আকাশটা ভেজা কাঁথার মতো ভারী ও পুরুষ্ট হচ্ছে। ক্রমে হালকা নীল আকাশটাকে কালো-সাদা-রুপালি মেঘের পরতে পরতে মোটা হচ্ছে। বৃষ্টি হতে পারে। আবার বাতাস যদি গতি বাড়িয়ে দেয় তাহলে মেঘের বাহাদুরি কোথায় পালাবে—তখন আবার বৃষ্টি! কিন্তু বাতাসের বেগ যা-ই থাকুক না কেন মাঝে মাঝে মেঘের পরত থেকে আলোর ঝিলিক মারে যা পলক ফেলার চেয়ে দ্রুত—একটু দেখিয়ে আবার সাদা-কালো-রুপালি মেঘের গভীরে লুকোয়। মেঘখ-গুলোর ছোটাছুটি যেন রূপের বাহার দেখানোর কসরত! কিছুক্ষণ এমন হেঁয়ালির পর আকাশটা ক্রমেই কাজলের মতো কালো হয়ে আসছে। যদি বৃষ্টি নামে তাহলে কী হবে? কলতলার পাশে দাঁড়িয়ে দুলি অঙ্ক কষে। অনেকক্ষণ আগে সে এক পাতিল পানি নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছিল এখনো সে কলের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। মাইল্যার মানুষ, অত মানুষ কইত্তে আইয়ে, পানির দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে চরম বিরক্ত হয়ে মনে মনে অভিশম্পাত দেয় দুলি। এক পাতিল পানির জন্য এত যন্ত্রণা কি আর সহ্য হয়? বৃষ্টির ভাবটা ক্রমে আরও ঘনিয়ে আসে। কালো মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়েছে। এবার নিশ্চিত হয় দুলি। বৃষ্টি নামবে। সামনের মানুষগুলো আস্তে আস্তে সরে পড়েছে। এবার দুলির ভাগ্যে জুটেছে এক পাতিল পানি।
পাতিলটি বস্তির একফালি ঘরের ভেতর রাখতে রাখতে দুলি বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, বাজান আইজ ভিকে যাইবা না? দুলির বাবা এবা কী যেন চিন্তা করছে। গতকাল কত টাকা পেয়েছে ভিক্ষে করে, আজ কি যাবে, কি যাবে না, সে বিষয়েই চিন্তা করছিল, তা ঠিক করে বলা মুশকিল। তার চোখ দু’টি নিষ্প্রভ ও নিরুত্তাপ। ঋজু হয়ে বসে আছে চকির ওপর। চকির ওপরে একটি কাঁথা। বেড়ায় ঠেস দেওয়া একটি তেল ছিটে বালিশ ও দড়িতে কয়েকটা কাপড় ঝুলছে। দুলি পাতিলটা মেঝেতে রেখে কপালের ওপর থেকে দড়িতে নাড়া লুঙ্গিটা সরিয়ে কাছে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, কী বাজান আইজ ভিকে যাইবা না? এবা এতক্ষণে তার কাটা পা দু’টি একটু নাড়িয়ে উত্তর দেয়, যদি মেঘ আইয়ে তয় গিয়া কি লাভ? ফতে কি মানুষ আইবো, ভিক দিবো কেডা? বলেই সে চোখ বন্ধ করে। আস্তে আস্তে জিগ্যেস করে, ঘরে খাওনের কিছু আছে নি রে দুলি? কাইলওতো মেঘে ভিইজ্যা দিন কাডাইলাম কয় ফয়সা ফাইলাম? তার চোখ দু’টি বড় হয়। ছোট্ট ঘরের পারপাশে চোখ বুলায়। একবার তার চোখ দু’টি স্থির হয় এবং নিবিষ্ট মনে বলে, তুই যা। দেখ কাগজটাগজ কিছু ফাসনি। তাই বেইচ্যা চাইল লিয়া আবি।
যা রাজপুত্তুরের লগে যা। সিংহাসনে বওয়াইয়্যা খাওয়াবো তরে। এবার বউ মেয়েটিকে রেখে চলে গেলো, আর ফিরে এলো না।
