মনোয়ারের সঙ্গে বিয়ের পর যেদিন প্রথম দেখা হয়, সেদিন আতঙ্কে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। অথচ আমি ধরেই নিয়েছিলাম মনোয়ারের সঙ্গে আবার দেখা হলে আমি বেশ সপ্রতিভ হয়ে হাই-হ্যালো করবো। স্মার্টনেসের চূড়ান্তরূপ দেখানোর একটা ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। মনোয়ার আমার প্রথম প্রেমিক। যে প্রেমিকের হাত ধরে কিশোরী তার প্রেমের কৌমার্য ভাঙে, মনোয়ার আমার সেই প্রেমিক। আমার প্রেম প্রথম হলেও মনোয়ারের তালিকায় আমি কত নম্বর প্রেমিকা, সেটি জানা হয়নি কোনোদিনও।
আমি আর আমার স্বামী সকালের কাঁচাবাজার করতে বের হয়েছিলাম। বাড়ির কাছেই বাজার বলে গাড়ি না নিয়ে দুজনেই রিকশা করে যাচ্ছিলাম। মনোয়ার রঙ সাইড দিয়ে বাইকে চেপে আসছিল। আর পড়বি তো পড় মালির ঘাড়েই। আমাদের রিকশার সঙ্গেই বাধিয়ে দিলো। আমি প্রথমে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত ছিলাম। সেই ভয় কাটিয়ে দিলো আমার স্বামী আরিফ। আমাকে এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ভয়ঙ্কর একটা গালি দিয়ে উঠলেন। সাধারণত মোটর বাইক চালকরা সাঁই করে কেটে যায়, কিংবা পালটা খিস্তি করে, মনোয়ার তো তেমন ছেলে নয়, বিনয়ই তার একমাত্র পুঁজি। স্যরি বলতে বলতে নেমে এলো। আরিফও স্যরি শুনে মাফ করতে নেমে গেলো। যেই মুহূর্তে সে হেলমেট খুললো আমার দ্বিতীয়দফা ভয় জাগলো। আরিফ কি চেনে মনোয়ারকে? আরিফের সঙ্গে স্যরি পর্ব শেষ করে মনোয়ার আমার দিকে তাকাতেই সেও একটা অদ্ভূত ফ্যাকাশে চেহারা করে ফেললো। আমাদের সাত বছরের প্রেম যেভাবে শেষ হয়েছে, তাতে আমাদের কাউকে দোষারোপ করার সুযোগ ছিল না। আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের পথ বেছে নিয়েছিলাম। তাই ফ্যাকাশে বা সিঁটিয়ে ওঠার কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি উঠেছিলাম। কারণটা মনোয়ার নয় আরিফ।
মনোয়ার নীরবতার বরফ ভেঙে জিজ্ঞাসা করলো, পাখি তোমার কোথাও লাগেনি তো। আমিও বলি, না-না লাগেনি, আপনার লেগেছে কী? সঙ্গত কারণেই আরিফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁটকাটা মনোয়ার আমাদের প্রেমের গপ্প পেড়ে ফেলার আগেই বললাম, ছোট কাকার বন্ধু। আমরা একই পাড়াতে থাকতাম। আমাদের সেদিনের হাই-হ্যালো সেই পর্যায়েই শেষ। আমি সেদিন থেকে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, ছোট কাকার সঙ্গে যেন আরিফের আগামী এক বছরে দেখা না হয়, দেখা হলেও যেন মনোয়ারের কথা মনে না থাকে। তবে আরিফের যে স্মৃতিশক্তি, দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছে, সেটি মনে না থাকলেও পাঁচ বছর আগে কে তার জুতা অসুন্দর বলেছিল, সেগুলো মনে থাকে।
