না। এই গল্পের চরিত্র শহীদুল জহিরের আবু ইব্রাহিম নয়। এই লোক আরেক আবু ইব্রাহিম। এই দেশে কত শত আবু ইব্রাহিম আছে, তাদেরই একজন এই আবু ইব্রাহিম। যদিও সে মৃত। গল্পটা তারও নয়, গল্পটা তার স্ত্রী রূপার।
আবু ইব্রাহিম মরে যাওয়ার পর রূপা প্রায়ই আবু ইব্রাহিমের ডায়েরিটা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তো। ওই ডায়েরিতে আবু ইব্রাহিমের মাসিক হিসাব লেখা। কোন মাসে কত খরচ হলো, কার কাছ থেকে কত টাকা ধার নিলো কিংবা কাকে সে টাকা ধার দিলো—এসব লেখা। আবার কিছু কিছু পৃষ্ঠায় লেখা আছে কবিতা। রূপা বোঝে না কবিতাগুলো আবু ইব্রাহিম লিখেছে না কি অন্য কারও কবিতা টুকে রেখেছিল! যদিও রূপা কবিতা পড়ে না, পড়লেও বোঝে না।
মাঝে মাঝে রূপাকে কবিতা পড়ে শোনাতো আবু ইব্রাহিম। রূপা তার আগা-মাথা কিছুই বুঝতো না। ডায়েরিটার একদম শেষ পৃষ্ঠায় আবু ইব্রাহিম লিখে রেখেছে, আমি শহীদুল জহিরের আবু ইব্রাহিম। আমার মৃত্যু হবে হাঁসের পালকের চাইতেও হাল্কা মৃত্যুর গল্পের মতো।
এই শেষ পৃষ্ঠাটা পড়লেই রূপার বুকে একটা মোচড় দিতো। শরীর শিউরে উঠতো। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। রূপা প্রায়ই ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা খুলে বুকে জড়িয়ে রাখতো। তখন তার ইচ্ছা হতো চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদতে, ইচ্ছা করতো নিজে নিজে আবু ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলতে।
কতদিন গল্প হয় না আবু ইব্রাহিমের সঙ্গে। আবু ইব্রাহিম যখন আগে অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরতো, রূপা তখন রান্নাঘর থেকে এসে দরজা খুলে দিতো। আবু ইব্রাহিম ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে বিছানায় এলিয়ে পড়তো। রূপা তখন চুলাটা কমিয়ে আবু ইব্রাহিমের কাছে আসতো।
রূপার হাত ধরে আবু ইব্রাহিম প্রথমেই জিজ্ঞেস করতো, কী করলে সারাদিন?
রূপা বলতো, কী আর! কত কাজ থাকে প্রতিদিন।
আবু ইব্রাহিম আবার প্রশ্ন করতো, শুধু কাজ করলে?
তো আর কী করবো?—রূপা আবু ইব্রাহিমের চোখে চোখ রেখে বলতো।
আবু ইব্রাহিম তখন রূপার হাতটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বলতো, আমার অপেক্ষা করোনি?
রূপা তখন মুচকি হেসে লজ্জা পেয়ে হাত ছেড়ে দৌড়ে যেতো রান্নাঘরে। কিছুই বলতো না।
প্রায় প্রতিদিনই আবু ইব্রাহিম এই প্রশ্ন করতো। রূপাও শুনতে চাইতো। তাই কোনোদিনই বলেনি সে সারাদিন রাতে আটটার অপেক্ষা করতো। কিছুক্ষণ পরপর সে ঘড়ি দেখতো। কখন রাত আটটা বাজবে আর আবু ইব্রাহিমও কলিংবেল চাপবে। এই অপেক্ষায় দিন যেতো রূপার। কিন্তু সে কখনোই বলেনি।
এসব ভাবনায় ডুবে রূপার শুধু কান্না পেতো। কিন্তু সে কানতেও পারতো না। ভয় পেতো, যদি ইমদাদুল হক শুনে ফেলে! এই ইমদাদুল হক রূপার দ্বিতীয় স্বামী। রূপা যদিও তার দ্বিতীয় স্ত্রী নয়। প্রথম স্ত্রী। ভদ্রলোক দেরি করে বিয়ে করেছেন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে বয়স বেড়ে গেছে। বয়স যখন চল্লিশ বছর পার হয়েছে, তখন হক সাহেবের মনে হয়েছে তার একটা বিয়ে করা উচিত।
কিন্তু হক সাহেব মেয়ে পান না। এই চল্লিশ বছরের লোকের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয় না। হক সাহেবের অনেক সম্পত্তি। শহরে তার দুটি ফ্ল্যাট, আছে রড-সিমেন্টের ব্যবসা। তিনি গ্রাম থেকে এসে শহরে স্থান গেড়েছেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে তার সময় পার হয়ে গেছে। তাই আর বিয়ে করা হয়নি।
তবে রূপার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবটা আনে রূপার শ্বশুর। হক সাহেবের টাকা যেই ব্যাংকে সেই ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন আবু ইব্রাহিমের বাবা জসিম ইব্রাহিম। সেখানে দুজনের পরিচয়, প্রথম সাক্ষাৎ।
জসিম ইব্রাহিম একদিন কথা প্রসঙ্গেই হক সাহেবকে প্রশ্ন করেন, আপনি বিয়া-শাদি করেন না কেন?
