দেখতি আসপে, তা শুনিচি আমি।
কিচ্চু তো বলিসনি যে তুই জানিস।
আমি চাইলাম, তুই নিজিই কবি আমার কাছে। তা বরের বাড়ি কনে? দেখতি কিরাম? কি করে?
আমি তো অতো কিচু জানিনে। ঘটক আবদুল চাচা কচ্চিলো, তাই কানে আইলো এটটু এটটু।
সেই এটটু এটটু, এটটুখানি ক। হিহিহি।
ফেরু… তুই এত ঠাট্টা কত্তি পারিস? হেসে ফেললো টেমিও। শুকনো হাসি।
ঠাট্টা মশকরা না করলি কি চলে? আর দুলাভাই আইসে নিক, তোর আগে আমি কান মইলো দোবো।
তুই পারবি কান মলতি? হিহিহি।
হি, তা পারবানে? ও ভালো কতা, তোর বর কী করে বললি?
কী আর করবে? আমি তো লিকা-পড়া কিচু জানিনে। নামডা শুধু লিখতি পারি। তাও তুই শিকোয়চিস। ওর একটা দুকান আচে, বাজারে। হিসাবপাতি রাখতি পারে। আর ঘড়ির কাঁটা চেনে।
বাহ। ভালোই তো। ঘড়ি দেইকে দেইকে মিনিট গুইনে গুইনে সব কাজ করবে? হাহাহা।
ফেরু… । তুই কিন্তু মাইর খাবি একন?
তা, মাইর যত সব আমার দে। জামাইর তো দিবি সব আদর, বুকির সব মধু। হিহিহি।
চার.
মাস তিনেক বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার যাওয়া-আসা করেছে বাবার বাড়ি। বরের মনের ভেতর সবসময় টলমলে সুখ টের পায়। ওকে পেয়ে কত যে খুশি নানাভাবে বোঝাতে চায়। হাঁটবারেও হাঁট ভাঙার আগেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি আসে। শ্বশুর রাগ করে। ও কানে তোলে না। চুপি চুপি মোটা মোটা জিলাপী আর পদ্মপাতায় মোড়া সন্দেশ নিয়ে ঘরে ঢুকে বউকে নিচু আদুরে স্বরে ডাকে। টেমি নামটা পছন্দ নয় জামালের। তাই বাসর রাতে বলেছিল, তোমারে আমি আলো কইয়ে ডাকপো। আপত্তি নেই তো? আমার নাম পছন্দ না হলি, তুমার মতো কইরে নাম দিতি পারো। খুবই অবাক হয়েছিল টেমি। ছেলেরা এমন করে বলতে পারে, বউয়ের কাছে অনুমতি নিতে পারে, তা বাবা ছাড়া আর কাউকে দেখেনি। বলেছিল, তুমার যে নাম পছন্দ তাই কইয়ে ডাকপা। আমার তাতে খুশিই লাগবে। আর তুমার নাম যিডা আচে, সিডাই সুন্দর, জামাল। শুনলি কিরাম জামা-জামা লাগে, মনে হয় সবসময় পইরে থাকি। হিহিহি। টেমির এই আকস্মিক রসিকতায় খুবই মুগ্ধ হয়েছিল জামাল। দুজনের খিলখিল হাসি খড়ের চাল ছাপিয়ে মিশেছিল বাইরের দুধের মতো জোছনায়।
এমন আনন্দ, হাস্যরসময় দিন মলিন হতে সময় নেয়নি। ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি যা-ই হয়, দিন চলে যায়। বাড়ির আশেপাশের যৎসামান্য জমিতে টেমির শাশুড়ির সবজি, বাজারের মাছ, বাড়ির হাঁস-মুরগী রান্নার সালুনে পেট ভরে খাওয়া হয় দুতিন বেলা। নিজে রান্না করে বড় বড় মাংসের টুকরো, ডিমওয়ালা মাছের তরকারি বাটিতে সাজিয়ে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বেড়ে খাওয়ায় শ্বশুরকে। বাবাকে খুঁজে পেতে চায় এই মানুষটার ভেতরে। কিন্তু কখনোই তেমন হেসে কথা বলেননি শ্বশুর। প্রথম প্রথম ভালোই হাসিখুশিই মনে হতো। জামালের মতোই। কিন্তু একদিন ওইপাড়ার এক লোক এলো। পানবিড়ি খেতে খেতে গল্প করলো। তারপর থেকেই যেন বদলে গেলেন শ্বশুর। কানিপাতা অভ্যাস নেই টেমির। তবু রাঁধতে রাঁধতে বারান্দায় তাদের কথার কিছুটা কানে এসেছিল।
ছেইলে বে দিলে, বাড়িতি তো নতুন কিচু দেকতিচি নে, ফজল।
নতুন কিচু মানে? নতুন বউ তো দেইকলে।
তাতো দ্যাকলাম। বলতিলাম, জামালের মতো এত সুন্দুর এককান ছেইলে তুমার। তার বেতে ছাইকেল, ঘড়ি, ট্যানডেসটার কিছুই পাওনা হইলো না?