দুলির চুলগুলো রুক্ষ, শুকনো খড়ের মতো। লালচে চুলিগুলোতে একটা বেণী করে রেখেছে যা খরগোশের লেজের মতো খাড়া হয়ে আছে। আবার পনিটেইলও বলা যাবে না। শরীরে এখানে-সেখানে ময়লা জমে কালো দাগ পড়েছে। হয়তো মাস পাড় হয়ে গেছে গায়ে সাবান পড়েনি। আবার সাবান! একটু শরীর ভেজানোর জন্য এক বালতি পানির জন্যই তাকে এক ঘণ্টা কলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তার ওপর আবার সাবান ঘষবে কখন আর ধুইবে কখন? মনের ভেতরে জেদ উগড়ে আসে। যখন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন নর্দমার পচা ভুরভুর গন্ধের যন্ত্রণায় নাক বন্ধ করে থাকতে হয়। পেট গুলিযে উদগার ওঠে। প্রতিদিন এই গন্ধটা লাগলেও দুলির এখনো গা-সহা হয়ে ওঠেনি।
দুলির গায়ে একটা ছেঁড়া মলিন ফ্রক। এটি গতবার ঈদের সময় কেনা হয়েছিল। সেই ফ্রক থেকেও ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। ছোট মানুষ বলে ঘামের গন্ধটা কম হয়। সারাদিন বাবাকে একটা কাঠের গাড়িতে বসিয়ে সে অলিগলির রাস্তা তারপর বড় রাস্তায়ও যায় বেশি ভিক্ষার আশায়। কোনো দিন বেশ ভালোই টাকা পায় আবার কোনো দিন যা পায়, তা দিয়ে দিনের খাবারেই শেষ হয়ে যায়। বাবার কথায় ঘর থেকে একটা চটের বস্তা বগলদাবা করে বের হয়ে যায় দুলি। এবা আবার চোখ বন্ধ করে। যদি আকাশটা বেঘোরে ঢালতো—বেসামাল মেঘ যদি ভেঙে পড়তো এই বস্তির আশপাশে—এবা আচ্ছন্ন হয়ে ভাবে।
গতকাল সারাদিন দুলি তার গাড়িটাকে ঠেলেছে। মরার মাইনষের কইলজ্যায় একটু দয়াও নাই। আমার দুইডা ফাও নাই। দুধের বাইচ্যা গাড়িডা ঠেলে। মাগার মাইনসের জেবেত্তো ফইয়সা খসে না। দজ্জালের দেশ। পাষাণ মাইনসের শ’অর (শহর)। পরক্ষণেই এবা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে মানুষের পা দু’টি কত গুরুত্বপূর্ণ। যখন পা ছিল তখন কি মানুষের দয়ায় চলতো? পা দুইটা কাটা পড়ায় এখন সে ভিক্ষা করে। দুলির মাও একদিন তাকে ছেড়ে এক ভাতারকে নিয়ে কড়াইলের বস্তি থাকে। যাওয়ার সময় বলে গেল, ল্যাংড়ার সাতে বেগার খাটমো এমুন শখের মুখে জুতা মারি। দুই ফইসা কামাই করনের মুরাদ নাই আবার ঘরঅ বউ রাখনের শক। বউ কি বাতাস খাইয়া থাকবো? শালা তেইল্যা চোরার ঘরের তেইল্যা চোর।
প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়েছিল এবা, শুধু দুটি পা থাকলে হয়তো তাকে উচিত শিক্ষা দিতে পারতো। কিন্তু অপারগতায় দেয়াল তো আর মগজের ক্রোধ রোধ করতে পারে না। এবা রাগে রিরি করে বলেছিল, জুতা জীবনে দেখছোসনি রে মাগি? যা রাজপুত্তুরের লগে যা। সিংহাসনে বওয়াইয়্যা খাওয়াবো তরে। এবার বউ মেয়েটিকে রেখে চলে গেলো, আর ফিরে এলো না।
রাগে গজ গজ করতে থাকে…বিয়ার কইলমাও ফরলি না। থাহা শুরু করলি মাউগের লগে। আখেরাতে জওয়াব দিস…।
এবা বেড়ার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। মেঘখণ্ডগুলো পুঞ্জিভূত হয়। বাইরে এখন মেঘ-আঁধার।
