ভেবেছিল—ডাক্তারি পেশাটা মহত্তের কাজ। অথচ পেশায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছে এর মতো মোহাচ্ছন্নতা আর মিথ্যের মিথস্ক্রিয়া ছড়ানো পেশা একটিও নেই পৃথিবীতে। আগে জানলে এই বিদঘুটে বিষয়ের বিবরে পা বাড়তো না দিশা। কিন্তু শৈশব থেকেই মা মনপ্রাণ উজার করে চাইতেন—তার মেয়ে একজন গাইনোক্লোজিস্ট হবে। এতসব থাকতে মা কেনো তাকে গাইনোক্লোজিস্ট বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, তা জানতে পারে সেদিন, যেদিন সে গাইনি ও প্রসূতিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাস করে সত্যিকারের একজন গাইনোক্লোজিস্ট হয়েছিল।
অ্যাপ্লাই করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বেসরকারি হাসপাতালে অপ্রত্যাশিতভাবে চাকরি হয়ে যায় দিশার। সম্মানজনক বেতন, বোনাস, ট্রানজিটসহ বিবিধ সুবিধা দিয়েই মাদার হসপিটাল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়। কিন্তু এতসব বাস্তবায়িত হবে কেবল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের একটা শর্ত মেনে নিলে। কী সেই শর্ত? ভাইভাবোর্ডের টেবিলে ক্যান্ডিডেড-চেয়ারে বসেই জানতে চেয়েছিল দিশা। অফিস টাইম শুরু সকাল দশটা থেকে হলেও আপনাকে আসতে হবে আরও এক ঘণ্টা আগে। আপনার মূল্যবান এই এক ঘণ্টা আপনি ব্যয় করবেন মাদার হসপিটাল অ্যান্ড কলেজের গাইনি-ক্লাসে। আন্তরিকতার সঙ্গে ভাইভাবোর্ড থেকে তাকে জানানো হয় শর্তটা। প্রতিযোগিতামূলক পেশার বাজার চিন্তা করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের অতিরিক্ত শর্তে সম্মত হয়ে মাদার হসপিটাল অ্যান্ড কলেজে যোগ দেয় দিশা। সেই গাইনি-ক্লাসে এখন ডুবে আছে কোনো এক বিজ্ঞ ডুবুরির মতো।
আমরা যদি বন্ধ্যাত্বের কারণ খুঁজতে যাই তাহলে প্রথমে দেখতে হবে—সন্তান কিভাবে জন্ম নেয়। একজন মেয়েশিশুর প্রথমদিকে ডিম্বাণুর পরিমাণ থাকে দশ থেকে বিশ লাখ। আস্তে আস্তে সেই শিশু যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয় বা মাসিকের সময় হয় (আমাদের দেশে মাসিকের সময় দশ থেকে চৌদ্দ বছর) তখন মেয়েদের ডিম্বাণুর পরিমাণ থাকে চল্লিশ হাজার। বাকি ডিম্বাণুগুলো কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়। এই সময় (১০-১৪ বছর) থেকে ৫২ বছর বা আরও ফিক্সড করে বললে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিমাসে বিপুল সংখ্যক ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর। কেবল একটা ডিম্বাণু প্রতিমাসে পরিস্ফুটন হয়। এই মাসিকের সময়টা হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ দিন। ১৩ বা ১৪তম দিনে ডিম্বাণু ফোটে। সেটা তখন ডিম্বনালীতে আসে। যদি সে পুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হয়। তখন জাইগোট তৈরি হয়।