এত সুন্দর এটটা মাইয়ে দেছে, আর কী দেবে? লোভ করা ভালো না, ছমির। তাছাড়া ঘড়ি দেছে এটটা।
শুধু ঘড়িতি কি কাজ হয়? ব্যবসাদাইরে ছেইলে জামাল। সাইকেল আর নগদ টাকা দিলি ব্যবসা বাড়াতি পাইরতো। ভাইবে দেকো।
এরপরে আর কোনও কথা শুনতে পায়নি। লোকটার দপদপে পায়ের শব্দ উঠোনের শেষে মিলিয়ে যেতে শুনেছিল শুধু।
ওইদিন রাতে জামালের মন খারাপ দেখে কারণ জানতে চাইলো। কিচু না বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে শুয়ে ছিল। চুলে আঙুল চালিয়ে, বুকটা জামালের পিঠে লেপ্টে পরম আদরে চুমু দিয়ে থাকলো টেমি। চুম্বকের মতো ঠোঁটদুটো বিছিয়ে রইলো জামালের ফর্সা পুরুষ্টু চিবুকে। টেমির এলোমেলো চুল হুড়মুড় করে মিশে গেল জামালের চুল ও মুখমণ্ডলে।
আব্বার কোনও কতায় তুমার মন খারাপ?
হুম
কী কতা?
তুমারে তা বলা যায় না।
ক্যান্?। এমন কী আচে যে আমার জানতি নেই?
না না, সেইরাম কিচু না। মানে, তুমারে জানাতি রুচিতি বাঁদে। স্বগত উক্তির মতো বলে, আমার আব্বা, এইরাম ভাবদি পারে, জীবনেও ভাবিনি আলো।
যদি কিচু মনে না করো, এটটা কতা বলি?
বলো
বুজদি পারিচি। স্কুলে না গেলি কী হবে। হিসাব কিতাব ভালোই শিকিচি। কইতর পুষে আলাদা কইরে কিছু টাকা জমায়ে রাকিচি। বাপের বাড়ি আমার ছোট বাইকসোডার মদ্যি আচে। চলো একবার বেড়ায়ে আসি। আর টাকা কডাও নে আসি। তুমার ব্যবসার কাজে লাগবে।
কী যে কও তুমি আলো? তুমার টাকা আমি নিতি যাব ক্যান্?
আমার বলতি একন আর কিচু আচে বলো? ওই টাকাডা রাকিলাম এটটা কতা ভাইবে। তা যকন তুমার ব্যবসায়ে লাব হবে, তকন না হয় দে দিও। একন ন্যাও।…মানা কইরে না।
কী মনে কইরে রাকিলে?