রাশেদা বলে, ট্যাহা আছে কি না, কও। এবা বলে, দশ ট্যাহা আছে। তরে দিয়া দিমুনে। রাশেদা আর কোনো কথা বলে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাচার ওপর বসে একটি বিড়ি ধরায় আর ভাবে অতীত জীবনের কথা। এবা যখন সুস্থ ছিল তখন কালিবাড়ি থেকে ট্রেনে ওঠে ট্রেনের ড্রাইভাওে সঙ্গে যোগসাজসে তেল চুরি করত। এলাকার মানুষ তাকে তেল চোর হিসেবে চিনতো। চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামার জন্য এবার জুড়ি ছিল না।
মলুয়ার শানু আর এবা একসঙ্গে কাজ করতো। শানু একদিন আগেই চলে যেতো ভৈরব, সেখান থেকেই মালবাহী ট্রেনের খোঁজ নিয়ে আউটার সিগন্যালের পাশে ট্রেনের ইঞ্জিনে উঠে যেতো এবং ড্রাইভারের সঙ্গে দরদাম শেষ করে কালিবাড়িতে পৌঁছার মাইল খানেক আগে ছালার চটের বস্তার ভেতর পলিথিনের দুটি বস্তা ঢুকিয়ে তার মধ্যে ইঞ্জিনের ভেতরের প্রকোষ্ঠ থেকে তেল ভরে নিতো। টাকা বুঝে পাওয়ার পর কালিবাড়ির কাছাকাছি ড্রাইভার গাড়ির গতি কমায় এবং তখন এবা ও শানু বস্তাটি আস্তে করে নিচে ফেলে, বস্তাটি গড়িয়ে যেতে যেতে ফসলের জমিতে গিয়ে পড়ে। ওরা দুজনও চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামতো। তখন তার রোজগার ভালো ছিল। ভালোমন্দ খেতে পারতো। তেলের চালান যেদিন দিতো সেদিন খাসির মাংস আর মাছ কেনা হতোই। হায়! হেই দিন কই গ্যালো? হে খোদা! খুডি দুই ভাইঙ্গা দিলা! খাড়ানিরও জোগাড় নাই।
কাটা পায়ে হাত বুলায় এবা। মনে পড়ে সেদিনের কথা—ছালার চটটি গড়িয়ে যাচ্ছে রেল লাইনের ঢালু বেয়ে ধানের জমিনের দিকে। ইঞ্জিনের পাদানি থেকে সে পা বড়াল। তারপর কী? তারপর কী? মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে হাসপাতাল। ডেটলের গন্ধ। তারপর একদিন বুঝল পায়ের নিচের অংশ নেই। সে কিভাবে বেঁচে আছে, তাও সে ভেবে পায় না।
সেই থেকে ঘর ছাড়া, গ্রাম ছাড়া ঢাকার এই বস্তিতে থাকা। হায়রে পেট, তোর যন্ত্রণায় দেশগেরাম সব ছাড়ান লাগলো। হায়রে ঢাহার শঅর! তাবৎ দুন্নিয়ার মানুষ আইয়া ভিড়লো এইহানে?
বস্তির চারপাশেই বড় বড় দালানবাড়ি। সাদা বাড়িগুলোর দেয়ালে যখন আলো এসে আছড়ে পড়ে তখন কিছুটা অকৃপণভাবেই এবার ঘরটাতে প্রতিফলিত হয়। এতে বস্তির ঘন অন্ধকার আবছা ধূসর হয়ে গড়াগড়ি খায়। রাতেও মাঝে মাঝে জোছনার আলো যখন প্রতিফলিত হয় তখন এবার ঘরে কিছুটা জোছনা আসে। তখন এবার গান গাইতে ইচ্ছে করে। গুনগুন করে গান গায়। গ্রামের পালা গান কিংবা সিনেমার গান। তার পা দু’টি গেছে বলে কী হবে, মনের রোশনাই ভাবটা তো আর মরে যায়নি। এই গুনগুন গান শুনে পাশের বস্তিঘরের রাশেদা মাঝে মাঝে উঁকি মারে। কার মনে এত আউশ, গান দরে গো। এবা তখন হাসে, ফাও নাই দেইক্যা কি আউশও নাই? তখন এবা বিরক্ত না খুশি হয়ে বলে তা বোঝা দুর্জ্ঞেয়। বলে, মনের আউশ তো আর মরে নাই কা। মন আছে না গো?