সেটি পরে জরায়ুর ভেতরে যায়। জরায়ুকে আঁকড়ে ধরে ভ্রূণ তৈরি হয়। ভ্রূণ ধীরে ধীরে বড় হয়ে মানবশরীরে রূপ নেয়। সেটি প্রসবের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসে। এভাবে জন্ম নেয় মানবসন্তান। এটা হচ্ছে সন্তান জন্মদানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমি আমার অধিকাংশ রোগীর বেলায় দেখি—ডিম্বাণু বড় না হওয়া। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পলিসিস্টিক অভারিয়ান সিন্ড্রম জিনিসটা হয়। এছাড়া থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে বা প্রোলেকটিন হরমোন বেড়ে গেলে ডিম্বাণু পরিস্ফুটন নাও হতে পারে বা বড় নাও হতে পারে। এছাড়া অ্যান্ড্রোমেট্রোসিস্টের কারণেও অনেক সময় ডিম্বাণু বড় না হওয়া বা পরিস্ফুটন না হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। আরেকটা বিষয় হলো—মানবদেহে যেসব প্রজননতন্ত্র আছে—জরায়ু, জরায়ুর দুই পাশে ডিম্বনালী আছে, তার নিচে আছে মাসিকের রাস্তা বা যোনিপথ। যদি কারও ডিম্বনালীতে সমস্যা থাকে বা বাধা থাকে, সেক্ষেত্রেও স্বাভাবিক সন্তান ধারণে সমস্যা দেখা দেয়।
ক্যাপিটাল অ্যালফাবেটে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বৃহদাকারে লেখা গাইনি ও প্রসূতি বিভাগ এর কাচের তৈরি স্বচ্ছময় স্লাইডিঙের বিশাল দরজাটা পুশ করলেই তার কর্পোরেট ডেকোরশনের চেম্বার। যার দরজার চূড়ায় ই-গতিতে লাল সবুজ রঙের কয়েকটা বাক্যের সমষ্টি একটা বাক্য যাওয়া-আসা করছে একঘেঁয়েমিভাবে। বাক্যটা এরকম—‘ডাক্তার দিশা, গাইনোক্লোজিস্ট, এমবিএস (গাইনি ও প্রসূতি, ঢামেক), শুক্র, শনি, সোম ও বুধবার (সকাল: ১০টা থেকে বিকাল: ০৫টা)।
ভাবছে, আজকে ঈশপের গল্প থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা মিথ্যেবাদী কাউবয় আসাদকে দিয়ে এগুলো পরিষ্কার করাবে। রিপ্রেজেনটেটিভকে তাড়াহুড়ো বিদায় করে পেশেন্টকে ‘অলাইকুম আসসালাম’ সম্মোহনে বসতে বলেন দিশা।
আর দরজার পিঠের মধ্যভাগে ডিজিটাল নেমপ্লেট হুবহু দরজার চূড়ায় ই-গতিতে একঘেঁয়েমিভাবে যাওয়া-আসা করা লাল সবুজ রঙের কয়েকটা বাক্যের সমষ্টি বাক্যটাই যেন চার লাইনের স্তবকে সাঁটানো হয়েছে অতি ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে। চাকচিক্যের অন্তর্গত প্রবাহে সম্ভাব্য জন্মকে নিয়ে বিবিধ কারচুপি চলে প্রতিনিয়ত। তবু ক্লাস শেষে এখানেই ফিরতে হয় তাকে।