হক সাহেব একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, চাচা এই বয়সে বিয়ে করবো কিভাবে?
হক সাহেবের বয়স আর কত? বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ। আবু ইব্রাহিমের হয়েছিল মাত্র ঊনচল্লিশ। এই বয়স তো অল্পই। মরার জন্য যদি অল্প হতে পারে, তাহলে বিয়ার জন্য বেশি বয়স হবে কেন? এই প্রশ্ন জসিম সাহেবের মনে আসে।
তাই তিনিও হাসতে হাসতে বলেন, কী যে বলেন আপনি। বিয়ার আবার বয়স কিসের? যখন জরুরৎ হবে, বিয়া করে ফেলবেন। জরুরৎ যদি ২০ বছরে হয় তখন করবেন, যদি ৫০ বছরে হয় তখনো করা যায়।
এটা শুনে হক সাহেব লজ্জা পান। বাবার সমান বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়ের কথা আলাপ করতে অস্বস্তি আসে। এরপর একদিন হুট করে হক সাহেবের মালিবাগের অফিসে হাজির হয় জসিম সাহেব। তাকে দেখে হক সাহেবের মাথায় হাত—এই বৃদ্ধ লোক হুট করে অফিস কেন!
সিসি ক্যামেরায় রিসিপশনে দেখে বাইরে দৌড়ে আসেন হক সাহেব। তাকে শুরুতেই বললেন, চাচা আপনি আমার অফিসের ঠিকানা পেলেন কেমনে?
জসিম সাহেব মুচকি হাসেন। কিছু বলেন না। রহস্য করেন। এই রহস্য হক সাহেবের পছন্দ হয় না। তবু তিন-চারবার জিজ্ঞেস করলে উত্তর না পেয়ে তিনি আর আগ্রহ দেখান না।
হক সাহেবের অফিসে সেদিন প্রথম বিয়ের আলাপটা প্রকাশ করেন জসিম ইব্রাহিম। রূপা তার ছেলের স্ত্রী। ছেলে তো দুনিয়ায় নেই। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছে। আর রূপার বয়স মাত্র বত্রিশ। এই বয়সে তো ছেলেদের ক্যারিয়ার শুরু হয়। রূপার সঙ্গে আবু ইব্রাহিমের সংসার মাত্র তিন বছর তিন মাস একুশ দিনের। এই অল্প সময়ের সংসারে জসিম ইব্রাহিম রূপাকে নিজের মেয়ের মতো করে দেখেছেন।
এজন্য ছেলে মরার ৪০ দিন পর যখন রূপার বাবা-মা তাকে নিতে আসে, তখন জসিম ইব্রাহিম তাকে নিতে দেননি। তাদের বলেছেন, রূপা এই ঘর থেকে যাবে না। সে এখানেই থাকবে।
রূপার বাবা মোতালেব মিয়া তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, বেয়াই সাহেব, রূপার বয়স আর কত! তার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। মেয়েটা আমাদের সঙ্গে থাকলে একটু মানসিক আরাম পেত। আমাদের নিয়ে যেতে দেন।
এসব বলার সময় মোতালেব মিয়ার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। জাড়ানো কণ্ঠে বলেন, আপনার ঘরেই তো তুইলা দিছিলাম বেয়াই সাহেব। আল্লাহ এ কী দুর্দিন দেখাইলো আমারে! মাইয়াটার চোখের দিকে তাকাইতে পারি না। এই বয়সে মেয়েটা কত বড় আঘাত পাইলো।
