নীহারিকার জানালায় এক টুকরো আকাশ ধরে। লেখালেখির ফাঁকে-ফাঁকে আকাশ দেখা তার অভ্যেস। বাসার একটু সামনেই অনেকখানি জায়গায় একটা পার্ক। নামেই শুধু পার্ক। কাজেকর্মে ছিটেফোঁটা লক্ষণও নেই। গাছপালাগুলো বিবর্ণ। এলোমেলোভাবে গজিয়ে ওঠা ঘাস আর কিছু ঝোপঝাড় ছাড়া কিছু নেই। কাউকে বেড়াতে আসতেও দেখেনি কোনোদিন। রাত নামতেই হয়ে ওঠে মদ্যপানের আখড়া। আজেবাজে ছেলেদের আড্ডা হয়। আরও অনেক কিছু হয়! শোনা যায়, পার্কটার দখল নিয়ে নাকি প্রভাবশালী দুই পক্ষের মধ্যে গণ্ডগোল। এজন্য পার্কটির আর সত্যিকার অর্থে পার্ক হয়ে ওঠা হচ্ছে না।
দীর্ঘশ্বাস পড়ে নীহারিকার। কথায় কথায় কত সহজে সবাই বলি, আগে মানুষ হও। অথচ সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে না-পারার পেছনেও যে থাকে কত কত কারণ, কত কত না-বলা কথা।
শহুরে ব্যস্ততা আজ যেন একটু তাড়াতাড়ি ঝিমিয়ে গেছে। আড়মোড়া ভেঙে রাতের মেহমানরা নেমে গেছে রাস্তায়। সস্তা পাউডার আর লিপস্টিকে বেশ চটকদার লাগে তাদের। ভোর হতেই হয়তো পরনের অপর্যাপ্ত কাপড় টেনেটুনে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে ডাস্টবিনের ধারের কোনো ফুটপাতে।
কারা আসে এদের কাছে? যারাই আসুক, দু’পক্ষই লাভবান হয়। একপক্ষের দেহের ক্ষুধা মিটে, আরেকপক্ষের মিটে পেটের ক্ষুধা। খুব পরিস্কারভাবে না হলেও, দু’চারজনের অবয়ব চেনা আছে। ওরা এখানকার নিয়মিত বাসিন্দা। খদ্দের পেয়ে আড়ালে চলে যায়। গরিবের ওয়েস্টিন হোটেল পার্কের চিপাচাপা, ঝোপঝাড়। মানুষ বড় অদ্ভুত! যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন এই আদিমবৃত্তিও টিকে থাকবে।
শারীরিক চাহিদাকে অস্বীকার করার, লুকোচাপা করার প্রবণতা যতদিন থাকবে, ততদিন মিথ্যের আশ্রয় নিতেই থাকবে নারী-পুরুষ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নীহারিকার মা দশম শ্রেণীর ছাত্রী। নানা-নানির সে কী দুশ্চিন্তা সদ্য যুবতী মেয়েকে নিয়ে! প্রায় প্রতিদিন শুনতেন, মেয়েদের ওপর নির্যাতনের খবর, বিভৎসভাবে মেরে ফেলার খবর। প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল লুকিয়ে, পালিয়ে বাঁচার। একটু বড় হওয়ার পর সব বুঝেছে নীহারিকা। মায়ের যদি তখন কিছু হয়ে যেতো! কতবার কল্পনায় আজেবাজে চিন্তা করে ভীত হয়ে মা’কে স্পর্শ করেছে। জড়িয়ে ধরেছে। এসব বুঝতে খুব বেশি বড় হওয়া লাগে না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিকই জানান দিয়ে দেয়।
দশ বছর বয়সে নীহারিকার চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়া একটি ছেলে ওকে প্রেম নিবেদন করেছিল। নিয়মিত চিঠি দিতো ছেলেটি। স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে পাহাড়ি পথ পেরোতে হতো। একদিন একটু উঁচুমতো জায়গা পেরুতে সাহায্য করতে গিয়ে ছেলেটা পেছন থেকে ওর কোমর জাপটে ধরে। ভীষণ রেগে গিয়েছিল ও। শিহরিতও হয়েছিল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।
ছেলেটার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। বাসায় ফিরে সোজা গোসলে। প্রচণ্ড কাঁপুনি হচ্ছিল। বাচ্চা হওয়ার জন্য বড়রা যেসব করে, মনে হচ্ছিল তেমন একটা কিছু ঘটে গিয়েছে ওর জীবনে! কেমন যেন ভয় ভয়, ভালোলাগা। সে কী সারল্য! এখন ভাবলে হাসি পায়।
প্রতিটি মানুষই একেকটি আগ্নেয়গিরি। ছোটবেলায় সুপ্ত থাকে। স্পষ্ট মনে আছে জীবনে প্রথম চুমু খাওয়ার সেই মাসে পিরিয়ড মিস হয়েছিল নীহারিকার। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও তার ভয় হচ্ছিল, চুমু থেকে বাচ্চা হতে পারে কি না! অনেক নির্ঘুম রাত কেটেছে ভয়ে, আতঙ্কে।