কেবল মৃত্যুর মর্মরি ছাড়া জীবনের কোনো জৌলুস নেই—যেন জ্যোৎস্না নেই এখানে। এই যেমন আজকে একটু আগে শাহিদা নামের এক গর্ভবতী পেশেন্টকে গাইনি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল প্রসবের জন্য। প্রথমদিকে সব ঠিকঠাক ছিল কিন্তু শেষ রক্ষা আর করা যায়নি। পানি ভাঙতে ভাঙতে নিঃশ্বাস পতনের মুখে পতিত হয় বাচ্চা-সমেত মা পেশেন্ট। ঢামেকে রেফার্ড করলে অ্যাম্বুলেন্সেই নিথর হয়ে যায়। কেবল আফসোস আর অনুশোচনায় ফেটে পড়া ছড়া অন্য কোনো আবেগ জানে না সে। যেমন একটা একশ টাকার বাংলাদেশি নোটের কাছে হসপিটালের নিয়ম ভঙ্গ করে পেশেন্টের পরিবর্তে রিপ্রেজেনটেটিভকে চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া পিয়ন আসাদের কাজ। ‘পেশেন্ট নেই ম্যাডাম’ নামক একটা মুখস্ত অজুহাত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তার চোখ রাঙানির রাহু থেকে পার পেয়ে যায় বরাবরই। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
সমস্যা ছাড়া তার কাছে কেউ আসেন না। না পেশেন্ট, না কর্তৃপক্ষ। এই যেমন রিপ্রেজেনটেটিভরাও। টার্গেট অ্যাচিভমেন্ট না হওয়ার সমস্যা নিয়েই তার কাছে আসেন তারা। এই যেমন সাজ্জাদ সাহেব এসেছেন। কিন্তু সেটা মুখে না বলেও তাদের কর্পোরেট চেহারার ছাপ দেখে দিশা বিষয়টা বেশ বুঝতে পারে। ম্যাডাম, এই অ্যাবরশন পিলটা লিখেন। খুব ভালো এটা। ম্যাডাম, এই এমএম কিটটা আপনাদের হসপিটালে ব্যবহার করুন। এটা আমাদের কোম্পানির নতুন প্রোডাক্ট। জানেনি তো আমাদের প্রোডাক্ট স্ট্রেলিয়া থেকে আসে। হাতে জোড়া জোড়া স্যাম্পলও সসম্মানে তুলে দিতে ভুল করেন না কেউ। ডাক্তারের সামনে রিপ্রেজেনটেটিভরা বিপুল বিনয়ী, বিনম্র ও অনুগত হয়ে থাকে। তার কারণও একটাই, আর তা হলো সেই টার্গেট অ্যাচিভমেন্টের গন্তব্যগলি অব্দি নিজের দায়িত্বশীলতাকে নিয়ে যাওয়া, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সফলতা জয় করা। ঘরে বউয়ের সঙ্গে এরকম বিহ্যাভ প্রদর্শন করলে হয়তো সাজ্জাদের ওয়্যাইফ সংসার ছেড়ে একেবারে চলে যেতো না।
শ খানেক স্যাম্পলে নিচের ড্রয়ারটা ভরে এখন ওপরের ড্রয়ারটাও দখল করেছে। দিশার এসব ভালো না লাগলেও সহ্য করতে হয়। কখনো মুখ বুঁজে, কখনো হাস্যোজ্জ্বলতায়। ভাবছে, আজকে ঈশপের গল্প থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা মিথ্যেবাদী কাউবয় আসাদকে দিয়ে এগুলো পরিষ্কার করাবে। রিপ্রেজেনটেটিভকে তাড়াহুড়ো বিদায় করে পেশেন্টকে ‘অলাইকুম আসসালাম’ সম্মোহনে বসতে বলেন দিশা।
কত রকমের পেশেন্ট আসে তার কাছে। একেক পেশেন্ট একেক ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে। এদের মধ্যে ভ্রূণ হত্যাকারীদের সংখ্যাই বেশি। এরা নানাভাবে এই অন্তর্জালে আবদ্ধ হয়ে আসে। আপনাদের সমস্যা কী? মুখে প্রফেশনালি হাসি ছড়িয়ে জানতে চান দিশা। আমরা হাজবেন্ড-ওয়াইফ। এক বছর হলো বিয়ে করেছি। দুজনেই চাকরি করি। দেখাশোনার জন্য কোনো গার্ডিয়ান আমাদের নেই। এছাড়া আমরা এখনো সেটেলড হইনি। তার মানে…তার মানে আপনারা বাবা-মা হতে চান না—তাই তো? তাদের কথা শেষ না হতেই দিশা একজন স্মার্ট ডাক্তারের ভাষায় পূর্বের বাক্যগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে বলেন। ঠিক তাই। হাজবেন্ড-ওয়াইফ উভয়েই সমস্বরে উত্তর দেয়। দিশা তাদের জন্য একটা অস্থায়ী ব্যবস্থাপত্র লিখে কনডম ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করে আসতে বলেন।