আমার লজ্জা কইরতেচে। তুমি চোক বন্দ করো।
হাহাহ। তুমার চুল না য্যানো ছিরাবন মাসের ম্যাঘ। চোখের ওপরে ছাইয়ে আসে সেই ককন থেইকে। দেকতি কি আর পাওয়া যায় কিচু? হাহাহ।
ভাবদিলাম, আমাদের বাবু হলি পয়লা যেদিন ইশকুলি যাবে, এই টাকা থেইকে ওর বই, ব্যাগ আর জামাকাপড় কিনে দোবো।
ও, সেই কতা? তা থাক তালি টাকাডা।
পাঁচ.
হাটবার। দুপুরে খেয়েই বাজারে গিয়েছে জামাল। শ্বশুরের পাঞ্জাবি, বাজারের থলি আর ছাতা এনে রেখেছেন শাশুড়ি। দুজন মিলে পান খাওয়া শেষ হলে বাজারে যাবেন ফজল। রোদের তেজ আরেকটু কমার অপেক্ষায় রয়েছেন। ডালায় সাজানো পানগুচ্ছ থেকে আরেকটি পানের পেছন ধরে টেনে এনে কয়টুকরো কুচোসুপুরি ছেড়ে দিলেন পানটার মাঝখানে। চুনের কৌটার প্রায় বেয়ে পড়া সাদা প্রলেপে পানের বোঁটা দ্রুত ঘষে চুন তুলে বউয়ের দিকে তাকালেন ফজল। ইশারায় ঘরের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
আলাপ করিচাও বউর সাতে?
কী আলাপ?
একুনি ভুলে গেইলে? ওই যে বলিলাম, বউ যোনো বাপের সাতে কতা কয়, দিনা পাওনার বিষয়ডা।
ও… ওই কতা? তুমি কী যে কও আইজকাল! জামাল আমার যোইগ্য ছেইলে। নিজি কামাই রোজগার করতি পারে। পরের টাকা নিতি যাবো ক্যান্? তাছাড়া কী সুন্দর মাইয়েডা আমরা পাইচি। মানে গোনে কত। বুজ-জ্ঞান খুব। কাজে কম্মে এসপাট।
তাতে হইয়েচে কী? সেদিন ছমির বইল্লো, ও ছেইলে বে দে কী কী পাইয়েচে, আমি বাদ থাকপো ক্যান?
জামালের বাপ, তুমি তো এইরাম ছিলে না। কীডা তুমার মাতা খাইয়েচে বুজদি পারতিচি। ওই ছমির যোনো এই বাড়ি আর না আসে। আরাট্টা কতা তুমার কই। তুমার যদি মাইয়ে থাইকতো, আর ছেইলের বাপ তুমার কাচে টাকা চাইতো। অপমান লাইগতো না? তাই কও?
লাইগদো আমার কচু। দ্যাও ছাতাডা দ্যাও। হাটে যাই।
পারব না কিছু দিতি। নিজি নিজি ন্যাওগে যাইয়ে।
দ্রুত পায়ে ছোট ভায়ের বাড়ির উঠোনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ফজল। ভাইপো মিঠুর সঙ্গে দেখা। চাচার মুখচোখের ভাব দেখে কথা বলার সাহস হলো না। মিঠুর দিকে আড়চোখে দেখে পা বাড়ালেন।
জামালের মা রহিমা তখনো পানের ডালার পাশে বসে। পান মুখে নিশ্চুপ উঠোনের দিকে তাকিয়ে।
ও বড়মা। কী ভাবদিচাও এই দিনে দুপুরে।
ও মা। তুই কনতে উদয় হলি? ভয় পাইয়ে গিচি আমি। হিহিহি।
আমারে কেউ ভয় পায় না, বড় মা। ভালোবাসে। হাহাহা।
কইয়েচে তোরে। তা তুই হাটে যাবি নে?
যাবানে। কেবুল দুপুর গড়াইলো। হাট জমবে আরও পরে।
তোর ম্যাটটিক পরীক্কার আর কত দিন বাকি?
আর কয়মাস আছে বড় মা। দোয়া কইরো।… তা ভাবীরি দেকতিচি নে। আলো ভাবী কনে?
