এক.
আমি যে একজন বিখ্যাত মানুষ, এটা পৃথিবীকে না জানিয়েই মনে হয় চলে যেতে হবে।
জীবনটা গেল চাকরগিরি করতে করতে। ঘরেরও চাকর, অফিসেরও চাকর। না দাম দিলো বস, না দাম দিলো বউ। তাই অন্ততঃ একটা চমক দেখাতে চাই।
অফিস কলিগ মিজান ভাইকে কথাটা বলতেই, ভাই সাঁই করে ঘুরে তাকাল আমার দিকে। চোখ পাকিয়ে বলল, বস আর বউকে কখনো চমক দেখাবার চেষ্টা করবেন না। যতবার চেষ্টা করবেন ততবারই চমকে যাবেন।
-ভাই মনে হয় আমার কথাটা ধরতে পারেননি। আমি একটা সারপ্রাইজ দিতে চাইছি। কী করতে চাইছি, শুনবেন তো।
-কিচ্ছু শোনার দরকার নাই। আবারও সাবধান করে দিচ্ছি, এই ভুলটা ভুলেও করবেন না। বসকে সারপ্রাইজ দেওয়া যেতে পারে তবে বউকে কখনো সারপ্রাইজ দেবার চেষ্টা করবেন না। এমন প্রাইজ দেবে, সন্দেহের ঠেলায় ঘরে ঢুকতে পারবেন না। তাই বলছি, যেমন আছেন তেমনই থাকুন।
আফসোস, আমি যে একজন বিখ্যাত মানুষ, এটা পৃথিবীকে না জানিয়েই মনে হয় চলে যেতে হবে।
দুই.
দু’চার জন মানুষ যে আমাকে চেনে না, ব্যাপারটা তেমন না। বাসার দারোয়ান হাসমত, ছুটা বুয়া গুল্লির মা, মোড়ের টং দোকানদার সদরুল, মাছ বাজারের বজলু মিয়া এরা আমাকে ভালোই চেনে। এরা অবশ্য চেনে, চিনতে হয় বলে। কিন্তু আমি চাই পরিচিত, অপরিচিত সবাই আমাকে এমনভাবে চিনুক, যাতে গর্বে বুক নায়ক সালমান খানের মতো ফুলে ওঠে।
এসব কথা সবাইকে বলা যায় না। যে গুটি কয়েকজনকে বলা যায়, তারা গুটিবাজিতে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। জোর করে বলতে চাইলে শোনেও না, গোণেও না। বলার জন্য কারো থাকে বেস্ট ফ্রেন্ড, কারো জাস্ট ফ্রেন্ড, কারো বা থাকে বাল্যকালের ক্লাস ফ্রেন্ড। আমার আছে গ্লাসফ্রেন্ড রাকিব।
অফিস থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যায় সদরুলের টং দোকানে দুই গ্লাসফ্রেন্ড বন্ধু বসি। এক গ্লাস চা, দুই গ্লাসে সমান ভাগে ভাগ করি। তারপর গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি করে চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবনার জগতে ডুব দেই। চা পান করতে করতে জাপান অব্দি চলে যাই। জাগতিক, ইহ জাগতিক কত কিছু নিয়েই না আমরা ভাবি।ৎ
রুনি খেপে আছে। আজ বাজার না নিয়ে বাসায় গেলে কুনি খেতে হবে। রুনির কুনির জোর মারাত্বক।
দু’জন একসাথে ভাবতে বসলেও দুজনের ভাবনার পরিনতি কিন্তু এক না। ও যা ভাবে, এখানে বসে উগরে দিয়ে থেমে যায়। আমি থামি না। সেই ভাবনা মাথায় করে বাসা অব্দি নিয়ে গিয়ে খাতা কলমে উগড়ে দিয়ে তারপর থামি।
আগে ডায়েরিতে লিখতাম, এখন ফেসবুকে লিখি। একজন তো প্রতিটা লেখার নীচে কমেন্ট করে, কোবি, কী লিখলেন, পড়ে টাসকি খেয়ে গেলাম। বই বের করছেন না কেন?