বিয়ের আগে প্রেম থাকতেই পারে। কিন্তু পুরনো সব প্রেমিকদের নিয়ে সংসারে ভীত হয়ে বেঁচে থাকার ঘটনাটা বিয়ের দিন রাত থেকেই শুরু হয়েছিল। আরিফ বেশ গম্ভীর গলায় বলেছিল—দেখো পাখি, আগে তোমার কয়টা বয়ফ্রেন্ড, কয়টা প্রেমিক ছিল, সেগুলো খুঁজতে যাব না। কিন্তু তাদের কারও সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ রয়েছে, এটি আমি মানবো না। সেই রাতে আমার খুব বিপ্লবী হয়ে ঝেড়ে ফেলার কথা থাকলেও আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম—এমনটি হবে না। কিন্তু একই শহরে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ থাকতেই পারে, পথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে একসঙ্গে বসে চা খাওয়ার ঘটনা ঘটতেই পারে এটা আরিফকে কেন, বুঝাইনি সেটা মাথায় আসেনি।
লঙ্কাকাণ্ড ঘটলো বিয়ের তৃতীয়দিন। আরিফের ভাগনে জয় বাসায় এসে হুলুস্থূল— আরে মামি তুমি নাসিম বসের বান্ধবী ছিলা? বস তো তোমার এই প্রশংসা সেই প্রশংসা। সদ্য বিবিএ পাস করা চাকরি পাওয়া কর্পোরেট বসের সঙ্গে আমার ক্ষণিকের হৃদ্য ছিল। আসতে-যেতে পথে যেমন করে হঠাৎ ভালো লেগে যায়, সে রকম একটু মাখা-মাখি। ফোনে একটু ইশ!, যাহ দুষ্টু টাইপের গল্প হয়েছিল নাসিমের সঙ্গে। মনে মনে যে তার প্রেমে পড়িনি, তা নয়। ওমন কর্পোরেট ডাকসাইটে বসের প্রেমে ছেলেরাই হাবুডুবু খায় আর মেয়েরা তো কোন ছার! জয়ও তেমন ভক্ত। হয়তো নাসিমের সঙ্গে একটু বেশি ঝুলাঝুলি করলে প্রেম-বিয়ে সবই হয়ে যেতো। কিংবা আমি বিয়ে টাইপ মেয়ে না। একটু মাঝারি গোছের প্রফেশনাল ক্যারিয়ার আর মাঝারি টাইপের সুন্দরীরা মাঝেই পড়ে থাকে। আমার ছিল সেই দশা।
জয়ের উচ্ছ্বাস দেখে আরিফ বিস্তারিত শুনলো। নাসিম আমার সম্পর্কে কী কী শব্দ ব্যবহার করেছে, বান্ধবী, ফিয়ান্সে শব্দগুলো কয়বার উচ্চারণ করেছে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলো। আমার সঙ্গে জয়ের সম্পর্ক কী করে জানলো, সেই বিষয়টাও জেনে নিলো। গায়েহলুদের দিনেই জয়কে ফেসবুকে অ্যাড করেছিলাম আমি। হলুদের ছবিতে ট্যাগ করা হয়েছিল। সেখানে নাসিম দেখেছিল। এর ফলে আমার হানিমুন যাওয়া ক্যান্সেল হলো।
রাতে বাড়ির সবাই ঘুমুতে যাওয়ার পর, আরিফ জানালো সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি অবাক। একই ঘরে দুজন মানুষ থাকবো সেখানে কথা বলতে চাইলে ফর্মালিটিসের কী আছে? প্রথম কথা কালকে আমরা নেপাল যাচ্ছি না। টিকিট ক্যান্সেল করেছি দুপুরে। দুজন মানুষ যাব—আরেকজনের মত না নিয়ে টিকিট ক্যান্সেল করা যায় না। কিন্তু আরিফ করেছে। আমি শুধু ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইলাম কারণটা। আরিফ নাসিমের প্রসঙ্গের অবতারণা করে চিৎকার করা শুরু করলো। আমার স্ত্রী আরেকজনের ফিয়ান্সে ছিলেন, তাও আমার ভাগ্নের বসের। ভাগ্নের