ওই ঘরে। দুপুরে খাইয়ে এটটু গড়াগড়ি দেচ্চে। সারাদিন যা দৌড়াদৌড়ি করে মাইয়েডা।
আমি এটটু দেকা করতি পারি, বড় মা?
এ আবার বলতি হয়? তুই হচ্চিস দেবর। বউর ছোট ভাইর মতোন। দেখা করবি তাতে কী। যা।
খোলা জানালার পাশে বালিশ পেতে শুয়ে ছিল টেমি। বাঁশ বাগানের ওইদিক থেকে ঝনঝন করে বাতাস এসে লাগছিল চোখেমুখে। পড়ে আসা বিকেলের রোদে সেই বাতাস পাপড়ভাজার মতো শুকনো। ঠনঠনে। উষ্ণ। মিঠুর পদশব্দে তাকাল। উঠে আধশোয়া হয়ে রইল। উঠোনের হলুদ রোদ ছায়া ফেলেছে ঘরে। প্রায়ান্ধকার ঘরটা ডুবে আসা সূর্যের কিনারের মেঘের মতো লাগছে।
তুমার কি শরীল খারাপ ভাবী?
না গো ভাই। শরীল ঠিক আচে।
নাপ। তুমার দিকি তাগাইয়ে তা মনে হচ্চে না। আলো ভাবীর হাসির আলো তো পালাম না একনও।
আর এত হাইসে কী হবে ভাই। শুকনো ঠোঁট দুটো দুদিকে হেলে গেলো।
সত্যি কইরে কও, কী হয়েচে।
মাতাডা একটু ধইরেচে। আর কিচু না।
খাটের ডানপাশে বসে টেমির কপালে হাত রাখলো মিঠু। বালিশ সরিয়ে এনে হাঁটুর কাছে পাতলো। মাথাটা ধরে রেখে দিলো বালিশের ওপর। টেমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেলো মিঠুর দুহাতের দশ আঙুল বিছিয়ে বিছিয়ে যাচ্ছে উষ্ণ কপালের ওপর। ওর ঘর্মাক্ত শীতল আঙুলের ছোঁয়ায় চোখ বুঁজে আসতে চাইলো। বলতে ইচ্ছে হলো, থাক মিঠু। মাথা টিপে দিতে হবে না। সরে বোসো তুমি। কিন্তু ওর ওই সাপের মতো চঞ্চল আঙুলে এত মমতা যে কথা-রুদ্ধ হয়ে আছে টেমি। আঙুলগুলো কপাল থেকে নিয়ে ভুরু চেপে চেপে দুচোখের কোণা পর্যন্ত আনছে। মনে হচ্ছে পথের মতো বাঁকা ভুরু দুটোকে আদরে আদরে উড়িয়ে দেবে কবুতরের মতো। কানের ঠিক উপরে ফুলে ওঠা শিরায় বুড়ো আঙুলের পেট মলমের মতো মলে মলে দিচ্ছে। তারপর চুলের গোড়া আলতো টেনে টেনে সেই ব্যথার উত্তাপ মিলিয়ে দিচ্ছে বাতাসে। টেমির ঘুম এসে গিয়েছিল প্রায়। মিঠু মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে তবু। সেই হাতে অন্য কোনো ভাষা নেই। সমবেদনা আর মমতা ছাড়া।
একন ভাল লাইগদেচে, ভাবী?
উমম। প্রায়-ঘুম চোখ হালকা মেলবার চেষ্টা করলো।
কচ্চি কি, মাথাব্যাথা কুইমেচে?
তুমার বউ খুব ভাইগ্যবতী হবে গো দেবর সাহেব। আদরে আদরে পাগলি হইয়ে ঘোরবে পতে পতে। হিহিহি।
আমি কী কচ্চি আর তুমি কী কচ্চাও।
ঠিকই কচ্চি। মাথাব্যথা তো দূরি থাক, জীবনে যেকোনো দুক্কু থাকে, সব ভুইলে গিচি গো ভাই আমার।
জানালার ওইপাশের খসখসে একটা আওয়াজে বাইরে তাকালো দুজন। হলুদাভ রোদের ফালি পড়ে আছে বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে। শুকনো দুএকটা বাঁশপাতা উড়ে চড়ুইয়ের মতো জায়গা বদল করলো।
ছয়.