পেশেন্টের মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। দিশা ব্যবস্থাপত্রে অ্যাডমিশন লিখে আসাদের মাধ্যমে সিস্টারের সঙ্গে ১৪ নাম্বার কেবিনে পাঠায়। বলে, আপনারা যান। সব বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। দায়িত্বে কোনো অবহলো করা হবে না, বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আরেকটা পেশেন্ট দেখে আসছি।
আগে থেকে ঢেকে রাখা সিরামিকসের শাদা পিরিচটা সরিয়ে কফির কাপটা ঠোঁটের কাছাকাছি আনে। শুষ্ক গলা ও তার আশপাশ উষ্ণ-আর্দ্রতা ঢালতে গিয়ে দেখে কফিটা জমে হিমঘর হয়ে গেছে। বসুন্ধরা টিস্যুর সাহায্যে ঠোঁটে লেগে থাকা কফির ছিটাফোঁটা মুছে আসাদকে আবার পেশেন্ট পাঠাতে নির্দেশ দেয় দিশা। আসাদ পেশেন্ট পাঠায়। হ্যাঁ বলুন, আপনাদের সমস্যা কী? দেখুন—ছেলেমেয়েদের ঝাঁমেলা আমাদের ভালো লাগে না। বোঝেন-ই তো, এই সেলফিশ নিউটালিজমের যুগে সন্তান দিয়ে কী হবে। শেষমেষ বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া তো কোনো ঠিকানা খুঁজে পায় না এই দিশে হারানো বার্ধক্যসমূহ। তাই, মনস্থির করেছি, আমরা আমরণ নিঃসন্তান থাকবো।
কারও কারও সন্তানই হয় না। এজন্য তাদের কতো আকুতি শোনা যায়। কী করলে একটা মানবসন্তান লাভ করা যাবে। পারলে দিশার পা ধরতেও কুণ্ঠাবোধ করে না অনেকেই। আর এরা তাদের উল্টোটা চাচ্ছে। সেই স্বপ্নময় ভ্রূণাগমনের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিতে চাইছে। কী কিম্ভুত এই পৃথিবী! আরেকটা ভ্রূণ হত্যার ব্যবস্থাপত্র লিখতে গিয়ে হাতটা কেমন ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। দিশা মনে মনে বেগানা ভয় বোধ করে। ডাক্তার হলেও সে তো কোনো এক রক্তমাংসের মানুষ। কেমন যেন ঘোরের ঘূর্ণিপাকে মূর্ছা যেতে থাকে দিশা। কোনো এক চল্লিশোর্ধ্ব মহিলার পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে সম্বিৎ ফিরে পায় সে।
আপা, মোর স্বামী দিনমজুর। ‘দিন আনি দিন খাই’ দলের মানুষ। ম্যালা ছাওয়াপোয়া হামার। হামরা এমাকগুলাক ভালো করি খাবার দিবার না পারলেও জন্মনিয়ন্ত্রণ কইরবার পারি না। দিশা বলেন, কনডম ব্যবহার করেন না কেন? কনডম, কনডম কী, আপা? খুব অবাক হয়ে জানতে চায় মহিলা। দিশা মহিলার প্রশ্নে অবাক হয় না। এটা তাদের জীবনযাপনের দুর্বলতা। পিল খান? দিশা বিরক্তি হাইড করে বলে। খাই তো। কিন্তু মাঝে-মধ্যে মনে থাকে না, মহিলা বলে। ঠিক আছে। একটা ইনজেকশন লিখে দিচ্ছি। ফার্মেসি থেকে কিনে আমাদের সিস্টারকে দিয়ে আজই পুশ করে নেবেন। আশা করছি, আগামী পাঁচ বছরেও আপনাদের জনসংখ্যা বাড়বে না। লিখতে লিখতে লাঞ্চের সময় হয়ে যায়। আবার আসবেন বলে পেশেন্টকে বিদায় করে কলিংবেলে চাপ দেয় দিশা। কাক-কর্কশ গলায় বেলটা বেজে উঠলে আসাদ চেম্বারের ভেতর আসে। পেশেন্ট আছে?