এসব শুনেও জসিম ইব্রাহিম অটল থাকেন। তার একমাত্র ছেলে আবু ইব্রাহিম। ছেলে দুনিয়াতে নাই। আবু ইব্রাহিমের স্ত্রী রূপা এখন তার কন্যা। এই কন্যাকে তিনি কী করবেন, সেটা ওনার দায়িত্ব বলে মোতালেব মিয়াকে জানিয়ে দিলেন।
মোতালেব মিয়া মহা খেপলেন মনে মনে। মনে মনে বললেন, তোর পোলা মরছে এখন তোগো বুড়া-বুড়িরে পাহারা দিতে আমার মাইয়া ধইরা রাখতে চাস। তবু তিনি আড়ালে মেয়েরে বললেন, তুই চল। এখানে থাকা লাগবে না। রূপা তখন কাঁদে। কোনও কথা বলে না।
যাওয়ার আগ মুহূর্তে মোতালেব মিয়া আবার ফিসফিস করে বললেন, চল, কয়দিন ঘুরে আয় বাসা থেকে।
রূপা তখন তার বাবারে জড়িয়ে ধরে। বলে, আব্বা আমি যাবো না। আমার স্বামী নাই এটা বিশ্বাস করতে পারি না। খালি মনে হয়, তিনি অফিস গেছেন,ফিরবেন। শুনে মোতালেব মিয়া কেঁদে দেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এখানে থেকে কী করবি?
রূপা শুধু বলে, অপেক্ষা করি আব্বা। আমারে একটু অপেক্ষা করতে দেন।
রূপা আসলে কিসের অপেক্ষা করবে তা মোতালেব মিয়া বোঝেন না। শুধু বোঝেন তিন বছরের সংসার করার পর রূপার অস্তিত্বজুড়ে আবু ইব্রাহিমের বাস। এই বাসা থেকে আবু ইব্রাহিমকে বের করা কঠিন। মোতালেব মিয়া চলে যান।
তো, রূপার দায়িত্ব তখন থেকেই জসিম ইব্রাহিমের। ছেলে ইন্তেকাল করার আট মাস পরই তার সঙ্গে দেখা হয় ইমদাদুল হক সাহেবের। তিনি গোপনে গোপনে ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে হক সাহেব সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি মর্মাহত হন। তিনি তখন অনুভব করেন, এই দুনিয়ায় সব মানুষের কত গল্প থাকে। তার পুত্র আবু ইব্রাহিমেরই যেন কোনও গল্প নাই। তিনি তখন অনুভব করেন, ইমদাদুল হকই হয়তো তার পুত্র।
কত সংগ্রামের জীবন। গ্রাম থেকে উঠে এসে এই শহরে ব্যবসা শুরু করে দিন রাত পরিশ্রম করে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে লোকটা। নিজেকে উন্নত করতে করতে জীবনে কত ভাঙন দেখেছে ইমদাদুল হক। প্রথমে বাবা, পরে মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এক বড় বোন ছিল শেষ আশ্রয় কিন্তু সেই বড় বোনও লঞ্চ ডুবিতে চলে গেলো। এরপর থেকেই ইমদাদুল হক নিঃসঙ্গ।
এসব শুনে জসিম ইব্রাহিমের তার পুত্রের কথা মনে পড়ে। তিনি ভাবেন, তার পুত্র আবু ইব্রাহিমও তো কবরে নিঃসঙ্গ একা। ঠিক তখনই তার মনে হয় আবু ইব্রাহিমের মতোই ইমদাদুল হক নিঃসঙ্গ, একা। তাই রূপার সঙ্গে ইমদাদুল হকেরই বিয়ে দেয়ার চিন্তা আটেন।
দুই.