মাত্র একজন কমেন্ট করে? তোর কোনো লেখা কোনো পেপার পত্রিকায় ছাপা হয় না? রাকিব আপসেট হয়ে পড়ে এই পারফর্মেন্সে।
আরে বাবা, আমি তো প্রচুর লেখালিখি করি। আমার তরফ থেকে তো কোনো অবহেলা নেই। এখন পত্রিকা সম্পাদকদের যদি এইসব ঝাঁঝালো লেখা ছাপানোর সাহস না থাকে, সে দূর্বলতা তাদের। কে না জানে, এই দেশে যোগ্য লোকের যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় না। উদাহরণ দেখাতে বেশিদূর যেতে হবে না। আমার পোস্টের লাইক, কমেন্ট দেখলেই বোঝা যায়। যোগ্য বলেই তো আমার পোস্টে লাইক, কমেন্ট কম। কিন্তু তাই বলে তো থেমে থাকলে চলবে না। কত বড় সেলিব্রেটি লেখককে পাঠক যে চিনতে পারছে না, তা তো তাদের বোঝাতে হবে, কী বলিস?
রাকিব কিছু বলে না। দেখে মনে হচ্ছে, সেলিব্রেটি লেখককে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরবার ব্যাপারে ওর কোনো আগ্রহ নেই।
ওর না থাকতে পারে, আমার তো আছে। চা কারিগর সদরুল ভাইকে চা বানাতে বলে রাকিবের দিকে তাকাই। দোস্ত, আমি ঠিক করেছি, নিজের লেখালিখি নিজেই প্রকাশ করব। লেখা বই আকারে প্রকাশিতই যদি না হয়, প্রতিভা বিকশিত হবে কী করে?
জ্বলন্ত চুলার কেটলির দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাতে শুরু করে রাকিব। ছেলেটাকে এ জন্যই আমি খুব পছন্দ করি। কিছু বললে অন্যদের মতো হেসে উড়িয়ে দেয় না। মাথা দোলাতে দোলাতে ভাবে। দুই গ্লাসে ঠোকাঠুকি করে চা গিলতে গিলতে দু’জন আবার ভাবনার জগতে ডুব দেই।
মশার কামড়ে ভাবনার জগত থেকে এক সময় আমি ভেসে উঠলেও রাকিবকে দেখি ঢুলছে। ধাক্কা দিয়ে ওকে জাগানোর চেষ্টা করলাম, এত ঢুলছিস কেন?
রাকিব চোখ বন্ধ রেখেই বলে, আরে কই ঢুলছি?
ঢুলছিস না তো, চোখ খুলছিস না কেন? লেখালিখির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোর সাথে।
এ কথাতেও রাকিবের বন্ধ চোখ খোলে না। তবে মুখ খোলে। হাই তুলতে তুলতে বলে, গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা চোখ বন্ধ করেই ভাবতে হয় রে বন্ধু। আমাকে ডিস্টার্ব করিস না তো। তোর সেলিব্রেটি হবার ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছি।
রাকিবকে ডিস্টার্ব না করে উঠে পড়লাম। বাসায় যেতে হবে। তিনদিন হয় বাজার করিনি। রুনি খেপে আছে। আজ বাজার না নিয়ে বাসায় গেলে কুনি খেতে হবে। রুনির কুনির জোর মারাত্বক।
আফসোস, আমি যে একজন বিখ্যাত মানুষ, এটা পৃথিবীকে না জানিয়েই মনে হয় চলে যেতে হবে।
তিন.
বাজারে প্রতিটা জিনিসের দাম আগুন। ধরলেই হাতে ফোস্কা পড়ে। কিন্তু এসব কথা কে কাকে বোঝাবে? যখন চালের দাম বেড়ে গেল, বউকে বোঝালাম, ভাত খেয়ে পেটে চাপ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। শুধু শুধু ভুড়ি বাড়ে। তাছাড়া বিজ্ঞমহল থেকে নির্দেশ এসেছে, বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান। যখন আলুর দাম বেড়ে চালের দামের উপরে চলে গেল, সেদিনও বউকে বোঝালাম; বিজ্ঞমহল থেকে নির্দেশ এসেছে, বেশি করে ভাত খান, আলুর ওপর চাপ কমান। চাপ কমাতে গিয়ে এখন দুটোরই দাম বেড়ে গেছে। শুধু কী তাই? যে কোনো সবজির দাম শুনে মানিব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে কবজি বেঁকে যায়। মাছ, মাংস দূরের কথা, ডিম, শিম কিনতে হিমশিম খাবার জোগাড়।
শোনো, ভাবতে হলে ভালো কিছু করার কথা ভাবো। এরপরেও যদি বইয়ের চিন্তা মাথায় আনো, তাহলে এ ঘরে হয় তোমার বই থাকবে নইলে বউ।
তারপরও বাজার করতেই হয়। বাড়ি ফিরতেই হয়। বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে বললাম, রুনি শুনছ, একটা জিনিস ভাবছি।
-ওমা, তাই? ভেরি গুড। সময় হয়ে এসেছে। তুমি না ভাবলে কে ভাববে বলো?
-মানে কী? তুমি বুঝে গিয়েছ? কী করে বুঝলে!
-রুনি নামের মেয়েরা যে কত গুণী হয়, তা যদি বুঝতে তাহলে আর এ প্রশ্ন করতে না। তুমি হচ্ছো বিশ্ব ভাবুক গোষ্ঠির চেয়ারম্যান। সারাদিন কী সব ভাবো আর ডায়েরির পাতায় কাকের ডিম, বকের ডিম লিখো।
-ইয়ে মানে, শোনো না। নভেম্বর মাস শুরু হয়ে গেছে। সময় তো সত্যিই আর বেশি নেই। এরমধ্যে কি পারব?
-জানুয়ারি মাস আসতে এখনও দুই মাস আছে। না পারার কী আছে?
-কীসের দুই মাস? ডিসেম্বরে জমা দিতে হবে।
-জমা দিতে হবে, দিবে। বই রেডি আছে না?
-তা আছে। কিন্তু
-কিন্তু আবার কী? বই জমা দিয়ে ভিসার জন্য দাঁড়ালেই হয়।
-ভিসা?!
-ভিসার কথায় এত অবাক হবার কী আছে? ভিসা ছাড়া তোমাকে কোনো দেশে ঢুকতে দেবে?
-ভিসার কথা আসছে কোথা থেকে? তুমি কীসের কথা বলছ, বলোতো?
-ঘরে ফিরেই না বললে, একটা জিনিস ভাবছ।
-আমি তো জীবনের প্রথম বই লিখে বইমেলায় ঢোকার কথা ভাবছিলাম।
-আমি তো ভেবেছিলাম বউ এর কথা ভেবেছ বুঝি। জানুয়ারিতে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী, তাই পাসপোর্ট বই জমা দিয়ে ভিসা লাগানোর কথা ভাবছ।
-ইয়ে মানে, অনেকটা তাই তো ভাবছিলাম। বিবাহ বার্ষিকীর দিন জীবনের সবচেয়ে দামি উপহার হিসাবে বইটা তোমার হাতে তুলে দেব।
-শোনো, সংসার জীবন ফাজলামি, ইয়ার্কি করার জায়গা না। বিবাহ বার্ষিকীতে বউকে নিয়ে যেতে হয় থাইল্যান্ড কিংবা সিংগাপুরে। দারুণ দারুণ রোমান্টিক সব ছবি তুলে বউয়ের হাতে তুলে দিতে হয় এমন এক দামী উপহার, যা দেখে আশেপাশের বাসার ভাবিদের চোখ কপালে ওঠে। ভাবিদের জামাইয়ের তিনদিনের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ফেসবুক ভাই,ভাবিরা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
-বই কি সোনা-দানা, হিরা-জহরতের চেয়ে অমূল্য না?
-অবশ্যই অমূল্য। অমূল্য বলেই তো এই জামানায় কেউ বই কেনে না। ফাও নেয়।
-এসব কী বলো? জন্মদিনে, কোনো অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়ার জন্য হলেও তো বই কেনে মানুষ।
-বই কেউ কেনে নাকি? বই উপহার দেওয়া মানে, মার্কেটে না চলা নিজের লেখা বই। এমন উপহারের কাঁথায় আগুন। সের দরে ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করা অথবা চুলোয় দেওয়া ছাড়া আর কী কাজে লাগে শুনি?
-আর কোনো কাজে লাগে না?
-লাগে তো। মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুমি ডান হাতে বইয়ের গাট্টি আর বাম হাতে থালা নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছ। শোনো, ভাবতে হলে ভালো কিছু করার কথা ভাবো। এরপরেও যদি বইয়ের চিন্তা মাথায় আনো, তাহলে এ ঘরে হয় তোমার বই থাকবে নইলে বউ।
জল টলমল চোখ নিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। আফসোস, আমি যে একজন বিখ্যাত মানুষ, এটা পৃথিবীকে না জানিয়েই মনে হয় চলে যেতে হবে।