—ছোট একটা প্রশ্ন ছুড়তেই মাথা অব্দি বা, হাতটা স্ক্রল করে উশকো-খুশকো চুলের গোছায় বিলি কাটতে কাটতে উত্তর দেয় আসাদ। তিনজন আছে, ম্যাডাম। এখনই পাঠাবো নাকি লাঞ্চের পরে? দিশা তাদের পাঠাতে বলে। লাঞ্চের সময় হলেও দিশা পেশেন্ট দেখেই যায়।
তারপর আরেকজন পেশেন্ট আসে। প্রথম দেখাতেই দিশার মনে হয়—তার বিয়ে হয়নি। মা সঙ্গে ছিল। লজ্জায় বেদানার মতো লাল হয়ে যাওয়া মেয়েটা মুখ খুলে পরিষ্কার করে কিছুই বলতে পারছে না। মুখে থতমতো কম্পনের বেড়ি দেখে মা-ই এগিয়ে আসে। আসলে ও একটা ভুল রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছিল। আর তা থেকেই এই ভয়ানক ভুলের উৎপন্ন। বলতে পারেন আমরা একটা ভুলজাত ভূগোল থেকে এসেছি। না বোঝার কোড়কে ডুবেই হয়তো এরকমটা ঘটেছে। অ্যাবরশন করাতে হবে। আপনারা কি সেরকম প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন? দিশা বলে। পেশেন্টের মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। দিশা ব্যবস্থাপত্রে অ্যাডমিশন লিখে আসাদের মাধ্যমে সিস্টারের সঙ্গে ১৪ নাম্বার কেবিনে পাঠায়। বলে, আপনারা যান। সব বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। দায়িত্বে কোনো অবহলো করা হবে না, বিশ্বাস করতে পারেন। আমি আরেকটা পেশেন্ট দেখে আসছি।
অপ্রকাশ্যে অন্তর্গত বেগানা ভয়টাও তার সঙ্গে যোগ হয়ে দপ করে জ্বলে ওঠা গুমোট অন্ধাকারে আরও যেন ভয়াল হয়ে ওঠে। সবিশেষ এতসব তুচ্ছতায় উড়িয়ে দিয়ে সাহসিনীর স্বর চিড়ে বেড়িয়ে আসে—আমি একজন গাইনোগ্লোজিস্ট।
লাল ইন্টারকমটা ঐরাবতের মতো বেজে ওঠে। কলারের স্পষ্ট স্বর শোনা যাচ্ছে। অ্যানেশথেসিয়ান মৌসুমী ম্যাডাম চলে এসেছেন। আসছি বলেই নিজের গাইনি বিভাগের বিবিধ রঙের চেয়ারটা ছেড়ে নীলাভ লিফটে চেপে তিনতলায় আসে দিশা। লিফটের ডানে ঘুরলেই শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল কাচের প্রাচীরে বেষ্টিত আধুনিক সাজসজ্জার অপারেশন থিয়েটার ঝিলিক দিয়ে ওঠে। থিয়েটার নয় যেন ভ্রূণ হত্যার কদর্য কারখানা এটি—মাঝে-মধ্যে মনে হয় দিশার। পিপিই পড়ে দিশা থিয়েটারে ঢুকে পড়েন হন্তারকের ভূমিকায়। সিলভার কালারের স্টিলের অত্যাধুনিক সিজারে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যকৃতের মতো একটা ক্ষুদ্রতর রক্তাভ-পিণ্ড বের করে আনে পৃথিবীর ট্রেতে। তারপর সিস্টার সেটা পলিথিনে পুরে ময়লাটে কোনো এক বাস্কেটে রাখে। এভাবেই কত যে ভ্রূণের হত্যাকারী হয়ে উঠেছে সে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আর এভাবেই অজস্র প্রাণ পূর্ণ রূপ পাওয়ার আগে পৃথিবীতে ময়লার মতো উড়ে যায় মাতৃজরায়ু ছিঁড়ে শহুরে ডাস্টবিনের বিবরে।