হক সাহেব শুরুতে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান। অপ্রস্তুত হয়ে তিনি কিছু বলতেও পারেননি। শুধু সময় চেয়েছিলেন জসিম সাহেবের কাছে।
হক সাহেব অনেক হিসাব মেলাতে পারেন না। তিনি ভেবে পান না একজন স্বামী মরা মেয়েকে তিনি বিয়ে করবেন কি না। তিনি তো এমন বিয়ে চাননি কখনো। তবু মেয়ে তো পান না। আবার তিনি জসিম সাহেবের এই প্রস্তাবেও মুগ্ধ হন। কয়জন শ্বশুর নিজ পুত্রের স্ত্রীর বিয়ার কথা চিন্তা করেন? তিনি ভাবেন, নিশ্চয় রূপা অনেক ভালো কিংবা জসিম সাহেব অতি ভালো। বিয়ের কথা ভাবতে গিয়ে হক সাহেবের কেন যেন রূপার প্রতি এক অতি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতে থাকলো মনে মনে। রূপার কথা ভাবলেই তার শরীর মনে শিহরণ জাগতে লাগলো।
নারীর স্পর্শ তিনি কখনো পাননি। এই প্রথম সেই স্পর্শ পাওয়ার এক তৃষ্ণা তার মধ্যে জায়গা নিতে থাকলো। তিনি দুইদিন পার না হতেই জসিম ইব্রাহিমকে ডাকলেন। বললেন, তিনি বিয়ে করতে চান। তবে সেখানে রূপার মতটা জরুরি।
জসিম ইব্রাহিম তখন কিঞ্চিৎ চিন্তিত হলেন। কারণ তিনি তখনো রূপার সঙ্গে কথা বলেননি। রূপা যদি বিয়েতে রাজি না হয়, তখন তিনি কী করবেন?
আবার এও খেয়ালে আসলো, তিনি রূপার পিতা না, শ্বশুর। রূপার পিতা-মাতার সঙ্গে তো কথা বলতে হবে।
সেই দিন সন্ধ্যায় প্রথম রূপার সামনে ইমদাদুল হক সাহেবের কথা বলেন জসিম ইব্রাহিম। রূপা শুধু নির্বাক চোখে চেয়ে ছিল শ্বশুরের দিকে। রূপা বিস্মিত হয়ে দেখছিল, জসিম ইব্রাহিম কিভাবে আবু ইব্রাহিমকে ভুলে গেলো।
কিন্তু রূপা তো ভোলেনি। মৃত স্বামী ইব্রাহিমকে তখনো রূপা মনে মনে আগলে রেখেছিল। রূপার সেদিন খুব অভিমানও হয়েছিল। রূপা এও ভাবছিল, শ্বশুর মনে হয় তাকে রেখে দিয়ে বিপদে পড়েছেন, তাই বিয়া দিতে চান।
রূপা পরদিন সকালে শ্বশুরকে বলে, আমি কি আপনাদের বোঝা হইয়া গেলাম? তাইলে আমি চলে যাই।
শ্বশুর তার অভিমান বোঝেন। তখন রূপাকে বলেন, মা-রে, আমার ছেলে তো নাই। সে তো আর ফিরবে না। কার জন্য আর তোর জীবনটা থামিয়ে রাখবো?
রূপার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। রূপা তার বাবা মোতালেব মিয়ারে যা বলছিল, সেটাই আবার বললো—আব্বা আমারে অপেক্ষা করতে দেন। আপনার ছেলের জন্য আমার অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। ওনারে দয়া কইরা আপনেরা মাইরা ফেইলেন না।
এটা বলেই রূপা কেঁদে দেয়। রূপার শাশুড়ি চুপচাপ সব দেখেন। কখনো কিছু বলেন না। মায়েদের নিস্তব্ধ অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা কারও নেই। ওই নীল বেদনা বড় ভয়ঙ্কর। তাই আপনারা রূপার মা এবং আবু ইব্রাহিমের মা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেন না।
তবে সেদিন অবশ্য আবু ইব্রাহিমের মা সুহেলা খাতুন কথা বলেন। তিনি রূপার পাশে বসেন। অবশ্য তিনি কিছুই বলতে পারেন না। শুধু বলতে পারেন, মা-গো বিয়া করি ফেলাও। আল্লাহ তোমারে অনেক সুখে রাখবে।
এর বেশি সুহেলা খাতুন কিছুই বলতে পারেন না। রূপাও কিছু বলে না। সেদিন আবু ইব্রাহিমের ঘরে তিনজন মানুষ শুধু চোখের জল ফেলেছিল। এসব মৃত আবু ইব্রাহিম দেখছিল কি না, তা আমরা কেউ জানি না।
তিন.