কাছে তার মান-সম্মান কী করে ধূলায় লুণ্ঠিত হয়েছিল সেই বর্ণনা করতে করতে তার হাঁপানির টান উঠে গিয়েছিল। চিৎকার শুনে আমার শাশুড়ি উঠে এলেন। আমি কোনো কথা না বলে তার কাছ থেকে জেনে নিলাম তার ছেলে ইনহেলার নেয় কিনা, নিলে সেটা কোথায়। সে যাত্রা ইনহেলার দিয়ে রক্ষা। হাঁপানির টান ওঠায় আমার সমাজের কাছে মুখরক্ষার একটা উপায় হয়েছিল। আমি বলতে পেরেছিলাম, আরিফ অসুস্থ তাই আমরা যাচ্ছি না। আরিফও বোধ করি তাই বলেছে।
পরের পাঁচদিন আরিফ আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। আমিও জোর করিনি কথা বলার জন্য। মা মারা যাওয়ার পর আমি আসলেই একা হয়ে গেছিলাম। আমার একটা সংসার দরকার ছিল। ভাইয়া যেহেতু প্রবাসী। তার কাছে গিয়ে ওঠার সুযোগও আমার ছিল না। কাকাদের সঙ্গে থাকাটা নেহায়েৎ দায়ে পড়ে থাকা। সেই স্কুলে পড়ার সময় যখন বাবা মারা গেলেন, তখনই তাদের সঙ্গে সম্পর্কের লেঠা চুকে গিয়েছিল। এখন শুধু ফরমালিটিজের সম্পর্ক। আরিফের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন ভাইয়ার এক বন্ধু। মায়ের চল্লিশা করতে ভাইয়া দেশে এসে দায়সারা গোছে বোনকে গছিয়ে দিয়ে গেলেন। দায়িত্ব শেষ। আমি যে চাকরি করি, ব্যাংকে যতটুকু জমেছে, তা দিয়ে দিব্যি চলে যেতে পারতাম। একটা হোস্টেল বা মেসেই থাকতে পারতাম। কিন্তু একটা সংসার করার তাড়না আমাকে এই ফাঁদে ফেললো। আমাকে ঠেলে একটা আতঙ্কগ্রস্ত জীবনে ফেলে দিলো।
এই সংসারে এসে আমি আর কিছু পাই বা না পাই আমার পুত্রমুগ্ধ শাশুড়িকে পেয়েছিলাম। আমার মাথায় তেল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে আমার শাশুড়ি ছেলের গল্প করতেন। চার মেয়ের পর তার এক ছেলে। ছেলের সেই জেদ। আমার শ্বশুর নাকি ছেলে চাঁদ চাইলে তাও এনে দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
ঝাঁঝালো গন্ধওয়ালা বাবা জর্দার পানের পিক ছিটাতে ছিটাতে আমার শাশুড়ি বলতেন—বাবুর চেতটাই হইলো দোষের, নইলে কইলজাডা মাটির। অমুন ভালা পোলা এই মহল্লায় নাই। বাবা জর্দার ঘ্রাণে আমার নিঃশ্বাস খেই হারিয়ে ফেলতো। আমি হাঁপানি রোগীর মতো বড় শ্বাস নিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতাম কতটা ভালো তার ছেলে।
যেদিন যে তরকারি মুখে দিয়ে আমার শাশুড়ির বাবু বলতেন—এটা কি খাওয়া যায় নাকি! আমার শাশুড়ি সঙ্গে সঙ্গে সেই তরকারি ময়নার মাকে দিয়ে বলতেন, এটা তুই রাতে নিয়ে যাস। বাবুকে তথা আরিফকে একটু আধটু ঝাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করতেন আমার মেঝো ননাস মানে জয়ের মা। তবে অন্যদের আহ্লাদের চোটে সেটা ধোপে টিকতো না।
আমার যত প্রেমিক আছে, যতদিন বেঁচে থাকবে, সইতে হবে। তবে নিশ্চিত থাকতে পারো তোমার বউকে কেউ ভাগিয়ে নিয়ে যাবে না।