অ্যাবরশন করলে দিশা কোনো কিছু মুখে দিতে পারে না। যাই দেখে, তাতেই ভেসে উঠে সেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পৃথিবীর ট্রেতে আনা ক্ষুদ্রতর রক্তাভ-পিণ্ড। অভিরুচি একেবারে নষ্ট হয়ে যায় তার। আজও সেটার ব্যাতিক্রম হয়নি। দুপুরের সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর এখন-অব্দি এক গ্লাস পানি মুখে দেয়নি সে। হসপিটাল থেকে খুব ক্ষুধার্ত ক্লেদাক্ত হয়ে ফিরলে জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক মা তাকে সঙ্গ দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। দেখো, এসময় না খেলে তোমার শরীর খারাপ করবে। আমার মতো একজন জীববিজ্ঞানের অধ্যাপকের চেয়ে তোমার মতো গাইনির ডাক্তার সেটা ভালো জানে। পেটে যে তরমুজের মতো আমার নানাভাই বা বোনটি আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে, তা তো শ্রাবণের মেঘে মূর্ছা যেতে পারে না। আরে, তাই তো! আমার জরায়ুতে তরমুজের মতো যে সূর্য বা চাঁদটা বেড়ে উঠছে তাকে তো একদম ভুলেই গেছি। সরি বলে মায়ের কাছে ক্ষমা চায় দিশা। জোর পূর্বক অল্প কিছু খেয়েদেয়ে মায়ের বুকে আশ্রয় খোঁজে দিশা।
শৈশব থেকে সে মায়ের কাছেই থাকে। মা-ই তার মা, মা-ই তার বাবা। যখন সে তার মায়ের জরায়ুতে ছিল, তরমুজের মতো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলো চাঁদের মতো, তখনই তাকে হত্যার পাপে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কোনো এক পুরুষজাত পিতা। সেই পুরুষের পরম পূজারি না হয়ে বিরঙ্গনার মতো পুরুষের প্রাসাদ ছেড়ে মাতামহির এই মমতা পল্লীতে ওঠেন তার মা। এ গল্প সে তার মাতামহির কাছেই শুনেছিল কোনো এক ঝুমবৃষ্টির রাতে।
আগামীকাল তিন মাস পূর্ণ হলেই আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট বলে দেবে—তরমুজের মতো বেড়ে ওঠা প্রাণটা সূর্য নাকি চাঁদ হবে। চাঁদ হলে পুরুষজাত পিতার মতো কানাডাপ্রবাসী পাভেলও কী হত্যার পাপে মরিয়া হয়ে উঠবে! নাকি পরম পিতৃত্বের পালকে তাকে জড়িয়ে নেবে আজন্মকালের জন্য পিতার পাঁজরে। বাইরে ঝড় হচ্ছে। বারবার সেই ঝড়ো হাওয়ার ঝাপ্টায় জানালাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। কখনো জানালা বিদীর্ণ করে ঝড়ের সিম্ফনি রুমের হৃদপিণ্ডে ঢুকতে চাইছে। অপ্রকাশ্যে অন্তর্গত বেগানা ভয়টাও তার সঙ্গে যোগ হয়ে দপ করে জ্বলে ওঠা গুমোট অন্ধাকারে আরও যেন ভয়াল হয়ে ওঠে। সবিশেষ এতসব তুচ্ছতায় উড়িয়ে দিয়ে সাহসিনীর স্বর চিড়ে বেড়িয়ে আসে—আমি একজন গাইনোগ্লোজিস্ট।