রূপার বাবা-মায়ের পাত্র ইমদাদুল হককে খুব পছন্দ হলো। দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ। ইমদাদুল হককে বেশ পছন্দ হয়েছে রূপার বাবা’র। উঁচা লম্বা ফর্সা ছেলে। আবু ইব্রাহিম ছিল বাট্টু। দেখতেও কালো। তবে এই কথা তিনি কাউকে বলেননি। নিজের মধ্যে রেখেই মনে মনে খুশি হয়েছিলেন।
তাদের বিয়ের আগেরদিন রূপা ড্রয়ার ঘেঁটে আবু ইব্রাহিমের ডায়েরিটা আবিষ্কার করেছিল। এই হিসাব-কিতাবের ডায়েরিটা রূপা তার কাপড়ের ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। এখানে থেকে গেলে তো আবু ইব্রাহিমের কোনো স্মৃতিই তার কাছে থাকবে না। তাই সেটা আগেই আলাদা করে নিয়েছিল। যদিও রূপার শরীর-মনজুড়ে আবু ইব্রাহিমের বাস।
রূপা তখনো জানতো না কিভাবে আবু ইব্রাহিম ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে সে সংসার করবে। তবু রূপা বিয়েতে রাজি হয়েছিল। কারণ সবাই বলে তার একটা ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু রূপা আবু ইব্রাহিম ছাড়া ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।
অফুরান প্রেম তার রয়ে যায় আবু ইব্রাহিমের জন্যই।
বিয়ের আগেরদিন সে তার শ্বশুরের কাছে একটা আবদার করে বসেছিল। আবু ইব্রাহিমের কবর দেখতে চায়।
শ্বশুর তাকে বলে, মেয়ে মানুষের কবরে যাওয়া যায় না।
তবু রূপা যেতে চায়। শ্বশুরকে সে শেষ অনুরোধ করে।
রূপাকে নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে জসিম ইব্রাহিম যান। সেখানে হাজার হাজার কবরে মধ্যে একটি কবরের সামনে গিয়ে জসিম ইব্রাহিম বলে, এখানে ঘুমায় আছে আবু।
রূপা অনেক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে থাকে কবরের দিকে। যেন সে দেখতে পায় তার স্বামীকে। তারপর শুধু আবু ইব্রাহিমরে প্রশ্ন করতে মন চায়, কেন তুমি চলে গেলা? কিন্তু প্রশ্নটা আবু ইব্রাহিমকে করা হয় না, সেই প্রশ্ন আল্লাহকেই করে—কেন মানুষ মরে যায়? না মরলে কী হয়?
তারপর দিনই ইমদাদুল হকের সঙ্গে রূপা বেগমের বিয়া হয়ে যায়। রূপা তখনো বোঝে না তার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে। তার অন্তরজুড়ে শুধু আবু ইব্রাহিমই থেকে যায়। বাসরঘরে রূপার মনে কোনও ভয় আতঙ্ক তৈরি হয় না। কেন হয় না তা রূপাও জানে না।
অন্যদিকে হক সাহেব সেদিন ছিলেন বড্ড অস্থিরতায়। যৌবনের ক্ষুধা তার সারা শরীরে সেদিন ছিল বহমান। হক সাহেব সেদিন যেন হিংস্র বাঘে রূপ নিয়েছিলেন।
হক সাহেব সে রাতে ঘরে ঢুকে বাতি নিভিয়ে দিলেন।
আর রূপার তখন মনে পড়লো আবু ইব্রাহিমের একটি কথা, যা রূপা কখনো বুঝতে পারেনি। রূপাকে আবু ইব্রাহিম বলতো, স্ত্রীকেও স্বামীরা ধর্ষণ করে। রূপা জিজ্ঞেস করতো, স্বামী হইলে আবার ধর্ষণ কেমনে করে?
আবু ইব্রাহিম হাসতো। কিছুই বলতো না।
সেদিন বাসরঘরে রূপা অনুভব করলো সেই ধর্ষণের বিকৃত অনুভূতি।
চার.
আপনাদের বলছিলাম, রূপা ডায়েরিটা বুকে নিয়ে শুয়ে থাকে। সে প্রায়ই এভাবে শুয়ে থাকে। এভাবে দিন যেতে রূপার বিয়ের ছয় মাস পার হয়ে গিয়েছিল।
রূপার এখনো আবু ইব্রাহিমের কথা মনে পড়ে। রূপা এখনো অনুভব করে তার শরীরজুড়ে আবু ইব্রাহিমের বাস। রূপার সঙ্গে যখন হক সাহেব যৌন মিলন করেন, রূপার তখন ভয় হয়। মনে মনে ভাবে, আবু ইব্রাহিম তাকে দেখছে না তো?