দোকানের ভার পাড়ার এক বন্ধুর ওপর দিয়ে টেমিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে জামাল। শ্বশুরবাড়ির গ্রাম বেশ পছন্দ ওর। নিজের গাঁ অসুন্দর এমন নয়। তবে এই গ্রামের পাশের নদীটা বড় ভালো লাগে। সবসময় জলজ প্রশান্তিময় বাতাস বয়। একটু পর পর হাঁটতে বের হয়। ফেরদৌসীদের আমতলা হয়ে মাঠের পথ ধরে। কিছুক্ষণ পথের মানুষের সঙ্গে কথা বলে ফিরে আসে। বিকেলবেলা সারামাঠ হেঁটে ফিরে এলে ফেরদৌসীর সঙ্গে দেখা। আমতলায় জলচৌকিতে বসে বই পড়ছিল ফেরদৌসী। জামালকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।
ও দুলাভাই, কুতায় গিছিলেন?
ওই যে নদীডা দেইকে আলাম।
টেমিরে একা থুইয়ে গ্যালেন যে।
ও, রান্না বান্নায় ব্যস্ত, বইললো, তুমি একা-একা যাও দিনি, আমার খুব কাজ আচে আইজ।
তা, আমারে বললিউ তো সাতে যাতি পারতাম। তালি আর একা একা লাইগদো না। হিহিহি।
একন আইসো। চলো, দ্যাকপা আলো কিরাম তোড়জোড় কইরে রান্না কইরতেসে। শুনলাম আমাগের পাড়ার ছমির চাচা আইয়েচে। সাতে সাতে আমারও এটটু খাতির-যত্ন বেশি হবে। হাহাহা।
ছমির বারান্দায় বসে আছে। জামালকে দেখে মুখভার করে তাকালো। ইশারায় পাশে বসতে বলল। জামাল বসল না। ফেরদৌসী রান্না ঘরের দরোজায় গিয়ে দাঁড়ালো।
ওরে ফেরু, ককন আসলি? আইজ বিকেলে আর বাইর হতি পারিনি। চাচা শ্বশুর আইয়েচে। রান্নায় এটটু ব্যস্ত আচি। তুই বয়। ডানহাতের বড় ভাতের চামিচ উঁচু করে ধরে বাম হাতে একটা পিড়ি এগিয়ে দিলো। রান্নাঘরের দরোজার সামনে পিঁড়িতে বসল ফেরদৌসী।
জামাল ছমিরকে দেখছে। এই লোকটাকে ওর আব্বা কেন যে এত খাতির করে, বুঝে উঠতে পারে না। পছন্দ করবার মতো লোক এ নয়। এর কাছে সবসময় খারাপ সংবাদ জমা থাকে। মুখ খুললেই সারখানার মতো দুর্গন্ধ ছড়ায়। শুধু লোকের বদনাম আর কুটনামিতে দিনরাত পার করে। এসে পড়েছে শ্বশুরবাড়ি। ভালোভাবে কথা না বললেও হয় না।
তুমাগের বাড়ির সবাই কিরাম আচে, চাচা?
আমাগের বাড়ির লোকজন আবার খারাপ থাকে কবে? তুইগের বাড়ির কেউ ভালো নেই।
ক্যানো, কী হয়েছে। মার কি শরীল খারাপ? আলো আর আমি কালই বাড়ি আসতিচি। চলো একসাতে যাবানে।
তোর মা ঠিকই আচে, বাপের অবস্থা ভালো না। তার জীবন-মরণ একন তোর হাতে।
ক্যান্, ক্যান্, কী হইয়েচে?