বিয়ের পরের যে পাঁচদিন আরিফ আমার সঙ্গে কথা বলেনি, সেই পাঁচদিন আমি আমার ফেসবুক ঝাড়পোছ করেছি, আমার প্রেমিকরা, হলেও হতে পারতো প্রেমিক, ভক্তকূলদের ব্লক তালিকায় ফেলে দিয়েছি। খুব অম্লমধুর সম্পর্ক আছে এমন মানুষগুলোকেও আমি ফেসবুক থেকে বিদায় করেছি। আমার বড় ভাবীর এক মামাতো ভাই খুব দিওয়ানা ভাব দেখাতো। যেন চান্স পেলেই আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। ভাবীর কারণে কোনো সম্পর্কই হয়নি, কিন্তু চ্যাট বক্সে খুব ফ্ল্যার্ট করা বাক্য ছিল। তাকেও ব্লক করার পর বিপদেই পড়লাম। কানাডা থেকে ভাবী ফোন করে সেকি কাঁদুনি। না হয় সেই হাই প্রোফাইল ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, তাই বলে আমার ভাইদের ব্লক করে দেবে? তোমার জন্য আমার কত লোকের কথা শুনতে হলো। আমার ভাই কী এমন-তেমন। আমি শুধু হু হা দিয়েই সারি। কারণ পাশেই আরিফ বসে ভাবী কী বলে বোঝার চেষ্টা করছিল। পাঁচদিন পর সেদিনই আরিফ কথা বলে। প্রথম প্রশ্নই ছিল—ভাবী কী বললো? আমি হেসে বললাম। ফেসবুকে কেন আপনার আমার রোমান্টিক ছবি দেইনি তাই জানতে চাইলো।
দ্বিতীয় প্রশ্ন—দাওনি কেন?
আবারও হেসেই বললাম—শুনলে না বললাম ‘ও পছন্দ করে না তাই।’ আসলে ভাবী তখন প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন অমুককে কেন ডিলিট করেছিলে, তমুককে কেন ডিলিট করেছিলে। আমি বলেই যাচ্ছিলাম আরিফ বা ও পছন্দ করে না। সে যাত্রা সংসার টিকে গিয়েছিল। সুপার পজেসিভ—ওয়ানম্যান শো আরিফের সঙ্গ মেনে নিয়েই আমি দিন দিন খুব নির্বিবাদী হয়ে উঠছিলাম। মন দিয়ে সংসার করা অফিস করার মধ্যেই আমার সীমাবদ্ধতা। ঘোরাঘুরি, আড্ডা, বন্ধু-বান্ধব সব শিকেয় উঠলো। ছন্নছাড়া আমিও একটা ভীষণ রুটিন লাইফে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। আমার ভাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার বোন একটু থিতু হলো। আমার শাশুড়ি আমার রান্নার আগ্রহ, তার ছেলের পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব দেওয়া দেখেও বেশ আহ্লাদিত। আত্মীয়-স্বজনদের বেশ ঘটা করেই ফোন করে বলতে লাগলেন—বেশি বয়সী মেয়ে বিয়ে করালে কী হবে—বউমা আমার বাবুর যা খেয়াল রাখে।
তবে সুখের সংসার বা দুধের বালতিতে এক ফোটা গোচনাই যথেষ্ট। সে গো-চনা হয়ে এলো অর্ঘ। আমার ছাত্র। আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেই, তখন অর্ঘরা আমাদের পাশের বাসায় ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছিল। অর্ঘ সাত বছরের আমি ১৫। ওর থেকে আট বছরের বড়। ওর মা আমাকে ওর পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিনিয়ময়ে মাস গেলে আমার বেশ একটা টাকা জুটে যেতো। অর্ঘ বলতো বড় হয়ে সে আমাকে বিয়ে করবে। আমি বেশ হাসতাম। ওর মাও বলতো চিন্তা করো