বিয়ের ছয় মাস পর রূপার দেহের মধ্যে তৈরি হয়েছিল আরেক মানবদেহ, তখনো রূপার মনে হয় সেটা নিশ্চয়ই আবু ইব্রাহিমের। দেখতে নিশ্চয়ই সে হবে আবু ইব্রাহিমের মতোই।
এভাবেই রূপা অপেক্ষা করে একদিন এই সন্তান ভূমিষ্ট হবে। আর দেখবে একজন নতুন আবু ইব্রাহিম হাজির হয়েছে তার কোলে। রূপার মনে হয়,এটা কি আবু ইব্রাহিম? না কি রূপাই জন্ম নেবে আবার?
আবু ইব্রাহিম প্রায়ই বলতো, আমাদের প্রথম সন্তান যেন মেয়ে হয়। মেয়ে ঘরের লক্ষ্মী হয়।
রূপার তখন ইচ্ছা হয়, যেন তার মেয়েই হয়। মেয়ে তো ঘরের লক্ষ্মী। রূপা তাই অপেক্ষা করে আরেকজন রূপার।
দিন যেতে যেতে রূপার ভেতরের মানুষ নড়াচড়া করে। রূপার অনুভূতি আরও ঘনীভূত হয়। যখন সে নড়ে রূপা মনে মনে বলে, ও রূপা নড়ো কেন এত? তারপর রূপার হাসি পায়। তার মনে আস্তে আস্তে আনন্দের খিল ছোটে।
ইমদাদুল হক ইদানিং রূপার খুব খেয়াল রাখেন। এজন্য হঠাৎ হঠাৎ রূপার খুব দরদ হয়।
হক সাহেব এখন অনেক যত্ন নেন। রূপাকে ভাত খাইয়ে দেন, জামা বদলাতে সাহায্য করেন। রান্না ঘরেও যেতে দেন না। সব হক সাহেব করেন। রূপা তখন অপলক ইমদাদুল হক সাহেবকে দেখে।
একদিন ইমদাদুল হক রাতে ঘুমিয়েছিলেন। রূপার ভেতরের মানুষটা মনে হচ্ছিল পেট থেকে বুকের দিকে উঠে নড়াচড়া করছিল। রূপার তখন ব্যথা লাগে। ঘুম ভেঙে যায়।
অন্ধকারে রূপা হক সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। হক সাহেব চোখ খুলে। জিজ্ঞেস করেন, কী হইছে?
রূপা বলে, প্যাটে ব্যথা করে।
হক সাহেব তখন রূপার পেটে হাত বোলান। রূপার কেমন যেন রোমাঞ্চ অনুভব হয়। এই প্রথম হক সাহেবের স্পর্শে সে রোমাঞ্চ অনুভব করে।
রূপা সেদিন সব লাজ-শরম ভুলে হক সাহেবকে বলে, একটু আমার কাছে আসবেন?
হক সাহেব প্রশ্ন করেন না। কাছে যান। কারণ এই প্রথম হক সাহেবকে রূপা কাছে ডাকে।
হক সাহেব কাছে গেলে, রূপা বলে, আমি একটু আপনারে আদর করি?
হক সাহেবের তখন খুব কষ্ট লাগে। এটা অবশ্য আন্দন্দের কষ্ট। আজ অবধি রূপা কখনো হক সাহেবের সঙ্গে প্রেম করেনি। কোনো আদর-স্নেহ পাওয়া তো দূরের কথা। সুন্দর করে কোনো কথা বলেনি। হক সাহেব ভাবতেন, রূপা তাকে ভয় পায়। মাঝে মাঝে হক সাহেব বুঝতো রূপা তার প্রথম স্বামীরে এখনো ভুলতে পারেনি।
হক সাহেব শুরুতে রূপার দেহে আকৃষ্ট হলেও ধীরে ধীরে সে রূপার মন পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। হক সাহেব নরম করে রূপার সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন। রূপাকে তিনবার প্রশ্ন করলে উত্তর দিতো। তাও হ্যাঁ, হু দিয়ে। এর বেশি রূপা কিছুই বলতো না।
রূপার সঙ্গে যখন হক সাহেবের মিলন হতো, রূপাকে মনে হতো এক নির্জীব মানুষ। হক সাহেব সেটা বিয়ের রাতেই বুঝে গিয়েছিলেন। সেদিন হক সাহেবের নিজের ওপর বড্ড জিদও চেপেছিল। বাসর রাতেই কেন তিনি যৌন ক্ষুধায় মাতাল হলেন।
হক সাহেব আজ রূপার এই আহ্লাদ শুনে চোখে পানি চলে আসছিল। হক সাহেব শেষ কবে চোখের পানি ফেলেছিলেন মনে পড়ে না। সম্ভবত মা যেদিন মরেছিলেন। এরপর থেকে তিনি শক্ত। হৃদয় তার পাটাতনের লোহা। কিন্তু তা যেন আজ গলে একাকার।
হক সাহেব বুঝে না রূপা কিভাবে আদর করবেন।
এসব ভাবতে গিয়েই রূপা আবার হক সাহেবকে বলে, আসেন না একটু কাছে। আপনাকে একটু আদর করতে ইচ্ছা করছে।
হক সাহেব তার মুখটা রূপার মুখের সামনে নেন। রূপা তখন হক সাহেবের মাথাটা নিজের বুকে টেনে রাখে। বলে, একটু আমার বুকে মাথা রাখেন না। শান্তি লাগে।
হক সাহেব রূপার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকেন। তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। দুই-এক ফোঁটা রূপার খালি বুকে পড়ে। রূপা চমকে ওঠে—আপনি কি কানতেছেন?
হক সাহেব নিজেকে সামলে বলে, না, কানবো কেন?
রূপা বোঝে হক সাহেব কাঁদেন। বুঝেও না বোঝার ভান করে।
রূপা জানে সে তার স্বামীকে এভাবে কাছ থেকে কখনো দেখেনি। এই প্রথম তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ রূপার বুকে এসে লাগে।
এভাবেই রূপা জড়িয়ে গেলো হক সাহেবের সংসার জগতে। হক সাহেবের ভেতর ডুবে গেলো সন্তানসম্ভবা রূপা। বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া রূপার কোলে এলো তাদের সন্তান। কন্যা সন্তান।
রূপার তখন আর আবু ইব্রাহিমের কথা মনে পড়ে না। যে আবু ইব্রাহিম তার কাছে কন্যা চেয়েছিল। রূপা বুঁদ হয়ে গেছে তার কন্যা রুবিনা হকের ভেতর। আর হক সাহেবের প্রেমে রূপা এখন মাতাল। এভাবেই রূপার জীবন বয়ে যায়।
তবে হঠাৎ একরাতে রূপার স্বপ্নে হাজির হয় আবু ইব্রাহিম। রূপা তাকে দেখে না। দেখে শেষ দেখার দৃশ্য। যেদিন জসিম ইব্রাহিমকে নিয়ে আবু ইব্রাহিমের কবরে গিয়েছিল রূপা। সেই আবু ইব্রাহিমের কবর দেখতে পায় রূপা। দেখা মাত্রই রূপা লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। দেখে স্বামী ইমদাদুল হক আর কন্যা রুবিনা হক গভীর ঘুমে অচেতন।
রূপা ধীরে ধীরে উঠে যায়। বের করে আবু ইব্রাহিমের সেই ডায়েরিটা। কতদিন সে দেখে না। এই ডায়েরিতে সে পায় আবু ইব্রাহিমের গন্ধ। তার আজ কোনও দুঃখ কাজ করে না। আবু ইব্রাহিম তো এই দুনিয়াতে নেই। দুঃখ করে কী হবে, রূপা নিজেকে নিজেই বলে। রূপা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শেষ পৃষ্ঠাটা দেখে—যেখানে লেখা, আমি শহীদুল জহিরের আবু ইব্রাহিম। আমার মৃত্যু হবে হাঁসের পালকের চাইতেও হাল্কা মৃত্যুর গল্পের মতো। রূপার মনে হয়, এই দুনিয়ায় প্রত্যেকেই এক একজন আবু ইব্রাহিম। প্রত্যেকের মৃত্যুই হাঁসের পালকের চেয়ে হাল্কা।