তোর এই বউ-ই কাল্ হবে কইয়ে দিলাম। তোর বউ মিঠুর সঙ্গে নষ্ট। এই কতা গিরামে জানাজানি হইয়ে গেচে।
কী সব আবাল-তাবাল কচ্চাও। যা মুকি আসে তাই কও চাচা? তুমার জন্যি সেই কোন্ সুমায় ধইরে কত কিছু রান্না কইতেচে, কত সমাদর-সম্মান করে তুমার, আর তুমি কিনা…।
জামালের গলার স্বর অজান্তেই জোর হয়। একটু দুরে ফেরদৌসী ও টেমি দুজনই শুনতে পায় কথাগুলো। জামাল কোনোদিকে না তাকিয়ে রাগে অস্থির হয়ে কী বলবে ভেবে পায় না। সামলে নিয়ে মুখ খোলো।
তা, মা কী কচ্চে?
তোর মা তো কচ্চে, বউমার কোনও দোষ নেই। টেমি উরাম মাইয়েই না। আমি শ্বাশুড়ি, আমি জানি।
আব্বা, তাও বিশ্বাস করবে না?
বিশ্বাস করবে কী কইরে? আমি নিজি চোকি দেকিচি। সেদিন বিকেলে…তোর ঘরে…মিটু আর বউমা শুয়ে ছিল। আমি সব দেকিচি। তোর বাপ তালাক-নামা বানায়ে পাটায়েচে। সই কইরে ইরাম বউর মুকি ছুঁইড়ে মাইরে চল্ বাড়ি যাই।
তোর এত্ত বড় সাহস। আলোর নামে বদনাম করিস। চানের আলোয় দাগ থাকতি পারে, আমার আলোর গায় এটটা তিলও নেই। তুই এটটা আস্ত শয়তান। লোকের বদনাম করা ছাড়া তোর আর কোনো কাজ নেই। তোরে চাচা কইয়ে ডাকি শুদু আব্বার জন্যি। তোর মতন জানোয়ারের ক্যান্ যে পাত্তা দেয় আব্বা, বুজি নে। কথাগুলো বলার পরপরই প্রচণ্ড এক চড়ের শব্দ হলো। চড় খেয়ে পাটিতে কাত হয়ে কোকাতে লাগলো ছমির। লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে চিৎকার করতে লাগলো।
তোর বউ তোর চাচাত ভাইর সাতে ফষ্টিনষ্টি করে। আমি নিজি দেকিচি। সারা গিরাম জানে। তোর ভালোর জন্যি কচ্চি। আর তুই আমার গায় হাত তুললি? দাঁড়া একুনি যাইয়ে কচ্চি তোর বাপের।
ছুটে এসে ছমিরের মাজায় কষে এক লাথি দিলো জামাল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে উঠে দৌড়াতে লাগলো ছমির। পেছনে পেছনে জামাল। চারপায়ের দুপদাপ শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই টেমিদের বাড়িতে লোকজন এসে ভরে গেলো। সন্ধ্যা তখনো নামেনি। কিন্তু চারদিক অন্ধকার ঠেকছে টেমির কাছে। ফেরদৌসী জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে। চুলার জ্বাল নিভে আসছে। আধপোড়া পাটকাঠি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। বিড়বিড় করে ফেরদৌসির দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত গলায় বলল, ফেরু, তুই বিশ্বাস কর। আমি খারাপ কিচু করিনি। ও আমার দেবর। হাসিখুশি আর একটু বেশি সরল। আমারে বুনির মতোন ভালোবাসে। শ্বাশুড়ি জানে সব।
আমি জানি টেমি। তোর আর কতি হবে না। লোকের কতায় কান দিস নে।
কিন্তুক, সারা গিরাম জাইনে গেলো। মিথ্যেডারে সত্যি বানাতি তো মানষির সুমায় লাগে না। আর জামাল যদি আমার ভুল বোজে। ও আল্লাহ, একন আমি কী করব?
তুই একন চল, টেমি। ঘরে চল। তোর মা চইলে আইয়েচে পাড়াত্তে। তোর আর রানতি হবে না।
উঠোনের হৈ চৈর ভেতর টেমিকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো ফেরদৌসী।
সাত.
ছমিরকে তাড়িয়ে দিয়ে জামাল ফিরে এলো। উঠোনে তখনও লোকজনের হট্টগোল। তাদের বলল, ওই ছমির আমাগের গিরামের এক পাগল। যিকেনে আত্মীয়র গোন্দ পায়, যাইয়ে কুটুম হয়, ভালোমন্দ খাওয়ার জন্যি। ওর কতায় কান দেবেন না আপনারা। আলো আমার বউ, আমি ওরে চিনি। আপনাগের মাইয়ে, আপনারাও চেনেন। পরের মুকি ঝাল আমরা খাব ক্যান্?
সবাই একে একে সরে গেলো। কাদের আর জাহিদা মেয়েকে অনেক বুঝিয়েও রাতে খাওয়াতে পারলো না। জাহিদা জামালকে ডেকে বলল, বাবা জামাল, দ্যাকো দুডো মুকি দিয়াতি পারো কি না। ও যে কানতি কানতি মইরে গেলো।
জামালের শত অনুরোধেও রাতে ভাত খেলো না। একটু পর পর উঠে মেঝের কুপির শিখার দিকে চেয়ে থাকে। হাতের বাতাসে আলো হেলায়। অস্ফুট স্বরে কথা কয়। জামাল টেনে এনে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চায়। হাত ছাড়িয়ে নেয় টেমি।
দুপুর রাত। চোখ কখন বুঁজে এসেছে টের পায়নি জামাল। হঠাৎ গোঙানির শব্দে ঘুম ভাঙল। উঠে দ্যাখে মেঝের কুপি অতি ক্ষীণ শিখায় জ্বলছে। কারও হাত-পা দাপানির শব্দ। লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে উবু হয়ে পড়ল সামনের দিকে। টেমির মুখ ভেসে উঠল। উৎকট গন্ধ মুখে। চিবুকের দুপাশ দিয়ে ফেনা ঝরছে।
ও, মা, শিগগির আসেন। আলো বিষ খাইয়েচে, আমার আলো বিষ খাইয়েচে।
পাশের বারান্দা থেকে কাদের আর জাহিদা দৌড়ে আসে।
ও আলো, আলো রে, তুমি একি কইল্লে? আমি কইছি, সারা দুনিয়া এক দিকি আর আলো এক দিকি। আমার আলোর কোনো খুঁত নেই। তাও তুমি আমারে ছাইড়ে ক্যানো চইলে যাতি চাও। তুমারে ছাড়া আমি বাঁচপো কী কইরে?
জামালের কান্নায় জোছনা রাতের আধো অন্ধকার দ্রুত সরে গিয়ে চারদিক আলোময় হয়ে উঠতে চায়। নদীর ওইদিক থেকে জলজ বাতাস আরও ভেজা, আরও ভারী হয়ে বয়। টেমি অতি কষ্টে, জামালের মুখের দিকে চোখ তুলে বলে, আমার মাতা ঠিক ছিল না গো। বাড়ি যাইয়ে মানসীর সামনে মুখ দেকাবো কী কইরে, এই লজ্জায় মইরে যাচ্চিলাম। মাফ কইরে দ্যাও। ওই বাইকশোর মদ্যি টাকা আছে। যা তুমারে কইলাম একদিন।
ডাক্তার আনো। ওরে খুদা আমি এ-কি করিচি। আল্লাহ আমার বাঁচাও। ও বাপ, ও মা.. তুমরা ঝিগরগাচা থেইকে ডাক্তার আনো।…বুক জ্বইলে গেলো। বলতে বলতে নিথর হয়ে এলো টেমির শরীর।
চোখদুটো তখনো কুপির মিনমিনে শিখার দিকে চেয়ে আছে।