বিয়ের পর, সেই প্রেমিক-স্বামীর পুরনো বিছানার তোশক উল্টাতেই পেয়েছিল প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটা চিঠি। একই মেয়ের লেখা। ধারাবাহিকতা ছিল। পোশাকের বর্ণনা ছিল। নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করার কথা ছিল। বিয়ের আগে লেখা নীহারিকার চিঠিগুলোও একসঙ্গেই রাখা ছিল। তবু অস্বীকার করলো স্বামী।
মেয়েটি একপাক্ষিকভাবে লিখেছে বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলো। মেয়ে হয়ে ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে যে, কোনোরকম রেসপন্স ছাড়া একটা মেয়ে একের পর এক এতগুলো চিঠি লিখতে পারে না। লাইব্রেরিতে দেখা করতে বলতে পারে না। নীহারিকার জন্য বিরাট এক ধাক্কা ছিল সেটা। যতটা না মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্কের জন্য, তারও চেয়ে বেশি স্বামীর মিথ্যের জন্য। তার ও মেয়ের চিঠির জায়গা একই ছিল, সেজন্য। সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। বুকের ভেতরের কষ্ট এতটা তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, প্রচণ্ড প্রবঞ্চিত মনে হচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কিছুই করার থাকে না প্রকৃতপক্ষে।
তবে একটা প্রতিশোধপরায়ণ ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছিল ঠিকই! সম্পর্কের ভেতর অনেককিছুই কিছুই না, আবার অনেক সামান্যকিছুও অনেকসময় অনেককিছু। নারী-পুরুষের সম্পর্কে সেক্সের কথা মাথায় আসবে সবার আগে। এটা স্বাভাবিক। এটাই সত্যি। বাকি সব মিথ্যা। ভণ্ডামি। আরোপিত।
গ্রামের বাড়িতে একবার এক ফুপুকে বড় বোনের স্বামীর সঙ্গে সেক্স করতে দেখে ফেলেছিল নীহারিকা। এগারো-বারো বছর বয়সে। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল অনেক্ষণ। কী হচ্ছিল প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি। শুধু বুঝেছিল, এটা ঠিক নয়। এটা অন্যায়। শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। এছাড়া আশেপাশের মুখরোচক দেবর-ভাবি, ভাসুরের সঙ্গে ছোটভাইয়ের বউদের রমরমা কাহিনি তো ছিলই। বিশেষ করে প্রবাসী স্বামীর বউদের নিয়ে। বড়দের আড্ডার এসব কথা কানে আসতো। ছোট হলেও অনেক কিছু বুঝতে পারতো।
নীহারিকা ওর ছেলে-পুতুল আর মেয়ে-পুতুলকে নিয়ে মজার খেলা খেলতো। নির্জন দুপুরে খাটের নিচে থাকা পুরনো জুতোর বাক্সে পেতেছিল ওর পুতুলের সংসার। অনেক সময় নিজের আঙুল নিয়েও খেলতো। ডান হাত ছেলে আর বাম হাত মেয়ে। তারপর, একটা সময় আর পুতুল না, নিজেকে নিয়েই খেলতো।
শারীরিক চাহিদাকে অস্বীকার করার, লুকোচাপা করার প্রবণতা যতদিন থাকবে, ততদিন মিথ্যের আশ্রয় নিতেই থাকবে নারী-পুরুষ। সারাজীবন সংসার করেও যেমন স্বামী বা স্ত্রী কখনো একে অন্যকে শেয়ার করতে পারে না যে, বিপরীত লিঙ্গের কাউকে দেখে ভালোলাগার অনুভূতি হয়েছে। কিংবা স্রেফ সেক্স করার ইচ্ছে জেগেছে। অথচ এমন ইচ্ছে অতি সত্য, চিরন্তন।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাগুলোও পরিবর্তিত হতে থাকে। যেসব সামান্য ব্যাপারে একসময় আকুল হওয়া, সেসব একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়। মনের ব্যাপারটা ঝাপসা হতে থাকে ক্রমশ। প্রাধান্য পেতে থাকে দৈহিক সম্পর্ক। শারীরিক নির্ভরশীলতা মানসিকভাবেও নির্ভরশীল করে তোলে একসময়।
কফির মগ হাতে বাইরে চোখ রাখে নীহারিকা। চাঁদ তার রূপের লটবহর নিয়ে উঠেছে আকাশে। জোৎস্নায় আলোকিত চারদিক। রঙচঙে, চটুল সাজের মেয়েটি খুব হাসছে। হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আজ সম্ভবত দামি খদ্দের পেয়েছে। দুটো ছায়াশরীর মিলিয়ে যেতে দেখলো অন্ধকারের আড়ালে।
হঠাৎ বিষণ্ন লাগে খুব। আজ বোধহয় আর গল্প লেখা হয়ে উঠবে না। সত্যি কথাগুলো যদি লেখা না হয়, লেখা না যায়, কী হবে বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখে?