রাশেদা আবার ফোরন কাটে, একলা একলা এত আউশ কইর্যাা কি অইবো? হি হি হি। এবা তার হাসির কারণ বুঝতে পারে না। সে কি তার কাটা পার দিকে চেয়ে বিদ্রূপ করে? না কি তার মনেও অন্য কিছু আছে? এ নিয়েও তার চিন্তার অন্ত নেই। কোমড়টা টেনে গলাটা বাড়িয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে রাশেদার স্থূল নিতম্ব, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে সরু রাস্তাটি ধরে হাঁটে। পিঠের ওপর একরাশ কালো চুলের বুনো সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে সে কোথায় যায় কে-ই-বা জানে। এবাকে দৃষ্টিসীমায় আসার জন্যই রাশেদার অর্থহীন হাঁটাহাঁটি।
একদিন দুলি কাগজ কুড়াতে গেছে। এবার শরীরটা ভালো ছিল না, গায়ে জ্বর ভাব ছিল। তাই সোয়ার করতে যেতে পারেনি। সেদিন রাশেদা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করেছির, আইজ সোয়ারে যাও নাই ক্যানে? ট্যাকা মনে বেশি অইছে?
—ট্যাকা কম কি বেশি তয় মাগি তর কী?
—দেকো নুলা অইয়্যা মুখ খরাপ করবা না কইল্লাম। আমারে মাগি কইবা না। মাগি ডাহনের খাইশ মিডাইয়া দিমু কইল্লাম।
এবা দমে যায়। কিন্তু মনের ভেতর একটা আগুনের দলা কুণ্ডুলী পাকিয়ে সেটি এমনভাবে বের হতে যাচ্ছে যেন রাশেদাকে পুড়িয়ে মারবে। সে ডাকে, আয়, ঘরে আয়। ট্যাকা বেশি কি কম দেইক্যা যা। রাশেদা ঘরে ঢুকে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কয় ট্যাকার মালিক তুমি? বেশি ট্যাকা থাকলে তো তোমার বউ গেছে গা ক্যান?
এবা হাসে। তার হাসিটি রাশেদার ভালো লাগে। মুখে সাদাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গোঁফ যেন বাঘের গোঁফ। এককালে শরীরে তেজ ছিল তা এখনো বোঝা যায়। এবাও জানে তার শরীরের কী পরিমাণ তেজ ছিল। পা দুটি না থাকায় সে এখন শ্রাবণের স্রোতহীন মরা নদী।
এবার ঘরটিতে সব সময়ই নর্দমার গন্ধ পাওয়া যায়। রোজগার থাকলে সে ঘরটি বদলাতো এমন মাঝে মাঝে ভাবে কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। রাশেদা ঘরে এসে এবার কাছে বসে। এবার রাশেদার শরীরে হাত দেয়। রাশেদা বলে, ট্যাহা আছে কি না, কও। এবা বলে, দশ ট্যাহা আছে। তরে দিয়া দিমুনে। রাশেদা আর কোনো কথা বলে না।
দুলি সেদিন কাগজ কুড়িয়ে পাঁচ টাকা পেয়েছিল। বস্তির ঘরটিতে এসে তার বাবাকে বলেছিল, পাঁচ ট্যাহা ফাইলাম বাজান। ঘরঅ দশ ট্যাহা আছে না, বাজান? এই পনরঅ ট্যাহা দিয়া চাউল-ডাউল লইয়্যা আই।
এবার মনের ভেতরে যেন কুঠারাঘাত পড়ে। সে তো দশ টাকা রাশেদাকে দিয়ে দিয়েছে। এখন সে দশ টাকা কোথায় পাবে? এবা বললো, পাঁচ ট্যাহা দেয়া আডা লইয়্যা আয়। চাইর ট্যাহার আডা আর এক ট্যাহার গুড়। তাইলেই অইবো। যা লইয়া আয়।
কিন্তু তবু তো নিজের ঘরে ফিরতেই হবে। দুলি গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বকের মতো পা তুলে হাঁটে এবং মাঝে মাঝে মুখ ভর্তি থুথু ফেলে।
দুলি বলে, ক্যান বাবা? দশ ট্যাহা তো ঘরে আছে, তো আডা ক্যান? সারা দিন কাগজ টুকাইয়্যা কি ক্ষিধা লাগে নাই? আডা খাইয়্যা ভুখ মিটবো?
এবার মন খারাপ হয়। সে জানতো না যে তার মেয়ে এই দশ টাকার খবর রাখে। অগত্যা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে মেয়েকে ধমক দিয়ে বললো, যা কইলাম তাই কর। ফহিন্নির বাচ্চা ফহিন্নি। অত ক্ষিধা লাগে তো রাজ কইন্যা অইতে ফারলি না? যেডা কইলাম হেইডা কর। দশ ট্যাহা থাকুক। কত বিপদআপদ আছে।
বাবার এ-রকম রুক্ষ মেজাজ দেখে দুলি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বাবার কথা মতোই আটা আর গুড় নিয়ে ঘরে ফিরে।
আজও সেই রকম একটা দিন। এবা রাশেদাকে ডাক দেয়। কিন্তু রাশেদা কোনো শব্দ করে না। এবা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ার ফাঁক থেকে তার কাপড়ের খতিটা বের করে। ভাংতি পয়সাগুলো গুনে। টাকাগুলো গুনে। আজও দশ টাকা আছে। এবা ঘর থেকে বের হয়। রাশেদাকে ডাকে। ও রাশেদা। রাশেদা বৃষ্টির ভাব দেখে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছিল। এবার ডাক শোনে জেগে ওঠে। রাশেদা জিজ্ঞেস করল, চিল্লাউ ক্যান? কী অইছে? এবা বলে, আয়, ঘরে আয়।
রাশেদা ঘরে এসে চকির ওপর বসে। এবা তার শরীরে হাত রাখে। রাশেদা বললো, ট্যাহা আছেনি আগে কও। এবা তার হাতের মুঠিতে রাখা টাকাগুলো দেখায়। রাশেদা বললো, দশ ট্যাহার কমে কিন্তু অইবো না। এবা বলল, দশ ট্যাহই আছে।
কালো মেঘের টুকরোগুলোও এখন দলা পাকাচ্ছে। রুপালি মেঘের টুকরোগুলোও যেন কোত্থেকে ভেসে এসে একসঙ্গে দলা পাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করছে। বাতাস স্থির হয়। মেঘেরা আকাশে আর আটকে থাকতে পারেনি। মাটি স্পর্শ করাটাই তাদের এখন জরুরি কাজ। ঝমাঝম বৃষ্টি শুরু হয়। বড় বড় ফোঁটায় রাস্তাঘাট সব যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পিচঢালা সড়কগুলোয় পানি জমেছে। রিকশা, গাড়ি স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। এগুবার উপায় নেই। কোনো কোনো গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক রাস্তায় কোমর পানি জমেছে।
এবা এখন দুলির কথা ভাবছে। মেয়েটা যে গেলো কাগজ টুকাইতে মেঘের লাইগ্যা কাগজ ফাইবো না। সে ঘরের দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়। না, বৃষ্টি আজ বড়ই নিষ্ঠুর। এবার ঘরে যে টাকাটা ছিল সেটাও রাশেদাকে দিয়ে দিয়েছে। এখন কী হবে? দুপুর, তারপর রাত কী খাবে? দুলি যখন টাকা চাইবে, তখন এবা তাকে কী বলবে? এইসব ভাবনার মধ্যে এক সময় এবা ঘুমিয়ে পড়ে। বৃষ্টির হিম আর শরীরের ক্লান্তি এক হয়ে এক অচেতন ঘুমে সে বিভোর হয়ে পড়ে। বৃষ্টির ছাঁটে বেড়ায় হেলান দেয়া বালিশটা ভিজে যায়। বেড়ার কাছে রাখা কাপড়গুলোও ভিজে যায়। কিন্তু এবার সে দিকে খেয়াল নেই। তার চোখে রাজঘুম। সে ঘুমে বিভোর হয়ে পড়ে।
বৃষ্টি থামে বিকেলে। এত বৃষ্টি হয়েছে যে আবহাওয়া অফিসের লোকদের পুরনো রেকর্ড খতিয়ে দেখতে হচ্ছে যে নতুন রেকর্ড হয়েছে কি না। রাস্তায় রাস্তায় পানি জমেছে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি। দুলি কয়েকটি শিশুর সঙ্গে জলখেলায় মেতে ওঠে। জল ছিঁটিয়ে হাঁটতে বেশ লাগছে। এমন জলে ডোবা শহর কি আর সব সময় পাওয়া যায়। ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যায়।
দুলির এক সময় মনে হয় আজকে একটি টাকাও জোগাড় করতে পারেনি। ঘরে কিছু টাকা আছে। তার বাবাকে যখন মানুষ টাকা ভিক্ষা দেয় তখন সে মনে মনে হিসাব করে। সে হিসাব বুঝেও। দুলির পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দুপুরেও কিছু খাওয়া হয়নি। কখন যে বিকেল হয়ে গেল তাও বৃষ্টির জন্য টের পায়নি। দুলি এবার ছুটতে ছুটতে বস্তির দিকে এগিয়ে আসে। বস্তিতে ওঠার রাস্তাটি পানির নিচে। পানিতে মানুষের মল ভেসে বেড়াচ্ছে। আরও কত নোংরা আবর্জনা, কালচে রঙের পানিতে শরীর কেমন যেন ঘিনঘিন করে। কিন্তু তবু তো নিজের ঘরে ফিরতেই হবে। দুলি গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বকের মতো পা তুলে হাঁটে এবং মাঝে মাঝে মুখ ভর্তি থুথু ফেলে।
এবার চোখে ঘুম না এলেও তার বুকের ভেতর ঝাঁক ঝাঁক বসন্তের কোকিল অবিশ্রাম গান গেয়ে যাচ্ছে। এই গানের রাগে জীবনের মাদকতায় ভরপুর।
ঘরে এসে দুলি দেখে বাবা নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। একবার ডাক দিলো, উঠলো না। তারপর আবার গায়ে হাত দিয়ে ডাক দিলো, ও বাজান। গুমাইয়্যা দিন কাডাইল্যা। খাওন-দাওন লাগবো না?
এবা ওঠে। স্থির হয়ে বসে। কিছু ফাইছোস?
—না, কিছু ফাই নাই, দুলি জবাব দেয়। মেঘের ফানিতে সব ভাইস্যা গেছে বাজান। কত্ত ফানি, ফানি আর ফানি।
—তয় হাইঞ্জ্যা তো অইলো। দুফুরে কিছু খাইছোসনি?
—না, খাওন ফাইবো কই? ভাত কি আমার লাইগ্যা মানইসে লাইড়্যা থইছে?
—তো অহন?
—ঘরো কয়ডা ট্যাহা আছে না? দেও চাউল লইয়্যা আই।
এবা ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। তার চোখ বাঘের চোখের মতো জ্বলে ওঠে। এই চোখে কোনো দয়ামায়া নেই। বুকের ভেতর কোনো দরদ অনুভূতি নেই। সে যে টাকাটা খরচ করে ফেলেছে তাতে তার কোনো আক্ষেপও নেই। সে বললো, ঘরে কোনো ট্যাহা ফইস্যা নাই। চুপ থাক বেতাছির হারামজাদির ঘরের হারামজাদি। সারা দিন টেল্লা মাইর্যান আইছস, চাইট্যা চাইল আনতে ফারলি না? কই আছিলে? হুঁ, কই আছিলে? কী করছিলি সারা দিন?
দুলির বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পায় না। এমন বাঘের মতো ক্ষিপ্র হয়ে উঠবে তাও বুঝতে পারেনি। বৃষ্টির পানিতে অন্য শিশুদের সঙ্গে সে খেলতে খেলতেই কখন বেলা শেষ হয়ে গেলো তার সে খেয়াল ছিল না। এটিই তার কাছে অপরাধ মনে হয়েছে। বৃষ্টির দিন কাগজই বা কোথায় পেতো? সবই তো ভিজে গেছে। কিন্তু এই ভাবনার চেয়ে বড় ভাবনা তার মধ্যে দেখা দিয়েছে সে অনেকক্ষণ খেলেছে। যদি না খেলত তাহলে হয়তো চাউলের একটা ব্যবস্থা হতো। দুলি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বাবার কাঠের গাড়িটির কাছে। চোখে-মুখে বিতৃষ্ণার কালো ছাপ। সারাদিন না খাওয়াতে শরীরটা কেমন যেন ভেঙে যাচ্ছে। পেটের খিদেটা গোক্ষুর সাপের মতো ছোবল মারছে বারবার। বুক ভাসিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে কাঁদতেও পারছে না। তার বুকের ভেতর ভয় ও শঙ্কা—কেন সে সারা বেলা খেলে কাটিয়েছে।
সন্ধ্যা নেমে আসে। বাবার পাশে শুয়ে পড়ে দুলি। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ে, বুঝতে পারেনি।
খিদের যন্ত্রণায় এবার চোখে ঘুম আসছে না। তার যে উপায় নেই। যে দশটা টাকা ছিল সে টাকাগুলো তো রাশেদা নিয়ে গেছে। এখন তার কাছে চাইলেও পাওয়া যাবে না। এবার চোখে ঘুম না এলেও তার বুকের ভেতর ঝাঁক ঝাঁক বসন্তের কোকিল অবিশ্রাম গান গেয়ে যাচ্ছে। এই গানের রাগে জীবনের মাদকতায় ভরপুর।