না বাবা—পাখিই আমাদের বাড়ির বউ হবে। আমি যখন ৩৪ বছর বয়সে অন্য একজনের বউ, তখন অর্ঘ লন্ডনে পড়তে গেছে। ওরা বাসা পাল্টানোর পর অর্ঘ বেশ কয়েকটা প্রেমময় চিঠি দিলেও যোগাযোগ হয়নি। এই কিছুদিন আগে ও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ফেসবুকে আমাকে খুঁজে বের করলো। করেই প্রথম বাক্য সিনোরিটা—তুমি বিয়ে করে ফেলেছ? তুমি না আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে? অর্ঘ সামনে গোলাপ ফুল আর চকোলেট নিয়ে এসে এই কথা বললে আমি হয়তো ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, ওরে আমি তোকেই বিয়ে করে নেব পরের জনমে, ভাবিস না। এ জন্মে অন্য মেয়ে খুঁজে নে। পিসির চ্যাট বক্স খোলা রেখে চা আনতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখলাম আরিফ সাহেব পিসির সামনে রাগে তার গা কাঁপছে। তার রাগের কারণ ধরতে পারলাম না। ঘুরে আমাকে যে চড়টা দিলেন—তাতে হাতের গরম চায়ের কাপ, বিস্কিটের প্লেট সব পড়ে চূরমার। সঙ্গে আমার মাথাও ঘুরে উঠলো।
জ্ঞান ফেরার পর শাশুড়ি মাতাকে তসবি হাতে সামনে দেখলাম। আরিফ সাহেবকে বেশ কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। গরম চা যেসব জায়গায় লেগেছিল গায়ের সেসব জায়গায় বার্নল লাগিয়েছেন আমার ননাস। তিনিই সবার আগে মুখ খুললেন, মা হতে যাচ্ছ, এটা আমাদের বলোনি কেন? আমি হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম, চোখ ভীষণ জ্বালা করছে। দুই সপ্তাহ আগেই জেনেছি আমার জীবনে এমন কেউ আসছে যে একান্তই আমার। আরিফ সাহেবের দেওয়া একটু স্পার্ম ছাড়া তার কোনো অবদানই নেই। কিন্তু কাউকেই বলতে পারছিলাম না। আজকে আমি জ্ঞান হারানোতে বাড়ির সবাই জেনে গেলো কী করে, ভাবছিলাম। আমি তো চড় খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম, এটা কী করে বলবো। একে একে সবাই চলে গেলো ঘর থেকে। শাশুড়ি পুরো ঘরে দোয়া পড়ে দিয়ে গেলেন, যেন আমার আর কোনো বিপদ-আপদ না আসে।
আরিফ সাহেব আমার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই জানতে চাইলাম চড় মারলেন কেন আমায়। আজকে আমার অনেক শক্তি। গত ছয় মাসের সংসারে এই প্রথম জোর গলায় পালটা প্রশ্ন করলাম। তিনি কাচুমাচু হিজিবিজি করে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করলেন—যার অর্থ হচ্ছে অর্ঘ কে? কেন তাকে বিয়ে করেছি অর্ঘকে বিয়ে না করে। আমি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করলাম না। রাতের বেলা ফেসবুক আইডিটা ডিঅ্যাক্টিভ করে দিয়ে মনে মনে শুধু বললাম—অর্ঘ তুই যেমন আমার সন্তানতুল্য তেমন কাউকে খুব সুস্থভাবে পৃথিবীতে আনতে তোদের সবার থেকে দূরে যেতে হলোরে।
তারপর চারটি বছর শুধুই আমার সন্তান নৈঋতকে নিয়ে কেটে গেছে। ম্যাটার্নিটি লিভে ঝামেলার কারণে আগের চাকরিটি ছেড়ে কয়েক বছর বেকার বসে রইলাম। ঠিক বেকার ছিলাম না, ছোটখাটো কিছু ক্ষেপের কাজ করে নিজের হাত খরচ আর নৈঋতের সখের জিনিস চালিয়ে নিয়েছি। যদিও পুত্র সন্তানের মা হওয়ার পর এই সংসারে আমার আরিফ সাহেবের চেয়েও বেশি পাওয়ার হয়েছে। সবাই মাথার ওপরেই রাখে। কারণ নৈঋত এই বংশকূল রক্ষা করবে আর তার সবচেয়ে প্রিয় তার মা।
দিন যেদিন খারাপ যায় সেদিন খারাপই যায়। সন্ধ্যায় নৈঋতকে নিয়ে বের হলাম আমরা তিনজন। আরিফ সাহেবই বললেন, রাতে বাইরে খাওয়াবেন। সেটাই কাল। দীর্ঘ ৭ বছর পর বড় ভাইয়ার বন্ধু আফতাব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। গত সাত বছরে লোকটা একদম পাল্টাননি। পাশে আইরিশ স্ত্রী। বউকে নিয়ে উঠে এলেন। সেই চিরচারিত রসিকতা। আমাদের টেবিলে বসলেন। আমাদের ট্রিট দেবেন এমন ঘোষণাও দিলেন। আরিফ আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
আফতাব ভাই হারে রে করে উঠলেন—কী রে পাখি তোর বর আমাকে চেনে না। হা হা হা মশাই আমি আর কয়েকটা দিন আগে বিয়ে করলেই তো পাখি আমার হতো। আরিফের মুখের রেখা পালটানো শুরু করেছে। আইরিশ ললনা বেশ বাংলা বোঝে মনে হলো—সে যা কঠিন ইংরেজিতে বললো তাতে বেশ আফসোস ঝরে পড়লো। আফতাব আমাকে বিয়ে করলে যেসব বাঙালি খানার জন্য আফসোস করে সেগুলো হতো না। নৈঋত এক মনে রেস্তোরাঁর প্লে জোনে খেলছে। আমি খুব সাহস করে বলেই ফেললাম, আরিফ, উনি আফতাব ভাই, বড় ভাইয়ার বন্ধু, আমার সাবেক প্রেমিকও বলা চলে। মা মারা যাওয়ার সময় উনি দেশে থাকলে হয়তো উনার সঙ্গেই আমার বিয়ে হতো। কপালে ছিলে তুমি কিছু করার নেই। আর তোমারও কিছু করার নেই, আমার যত প্রেমিক আছে, যতদিন বেঁচে থাকবে, সইতে হবে। তবে নিশ্চিত থাকতে পারো তোমার বউকে কেউ ভাগিয়ে নিয়ে যাবে না। সে তোমারই থাকবে। বলে বেশ হাঁফ ছাড়লাম। মনে হলো আরও আগে বলা উচিত ছিল। ও সকালে যে লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মনোয়ার সেও আমার প্রেমিক ছিল। সাত বছর প্রেম করেছিলাম। ছুটির দিনের সন্ধ্যাটা ম্লান করতে চাইনি বলে পরিচিত বলেই শেষ করেছি। আরিফের শক্ত মুখটা হঠাৎ করে বেশ কোমল হয়ে উঠলো। ও, হ্যাঁ, না, বলে স্যুপের বাটিতে মনোযোগ দিলো। একবার নৈঋত কই, সে খাবে না বলে উঠে গেলো। তাকে এক পাশে রেখে আমি আফতাব ভাইয়ের সঙ্গে আমার পুরানো দিনের গল্প নিয়ে মেতে উঠলাম। আফতাব ভাই বললেন, মনোয়ার কোনটারে? যেটার সঙ্গে প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর তুই আমার কাঁধে সিন্দাবাদের বুড়ির মতো সওয়ার হয়েছিলি? নৈঋতের পিতা আমার স্বামী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের গল্প শুনে যাচ্ছিলেন। আমি মনে মনে ভয়ঙ্কর একটি রাতের চিত্রনাট্য লিখছি, তবে ভয়টা আর নেই…