জানালার পাশেই ওর লেখার টেবিল। দিনের একটা বড় সময় এখানে বসেই কাটে। সংসার ছেড়েছে আজ বেশ ক’বছর হলো। একা থাকতেই ভালোবাসে নীহারিকা। অভিনয় করে যাওয়া মেকি সংসার আর টানে না ওকে। এখন লেখালেখির সঙ্গেই জীবন-যাপন। গুড-সেক্সের মতোই আনন্দ পায় এতে। লেখার তাগিদ রয়েছে বেশ কয়েকটা। এগুতে পারছে না কিছুতেই।
কী লিখবে? গতানুগতিক প্রেমের গল্প? না কি ত্রিভূজ প্রেম? এসবের নাকি কাটতি বেশি। মেয়েরা লিখবে পুতুপুতু প্রেমের গল্প। তাদের লেখায় কখনো সেক্স আসবে না। থাকবে শুধু মানিয়ে নেওয়ার আর মেনে নেওয়ার গল্প। এমনটাই মেন্টাল সেটআপ অনেক পাঠকের। মেয়েরা কখনো লিখতে পারবে না, তাদের হাতে ধরা প্রথম উত্থিত লিঙ্গটি ছিল তাদেরই মামা, চাচা বা পরিবারের ঘনিষ্ঠ স্বজনদের। দারুণ হিপোক্র্যাসি!
গার্লস স্কুলে পড়েছে নীহারিকা। সেভেনে পড়ার সময় স্কুলমাঠের পেছন দিকটাতে বসে আড্ডা দিত ঘনিষ্ঠ কয়জন মিলে। অনেক সময় বেশ কিছু অদ্ভুত গল্প বেরিয়ে আসত সেই আড্ডা থেকে। পিংকি নামের একজন ছিল যাদের তিন রুমের বাসার একটি রুম ভাড়া দিতো, বাইরের লোকের জন্য। একেকসময় একেকজন আসতো। সঙ্গে থাকতো মেয়ে। সময় কাটানোর জন্য ঘণ্টা হিসেবে চার্জ নিতো। পিংকির বাবা রোড অ্যাক্সিডেন্টে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর অভাবের তাড়নায় এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল ওদের পরিবার। প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগলেও একটা সময় পিংকিও সাহায্য করতে লেগে গেলো। আগত অতিথিদের ঘর দেখিয়ে দিতো। টাকা গুনে মায়ের হাতে তুলে দিতো।
মিল্কি নামের একটি মেয়ে ছিল। সরকারি কলোনিতে থাকতো। দুই রুমের বাসা। এক রুমের বিছানায়, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট ভাই আর অন্য রুমে মিল্কি ঘুমাতো। আত্মীয়স্বজন এলে মিল্কির বিছানায় শেয়ার করতে হতো। ওর এক চাচা প্রায়ই আসতেন। ওর সঙ্গেই ঘুমাতে হতো মিল্কিকে। এইটুকু বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠেছিল মিল্কি। ওর চাচার আচরণের কথা বাবা-মাকে বলতে পারেনি কখনো। মন খারাপ করে সবাই শুনতো সেসব অভিজ্ঞতার কথা। একজনের কান্না অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হতো। সান্ত্বনা দিতো একে অন্যকে। কমবেশি সবার জীবনেই এমন ঘটনা থাকে। কেউ বলে, কেউ বলে না। এটুকুই শুধু তফাৎ।
হঠাৎ বিষণ্ন লাগে খুব। আজ বোধহয় আর গল্প লেখা হয়ে উঠবে না। সত্যি কথাগুলো যদি লেখা না হয়, লেখা না যায়, কী হবে বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখে?